#অদিতির_যবনিকা -০৩
#তিশা
– মাম্মাম জানো পার্কে রঙ্গন আংকেলের সাথে আবার দেখা হয়েছিলো।
রঙ্গন নামটা শুনে অদিতি ঘরের বাইরে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এলো।
– রঙ্গন আংকেল?
– হ্যা তোমাকে কাল বলেছিলাম না পেস্ট্রি খেতে গিয়ে এক মাক্স পরা আংকেলের সাথে দেখা হয়েছিলো কাল তো তোমাকে নাম বলতে ভুলে গেছিলাম ওই আংকেলের নাম রঙ্গন আংকেল।
অদিতি একটু হতাশই হলো। মনে মনে ভাবলো পৃথিবী এত ছোট কেন! চিন্তা করলো কনসার্ট শেষ হলেই তো রঙ্গন চলে যাবে তাহলে ওর সাথে দেখা হওয়ার আর কোন সুযোগ নেই। তারপর আবার ভাবলো অন্য কোন রঙ্গন নয় তো! মাকে ভাবুক হতে দেখে আহিনা মায়ের গলা জড়িয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
– মাম্মা জানো রঙ্গন আংকেলই আর আর!
মনের মধ্যে যতটুকু কনফিউশান ছিল এবার পুরোটায় দূর হলো অদিতির।আহিনার সাথে যে রঙ্গনের দেখা হয়েছিল সেই রাফিয়ান রঙ্গন। মেয়ের গালে আদর দিয়ে বলল অদিতি,
– তাহলে তো কনসার্টে যেতে না পারার জন্য আর কোন দুঃখ নেই আর আর কে সামনে থেকে দেখে ফেলেছো।
আহিনা খুশি হয়ে বলল ,
– হ্যা আর আংকেল আমাকে আদরও করেছে জানো।
অদিতি হাসলো মেয়ের কথায় তারপর ভাবুক হলো অদিতি ‘রঙ্গন যে ভালোবাসা ছড়াতেই জানে কিন্তু সেই ভালোবাসা লুফে নেয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না।’
পরদিন সকালে আহিনা খুব করে চাইলো রঙ্গনের সাথে দেখা করতে কিন্তু মাম্মাম কিংবা তার প্রিয় জেনি আন্টিও যখন তাকে নিয়ে গেলো না তখন সে গাল ফুলিয়ে ঘরের এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে রইলো অদিতি ভাবলো মেয়ের প্রিয় ব্রেকফাস্ট বানিয়ে তার মন ভালো করবে।
রঙ্গন দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ক্লান্ত হয়ে একটা বেঞ্চে বসে পড়লো দুই হাত মেলে দিয়ে আকাশের দিকে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলো। হঠাৎ খেয়াল করলো কেউ তার হুডি ধরে টানছে তাকিয়ে দেখলো আহিনা তার ছোট্ট হাত দিয়ে তার হুডি ধরে টানছে।
– বেবী তুমি আজ আবার একা একা এসেছো?
আহিনা মাথা দুলিয়ে হ্যা জানালো।
– কাল না তোমাকে বুঝালাম একা একা না আসতে?
– আমি তোমাকে মিস করছিলাম আংকেল। মাম্মাম আর জেনি আন্টিকে কত করে বললাম তোমার সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসতে কিন্তু এলো না তাই তো একা একা এলাম।
রঙ্গন চিন্তিত হলো তারপর কিছু একটা ভেবে বলল,
– তুমি তোমাদের বাসা চিনো?
আহিনা হ্যা জানালো।
আহিনার জন্য ক্রিমি পাস্তা বানিয়েছে অদিতি।পাস্তার বাটি হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমের টেবিলে রেখে সে আহিনাকে ডাকতে গেলো। কিন্তু পুরো বাড়ি খুজেও যখন আহিনাকে পেলো না তখন বুকটা কেঁপে উঠলো তার।তারপর মনে পড়লো আহিনা তো রঙ্গনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জেদ করেছিলো একা একা চলে যায়নি তো! হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো সে। দরজা খুলতেই সামনে আহিনাকে দেখতে পেলো সে। হাটু ভেঙে বসে পড়লো অদিতি দুইহাতে আকড়ে নিলো আহিনার ছোট্ট তনু।
রঙ্গন এখনো পাথরের মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে দরজায়।এতগুলো বছর যার জন্য যাযাবরের মত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছে সেই রমণী আজ তার সামনে। তার মানে আহিনা অদিতির মেয়ে এজন্য আহিনার চোখগুলো তাকে এতো টানতো।আর ভাবতে পারছে না সে।
– মিস চড়ুই!!
রঙ্গনের মৃদু কণ্ঠে অদিতির চেতনা ফিরলো।আহিনার দুশ্চিন্তায় এতক্ষণ পিছনে দাড়িয়ে থাকা রঙ্গনকে খেয়ালই করেনি সে। হুডি আর মাক্স পরা রঙ্গনকে চিনতে এতটুকুও ভুল হলো না তার।কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো কোকড়া চুল সেই কৃষ্ণগহ্বরের মত গভীর দুটি চোখ চোখের পাশের সেই আলোচিত ছোট্ট কাটা দাগ। অদিতি উঠে দাড়ালো ধীরে ধীরে।
– রঙ্গন?!
রঙ্গন ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলো ,
– আহিনা আপনার মেয়ে মিস চড়ুই?
অদিতি মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।
– তুমি রঙ্গন আংকেলকে চিনো মাম্মাম?
আহিনার কথায় দুজনের ধ্যান ভঙ্গ হলো।রঙ্গন আহিনাকে বলল,
– আজ আসি বেবী তুমি আর কক্ষনো একা বের হইয়ো না ওকে?
আহিনা টুপ করে রঙ্গনের গালে আদর দিয়ে বলল টাটা। রঙ্গন একটা শুকনো হাসি দিয়ে আহিনার কপালে আদর দিয়ে আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না।
অদিতি রঙ্গনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে আহিনার দিকে তাকালো।কোমরে দুই হাত দিয়ে রাগী রাগী মুখে বলল,
– তুমি লুকিয়ে বাসা থেকে কেন বেরিয়েছো? তোমাকে না কতবার বলেছি একা একা কোথাও যাবে না?
আহিনা মাথা নিচু করে হাত দিয়ে নিজের দুই কান ধরে বলল,
– সরি মাম্মাম। আমি তো রঙ্গন আংকেলকে মিস করছিলাম তাই গেছিলাম তোমাকে এত করে বললাম তুমি তো নিয়ে গেলে না।
অদিতি মুখে রাগ বজায় রেখেই বলল,
– তাই বলে একা একা বেরিয়ে যাবে? যাও মাম্মামের তোমার সাথে আড়ি আজ থেকে। মাম্মাম কথা বলবে না আহি মনির সাথে।
কথাটা বলে অদিতি ঘরের ভিতরে যেতে লাগলো ছোট্ট আহিনা সরি বলতে বলতে মায়ের পিছু নিলো।
নীরবেই,অভিমানে নিভৃতেই
করছো,তিলে তিলে নিজেকে শেষ
কেন বলো,পৃথিবীতে কেউ কারো নয়
হয়ে গেছে, ভালোবাসা নিঃশেষ
বন্ধু~ভেঙে ফেল এই কারাগার
খুলে দাও~সে হৃদয়ে প্রণয়েরই দ্বার
আ,হতেও পারে,এই দেখা শেষ দেখা
হতেও পারে,এই গানই শেষ গান
হতেও পারে, এই দেখা শেষ দেখা
হতেও পারে,এই গানই শেষ গান।
হতেও পারে আমাদের এই মিলনমেলাই এক ইতিহাস
হতেও পারে
তোমার শীতল চোখটাই যেন এক উচ্ছ্বাস
হতেও পারে বিষাদের এই জনপদ প্রণয়ের তীর্থ
হতেও পারে তোমার একটু নীরবতায় সে ব্যর্থ
হতেও পারে~এই দেখা শেষ দেখা
হতেও পারে,এই গানই শেষ গান
গান শেষ করে প্রিয় গীটারটা বিছানায় ছুড়ে মারলো রঙ্গন। তীব্র হাসফাস লাগছে তার। সে তো ধারণা করেই রেখেছিলো মিস চড়ুই অন্য কারো সংসার করছে তাহলে আজ আহিনার মা হিসেবে তাকে দেখে কেন তার হৃদপিণ্ড এফোড় ওফোড় হয়ে যাচ্ছে।যে অনুভূতি মাটি চাপা দেয়ার জন্য বহু বছর আগে বাংলাদেশ ছেড়েছিলো সে সেই অনুভূতি এতগুলো বছরের পর কেন জাপানের মাটিতে নেমে এসেছে।পুনরায় গীটার আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ব্যালকনির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। গান আর নিকোটিন ছাড়া আর কোনকিছু নেই তার জীবনে যার মাধ্যমে সে চিত্তপটের অব্যক্ত অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে।
গাড়িতে গাল ফুলিয়ে বসে আছে আহিনা।পাশে বসে মুচকি মুচকি হাসছে জেনিফার।আজ আহিনার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে তাই সে তার প্রিয় রঙ্গন আংকেলের সাথে পার্কে দেখা করতে যেতে পারেনি। হঠাৎ গাড়ির জানালা দিয়ে রিফাতকে দেখে আহিনা চিল্লিয়ে বলল,
– আন্টি গাড়ি থামাতে বলো প্লিজ।
আহিনার চিল্লানোতে জেনিফার ড্রাইভারকে থামাতে বলল।আহিনা গাড়ির দরজা খুলে রিফাতের দিকে দৌড়ে গেলো।
– এই যে ঝগড়ুটে আংকেল আমার রঙ্গন আংকেল কোথায়?
রিফাত আহিনার কথা শুনে নিচে তাকিয়ে দেখলো আহিনা কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।রিফাত প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জেনিফার খ্যাক করে উঠলো ,
– আহি মামনি এসব ঝগড়ুটে লোকের সাথে কথা বলতে হয় না।
বিনিময়ে রিফাতও প্রতিক্রিয়া দেখালো। আহিনা গাল ফুলিয়ে ঝগড়া দেখতে লাগলো দুজনের গোল গোল আখি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো আশেপাশে রঙ্গন আছে কি না একপর্যায়ে পেয়েও গেলো রিফাতের পিছনে বেশ কিছুটা দূরের এক এ টি এম বুথ থেকে রঙ্গন বের হচ্ছে।নেত্র যেনো খুশিতে নেচে উঠলো আহিনার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ছুটে যেয়ে রঙ্গনের পা জড়িয়ে ধরলো আহিনা রঙ্গন চমকে নিচে তাকিয়ে দেখলো আহিনা হাসি হাসি মুখে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।আজ আহিনাকে দেখে রঙ্গনের হৃদপিণ্ডের পুরনো আ’ঘাতটা বুঝি জেগে উঠলো। হাসিমুখের আড়ালে নিজের বিষাদ লুকিয়ে ফেললো সে চটপট।
– বেবী আজ আবার একা এসেছো নাকি সাথে কেউ আছে?
আহিনা তর্জনী তুলি পিছনে দেখালো রিফাত আর জেনিফারকে আবার ঝগড়া করতে দেখে বিরক্ত হলো সে।আহিনাকে গাড়ির ডিকির ওপরে বসিয়ে দিলো সে তারপর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আহিনার হাতে দিয়ে বলল,
– তুমি যখন বড় হয়ে আমার কনসার্ট দেখতে চাইবে এই কার্ডের নাম্বারে ফোন দিয়ে যোগাযোগ করবে বুঝেছো।
আহিনা কার্ডের দিকে একবার তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত চোখে রঙ্গনের দিকে তাকালো। রঙ্গনের বিষাদ মেশানো হাসি আহিনার বোধগম্য হলো না।
– বাবাই যখন ফিরে আসবে তখন বাবাইকে বলবো তোমার কনসার্টে নিয়ে যেতে।
রঙ্গন একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল,
– তোমার বাবাই কোথায় গেছে?
– তা তো জানি না তবে মাম্মাম বলেছে বাবাইয়ের কাজ শেষ হলে ফিরে আসবে।
রঙ্গন ভাবলো কাজসূত্রে অদিতির স্বামী বোধহয় বাইরে গেছে। তাই একটা হাসি দিয়ে বলল,
– ওকে বেবী তোমার বাবাই আসলে যেয়ো।
আহিনা এবার মুখ গোমড়া করে বলল,
– মাম্মাম সব সময় বলে বাবাই আসবে কিন্তু জানো আংকেল বাবাই আর আসে না।
তারপর একটু উদাস হয়ে বলল,
– কি জানি কবে কাজ শেষ হবে বাবাইয়ের!
এবার রঙ্গনের ললাটে ভাজ পড়লো। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার বাবাই তোমার আর মাম্মামের সাথে থাকে না?
– না তো।
আহিনা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো তার আগেই জেনিফার এলো।
– মামনি চলো স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
রঙ্গন একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
– সব সময় বাচ্চাটাকে এরকম ছেড়ে রাখেন কেন? খেয়াল রাখবেন না ঠিকভাবে?
– আপনার ওই হুলোমুখো সেক্রেটারিই তো পা বাধিয়ে ঝগড়া করছিলো তাছাড়া আমি দেখলাম আপনার সাথে গল্প করছে এখন স্কুলের দেরি হচ্ছে তাই ডাকতে এলাম।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে আহিনার হাত ধরে জেনিফার নিয়ে গেলো। যেতে যেতে আহিনা পিছু ফিরে রঙ্গনকে হাত নাড়িয়ে টাটা দিলো।
রিফাত এসে রঙ্গনের পাশে দাড়ালো রঙ্গন ভ্রু কুচকে বলল,
– ঝগড়া করা স্বভাব তো তোর ছিল না এরকম কোমর বেধে ঝগড়া কোথা থেকে শিখলি?
– ওই মহিলায় ঝগড়ুটে ভাই।
রঙ্গন হাত উচু করে রিফাতকে থামিয়ে দিলো তারপর গাড়িতে বসতে বসতে বলল,
– আহিনা আর ওর মায়ের সমস্ত তথ্য চাই আমার।
রিফাত গাড়িতে বসে দরজা লাগাতে ভুলে গেলো কি বলছে রঙ্গন এটা? সে কি ঠিক শুনছে? রঙ্গন কোন নারীর ব্যাপারে জানতে চাইছে? মনে মনে কথাগুলো ভেবে নিজেকে চিমটি কাটলো নাহ ব্যথা তো লাগছে তাহলে এটা সত্যি! রিফাতকে উদ্ভ্রান্তের মতো দেখে রাগত স্বরে বলল রঙ্গন,
– হাবার মতো তাকিয়ে না থেকে গাড়ি স্টার্ট দে।
পরদিন সকালে আহিনার স্কুলের সামনে অপেক্ষা করছে রঙ্গন। রঙ্গনের অবচেতন মন বুঝতে পারছে না তার ভিতরে এক দশক আগের সেই উন্মাদনা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।আহিনা গাড়ি থেকে নেমেই নীল রঙা হুডি পরিহিত পুরুষকে ঠিকই চিনলো ছুটে গেলো সেদিকে। রঙ্গনও আহিনাকে তার দিকে ছুটতে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলো আহিনা দৌড়ে নিজের ছোট্ট শরীরটা রঙ্গনের দিকে ছুড়ে দিলো রঙ্গনও দুহাতে লুফে নিলো আহিনাকে।জেনিফার আহিনাকে রঙ্গনের সাথে দেখে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে হাসলো ,আহিনা রঙ্গনকে বেশ পছন্দ করে এজন্য কিছু না বলে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করতে লাগলো।আহিনা রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?
রঙ্গন মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো আহিনা অবাক হওয়ার মত করে মুখে হাত দিলো। রঙ্গন আহিনার কাণ্ডে হেসে ফেলল তারপর বলল,
– বেবী একটা কথা বলো তো?
আহিনা মাথা নাড়িয়ে জানতে চাইলো কি? রঙ্গন একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে বলল,
– তোমার বাবাই কোথায় থাকে?
…………..চলবে?
বিঃদ্রঃ সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।