অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-১৬

0
422

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য

কামরুন নাহার মিশু

১৬)
সীমাকে দেখেই লায়লা খালা প্রচন্ড বিরক্ত হলেন।

” কী ব্যাপার! কোথায় ছিলি? ”

মৃদু হেসে সীমা উত্তর দিল,

” একটা কাজ ছিল খালা।”

” সেটা তো বুঝতে পারছি। কিন্তু কী কাজ যে তোকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাহিরে থাকতে হলো।”

” খালা আমাকে নিয়ে তুমি কী চিন্তা করছ! আমি বেশ বড় একজন মানুষ। মহিলা বলতে পার।”

” সে জন্যই তো চিন্তা হয়।”

” চলে এলাম তো! এবার চিন্তা বন্ধ করো।”

” জানিস তোর মা ছিল আমার চাচাতো বোন। সম্পর্কে চাচাতো বোন হলেও সে ছিল আমার বান্ধবী। আমার নিজের কোনো বোন না থাকায় আমি তাকে আপন বোনের মতো ভালোবাসতাম।”

” জানি তো খালা সব।”

” তোর মা থাকলে চিন্তা করত না তোর জন্য বল? ”

” মনে হয় না খালা! মা নেই তো কি হয়েছে? ভাই নেই? বোন নেই? কই কেউতো আমাকে নিয়ে চিন্তা করে না।”

” সুমন আর রুমন আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর আমি আফসারকে বলেছি তোকে আমার কাছে দিয়ে যেতে। হয়তো আপন খালা নয় দেখে ভরসা করতে পারেনি। দীর্ঘসময় যোগাযোগ নেই, আমিও দেশে ছিলাম না। ভেবেছি হয়তো এতদিনে তোর বিয়ে দিয়েছে। কী মনে করে তুই কোনো যোগাযোগ না করে হঠাৎ আসলি! থাকছিস কয়েকদিন থেকে। থাক যতদিন ইচ্ছে। আমার আপত্তি নেই। তবে হুটহাট এভাবে বের হবি না।”

” আর বের হওয়ার দরকারও হবে না। তবে খালা আমি আর বেশিদিন থাকব না, চলে যাব।”

” কেন? বাড়ি গিয়ে কী করবি? আফসারের বউটাও কেমন যেন? থাক আমার এখানে। ভালোই তো লাগছে। খালা, বোনজি গল্প করে সময় পার করছি।”

” বাড়ি যাব তো বলিনি। ”

” কোথায় যাবি?”

“জানি না। আমার তো কোনো বাড়ি নেই। ছিলাম রীমার কাছে। ছিলাম ভাইজানের কাছে। আছি তোমার কাছে।”

” দাঁড়া, আফসারের সাথে কথা বলে তোর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করব”

” না খালা। সবার কপালে বিয়ে জুটে না।”

” কী বোকার মতো কথা বলিস! তোর বয়সী অসংখ্য মেয়ে এদেশে অবিবাহিত আছে।”

” খালা আমি পনেরো বছর আগে স্বামী পরিত্যক্তা এক অপয়া নারী।”

” আচ্ছা ভালো কথা। রীমার জামাইটা কেমনরে?”

সীমা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

” জানি না!”

রীমার বর কেমন সেটা সীমা না জানাতে চাইলেও আমরা বেশ ভালো করেই জানি। যে রাতের পর রাত স্ত্রীর বড় বোনের সাথে নোংরামি করার জন্য সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে অজ্ঞানের মতো করে ফেলে রেখেছে।
যে দিনের পর দিন স্ত্রীর সাথে ভালো স্বামী হওয়ার মিথ্যা অভিনয় করেছে। নিজের ঔরসজাত সন্তানকে ঠকিয়েছে। নিজের স্বার্থ হাসিলের পর যে এখন সীমার সাথেও অপরিচিতের মতো আচরণ করছে। সেই রীমার জামাই। এরা সমাজের মুখোশধারী শয়তান।

সেদিন সীমার কাছ থেকে ফিরে, শাওন নিজের সাথে মানসিক দ্বন্দে হেরে গিয়ে সারারাত স্ত্রী সন্তানের কাছে একবারও যায়নি।

রীমা চায়, শাওন তার স্বামী, সে যেন তার জীবনের সব অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল, ত্রুটি ভুলে গিয়ে রীমার কাছে ফিরে আসে। রীমা নিজেও তার ভুলগুলো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

হঠাৎ শাওনের এমন অপরিচিতের মতো আচরণে রীমা দিশেহারা হয়ে শাশুড়িকে ফোন করল।

” মা! শাওনের কি জানি অইছে। অফিস থেকে ফিরে দরজা বন্ধ করে রুমের মধ্যে শুয়ে আছে। সারারাত বের অয় নয়। আপনে তাড়াতাড়ি চলি আসেন।”

রীমার ফোন পেয়ে শর্মিলি আহমেদ আর একদিনও অপেক্ষা করেননি। পরেরদিন বিকালেই ফিরে এলেন শাওনের বাসায়। সঙ্গে সুরাইয়াকে নিয়ে। সুরাইয়া বাসন্তির মেয়ে।

যাকে শর্মিলি আহমেদ পুরো পৃথিবীর থেকে আড়াল করে নিজের মতো করে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন।

প্রায় ত্রিশ বছর আগে স্বামীর করা পাপের বোঝা নিজের দায়িত্বে রেখে, পুরো পৃথিবীর কাছে স্বামীকে শুদ্ধ মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। এতসব ত্যাগ তিনি স্বামীকে ভালোবেসে করেননি। করেছেন বাধ্য হয়ে। চরিত্রহীন পিতার সন্তানকে নিশ্চয়ই এসমাজ ভালো চোখে দেখবে না।

স্বামী পরিত্যক্তা নারীকে অবশ্যই এসমাজ ভালোভাবে গ্রহন করবে না। তাই তিনি সন্তানের কথা ভেবে, সমাজের কথা ভেবে একাই সবকিছু হজম করেছেন।

গতমাসে সেই সুরাইয়ার জামাই মারা গেছে। এরপর পিতৃপরিচয়হীন সুরাইয়া এসে উঠেছে আশ্রিতা মা শর্মিলি আহমেদের কাছে। শর্মিলি আহমেদ ছেলেদেরকে অনুরোধ করছেন সুরাইয়াকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগিদার করতে। যেন বাকি জীবন সুরাইয়ার একটা আশ্রয় হয়।

কিন্তু সুরাইয়ার সঠিক পরিচয় সম্পর্কে না জানায় ছেলেরা মায়ের অন্যায় আবদার মানতে রাজি নয়।
যে মানুষটা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে, শর্মিলি আহমেদ চান না এতগুলো বছর পর সেই মানুষটার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করতে।

তাই তিনি ছেলেদের উপর রাগ করে সুরাইয়াকে নিয়ে চলে এলেন শাওনের বাসায়।

শর্মিলি আহমেদকে দেখে রীমা বেশ ভরসা পেল। তিনি গত কয়েকদিনের বিস্তারিত ঘটনা শুনে প্রথমে রীমাকে প্রশ্ন করলেন,

” তোমার বইন সীমা কোথায়?”

” মা হে তো গ্রামের বাড়িত! ”

” তুমি কি নিশ্চিত? আমার তো মনে অইতাছে হে ঢাকা অইছে। শাওন তার সাথেই দেখা করছে।”

আজ একটা সাপ্তাহ রীমার একটাবারের জন্যও মনে হয়নি সীমা ঢাকা আসতে পারে।
রীমা উঠে গিয়ে তার ভাইজান আফসার উদ্দিনকে ফোন দিল।

প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর রীমা জিজ্ঞেস করল,

” ভাইজান, সীমা কই?”

” ওরে বইন তোরে তো জানানোই অইল না। সীমা লায়লা খালার বাসায়। খালা তো একা। ছেলেরা সবাই আমেরিকায়। ”

সীমা ঢাকা শুনে রীমা আর কোনো কথা না চট করে ফোন কেটে দিল।

রীমা তার শাশুড়ির বিচক্ষণতা দেখে বিস্মিত হলো। সে বিস্ময় আড়াল না করে সে সরাসরি শাশুড়ির প্রশংসা করে বলল,

” মা, সীমা আমার মায়ের চাচাতো বোন লায়লা খালার বাসায়। আপনি শুনার সাথে সাথে কিভাবে বুঝলেন?”

“আমার বুঝনের আগে তোমার বুঝার দরকার আছিল।”

” মা!”

” এমন অসহায়ের মতন মা বললে অইব না। আমি যেটা কই সেটা শুনো।”

” মা আমার প্রচণ্ড ঘেন্না অইতাছে। আমি আর শাওনের মুখোমুখি অইতে চাই না।”

” আমার কতা শুনো। তুমি শাওনের সাথে স্বাভাবিক থাইকবা, যেন তুমি কিছুই জানো না। আমি জানি এডা কষ্টের। এই কষ্টাটাই তোমারে কইরতে অইব।”

” আমি পারব না।”

” তোমাকে পারতে অইব। শাওন তোমাকে ভয় পাইতাছে, তোমার থেকে ঘটনাটা আড়াল করতাছে। তার মানে সে তোমাকে মূল্যায়ন করতাছে। যখন বুঝব তুমি জানো। তখনই তার সাহস বাইড়া যাইব। সে আর কিছু গোপন করব না। বাকিটা আমি দেখব কী করা যায়!

চলবে….