অদিতির যবনিকা পর্ব-০৭

0
13

#অদিতির_যবনিকা -০৭
#তিশা

বিগত তিনদিন রঙ্গন ইউরোপে আছে তার কনসার্টের কারণে। আহিনার সাথে ফোনে কথা হলেও তাতে আহিনার মন ভরছে না। মন খারাপ করে পার্কে বসে আছে সে। জেনিফার মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
– তোমার রঙ্গন আংকেল তো দুইদিনের মধ্যে চলে আসবে বলল তাহলে এত মন খারাপ কেন?
– আজকে একটা বাবাই থাকলে আংকেলকে এত মিস করতাম না আন্টি।
গাল ফুলিয়ে আহিনা বলল।জেনিফার ঠোট চেপে হাসলো তারপর বলল,
– তাহলে রঙ্গন আংকেলের মত বাবাই চাই তোমার?
আহিনা গোমড়া মুখে মাথা দুলিয়ে হ্যা জানালো। তারপর হঠাৎ উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল,
– রঙ্গন আংকেলকে বাবাই বানালে কেমন হবে জেনি আন্টি?
আহিনার কথায় জেনিফার মনে মনে হাসলো তারপর আহিনার গাল টেনে বলল,
– খুবই ভালো হয় কিন্তু মাম্মাম আর রঙ্গন আংকেল যদি রাজি না হয়?
আহিনা গভীর চিন্তায় পড়লো তারপর দুঃখী আওয়াজে বলল,
– কান্নাকাটি করলে রঙ্গন আংকেল রাজি হবে কিন্তু মাম্মাম পিট্টি দেয় যদি।
জেনিফার একটা প্রশান্তির শ্বাস ছাড়লো। বড়রা মানুষ চিনতে ভুল করলেও বাচ্চারা কখনো মানুষ চিনতে ভুল করে না। কত সহজেই আহিনা বলে দিলো সে একটু কাদলেই রঙ্গন আংকেল রাজি হয়ে যাবে তার মানে রঙ্গনের প্রতি আহিনার এই বিশ্বাস এমনি এমনি হয়নি তার কাছ থেকে আহিনা সেই ভালোবাসা ভরসা পেয়েছে তাই হয়েছে।জেনিফার এবার আহিনার চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
– আগে রঙ্গন আংকেল আসুক তারপর চিন্তা করো এখন চলো বাসায় ফিরতে হবে।
– রঙ্গন আংকেলকে একটা ফোন দাও তো।
– একটু আগে না কথা বললে?
– উহু আন্টি ফোন দাও না একটু।
আহিনার আদুরে আবদারে জেনিফার রঙ্গনকে ফোন দিলো। রঙ্গন তখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হবে এমন সময় ফোন বেজে উঠলো তার জেনিফারের নাম্বার দেখে বুঝলো আহিনা ফোন দিয়েছে।
– হ্যা বেবী বলো।
– আংকেল তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো আমার তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
আহিনার এমন কথায় ঠোট এলিয়ে হাসলো সে। তারপর আদুরে ভাবে বলল,
– কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা আমার আহি বেবীর?
– উহু তুমি আসো তো আগে তারপর বলবো।
– ওকে আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আমার আহির কাছে চলে যাবো।
– ওকে টাটা।
আহিনা ফোন কেটে দিতেই রঙ্গন মুচকি হেসে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে রিফাতকে বলল,
– আগামীকাল কনসার্ট শেষেই আমরা জাপানের জন্য রওনা দেব সেই ব্যবস্থা কর।
– ভাই কনসার্ট শেষে রাতটা রেস্ট নিলে হতো না?
রঙ্গন শীতল চোখে তাকাতেই রিফাত মাথা নাড়িয়ে ওকে বলে বেরিয়ে গেলো।

আরাফ আজ ভীষণ খুশি নামকরা বিজনেসম্যান রওনক চৌধুরীর কোম্পানি নিজ থেকে তার সাথে বিজনেস কোলাব করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয় রওনক চৌধুরীর ছেলে নাকি নিজে এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত। যদি কোনভাবে তাদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাহলে তাকে আর পায় কে। লোকমুখে শুনেছে রওনক চৌধুরীর নাকি অনেক ক্ষমতা একসময়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডেও নাকি খুব দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।যদি কোনভাবে এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায় তাহলে আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হবে না।

আহিনা তার নতুন সাইকেল নিয়ে পার্কে এসেছে আজ। রঙ্গন তাকে বলেছে আজ আসবে কিন্তু আধাঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও যখন রঙ্গন এলো না তখন আহিনা হাত পা ছুড়ে ঘাসের উপর বসে পড়লো। অভিমানী স্বরে বলল,
– রঙ্গন আংকেল প্রমিস ব্রেক করেছে আমি আর তার সাথে কথা বলবো না।
বলেই দুই হাত বুকের কাছে ভাজ করে ঠোট ফুলিয়ে বসে থাকলো।
– আহি বেবী সত্যিই রঙ্গন আংকেলের সাথে কথা বলবে না?
রঙ্গনের কণ্ঠ শুনে মুহূর্তেই আহিনা তার রাগ অভিমান ভুলে পিছু ফিরে উচ্ছ্বসিত হয়ে রঙ্গনের দিকে ছুটে গেলো। রঙ্গনও পরম আদরে তাকে জড়িয়ে নিলো।
পুরোটা সকাল আহি তার রঙ্গন আংকেলের সাথে সাইকেল চালিয়ে কাটালো। রবিবার হওয়ার সুবাদে আহিনার স্কুলে যাওয়ারও টেনশন নাই। দুজনে যখন সাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত তখন বেঞ্চে বসে পড়লো। আহিনা রঙ্গনের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
– তুমি এখন আমার সাথে আমার বাসায় যাবা।
রঙ্গন ভ্রু কুচকে বলল,
– কেন?
– তোমাকে না সেদিন ফোন দিয়ে বললাম তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
রঙ্গনের ভ্রুদ্বয় শিথিল হয়ে এলো। সে তো ভেবেছিলো আহিনা সাইকেল চালানো শেখার জন্য তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছিলো।

– স্যার আপনার নির্দেশমতো আরাফ মাহমুদের কোম্পানিতে প্রোপোজাল পাঠানো হয়েছে।
সেক্রেটারির কথায় সেদিকে মনোযোগ দিলেন রওনক চৌধুরী। মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– তোমাকে যে আরাফ মাহমুদের সমস্ত তথ্য জোগাড় করতে বলেছিলাম সেটার কি হলো?
– স্যার আরাফ মাহমুদই অদিতি ম্যামের সাবেক স্বামী এবং আহিনার বাবা। অদিতি ম্যাম প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় আরাফ মাহমুদ তার বর্তমান স্ত্রী রুহির সাথে প’রকীয়ায় জড়ান সেটা জানার পরেই অদিতি ম্যাম ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করেন এবং মেয়ের সংসার ভাঙার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মতিউর সাহেব হার্ট অ্যাটাক করে মা’রা যান।
রওনক সাহেব পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তারপর বললেন ,
– আরো খোঁজ নাও তার বৈধ অবৈধ কোন কোন ব্যবসা আছে ,কোথায় কোথায় শেয়ার আছে কাদের সাথে পার্টনারশিপ আছে ,সব খবর আমার চাই।
আদেশ পেয়ে সেক্রেটারি প্রস্থান করলেন।রওনক সাহেব বাকা হেসে ভাবলেন ‘ছেলে আমার প্রেয়সীর হয়ে প্রতিশোধ নিতে চাইছে তাহলে।ঠিক আছে বাবা হিসেবে আমারও দায়িত্ব ছেলের রাস্তা সহজ করে দেওয়া।’

আহিনা রঙ্গনকে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে এসেছে। অদিতি দরজা খুলে আহিনার সাথে রঙ্গনকে দেখে জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে চাইলো।
– সরো তো মাম্মাম আমরা খুব টায়ার্ড অনেক সাইকেল চালিয়েছি আজ।
অদিতি দরজা থেকে সরে দাড়ালো। আহিনা রঙ্গনকে টানতে টানতে নিয়ে সোফায় বসলো। অদিতি দরজা বন্ধ করে বিপরীত পাশের সোফায় বসলো। জেনিফার সোজা নিজের রুমে চলে গেছে সে বুঝতে পারছে আহিনা আজ বো’মা ফাটাবে। আহিনা অদিতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– তুমি রঙ্গিন আংকেলকে বিয়ে করে নাও মাম্মাম প্লিজ।
আহিনার স্বাভাবিক এই কথাটা যেনো তার সামনে বসা দুই মানব মানবীর মধ্যে দাবানল জ্বালিয়ে দিলো। রঙ্গন চমকে একবার আহিনার দিকে তাকালো আর একবার অদিতির দিকে তাকালো। অদিতিও বিস্ময় নিয়ে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে আছে। রঙ্গন একটু ঘাবড়ালো মনেমনে।ও ভয় পাচ্ছে যদি অদিতি তাকে ভুল বোঝে যদি ভাবে রঙ্গনই আহিনাকে এসব শিখিয়েছে।
– এসব তুমি কি বলছো আহি?
– ঠিক বলছি মাম্মাম তুমি রঙ্গন আংকেলকে বিয়ে করলে আমি বাবাই পেয়ে যাবো।
অদিতি এবার কড়া কণ্ঠে আহিনাকে জিজ্ঞেস করলো,
– এসব তোমাকে কে বলেছে?
– আমার বন্ধু রেননও এভাবে বাবাই পেয়েছে আমারও বাবাই চাই প্লিজ মাম্মাম।
আহিনা ছলছল চোখে কথাগুলো বলে রঙ্গনের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো।
– তুমি তো আমাকে বাবাইদের মত আদর করো আমার সব কথা শোনো আবার সাইকেলও চালানো শিখাও তাহলে প্লিজ আমার বাবাই হয়ে যাও না।
কথাগুলো বলে আহিনা রঙ্গনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। রঙ্গনের হৃদপিণ্ডের গতি বুঝি বেড়ে গেলো। এরকম অনুভূতি কি আগে তার কখনো হয়েছে? কই মনে পড়ছে না তো! খুবই নমনীয়ভাবে রঙ্গন দুহাতে আগলে নিলো আহিনাকে। অদিতি স্তব্ধ হয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করলো। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো সে।
– আহি মামনি আমার কাছে আসো রঙ্গন আংকেল এখন বাসায় যাবে।
অদিতির কথায় আহিনা কান্নারত অবস্থায় বলল,
– না আংকেল আহি বেবীকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।
– আহিনা!!
ধমকে উঠলো অদিতি। রঙ্গন শীতল চোখে অদিতির দিকে তাকালো তারপর দাতে দাত চেপে বলল,
– খবরদার আহিনাকে ধমকাবেন না।
সেই পুরনো রগচটা রঙ্গনকে দেখে অদিতি বুঝি ভড়কালো একটু। রঙ্গন আহিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– বেবী তুমি জেনি আন্টির কাছে যাও। আংকেল একটু মাম্মামের সাথে কথা বলবে।
আহিনা রঙ্গনকে ছেড়ে যেতে নারাজ। রঙ্গন অনেক আদর করে বুঝিয়ে তাকে জেনির কাছে পাঠালো।

– আহিনার সাথে তুমি আর দেখা করবে না।
রঙ্গন অদিতির কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুচকি হাসলো তারপর অদিতির সামনে দাড়িয়ে মাথা নিচু করে অদিতির চোখে চোখ রেখে গম্ভীর স্বরে বলল,
– আহিনার সাথে দেখা তো করবই সেই সাথে তার মায়ের সাথেও দেখা করবো।
অদিতি চোখ রাঙালো রঙ্গনকে। রঙ্গন বিনিময়ে হাসলো সেই হাসিতে অদিতির মেজাজ আরো খারাপ হলো। আংগুল উচিয়ে রঙ্গনকে কিছু কথা শোনাতে উদ্যত হলে রঙ্গন সেই সুযোগ না দিয়ে আগেই বলল,
– আমার আহি বেবী কি বললো শোনেন নি তার রঙ্গন আংকেল তার সব কথা শোনে তাহলে এই কথা অগ্রাহ্য করে কিভাবে? একবার আপনার কথা শুনেছি সরে গিয়েছিলাম আপনার জীবন থেকে কিন্তু যাওয়ার আগে কি বলেছিলাম আপনি ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি।আর এবার তো চাওয়াটা আমার দ্বিগুণ। আমি সেই উনিশ বছরের রঙ্গন নই যে আপনার সামাজিকতার ফালতু লজিক মেনে সরে যাবো।মাথা ঠাণ্ডা করুন রঙ্গনের রঙ্গিন রূপ দেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।
কথাগুলো বলে রঙ্গন আর দাড়ালো না গটগট করে বেরিয়ে গেলো।
রঙ্গন যেতেই অদিতি ধপ করে বসে পড়লো। ভাবলো পাগল সারাজীবন পাগলই থাকে। তারপর হঠাৎ চিত্তপটে হানা দিলো পুরনো কিছু ভয়ংকর কথা “আজ আমি আপনার কথা মেনে চলে যাচ্ছি মিস চড়ুই। আপনার ত্রিসীমায় আর আমাকে দেখতে পাবেন না কিন্তু যদি নিয়তি দ্বিতীয়বার আমাকে আপনার সামনে দাড় করায় সেদিন আমি আর কোন কিছুর পরোয়া করবো না। হয় সবকিছু জ্বালিয়ে দেব নয়তো নিজে জ্বলবো।”

এ কার জীবন আমার কাঁধে?
আমি বইতে আর পারছি না
বেকার এ মন আবেগে বাঁধে
আমি সইতে পারছি না
এ কেমন ভালোবাসা?
কইতে পারছি না

মায়া, মায়া, মহামায়ার ভিতর
আমি কে, আমি কে, আমি কে তোর?
মায়া, মায়া, মহামায়ার ভিতর
আমি কে, আমি কে, আমি কে তোর?

সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বেপরোয়া সুর তুলে গান গাইতে গাইতে গীটারটা ছুড়ে দিলো পাশে তারপর হঠাৎ পানিতে ঝাপিয়ে পড়লো রঙ্গন। বেপরোয়া ঝংকার তুললো সুইমিংপুলের স্বচ্ছ পানিতে। আবেগ অনুভূতি হয়তো পানির সাথে ধুয়ে ফেলতে চাইলো। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব! এতগুলো বছর যে আগ্নেয়গিরি সুপ্ত অবস্থায় ধিকি ধিকি জ্বলছিলো আজ বুঝি তা অগ্নুৎপাতে রূপ নিলো।

…………..চলবে?

বিঃদ্রঃ সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।