অদিতির যবনিকা পর্ব-২৬

0
15

#অদিতির_যবনিকা -২৬
#তিশা

অদিতি হাসিমুখে ফ্লোরার সাথে হ্যাণ্ডশেক করলো।ফ্লোরা মৃদু হেসে বলল,
– আমি রঙ্গনের অনেক বড় ফ্যান ম্যাম।বলতে পারেন অন্ধভক্ত।
অদিতি ফ্লোরার চোখের ভাষায় বুঝলো ফ্লোরা শুধু রঙ্গনের সাধারণ কোন ভক্ত নয়।ফ্লোরার রঙ্গনের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি আছে। যেটা ফ্লোরা হাসির আড়ালে লুকাতে চাইছে। মনে মনে অনুভব করলো ফ্লোরার এক তরফা ভালোবাসার আকুতি।দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ভাবলো তারই বা কি দোষ। এরকম অনেক ফ্লোরারই মন ভেঙেছে তার আর রঙ্গনের সম্পর্কের নিউজে।অদিতি ভাবনা সরিয়ে ফ্লোরাকে জিজ্ঞেস করলো,
– এরকম হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছো?
ফ্লোরা হেসে বলল,
– এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে রঙ্গনের কনসার্টের ভেন্যুতে যাবো। যত দ্রুত যেতে পারবো ততো সামনের সারিতে বসতে পারবো। এজন্য এই পার্কের শর্টকাট রাস্তা দিয়ে ভার্সিটি যাচ্ছিলাম।
অদিতি হেসে ফেললো।ফ্লোরা অদিতির হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– হাত বাড়ালেই মানুষটাকে স্পর্শ কর‍তে পারেন তো এজন্য আমাদের উন্মাদনা আপনি বুঝবেন না। আমরা একটু বেশি কাছাকাছি থেকে তাকে দেখতে পেলেই নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবি।
অদিতি নিষ্পলক চাইলো ফ্লোরার দিকে। বুঝলো যে মানুষটা হাজারো তরুণীর রূপকথার স্বপ্ন পুরুষের মত যাকে পাওয়ার আকাঙ্খায় কতশত রমণী আরাধনায় মত্ত সেই পুরুষ কত সহজেই অদিতির সান্নিধ্যে ধরা দিয়েছে।অদিতি আর ফ্লোরার আলাপনের মধ্যেই আহিনা ছুটে এলো। ফ্লোরা নিচু হয়ে আহিনার থুতনি ধরে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
– এই বুঝি রঙ্গনের বেবী।
অদিতি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– তুমি বেবীর কথাও জানো?
– রঙ্গন সম্পর্কিত প্রত্যেকটা আর্টিকেল, নিউজ , ইন্টারভিউ সবকিছুই আমার মুখস্ত।
হেসে বলল ফ্লোরা।তারপর হাতঘড়িতে নজর বুলিয়ে বলল দেরি হয়ে যাচ্ছে আজ আসি। ভাগ্যে থাকলে অন্য একদিন দেখা হবে। চলে যেতে নিয়ে পুনরায় পিছু ফিরে ফ্লোরা শান্ত দৃষ্টিতে অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল,
– আপনি অসম্ভব সুন্দর। তবে রূপবতীর চেয়ে মায়াবতীই বেশি লাগে আপনাকে। এজন্যই বোধহয় রাফিয়ান রঙ্গন লক্ষ লক্ষ আধুনিক তরুণীকে ছেড়ে আপনাতেই মত্ত।
কথাগুলো বলে ফ্লোরা আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না দ্রুত কদমে পার্কের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। অদিতি হতাশভাবে ভাবলো না জানি এরকম কত রমণীর হৃদয় ভেঙেছি আমি।

ঘন্টাখানেক পরে আহিনাকে নিয়ে হোটেলরুমে ফিরলো অদিতি।আহিনা বাবাইয়ের কাছে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। অদিতি তাকে বুঝিয়েছে একটু পরেই তারা বাবাইকে টিভিতে দেখতে পারবে।আহিনা এই কথা শুনে তো সেই খুশি তার বাবাইকে টিভিতে দেখতে পাবে।

অদিতির রঙ্গনের সাথে ক্যালিফোর্নিয়া আসতে রাজি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আগামীকাল রঙ্গনের জন্মদিন। অদিতি তাকে রাত বারোটায় সারপ্রাইজ দিতে চায়। নিজের মুখে জানাতে চায় সেও রঙ্গনকে ভালোবাসে। আজ অব্দি অদিতি কখনো রঙ্গনকে ভালোবাসি কথাটা বলেনি। রঙ্গনও কখনো তাকে জোর করেনি সে যেনো অদিতির চোখের ভাষাতেই ভালোবাসা অনুভব করে নিয়েছে।এজন্য অদিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে জন্মদিনে রঙ্গনকে ভালোবাসি কথাটা নিজের মুখে জানাবে সে। সেই সাথে রঙ্গনকে লাইফের বেস্ট গিফটটা দিতে চায় সে।
দুপুরে আহিনাকে খায়িয়ে জেনিফারের রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে সে।ঘরে ঢুকতেই রঙ্গনের মেসেজ এলো সে স্টেজে উঠছে। অদিতি মেসেজটা দেখে নিশ্চিন্তে রুম ডেকোরেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবকিছু সাজাতে সাজাতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো। এমন সময় আহিনাকে নিয়ে জেনিফার রুমে ঢুকলো। আহিনাতো এত সুন্দর ডেকোরেশন দেখে হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগলো। অদিতি আহিনাকে হালকা নাস্তা খায়িয়ে জেনিফারকে বলল আহিনাকে নিয়ে হোটেলের নিচ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে।জেনিফার আহিনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে অদিতি ল্যাগেজ থেকে একটা নীল রঙের মসলিন শাড়ি বের করে। শাড়িটাতে হাত বুলিয়ে ভাবে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে ফেরার পরে রঙ্গনের ল্যাগেজ থেকে জামাকাপড় বের করার সময় শাড়িটা পায় সে।রঙ্গনকে জিজ্ঞেস করলে জানায় ‘আমার বউয়ের জন্য। তার যেদিন অনেক ভালোবাসা পাবে আমার প্রতি সেদিন যেনো এই শাড়িটা পরে আমার সামনে আসে।’ ভাবতে ভাবতে অদিতির অধর প্রসারিত হলো।রঙ্গনের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর এর থেকে ভালো সুযোগ বুঝি আর আছে।শাড়িটা নিয়ে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো সে।

রঙ্গনের আজ কেনো যেনো গানের প্রতি মন বসছে না।কেমন যেনো অস্বস্তি হচ্ছে। বারবার মন চাচ্ছে অদিতি আর আহিনার কাছে ছুটে যেতে।বেশ কিছুক্ষণ আগে অদিতিকে ফোন করে কথাও বলেছে সে। কিন্তু কোন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।চিন্তা করলো যত দ্রুত সম্ভব কনসার্ট শেষ করে হোটেলে ফিরে যাবে সে।

অদিতি চেঞ্জ করে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখলো ব্লাউজের গলাটা বেশ বড়। বক্ষ বিভাজনের একটু উপরেই বেশ কালচে বেগুনি একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে।ক্ষতটাতে হাত বুলিয়ে রক্তিম হলো সে। ভাবলো পাগলাটে প্রেমিকের এরকম কতশত ক্ষত নিয়ে ঘুরতে হয় তাকে।শাড়ির আচল তুলে দিয়ে ভালোভাবে আড়াল করে নিলো তার পাগলাটে প্রেমিকের বেপরোয়া ভালোবাসার চিহ্ন।
কানের দুল পরতে পরতে হঠাৎ রুমের লাইট চলে গেলো। অদিতি ভ্রু কুচকে ভাবলো ক্যালিফোর্নিয়াতেও কি লোড শেডিং হয়।হঠাৎ কক্ষে দ্বিতীয় কোন মানুষের অস্তিত্ব অনুভব হতেই তীক্ষ্ণ সঙ্কা জেগে উঠলো মনে।

রঙ্গন কনসার্ট শেষ করে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে গেছে।হোটেল রুমে ঢুকতেই অন্ধকার দেখে ভ্রু কুচকে এলো তার। অদিতিকি ঘুমিয়ে পড়লো? দ্রুত ফোনের ফ্লাশ অন করে সুইসবোর্ড খুজে লাইট অন করলো সে। কক্ষ জুড়ে বৈদ্যুতিক আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়লো।দৃশ্যমান হলো সুন্দর করে ডেকোরেশন করা কক্ষটি। ঠোটের কোণে হাসি ফুটলো তার।টি টেবিলের উপরে কেক আর গিফট বক্স দেখে মনে পড়লো আজ তার জন্মদিন। আশেপাশে অদিতিকে খুজে না পেয়ে টি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

রিফাত হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো।
– ভাই জেনিকে অজ্ঞান অবস্থায় হোটেলের লনে পাওয়া গেছে।
মুহূর্তেই রঙ্গনের চেহারার হাসি মুছে গেলো।ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো মুখাবয়ব।কিছু বলতে উদ্যত হবে এমন সময় ফোন বেজে উঠলো তার।স্ক্রিনে ইনকামিং নাম্বারটা দেখে দ্রুত রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে কি বললো ঠিক বোঝা গেলো না। ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই রঙ্গন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে রিফাতকে বলল,
– জেনিফারের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা কর।আমি আসছি।
রঙ্গনকে অনুসরণ করতে করতে রিফাত বলল,
– আমিও যাবো আপনার সাথে। জেনিফারের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।
রঙ্গন প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না চলার গতি বাড়িয়ে দিলো।

কনসার্ট শেষে ফ্লোরা আর ন্যান্সি হাটতে হাটতে হোস্টেলের দিকে যাচ্ছে।ন্যান্সি বুঝতে পারছে ফ্লোরা বেশ বিমর্ষ। তাই বিভিন্নরকম গল্পগুজব করে বন্ধুর মন ভালো করার চেষ্টা করছে সে।ফ্লোরাকে নিরিবিলি গলিতে ঢুকতে দেখে ন্যান্সি ওকে বলল,
– এদিক দিয়ে কেন যাচ্ছিস? রাস্তাটা ভালো না জানিস না?
– আরে কিচ্ছু হবে না এটা শর্টকাট। চল তো।
ফ্লোরার কথায় আর বেশি কথা বাড়ালো না সে।হঠাৎ তাদের পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে একটা কালো গাড়ি চলে গেলো। ন্যান্সি ভয় পেয়ে ফ্লোরার দিকে সরে যেয়ে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
– নিশ্চয়ই কোন মা’তাল চালাচ্ছে গাড়ি। পুলিশ যে ইদানীং কি করছে।

পুরনো এক কারখানায় অদিতিকে চেয়ারের সাথে বেধে রাখা হয়েছে। বাইরের করিডোর থেকে আসা অল্প আলোর ছটায় নিভু নিভু চোখে অদিতি চেয়ে দেখলো চারপাশে পুরাতন কিছু যন্ত্রপাতি এবং আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দরজার পাশে দুজন সশস্ত্র গার্ডকে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে কক্ষের আলো জ্বলে ওঠায় অদিতি চোখ বন্ধ করে নিলো।ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইলে সামনে দাড়ানো সুন্দরী তনয়া দৃষ্টিগোচর হলো তার। অবাক হয়ে আস্তে করে বলল,
– সোফিয়া!
সোফিয়া একটা বাকা হাসি দিয়ে অদিতির সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
– সারপ্রাইজ রঙ্গনের রঙ্গবতী।
অদিতি কিছু বলল না। শান্ত চোখে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলো সে।অদিতির দিকে তাকিয়ে সোফিয়া একটা হাসি দিয়ে বলল,
– তোমার এই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে অদিতি তুমি কখনো উত্তেজিত হও না। সব সময় শান্ত থাকো।এজন্যই বুঝি দুরন্ত রঙ্গন তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
– আমাকে এভাবে তুলে নিয়ে আসার কারণ কি?
শান্তভাবেই জিজ্ঞেস করলো অদিতি।
– তোমাকে মে’রে ফেলা।
অকপট স্বীকারোক্তি সোফিয়ার।অদিতি ভ্রু কুচকে তাকালো সোফিয়ার দিকে।সোফিয়া অট্টহাসি দিয়ে বলল,
– তুমি কি ভেবেছো তোমাকে মে’রে রঙ্গনকে আমার করে নিতে চাইছি।উহু মোটেই নয়।রঙ্গনকে আমি কখনোই ভালোবাসিনি। ভালোবাসা তো দূর রঙ্গনকে আমি ওই নজরেই কখনো দেখি নি।
কথাগুলো বলে সোফিয়া অদিতির দিকে এগিয়ে গেলো একটু তারপর শক্ত করে অদিতির গাল চেপে ধরে বলল,
– আমার ভালোবাসা তো রঙ্গনের জন্য বহু আগেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। তাই তোমাকে মে’রে রঙ্গনকে বোঝাতে চায় ভালোবাসা হারালে কেমন লাগে।

কিছুদূর হেটে সামনে যেতেই ফ্লোরা আর ন্যান্সি দেখলো কিছুক্ষণ আগের সেই কালো গাড়িটা রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে কালো পোশাকধারী কয়েকজন লোককে বেরিয়ে আসতে দেখে ফ্লোরা আর ন্যান্সি দ্রুত একটা ডাস্টবিনের পিছনে লুকিয়ে পড়লো। আড়াল থেকে ফ্লোরা দেখলো লোকগুলো একটা ছোট ঘুমন্ত বাচ্চাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো।ফ্লোরা দ্রুত ফোন বের করে গাড়িটার ছবি তুললো।গাড়িটা দ্রুতবেগে চলে যেতেই ফ্লোরা আর ন্যান্সি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো।ছুটে গেলো বাচ্চাটির কাছে। কোলে তুলে বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে আতকে উঠলো সে। বিড়বিড় করলো রঙ্গনের বেবী।ন্যান্সি ফ্লোরাকে জিজ্ঞেস করলো ,
– চিনিস বাচ্চাটাকে?
ফ্লোরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝালো তারপর আস্তে করে বলল,
– রঙ্গন আর অদিতির বেবী।
ন্যান্সি অবাক হয়ে বলল,
– এখানে এভাবে ফেলে রেখে গেলো কারা?
হঠাৎ অনেকগুলো পদধ্বনিতে চমকে তাকালো ন্যান্সি আর ফ্লোরা।দেখলো বেশ কিছু সশস্ত্র বডিগার্ড টাইপের লোক তাদের দিকে পি’স্তল তাক করে আছে।একজন বডিগার্ড এগিয়ে এসে বলল,
– বাচ্চাটাকে আমাদের কাছে দিন মিস!

……………….চলবে?

বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।