#অদিতির_যবনিকা -(বোনাস পর্ব)
#তিশা
সন্ধ্যায় রঙ্গন অদিতি আর আহিনাকে নিয়ে এলো রওনক সাহেবের সাথে দেখা করাতে।অদিতি রওনক সাহেব আর আহিনার বণ্ডিং দেখে যারপরনাই অবাক হলো।আহিনার সাথে উনার এত ভালো মেলবন্ধন কিভাবে হলো ভেবে পেলো না সে।কিছুক্ষণ আহিনার সাথে সময় কাটানোর পরে তাকে রিফাতের সাথে বাগানে খেলতে পাঠালেন রওনক সাহেব।
– আমি জানি তোমার বাবা মা কেউ আর জীবিত নেই কিন্তু আর কোন অভিভাবক আছেন কি?
রওনক সাহেব অদিতির কাছে জানতে চাইলেন।অদিতি শান্ত কণ্ঠে বলল,
– আমার মামা আছেন উনি বাংলাদেশে থাকেন আপনি উনার সাথে কথা বলতে পারেন আংকেল।
রওনক সাহেব তখনই রফিকুল ইসলামকে ফোন করলেন। দুজনের কাথাবার্তা শেষ করে ফোন রেখে রওনক সাহেব বললেন,
– তোমার মামা চাইছেন তোমাদের বিয়েটা বাংলাদেশে হোক। তিনি নিজ হাতে দায়িত্ব নিয়ে তোমার বিয়ে দিতে চান।
রওনক সাহেব একটু থেমে বললেন,
– সত্যি বলতে আমিও চাই রঙ্গনের বিয়ে দেশের মাটিতে ধুমধাম করে দিতে।
অদিতি আর রঙ্গন একে অন্যের দিকে চিন্তিতভাবে তাকালো। দুজনের ললাটেই চিন্তার রেখা দেখা দিলো।এমন সময় আহিনা ছুটে এসে রঙ্গনের কোলে বসলো। রওনক সাহেব আহিনাকে বললেন,
– দাদু খুব শীঘ্রই আমরা বাংলাদেশ যাবো।
– বাংলাদেশ কোথায় দাদু?
রওনক সাহেব আহিনাকে রঙ্গনের কাছ থেকে নিজের কোলে নিলেন তারপর বললেন,
– বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ দাদু।গেলেই দেখতে পাবে।
আহিনা খুবই উৎফুল্ল হলো। রওনক সাহেব আহিনাকে কোলে নিয়ে স্ট্যাডি রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন,
– চলো তোমাকে বাংলাদেশের গল্প শোনাবো আর ছবিও দেখাবো।
রওনক সাহেব আর আহিনা চলে যেতেই অদিতি চিন্তিত সুরে বলল,
– আমার দুই তিনটা প্রজেক্ট চলছে দুই তিনমাসের আগে জাপান ছাড়া পসিবল না।
রঙ্গনকেও বেশ চিন্তিত দেখালো।
– আমারো ক্যালিফোর্নিয়ায় কনসার্ট আছে সেই সাথে প্যারিস ফ্যাশন উইক আর নতুন এলবাম সহ বেশ কিছু প্রজেক্টের কাজ আছে।
– তাহলে?
অদিতি নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো।রঙ্গন মৃদু হেসে অদিতির দুইহাত মুঠোবন্দী করে বলল,
– আপনিও প্রজেক্ট গুলো শেষ করুন আমিও আমার কাজগুলো শেষ করি দুই তিনমাস পরে আমরা বাংলাদেশ যাবো।
অদিতি ভেবেছিলো রঙ্গন যে অধৈর্য্য হয়তো মানতে চাইবে না কিন্তু রঙ্গনের কথা শুনে এখন একটু নিশ্চিন্ত লাগছে। ভাবনার মাঝেই হাতে নরম স্পর্শ অনুভব করলো সে।রঙ্গন ওর হাতে অধর ছুয়ে বলল,
– এতগুলো বছর অপেক্ষা করেছি আর তো মাত্র তিনমাস। এরপরে আর কোনকিছু মানছি না আমি।
রওনক সাহেব এবং রফিক সাহেবকে জানানো হলে দুজনেই রাজি হলেন। ঠিক করা হলো তিনমাস পরেই বাংলাদেশে বিয়ে হবে অদিতি আর রঙ্গনের।আহিনা চুপচাপ রঙ্গনের কোলের মধ্যে বসে খেলছিলো।পূর্বে আহিনা বন্ধুদের থেকে জেনেছিলো মাম্মামের বিয়ে হলে সে বাবাই পাবে কিন্তু বাবাই তো সে পেয়ে গেছে তাহলে বিয়ে আসলে কি সেটাই বুঝতে না পেরে সবার আলোচনার মধ্যে প্রশ্ন করে বসলো,
– বিয়ে কি?
সবার আলোচনা থেমে গেলো।অদিতি মেয়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে একটু লজ্জা পেলো বোধহয়।রঙ্গন ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।রিফাত একটা বাকা হাসি দিয়ে বলল,
– তোমার মাম্মামের সাথে বাবাইয়ের বিয়ে হলে বাবাই সারাজীবন তোমার মাম্মামের সাথে থাকার লাইসেন্স পাবে।
– লাইসেন্স কি আংকেল?
রিফাত যেনো বেশ মজা পাচ্ছে ব্যাপারটাতে।রঙ্গনের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে বলল,
– লাইসেন্স হচ্ছে অনুমতি।বিয়ে হলে বাবাই মাম্মামের সাথে থাকার অনুমতি পাবে।
আহিনা বেশ চিন্তিত হলো। সেও তো বাবাইয়ের সাথে সারাজীবন থাকতে চাই তাহলে তারও তো অনুমতি লাগবে। সে দ্রুত রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– বাবাই আমিও তোমাকে বিয়ে করবো। আমারো তোমার সাথে সারাজীবন থাকার অনুমতি লাগবে।মাম্মাম কেন একা থাকবে শুধু তোমার সাথে? আহি বেবীও থাকবে।
রঙ্গন হো হো করে হেসে ফেললো। অদিতি যেনো এবার অস্বস্তিতে পড়লো। রওনক সাহেবও মুচকি মুচকি হাসছেন।
– তোমার অনুমতি তো আরো আগে হয়ে গেছে বেবী।তুমি আর আমি সারাজীবন একসাথে থাকবো তো।
আহিনা গাল ফুলিয়ে জানতে চাইলো ,
– কবে?
রঙ্গন আহিনার কপালে গভীরভাবে আদর দিয়ে নরম সুরে বলল,
– যেদিন তুমি আমাকে বাবাই ডেকেছো।
আহিনা কথার মর্মার্থ বুঝলো না কিন্তু এটুকু বুঝলো তার বাবাইয়ের সাথে সারাজীবন একসাথে থাকার অনুমতি আছে। সে খুশি হয়ে রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরলো।
অফিসের ক্যান্টিনে চিন্তিত মুখে বসে আছে আরাফ।রাসেল এসে বসলো তার পাশে।
– কি এত ভাবছিস?
– ভাবছি রঙ্গন কাকতালীয়ভাবে আমার সাথে বিজনেসে পার্টনার হয়েছে নাকি এর পিছনে অদিতি ঘটিত কারণ আছে কোন?
রাসেলকেও চিন্তিত দেখালো। তারপর বন্ধুকে আশ্বস্ত করে বলল,
– সেরকম কিছুই না।তোকে তো রওনক চৌধুরী প্রপোজাল দিয়েছিল তোর আগের কাজের পজিটিভ রিভিউয়ের জন্য। পরে না রঙ্গন ইনভলভ হলো। আর এই প্রজেক্টের ক্ষতি হলে তো রঙ্গনেরও লস তাই না। আচ্ছা এর মধ্যে কি রঙ্গনের সাথে তোর কোনরকম যোগাযোগ হয়ছে?
– হ্যা গত পরশুও অনলাইন মিটিং ছিল বেশ স্বাভাবিকভাবেই হেসে কথা বললো।
– তাহলে এত চিন্তা করিস না। আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা পুরোটাই কাকতালীয়।
আরাফেরও কথাটা পছন্দ হলো। কারণ রঙ্গন সব সময় সহজ সাবলীল ব্যবহার করেছে তার সাথে কোনরকম কিছু তো নজরে পড়েনি তার।
গত কয়েকদিন অদিতি বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে। রঙ্গনও তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দুজনেই বিয়ের আগে নিজেদের সমস্ত কাজ গুছিয়ে নিতে চাইছে যত দ্রুত সম্ভব।আজ অদিতির ইতালিয়ান এক ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে। সকাল থেকে সেটা নিয়েই ব্যস্ত সে। নির্দিষ্ট সময়ে একজন ইউরোপীয় সুপুরুষ তার টিম নিয়ে অদিতির মিটিংরুমে উপস্থিত হলেন।
আজ রঙ্গন এসেছে আহিনাকে স্কুল থেকে নিতে। গত কয়েকদিন এলবামের কাজের জন্য বেশ ব্যস্ত ছিল সে। আহিনাকে বেশি সময় দিতে পারেনি আজ একটু ফ্রি থাকায় চিন্তা করেছে আজ সারাদিন আহিনাকে সময় দেবে সে। স্কুল থেকে বেরিয়ে বাবাইকে দেখে আহিনার খুশি দেখে কে।রঙ্গন আহিনাকে কোলে তুলে বলল,
– আজ সারাদিন আমার বেবীর।বলো কোথায় ঘুরতে যাবে?
– চল মাম্মামের অফিসে যাই। তোমার মত মাম্মামও শুধু ব্যস্ত থাকে।
ঠোট ফুলিয়ে অভিযোগ জানালো আহিনা।রঙ্গন হেসে মেয়ের ফুলো ফুলো গাল টেনে দিয়ে বলল,
– ওকে প্রিন্সেস।
অদিতির মিটিং শেষ হয়ছে কিছুক্ষণ আগে। সবকিছু ঠিকঠাক কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ইতালিয়ান ভদ্রলোক টমাসোকে নিয়ে।লোকটা কিভাবে যেনো অদিতিকে দেখছে। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে বেশ অস্বস্তি অনুভূত হতে লাগলো অদিতির।মিটিং শেষে সবাই বেরিয়ে যেতে নিলে টমাসো জানালো সে অদিতির সাথে নিরিবিলিতে কথা বলতে চাই।অদিতি ভ্রু কুচকে তাকালো টমাসোর দিকে। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
– অফিসের ক্যান্টিনে আসুন সেখানেই যা বলার বলবেন।
কথাটা বলে অদিতি দাড়ালো না শক্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো।টমাসো বুঝলো এই রমণী এত সহজে ধরা দেয়ার মত নয়।
ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে আছে অদিতি আর টমাসো। অদিতি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এই টমাসো ভালো কিছু বলতে যাচ্ছে না।তারপরও শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,
– বলুন মিস্টার টমাসো কি বলতে চান?
– আপনি খুবই সুন্দরী মিস অদিতি।প্রথম দেখায় ভালো লেগে যাওয়ার মতো।আই থিংক আই ফেল ফর ইউ।
অদিতি একটা শান্ত হাসি দিয়ে নিজের হাতটা সামনে এনে অনামিকায় জ্বলজ্বল করা হীরে খচিত আংটিটা দেখিয়ে বলল,
– Sorry mr.Thomaso i’m already engaged.
টমাসো একটা কুটিল হাসি দিয়ে বলল,
– আমি আপনার লাভ লাইফের ব্যাপারে অবগত। শুধু আমি নয় কোটি কোটি মানুষ অবগত। কিন্তু দেখুন ওসব সিঙ্গার দিয়ে কি জীবন চলে। আজ আপনাকে ভালো লাগছে বলে আপনার কাছে আছে দুদিন পরে হয়তো অন্য কোন সেলিব্রিটিকে ভালো লাগবে আপনাকে ছেড়ে তার কাছে চলে যাবে। তাছাড়া আপনার আমার কর্মক্ষেত্র এক আমাদের ব্যাপারটা জমবে বেশি। তাছাড়া একজন সুদর্শন সেলিব্রিটি শুধু শুধু ডিভোর্সি সিঙ্গেল মাদার বিয়ে করতে যাবে কেন ভেবে দেখেছেন কখনো এই যে আপনি এরকম সুন্দরী সফল বিজনেস উইমেন এটাই আসল কারণ। দুদিন আপনার সাথে মজা নিবে তারপর ফেলে চলে যাবে।
অদিতির মেজাজ এবার চরম খারাপ হলো। রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গনকে দেখে অদিতি ঘাবড়ে গেলো। আহিনাকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে। চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে মুহুর্তেই সব ধ্বংস করে দেবে যেনো। অদিতি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো কতটুকু কি শুনেছে আর কি যে বুঝেছে এই পাগল প্রেমিক আল্লাহ ভালো জানেন। রঙ্গন জেনিফারের কোলে আহিনাকে দিতে দিতে বলল,
– আধাঘন্টার মধ্যে বেবীকে নিয়ে এদিকে আসবে না।
জেনিফার মাথা নাড়ালো এই মুহূর্তে তারই রঙ্গনকে দেখে ভয় লাগছে।
আহিনা চোখের আড়াল হতেই অদিতি ছুটে রঙ্গনের হাত ধরে বলল,
– আমার কেবিনে চলো মাথা ঠান্ডা করো।
রঙ্গন আস্তে করে অদিতির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হুডির হাতা গোটাতে গোটাতে টমাসোর দিকে এগিয়ে গেলো। মাক্স আর হুডির জন্য টমাসো এখনো রঙ্গনকে চিনতে পারেনি। সে কনফিউজড হয়ে ঘটনা বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু রঙ্গন কোনরকম বোঝার সুযোগ না দিয়েই টমাসোকে মা’রতে লাগলো।
– হারা**দা তোর এত বড় সাহস তুই আমার সম্পদের দিকে হাত বাড়াস।তোর পছন্দ আমি আজ ছুটিয়ে ছাড়বো।
রঙ্গন যেনো হিংস্র হয়ে উঠেছে। অদিতি হতবাক হয়ে গেছে। কিছু বলার মত শক্তি পাচ্ছে না।সে যেনো ভার্সিটির সেই উনিশ বছরের রঙ্গনকে দেখতে পাচ্ছে। সেই তেজ সেই ভয়ংকর রাগ।
– সিঙ্গার দিয়ে জীবন চলে না তাহলে কি অন্যের ফিয়ন্সে ভাগিয়ে নিয়ে জীবন চালাতে হয়।
টমাসোর কলার ধরে কথাটা বলে পুনরায় মা’রতে লাগলো।অদিতি এবার একটু ধাতস্থ হলো। ছুটে যেয়ে রঙ্গনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– প্লিজ রঙ্গন আর পাগলামি করো না। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে ওই লোকের। এবার মা’রলে ম’রে যাবে।
কিছুটা শান্ত হলো সে। কিন্তু গর্জে উঠলো পুনরায়।
– ওর সাহস কিভাবে হয় আপনাকে উল্টাপাল্টা কথা বলার। আমার ভালোবাসার দিকে আঙ্গুল তোলার। মে’রেই ফেলবো আজ একে আমি।
অদিতি এবার বেশ জোরেশোরে ধমকালো রঙ্গনকে।
– চুপ!! একদম চুপ। অনেক মে’রেছো এখন চলো আমার সাথে।
তারপর অফিসের কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলল,
– আপনারা নিজেদের কাজে ফিরে যান।
সবাই দ্রুত সরে গেলো।অদিতি এবার ফ্লোরে পড়ে থাকা টমাসোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– আপনার সাথে ডিল করবো না আমি নিজের লোকজন নিয়ে বেরিয়ে যান আমার অফিস থেকে।
কথাগুলো বলে অদিতি রঙ্গনের হাত ধরে কেবিনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। যেতে যেতে রঙ্গন পিছন ফিরে রিফাতকে ইশারায় কিছু বোঝালো রিফাতও ঘাড় নাড়িয়ে ঠিক আছে বোঝালো।
অদিতি রঙ্গনকে সোফায় বসিয়ে পানি আনতে যেতে নিলে রঙ্গন ওর কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুজে দেয়। অদিতি যেন এই স্পর্শে শিউরে ওঠে তারপরও ধীরে ধীরে রঙ্গনের চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– রাগ কমাও রঙ্গন। তুমি না এখন বাবা হয়ছো। এরকম রগচটা হলে হবে? যেকোন পরিস্থিতি মাথা ঠাণ্ডা করে সামাল দিতে শেখো।
– “আমরা আজকেই বিয়ে করবো আহিনার মাম্মাম।”
……………চলবে?
বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।