অদিতির যবনিকা পর্ব-২১+২২

0
16

#অদিতির_যবনিকা -২১
#তিশা

ঘড়ির কাটা রাতের দ্বিপ্রহর পেরিয়েছে আরো আগে।বাইরে বৃষ্টি এখনো তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।আলো আধারি কক্ষে উদোম শরীরে উবুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে রঙ্গন। বাম হাতে জড়িয়ে রেখেছে অদিতির নগ্ন উদর।অদিতি নিষ্পলক তাকিয়ে আছে রঙ্গনের ঘুমন্ত মুখের দিকে। কি নিষ্পাপ সেই আনন অথচ ক্ষণকাল পূর্বে সে ছিল বড়ই অশান্ত। দীর্ঘদিনের অপেক্ষিত প্রণয় যেনো আজ পূর্ণতা পেলো। ঘুমের মধ্যেই রঙ্গন প্রিয়তমার আরো একটু কাছে এলো। শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তারপর অদিতির বুকে মুখ গুজে দিলো।অদিতির অধরে স্নিগ্ধ হাসি দেখা দিলো মনে পড়ে গেলো দুদিন আগে আহিনা রঙ্গনকে নিয়ে গেছিলো তার সাথে ঘুমাতে। মাঝরাতে রঙ্গন অদিতির কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত করে বলেছিলো আপনার বাহুবন্ধনে বন্দী না হলে যে আমার আর ঘুম আসেনা।ভাবতে ভাবতে আলতো হাতে রঙ্গনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অদিতিও ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো। অবচেতন মনে ভাবলো বেপরোয়া রঙ্গন তার ভালোবাসার পুরোটায় উসুল করে নিয়েছে অদিতিও আজ তার প্রণয়ের সম্পূর্ণ মালিকানা সপে দিয়েছে রঙ্গনের সমর্পণে।

রঙ্গন আর অদিতি যখন তাদের নতুন অনুভূতির সাথে মেলবন্ধনে ব্যস্ত ঠিক তখনই ক্যালিফোর্নিয়ার এক ব্যস্ত নগরীতে এক রমণী প্রতিহিংসার ধ্বংসযজ্ঞ সাজানোর পরিকল্পনাতে ব্যস্ত।

সকাল সকাল ছোট্ট ছোট্ট করাঘাতে রঙ্গনের ঘুম ছুটে গেলো।নিজের প্রসস্ত বক্ষঃস্থলে উষ্ণ কিছুর অবস্থান অনুভব করে সেদিকে নজর ঘুরাতেই অদিতির ঘুমন্ত আনন দৃশ্যমান হলো। প্রাপ্তির একটা সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো রঙ্গনের অধর কোণে। নিজের খসখসে ওষ্ঠ ছুয়ে দিলো প্রেয়সীর ললাটে।ওদিকে বাবাই মাম্মামের দরজা বন্ধ পেয়ে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে আহিনা। অনেকক্ষণ ডাকার পরেও যখন সাড়াশব্দ পেলো না তখন দরজার সামনে বসে উচ্চস্বরে কান্না জুড়ে দিলে। আহিনার কান্না কানে আসতেই রঙ্গন সম্বিত ফিরে পেলো। ততোক্ষণে অদিতিরও নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। রঙ্গন দ্রুত দরজা খুলে আহিনাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।রঙ্গন আহিনাকে বুকে নিয়ে অনেকরকম আদর দিয়ে বুঝিয়ে কান্না থামিয়েছে। কান্না থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোট ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
– তুমি আমার বাবাইয়ের জামা পরেছো কেন? বাবাই এজন্য খালি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অদিতি একটু অপ্রস্তুত হলো তার গায়ে রঙ্গনের টিশার্ট জড়ানো রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রঙ্গনের শুধুমাত্র ট্রাউজার পরা।গতরাতের কথা মনে পড়ে গেলো এবার অদিতির।লজ্জারাঙা মুখাবয়ব অন্যদিকে ফিরে লুকাতে চাইলো।রঙ্গন অগোচরে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে আহিনার মন ঘুরানোর জন্য অন্য গল্পে মাতিয়ে তুললো। সেই সুযোগে অদিতি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।

ব্রেকফাস্টে অদিতি আর একটা কথাও বলেনি। চুপচাপ খেয়ে অফিসে চলে গেছে। রঙ্গন অদিতির অস্বস্তি বুঝে সবার সামনে আর কিছু বলেনি শুধু অদিতির চোখে চোখ পড়তেই দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিছে যেটা অদিতিকে আরো অস্বস্তিতে ফেলেছে।মনে মনে রঙ্গনকে অসভ্য বলতেও ভুলেনি।

– নয়নের থেকে নিশ্চয়ই জেনেছো তোমাকে বাংলাদেশ যেতে হবে দুইদিনের জন্য।
রওনক সাহেবের কথায় রঙ্গন মাথা নাড়ালো।
– তুমি যেতে না চাইলে আমি যেতে পারি কিন্তু।
রঙ্গন একটা বাকা হাসি দিয়ে বলল,
– আমাকে তো এবার যেতেই হবে বাবা।আরাফ মাহমুদ যে আমার আশায় চাতক পাখির মত বসে আছে।
রওনক সাহেব বুঝলেন ছেলে কিছু একটা পরিকল্পনা করে রেখেছে।তবে বেশি ঘাটলেন না। উনার যতটুকু করার দরকার আড়াল থেকেই করবেন।আরো কিছুক্ষণ দুজনে কথাবার্তা বললেন তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রঙ্গন বাবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে রওনক সাহেব প্রশ্ন ছুড়লেন,
– অদিতি তো অফিসে এত তাড়া কিসের?
– মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি।
যেতে যেতে প্রত্যুত্তর করলো রঙ্গন। রওনক সাহেব মুচকি হেসে চিন্তা করলেন ভাবা যায় তার যাযাবর ছেলে বউ বাচ্চা নিয়ে সংসারী হচ্ছে

স্কুল থেকে আহিনাকে নিয়ে রঙ্গন সরাসরি অদিতির অফিসে এসেছে। সকালে সেই যে অদিতি চোখ রাঙিয়ে অফিসে এসেছে তারপর আর রঙ্গনের ফোন তুলছে না। বউ ফোন তুলবে না এই ব্যাপারটা রঙ্গন কিছুতেই মেনে নিবে না। আহিনাকে রিফাতের সাথে কিডস জোনে পাঠিয়ে সে সরাসরি অদিতির কেবিনে ঢুকে গেলো অদিতি তখন কোন একটা ফাইলে ডুবে ছিল রঙ্গনের উপস্থিতি টের পেলো না।

(বোঝে না, বোঝে না বউ আমার, বোঝে না আমারে)
(বোঝে না, বোঝে না, বোঝে না, বোঝে না আমারে)।।

পরিচিত গানের গলা শুনে অদিতি ফাইল থেকে মাথা তুলে চাইলো। গুনধর বরমশাইকে দেখতে পেয়ে হতাশ হলো।রঙ্গন অদিতির সামনের চেয়ারে বসে দুঃখী মুখে গাইলো।

জীবন পুরা বদলে গেল
ছিল যেসব অগোছালো
শিখছি আমি নতুন করে বউয়ের চাপে ঘর গোছানো
ঝাড়ু দেয়া, ভেজা towel
এই অভ্যাস ভাল্লাগে না
যে চোখে তার মায়া ছিল, আজ আমাকেই ভাল্লাগে না

অদিতি চোখ গরম করে তাকালে রঙ্গন মুখ গোমড়া করে পুনরায় গাইলো ,

তবে কোথায় হারালো সেই প্রেম?
অনুভূতির জোয়ার, মায়া তোমার-আমার
অভিমানে ঢাকা পড়ে গেছি
লাগে বেশি-বেশি যখন কাছে আসি

রঙ্গন এবার অদিতির নাক টেনে দিয়ে একটা হাসি দিলো…

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে
বোঝে না, বোঝে না বউ আমার, বোঝে না, বোঝে না রে!!

অদিতি চেয়ারে আরাম করে বসে ভ্রু কুচকে বলল,
– গায়ক হয়ছো বলে কি যেকোন সিচুয়েশন গান গেয়ে হ্যাণ্ডেল করবা ভেবেছো? আর তোমার কি সব পরিস্থিতির জন্য গান রেডি থাকে সব সময়?
রঙ্গন একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলল,
– আমার রঙ্গবতী যেমন তার শান্ত স্নিগ্ধ আচরণ দিয়ে আমাকে সামলে নেয় সেরকম আমার এই গানটাই আছে তাকে সামলে নেয়ার জন্য।
অদিতি নিষ্পলক চেয়ে রয় রঙ্গনের দিকে। এরকম লাগামছাড়া রগচটা মানুষ কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে বার বার অদিতিকে বশীভূত করে ফেলে ভেবে অবাক হয় সে। অদিতির নিষ্পলক আখিতে আখি মেলায় রঙ্গন চোখে মুখে তার প্রাপ্তির হাসি। তার মিস চড়ুই যে ধীরে ধীরে তার ভালোবাসার বেড়াজালে আটকে গেছে ভালোই অনুভব করতে পারে সে।

অফিস থেকে সরাসরি গ্রোসারি শপিংয়ে এসেছে অদিতি। রঙ্গন আর আহিনাও সাথে এসেছে।কিন্তু তাদের শপিং করার সেক্টর আলাদা। অদিতি শাকসবজি আর ফলমূল কিনতে ব্যস্ত আর রঙ্গন আহিনা মুখরোচক স্ন্যাকস কিনতে ব্যস্ত।অদিতি ট্রলিতে বিভিন্ন রকম ফল উঠাতে উঠাতে একবার পিছন ফিরে দেখলো আহিনা দুইহাতে চিপসের প্যাকেট ধরে দাড়িয়ে আছে আর রঙ্গন রক পেপার সিজারের মাধ্যমে চুজ করতেছে কোনটা নিবে। অদিতি হতাশ হলো।ভাবলো মেয়ে যে রঙ্গনের মত বিগড়াবে সেটা নিশ্চিত।
রঙ্গন আর আহিনা তখন গামিস কিনতে ব্যস্ত হঠাৎ রঙ্গনের নজরে এলো অদিতির সাথে শার্ট প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক হেসে হেসে কথা বলছে আর পাশে পাশে হেটে শপিং করছে। রঙ্গন চোখ উল্টালো। উদাস হয়ে আহিনাকে বলল,
– জানো তো বেবী মাম্মাম ছোটখাটো বাচ্চাদের মত দেখতে হলে কত ঝামেলা?
আহিনা কথা কিছু না বুঝলেও আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
– কি ঝামেলা বাবাই?
– সব সময় পাহারা দিয়ে রাখতে হয় নাহলে চারপাশে মাছি ভনভন করে।
যদিও ছোট্ট আহিনার মাথায় সেসব ঢুকলো না তারপরও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রঙ্গন খেয়াল করলো অদিতি বেশি কথা না বললেও লোকটা বেশ হেসে হেসে কথা বলছে।অদিতিকে বিভিন্নরকম প্রোডাক্ট সাজেস্ট করছে। রঙ্গনের বুঝি আর সহ্য হলো না। মেয়েকে বলল ,
– মাম্মামের কাছে যেয়ে বলো বাবাই ডাকছে।
আহিনা দৌড়ে গেলো মাকে ডাকতে। রঙ্গন একটা শয়তানি হাসি দিয়ে ভাবলো হতচ্ছাড়া রঙ্গনের বউয়ের সাথে লাইন মারা।

– মাম্মাম বাবাই তোমাকে ডাকছে।
হঠাৎ আহিনার কণ্ঠে আগন্তুক আর অদিতি আহিনার দিকে তাকালো। আগন্তুক কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
– আপনার মেয়ে?
অদিতি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আগন্তুককে একটু বিমর্ষ দেখালো কি? মেয়েকে দেখে মনে মনে হাফ ছেড়ে বাচলো অদিতি। এই লোক যেহারে কথার ঝুড়ি খুলে বসেছিলো। দ্রুত মেয়েকে নিয়ে রঙ্গনের দিকে যেতে লাগলো। ওদিকে আগন্তুকের বিমর্ষ চেহারা দেখে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেলো রঙ্গন।

রাতে অদিতি সোফায় বসে অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চেক করছিলো এমন সময় হুট করে রঙ্গন এসে অদিতির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। অদিতি একটু চমকে গেলেও রঙ্গনকে দেখে সামলে নিলো। রঙ্গন অদিতির হাত নিয়ে নিজের মাথার উপরে রাখলো।
– একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিন তো ঘুম পাচ্ছে।
– আজব ঘুম পাচ্ছে তো বেডে যাও।
– উহু বউ পাশে না থাকলে ঘুম আসেনা।
অদিতি মুখে বিরক্তি দেখালেও একহাত দিয়ে ঠিকই রঙ্গনের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। প্রশান্তিতে নেত্র বুজে এলো রঙ্গনের।কিন্তু ঘুমালে তো চলবে না আজ অদিতিকে আরাফের সাথে বিজনেস ডিলের কথাটা জানাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রঙ্গন। অদিতির অগোচরে কিছু করতে চায় না সে।অদিতির উদরে মুখ গুজে রঙ্গন বলল,
– একটা কথা বলতে চাই প্লিজ রাগ করবেন না।
অদিতি ভাবলো আবার হয়তো ঘরবাড়িতে সে আর আহিনা কোন ভাংচুর চালিয়েছে। ফাইলে চোখ রেখেই জানতে চাইলো আদিতি,
– আবার কি ভেঙেছো বাপ মেয়ে?
রঙ্গন উঠে বসলো তারপর অদিতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুই হাত মুঠোবন্দী করে বলল,
– আমি আরাফ মাহমুদের সাথে বিজনেস কোলাব করেছি।
অদিতি ঠান্ডা চোখে চাইলো রঙ্গনের দিকে।সেই দৃষ্টিতে রঙ্গন বুঝি ঘাবড়ালো। অদিতি রঙ্গনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হতে হতে বলল,
– কারণ কি?
– তাকে তার কর্মফল ভোগ করানো।
অদিতি রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল,
– পাগলামি করার মানে হয় না রঙ্গন। তাকে তার মতো ছেড়ে দাও। নোংরা নিয়ে ঘাটাঘাটি করা আমাদের কাজ নয়।
রঙ্গন চট করে অদিতিকে উরুর উপরে বসিয়ে জড়িয়ে ধরলো। অদিতির গলায় মুখ গুজে দিয়ে বলল,
– উহু আপনি কেন নোংরা ঘাটবেন আপনি তো পবিত্র। আপনার আশেপাশের সমস্ত নোংরা পরিষ্কার করার দায়িত্ব আমার।আপনাকে কেউ কষ্ট দিয়ে পৃথিবীতে সুখীভাব বাস করবে আমি বেঁচে থাকতে সেটা সম্ভব না। আপনার অগোচরে কিছু করতে চাই না তাই জানালাম ব্যাপারটা।
অদিতি রঙ্গনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– আমি জানি না কি করতে চাইছো তবে অন্যায় কিছু করবে না।
রঙ্গন অদিতির গ্রীবাদেশ ঠোট ডুবিয়ে ছোট ছোট চুমু দিয়ে একটা বাকা হাসি দিলো। ভাবলো অদিতিকে জানানোটা দরকার ছিল সেটা জানানো হয়ে গেছে বাকিটা সে সামলে নেবে।আর ন্যায় অন্যায় দেখে নেয়ার জন্য অদিতির শ্বশুরমশাই যথেষ্ট।

এবারের মিটিংটা রওনক চৌধুরীর ঢাকার অফিসে ঠিক করা হয়েছে।বেশ সুষ্ঠুভাবে মিটিং সম্পন্ন হয়েছে। সবাই যখন মিটিং রুম ত্যাগ করবে তখন আরাফ ইতস্ততভাবেই রঙ্গনকে বলল,
– মিস্টার চৌধুরী শুনলাম খুব শীঘ্রই বিয়ে করছেন আপনাকে নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা।
রঙ্গন আরাফের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা শান্ত হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানালো।রঙ্গন বুঝতে পারছে আরাফ তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু জড়তার জন্য বলতে পারছে না।শেষমেশ আরাফ বলল,
– আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই ব্যক্তিগত!!
রঙ্গন মিটিংরুমের বাকি সবাইকে বাইরে যেতে ইশারা করলো।তারপর আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– বলুন কি বলতে চান?
– আপনি কি আপনার ফিয়ন্সের অতীত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত?

……………চলবে?

#অদিতির_যবনিকা -২২
#তিশা

আরাফের প্রশ্ন শুনে রঙ্গন ঠাণ্ডা একটা হাসি দিলো তার দিকে তাকিয়ে। সেই হাসিতে আরাফ কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। রঙ্গন সাবলীলভাবে বলল,
– সারাজীবন একসাথে থাকার জন্য যতটুকু জানা প্রয়োজন আমি জানি। আর তার অতীত দিয়ে আমার কি হবে? তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ আমি। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আরাফ রঙ্গনের কথায় বেশ অবাক হলো।সেটা তার মুখাবয়বে প্রকাশও পেলো।রঙ্গন একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি হঠাৎ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে জানতে চাইছেন?
– আপনার ফিয়ন্সে জানে আমি আপনার বিজনেস পার্টনার?
রঙ্গন একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলো আরাফকে।বুঝার চেষ্টা করলো আরাফ কি বুঝাতে চাইছে।
– আমরা একজন আরেকজনের কাজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করি না আরাফ সাহেব।তাই আপনি কেন আমার কাজের কোন খবরাখবর সে রাখে না আমিও তার কাজের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না।কিন্তু বুঝতে পারছি না আপনি হঠাৎ এসব নিয়ে কেন প্রশ্ন করছেন?
আরাফ এবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
– আমিই অদিতির প্রাক্তন স্বামী।
রঙ্গন আরাফের মুখের দিকে শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,
– আমি শুনেছিলাম উনার প্রাক্তন স্বামীর নাম আরাফ তবে আপনিই সেই আরাফ আমি জানতাম না। যাই হোক আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন আর পেশাগত জীবন আলাদা রাখতে পছন্দ করি। অদিতি আপনার অতীত ছিল আর আমার বর্তমান। এই ব্যাপারটা আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কে না আসাই ভালো। আশা করি আমি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি?
রঙ্গনের কথার ধরনে আরাফ নিশ্চিত হলো এই ব্যবসায়িক ডিলটা পুরোটাই কাকতালীয়। অদিতির সাথে এর কোন যোগসূত্র নেয়। মনে মনে শান্তি পেলো। রঙ্গন বুঝি বুঝলো আরাফের মনোভাব। মনে মনে হাসলো।
আরাফ মাথা নাড়িয়ে রঙ্গনের কথার সম্মতি জানালো। তারপর বলল ,
– সেটাই হবে কিন্তু আমি আসলে অদিতিকে নিয়ে নয় আহিনাকে নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
রঙ্গনের ললাটে ভাজ পড়লো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আরাফের দিকে।
– আপনাদের নতুন জীবনে আহিনাকে নিয়ে কোন সমস্যা থাকলে আমি আহিনাকে আমার কাছে নিয়ে রাখতে চাই।
রঙ্গনের চোখ মুখের ভাবমূর্তি বদলে গেলো যেনো। না না এখনই মাথা গরম করে কিছু করা যাবে না।অনেক কষ্টে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে শান্ত তবে দৃঢ়ভাবে বলল,
– অদিতি আর আমার সম্পর্ক এখন শুধু প্রেমিক প্রেমিকা বা ফিয়ন্সে নয় এখন আমরা স্বামী স্ত্রী। সময় আসলে ব্যাপারটা পাবলিক করা হবে। আর আইনী ভাবে আহিনা আমার মেয়ে।আমার মেয়ে তো যে কেউ চাইলেই আমি তাকে দিয়ে দেব না তাই না। অবশ্য আপনি চাইলে আইনী পদক্ষেপ নিতে পারেন তবে তাতে যে খুব বেশি লাভ হবে না সেটা আপনিও ভালো ভাবে জানেন।
রঙ্গনের শান্ত কথায় আরাফ একটু ভড়কালো।আরাফ ভেবেছিলো যদি কোনভাবে রঙ্গনকে ইনফ্লুয়েন্স করে আহিনাকে তার কাছে আনা যায়।এজন্য একটু রঙ্গনকে বাজিয়ে দেখছিলো কিন্তু মনে হচ্ছে রঙ্গনও আহিনাকে ছাড়তে নারাজ। মনে মনে হতাশ হলো সে। কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,
– আরেহ আমি তো শুধু এটাই বলতে চাচ্ছিলাম আহিনাকে নিয়ে যদি আপনার আর অদিতির মধ্যে কোন সমস্যা হয় তাহলে আমি ওকে আমার কাছে রাখতে রাজি আছি।
রঙ্গন একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলল,
– আহিনাকে নিয়ে আমার আর অদিতির মধ্যে ঝামেলা হওয়া তো অনেক দূরের কথা বরং আহিনা আমার আর অদিতির ভালোবাসার সবচেয়ে বলিষ্ঠ অনুভূতি। আপনার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
আরাফ মাথা নাড়ালো। রঙ্গন আরাফকে অন্যমনস্ক দেখে অগোচরে বাকা হাসলো তারপর কণ্ঠটা একটু নমনীয় করে বলল,
– আমি চাইবো এই ব্যাপারটা আপনার আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাক এবং এই আলোচনা এখানে শেষ হোক।
রঙ্গনের নরম কণ্ঠে আরাফ ভাবলো যাক রঙ্গনকে নিয়ে তাহলে এত ভয় পেয়ে লাভ নেয়। মনে মনে প্রসন্ন হলো সে।

আরাফ চলে যেতেই রঙ্গন চেয়ারে আয়েশ করে বসলো।অধর কোণে ফুটে উঠলো রহস্যময় এক হাসি।
“আরাফ মাহমুদ এইতো সবে শুরু প্রথমে অন্তর্দহনে জ্ব’লবে তারপর তোমাকে সর্বশান্ত করবো আমি।”

– স্যার অদিতি ম্যাম আর আহিনার আশেপাশে বেশকিছু সন্দেহজনক লোককে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে দেখা গেছে। খোজ নিয়ে দেখেছি তারা কেউ সাংবাদিক নয়।
নয়নের কথায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো রওনক চৌধুরীর কপালে।বেশ কিছুক্ষণ গভীর কিছু ভাবলেন তারপর নয়নকে আদেশ দিলেন বেশ কিছু প্রশিক্ষিত বডিগার্ড নিযুক্ত করতে যারা দূর থেকে অদিতি এবং আহিনাকে পাহারা দেবে।এবং কারা ফলো করছে দ্রুত যেনো তাদের খুজে বের করে।নয়ন মাথা নাড়িয়ে প্রস্থান করলো। রওনক সাহেব বেশ চিন্তায় পড়লেন। কারা আবার অদিতি আর আহিনার ক্ষতি কর‍তে চায়! রঙ্গন ফিরলে এই ব্যাপারে দ্রুত তার সাথে কথা বলতে হবে।

রাতে আহিনা কেদেকেটে অস্থির। বাবাই ছাড়া খাবে না ঘুমাবে না।অবশেষে রঙ্গন ভিডিও কলে বুঝিয়ে সুজিয়ে খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। কিন্তু আহিনা জানিয়েছে সারারাত ভিডিও কলে বাবাইকে থাকতে হবে। আহিনা ঘুমালে রঙ্গন অদিতিকে বলেছে সকালে আহিনা ঘুম থেকে উঠার আগেই আবার ভিডিও কল দিবে।
মেয়ে ঠিকই ঘুমিয়েছে কিন্তু অদিতির ঘুম আসছে না কিছুতেই।ঘর জুড়ে কেমন যেনো রঙ্গনের শূণ্যতা বিরাজ করছে। পাগল প্রেমিক যেনো অদিতিকেও তার প্রেমে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। অবশেষে কাবার্ড থেকে রঙ্গনের একটা টিশার্ট নিয়ে গায়ে জড়িয়েছে যেনো একটু হলেও রঙ্গনকে অনুভব করতে পারে কিন্তু বিধিবাম।তাতেও যখন কাজ হলো না অদিতি তখন রঙ্গনকে ফোন দিলো।
রঙ্গন সবে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে।অসময়ে ফোনের রিংটোনে ভ্রু কুচকে এলো তার। অদিতির নাম্বার দেখে ওষ্ঠে হাসি ফুটলো। রিসিভ করে শান্ত সুরে বলল,
– আমাকে ছাড়া আহিনার মতো আহিনার মাম্মামেরও বুঝি ঘুম আসছে না?
অদিতি লাজুক হলো কিন্তু কিছু বললো না। মনে মনে ভাবলো রঙ্গনের প্রেমে পড়ে সে টিনেজ প্রেমিকার মত আচরণ করছে কি! রঙ্গনের কথায় ভাবনাচ্যুত হলো সে।
– ভালো তো বাসেন একটু মুখে স্বীকার করতে কি হয়?
অদিতি ঠোট টিপে হাসলো অডিও কল হওয়ার দরুন সেই হাসি রঙ্গনের দৃষ্টিগোচর হলো না।অদিতি কোনমতে বলল,
– খোজ নিতে ফোন দিয়েছিলাম। রাখছি।
– তো খোজ নিন।জিজ্ঞেস করুন আমি কেমন আছি? খাইছি কি না? বউ বাচ্চাকে মিস করছি কি না?
অদিতির এবার মেজাজ খারাপ হলো। দাতে দাত চেপে বলল,
– তোমার ফাযলামি মার্কা কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারছি বহাল তবিয়তে আছো।
রঙ্গনের হাসির শব্দ ভেসে এলো। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর গীটারের টুংটাং আওয়াজ এলো। রঙ্গন নেশালো কণ্ঠে বলল,
– Ahinar Mummum I miss your smell.
অদিতি সেই কথায় অনুভূতির অকুল পাথারে হাবুডুবু খেলো কিছু প্রত্যুত্তর করতে পারলো না। ভেসে এলো রঙ্গনের সুমধুর আওয়াজ…

এ শহরের হাজারো বোকা প্রেমিকেরা তোর ভাল চায় বলে তাই উপন্যাসের বন্যা দিয়ে
মিছিল করে যায় আমি অলস তাই পিছে পড়ে রই
দিশেহারা তুই আর আমি মিলে দুই আমার নীলাকাশ ছিড়ে উড়ে গেলি তুই
আমার বোকা অভিমান তাসে হেরে যাওয়া দান তোর পুরনো কাগজে আমি মাথা গুজে শুই

দীর্ঘ তেপান্তরে বাঁধ ভেঙে যায়কোনো এক আকাশ শুধু তোকে পেতে চায়
তোর প্রেমে বুঁদ হয়ে এতো আয়োজন মন খারাপের রাতে তোকে প্রয়োজন…..

রঙ্গনের গানের অনুভূতিতে ডুবে তন্দাচ্ছন্ন হলো অদিতি।অপরদিকে অদিতির সাড়াশব্দ না পেয়ে রঙ্গন বুঝলো অদিতি ঘুমিয়ে গেছে। ফোন কেটে হাসলো সে।নিজেকে সুখী মানুষের কাতারে মনে হয় আজকাল। এতগুলো বছরের বিষাদময় রজনীগুলো এখন তার কাছে দুঃস্বপ্নের মত লাগে। মনে হয় রাতের দুঃস্বপ্নের পরে সুন্দর সকাল এসেছে তার জীবনে।

আজ কন্সট্রাকশন সাইটে এসেছে রঙ্গন। সাইট পরিদর্শনের পরে আরাফ আর সে সাইটের কর্মীদের সাথে কথা বলছিল বসে। হঠাৎ টেবিলের উপরে রাখা রঙ্গনের ফোনের শব্দে সবার মনোযোগ সেদিকে চলে গেলো।আরাফ দেখলো স্ক্রিনে অদিতি আর আহিনার একটা হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভাসছে। রঙ্গন এক্সকিউজ জানিয়ে ফোন রিসিভ করলো।
– বাবাই দুইদিন হয়নি?
গাল ফুলিয়ে জানতে চাইলো আহিনা।
– আজ রাতেই রওনা দেব বেবী।সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখবা বাবাই চলে এসেছে।
আরাফ সবটাই শুনতে পাচ্ছে। রঙ্গন একবার আড়চোখে আরাফকে দেখে নিলো তারপর অন্য পাশে চলে গেলো।আহিনা ওপাশে তখনো অভিমানের খাতা খুলে রেখেছে।
– মাম্মাম শুধু বড় বড় চোখ করে তাকায় এরপর যেখানে যাবে আমাকে সাথে নিয়ে যাবে তো।
রঙ্গন হেসে বলল,
– তোমার মাম্মাম কি করে?
– ওইযে এখনো বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
রঙ্গন হো হো করে হেসে উঠলো। ততক্ষণে অদিতি স্ক্রিনের সামনে চলে এসেছে।
– দুজনের আমার নামে নিন্দা করা শেষ?

দূর থেকে আরাফ দেখলো রঙ্গনের হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব। কত সুখী সে।অথচ রঙ্গন যে মানুষগুলোকে নিয়ে সুখের সাম্রাজ্য সাজিয়েছে সেই মানুষগুলো একটা সময় তারই ছিল। বিমর্ষ নয়নে আরাফ দেখলো অদিতি রঙ্গনের খুনসুটিময় প্রণয়ালাপ।

ক্যালিফোর্নিয়া ,
– ম্যাম রঙ্গন স্যারের কনসার্ট আগামী মাসে আপনি কি তখনই পদক্ষেপ নিতে চান?
– আগে খবর নাও রঙ্গনের সিকিউরিটি সম্পর্কে।
বডিগার্ডটি বেরিয়ে যেতেই রমণী একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল “ভালোবাসা হারানোর অনুভূতি কেমন হয় তোমারও বোঝা উচিত রাফিয়ান রঙ্গন।” তারপর চিত্তপটে ভেসে উঠলো বিষাদময় কিছু অতীত।বাদামী বর্ণের অসাধারণ নেত্র থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুমালা।

রঙ্গন যখন জাপানে ফিরলো তখন মাঝরাত। অদিতিকে জানিয়েছে সকালে ফিরবে।তাই সে রঙ্গনের বাড়ি ফেরার ব্যাপারে অবগত নয়।বেডরুমে ঢুকে প্রেয়সীকে নিজের টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে ঘুমাতে দেখে অধর প্রসারিত হলো তার।ধীর পদক্ষেপে বিছানায় নিদ্রাবিষ্ট প্রিয়তমার দিকে অগ্রসর হলো সে।কালবিলম্ব না করে সহধর্মিণীর সান্নিধ্যে নিজের জায়গা করে নিলো।হঠাৎ কারো উপস্থিতি অনুভব করে অদিতি চমকে উঠলো ঘুমের মধ্যে।দ্রুত ব্যক্তিটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে শক্তপোক্ত একটা হাত তার দুই হাত একসাথে চেপে ধরলো খাটের হেডবোর্ডে।অধরে অধর মিললো মুহুর্তেই।পরিচিত স্পর্শে শীতল হলো অদিতির চিত্ত।কর্ণগোচর হলো অতি আপন সেই কণ্ঠস্বর।

“অঙ্গুরি এসেছ তুমি ফিরে অজ্ঞাতবাসের পর
আমার এ ঘরে আজ। বহুদিন ছিলে অন্ধকারে
বস্তুত গা ঢাকা দিয়ে; তোমাকে ভেবেছি বারে বারে,
দেখেছি তোমার স্বপ্ন কত, ইতিমধ্যে বহু ঝড়
ঝাপ্টা গ্যাছে, বিস্মৃতির এক্কা দোক্কা তোমার খবর
সহজে ফেলেছে মুছে কখনো সখনো। কোন্‌ তারে
কখন লেগেছে সুর পুনরায় কোমল গান্ধারে,
আমিতো পাইনি টের; ছিল খুব হৃদয়ের জ্বর!”
(শামসুর রাহমান)

…………….চলবে?

বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।