#অদিতির_যবনিকা -১৫
#তিশা
আজ রবিবার আহিনার বাবাই আর মাম্মামের সাথে ঘুরতে যাওয়ার দিন। সকাল থেকে আহিনা খুব এক্সসাইটেড। বেশ কয়েকবার রঙ্গনকে ফোন দিয়েও যখন রঙ্গন ফোন ধরলো না আহিনা তখন ঠোট ফুলিয়ে ঘরের মধ্যে বসে রইলো। এদিকে রঙ্গন বেশ অনেক রাত পর্যন্ত নতুন এলবামের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে এখনো ঘুমে বেহুশ।
আহিনার যখন মনে হলো রঙ্গন সত্যিই আসবে না সে কান্না করে দিলো। বাধ্য হয়ে অদিতি রিফাতকে ফোন দিলো।রিফাত রঙ্গনকে তুলে যখন ঘটনা জানালো রঙ্গন দ্রুত মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো রাতে সাইলেন্ট করেছিল তারপর জেনারেল করতে ভুলে গেছিলো। দ্রুত অদিতিকে ফোন করলো রঙ্গন। অদিতি রিসিভ করতেই রঙ্গন বলল,
– মিস চড়ুই বেবীকে ফোন দিন।
– তোমার বেবী দুই চোখে সমুদ্র বানিয়ে বসে আছে কথা বলবে না।
রঙ্গনের নিজের উপরেই রাগ হলো কেন সে ফোন সাইলেন্ট করেছিল ভেবে। শান্তভাবে বলল,
– বেবীকে বলুন ওর বাবাই এক্ষুনি আসছে।
অদিতি ফোন রেখে আহিনার দিকে তাকালো। তারপর ঠোট চেপে হেসে আহিনাকে শুনিয়ে জেনিফারকে বলল,
– আহি যেহেতু আর তার বাবাইয়ের সাথে কথা বলবে না তাহলে জেনি দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে আসো তো। রঙ্গনকে আমরা আর বাসায় ঢুকতেই দেব না।
জেনি আচ্ছা বলে যেতে নিলে আহিনা আরো জোরে কেদে দিলো। অদিতি হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
– থাক বেবী আর কান্না করে না। বাবাই তো ঘুমিয়ে পড়েছিলো এজন্য ফোন ধরতে পারেনি। আসছে তো বাবাই। আসলে আমরা অনেক বকা দিয়ে দিবো। ওকে?
আহিনা গাল ফুলিয়ে ওকে বলল। অদিতি ভাবলো মেয়েকে রঙ্গনের থেকে আলাদা করা এজীবনে আর সম্ভব নয়।
আধাঘন্টার মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে রঙ্গন এলো। রঙ্গনকে দেখে আহিনা রাগে গাল ফুলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দুপদাপ করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো।রঙ্গন অদিতির দিকে হতাশ হয়ে তাকালো। অদিতি ঠোট চেপে হাসলো।
আহিনা উল্টোদিকে ফিরে বসে আছে। রঙ্গন অনেকগুলো রঙিন বেলুন নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
– বেবীর জন্য বাবাই যে এতগুলো বেলুন আনলো এখন বেবী যেহেতু কথা বলছে না তাহলে আর কি ফেরত দিয়ে আসি দোকানে।
বেলুনের কথা শুনে আহিনা প্রফুল্ল চোখে চাইলো। এত্তগুলো বেলুন দেখে খুশি হয়ে রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরলো।
– বাবাইয়ের সরি কি একসেপ্ট হয়ছে?
আহিনা রঙ্গনের গালে আদর দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
– ইউ আর বেস্ট বাবাই।
রঙ্গন আর আহিনা অদিতির জন্য বসে আছে ড্রয়িংরুমে।অদিতি রেডি হয়ে বের হলেই তারা ঘুরতে বের হবে।আহিনা গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে। রঙ্গন তখন আহিনার কথায় সায় দিয়ে সামনে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিতে যেয়েও নিতে পারলো না। থমকে গেলো তার দৃষ্টি সেই সাথে বুঝি এলোমেলো হলো হৃদপিণ্ডের গতি।অদিতি রঙ্গনের দেয়া সেই মেরুন রঙ্গা জামদানী পরেছে। অভিভূতের ন্যায় অদিতিকে অবলোকন করতে করতে ফিরে গেলো অতীতে।
বহু বছর আগে ভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে কলাপাতা রঙের জামদানী পরিহিত অদিতিকে দেখেই প্রথম রঙ্গন অনুভব করেছিলো অদিতির প্রতি নিরন্তর ভালোবাসা। রঙ্গনের ঘোর কাটলো আহিনার উচ্ছ্বসিত আওয়াজে।
– মাম্মাম ইউ লুক সো প্রিটি।তাই না বাবাই?
রঙ্গন অপলক নেত্রে ঘাড় নাড়ালো। রঙ্গনের সেই বিমোহিত দৃষ্টিতে অদিতি বুঝি একটু অস্বস্তি অনুভব করলো।রঙ্গন ততোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। অধর কোণে দেখা দিলো নির্মল হাসি।উঠে দাড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে অদিতির দিকে এগিয়ে এসে তার কানের কাছে মুখ দিয়ে গভীর কণ্ঠে বলল,
– You look like queen Ahinar Mummum. Queen of Rafiyan Rongon.
কথাটা বলে রঙ্গন সরে এলো তারপর আহিনাকে কোলে তুলে বলল,
– Let’s go baby.This is our day.
– Yehhhh!
আহিনা আর রঙ্গন উল্লাস করতে করতে বেরিয়ে গেলো।অদিতি তখনো রঙ্গনের কথার মায়াজাল থেকে বের হতে পারেনি।আহিনার ডাকে অদিতির সম্বতি ফিরলো।
রঙ্গন আহিনা আর অদিতিকে নিয়ে টোকিও ডিজনি রিসোর্টে এসেছে।আহিনা তো সেই খুশি।জীবনে প্রথমবার বাবাই মাম্মাম নিয়ে একসাথে ঘুরতে বের হয়ছে খুশি তো হবেই। স্কুলে এবার সেও বন্ধুদের বাবাই মাম্মামকে নিয়ে একসাথে বেড়াতে যাওয়ার গল্প করতে পারবে। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে ক্ষুধার্ত হয়ে ওরা একটা বিলাশবহুল রেস্টুরেন্টে বসলো।খাওয়াদাওয়া শেষে যখন রেস্টুরেন্ট থেকে ওরা বের হতে নিবে তখন অদিতির পুরনো এক ক্লায়েন্টের সাথে দেখা হলো। ভদ্রতা সুলভ অদিতি উনার সাথে কথা বলতে লাগলে রঙ্গন জানালো সে আহিনাকে নিয়ে বাইরে ওয়েট করছে। অদিতি মাথা নাড়ালো।
রেস্টুরেন্টের বাইরে অনেকগুলো টয় শপ। আহিনা রঙ্গনের কাছে বায়না করলো পুতুল কিনে দিতে। কাচের দেয়াল ভেদ করে রঙ্গন একবার অদিতিকে দেখে নিয়ে রাস্তার অপরপাশের একটা দোকানে ঢুকলো। রঙ্গন আর আহিনা তখন একটা মিকি মাউজ পুতুল দেখতেছিলো হঠাৎ রঙ্গনের অনুভব হলো চারপাশ হালকা কাপছে। মুহূর্তেই বুঝলো ভূমিকম্প হচ্ছে।জাপানের জন্য এটা অবশ্য স্বাভাবিক ব্যাপার। যখন বুঝলো কম্পনের মাত্রা বেশি দ্রুত আহিনাকে এক হাতে তুলে নিয়ে দৌড়ে ফাকা রাস্তায় দাড়ালো। রঙ্গন রাস্তায় দাড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই ধরণী কাপিয়ে সামনের সুবিশাল রেস্টুরেন্ট ভেঙ্গে পড়লো। রঙ্গন যেনো কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো।তারপর যখন বোধগম্য হলো কি ঘটেছে ছুটে গিয়ে দাড়ালো রেস্টুরেন্টের ভগ্নাংশের সামনে। উন্মাদের মত এদিক ওদিক দিয়ে ভাঙা ইমারতের ভিতরে ঢুকতে চাইলো কিন্তু সামনের দিকটা পুরো ভেঙে ভিতরে ঢোকার রাস্তাটা পুরো বন্ধ হয়ে গেছে।কোন পথ খুজে না পেয়ে অসহায় হয়ে রঙ্গন হাটু ভেঙে বসে পড়লো রাস্তায়।আজ বুঝি অশ্রুকণাও কোন বাধা নিষেধ মানতে নারাজ।কিছু মুহূর্ত মাথা নত করে রইলো রঙ্গন এতগুলো বছরের আকাঙ্খিত ভালোবাসা যখন কেবলই পাখা মেলতে শুরু করেছে তখন এভাবে সেটা দুমড়ে মুচড়ে যাবে রঙ্গন বিশ্বাসই করতে পারছে না।অদিতি না থাকলে কিভাবে বাঁচবে সে। আর ভাবতে পারলো না সে মাথা তুলে চিৎকার করে ডাকলো,
– অদিতি!!!!!
এই প্রথম বুঝি রঙ্গন তার মিস চড়ুইকে নাম ধরে ডাকলো। এতক্ষণ রঙ্গনের পাশে আহিনা ভীতু মুখে দাড়িয়ে ছিলো। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে।ভীতু পায়ে আহিনা আর বাবাইয়ের দিকে আর একটু আগাতে নিলেই অপরদিক থেকে অদিতিকে দৌড়ে আসতে দেখে জোরে বলে উঠলো,
– মাম্মাম!!!
আহিনার কথায় রঙ্গন আহিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে উল্টোদিকে চেয়ে দেখলো মেরুন রঙের শাড়ি পরিহিত এক রমণী তাদের দিকেই ছুটে আসছে। মুহুর্তেই রঙ্গনের অনুভূতি সচল হলো কোনরকমে উঠে ছুটে জড়িয়ে ধরলো অদিতিকে।অদিতি অনুভব করলো রঙ্গনের শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাপছে।আস্তে করে রঙ্গনের পিঠে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো সে। রঙ্গন আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যেন কিছুতেই ছাড়বে না অদিতিকে।
– শান্ত হও আমি ঠিক আছি।
রঙ্গন বাধন ঢিলা করলো তারপর দুহাতের মধ্যে অদিতির মুখখানি আগলে ধরলো।অদিতির ললাটে গভীরভাবে অধর ডুবিয়ে রেখেই বিড়বিড় করে বলে,
– আপনার কিছু হলে কি করতাম আমি? কিভাবে বাঁচতাম আমি?
অদিতি নির্নিমেষ চেয়ে এক পাগল প্রেমিকের উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করলো। সেই মুহুর্তে অদিতি আরো অনুভব করলো ‘এই বেপরোয়া প্রেমিকের ভালোবাসার কাছে হেরে গেছে তার সকল যুক্তিতর্ক।’
– বাবাই আমারও মাম্মামের মত আদর লাগবে!
আহিনার অভিমানী কথায় ঘোর কাটলো দুজনের।রঙ্গন চট করে আহিনাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে আদর দিতে দিতে বলল,
– বাবাইয়ে তো আদর করার জন্য আহিনা আর আহিনার মাম্মামই আছে বেবী।
অদিতি রঙ্গনের কথায় কপট রাগ দেখিয়ে কনুই দিয়ে গুতা মারল তার পেটে। রঙ্গন নির্মল হাসলো তারপর অপর হাত দিয়ে অদিতিকে টেনে নিলো কাছে।
– আর কোন কিছু শুনছি না আমি। আহিনা আর তার মাম্মামকে পরিপূর্ণভাবে নিজের করে চাই আমার।
তখন ভূমিকম্পের আগেই অদিতি বাইরে আসে কিন্তু রঙ্গন আর আহিনাকে দেখতে না পেয়ে চারপাশে তাকিয়ে খুজতে থাকে তখনই ভূমিকম্প শুরু হয় আর রেস্টুরেন্ট ভেঙ্গে পড়ে। এরপর হট্টগোল আর লোকজনের কোলাহলে চারদিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এতে করে অদিতি আরো ঘাবড়ে যায়।
সারারাস্তা রঙ্গন একদম চুপচাপ হয়ে ছিল কোন কথা বলেনি আর। আহিনা অদিতির কোলেই ঘুমিয়ে গেছে। গ্যারেজে গাড়ি দাড় করিয়ে রঙ্গন নিশ্চুপ ভাবেই আহিনাকে অদিতির কোল থেকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। অদিতি রঙ্গনের এই নিশ্চুপ ব্যবহারের কারণ ধরতে পারছে না। অদিতি ধীর স্থির ভাবেই বাড়ির মধ্যে ঢুকলো। ততোক্ষণে রঙ্গন আহিনাকে তার ঘরে শুইয়ে জেনিফারকে আহিনার ড্রেস চেঞ্জ করতে বলল।আহিনার ঘর থেকে বেরিয়ে রঙ্গন দেখলো অদিতি ড্রয়িংরুমে কেবল ঢুকছে। রঙ্গন দ্রুত যেয়ে অদিতির হাত ধরে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। অদিতি কি ঘটছে ধরতে পারছে না তখনো। অদিতিকে বসিয়েই রঙ্গন তার সামনে হাটুতে ভর দিয়ে বসে অদিতির কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রাখলো তারপর ধরা গলায় বলল,
– আমার হয়ে যান প্লিজ। অনেক তো হলো জীবনের ঘাত প্রতিঘাত।কেন বোঝেন না আপনাকে ছাড়া আমি শূণ্য। আজ যখন রেস্টুরেন্টটা চোখের সামনে ভেঙে পড়লো যখন মনে হলো আপনাকে হয়তো চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম তখন বুঝলাম আপনাকে ছাড়া আমার সম্ভব না।
শেষের টুকু বলতে বলতে রঙ্গনের কণ্ঠ জড়িয়ে এলো।অদিতির নেত্রও বুঝি সিক্ত হলো। হয়তো অশ্রুও গড়ালো। শান্ত ভঙ্গিতে কোলের উপরে রাখা রঙ্গনের মাথায় হাত বুলিয়ে এলোমেলো কোকড়া চুলগুলো আর একটু এলোমেলো করে দিলো। তারপর মাথাটা নিচু করে রঙ্গনের চুলের ভাজে অধর ছুয়ে দিলো।রঙ্গন চোখ বন্ধ করে নির্মল এক হাসি দিলো। এই স্পর্শেই বুঝি প্রণয়িনী তার প্রণয়ের নিরব সম্মতি জানালো।
ড্রয়িংরুম থেকে সেই দৃশ্যের নিরব সাক্ষী হলো জেনিফার। তার চোখে মুখে দেখা দিলো প্রশান্তির এক হাসি। ‘আহিনা বুঝি এবার সত্যি সত্যি পরিপূর্ণ পরিবার পাবে’ ভাবতে ভাবতে আহিনার রুমের দিকে পা বাড়ালো সে।
…………..চলবে?
#অদিতির_যবনিকা -১৬
#তিশা
বেশ কিছুটা সময় পরে রঙ্গন মাথা তুলে চাইলো অদিতির পানে।দুজনের আখিই সিক্ত কিন্তু মুখাবয়ব জুড়ে আছে প্রাপ্তির মৃদু হাসি। রঙ্গন অদিতির দুই হাত নিজের মুঠোবন্দী করে সেখানে ওষ্ঠ ছুয়ে বলল ,
– চলুন না বিয়ে কয়ে নিই!
অদিতি ঠোট এলিয়ে হাসলো তারপর মৃদু স্বরে বলল,
– এত তাড়া কিসের?
– এতগুলো বছর অপেক্ষা করেছি আর সম্ভব নয়।
দৃঢ় কণ্ঠে বলল রঙ্গন। অদিতি হাতাশ হয়ে ভাবলো লাগাম সেই খুলে দিয়েছে আর থামানো সম্ভব না।
আরাফ রুহিকে নিয়ে তার বোনের বাড়িতে এসেছে আজ। আরাফের ভাগ্নীর জন্মদিন উপলক্ষ্যেই আসা তাদের।আরাফ ভালোভাবেই জানে শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরেই তাকে আর রুহিকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে কিন্তু আরাফ মনে প্রাণে পরিবারের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্কটা পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক করতে চায় এজন্যই সে এসেছে। আরাফ আর রুহিকে আরাফের বোন অনু আর তার স্বামী সাবিত মনে মনে যতই অসন্তুষ্ট হোক তারপরও স্বাভাবিকভাবেই স্বাগতম জানিয়েছে।আরাফের বাবা মা অবশ্য একরকম উপেক্ষায় করেছে আরাফকে।
কেক কাটা শেষে সবাই একসাথে খেতে বসেছে তখন সাবিতের মা রুহির কাছে বাচ্চাকাচ্চার প্রসঙ্গ তুললে রুহি জানায় ডাক্তার দেখিয়েছে তারা কোন সমস্যা নেয়। তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছেন ডাক্তার।সাবিতের মা ভ্রু কুচকে বলল,
– সমস্যা নেই তাহলে এতদিন চেষ্টা করেও হচ্ছে না কেন?
রুহি উত্তর দেওয়ার আগেই অনু বিড়বিড় করে বলল,
– প্রকৃতির অভিশাপ বলে তো কিছু আছে!
অনু বিড়বিড় করলেও আরাফ এবং রুহি ঠিকই শুনতে পেলো। রুহি শক্ত কণ্ঠে বলল,
– শিক্ষিত সচেতন মানুষ হয়ে কারোর দুর্বলতা নিয়ে খোচা মারতে বিবেকে বাধলো না?
অনু রুহির দিকে একপলক সরু চোখে তাকালো তারপর ঠোট বাকিয়ে একটু হাসলো।
– অবশ্যই অন্য কেউ হলে আমি তাকে সান্ত্বনা দিতাম তার প্রতি আমার সহানুভূতি কাজ করতো। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার প্রতি সেসব অনুভূতি কাজ করছে না। এমন তো নয় আমি কারো ফুপু হয়নি।
এরপর অনু একটু থেমে নরম কণ্ঠে বলল,
– তোমাদের দুজনের দোষে আমি ফুপু হয়েও আজ অব্দি আমার ভাইঝিকে চোখের দেখাটাও দেখতে পাইনি।
অনুর কথায় চারপাশে একটা থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হলো। রুহি উঠে চলে যেতে নিলে আরাফ একটা হতাশ দৃষ্টি দিলো পরিবারের দিকে তারপর আস্তে করে উঠে চলে গেলো। মাহমুদ সাহেব মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– আর কখনো ওদের দাওয়াত দিবি না শুধু শুধু উৎসবের পরিবেশ নষ্ট হয়।
রাতে রঙ্গন যখন বাড়ি ফিরলো রওনক সাহেব তখন সবে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। রঙ্গন একরকম হুলস্থূল ভাবে বাবার ঘরে ঢুকলো। এরকম হঠাৎ রঙ্গনকে ঢুকতে দেখে রওনক সাহেব চমকে উঠলেন। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই রঙ্গন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ছেলের শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাপছে বুঝে ঘাবড়ে গেলেন তিনি।
– কি হয়ছে বাপ এরকম কাপছিস কেন?
– মিস চড়ুই রাজি হয়ে গেছে বাবা।
কাপা গলায় বলল রঙ্গন। রওনক সাহেব বুঝতে পারলেন এবার। হালকা হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি।মনে মনে শান্তি পেলেন।ছেলের জীবন বুঝি এবার একটু স্বাভাবিক হবে ভেবে প্রশান্তি অনুভব করলেন।
পরদিন স্কুল ছুটির পরে রঙ্গনকে দেখতে না পেয়ে মুখ ভার হলো আহিনার।
– জেনি আন্টি বাবাই তো আজ আসবে বলেছিলো?
জেনিফার মনে মনে হাসলো।
– হয়তো ভুলে গেছে।
জেনিফারের কথা শুনে বেজায় দুঃখ পেলো আহিনা। বাবাই তাকে ভুলে যেতে পারলো ভেবে গাড়িতে বসে মুখ ফুলিয়ে রাখলো।
– আমার বেবীর মন খারাপ কেন?
রঙ্গনের কথায় চমকে পাশে তাকিয়ে দেখলো পাশের সিটে রঙ্গন বসে। আহিনা কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। রঙ্গন আহিনাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
– আজ আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে ওকে?
আহিনা সঠিক বুঝলো না কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে কিন্তু তার বাবাই যেহেতু বলেছে সেহেতু কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর বাবাভক্ত আহিনা বাবার কথামতো সব করতে রাজি।
ক্যালিফোর্নিয়ার এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর তরুণ তরুণীদের কলরবে মুখোরিত। কেউ বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মশগুল তো কেউ আসন্ন এসাইমেন্টের চিন্তায় বিভোর কেউবা মুঠোফোনে ব্যস্ত।এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে দুই তরুণী নিজেদের মধ্যে খুনশুটিতে ব্যস্ত। খুব সম্ভবত প্রিয় বন্ধুর ব্যক্তিগত ডায়েরি ছিনিয়ে নিয়ে সামনের মেয়েটি দৌড় দিয়েছে আর পিছনের মেয়েটি নিজের ডায়েরি উদ্ধারের জন্য সামনের জনের পিছনে দৌড়াচ্ছে।অতি কষ্টে ডায়েরি পুনরুদ্ধার করে রাগী চোখে বান্ধবীর দিকে তাকালো মেয়েটি।
– রাগ করছিস কেন। জানি তো তোর ডায়েরি জুড়েই সুপারস্টার রাফিয়ান রঙ্গন।
মেয়েটি আগুন চোখে বান্ধবীর দিকে তাকালো তারপর দুপদাপ করে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে শুনতে পেলো বান্ধবীর হাসোজ্জল রসিকতা।
– আরে ফ্লোরা এত পাগলামি করে কি লাভ তোর রঙ্গন তো জানতেও পারবে না কোনদিন যে তার এরকম কোন দিওয়ানি আছে।
ফ্লোরা নামের মেয়েটি বান্ধবীর কথায় দাতে দাত চেপে মনে মনে আওড়ালো ‘কে বলেছে জানতে পারবে না রঙ্গন পর্যন্ত একদিন আমি ঠিকই পৌছাবো।’
অদিতির আজ অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে।বাড়িতে ঢুকতেই ললাটে চিন্তার ভাজ পড়লো তার।ঘরবাড়ি এরকম অন্ধকার আর চুপচাপ কেন? তার জানামতে রঙ্গন বাড়িতে আছে। রঙ্গন আর আহিনা একসাথে থাকার পরেও ঘরবাড়ি এরকম শান্ত নিশ্চুপ এটাই আরো বেশি করে ভাবাচ্ছে তাকে।সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে যখন চারিদিকে অন্ধকার দেখলো তখন পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানোর জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন তার চোখদুটো কাপড় দিয়ে বেধে দিলো। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটলো সে অদিতি রিয়্যাক্ট করার সুযোগ পেলো না কিন্তু সম্বতি ফিরে যেই উচ্চস্বরে কিছু বলতে নিবে তখনই শক্তপোক্ত দুটি হাত পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে নিয়ে কানের কাছে গভীর স্বরে বলল,
– Ahinar Mummum relax.It’s me.
রঙ্গনকে এত কাছাকাছি অনুভব করে অদিতির পাজোড়া বুঝি জমে গেলো।কিছু বলার শক্তি পেলো না।কিছুক্ষণ সময় নিলো ধাতস্থ হওয়ার জন্য।তারপর ধীর স্বরে বলল,
– এসব কি রঙ্গন?
বলে অদিতি চোখের উপরের কাপড় সরাতে নিলে রঙ্গন বাধা দিয়ে বলল,
– জাস্ট এক মিনিট প্লিজ।
অদিতি কিছু বলল না আর তবে অনুভব করলো রঙ্গন তার হাত ধরে কিছুদূর নিয়ে গেলো তারপর হাত ছেড়ে দিলো। অদিতি তখন হাত বাড়িয়ে রঙ্গনকে পুনরায় ধরতে উদ্যত হলো কিন্তু অন্ধকারে খুজে পেলো না তাকে।বেশ কয়েকবার রঙ্গনকে ডেকেও যখন সাড়া পেলো না তখন চোখের বাধন খুলে ফেললো সে।চোখের থেকে কাপড় সরাতেই সুক্ষ্ম এক আলোরশ্নি তার চোখে আঘাত করলো পুনরায় চোখ বন্ধ করে এবার ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে।দেখলো বাড়ির পিছনের বাগানের চারদিকে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে সেই সাথে চারপশটা বেলুন আর ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করা। কিন্তু সব থেকে বেশি যেটা অদিতিকে অবাক করলো সেটা হলো আহিনা আর রঙ্গন তার সামনে হাটু মুড়ে বসে আছে আহিনার হাতে একটি রঙ্গিন কাগজ তাতে লেখা ‘mummum please marry my Babai’ আর রঙ্গনের হাতে একটি সুন্দর রিং। অদিতি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ভাষাহীন হয়ে পড়লো।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– এসব কি?
– প্লিজ!!!
রঙ্গন আর আহিনা একসাথে বলে উঠলো। এতক্ষণ নির্লিপ্ত ভাবে থাকলেও এবার অদিতি মুখে হাত চেপে হেসে ফেললো সেই সাথে বুঝি চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা সুখের অশ্রু। তারপর শান্তভাবে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। রঙ্গন বুঝি অদিতির হাত বাড়িয়ে দেয়াতে এবার একটু স্নায়ুবিক চাপ অনুভব করলো।হৃদয়ের গহীনে বুঝি সব উলোটপালোট হতে লাগলো। সত্যি অদিতি হাত বাড়িয়েছে নাকি স্বপ্ন! অনেক কষ্টে মানসিক উত্তেজনা প্রতিহত করার চেষ্টা করতে করতে কাপা কাপা হাতে আংটিটা পড়িয়ে দিলো অদিতির অনামিকায়।তারপর উঠে দাড়িয়ে দৃঢ়ভাবে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো অদিতিকে। আহিনা খুশিতে লাফাতে লাফাতে দুই হাতে তালি দিলো। কেন বাবাই মাম্মামকে আংটি পরিয়েছে এসব কিছু জানে না সে শুধু জানে বাবাই তাকে বলেছে মাম্মাম যদি বাবাইয়ের হাত থেকে আংটি পরে তাহলে এরপর থেকে বাবাই মাম্মাম আর সে একসাথে থাকবে।
অদিতি রঙ্গনের কানে ফিসফিস করে বলল,
– বেবী দেখছে ছাড়ো।
রঙ্গন হাতের বাধন আলগা করলো তারপর আহিনার দিকে হাত বাড়ালো আহিনা ছুটে এলো রঙ্গন ওকে কোলে তুলে নিলো।
– ইয়েহহ এরপর থেকে বাবাই মাম্মাম আর আমি একসাথে থাকবো।
আহিনার কথা শুনে অদিতি অবাক হয়ে রঙ্গনের দিকে তাকালো। রঙ্গন ভ্রু নাচিয়ে হাসলো অদিতি রঙ্গনের বাহুতে চড় মা’রলো একটা।
– মিস জ্বীনি ভাইয়ের তাহলে একটা গতি হলো?
উচ্ছ্বসিত হয়ে রিফাত জেনিফারকে বলল।জ্বীনি নামটা শুনে জেনিফার তেতে উঠলো।
– আর একবার জ্বীনি ডাকলে আপনাকে আমি সারাদিন রঙ্গন স্যার আর আহিনার কনসার্ট শোনাবো।
– সরি!
অসহায় ভাবে বলল রিফাত।কোনভাবেই সে আর বাপ বেটির কনসার্ট শুনতে রাজি নয়।
এক মুঠো রোদ্দুর হাতে,এক আকাশ নীল
আজ তোমার জন্য ব্যস্ত শহরে,
চলছে ভালবাসার মিছিল
শুধু তোমার জন্য, প্রেমের জোয়ারে ভাসল দু’কূল ।।
রাতের আকাশ জাগে,
তারার চাদরেবৃষ্টি ভেজা বাতাস বহে
রাতের আদরেপাহাড়ে পাহাড়ে ফুটল বনফুল
শুধু তোমার জন্য,প্রেমের জোয়ারে ভাসল দু’কূল ।।
এক মুঠো রোদ্দুর হাতে,এক আকাশ নীল ।
গীটার বাজিয়ে গাইছে রঙ্গন। তার সামনে অদিতি গালে হাত দিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে রঙ্গনের দিকে। এই ছেলেটা তাকে এত কেন ভালোবাসে বুঝে পায় না সে।ভার্সিটিতে মেয়েদের কাছে রঙ্গন খুব সুপরিচিত ছিল অনেক প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছিল কিন্তু রঙ্গন সেই ঘুরে ফিরে অদিতিতেই মত্ত থাকতো। অথচ অদিতির থেকে দ্বিগুণ সুন্দরী মেয়ে ছিল রঙ্গনের আশেপাশে।
গান শেষে গীটার পাশে রেখে অদিতির দিকে চাইলো রঙ্গন। অদিতিকে তার দিকে নিষ্পলক চাইতে দেখে মৃদু হাসলো রঙ্গন।তারপর অদিতির নাকের সাথে নাক ঘষে জিজ্ঞেস করলো,
– এভাবে কি দেখছেন?
অদিতি হাত দিয়ে নাক ঘষে ঠোট ফুলালে রঙ্গন উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
– এখন বুঝলাম বেবী ঠোট ফুলানো কার থেকে শিখেছে।
অদিতি কপট রাগ দেখালো। এমন সময় আহিনা দৌড়ে এসে রঙ্গনের কোলের উপরে বসে পড়লো।তারপর ঠোট ফুলালো অদিতি আহিনার ঠোট ফুলানো দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসলো আর রঙ্গন আহিনার ঠোট চেপে জিজ্ঞেস করলো ,
– আমার বেবীর আবার কি হলো? মাম্মামের মত ঠোট ফুলাও কেন?
– তুমি মাম্মামের সাথে কম কম গল্প করবে আমার সাথে বেশি গল্প করবে আমি না তোমার বেবী?
অদিতি অবাক হয়ে মেয়ের দিকে চাইলো। মেয়ে তাকে হিংসা করছে ভেবে হতাশ ভাবে দুইপাশে মাথা নাড়ালো। রঙ্গন অদিতির এক্সপ্রেশনে বাকা হাসলো তারপর আহিনাকে বলল,
– অবশ্যই। আমার বেবী যেটা বলবে সেটাই হবে।
অদিতি উঠে উঠে যেতে যেতে বলল,
– দুজনেই এরপরে এসো আমার কাছে তারপর বুঝাবো।
…………….চলবে?