#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৩৮(অন্তিম)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ফাতেমার জীবন থেকে আরো একটা রাত চলে গেল। আজকের নতুন প্রভাত তার জীবনে যেন নিয়ে এলো নতুন সূর্যদয়ের পাশাপাশি নতুন অনেক আলেখ্য হিসাব নিকাশ। আজ তাকে হয় এসপার নাহয় ওসপার করতে হবে। নুহাশ তাকে কথা দিয়েছে আজ তাকে এক ঘন্টা সময় দেবে। এই এক ঘন্টার মাঝেই তাকে যা করার করতে হবে।
যথাসময়ে নুহাশ আসে ফাতেমার কাছে। ফাতেমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। কাছে এসে তার হাত-পায়ের বাঁধন আলগা করে দেয়। অতঃপর বলে ওঠে,
“তোমার এক ঘন্টার কাউন্টডাউন শুরু হলো। এই কথা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানে না। সবাই ভাবছে তুমি এখানে বন্দি হয়ে আছ। এখন যাও এই এক ঘন্টার মধ্যে যা করতে পারো করো।”
ফাতেমা অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। অনেক দিন থেকে বন্দি থাকায় তার শরীরে শক্তি বলতে কিছু ছিল না। নুহাশ বলে,
“তোমার রুমের আশেপাশে কোন পাহারাদার নেই। তবে এখান থেকে কয়েক মিটার দূরেই কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা তোমাকে কোন কিছু করতে আটকাবে না। যাও যা করার করে নাও।”
ফাতেমা আস্তে ধীরে হেটে বাইরে আসে। বাইরে এসেই সে হতবাক হয়ে যায়। বাইরে অনেক অস্ত্র সাজিয়ে রাখা। এসব কি তার জন্যই সাজিয়ে রাখা? ফাতেমা বুঝে উঠতে পারে না। নুহাশ চাইছে টা কি? ফাতেমা হাতে তুলে নেয় একটা রামদা। একটা বন্দুকও কোমড়ে গুজে লুকিয়ে রাখে। অতঃপর এগিয়ে চলে সামনের দিকে। কিছু দূরে যেতেই শুনতে পায় একটা রুম থেকে একটা মেয়ের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। গলাটা চেনা তার। এই ক’দিন অসংখ্যবার এই কন্ঠ সে শুনেছে। এটা নেহার কন্ঠস্বর। ফাতেমার মাথায় রাগ চেপে বসলো। এই মেয়েটা নারী জাতির কলংক। কত জঘন্য কাজে জড়িত ছিল। ছোট্ট নিহাকে ম*রতে দেখেও চুপ ছিল। ফাতেমা প্রবল ভয়ংকর রূপে এগিয়ে যাচ্ছিল। হাওয়ায় তার চুল উড়ছিল। ফাতেমা সেই রুমে প্রবেশ করে দেখে নেহা কারো সাথে হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে। নেহা আস্তে আস্তে নেহার কাছে যায়। নেহার ঘাড় ধরে সামনে ঘোরায়, নেহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতে কোপ বসায়। নেহার একটা হাত বিছিন্ন হয়ে যায়। চারিদিকে রক্তের বন্যা বইয়ে যায়। রুমটা সাউন্ড প্রুফ হওয়ায় কেউ এগিয়ে আসে না,কারণ কারো কানে শব্দই পৌঁছায় না। ফাতেমা নেহার চুলের মুঠি ধরে বলে,
“অনেক অন্যায় করেছিস তুই এবার তার শাস্তি পাবি। নিজে মেয়ে হয়ে অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছিস, তাদের আর্তনাদ শুনেও চুপ ছিলি আর আজ তোর আর্তনাদ শোনার মতোও কেউ নেই।”
বলেই পরপর কয়েকবার রামদা দিয়ে চো*ট মা*রতে থাকে। নেহার প্রাণবায়ু বেড়িয়ে যায়। মেঝেতে পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। ফাতেমা তৃপ্তির হাসি হাসে।
অতঃপর এগিয়ে যেতে থাকে সামনে। একটু সামনে গিয়ে দেখতে পায় নাঈম কিছু দলবল নিয়ে এগিয়ে আসছে। ফাতেমা কোমড়ের গুজে রাখা বন্দুকটা বের করে। ছোটবেলা থেকে তার নিশানা অনেক ভালো। মাস্তুল দিয়ে কত লক্ষ ভেদ করেছে। বাবার কাছেও অল্পসল্প বন্দুক চালানো শিখেছে সেল্ফ ডিফেন্সের জন্য। কিন্তু আজ বন্দুক হাতে ধরতেই তার হাত ভীষণ কাপছে। কাপা কাপা হাতে বন্দুক তুলে নিয়ে সে নাঈমকে ঘিরে রাখা ৫-৬ জন সঙ্গীসাথীর মাথায় নিশানা করে গুলি চালায়। ফলাফল তাদের সকলেরই স্পট ডেট। নাঈম হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফাতেমার দিকে। রেগে বলে ওঠে,
“শালী৷ তোকে তো আমি..”
বলেই এগিয়ে আসতে নিতেই ফাতেমা নাঈমের পা লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ফলস্বরূপ সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ফাতেমা নাঈমের কাছে এগিয়ে যায়। রামদা বের করে নাঈমের হাত সামনে ধরে হাতের প্রত্যেকটা আঙুল কুচি কুচি করে কা*টতে থাকে। নাঈমের চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যায়। কিন্তু ফাতেমা এসবে আনন্দ পায়। এই অমানুষটা না জানি কত মেয়ের কষ্টের কারণ। নিহার মতো ছোট্ট প্রাণও যার আক্রোশ থেকে মুক্তি পায়নি। এর পরিণতি এমনই হওয়া উচিৎ।
নাঈমের হাত পা সব কে’টে টুকরো টুকরো করে ফাতেমা। আর নাঈম আর্তনাদ করতে থাকে অসহায়ের মতো। অতঃপর ফাতেমা নাঈমের কাটা স্থানে লবণ ছিটিয়ে দেয়। যা নাঈমের জ্বালা আরো বাড়িয়ে দেয়। তবে ফাতেমা শুধু এসব করেই ক্ষান্ত হয়না। মদ পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে এনে ঢেলে দেয় নাঈমের গালে। মদে এলকোহল থাকে যা দাহ্য পদার্থ। তাই মদ ঢালার পর দিয়াশলাই এর মাধ্যমে আগুন জ্বালিয়ে দেয় নাঈমের গালে। নাঈম ছটফট করতে করতে জ্বলে পুড়ে ছাই হতে থাকে। আর ফাতেমা হাসতে থাকে। নাঈমের মতো একটা নরপিশাচকে নিজের হাতে শেষ করতে পেরে সে আজ ভীষণ খুশি।
নাঈমের মৃত্যুতে ফাতেমার সমস্ত খুশি এক নিমেষে বদলে যায় যখন নুহাশ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নুহাশ এসেই বলে,
“তুমি সত্যিই একজন অতুলনীয়া নারী ফাতেমা। তুমি আজ প্রমাণ কথা দিলে যে তুমি সাধারণ কেউ নয়, ইতিহাস তোমায় আজীবন মনে রাখবে। তোমাকে দেয়া এক ঘন্টা সময়ের আর মাত্র ২ মিনিট বাকি। এরমধ্যে আমাকে শেষ করে দাও।”
নুহাশের মুখে এমন কথা শুনে ফাতেমা নীরব হয়ে যায়। তার চারপাশের সময় যেন থেমে যায়। হাজার হোক, এই লোকটার সাথে সে কয়েক মাস সংসার করেছে, মনের অজান্তেই তার প্রতি মায়া তৈরি হয়েছে এখন যতোই তার সত্যিটা সামনে আসুক না কেন, তাকে মে*রে ফেলা এতটা সহজ হবে না ফাতেমার জন্য। নেহা, নাঈমকে মারার সময় তার মনে যতটা শক্তি ছিল সেটা এখন আর নেই। ফাতেমার হাত রীতিমতো কাপছে। নুহাশ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে ওঠে,
“আমার প্রতি মায়া করো না। আমি তোমার মা-বাবার খুনি, তোমাকে বোনের খুনি, আজ যদি তুমি আমায় মে*রে না ফেলো তাহলে তোমাকেও শেষ করতে দুবার ভাববো না…তাই আমার মত বদল হওয়ার আগেই শেষ করে দাও আমায়। তোমার হাতেই ধ্বংস করে দাও আমার পাপের সাম্রাজ্য।”
ফাতেমা কাপা কাপা হাতে রামদাটা নিয়ে এগিয়ে যায় নুহাশের দিকে। কিন্তু কিছুতেই আঘাত করতে পারে না তাকে। নুহাশ হঠাৎ করেই ফাতেমার হাত টেনে নিয়ে নিজের ঘাড়ে চোট বসিয়ে দেয়। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নুহাশ। ফাতেমাও বসে পড়ে নুহাশের পাশে। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“এ আপনি কি করলেন নুহাশ?”
“এটা হবারই ছিল ফাতেমা। একদিন না একদিন এই পাপের ইতি টানতেই হতো। জানো, যখন প্রথমে নাহিদ মির্জা আমায় এই পাপে যুক্ত করতে চেয়েছিল আমি এসব করতে চাই নি কিন্তু সে আমার উপর অমানবিক অত্যাচার করত। টানা দুই দিন আমায় খেতে দেয়নি। ছোট্ট আমি এসব নিতে পারিনি। এক ফোটা পানির লোভে সেই প্রথম উনি আমার দ্বারা একটা নিষ্পাপ মেয়েকে হত্যা করিয়েছিলেন। সেই মেয়েটা হত্যার বিনিময়ে আমি পানি খেতে পেরেছিলাম৷ এরপর থেকেই আমার মাথায় অপরাধের নেশা চেপে যায়…কিন্তু এর শেষ হওয়ারই ছিল। আর সেই শেষটা আমাকেই করতে হতো। তাই তো আমি তোমাকে বেছে নিলাম নিজের এই পাপের সাম্রাজ্য ধ্বংসের জন্য।”
ফাতেমা অনবরত কাঁদতে থাকে। নুহাশ রক্তমাখা হাতে ফাতেমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“তোমার মতো অতুলনীয়া একজন নারীর আমার মতো পাপীষ্ঠের জন্য কান্না মানায় না ফাতেমা। তুমি নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিও।”
ফাতেমার কি হয় সে বুঝে উঠতে পারে না। নুহাশকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আর বলে,
“আপনি কেন ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলেন? কেন আপনি সত্যি ভালো মানুষ হলেন না? তাহলে আমাদের একটা সুন্দর সংসার হতে পারত। আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি একটা সুন্দর মনের অধিকারী ছিলেন যেই মন আবার বাবা নষ্ট করে দিয়েছে। আচ্ছা তওবা করলে তো আল্লাহ সব অপরাধ ক্ষমা করে দেন…আপনি কেন সময় থাকতে শুধরে গেলেন না?”
নুহাশ আর কিছু বলে না। ফাতেমা বুঝতে পারে নুহাশ আর নেই। নুহাশের নিস্তেজ, অসাড় দেহের দিকে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল ব্যয় করতে থাকে ফাতেমা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজের মায়ের ডায়েরি পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ফারিয়া। ছোট্ট ফারিয়া এখন অনেক বড় হয়েছে। এখন সে ২২ বছরের যুবতী। মেডিকেল কলেযে পড়াশোনা করছে। মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার লেখা ডায়েরিটা পড়লো ফারিয়া। ছোটবেলা থেকে মায়ের উপর তার অনেক অভিমান ছিল। যে তার মা কেন তাকে তার মামা-মামীর কাছে রেখে বিদেশ চলে গেলো। কিন্তু আজ ফারিয়া বুঝতে পারছে তার মা বিদেশে নয় জেলে ছিল। আর সেখান থেকে ফিরে বাকি সময় কাটিয়েছেন আশ্রমে। মৃত্যুর আগ অব্দি দেখা পর্যন্ত করেন নি ফারিয়ার সাথে। তার মৃত্যুর পর ঐ আশ্রমেরই এক মহিলা ফারিয়ার হাতে এই ডায়েরি তুলে দেয়। ফারিয়া এতদিন অভিমানে ডায়েরিটা পড়ে নি। কিন্তু আজ মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ডায়েরিটা পড়ল। আর বুঝতে পারল মাকে নিয়ে তার ধারণা কতটা ভুল ছিল। তার মাকে আজীবন কতটা মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে অথচ তিনি ফারিয়ার গায়ে তার আঁচ লাগতে দেন নি। ফারিয়া একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি সত্যিই একজন অতুলনীয়া নারী ছিলে মা, আমার জন্য দোয়া করিও যেন আমিও তোমার মতো অতুলনীয়া হয়ে উঠতে পারি।”
সমাপ্ত ✨