#অদিতির_যবনিকা -৩১
#তিশা
রাতে বাড়ি ফিরে আরাফ বিয়ের কার্ডটি রুহির দিকে বাড়িয়ে দিলো। রুহি কনফিউজড হয়ে কার্ডটি হাতে নিয়ে খুলল।পুরোটা পড়ে হতবাক হয়ে আরাফের দিকে চাইলো।আরাফ নির্বিকার ভাবে বলল,
– রঙ্গন আজ অফিসে এসে ইনভাইট করে গেছে। তুমিও ইনভাইটেড।যেতে চাও?
রুহি কিছু বললো না পুনরায় কার্ডের দিকে গভীর চাহনিতে তাকিয়ে রইলো।
জোর কদমে এগিয়ে চলছে অদিতি আর রঙ্গনের বিয়ের প্রস্তুতি। আহিনা কিছু না বুঝেও বেশ আনন্দিত বাবাই আর মাম্মামের বিয়ের জন্য।যদিও অল্প সংখ্যক অতিথি নিমন্ত্রিত তারপরও রওনক সাহেব একমাত্র ছেলের বিয়েতে কোনরকম ত্রুটি রাখতে চান না।
আজ সবাই মিলে শপিংয়ে এসেছে রঙ্গন আর অদিতির বিয়ের জামাকাপড় কিনতে। অদিতি মামী এবং আনিশার সাথে শাড়ি দেখছে। রঙ্গন আহিনাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদিতি একটা একটা করে বেনারসি রঙ্গনকে ইশারায় দেখাচ্ছে কিন্তু রঙ্গনের একটাও পছন্দ হচ্ছে না। শেষে বিরক্ত হয়ে অদিতি রঙ্গনকে আর কিছু না দেখিয়ে একটা মেরুন রঙের বেনারসি নিয়ে ট্রায়াল রুমে ঢুকলো।
রঙ্গন তখন আহিনাকে আনিশার পাশে বসিয়ে মাম পট থেকে পানি খাওয়াচ্ছিলো হঠাৎ আনিশা জোরেসোরে ওয়াও বলে উঠতেই রঙ্গন আনিশার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই যেনো বেড়ে গেলো রঙ্গনের হৃদ স্পন্দন।আনিশা রঙ্গনের অনুভূতি বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল,
– ভাইয়া নিঃশ্বাস নিন নাহলে দম বন্ধ হয়ে যাবে।
আনিশার কথায় রঙ্গন মাথা নিচু করে হাসলো তারপর আবার দৃষ্টি মেললো প্রেয়সীর দিকে।অদিতি রঙ্গনের দৃষ্টিতে লাজুক হলো বুঝি। এদিক ওদিক তাকিয়ে ছুটে গেলো ট্রায়াল রুমে।
অদিতি কেবল শাড়ির আচল নামিয়ে শাড়ি খুলতে উদ্যত হয়েছে এমন সময় কাউকে ট্রায়াল রুমে ঢুকতে দেখে তড়িঘড়ি করে আচল উঠিয়ে পিছু ফিরে দেখলো রঙ্গন বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে।চোখে মুখে তার দুষ্টুমির ছাপ। অদিতি কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
– এখানে কি করছো তুমি?
– আমার বউকে দেখতে এসেছি।
নির্লিপ্ত উত্তর রঙ্গনের। অদিতির আনন রক্তিম হলো লজ্জায়।রঙ্গন হেসে অদিতির দিকে এগিয়ে শাড়ির আচলটা অদিতির মাথায় তুলে দিলো।তারপর অদিতিকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– দেখুন আমার বউ কি সুন্দর!
অদিতি দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। রঙ্গন অদিতির কানে অধর ছুয়ে গভীর কণ্ঠে বলল,
– আমার ভালোবাসা নিজের মধ্যে ধারণ করে ঘুরছেন অথচ এখনো এত লজ্জা পাচ্ছেন?
অদিতি ঘুরে রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরে গ্রীবাদেশে দাত বসিয়ে দিলো।ব্যথা পেলেও রঙ্গন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।অদিতিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– লজ্জা দেয়াতে যদি এরকম শাস্তি পেতে হয় তাহলে এরকম লজ্জা আমি সব সময় দেব।
এমন সময় আহিনার ডাক শুনে রঙ্গন অদিতির ললাটে অধর ছুয়ে বেরিয়ে এলো।
আজ অদিতির মেহেদী সন্ধ্যা। অদিতি এবং আহিনা কলাপাতা রঙের জামদানী পরেছে। আহিনা মাম্মামের মত হাতভর্তি মেহেদী দিতে পেরে সেই খুশি। মেয়েরা সবাই যখন মেহেদী দিতে ব্যস্ত হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো।কোলাহলের আওয়াজের মধ্যেই হঠাৎ একফালি আলোরশ্মি পড়লো স্টেজে। অদিতি তাকিয়ে দেখলো সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরা রঙ্গন গীটার হাতে বসে আছে।তারপর ধীরে ধীরে গীটারে সুর তুললো……
সে ছিলো বড়োই আনমনা
আর ছিলো আমার কল্পনা আল্পনা
সে ছিলো বড়োই আনমনা
আর ছিলো আমার কল্পনা আল্পনা
সে ছিলো বড়োই আনমনা
আর ছিলো আমার কল্পনা আল্পনা
সে যে পূর্ণিমা রাত ছিলো
সে যে ভালোবাসার গান ছিলো
সে যে পূর্ণিমা রাত ছিলো
সে যে ভালোবাসার গান ছিলো
সে ছিলো বড়োই আনমনা
আর ছিলো আমার কল্পনা আল্পনা
আল্পনা আল্পনা…
অদিতি রক্তিম আননে চেয়ে রইলো রঙ্গনের দিকে।এক রঙ্গনের প্রেমে আর কতবার পড়বে সে।গান শেষ হতেই আহিনা ছুটে গেলো বাবাইয়ের কাছে। রঙ্গনও বাহুবন্দী করে নিলো তার ছোট্ট জানটাকে।আহিনা নিজের ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটি উচু করে দেখিয়ে বলল,
– বাবাই দেখো আমি কি দিয়েছি।
রঙ্গন আহিনার কোমল হাত দুটিতে ঠোট ছুয়িয়ে বলল,
– আমার বেবীকে খুব সুন্দর লাগছে।
আহিনাও খুশি হয়ে তার বাবাইয়ের গাল আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো।
আহিনাকে নিয়ে রঙ্গন অদিতির সামনে এসে আহিনাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে অদিতির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। অদিতি নিষ্পলক চাইলো রঙ্গনের দিকে।রঙ্গন চোখ দিয়ে ইশারা করলো হাত ধরতে।অদিতি রঙ্গনের চোখের দিকে তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে দিলো।
রঙ্গন অদিতিকে নিয়ে ডান্স ফ্লোরে নিয়ে গেলো। অদিতি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
– কি করছো কি? এই অবস্থায় ডান্স করতে যেয়ে পড়ে টড়ে গেলে বিপদ হবে।
রঙ্গন অদিতির হাতে অধর ছুয়ে বলল,
– বাবাই পুচকু আর তার মাম্মামের কিছু হতে দেবে না।ভরসা আছে না আমার উপরে?
অদিতি মাথা নাড়ালো। রঙ্গনের অধর প্রসারিত হলো।হঠাৎ মিউজিক বেজে উঠলো তেরি মেরি মেরি তেরি প্রেম কাহানি। রঙ্গন অদিতির কোমর জড়িয়ে গানের তালে তালে অদিতিকে নিয়ে ডান্স করতে লাগলো।
রাতে অদিতি রঙ্গনের সামনে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। রঙ্গন মেহেদী রাঙা হাত দুটো ধরে তাতে চুমু দিলো। অদিতি ঝাড়া মে’রে হাত সরিয়ে নিয়ে ঝাঝালো কণ্ঠে বলল,
– সব সময় শুধু লুতুপুতু চিন্তা। তোমাকে হাত দিয়েছি নিজের নাম খুঁজে বের করতে।
রঙ্গন ঠোট বাকিয়ে হাসলো। তারপর আলতো ভাবে অদিতির হাত ধরে নিজের কাছে এগিয়ে নিলো।
– এত সুন্দর বউ থাকলে লুতুপুতু চিন্তা তো আসবেই।
অদিতি চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রঙ্গন হেসে সরি বলল।তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিজের নাম খুজে বের করে তাতে অধর ছুয়ালো। তারপর নিজের হাত বাড়িয়ে বলল,
– আপনাকে আর কষ্ট করে নাম খুজতে হবে না।
অদিতি দেখলো রঙ্গনের হাতে খুব সুন্দর করে ডিজাইন করে অদিতির নাম লেখা। অদিতি অবাক হয়ে বলল,
– তুমি এটা কখন করলে?
রঙ্গন কিছু বলল না আলতো হাসলো। অদিতি রঙ্গনের ঘাড়ে মাথা দিয়ে দুজনের হাত দুটো পাশাপাশি করে অপলক চেয়ে রইলো।
পরদিন হলুদের অনুষ্ঠানও বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। “আজ রঙ্গন অদিতির বিয়ে।”রঙ্গন জানিয়েছে আহিনা তার সাথে বরযাত্রী হয়ে আসবে। আহিনাও ব্যাপারটাতে বেশ উৎসাহী। সেজেগুজে বাবাইয়ের সাথে মাম্মামকে আনতে যাবে।
বর সেজে আহিনাকে কোলে নিয়ে গেটে দাড়িয়ে আছে রঙ্গন। জেনিফার আর আনিশাসহ অদিতির দূরসম্পর্কের কিছু কাজিন গেট আটকে দাড়িয়ে আছে।তাদের দাবি পঞ্চাশ হাজার টাকা না দিলে গেট ছাড়বে না।রঙ্গন এক বাক্যে রাজি হয়ে যায়। রিফাত পাশ থেকে কানে কানে বলল,
– ভাই একটু তো দর কষাকষি করতেন।
রঙ্গন একটা হাসি দিয়ে বলল,
– কাউকে ভালোবেসে এক দশক অপেক্ষা করেছিস রিফাত? করলে বুঝতিস।আমার বিয়েতে যারা মজা করতে চাইছে আমি চাই তারা সবাই খুশি থাকুক। আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়ার মত সামর্থ্য না থাকলে একটা কথা ছিল কিন্তু যেহেতু আছে তাহলে শুধু শুধু এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে গুলোকে কেন অখুশি করবো।
রিফাত আলতো হাসলো। বুঝলো সবাই ভালোবাসতে পারে কিন্তু রাফিয়ান রঙ্গনের মত এরকম গভীরভাবে কয়জনই ভালোবাসতে পারে।
আহিনা ছুটে গেছে মাম্মামের কাছে।আহিনাও অদিতির মত মেরুন কালারের লেহেঙ্গা পরেছে।মাম্মামকে টুকটুকে বউয়ের সাজে দেখে আহিনা তো সেই খুশি। অদিতি মেয়েকে দেখে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো। আহিনা মায়ের কোলে উঠে বলল,
– মাম্মাম তোমাকে খুব প্রিটি লাগছে।
অদিতি মেয়ের গাল টেনে বলল,
– আমার বেবীকেও অনেক প্রিটি লাগছে।
মায়ের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে আহিনা আবার ছুটলো বাবার কাছে। আজ সে খুব খুশি।বিয়ে জিনিসটা বুঝতে না পারলেও আজ যে খুশির দিন সেটা ঠিকই বুঝতে পারছে।
ছুটতে ছুটতে স্টেজে রঙ্গনের কাছে গেলো সে।
– বাবাই বাবাই!!
রঙ্গন আহিনাকে কোলে তুলে নিয়ে কপালের ছোট্ট টিকলিটা ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
– কি হয়েছে আমার বেবী এত খুশি কেন?
– জানো বাবাই মাম্মামকে একদম প্রিটি পুতুলের মত লাগছে।
উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল আহিনা।রঙ্গন হেসে বলল ,
– জানি তো আমার বেবী আর তার মাম্মামকে সব সময়ই পুতুলের মত লাগে।
বিয়ে পড়ানো শেষ হলে অদিতি আর রঙ্গনের মাঝখান থেকে ফুলের পর্দাটা সরিয়ে ফেলা হলো।আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে বলা হলো দুজনকে। রঙ্গনকে জিজ্ঞেস করা হলো সে কি দেখতে পাচ্ছে?সে অকপটে জবাব দিলো ‘রঙ্গনের জীবনের আকাঙ্খিত সুখ।’ অদিতিকে জিজ্ঞেস করা হলে সে একটু সময় নিয়ে ধীর স্বরে বলল #অদিতির_যবনিকা। রঙ্গন কথাটা শোনামাত্র নিষ্পলক চাইলো অদিতির দিকে।এতটা ভালোবাসে তার রঙ্গবতী তাকে।
পুরো ব্যাপারটা অবলোকন করলো রুহি আর আরাফ। আরাফ বুঝলো যে ভালোবাসা সে অদিতির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো সেই ভালোবাসা অন্য কেউ উজাড় করে দিয়েছে অদিতিকে।
আরাফ পরিচিত কিছু ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলছিলো তখন রুহি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো আহিনা কিছু বাচ্চাদের সাথে খেলছে। রুহি ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো।
– হাই আহিনা।
আহিনা ডাক শুনে সেদিকে তাকালো। প্রত্যুত্তরে হাসিমুখে কিউট করে হাই জানালো সেও।
– তুমি কি তোমার আসল বাবাকে চিনো?
আহিনা যেনো রুহির কথায় কনফিউজড হলো।বাবা আবার আসল নকল হয় নাকি।
– আসল বাবা?
আহিনা জানতে চাইলো। রুহি মাথা নাড়ালো। ততোক্ষণে আরাফও চলে এসেছে। রুহি আরাফকে দেখিয়ে বলল,
– এই যে তোমার আসল বাবা।
আহিনা আরাফের দিকে তাকালো আরাফও বুঝি একটু আবেগী হলো। এগিয়ে গেলো আহিনার দিকে কিন্তু আহিনার কথায় তার পা থেমে গেলো।
– আমার বাবাই আছে। অন্য কোন বাবাই লাগবে না।
রুহি হেসে আহিনার কাছে যেয়ে গালে আদর দিয়ে বলল,
– রঙ্গন তোমার আসল বাবা নয় তোমার স্টেপ ড্যাড। ইনি তোমার আসল বাবা।কয়েকদিন পরে তোমার মাম্মামের নতুন বেবী আসবে তখন কিন্তু বাবাই আর মাম্মাম এরকম আদর করবে না তোমাকে।
আহিনার যেনো কথাটা পছন্দ হলো না।গাল ফুলিয়ে বলল,
– তোমরা পচা আংকেল আন্টি। আমার বাবাই মাম্মাম বেস্ট।
কথাটা বলে আহিনা দৌড়ে রঙ্গন আর অদিতির দিকে চলে গেলো।আরাফ আর রুহি হতাশ হয়ে আহিনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আরাফ দেখলো আহিনা দৌড়ে রঙ্গনের কাছে যেয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো রঙ্গনও হাসিমুখে তাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর আহিনা গাল ফুলিয়ে রঙ্গনের বুকে মাথা এলিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো। রঙ্গনও পরম আদরে আহিনার কপালে চুমু দিয়ে আদর করে কি যেনো বলছে।আরাফ রুহি বুঝলো আহিনা শুধু নামেই রঙ্গনের মেয়ে নয় তারা আত্মার আপন।
………………চলবে?