অদিতির যবনিকা পর্ব-০২

0
16

#অদিতির_যবনিকা -০২
#তিশা

রিফাত বোঝে রঙ্গনের জীবনে এমন কোন নারীর অস্তিত্ব আছে যাকে সে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে কিন্তু কে সে তা রিফাত জানে না আর এটুকুও বোঝে সেই নারীর ভালোবাসা না পাওয়ার জন্যই রঙ্গন এরকম প্রস্তরের মত কঠিন হয়ে গেছে।যার এত এত নারী অনুরাগী সে আজ অব্দি কোন নারীর সংস্পর্শে যাইনি শুধুমাত্র হৃদয়ে কোন এক অজানা রমণীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ধারণ করার জন্য।
– ভাই জাপানে কনসার্ট আছে আগামী সতেরো তারিখ।
রিফাতের কথায় চোখ তুলে চাইলো রঙ্গন। চিন্তিত ভঙ্গিতে রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
– বাবা জানে?
রিফাত মাথা নিচু করে বলল,
– ভাই তোমার কনসার্টের নিউজ কি চাপা থাকে?
রঙ্গন ফোস করে নিঃশাস ছাড়লো।বাবার কানে যেহেতু গেছে সেহেতু জাপান গেলে তাকে বাবার সাথে দেখা করতেই হবে মনে মনে ভাবলো সে।ভাবতে ভাবতেই রওনক চৌধুরীর ফোন এলো রঙ্গনের ফোনে। রঙ্গন হতাশ ভাবে তাকালো সেদিকে তারপর ফোনটা রিফাতের দিকে ছুড়লো রিফাত সাথে সাথে সেটি ধরে ফেলল।
– বল আমি ঘুমাচ্ছি।
কথাটি বলে রঙ্গন বেডরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।রিফাত হতাশ হয়ে ফোন রিসিভ করলো।

– জানিস জাপানে আর আর কনসার্ট করতে আসছে!
জেসিয়ার কথায় আহিনা ঠোট উল্টে জিজ্ঞেস করল,
– আর আর কে?
– আর আর হচ্ছে অনেক বড় সিঙ্গার সবাই চেনে তুই চিনিস না?
আহিনা মাথা নাড়িয়ে না জানালো।
– দাড়া তোকে দেখাচ্ছি আমি বড় আপুর থেকে লুকিয়ে একটা ফটোকার্ড এনেছি।
জেসিয়া তার পিংক কালারের স্কুল ব্যাগের ভেতর থেকে রঙ্গনের একটা ফটোকার্ড বের করে আহিনার হাতে দিলো। আহিনা তার গোল গোল চোখ দিয়ে দেখলো তারপর ছবিতে হাত বুলিয়ে বলল,
– তুই যাবি কনসার্টে?
– না রে আমি তো ছোট তাই আমাকে নেবে না আপু।
দুঃখী মুখ করে বলল জেসিয়া।আহিনা রঙ্গনের ছবিতে আর একবার হাত বুলিয়ে জেসিয়াকে ফের‍ত দিলো।

স্কুল থেকে এসে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে আহিনা। অফিস থেকে ফিরে মেয়ের ফোলা গাল দেখে জেনিফারকে চোখ দিয়ে ইশারা করে জানতে চাইলো কি হয়ছে?জেনিফারও বিপরীতে ইশারায় জানালো সে জানে না।অদিতি মেয়ের পাশে বসে তাকে কোলে উঠিয়ে নিলো।আহিনার ছোট্ট নাকের সাথে নিজের নাক ঘষে আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইলো,
– আমার পাখিটার কি হয়ছে?
আহিনা ঠোট ফুলিয়ে বলল,
– আমি আর আর এর কনসার্টে যেতে চাই মাম্মাম।
অদিতির চেহারার হাসি মুছে গেলো।রঙ্গনের কনসার্টের পোস্টার তার নজরেও এসেছে কিন্তু আহিনা হঠাৎ রঙ্গনের কনসার্টের ব্যাপারে আগ্রহী হলো কিভাবে?
– তোমাকে কে বলেছে মাম্মাম?
– জেসিয়া। ওর আপু দেখতে যাবে আর আর এর কনসার্ট। জেসিয়া ছোট বলে ওকে নিচ্ছে না
অদিতি হেসে বলল,
– দেখেছো জেসিয়া ছোট বলে ও যাচ্ছে না তাহলে তুমিও তো ছোট তাই না মা।
অদিতি দেখলো মেয়ের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাই আহিনার গালে চুমু দিয়ে বলল,
– আমি তোমাকে একটা প্ল্যান দিতে পারি বেবী।
– কি মাম্মাম।
উৎসুকভাবে জানতে চাইলো আহিনা।
– তুমি আর জেসিয়া মিলে প্ল্যান করে রাখো তোমরা বড় হলে দুজনে একসাথে আর আর এর কনসার্ট দেখতে যাবে।এখন যদি তুমি ওকে ছাড়া যাও তাহলে ও কষ্ট পাবে না তুমি কি তোমার বন্ধুকে কষ্ট দিতে চাও?
মায়ের কথায় বেশ ভাবুক হলো আহিনা তারপর উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল,
– তুমি ঠিক বলেছো মাম্মা আমি কাল স্কুলে যেয়েই জেসিয়াকে বলব।
কথাটা বলেই মায়ের কোল থেকে নেমে নিজের রুমের দিকে দৌড় দিলো আহিনা। আহিনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সোফার উপরে আয়েশ করে নিজের ভর ছেড়ে দিলো অদিতি তারপর হালকা হেসে মনে মনে আওড়ালো রাফিয়ান রঙ্গন দ্যা ফেমাস চকলেট বয় অব ইউনিভার্সিটি!

বাবার জেদের কাছে হার মেনে রঙ্গনকে একটু আগেভাগেই জাপান আসতে হয়েছে।বহুদিন পরে রওনক চৌধুরী ছেলেকে দেখে যেনো আনন্দে আত্মহারা হলেন।কিন্তু ছেলে তার নির্বিকার।বরাবরের মতই ছেলের লির্লিপ্ততায় হতাশ হলেন তিনি।একবার যদি জানতে পারতেন কেন তার ছেলে এত বেপরোয়া কে সেই মেয়ে তাহলে দুনিয়া এফোড় ওফোড় করে হলেও তাকে ছেলের জন্য খুজে নিয়ে আসতেন।

ভোরবেলা কালো হুডি আর মাস্ক পরে পার্কে দৌড়াচ্ছে রঙ্গন।দৌড়াতে দৌড়াতে রঙ্গনের মনে হলো অতি আপন এক সুবাস বাতাসের বেগে তার পাশ দিয়ে চলে গেছে মুহুর্তেই থমকে গেলো সে। পিছন ফিরে দেখলো বেশ কয়েকজন নারী পুরুষ জগিংয়ে ব্যস্ত তারপরের দশ মিনিট উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটল সে পার্কের আনাচে কানাচে। এতগুলো বছর পর আবার সে এই পরিচিত সুবাস পেয়েছে এটা কিভাবে ভুল হতে পারে কিন্তু তন্নতন্ন করে খুজেও যখন কাঙ্খিত সেই তনয়ার খোজ মিললো না হতাশ হয়ে হাটুতে ভর দিয়ে জমিনে বসে পড়লো সে।

আহিনা জেনিফারের কাছে আবদার করেছে মায়ের অফিসে যাবে কিন্তু অদিতির আজ বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে তাই জেনিফার আহিনাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে একটা বেকারিতে নিয়ে এসেছে পেস্ট্রি খাওয়াতে। বেকারিতে ঢুকতেই জেনিফারের সাথে ধাক্কা লাগে রিফাতের।
– এই যে মিস দেখে হাটতে পারেন না?
– আপনি কি চোখ বাড়িতে রেখে এসেছেন মিস্টার?
রিফাতের কথার বিপরীতে তেতে উঠলো জেনিফার। আহিনা বড় বড় চোখে দুজনের ঝগড়া দেখছে।এমন সময় পিছন থেকে ভারী পুরুষালী আওয়াজে দুজনে থেমে গেলো।
– সমস্যা কি?
আহিনা সহ রিফাত এবং জেনিফার তাকিয়ে দেখলো সাদা হাফপ্যান্টের সাথে গ্রে কালারের হুডি পরে রঙ্গন দাড়িয়ে আছে যদিও মাস্কের কারণে আহিনা আর জেনিফার তার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না।
– জেনি আন্টি আর ওই আংকেল ঝগড়া করছে।
আহিনা তার বাচ্চা বাচ্চা কণ্ঠে রঙ্গনকে বলল।রঙ্গন আহিনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় কিন্তু মুহুর্তেই কুচকানো ভ্রুদ্বয় নিজ স্থানে ফিরে আসে। আহিনার ছোট্ট আদুরে মুখটার সাথে ওই চোখদুটোও কেমন জানি পরিচিত লাগছে তার কাছে। হাটুমুড়ে বসে পড়ে আহিনার সামনে সে নিজের শক্তপোক্ত হাতদুটো দিয়ে আহিনার কোমল সুশ্রী মুখটা আলতো করে ছুয়ে দিলো সে।
– তোমার নাম কি বেবী?
– আহিনা।তোমার নাম কি আংকেল?
– রঙ্গন।
আরো কিছু বলতে নিবে কিন্তু তার আগেই জেনিফারের ফোনে অদিতির ফোন আসে।
– আহি মামনি চলো মাম্মাম ফোন করেছে।
কথাটা বলে রিফাতকে চোখ রাঙিয়ে আহিনাকে নিয়ে জেনিফার চলে গেলো।রঙ্গন এখনো উদাস চোখে আহিনার চলে যাওয়া দেখছে। তারপর নিজেই ভাবলো পৃথিবীতে একরকম চোখের কত মানুষ আছে। কথাটা ভেবেই দুপাশে মাথা নাড়িয়ে প্রস্থান করলো সে।

কাকতালীয় ভাবে পরদিন সকালে রঙ্গনের সাথে আহিনার আবার দেখা হয়। রঙ্গন তখন পার্কে দৌড়াচ্ছে হঠাৎ পরিচিত বাচ্চা কণ্ঠ শুনে থেমে যায় সে।
– রঙ্গন আংকেল????
আহিনার ডাকে পিছু ফিরে দেখে গতকালের কিউট বাচ্চাটা হাত নেড়ে ডাকছে। রঙ্গন এগিয়ে গেলো হাটুতে দুই হাত ভর দিয়ে নিচু হয়ে বলল,
– আমাকে চিনলে কিভাবে বেবী?
– তুমি অনেক হ্যান্ডসাম তোমার মত এরকম হ্যাণ্ডসাম কেউ নেই পার্কে।
মাক্সের আড়ালে রঙ্গনের হাসিটা আহিনা দেখতে পেলো না রঙ্গন আহিনাকে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসে পড়লো।
– তুমি সব সময় মাক্স পরো আংকেল?
– হ্যা।
– আমি তোমাকে দেখবো।
– আমাকে দেখে কি করবে বেবী?
– যদি কখনো তুমি মাক্স আর হুডি ছাড়া আসো আমি তো তোমাকে চিনতে পারবো না।
রঙ্গন হুডির টুপিটা আর একটু সামনে টেনে দিলো তারপর মাক্স খুলে হাসিমুখে আহিনার দিকে তাকালো আহিনা অবাক হয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল ,
– মিস্টার আর আর!!!
রঙ্গন দ্রুত মাক্স পরে আহিনার ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলল,
– হুস বেবী কেউ শুনতে পেলে সমস্যা হবে।
– কি সমস্যা আংকেল?
– সবাই এসে ভীড় করবে ছবি তুলতে চাইবে তখন কিন্তু তুমি আমি এভাবে গল্প করতে পারবো না।
আহিনা ভাবুক হয়ে বলল,
– তাহলে আমি আর চিল্লাবো না।
কথাটা বলে আহিনা টুপ করে রঙ্গনের কোলের উপরে বসে পড়ল রঙ্গন অবাক হলেও হাত দিয়ে আগলে নিলো আহিনাকে। আহিনা হুডির টুপির ভিতর দিয়ে রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরলো এক হাত দিয়ে আরে এক হাত দিয়ে রঙ্গনের মাক্স একটু নামিয়ে থুতনিতে রাখলো তারপর গুটুর গুটুর করে তাকালো রঙ্গনের মুখের দিকে। রঙ্গন হেসে বলল,
– কি দেখছো?
– তুমি জেসিয়ার ফটো কার্ডে যেমন দেখতে ছিলে এখন তার থেকে বেশি সুন্দর।
তারপর আহিনা নিজেই রঙ্গনের মাক্স পরিয়ে দিয়ে কোল থেকে নেমে বেঞ্চে বসে পড়লো গাল ফুলিয়ে।রঙ্গন ওর কিউট অভিব্যক্তি দেখে গাল টেনে দিলো।
– ছবির থেকে আমি বেশি সুন্দর এটার জন্য মন খারাপ তোমার?
আহিনা মাথা দুলিয়ে বুঝালো না।রঙ্গন জিজ্ঞেস করলো,
– তাহলে?
– তোমার কনসার্টে বাচ্চারা যেতে পারে না কেন? তুমি জানো আমি আর জেসিয়া তোমার কনসার্টে যেতে চাই কিন্তু বাচ্চা বলে আমাদের নিবে না।
রঙ্গন হেসে ফেলল তারপর বলল,
– অনেক মানুষ হয় তারপর অনেক জোরে মিউজিক বাজে তোমাদের মত কিউট বাবুরা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এজন্য নেয় না।
– এজন্য আমি আর জেসিয়া বড় হয়ে একসাথে তোমার কনসার্টে যাব প্ল্যান করেছি।
– ভেরী গুড।
– জানো আইডিয়াটা মাম্মাম দিয়েছে।
হঠাৎ নারীকণ্ঠে দুজনের গল্পের সুতো কেটে গেলো।
– আহি মামনি এদিকে কেনো এসেছো কতোক্ষণ ধরে তোমাকে খুজছি জানো?
জেনিফার হাপাতে হাপাতে বলল।
– আমি রঙ্গন আংকেলকে দেখে এখানে এসেছি।
– আর কখনো না বলে আসবে না জানো আন্টি কত ভয় পেয়েছি।
জেনিফারের কথা শুনে রঙ্গনও আহিনাকে বলে উঠলো,
– ভেরী ব্যাড বেবী এরকম আর কখনো করবে না বুঝেছো। একা একা কোথাও যাবে না।
– সরি স্যার আহি কি বেশি জ্বালাতন করেছে?
– না সী ইজ ভেরী কিউট আন্ড সুইট গার্ল।
জেনিফার এবার আহিনাকে বলল,
– চলো মামনি বাসায় যেতে হবে।
আহিনা মন খারাপ করে বলল,
– টাটা আংকেল।
রঙ্গন আহিনার মাথার চুল এলোমেলো করে বলল,
– টাটা বেবী।

রাতে রঙ্গন তার বেডরুমের বিশাল ছাদ ব্যালকনিতে গীটার হাতে বসে আছে।বাচ্চা যে সে খুব পছন্দ করে তেমন নয় তবে আহিনা তাকে কেন যেনো টানছে। আহিনার চোখ দুটো দেখলে হৃদয়পটে লুকিয়ে থাকা এক রমণী যেনো মস্তিষ্কে প্রখরভাবে হানা দেয়।আর ভাবতে পারছে না রঙ্গন বেপরোয়া ভাবে গীটারে সুর তুললো সে……

আলো, আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না
চাঁদের আলো, তুমি কখনো আমার হবে না
হবে না, হবে না, হবে না
রোমন্থন করি ফেলে আসা
দৃশ্যপট স্বপ্নে আঁকা
লুকিয়ে তুমি কোন সুদূরে
হয়তো ভবিষ্যতে আড়ালে
ঘাসের চাদরে শুয়ে একা
আকাশের পানে চেয়ে জেগে থাকা
তবে আজ এত একা কেন?
আলো হয়ে দূরে তুমি…….!

……….চলবে?