#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু
২২)
খুব অল্প সংখ্যক কাছের মানুষের উপস্থিতিতে ঘরোয়া পরিবেশে শুক্রবার বাদ জুমা সীমার বিয়ে হয়ে গেল আরিফের সাথে।
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছেন লায়লা খালা। তিনি একদিকে পাত্রীর খালা, অন্য দিকে পাত্রের ফুফু। পাত্রীরও সে অর্থে আপন কেউ নেই। রীমা তো আসেইনি বিয়েতে। আফসার উদ্দিন যাও আসল, এসেই সে ঘোষণা দিল পথে সমস্ত টাকা পয়সাসহ তার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো এযাত্রায় সে সুস্থভাবে বাসায় ফিরতে পেরেছে। বোনের বিয়ের জন্য এসে আজ সে মরতে মরতে বেঁচে গেল। ছিনতাইকারীদের হাতে যে ধারাল রাম দা আর চাপাতি ছিল, ব্যাগ না ছাড়লে তাকে জানেই মেরে দিত।
আফসার উদ্দিনের ছিনতাইয়ের ঘটনায় সবাই হা – হুতাশ করলেও ছিনতাইয়ের কবলে পড়া আফসার উদ্দিনের বোন কিন্তু নিশ্চুপই ছিল। ভাইয়ের রোগ ধরতে বোনের খুব একটা অসুবিধা হয়নি।
আরিফের তো কেউ নেইই। তার বাবা মারা গেলেন সে ছাত্র অবস্থায়। মা মারা গেলেন গত বছর। বড় দুই বোন আছে তাদের সাথে তেমন সুস্পর্ক আছে বলে মনে হয়নি। যদি থাকত, তাহলে অবশ্য একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে উপস্থিত না থেকে পারত না।
অবশ্য উপস্থিত থাকবেই বা কোন মুখে কারণ এটা ভাইয়ের চতুর্থ নাম্বার বিয়ে।
বোনেরা আশংকা করেছে অন্য তিন বউয়ের মতো এর স্থায়ীত্ব হয়তো বড় জোর তিন মাস। তাই তারা কষ্ট করে সময় নষ্ট করার জন্য বিয়েতে উপস্থিত হয়নি।
একমাত্র ফুফু হিসাবে তাই সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে লায়লা খালাই দুই ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষকে এক করে দিলেন।
সীমা অসহায় হয়ে হোক বা জিদ করে হোক শাওন তাকে ফিরিয়ে দেয়ার পর বিয়ে নিয়ে সে আর কোনো দ্বিমত করেনি। হয়তো শাওনকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে শাওন ফিরিয়ে দিলেও সীমা পচে যায়নি। তার চেয়েও যোগ্য ছেলের সাথে পারিবারিকভাবে সীমারও বিয়ে হতে পারে।
সীমার তিন মাসের বিবাহিত জীবন থাকলেও শাওনের সাথে তার এক বছর অবৈধ সম্পর্ক থাকলেও নির্ভয়ে সে কোনো পুরুষের কাছে যেতে পারেনি। সব সময় ভয় ছিল কেউ দেখে ফেলার। তাই ভেবেছে এবার আর কোনো ভয় নেই। আরিফ তার স্বামী। কালেমা পড়ে বৈধভাবে তাদের বিয়ে হয়েছে। সে আজ নির্ভয়ে আরিফের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেবে।
আরিফের বাসায় কাছের কোনো আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিল না। সে নিজেই বন্ধুদের নিয়ে নতুন বউকে গ্রহন করেছে।
সীমা মনে মনে ভেবে রেখেছে হয়তো, সাজানো গোছানো থাকবে ফুলশয্যার ঘর। অসংখ্য ফুলের ছড়াছড়ি থাকবে। আরিফ নিশ্চয়ই অনেক আয়োজন করে রেখেছে।
আরিফের কেউ না থাকলেও টাকার তো তেমন অভাব নেই বলেই জেনেছে সীমা। টাকা থাকলে আজকাল সব কিছুই করা যায়।
অথচ খুব সাধারণ একটা ঘরে নিয়ে সীমাকে বসানো হয়েছে। ঘরের বিছানার চাদরটাও পাল্টানো হয়নি অনেকদিন। পুরো ঘরের আনাচে- কানাচে সিগারেটের ভ্যাপসা গন্ধ।
মনে হচ্ছে কেউ যুদ্ধ শেষ করে রাতে এসে কোনো মতে মাথা গুঁজে বাসায় এসে। এত অবহেলা সব জায়গায় দেখেও সীমা মোটেও মন খারাপ করেনি। ঝটপট সে কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে পুরো ঘর গুঁছিয়ে ফেলল ত্রিশ মিনিটের মধ্যে।
আলমারি থেকে বের করে নতুন চাদর বিছাল, রুম ঝাড়ু দিলো। অসমাপ্ত সিগারেটের শলাকাগুলো খুঁজে খুঁজে বিনে ফেলল। এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে রুমের সব গন্ধ দূর করল। ডাইনিং রুম থেকে বোতল ভর্তি করে পানি আনল।
এদিকে রাত বেড়েই চলছে। অথচ আরিফের দেখা নেই। এতক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকায় সীমা বুঝতে পারেনি, প্রায় মধ্যরাত হতে চলল।
সীমা আরিফকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল বের করল। ডায়ালে শাওনের নাম্বার দেখে সীমা স্মৃতি কাতর হলো। তার চোখ ছলছল করে উঠল। শাওন নিশ্চয়ই এখন রীমাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ফোন করলে হয়তো রিসিভ করবে না। নয়তো রিসিভ করে অসম্মান করবে।
কী অদ্ভুত পরুষের চরিত্র! এই শাওনই একসময় শরীরের প্রয়োজনে সীমার কাছে ছুটে এসেছিল। এখন যখন প্রয়োজন পুরিয়ে গেছে তখনই কত নীতি কথা বেরিয়ে এসেছে।
তার নিষ্পাপ স্ত্রী আছে, অবুঝ সন্তান আছে তার পক্ষে তাদেরকে ঠকানো সম্ভব নয়। সীমার জানতে ইচ্ছে করছে, শাওন যখন সীমার বুকে মুখ গুজে শরীরের উষ্ণতা খুঁজত, তখন কোথায় ছিল তার বিবেক? যখন রাতের পর রাত সীমাকে ব্যাবহার করে সুখের সাগরে ভেসেছিল, তখন কী তার স্ত্রী নিষ্পাপ ছিল না!
হ্যাঁ পাপ সীমাও কম করেনি। বোনের বরের কাছে দেহ বিলিয়ে দেতে সে দুইবার ভাবেনি। প্রকৃতি তার সাথে কী ন্যায় করেছে যে তাকে প্রকৃতির সন্তানের সাথে ন্যায় করতে হবে।
রীমার মতো সংসার করার জন্য তো সীমাও স্বামীর ঘরে গিয়েছিল। অথচ রাতে না ঘুমিয়ে সকালে ভোরে উঠার কারণে রান্নাঘরে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় সাথে সাথে তার বর তাকে এপিলেপসি রোগে আক্রান্ত বলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বাবার বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে আর ফিরিয়ে নেয়নি।
শাওনের মনে তিন বছর সংসার করা স্ত্রীর জন্য কত মায়া। সীমাও তো তিনমাস সংসার করেছে, ভালোবেসেছে। কই তার প্রতি তো তার স্বামীর কোনো মায়া কাজ করেনি। প্রকৃতি কি তাকে ঠকায়নি! আজ শর্মিলি আহমেদ ছেলের দোষ খুঁজে পায়নি। উল্টো সীমাকে রক্ষিতা বলে অপবাদ দিয়েছে।
কে সীমার সাথে ন্যায় করেছে?
তার প্রথম সংসার ভেঙে যাওয়ায় ভাইজান তিন লক্ষ টাকা নগদ পেয়েছির। সে টাকা দিয়ে ভাইজান ব্যাবসা করেছেন। অথচ তাকে বিয়ে দেয়নি। আজও তার বিয়েতে একটাকা খরচ করার ভয়ে এসে ছিনতাইয়ের নতুন গল্প বানিয়েছে।
সীমা পরিকল্পনা করে রেখেছে আরিফকে সে তার ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধবে। আরিফের জীবনের সব অতীত ভুলিয়ে দেবে। শাওনের সাথে আর নয়। সীমা আস্তে করে শাওনের নাম্বারটা মোবাইল থেকে ব্লক করে দিল।
আচ্ছা নারীরা যাকে হৃদয়ে স্থান দেয়। ডায়াল নাম্বার থেকে, কন্ট্রাক নাম্বার থেকে তাকে ব্লক করলেই কি জীবন থেকে ব্লক করা যায়? যায় না। সীমাও এক জীবনে শাওনকে ভুলতে পারবে না। পনেরো বছর আগে সদ্য যৌবনবতী হওয়া সীমার বিয়ের স্মৃতি বলতে তেমন কিছু নেই। তার জীবনে পুরুষ বলতে একমাত্র শাওনই সত্যি।
সীমার কাজল দেয়া চোখের কোণে উপচে পড়ছে জল। সে আলতো করে নিজের চোখ নিজেই মুছে দিল।
এমন সময় দরজা ধাক্কা দিয়ে আরিফ ঢুকল রুমে। সীমা ভেবেছিল রুমের চেহারা দেখে হয়তো আরিফ চমকে যাবে। ছেলেরা আর যাই হোক সংসারী মেয়ে খুব পছন্দ করে। সীমার অন্য দোষ থাকলেও সুনিপুন গৃহীনি হিসাবে সে একশে একশ নাম্বার পাবে। শাওনের চোখেও সে প্রথম পড়েছিল তার গোছানো কাজের কারণে।
কিন্তু না আরিফের চেহারায়ও কোনো পরিবর্তন নেই, কণ্ঠেও নেই। সে যেন সীমাকে এনেছেই ঘর গোছানোর জন্য। ঘরে ঢুকে আরিফ সরাসরি বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় সীমা বিভ্রান্ত হলো। সে আরিফের পাশে গিয়ে বসল।
” কোথায় ছিলে? এত দেরি হলো যে! আমি একা একা ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।”
” কৈফিয়ত চাচ্ছ?”
আরিফের কথায় সীমার চোখ বিস্পারিত হলো।
” এটা কেমন কথা!”
” কী অবাক হচ্ছো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। শুনো এত অল্প সময়ে আসলে তোমাকে সব বলা হয়নি। আজ বলছি, তুমি আমার স্ত্রী হয়েছো। বেশ ভালো। থাকো, খাও, ঘর গোছাও। দয়া করে আমার জীবন গোছাতে এসো না। আমি এসব পছন্দ করি না। আমি আমার মতো থাকব। ”
” আরিফ এসব যখন এতদিন বলনি, আজও না বললে কি নয়!”
” কেন? আজ কি?”
” আজ আমাদের ফুলশয্যা।”
” এটা নতুন কি! আমিও তোমার প্রথম স্বামী নয়, তুমিও আমার প্রথম স্ত্রী নয়। ফুলশয্যা টয্যা তো হয়েছিল দুজনেরই। এককাজ কারো ডাইনিং টেবিলে তোমার জন্য খাবার রেখেছি। চট করে খেয়ে শুয়ে পড়।”
” আরিফ আমরা বিয়ে করেছি কেন?”
” তুমি বলো কেন?”
” সংসার করার জন্য।”
” শুনো, তোমার কি মনে হয় না আমি একজন কুমারি মেয়েকে বিয়ে করতে পারতাম। পনেরো বছর আগে বিয়ে হওয়া মধ্য বয়স্ক তোমাকে কেন বিয়ে করেছি! আসলে আমার একজন পার্মানেন্ট স্ত্রীর প্রয়োজন ছিল। যে আমার ঘর গুছিয়ে রাখবে। আগোছাল ঘর দেখে বুঝনি এতদিন কেমন ছিলাম! তোমারও আশ্রয়ের। লায়লা খালা আমাকে সব বলেছে। তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলেও আমি জেনেছি সে তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চায় না। সে কারণে তোমাকে বেটার অপশন মনে হয়েছিল। ”
বাকরুদ্ধ সীমা স্ট্যাচু হয়ে বসে পড়ল আরিফের পাশে বিছানায়। আরিফ শোয়া থেকে উঠে এসে সীমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” সুন্দরী, সেই কিশোরি বয়সে অবশ্য তোমাকে বেশ ভালো লেগেছিল। এখন তো তুমি বুড়ি।”
এবার আরিফ হেঁচকা টেনে সীমার গা থেকে কাপড় সরিয়ে বলল,
” এসব কী পরে আছো হাবিজাবি। খোল তো!”
আরিফের মুখ থেকে বিশ্রি গন্ধ আসছে। আরিফ ড্রিংকস করেছে। সেই গন্ধে সীমার বমি আসছিল। সে কোনোমতে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,
” তুমি ড্রিংকস করেছ?”
” হুম। তুমিও করবা? দারুণ ব্যাপার হবে।”
সীমা এবার কাঁদতে কাঁদতে আরিফের পা জড়িয়ে বলল,
” এসব কেন বলছ আরিফ। প্লিজ এতটা নিষ্ঠুর হইও না। লায়লা খালা এসব শুনলে কী বলবেন! তিনি কত আশা করে তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছেন।”
” লায়লা ফুফু শুনলে কী হবে! তিনি তো আগামী সপ্তাহে আমেরিকায় চলে যাবেন। লায়লা ফুফুকে এসব বলে লাভ নেই। এর চেয়ে বরং কাপড় খোল, তাতেই তোমার লাভ হবে। ”
চলবে…..