অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-২১

0
447

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

২১)

লায়লা খালা ফোন দিয়েছেন রীমাকে, তিনি সীমার বিয়ে ঠিক করেছেন। আগামী শুক্রবার বাদ জুমা সীমার বিয়ে। রীমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি বিয়েটা লায়লা খালা ঠিক করলেও এই বিয়েতে সম্পূর্ণ অবদান আছে তার শাশুড়ি শর্মিলি আহমেদের।
যে শর্মিলি আহমেদ মাসের পর মাস ঢাকা থাকলেও কখনো বিশেষ প্রয়োজন না হলে ঢাকার রাস্তায় বের হন না।

কখনো বের হলে শাওন সাথে থাকতে হয়। তিনি বড় জোর পাশের মার্কেট বা রেস্টুরেন্টে যান। যেন কোনো যানবাহনে না উঠেই নিরাপদে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে আসা যায়।
সেই তিনি শাওনের অফিসের গাড়ি নিয়ে একা ড্রাইভারের সাথে হুটহাট ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক ঘন্টা থেকে আবার নিরাপদে বাসায়ও ফিরে আসছেন।

রীমা মাঝেমধ্যে ভাবে, যদি তার শাশুড়ির মতো দশ শতাংশও সাহস, বুদ্ধি ও মানসিক শক্তি রীমার থাকত, তাহলে এই সমাজে কেউ তার উপর ছড়ি ঘুরাতে পারত না।

বিয়েতে রীমা যাবে না এটা তার পূর্বের সিদ্ধান্ত। সে এজীবনে আর সীমার সামনে পড়তে চায় না। ঘরের কথা বাহিরের কেউ জানুক এটা রীমা চায় না। তাই সে এই মুহূর্তে লায়লা খালাকে কিছু বলেনি। তবে তার কৌতুহল হলো সীমার বর সম্পর্কে জানার।

এত অল্প সময়ে কিভাবে বরের ব্যবস্থা হলো। সীমাও কি বিয়েতে আপত্তি করেনি? বিয়েটা ঢাকায় হচ্ছে কেন?

ভাইজান স্বপরিবারে বিয়েতে থাকবেন কি-না! বিয়ের সমস্ত খরচাদিই বা কে বহন করছে! কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস না করলে পুরো বিষয়টা জানা যাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে কাকে জিজ্ঞেস করা নিরাপদ রীমা বুঝতে পারল না।

তবুও কৌতুহল দমন করতে না পেরে রীমা তার ভাবি রাহেলা বেগমকে ফোন দিল।

” কেমন আছো ভাবি?”

” তুমি তো আমার আমার রাগ! ঢাকা যাওনের পর আমার একটা খোঁজও নিলা না!”

” না,ভাবি। তুমি ভুল বুঝছ। রাগ করুম ক্যান তোমার উপর? ব্যস্ত আছিলাম। ঢাকা আইলে আমার বাসায় বেড়াইতে আইবা।”

” ঢাকা আমরা যাই কী করুম! তোমার ভাইজান হয়তো যাইব। বুড়ি বয়সে সীমার এমন বিয়ার টক উঠল, যে তোমার লায়লা খালারে পটাই বিয়ার ব্যবস্থাও করি নিচে।”

” ওহ্। বর কি করে?”

” ক্যান, তুমি জানো না?”

” জানি! ”

” তাহলে আর কি! বিয়া কি তোমার বাসায় অইব?”

” না, ভাবি। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আছে।”

” লায়লা খালা কি স্বার্থে এত কিছু করছে বুঝ না?”

” না, কিসের স্বার্থ আবার!”

” ন্যাকা কিছু বুঝ না, না!”

” লায়লা খালার ভাইপুত আরিফ্যার চরিত্র সম্পর্কে কে না জানে? তিন তিনটা বিয়া করছে, একটা বউও টিকল না। সীমা টিকব তোমার মনে অয়।!

রীমা মুখ ফসকে বলে ফেলল ” আরিফ ভাই”।

আরিফ একটা সময় রীমাদের বাসায় আসত নানান অজুহাতে। তখন সীমা বড় ছিল। রীমা বড় না হলেও ছোট না। তখন থেকে শুনতো আরিফ ভাই বিবাহিত। তবে ওর স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। একটা সময় জানতে পেরেছে বনিবনা না হওয়ার কারণ হচ্ছে আরিফ ভাইয়ের চরিত্র। অফিসের বাবুর্চি থেকে ঘরের বুয়া সবার সাথে আরিফ ভাইয়ের দৈহিক সম্পর্ক ছিল। তার সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়ের সাথে নয়, নারী দেহ হলেই তার হতো।

কয়েকবার না-কি তার স্ত্রী হাতে নাতে ধরে ফেলেছিল। পরবর্তীতে পারিবারিকভাকেই আরিফ ভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। এসব অবশ্য শোনা কথা। যদিও আরিফ ভাইয়ের পরিবার এসব কখনো স্বীকার করেনি। তারা প্রচার করে বেড়িয়েছেন আরিফ ভাইয়ের স্ত্রীর অন্য জায়গা সম্পর্ক ছিল।
পরবর্তীতে আরিফ ভাইয়ের আরও দুটো বিয়ের খবর শুনলেও শেষ পর্যন্ত তিনি কারো সাথেই সংসার করতে পারেননি।

আরিফ ভাই তো একটা সময় সীমাকেও কুপ্রস্কাত দিয়েছিল। সেই আরিফ ভাইয়ের সাথেই জেনে শুনে সীমার বিয়ে!

রীমা কোনোভাবেই বিষয়টা হজম করতে পারেনি। সে তাৎক্ষণিক লায়লা খালাকে ফোন দিল।

” খালা, বাবা-মা নেই। তাই বলে আপনি আরিফ ভাইয়ের সাথে সীমাপার বিয়ে দিচ্ছেন!”

” কেন? আরিফের কি সমস্যা? ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাট আছে। বড় চাকরি আছে, ব্যাংকে মোটা অংকের ডিপোজিট আছে। সীমা সুখেই থাকবে।”

” সেসব দিয়ে কি আর সুখ কেনা যায় খালা? আরিফ ভাইয়ের চরিত্র সম্পর্কে কে না জানে। গত পাঁচ বছরে এত কিছুর লোভ দেখিয়েও তো একটা বিয়ে করাতে পারলেন না।”

” জোয়ান কালে পুরুষ মানুষের এমন টুকটাক দোষ থাকেই। দোষ নেই কার? যে মেয়ে ছোট বোনের বরের দিকে হাত বাড়ায়। তার কপালে এর চেয়ে ভালো বর জুটবে তোমার মনে হয়!”

” কী বলছেন আপনি এসব খালা?”

” শুনো, আমি সব খবর জানি। তোমার শাশুড়ি মিসেস আলতাফ আহমেদের সাথে আমার কয়েকবার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে কিছুটা জানিয়েছেন। যদিও আমি নিশ্চিত তিনি সবটা আমাকে বলেননি। ব্যক্তিত্ববান ভদ্র মহিলা তো। অন্য মেয়ের দোষের কথা বলতেই চাইছেন না।”

” মা আপনাকে কী বলেছেন সেটা আমি জানি না। তবে সবটা সত্য নয়।”

” জানি, সত্যটা তিনি আমাকে বলেননি। আর সত্য জানার জন্য আমি সীমাকেও কিছু জিজ্ঞেস করিনি। নিষেধ করেছেন তোমার শাশুড়ি সীমাকে কিছু না বলতে।”

” খালা আমার ভালো লাগছে না। সীমার কি বিয়েতে মত আছে।”

” অমত করার মতো পরিস্থিতি কি সীমার এখন আছে? তোমার বাসায় তুমি সীমাকে নিবে না। তোমার ভাইও তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে রাজি না। আমি আগামী মাসে চলে যাব আমেরিকা। সীমা কোথায় থাকবে? আমার এখানে থাকতে পারবে। কিন্তু কি পরিচয়ে থাকবে? তোমার মা নেই। তোমার মা ছিলেন আমার বিশেষ বান্ধবী। এতদিনে যখন তোমরা কেউ সীমার বিয়ে দাওনি। আমি এখন সীমার বিয়ে দেয়াকে দায়িত্ব মনে করলাম।”

” খালা, সীমাপার বিয়ে হলেও কিন্তু সে অর্থে তার সংসার হয়নি। আরেকটু দেখে শুনে তাকে অন্য ছেলের কাছে বিয়ে দেয়া যেত না!”

” যেত, কিন্তু সে সময় নেই। সীমার এমন কোনো যোগ্যতাও নেই কোনো অবিবাহিত ছেলের কাছে তাকে বিয়ে দেব। পড়াশোনাও তো বেশি না। বিয়ে আরেকটা হয়েছে আরও পনেরো বছর আগে। শুধু গায়ের রং দিয়ে কি সব হয়? এদিকে তোমার বাসায়ও কম কেলেঙ্কারি করেনি। তোমার ভাই কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি না। এমন মেয়েকে কি লোভে, কে বিয়ে করবে? ভাগ্য ভালো আরিফ রাজি হয়েছে। এখন তোমার আপত্তি থাকলে এক কাজ করো, সীমাকে তোমার বাসায় নিয়ে তুমি দেখে শুনে বিয়ে দিও। আমি আরিফকে নিষেধ করে দেব।”

” আমার আপত্তি বলতে, আমি জানতে চাচ্ছি সীমা রাজি কি-না! ”

” সীমা রাজি, আফসার উদ্দিন রাজি, আমি রাজি। সীমা আজ আরিফের সাথে বের হবে বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য। একটাকাও খরচ হবে না বিয়েতে। কাজি ডেকে আমার বাসায় বিয়েটা পড়িয়ে আরিফ সীমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবে। আফসার, আমি, তুমি আর আরিফের কাছের কয়েকজন বন্ধু উপস্থিত থাকবে শুধু।”

” ঠিক আছে খালা সবাই যেটা ভালো মনে করে।”

” তুমি এক কাজ করিও, শুক্রবারে সকালেই চলে আসিও বাসায়।”

রীমা হ্যাঁ, না কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দিল। রীমা বুঝতে পারল না এই একটা সপ্তাহে কি থেকে কি হলো যে মাসহ সীমার বিয়ে ঠিক করে ফেলল।

একদিকে সীমার বিয়ে হলে রীমার সংসারে স্বস্তি ফিরে আসবে। শাওন আর যাই হোক অন্যের স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করতে যাবে না। নতুন স্বামী, সংসারে সময় দিতে গিয়ে সীমাও আর শাওনকে বিরক্ত করবে না।

তারপরও রীমা কেন জানি শান্তি পাচ্ছে না। এত জটিল মহা সংকটে মনে হয় কেউ পড়ে না। যদি আরিফ ভাইয়ের স্বভাব, চরিত্র আগেরটাই থাকে তাহলে তো সীমা কোনোদিন সুখী হবে না। আরিফ ভাই ঠিকই ফুলশয্যার ঘরে সীমাকে রেখে অন্য মেয়ের কাছে যাবে।

সীমার বিয়ে নিয়ে রীমার এত কৌতুহলের প্রয়োজন ছিল না। উল্টো সীমার বিয়ে হওয়ায় রীমার খুশি হওয়ার কথা। আপদ বিদেয় হচ্ছে বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার কথা। অথচ কেন জানি রীমা স্বস্তি পাচ্ছে না। রীমা তো আর সীমার মতো স্বার্থপর না। যে মেয়ে নিজের বোনের কথা ভাবল না, রীমা সেই বোনের কথাই বারবার ভাবছে। আসলে রীমা হচ্ছে নরম মনের, সরল মেয়ে কেউ ছোবল মারলেও মরতে মরতে সে ছোবল মারা ব্যক্তিকে উঁকি দিয়ে দেখবে সে ব্যাথা পায়নি তো!

রীমা সাহস করে তার শাশুড়ি শর্মিলি আহমেদের কাছে গিয়ে বলল,

” মা, সীমার বিয়া ঠিক অইছে।”

” জানি।”

” কিন্তু মা, হঠাৎ করে কেমনে কি অইল কিছু বুঝলাম না।”

” তোমার এত সব কিছু বুঝনের কাম না। এককাজ করিও তুমি আর শাওন বৃহস্পতিবার রাইতে গাজিপুরের এদিকে অনেক সোন্দর সোন্দর থাকনের জায়গা আছে। তোমারা একদিনের জন্য কোথাও থাইকা বেড়াই আইস। তোমাদের বিয়াতে থাকনের দরকার না।”

” কিন্তু মা, আপনে হয়তো জানেন না। আরিফ ভাইয়ের চরিত্র খারাপ।”

” হুনো, তুমি হয়তো মনে কষ্ট পাইবা। সীমারও সমস্যা কম না। এসব চিন্তা বাদ দিয়া নিজের কতা ভাব। আল্লাহ যা করেন ভালোর জইন্যই করেন। দোয়া কর সবাই যেন ভালা থাকে।”

রীমা আর সাহস পেল না শাশুড়ির সাথে এপ্রসঙ্গে কথা বলার।

শাওন সীমার বিয়ে সম্পর্কে জানে কি-না রীমা বুঝতে পারল না। রীমা তো এপ্রসঙ্গে কোনো কথা বলবেই না। শর্মিলি আহমেদেরও বলার কথা না। ইদানিং তাদের মা ছেলের আলাদা কোনো কথাই হয় না। তারপরও রীমার মন বলছে শাওন সব জানে। সীমা একই শহরে থাকে। দুজনের হাতে মোবাইল আছে। সীমা নিশ্চয়ই এতদিনে ফোন করে শাওনকে তার বিয়ের সুখবর জানিয়ে দিয়েছে।

তবে শাওনের মাঝে বিশেষ কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ল না। শাওন ভীষণ ব্যস্ত অফিসের কাজে। এবছর তার একটা প্রমোশন হওয়ার আছে। সকাল আটটায় অফিসের গাড়ি এসে বাসার সামনে থামে,সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। ফিরে আসে রাতের নয়টার পর। এসেও কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ে।

রীমাও ব্যস্ত স্বামী, সংসার, সন্তান, শাশুড়ি আর গ্রাম থেকে আসা কাজের মেয়ে সুরাইয়কে নিয়ে।

এদিকে শর্মিলি আজমেদ ঘোষণা দিয়েছেন, সুরাইয়া অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এখানেই থাকবে। সুরাইয়াকে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি।

সমস্যা হচ্ছে একটাই। সুরাইয়া সারাদিন কারো সাথে একটা কথাও বলে না। শাওন বাসায় ফিরলে সে একদম হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। চারর রুমের বাসায় তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। হাজার বলেও তখন তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না।

সে সবসময় জায়নামাজে বসে চুপিচুপি অনেক্ষণ কাঁদে। মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্কার উপর তার অভিযোগের শেষ নেই।

চলবে….