অদিতির যবনিকা পর্ব-১১+১২

0
16

#অদিতির_যবনিকা -১১
#তিশা

আরাফের সাংসারিক জীবন বেশ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং কথায় কথায় রুহির সাথে ঝামেলা লেগে যাচ্ছে।স্বাভাবিক কোন কথোপকথনও তার সাথে করা যাচ্ছে না। না চাইতেও যেনো আরাফের চিত্তপটে ভেসে উঠলো অদিতির নিষ্পাপ মুখখানা। যত রকম ঝামেলায় থাকুক না কেন অদিতি সবকিছু খুব শান্তভাবে সমাধান করতো। যেকোন জটিল পরিস্থিতিও খুব বিচক্ষণতার সাথে সামলে নিতো। যে অল্প সময় অদিতির সাথে তার সংসার ছিল কোনদিন অদিতিকে রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু কর‍তে দেখেনি আরাফ।এমনকি রুহির ব্যাপারটা জানার পরেও অদিতি ছিলো শান্ত। অন্য কেউ হলে চিৎকার, ঝগড়া, ঝামেলা ,কান্নাকাটি অবশ্যই করতো সেখানে অদিতি ছিলো নিস্প্রভ শীতল।শুধু যাওয়ার আগে বলেছিল ‘মানুষ ক্ষমা করলেও প্রকৃতি কখনো কাউকে ক্ষমা করেনা সঠিক সময়ে প্রত্যেকেই তার কর্মফল পাবে।’ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরাফের বুক চিরে বেরিয়ে এলো হতাশার নিঃশ্বাস।ভাবলো এটাই বুঝি তার কর্মফল পাওয়ার সময়।
আরাফ যখন এসকল ভাবনায় মশগুল তখন একজন কর্মচারী এসে নক করলো। আরাফ হতচকিতে সেদিকে তাকালো।
– স্যার রাফিয়ান রঙ্গন চৌধুরী আগামীকাল বাংলাদেশ আসছেন।
আরাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। কর্মচারীটি চলে যেতেই আরাফ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে চেয়ারে আর একটু আরাম করে বসলো তারপর ভাবলো যাক এত কিছুর মধ্যে তার ব্যবসাটা সাফল্যের মুখ দেখছে।কিন্তু সে বুঝলো না রাফিয়ান রঙ্গন তার জীবনে সুখের বার্তা হয়ে নয় এক ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় হয়ে আসছে এজন্য প্রকৃতি এখন এতো শান্ত।

রাতে রঙ্গন এয়ারপোর্টের জন্য রেডি হয়ে অদিতির বাসায় এলো আহিনাকে বাই বলার জন্য।আহিনা গাল ফুলিয়ে বলল,
– তুমি কিন্তু প্রমিস করেছো সাত দিনের মধ্যে চলে আসবা!
– আসবো তো বাচ্চা।
বেশ কিছুক্ষণ আহিনা আর রঙ্গনের মান অভিমানের দৃশ্য চললো। অদিতিও মাঝে মাঝে আজকাল অবাক হয় আহিনার প্রতি রঙ্গনের ভালোবাসা দেখে।রক্তের সম্পর্ক না হয়েও কি এরকম বাবা হওয়া যায়!

বহুবছর পর বাংলাদেশের মাটিতে পা দিলো রঙ্গন। যার জন্য দেশ ছেড়েছিলো আজ তার জন্যই দেশে এসেছে কিন্তু তাকে রেখে এসেছে অন্য দেশের মাটিতে।এয়ারপোর্টে নামতেই খেয়াল করলো রওনক সাহেবের লোক তার জন্য অপেক্ষা করছে।
– আস সালাম আলাইকুম স্যার আমি রিহান রওনক স্যারের বিডি অফিসের দায়িত্বে আছি।
– আলাকুম আস সালাম।
শান্ত স্বরে জবাব দিয়ে রঙ্গন গাড়িতে উঠে বসলো।গাড়ির মধ্যে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। ড্রাইভারের পাশে রিহান বসা আর পিছনে রিফাত আর রঙ্গন। নীরাবতা ভেঙ্গে রঙ্গন প্রথমে আরাফের বিষয়ে রিহানের কাছে জানতে চাইলো। রিহান একটা নীল রঙ্গের ফাইল রঙ্গনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। রঙ্গন কনফিউজড হয়ে ফাইলটি হাতে নিলো।
– রওনক স্যার আগেই সব তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। এই ফাইলে আরাফ মাহমুদের যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবেন।
রঙ্গনের ঠোট প্রসারিত হলো।সে আন্দাজ করেছিলো বাবা নিশ্চয়ই আরাফের নাড়ি নক্ষত্র বের করেই ছাড়বে। যাক বাবার জন্য হয়ত কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে বেশি বেগ পেতে হবে না।

অফিস থেকে ফিরে অদিতি দেখলো আহিনা ড্রয়িংরুম ভরে খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে টিভিও চলছে কিন্তু সেসবে তার মনোযোগ নেই তার।ঠোট ফুলিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে সে।অদিতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জেনিফারের দিকে তাকালো।
– রঙ্গন স্যারকে মিস করছে। সারাদিন গোমড়া মুখ করে ঘুরে বেড়িয়েছে।
আস্তে করে জবাব দিলো জেনিফার।অদিতি হতাশ হলো তারপর ধীরে ধীরে আহিনার পাশে বসলো।
– আমার বেবীর মন খারাপ?
আহিনা গোমড়ামুখে মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।তারপর বললো ,
– বাবাই কবে আসবে মাম্মাম?
– তোমার বাবাই গেছে এক দিনও হয়নি এখনো ছয়দিন বাকি আছে।
আহিনা এবার বেজায় দুঃখী হলো। অদিতি মুচকি হেসে বললো,
– আজ আহিনা আর মাম্মাম ঘুরতে যাবে।কি? আহি বেবী যাবে?
আহিনার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। হাত তালি দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
– ইয়েহ!!!

ঢাকার এক বিলাশবহুল হোটেলের ভি আই পি সেকশনে মুখোমুখি বসে আছে আরাফ আর রঙ্গন। রঙ্গন সুক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষণ করছে আরাফকে।অপরদিকে আরাফ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। রওনক চৌধুরী এলে একটু চিন্তার বিষয় ছিল কিন্তু রঙ্গনকে দেখে বেশ চিন্তামুক্ত লাগছে তার। একে রঙ্গন অল্প বয়সী তার উপরে প্রথম ব্যবসা সামলাচ্ছে। সেলিব্রিটি মানুষ ব্যবসা আর কি বুঝবে একে তো সহজেই আয়ত্তে আনা যাবে।
রঙ্গন বেশ বুঝতে পারছে আরাফের মনোভাব। মনে মনে হাসলো সে। আরাফ যে তাকে মিষ্টি কথায় বশে আনতে চাইছে দিব্যি বুঝতে পারছে সে।মনে মনে ভাবলো ‘প্রথম চালটা নাহয় তোমার মন মর্জি মতই হোক আরাফ মাহমুদ।’

বাইরে থেকে এসে আহিনা ধুপ করে বসে পড়লো। তারপর রাগ করে জেনিফারকে বলল,
– জেনি আন্টি এক্ষুনি বাবাইকে ফোন দাও আর ভিডিও কল দিবা।
জেনিফার মুচকি মুচকি হেসে রঙ্গনকে ফোন দিলো। অদিতি বিরক্তিকর ভাবে মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো।

রঙ্গন তখন আরাফের সাথেই মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিল।রিফাত এসে ধীর স্বরে বলল,
– ভাই আহি মামনি ভিডিও কল করছে।
রঙ্গন একবার আরাফের দিকে তাকালো তারপর অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে আরাফকে এক্সকিউজ জানিয়ে কল রিসিভ করলো। রঙ্গন ফোন রিসিভ করতেই আহিনার রাগী কিউট মুখশ্রী ভেসে উঠলো স্ক্রিনে।রঙ্গন কিছু বলার আগেই আহিনা তুরতুর করে বলা শুরু করলো,
– তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো বাবাই। জানো মাম্মাম আজ ঘুরতে নিয়ে গেছিলো। মাম্মামের সাথে ঘুরে মজা না। মাম্মাম শুধু বকে এটা করো না এটা ধরো না। জানো আইসক্রিমও কিনে দিলো না। আমার নাকি ঠান্ডা লাগবে। তুমি চলে আসোতো তারপর আহি বেবী আর বাবাই ঘুরবে শুধু।
আহিনার এত্ত নালিশ শুনে রঙ্গন হাসলো। তারপর আদুরে কণ্ঠে বলল,
– বাবাইয়ের আর অল্প একটু কাজ আছে তারপরেই বাবাই তার বেবীর কাছে চলে আসবে। তারপর বাবাই আর বেবী আইসক্রিম পার্টি করবে। ওকে বেবী?
আহিনার গোমড়া মুখে খুশির আলো দেখা দিলো। ওকে বলে ফোন কেটে দিলো। আরাফ এতক্ষণ রঙ্গন আর আহিনার পুরো কথাটায় শুনছিলো। ফোন রাখতেই আরাফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার বাচ্চা?
রঙ্গন একটা সুক্ষ্ম হাসি দিয়ে সম্মতি জানালো। আরাফ পুনরায় বলল,
– এত অল্প বয়সে ফ্যামিলি তারপর বেবী? দেখলে মনেই হয় না।
রঙ্গন একটা বাকা হাসি দিয়ে বলল,
– বাচ্চার রেসপনসেবলিটি নেয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট বয়স লাগে না সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থাকলেই হয়।
রঙ্গনের কথাটা যেনো আরাফের আরাফের চিত্তে ভয়ংকর থাবা বসালো। অতীত ভেসে এলো কি সামনে? রঙ্গন বুঝলো সে আরাফের কোথায় খোচাটা দিয়েছে।মনে মনে বলল ‘আরো অনেক কিছু অনুভব করা বাকি তোমার আরাফ মাহমুদ।’

অদিতির পি.এ জানালো বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রওনক চৌধুরী তার সাথে দেখা করতে এসেছে। অদিতির ললাটে ভাজ পড়লো রওনক চৌধুরীর নাম শুনে।রঙ্গনের বাবা তার সাথে কেন দেখা করতে আসবে? উনাকে ভিতরে নিয়ে আসতে বলল অদিতি।অদিতি ভাবলো হয়তো ছেলের পাগলামির কথা উনার কাছে গেছে এজন্য হয়তো ছেলের থেকে দূরে থাকার সাবধান বাণী শোনাতে এসেছে।নেতিবাচক চিন্তায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
রওনক সাহেব প্রবেশ করতেই অদিতি দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিয়ে বসার অনুরোধ করলো।রওনক সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে অদিতির সামনের চেয়ারে বসলেন।অদিতিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। ছোটখাটো গড়নের সুন্দরী তনয়া বলা যায়। দেখে বোঝা যায় না মেয়েটির একটি পাঁচ বছরের সন্তান আছে। চেহারায় বাচ্চামো ভাব আছে একটা।
– আমি কেন এসেছি জানো তুমি?
– ব্যবসায়িক কাজে আসেন নি সেটা বুঝতে পারছি।
অদিতির সরল স্বীকারোক্তি। রওনক চৌধুরী বুঝলেন চেহারায় যতই বাচ্চামো থাকুক মেয়েটি স্পষ্টবাদী এবং বুদ্ধিমতী।রওনক সাহেব হেসে বললেন,
– ঠিকই ধরেছো আমি রঙ্গন আর তোমার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।
অদিতি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো ,
– কি কথা বলতে এসেছেন?
– তোমার আর রঙ্গনের ব্যাপারে কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছি আমি।আমার জীবনের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন রঙ্গন। বলতে পারো আমার গোটা জগৎ রঙ্গনকে ঘিরেই। অনেক বছর ধরে রঙ্গনের উদাসীন জীবনযাপন যাযাবরের মত দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো আমাকে মানসিক পীড়া দিতো।বুঝতে পারতাম ছেলে আমার অন্তর্দহনের অনলে জ্বলছে কিন্তু সমাধান জানা ছিল না।
এরপর রওনক সাহেব একটু বিরতি নিলেন তারপর পুনরায় বললেন,
– আমি মন থেকে তোমাকে পুত্রবধূ রূপে মেনে নিয়েছি মা।
রওনক সাহেবের কথায় অদিতি চমকে উঠলো। বিস্মিত নজরে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।তারপর শান্তভাবে বলল,
– আংকেল আপনি জানেন তো আমি ডিভোর্সী এক সন্তানের মা?
রওনক সাহেব নির্মল হাসি দিলেন।
– আমি সবকিছুই জানি। আমার এসবে কোন আপত্তি নেই। মধুমিতা মানে রঙ্গনের মা আমার ছয় বছরের বড় ছিলো। একসাথে থাকার জন্য ভালোবাসা আর বোঝাপড়াটায় আসল বাকিসব তো তুচ্ছ। দিনশেষে যার সান্নিধ্যে তুমি নিজের সুখ দুঃখ হতাশা সপে দিতে পারবে সেই তোমার নিজের মানুষ। এখানে অতীত, বয়স, সমাজ এগুলো তো মানুষের তৈরি বেড়াজাল। আজ আমি রঙ্গনের জন্য তোমাকে চাইতে আসিনি আমি এসেছি নিশ্চয়তা দিতে। তোমার জীবনে রঙ্গনকে তুমি কোন আসনে বসাবে সেটা তোমার একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমি রঙ্গনের বাবা হিসেবে তোমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে এসেছি যে তুমি আর আহিনা রঙ্গনের কাছে কোনদিন অসুখী হবে না। স্বামী এবং বাবা দুটো দায়িত্বই সে নিষ্ঠার সাথে পালন করবে। আর রঙ্গনের ভালোবাসার সাফাই মনে হয় না আমার দেয়ার প্রয়োজন আছে।
কথাগুলো বলে রওনক সাহেব উঠে দাড়ালেন। অদিতিও উঠে দাড়ালো।
– ভালো থেকো।আজ আসি।
কথাটা বলে বেরিয়ে যেতে নিয়ে দরজায় জেনিফার আর আহিনাকে দাড়ানো দেখলেন।আহিনাকে দেখে রওনক চৌধুরী মিষ্টি করে হাসলেন। নিচু হয়ে আহিনার থুতনিতে হাত দিয়ে বললেন ,
– সৃষ্টিকর্তা সহায় হলে খুব শীঘ্রই তোমার সাথে আমার একটা মিষ্টি সম্পর্ক হবে।
আহিনা কিছু বুঝলো না গোলগোল চোখে চাইলো।রওনক সাহেব আহিনার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রস্থান করলেন।

……………চলবে?

#অদিতির_যবনিকা -১২
#তিশা

গাড়িতে বসে আছে রওনক চৌধুরী। তার এসিস্ট্যান্ট নয়ন একটু সাহস নিয়েই বলল,
– স্যার অদিতি ম্যামের সাথে দেখা করার পিছনে কারণটা কি?
রওনক সাহেব নয়নের দিকে তাকাতেই নয়ন একটু ভড়কে গেলো।ইতস্ততভাবে বলল,
– না মানে স্যার আপনি এভাবে সেধে দেখা করতে গেলেন তাই আর কি!
রওনক সাহেব হেসে বললেন,
– একজন ডিভোর্সি সিঙ্গেল মাদার মানে সমাজের ঘাত প্রতিঘাতের সাথে সংগ্রাম করা একজন যোদ্ধা। এরকম মহীয়সী নারীরা সবার সামনে ইস্পাতের মত দৃঢ় মনোবল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু মানসিকভাবে তারা খুব নাজুক হয়।সমাজ ,প্রতিবন্ধকতা ,সন্তানের ভবিষ্যৎ সবকিছু নিয়ে খুব মানসিক টানাপোড়নের মধ্যে থাকে। নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও অনেককিছু ভাবতে হয় তাদের।আমি শুধু অদিতিকে এটাই আশ্বস্ত করতে গেছিলাম রঙ্গনের পরিবারের পক্ষ থেকে তার অতীত এবং সন্তান নিয়ে কোনরকম কোন সমস্যা নেই।
একনাগাড়ে কথা গুলো বলে রওনক সাহেব একটু থামলেন তারপর একটা নিস্প্রভ হাসি দিয়ে বললেন,
– সবকিছুর উর্ধ্বে আমি আমার সন্তানের সুখের জন্য গেছিলাম বলতে পারো।আমার কাছে রঙ্গনের সুখটাই মূখ্য।
নয়ন অভিভূত হয়ে রওনক সাহেবকে দেখতে লাগলো। তার বস শুধু একজন ভালো বাবা নয় একজন উন্নত মানসিকতার অধিকারী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

আহিনাকে নিয়ে অদিতি আর জেনিফার ইনডোর কিডস জোনে এসেছে। আহিনা খেলতে ব্যস্ত অদূরেই জেনিফার আর অদিতি বসে আছে। অদিতি বেশ ভাবনায় বিভোর।জেনিফার অদিতির ভাবনা একটু হলেও বুঝতে পারছে। তখন রওনক সাহেবের শেষের কিছু কথা জেনিফার শুনেছে।
– আপু?
জেনিফারের ডাকে অদিতি তার দিকে তাকালো।
– একটা কথা বলবো কিন্তু যদি রাগ হন তাই আগেই মাফ চাইছি।
– বলো রাগ করবো না।
– বলছিলাম একবার তো সব কিছু মেনে ভদ্র সভ্য এক প্রতারককে জীবনে স্থান দিয়েছিলেন এবার না হয় আহিনার খুশির জন্য একজন অসভ্য বেপরোয়া মানুষকে জীবনে জায়গা দিলেন। আমি নিশ্চিত এতে শুধু আহিনা নয় ভবিষ্যতে আপনিও ভালো থাকবেন। এতদিনে এতটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আহিনার জন্য রঙ্গন স্যারের থেকে ভালো বাবা কেউ হতে পারবে না।
অদিতি কিছু বললো না জেনিফারের দিকে তাকিয়ে একটা সুক্ষ্ম হাসি দিলো।

আরাফ দীর্ঘসময় ধরে বারান্দায় বসে গভীর ভাবনায় নিমগ্ন।রঙ্গনের তখনকার কথাগুলো কেন যেনো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বার বার ভাবনা আসছে ‘আচ্ছা সে কি চাইলেই পারতো না আহিনার দায়িত্ব নিতে।রুহির প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে গেছিলো যে নিজের সন্তানের মায়াও ফিকে হয়ে গেছিলো।’
রুহি বেডরুমে বসে অনেকক্ষণ যাবত আরাফকে লক্ষ্য করছে। অলরেডি তিন চারটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে সে।কিসের এত চিন্তা করছে সে? ইদানীং রুহির কাছেও আরাফকে বড্ড অচেনা লাগে । আগের মত ভালোবাসা আর তাদের সংসারে বিরাজ করে না। আচ্ছা আরাফ কি ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে! এসমস্ত চিন্তায় রুহির বুকটা কেপে উঠলো।

– ভাই এসবের মানে কি?
রিফাতের কথায় রঙ্গন ফোন থেকে চোখ সরালো।
– কোন সব?
– এই যে আরাফের সামনে এরকম নরম সরম ব্যবহার করলেন?
রঙ্গন একটা চতুর হাসি দিলো।
– যাতে আরাফ মাহমুদ ভাবে রঙ্গন কাচা খেলোয়াড় তাকে ইচ্ছে মতো নাচানো যাবে।
রিফাত বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো। তারপর বলল,
– ভাই আমরা জাপান ফিরবো কবে?
– কাল প্রজেক্ট সাইন হলে রাতেই ফিরে যাবো।

রঙ্গন বাংলাদেশ যাওয়ার পরে আহিনা প্রায় প্রতিদিনই অদিতির অফিসে যায় কিন্তু আজ অদিতির অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আর কনফারেন্স আছে এজন্য জেনিফার তাকে ঘুরতে নিয়ে এসেছে। হাটতে হাটতে গার্ডেনের একটা চেয়ারে বসে পড়লো আহিনা।
– বাসায় চলো জেনি আন্টি।
– এক্ষুনি তো এলে এখনই যাবে?
আহিনা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো ,
– সাতদিন এখনো হয়নি আন্টি?
– ছয়দিন হচ্ছে বেবী।
আহিনা ঠোট ফুলিয়ে বলল ,
– এরপর বাবাইকে বলবো আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে।

“আচ্ছা এরপর থেকে আমার বেবীকে সাথে নিয়ে যাবো।”
হঠাৎ রঙ্গনের আওয়াজ শুনে আহিনা উচ্ছ্বসিত নজরে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুজলো তাকে। অদূরে রঙ্গনকে দেখে ছুটে গেলো সে।

রাতে অদিতি অফিস থেকে ফিরে আহিনার ঘর থেকে রঙ্গন আর আহিনার হাসির শব্দ শুনে ভ্রু কুচকালো।ভাবলো রঙ্গন ফিরে এসেছে! সোফায় বসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে জেনিফারকে বলল,
– কি চলছে ওই ঘরে?
জেনিফার হেসে বলল,
– আপনি নিজেই দেখুন।
অদিতি উঠে আহিনার ঘরের দরজায় দাড়ালো। দেখলো রঙ্গন একটা ছোট্ট জামদানী শাড়ি আহিনাকে পরানোর চেষ্টা করছে আর সামনে মোবাইলে শাড়ি পরার টিউটোরিয়াল চলছে। আহিনা একটা স্কার্ট আর ক্রপ টপ পরে দাড়িয়ে আছে রঙ্গন বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করছে আর আহিনা কাতুকুতু বলে খিলখিল করে হাসছে। অজান্তেই অদিতির ঠোটে একটা হাসি দেখা দিলো। জেনিফার আস্তে করে অদিতিকে বলল,
– রঙ্গন স্যার বাংলাদেশ থেকে আহিনার জন্য জামদানী শাড়ি এনেছে গত একঘন্টা ধরে দুজনে সেই শাড়ি পরার যুদ্ধ করছে।
অদিতি হাসলো তারপর রঙ্গন আর আহিনার দিকে এগিয়ে গেলো।
– আমাকে দাও আমি পরিয়ে দিচ্ছি।
অদিতির কথায় রঙ্গন আর আহিনা তার দিকে তাকালো। রঙ্গন শাড়িটা অদিতির হাতে দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো।শাড়ি পরানো হতেই অদিতি আহিনাকে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে দিলো। আহিনা আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখতে লাগলো তারপর রঙ্গনের কাছে যেয়ে দুই হাত তুলে বোঝালো কোলে নাও। রঙ্গন কোলে নিতেই উৎফুল্ল ভাবে জিজ্ঞেস করলো ,
– আমাকে কেমন লাগছে বাবাই?
রঙ্গন আহিনার গাল টেনে বলল,
– খুব সুন্দর । একদম পরীর মতো।
রঙ্গন আহিনাকে কোলে নিয়ে উঠে দাড়ালো তারপর বেডের উপর রাখা একটা বক্স তুলে অদিতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা আহিনার মাম্মামের।
অদিতি কনফিউজড হয়ে বক্সটা নিলো। রঙ্গন আহিনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। অদিতি বেডে বসে বক্স খুলে দেখলো একটা মেরুন রঙের জামদানী। অদিতির ঠোট প্রসারিত হলো কোমল স্পর্শে ছুয়ে দিতে লাগলো শাড়িটা।

আজ স্কুল থেকে অদিতির অফিসে এসেছে আহিনা।মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই আহিনা দেখলো রঙ্গনের বড় বড় দুইটি পোস্টার। সে ছুটে গেলো সেদিকে জেনিফারকে আনন্দিত হয়ে বললো ,
– জেনি আন্টি দেখো বাবাইয়ের ছবি।
এরিনা আর দুইজন কর্মচারী তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। আহিনার কথায় তারা থেমে গেলো। এরিনা আহিনার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলল,
– ইনি তোমার বাবাই নয় বেবী।
আহিনা চোখ মুখ কুচকে বলল,
– উহু এটাই আমার বাবাই তুমি জানো না।
এমন সময় রঙ্গন আর রিফাতও ঢুকলো গেট দিয়ে। আহিনা রঙ্গনকে দেখে ছুটে যেয়ে ওর পা জড়িয়ে ধরলো। রঙ্গন আহিনাকে কোলে তুলে নিতেই রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরে এরিনাকে উদ্দেশ্য করে আহিনা নালিশ জানালো।
– বাবাই ওই আন্টিটা বলেছে তুমি আমার বাবাই না।
রঙ্গন একটা হাসি দিয়ে আহিনার কপালে আসা চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
– আন্টিটা তো জানে না তাই বলেছে আমি বলে দেব আর বলবে না।
আহিনা মাথা নাড়ালো। ওদিকে এরিনাসহ অফিসের বেশ কিছু কর্মচারী আহিনা আর রঙ্গনের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।আহিনাকে অফিসের সবাই মোটামুটি চেনে অদিতির মেয়ে হিসেবে এবং তারা তো জানে অদিতি সিঙ্গেল মাদার তাহলে রঙ্গনকে আহিনা কেন বাবাই ডাকছে।এই সমস্ত কানাঘুষার মধ্যেই রঙ্গন তীক্ষ্ণ নজরে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলল,
– কি সমস্যা? এখানে কি সার্কাস হচ্ছে?
রঙ্গনের গুরুগম্ভীর কথায় সবাই সবার কাজে চলে গেলো।এরিনা যেতে যেতে গভীর ভাবে আর একবার রঙ্গন আর আহিনাকে দেখলো।

– তুমি অনেক বদলে গেছো আরাফ।
রুহির কথায় আরাফ ল্যাপটপে কাজ কর‍তে করতেই উত্তর দিলো,
– আমি বদলায়নি আগের মতই আছি।
– তাহলে আগের মত আমার সাথে কথা বলো না কেন?
আরাফ এবার ল্যাপটপ সরিয়ে রাখলো।
– তোমার সাথে কি ঠিকভাবে কথা বলা যায়? একটু কিছুতেই তোমার মেজাজ গরম হয়ে যায় চিৎকার চেচামেচি করো এজন্যই কথা কম বলি যাতে ঝামেলা কম হয়।
রুহি তিক্ষ্ণ স্বরে বলল,
– তুমি বলতে চাইছো আমি সব সময় চিৎকার চেচামেচি করি?
আরাফ ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তারপর ল্যাপটপ নিয়ে উঠে দাড়ালো।
– এইজন্যই বেশি কথা বাড়াতে চাই না তোমার সাথে। আমি অন্য রুমে যাচ্ছি আমার অনেক জরুরি কাজ আছে। দয়া করে এখন কোন ঝামেলা করো না।
এরপর আরাফ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।কঠিন দৃষ্টিতে আরাফের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো রুহি।

আহিনা রঙ্গনের সাথেই শুটিংয়ের সেটে বসে আছে। জেনিফার অনেক বলেও আহিনাকে সরাতে পারেনি। রঙ্গন এক পর্যায়ে জেনিফারকে আশ্বস্ত করেছে আহিনা থাকুক। অদিতি জেনিফারের কাছে সবটা শুনে ভাবলো সে নিজেই আহিনাকে নিয়ে আসবে। অদিতি যখন লিফটের উদ্দেশ্যে হাটছিল তখন হঠাৎ এরিনা তার সামনে এসে দাড়ালো। অদিতি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো। এরিনা মাথা নাড়িয়ে অদিতিকে অভিবাদন জানিয়ে ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলো,
– ম্যাম রঙ্গন স্যারের সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক মানে আহিনা স্যারকে বাবাই ডাকলো তো তাই আর কি জানতে ইচ্ছে হলো।
কথাটা বলে এরিনা একটু হাসার চেষ্টা করলো।অদিতি ঠাণ্ডা চোখে চাইলো এরিনার দিকে।সেই দৃষ্টিতে এরিনা বুঝলো ভুল মানুষকে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে কিন্তু এখন আর পিছনে ফেরার জায়গা নেই।
– মিস এরিনা আপনাকে এখানে রাখা হয়েছে অফিসিয়াল কাজের জন্য আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি করার জন্য নয়।আমার মেয়ে কাকে বাবা ডাকলো ব্যক্তিগত জীবনে আমার কার সাথে কি সম্পর্ক এসব রহস্য উদঘাটনের জন্য কোম্পানি আপনাকে স্যালারি দিচ্ছে না তাই নিজের কাজে মন দিন।
এরিনা মাথা নিচু করে সরি বলে চলে গেলো।অদিতি মাথা নাড়িয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো তারপর নিজের গন্তব্যের দিকে হাটা শুরু করলো।

অদিতি সেটে যেয়ে দেখলো রঙ্গন শুটে ব্যস্ত আর আহিনা গালে হাত দিয়ে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতি মেয়ের পাশে বসে বলল,
– এভাবে কি দেখছো বেবী?
আহিনা মায়ের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল,
– জানো মাম্মাম আমার বন্ধুদের সবার মধ্যে আমার বাবাই সব থেকে বেশি সুন্দর।
অদিতি রঙ্গনের দিকে চাইলো তারপর আনমনে বলল,
– হ্যা বেবী তোমার বাবাই বেস্ট!

নোট: মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা পোস্ট দিয়ে আমার প্রজাপতিদের বিভ্রান্ত করি তো তাই সকাল সকাল রঙ্গনকে দিয়ে গেলাম।টাটা গুডনাইট!!!

…………..চলবে?

বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।