#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু
১৮)
অপমানে, লজ্জায় কেমন যেন মুষড়ে যাচ্ছে রীমা। সাধারণত বাবার বাড়িতে কোনো সমস্যা হলে, ভাই-বোনের কোনো ত্রুটি হলে মেয়েদেরকে আজীবন সেগুলো শ্বশুর বাড়িতে আড়াল করে রাখতে হয়।
না হয় শ্বশুর বাড়ির লোকজন পেয়ে বসে, সারাক্ষণ ইনিয়ে, বিনিয়ে কথা শুনাতে থাকে। এই কথা শুনানো মানুষের তালিকায় স্বামীও বাদ যায় না।
কী জটিল সমস্যা রীমার জীবনে! একদিকে নিজের আপন মায়ের পেটের বোন, অন্যদিকে নিজের স্বামী। সীমা কি আর বন্ধুত্ব করার জন্য পুরো পৃথিবীতে কোনো পুরুষ খুঁজে পায়নি! তাকে বেছে নিতে হলো আপন ছোট বোনের স্বামীকে।
রীমা খুব ভয় পাচ্ছে। মা মনে মনে কী ভাবছেন! নিশ্চয়ই তার চরিত্র নিয়েও মায়ের মনে প্রশ্ন জাগছে। শাওন আর সীমাপার মধ্যকার বন্ধত্বপূর্ন সম্পর্কের জন্য রীমা নিজেকে দায়ী মনে করছে।
সংসার ছেড়ে দিয়ে মরার মতো পড়ে পড়ে না ঘুমালে তো শাওন সুযোগই পেত না সীমাপার কাছে আসার।
মা ভাইজানের সাথে রুক্ষ ভাষায় কথা বলার পর থেকে রীমার ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে। সে কাচুমাচু করে শর্মিলী আহমেদের কাছে গিয়ে বলল,
” মা সব দোষ আমার! আসলে দোষ বলতে শরীরটা তখন এত খারাপ থাকত যে মরার মতন পইড়া ঘুমাতাম। সে কারণেই আইজ এমন দিন দেখতে হলো। আপনে চিন্তা কইরেন না ভাইজান সীমাপার বিয়ার ব্যবস্থা করব।”
” আশ্চার্য মাইয়া তুমি! সব দোষ তোমার অইব ক্যান? শাওন যে অফিসের কাজে দু’মাস দুবাই আছিল, একমাস মালয়েশিয়া আছিল। তোমার কি ইচ্ছা করে নাই তার সঙ্গ পাইতে? আমি তো জানি কাজের ব্যস্ততার কারণে তখন হে দুইদিনেও একবার তোমার সাথে কথা বলতে পারত না। তখন কি তার অনুপস্থিতিতে তুমি কারো সাথে ঘনিষ্ট অইছ?”
” ছিঃ মা! এসব কী বলেন! ”
” আমরা মাইয়্যারা যদি পুরুষদের সঙ্গ ছাড়া থাকতে পারি। বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে আগলে। তাহলে পুরুষরা থাকতে পারব না ক্যান? তুমি তো তখন মইরা যাওনাই যে, শাওনরে তোমার বইনের সাথে ঘনিষ্ট অইতে অইবে।”
” মা, দোষ যারই হোক, আপনে দোয়া করেন সব যেন ঠিক অই যায়।”
” আগে তুমি নিজেরে দোষ দেওন বন্ধ কর। দোয়া দিয়া কিছু অইব না। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কইরতে অইব।”
” ঠিক আছে মা। সব যেন ঠিক অই যায়।”
রীমা ভীষণ কৃতজ্ঞ তার শাশুড়ির উপর। শাশুড়ি নামের চরিত্রটার উপর মানুষের কেন এত অনাস্থা রীমা বুঝতে পারে না। তার মাও শাশুড়ি হিসাবে এত ভালো ছিল না। আশেপাশে সব ভাবিদের মুখে শাশুড়ির চরিত্র নিয়ে অভিযোগ শুনতে শুনতে রীমার মনে একটা আতঙ্ক ছিল। হয়তো তার শাশুড়িও দুষ্ট প্রকৃতির হবে। অকারণে কথা শুনাবে, অপমান করবে, অসম্মান করবে। কিন্তু বাস্তবে পুরো বিষয়টাই উল্টা।
রীমার মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আপন ব্যক্তি তার শাশুড়ি। তার স্বামীও না। বাবা-মা তো বেঁচেই নেই।
শর্মিলি আহমেদ কেন এই পরকীয়ার বিপক্ষে সোচ্ছার, সে ব্যাপারে রীমা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি।
তবে সুরাইয়া আসার পর রীমার একটুও ভালো লাগছে না। কী দরকার ছিল মায়ের সুরাইয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার! সুরাইয়া আসার পর শাওনও কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সেটা কি সুরাইয়া আসার কারণে, না-কি মা আসার কারণে। তবে আজ দশদিনে একবারও সুরাইয়া শাওনের সামনেও পড়েনি। বাসায় যে বাড়তি একজন মানুষ আছে, এটা বাহিরের মানুষ বুঝতেই পারবে না। শুধু বুঝতে পারবে এ বাসার প্রতিটা কাজে ভীষণ যত্নের চাপ।
তবে সুরাইয়া নিবিষ্ট মনে কাজ করার সময় রীমা সুরাইয়ার মুখের দিকে তাকালে অবাক হয়। চুপচাপ সুরাইয়ার মুখের আদলের সাথে কোথায় যেন শাওনের সাথে একটা মিল আছে। এটা কি রীমার চোখের ভুল! রীমা বুঝতে পারে না। লজ্জায় কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছে না।
শাওন পুরুষ, সুরাইয়া মহিলা। সুরাইয়ার মা আবার হিন্দু। সুরাইয়ার মাকে রীমার শাশুড়ি বোনের মতো পছন্দ করতেন সে কারণে মৃত বাসন্তির মেয়ের দায়িত্ব তার শাশুড়ি নিয়েছেন। এখানে সুরাইয়ার সাথে শাওনের চেহারার মিল থাকার প্রশ্নই আসে না।
তবে গতকাল সুরাইয়া কাপড় বদলানোর সময় হঠাৎ রীমা সামনে এসে পড়ায় সে সুরাইয়ার ঘাড়ের কাছে কালো জন্মদাগটা দেখে ভীষণ চমকালো। এরকম একটা জন্মদাগ তো শাওনের ঘাড়েও আছে। ব্যাপারটা কি নিচক কাকতালীয়। রীমা ভেবেছিল একবার ব্যাপারটা তার শাশুড়ির সাথে আলাপ করবে। কিন্তু সাহস করতে পারেনি।
আফসার উদ্দিন বুঝতে পারছে সীমার একটা বিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার আগেও সীমা বিয়ের ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছে।
এদিকে রীমা ও রীমার শাশুড়ির কাছে বিয়ের ইচ্ছের কথা জানিয়েছে। তা না হলে তারা এভাবে জরুরী ভিত্তিতে সীমার বিয়ের কথা বলত না।
সীমার মন আসলে কী চায় জানার জন্য আফসার উদ্দিন লায়লা খালার বাসায় ফোন করল।
” সীমা তোর যদি বিয়ার এতই ইচ্ছা অয়। সংসার করনের এত মন চায় আমি কি মরি গেছি! তুই রীমার সংসারে গিয়ে….”।
আফসার উদ্দিনের কথা শেষ না হতেই সীমা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল।
” ভাইজান আপনে আমারে মাপ কইরা দেন। সব মিথ্যা কথা।”
” আমি জানি সব। আমারে রীমার শাশুড়ি ফোন করছে। তোর কান্দনের দরকার নাই। তোর ভাই এহনো মরি যায়নি, সে তোর একটা ব্যবস্থা করব।”
” ভাইজান তুমি আমার জন্য যেটা ভালা মনে কর, সেটাই কর। তবে আমারে ভুল বুইঝ না। আমার কোনো দোষ নেই।”
সীমা বুঝতে পারেনি তার ভাই তাকে কী বলার জন্য ফোন দিয়েছে। সে ভেবেছে হয়তো সীমা যে শাওনের সাথে ঢাকা এসে দেখা করেছে, সেটা রীমার শাশুড়ি টের পেয়ে ভাইজানকে ফোন করে সব বলে দিয়েছে।
তবে সীমাও এত সহজে ছাড়ার পাত্রী নয়। তাকে যদি সত্যি, সত্যি সব হারাতে হয়। ভাইজান, ভাবির কাছে ছোট হতে হয়। তাহলে সীমা শাওনের ভালো মানুষির মুখোশ উন্মোচন করে ছাড়বে।
দুশ্চরিত্র, লম্পট! স্ত্রীর কাছে বিড়াল সাজা হচ্ছে, মায়ের কাছে চরিত্রবান সন্তান।
সবার আগে অপমান করতে হবে অহংকারি, কুটিল শর্মিলি আহমেদকে। পরিকল্পনা করে রীমাকে বাসা থেকে বের করেছে। যার ছেলে চরিত্রহীন, তাকেও ছেলের অপরাধের দায় নিতে হবে। শুধু শুধু সীমা চরিত্রহীন হবে কেন? পাপ তো সীমা একা করেনি। তাকে পাপের পথে যে টেনে এনেছে সে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করবে। সমাজে ভালো মানুষ সেজে থাকবে, স্ত্রীর কাছে বিশ্বস্ত স্বামী সেজে থাকবে, সন্তানের কাছে সৎ বাবা সেজে থাকবে। অসম্ভব!
রীমাকেও সব জানাতে হবে। তার জামাই ফেরেশতা নয়, একটা মুখোশধারী শয়তান। কত বড় লম্পট এটা রীমাকেও জানতেই হবে। শাওন যখন সীমাকে গ্রহন করতে অসম্মতি জানিয়েছে। সীমা রীমার সাথে শাওনকে সুখে সংসার করতে দেবে না।
চলবে….