অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-১২+১৩

0
269

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১২)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

১২.
অতীত: ট্রামাটিক ফেলিক্স স্টোনের ফিউনারেল

মৃ’ত্যু’র নিজস্ব স্বাদ আছে। ভী’তিকর, শি’উরে উঠা, শ্বা’সরু’দ্ধকর একটা স্বাদ। মুহূর্তেই জীবনের প্রতিটা ছোট বড় মুহূর্ত সেই এক নিশ্বাসে গুচ্ছিত হয়ে ধরা দেয়। কারো প্রা’ন কে’ড়ে নেওয়া মানে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে ঘনীভূত অনুভুতির অসাড় হয়ে আসা যা নিতান্তই আ’ত্ম’ঘা’তী থেকেও যন্ত্রনাদায়ক। আর প্রাণ কাড়তে দেখা মানে প্রতি নিয়ত মৃত্যুর অপেক্ষায় নিজেকে উ’ন্মা’দ বানিয়ে ফেলা। সারা জীবনের সমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর ক্লি’ষ্ট স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে, গুণী মানুষজন একে চূড়ান্ত সাফল্য বলে আখ্যা দিয়েছেন।

(Death has taste, it chokes and clenches out the entire life in a glance. It’s a game of either cold, icy or fierce, hot might be numbing. A feel of Numb is downright suicidal when somebody kills you but you can’t feel the pain. This pain is an ultimate, and nobles labeled it as success.
— Painted Scars by P. Newmi on Wattpad)

মানুষ বলে ধ্বংসের কোন রূপ নেই কিন্তু তার সামনে তার প্রান মুঠোয় নিয়ে স্বয়ং তা’ণ্ডব দাড়িয়ে ছিল।
তার ধ্বংস অতি সুদর্শন রূপে হাজির হয়ে ছিল। সুঠাম বলিষ্ঠ তামাটে রঙের দেহ, পেটানো শক্ত বুক, গলায় স্থিত এডাম অ্যাপেল, শক্ত মুখের ধারালো চোয়াল।
মাসকিউলিন বাহু ফ্লেক্স করে, তার ফোলা শিরান্বিত হাত যা মুহূর্তেই তার মতো চিনেপুটির শ্বাস কেড়ে নিতে সক্ষম। শক্ত হাতখানা শেষ বেলার সমুদ্রের ঢেউখেলানো চুলের ফাঁকে লম্বা লম্বা আঙুল ফেলে ব্যাক ব্রাশ করে শৃঙ্খল করে নেয়।

কৌশিক মির্জা ইজ দ্যা পারফেক্ট ডিফেনেশন অফ আ ট্রু হ্যান্ডসাম হাঙ্ক।

“Well, you are truly doomed.”
আবার সেই শক্ত পুরুষালি গলা তার কানে তরঙ্গায়িত হয়ে কাঁপিয়ে দেয় তার মেয়েলি নরম কায়া।
তখন শোনা মাত্রই সে ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে পর্দার আড়ালে এসে গলার বড় ওড়নায় মুখে চেপে ধরে। কোন দিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি যে কারো ফিউনারেলে এসে একটা কো’ল্ড-ব্লা’ডে’ড মা র্ডা রে র চক্ষু সাক্ষী হয়ে যাবে। কাশফির মনে হচ্ছে তার ভিতর থেকে সবকিছু এখনই বেরিয়ে পড়বে, বার বার রক্তের কথা মনে পড়ছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়া নিথর দেহ খান মস্তিষ্কে ফিট হয়ে গিয়েছে। সে দুই হাতে মাথা টিপে ধরে বুকে হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে হুহু করে কেঁদে উঠে। মনে পড়ে যায় আবার,

“রোয়ান বেশ চওড়া দামে তাহলে তোমার বিশ্বস্ততা কিনে নিয়েছে। এক্সাকটলি কত? ত্রিশ নাকি পঁয়তাল্লিশ? আমার জানা মতে এইদুটো তার লাকি নাম্বার। ”

“না—

“আমার সাথে প্রতারণা করে এখন অভিনয় করছ আবার মিথ্যে বলছো। তিনটা ভুল— চরম ভুল। তোমাকে দুটো পথ দিচ্ছি, স্বীকার করে নিজের নিয়তি কে বেছে নাও আর নাহয় প্রত্যাখ্যান করতে থাকো তোমার মৃ ত্যু কঠিন থেকে কঠিন হবে।”

কৌশিক মির্জার বদনে হিং’স্র’তা, তার রিভলভার ভীতু সাইফুলের দিকে তাক করা। সাইফুল হয়ত বুঝার সময়টুকু পর্যন্ত পায়নি। পরক্ষণে সাদা শার্টে সাইফুলের তাজা রক্তের ছিটে ফোঁটা ছড়িয়ে পড়া।
একটা বুলেট নিমিষেই সাইফুলের বুকের বাম পাশ ভেদ করে ঢুকে তারপর স্পট ডেথ।

দশ মিনিট পর নিজেকে ধাতস্থ করে রূমে ফিরে, বুকের বেগতিক উঠানামা দেখে যে কারো মনে হবে ম্যারাথন দৌড়ে এসেছে সে। । তার হাত দুটো নোংরা নোংরা মনে হচ্ছে, কাউকে কোন কৈফিয়ত না দিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে হাত জোড়া ঘষে ঘষে ধুতে লাগলো, কেন জানি মনে হচ্ছে এখনো রক্ত লেগে আছে।
বেসিনের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বার বার পানির ঝাপটায় মুখ পরিষ্কার করে নিল। কয়েকটা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে পড়ল।

***

ফিউনারেল শুরু হয়েছে কয়েক মিনিট আগে, একজন প্রিস্ট কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে লাশের উদ্দেশ্যে ইউলোজি(eulogy) পাঠ করে প্রার্থনা করছেন। ফেলিক্সের স্ত্রী, তার বড় ছেলে আর তার মেয়ে অ্যাবি পোডিয়ামে দাড়িয়ে তাদের ইউলোজী পড়ে শেষে কফিনের উপর চুমু দিয়ে নেমে চলে যায়। আনমনা কাশফি এতক্ষন জানলার পাশে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে, তাদের কিছুতেই তার মনোযোগ নেই। হঠাৎ খুবই চেনা একটা কর্কশ, পুরুষালী কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয় পোডিয়ামের স্পিকারে। গলাপরিষ্কার করে জানালো —
“এখানে উপস্থিত সবাইকে একটা শোকাহত আফটার্নুন।”

একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কৌশিক মির্জা সবার দিকে একবার চেয়ে নেয়। এখন গায়ে রক্ত মাখা শুভ্র শার্টের পরিবর্তে একটা কালো শার্ট, কালো সুট, কালো টাই, সম্পূর্ণ কালো গেটআপ। চেহারায় আগের ন্যায় হিং স্র তা র পরিবর্তে একটা শক্ত ভাবমূর্তি দেখাচ্ছে, আগের বিশৃঙ্খল কৌশিক মির্জা আর এখনকার তথাকথিত রাজনীতিবিদ, শান্ত, ভদ্রলোক কৌশিক মির্জার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। কিঞ্চিৎ হেসে কৌশিক মির্জা ইউলোজি উপস্থাপন করলেন—
“আমরা সবাই আজ এখানে একত্রিত হয়ে ফেলিক্স স্টোনের শেষ বিদায় হাসিমুখে দিতে এসেছি। মিসেস স্টোন, মিস্টার সেবাস্টিয়ান স্টোন আর মিস অ্যাবিইগাল স্টোন আমরা সবাই গভীরভাবে শোকাহত, তার প্রস্থান এত দ্রুত হবে হয়ত আমরা কেউ কল্পনা করতে পারিনি। আমাদের পাশে ফেলিক্স স্টোনের অবদান অসামান্য, সিনিওর হিসাবে হাতে ধরে অনেক কিছুই শিখিয়ে গিয়েছেন…”

কাশফি সেই বক্তৃতায় আর মনোযোগ রাখলো না কেবল অপলক চেয়ে রইল মানুষটার দিকে, ভালো খারাপ মিলিয়ে পৃথিবীতে বৈচিত্র্যতা অনেক তবে কৌশিক মির্জার মতো বহুরূপী সে খুবই কম দেখেছে, গিরগিটি থেকেও দ্রুত রঙ পাল্টে ফেলতে পারে এই মানুষ। কাশফি বুঝে পায়না কিভাবে একটা লাশের বিদায়লগ্নে উপস্থিত হয়ে অন্য জনের জন্য চাল চেলে নিজ হাতে হ ত্যা করে সে এতটা স্থির থাকতে পারে…
সুদর্শন পুরুষ কৌশিক মির্জা সাহারার মরীচিকার ন্যায়।

আজকের ঘটনা ভুলার লক্ষ্যে সে মাটিতে শুকনো ঘাসেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। তবুও মাথা থেকে সেই রি’ভ’ল’ভার ধরে দাড়িয়ে থাকা শ’য়’তা’নের ছবি সে বের করতে অক্ষম। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে শক্ত করে ঠোঁট কামড়ে ধরে, তার হাত পা আবার নিশপিশ করছে ধোঁয়ার জন্য। মনে হচ্ছে সাইফুলের র’ক্তে’র ছিটেফোঁটা অ মা নু ষ মির্জার গায়ে নয় তার গায়ে লেপ্টে আছে।
ভাবনায় ডুবে থাকা কাশফি করো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপলব্ধি করতে পারে মাথা উচুঁ করে ডানে বামে তাকিয়ে আবার সামনে ফিরতেই যেন দম আটকে আসলো, বুকে হাত দিয়ে জামা খাঁ’ম’চে ধরে, হৃদপিণ্ডের উঠানামা অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে গিয়েছে। তাদের মাঝে এত দূরত্ব থাকার সত্বেও কৌশিক মির্জার নিষ্প্রাণ ছাই রঙ্গা শিকারী বদন জোড়া তার উপর স্থির। এতখানি দূরত্ব যেন নিমিষেই বিলীন হয়ে গিয়ে তাদের একে অপরের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে। কাশফি ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলে, লোকটাকে প্রতিবার দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

হঠাৎ করে তাদের গ্রামের এক নানাজানের কথা মনে পড়ে যায়, তিনি বলতেন যেই স্থানে দুষ্টু জ্বীন, খারাপ কিছু বা শয়তানের আনাগোনা থাকে সে জায়গাটা আলগোছে বোঝা যায়। কৌশিক মির্জার উপস্থিতি তার চোখে শয়’তানের ন্যায়, অ’শুভ, অম’ঙ্গল। কৌশিকের অপলক চাহনির দিকে কাশফি মুখ কুঁচকে একরাশ ঘৃণা ছুড়ে দিল, তবুও কৌশিকের কোন হেলদোল নেই।
ত্রিশ সেকেন্ড
দুই মিনিট
পাঁচ মিনিট….

অতি নৈপুণ্যে নিজের ভঙ্গিমা আড়াল করে খুবই ধীর গতিতে কৌশিক মির্জার কালচে ঠোঁটের কোণ উপরে উঠে, ক্রুর হাসির সংস্পর্শে মুখ অবয়ব যেন পাল্টে কেবল হিংস্রতা বিরাজ করছে। কাশফির চোঁখে বার বার রক্তের আর নিথর দেহের প্রতিচ্ছবি ভাসছে। কাশফির চোঁখে মুখে ভীতি দেখে কৌশিক মির্জার চোখ চকচক করে উঠলো, সাথে সাথেই কাশফির মনে পড়ে গেল সাইফুলকে মেরে ফেলার আগে তার দৃষ্টির কথা, ঠিক একই রকমের দৃষ্টি ছিল। পরক্ষণে মনে হলো সে কোন সাইকোপ্যাথের কম নয়।

কৌশিক মির্জা মুলত মানুষের ভীতি, কষ্ট আর যন্ত্রনা উপভোগ করে।
মুহুর্তেই তার মাথা ভার হয়ে সারা শরীর আসাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। পাশের ইজি চেয়ার ধরে নিজেকে ধাতস্থ করে মাথার চুল টেনে ধরে বসে পড়ে। চোখ, মুখ, গলা, সারা শরীর তার জ্বালা করছে, মনে হচ্ছে সে নোংরা হয়ে আছে। দৌঁড়ে ওয়াশরুমে যেতেই বমি করে ভাসিয়ে ফেলে।

যেন দূর থেকে কেউ শব্দ সহযোগে ক্রুর হেসে বলছে—
“Here comes nothing…”

***

বাসায় আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা, কাশফি শাওয়ার ট্যাপ ছেড়ে সারা শরীর জোরে জোরে ঘষতে লাগলো— বেশ খানিকক্ষণ ঘষার পরও মনে হচ্ছে রক্ত উঠছে না। ঘষে ঘষে সারা শরীর জ্বালা পোড়া করছে আর না পেরে সে ফ্লোরে বসে পড়ে, জোরে জোরে চিৎকার করে কেঁদে অবাধ্য অশ্রুদের আজ মুক্ত করে দেয়। প্রতিটা নোনা বিন্দু শাওয়ারের পানির সাথে ধুয়ে যাচ্ছে তবে আজ যেন অন্ত নেই। আজকের ঘটনা তার দুঃস্বপ্ন গুলো বাস্তব হয়ে দাঁড়ানোর মতো।

দেড় ঘণ্টা পর নাক টেনে কাশি দিয়ে, চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় সে, চোখ লাল হয়ে মুখ খানা ফ্যাকাশে হয়ে আছে, হাতে পায়ের আঙুল শুকিয়ে আছে। ফোন হাতে নিয়েই তার ভীত হয়ে থাকা শুকনো বদন রক্তশূন্য হয়ে এলো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ছোট বার্তা —
“নিজে আড়ালে থেকে আপনাকে দুরে থাকার সুযোগ দিয়েছিলাম কাশফি কিন্তু নিয়তি এনে একসাথে দাড়া করলো। অনেক ‘কেনো?’ আপনার মনে জাগ্রত হবে তবে জানেন তো সব ‘কেনো?’ এর উত্তর হয়না।”

কাশফি?! সে কাশফি কেন ডাকলো…
এই নামে তাকে কেউ ডাকে না— আসলে এই নামে ডাকা তার পছন্দ না। মুলত কাশফি নামটা চারুলতা আর তার বাবা উভয়ের পছন্দে রাখা।
তার মাথা ঘুরছে যেন, ফোন আঙ্গুলের ফাঁক পিছলে পরে গেলো। তার পা পিছিয়ে নিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকলো। চোঁখ শক্ত করে বন্ধ করে নেয়,

রিভ’লবারের ট্রি গা রে কৌশিকের লম্বা আঙ্গুল…
নিথর দে হ
র ক্ত
নিস্তব্দতা

“Well, you are truly doomed.”

খট করে চোখ খুলে ঘনঘন শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। সে এখন নিরাপদ, কৌশিক একটা খানিকের ভীতি ছিল আর কিছুই না। এসব শুধু ভয় দেখানো, নিজের প্রভাব বজায় রাখার কৌশল মাত্র…
কাশফি আসেপাশে তাঁকিয়ে তার খালি রুমটা দেখে নেয়। বাইরের হুতুম পেঁচার ডাক আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার মিইয়ে যাওয়া শব্দ বাতাসে ভেসে আসছে। মনে মনে ঢের সান্তনা দিয়ে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নেয়। ঢুলুঢুলু অবস্হায় দেওয়াল থেকে সরে যায়। হাতের তালুতে চোঁখের কোনে জমা পানি মুছে দুর্বল পা বাড়িয়ে দেয় ফোনের অগ্রসরে। নিজের ভাবনায় বিভোর কাশফি ঘুর্ণক্ষরেও টের পেলো না কারো নিঃশব্দে প্রবেশ। একটু ঝুঁকে ফোনটা নিতে যাওয়ার আগেই আকষ্মিক একটা হাত তার মুখ চেপে ধরে…

#চলবে….

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৩)
#প্রোপীতা_নিউমী

১৩.

“শা লী গ র্দ ভের বাচ্চা এভাবে কেউ পিছন থেকে মুখ চেপে ধরে? আগাছার মতো তরতর করে কেবল বড় হয়েছিস কিন্তু বুদ্ধি এখনো হাঁটুর নিচে!”
থমথমে পরিবেশে কাশফির বাজ খাই কন্ঠ শোনা গেলো। তার শক্ত হাতের এলোপাথাড়ি কিল, ঝাটি আর চাপড় খেয়ে ফারাবী আড়মোড়া ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কাশফি আর ফারাবীকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে তরী নিরুদ্বেগ হয়ে কাশফির বিছানায় উঠে বসে।

মার খেয়ে খেয়ে ফারাবীর মূখে আষাঢ়ের মেঘ জমেছে যেন, দুঃখ এমন মুখ ফুটে না কিন্তু বুক ফেটে চৌচির। দুঃখী দুঃখী স্বরে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
“এত অপমান করার কি আছে? আমি তো দিগন্ত ভাই বাসায় দেখে তোর কাছে এসেছি শুধু!”

কাশফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তরী চোখ পাকিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“দিগন্ত ভাই কি? ভাইয়া কাবিন করিয়ে রেখেছেন অথচ তোর এখনো ঢং যায় না, নাহ?”

বিপরীতে ফারাবী গাল বাঁকিয়ে আঙুল তুলে তীব্র প্রতিবাদে জানায়,
“এত পক্ষপাতিত্ব করবি না, ফলতুটা আমায় চু’মু খেয়েছে!”

তরীর বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো যেন, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ফারাবীর বাচ্চা, তোর এসব ন্যাকামি এখন শুরু করলে কিন্তু লাথি মেরে তোকে পঁচা ডোবায় ফেলবো!”

ফারাবী ন্যাকা কান্নার সুর তুলে,
“আমার ফার্স্ট কিস ছিল তরী তুই কি বুঝিস না?”

“না, এসব আজাইরা কথা আমি বুঝিনা। বিয়ের আগে হোক পরে হোক চুমু ছাড়া অনেক কাহিনী হতো এসব কিছুই তো করেনি না?!”

“ছিঃ তুই একটা খবিশ তরী!”

কাশফি এই নিয়ে তিনবার হাই তুলে ফেললো, সে মহা বিরক্ত। অবশ্যই একদিক দিয়ে ভালো। ঘুমের ঔষুধটা হয়ত আজ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সে কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলে,

“এই তোরা কি আমার ঘরে ঝগড়া করতে এসেছিস?!”

ফারাবী ফট করে উওর দিলো,
“না, আজ রাত বাসায় দিগন্ত ভাই থাকবেন।”

“ভাইয়া কি তোর রূমে তোর খাটেই থাকবেন?”

“ছিঃ, অবশ্যই না!!!”

“তো?!”

“আসলে আমি ভয় পাচ্ছিলাম।”

“ঝেড়ে কাশ ফারাবী!”

“আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তরীর সাথে ঘুমাবো কিন্তু এই মেয়ে যা কেউ আমাকে তুলে নিয়ে গেলে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বলবে— ‘আজাইরা আপদ নিজের ঘাড়ে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ’।”

“You are absolutely right Farabi!”
তরী বসা থেকেই উওর দিয়ে ফেললো। এতে ফারাবী ভেংচি কেটে কপট রাগ দেখিয়ে বলে — “দেখলি?”

“তো এখানে আমার করণীয় কী?”
কাশফির প্রশ্নাত্বক চাহনির প্রত্যুত্তরে ফারাবী একটা মিষ্টি হাসি হেসে কাছে এসে তার হাত আকড়ে ধরে বলে,

“চল আমরা একসাথে থাকি সবাই সেইফ থাকবো। হুঁ, আমি তোদের কত চিন্তা করি আর তোরা? ঘসেটি বেগমের বংশধর!”

“আর তুই রাজার রাজত্ব উদ্ধার করেছিস, আমরা ধন্য!”

কাশফি ভাবতে উদ্যত হয়, এই দুইজনের সাথে রাত কাটানো মানে ফজরের আগ পর্যন্ত ঘুম নেই। ঘুমের ওষুধটা নিবে নিবে বলেও আর নেওয়া হলো না এই ভেবে কিছুটা স্বস্থি পায় আজকে রাতটুকু তার দুঃস্বপ্নহীন কাটবে। কাশফি আলমারি থেকে কাঁথা আর দুটো বালিশ বের করে নেয়।

এদিকে ফারাবী ল্যাপটপ খুলে একটা হলিউড সিরিজ প্লে করে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। কাশফির দিকে তাঁকিয়ে ঈশারায় বলে তাড়াতাড়ি পাশে এসে বসতে। তরী মুখে বিরক্ত প্রকাশ করলেও আগ্রহী হয়ে বসেছে কাশফি মুচকি হেসে ফারাবীর পাশের বরাদ্দকৃত জায়গা গ্রহণ করে নেয়।

***

১৮ নভেম্ভর, ২০১৯

কেটে গেছে বহু দিন, সেকেন্ড ইয়ারে সময় কম পড়ার চাপ প্রচুর সামনে বোর্ড এক্সাম তবে তার মনে কৌশিক নামের একটা বিশ্রী মরিচা বেঁধেছে। কাশফি ইদানিং ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যায়, তার কিশোরী মন কৌশিক নামক শঙ্কায় সে নাস্তানাবুদ। বার বার খেয়াল আসে যে এই তো তার সামনে যে কোন মুহুর্তেই কৌশিক এসে দাঁড়াবে হাতে রিভলবার নিয়ে বলবে —
“Time to say goodbye.”

এই জেলার নামকরা অভিজাত শ্রেণীর রাজনীতিবিদের কাতারে মির্জাদের নাম সবার উপরে। কুখ্যাত কৌশিকের ভয়ে সেকেন্ড ইয়ারের অনেকগুলো ক্লাস মিস হয়েছে। এতগুলো নোটস কলেক্ট করতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি কিন্তু নিজের নোটে তুলতে গেলে তখন ঠেলা বুঝা যায়। কাশফির নাভিশ্বাস ঊঠে গেলো, এখন কৌশিক মির্জাকে গা’লি গা’লা’জ করে লাভের লাভ কচু হবে তার চেয়ে বরং আল্লাহর নাম নিয়ে হাত চালু করাই শ্রেয়।
অতঃপর বিক্ষিপ্ত মনে কলেজ শেষে বসেছে ক্যান্টিনে, দ্রুতই নোট মিলিয়ে মিলিয়ে নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল সে। এদিকে ফারাবী আর ঈশান রীতিমত ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে আর তরী চোঁখে মুখে আগ্রহ নিয়ে ঝগড়া দেখতে ব্যাস্ত, কই আগ বাড়িয়ে ঝগড়া থামাবে তা নয়!

কাশফি দ্রুত কলম চালিয়ে খাতায় তুলতে ব্যাস্ত, এমনিতেই তার হাতের লিখা থার্ড ক্লাস আর তাড়াহুড়োয় হাতের লিখা কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং ছড়িয়ে যায়, পরীক্ষার খাতা যে মূল্যায়ন করে তার চৌদ্দপুরুষ স্মরণ করিয়ে দেয় তার এই বাজে হাতের লেখা।

ফারাবী আর ঈশানের নেহাতই বাচ্চামো রকমের তুমুল কথা কা’টা’কা’টি চলছে তাদের ঝগড়ার অন্যতম বিষয় হলো ফারাবীর একটা পোষ্ট।
ফারাবী সূর্য উঠার পূর্বে কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের নিচে দাড়িয়ে একটা ছবি আপলোড দিয়েছিল, সেখানে অবশ্যই তার চেহারা সুরত সব কিছুই কালো। ছবির ক্যাপশন এমন ছিল যে— “আকাশের বুকে বিষন্নতা”

ছবির নিচে ঈশান ফা’জ’লা’মী করে কমেন্ট করে— “গত বছর সাত সকালে উঠে এমন পরিবেশ দেখে ফারাবী নামক মেন্টাল বলেছিল ‘আকাশ বিডি খায়’ মনে পড়ে?!”

ছবি থেকেও এই কমেন্টে রিয়েক্ট বেশি উঠায় ফারাবী তেলে বেগুনে জ্বলছে, তার অ্যাটেনশন অন্যকেউ কেন নিবে তাও মান ইজ্জতের তেরোটা বাজিয়ে।
ঝগড়ার ফাঁকে তাদের অন্যকিছু চোখে পড়ল, মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখে একজন ছিমছিমে দেহের গড়নের ছেলেকে, এটা তো তাদের মাল্টি ট্যালেন্টেড ক্লাস মেট।
ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দুই পাটি ঝকঝকে তকতকে নিখুঁত দাঁত দেখিয়ে কাশফির দিকে হেসে একটা সুন্দর টানা সালাম দিলো। কাশফি থতমত খেয়ে বাতাস গিলে ফেললো যেন, তার জীবনে এই প্রথম তাকে কেউ সলাম দিয়েছে বলে কথা তাও প্রথম সারির ক্লাসমেট যাদের সাথে এই জীবনে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত।

ঘটনার আকস্মিকতা যেতে না যেতেই গর্দভ ফারাবী আহাম্মকের মতো কাজ করে বসলো। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে গালে হাত দিয়ে হেঁসে বলে,
“তোমার দাঁত গুলো কি সুন্দর! এই তুমি কি কালো কালো ছাই দিয়ে দাঁত মাজো?”

ছেলেটা কোন কথা বলার বলার পূর্বেই বড়সর ভ্যাবাচেকা খেয়ে। ফারাবীর ট্যারা বাকা দাঁতের হাঁসির দিকে চেয়ে বিব্রত বনে যায় তবুও ভদ্রতাসূচক জিজ্ঞেস করল,
“জ্বি?”

ফারাবী কথার এদিক ওদিক না ধরে তার মুখ চালিয়ে গেলো ব্রেকফেইল গাড়ির ন্যায়। একটা সপ্নীল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গরগর করে বলে ফেললো,
“আমার দাঁতের কোন ঠিক ঠিকানা নাই, আম্মু ছাই দিয়ে দাঁত মেজে সোজা করতে বলেছিল কিন্তু তখন তো শুনিনি। ইশ কেনো যে শুনলাম না? দাঁত গুলোর জন্য একটা ছেলে পটাতে পারলাম না!”

এতক্ষন নিঃশব্দে থাকা তরী ওয়ানটাইপ কাপের কফি টুকুতে চুমুক বসানোর আগে রাশভারী কন্ঠে বলল,
“Sorry to say but তোর মতো তার ছেড়ার দ্বারা কেউ পটতো না।”

তরী নির্বিকার এমনভাবে ফারাবীর তীর্যক দৃষ্টি উপেক্ষা করল যেন কিছুই সে বুঝেনি। এদিকে কাশফি তার বন্ধুবান্ধব কে চোখ পাকিয়ে চুপ করতে বলে। এরপর সে ইতস্তত হয়ে থাকা ছেলেটার দিকে করুণ নজরে তাকিয়ে পাশের চেয়ারে বসতে বলে। ছেলেটা একটা সৌজন্যমূলক হাঁসি হেঁসে বসে পড়ল।

এতক্ষন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকা ঈশান হুট করে বলে উঠে — “তুমি অন্তু না?”

বলার দেরি আর উজবুক ফারাবীর কানাকানি করতে দেরী হলো না। খুসুরপুসুর করে কাশফির কানে কানে বললো—
“আমাদের কোনো এক ক্লাসের বইয়ে একটা ছেলে ছিল অন্তু, সে শৌচালয় ব্যবহার করে সাবান দিয়ে হাত ধৌত করতো না তার মামাও করতো না তাই পরবর্তীতে অসুখ হয়। আমার প্রশ্ন সেই অন্তু কোন ক্লাসে যেন ছিল?!”

ফারাবীর ভাবলেশহীন কথাবার্তায় কাশফি অন্তুর দিকে চায়, এক কথায় ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সে, কথাবার্তাও তেমন কম বলে আর মানুষের সাথে কম মিশে। তাহলে সে কাশফির সাথে কি করতে এসেছে? কাশফি এখন ফারাবীর সংক্রমণে এসে বার বার টয়লেটের কাহিনী মাথায় আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে ফারাবীর হাতে চিমটি কা’ট’তেই ফারাবী আতকে উঠে। পরক্ষনে তার রাগী বান্ধবীর তার কারণে লজ্জায় পড়ে মুখ লাল হতে দেখে আর কিছু না বলে ব্যাগ থেকে বই বের করে সামনে ধরে আড়াল হয়ে যায়। ভানখানা এমন যেন সে দিন রাত এক করে পড়ছে!

এতক্ষন কিছু না বললেও কাশফি একটা বন্ধুত্ব সুলভ হাসি দিয়ে অন্তুকে বলে,
“প্লিজ কিছু মনে করো না ফারাবী একটু অবুঝ টাইপের?”

ছেলেটা বিস্ময় প্রকাশ করে ঘোর বিরোধিতা করে
— “একটু?!”

কাশফি কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেঁসে উল্টা বই ধরে পড়ার অভিনয় করতে থাকা ফারাবীর দিকে তাকায়। মেয়েটা অভিনয় পর্যন্ত ঠিকঠাক জানে না। আবার সে অন্তুর দিয়ে তাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলে— “অনেকটা!”

অন্তু ফিক করে হেসে ফেলে এরপর ফারাবীর লিখা গুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে কিছুটা লাজুক স্বরে বলে
— “এসব তোমার তোলার প্রয়োজন নেই বোধহয়।”

কাশফি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। অন্তু ঘাড় চুলকে এবার কন্ঠের লজ্জাটা কিছুটা দমিয়ে বলে,
“আসলে আমি তোমার জন্য নোটস করে এনেছিলাম।”

কাশফি বিস্ময় কাটাতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা মজা করছে নাকি? ততক্ষনে অন্তু ব্যাগ নামিয়ে চেইন খুলে একটা পরিপাটি সুন্দর নোট তার দিকে ঠেলে দিলো। কাশফি দ্বিতীয় দফায় চমকপ্রদ, হতবিহ্বল! ধুম করে ফারাবীর বইটা টেবিলে পড়ে ফারাবীর হা করা মুখটা করো চক্ষু আড়াল হলো না আর।

অবিশ্বাস্য চোঁখে তর্জনী নিজের দিকে ইশারা করে বললো,
“তুমি আমার জন্য করেছ?!”

অন্তু মাথা দোলায়,
“আসলে তোমাকে কখনো ক্লাস মিস দিতে দেখিনি এতদিন আসো নি তাই নিজের সাথে তোমার টাও করে নিলাম।”

সে এতদিন কাশফি ছিল না সেটাও খেয়াল রেখেছে। এবার কাশফি নিজের আশ্চর্য্য দুরে ঠেলে খুশিতে গদগদ হয়ে মনে মনে বলল— ‘এমন নোটস প্রতিদিন দিলে নাম্বার কেন? টাকা সম্পত্তি সব তার নামে লিখে দিব।’
কিন্তু মুখে বলল— “কি করে যে তোমাকে শুকরিয়া দিই বুঝতেই পারছিনা। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ অন্তু!”

অন্তু লাজুক হাসলো কিছুটা, পাঁচ মিনিটের মতো পড়ার বিষয়ে এটা সেটা প্রশ্ন করছিল কাশফি আর অন্তু সুন্দর করে উওর দেয়। তাদের কথা শেষে অন্তু আগ বাড়িয়ে খাতার একপাশে ছোট করে তার ফোন নাম্বার লিখে বলে —
“কোন সমস্যা হলে আমাকে কল করিও ঈশিতা, এখন উঠি।”

অন্তু হুট করে যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই চলে যায়। কাশফির খুশির চোটে আর কারো দিকে নজর পড়ল না। পড়লে হয়ত দেখতে পেতো কিছু উৎসুক নজর।

রাতে কাশফি কায়েসকে নিয়ে পড়তে বসেছে। তার পড়ার টেবিল বেশ বড়, এক পাশে সে বসেছে খাতা বই, কলম, ক্যালকুলেটর ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্য পাশে কায়েস তার খেলনা আর ছড়ার আর বর্ণমালার বই নিয়ে বসেছে। তার ভাষ্য মতে সে খেলতে খেলতে পড়ছে মানে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কাজ, কিন্তু আদো কি সম্ভব? না। কাশফি জবাবে বলে ‘তোর আম ও যাবে ছালা ও যাবে’ কিন্তু কায়েস তার বুবুর কথা ভেংচি কাটে।
কাশফির হিসাবনিকাশ মিলানোর ফাঁকে হঠাত করেই তার ফোন বেজে উঠলো। এক পলক চেয়ে যখন দেখলো আননোন নাম্বার তখন বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। একসময় কল বাজতে বাজতে কেটে যায় পরক্ষণে আবার ফোনটা টেবিল কাঁপিয়ে বেজে উঠলো। এবার ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার। আগের টা?
অন্তু কে তো সে তার নাম্বার দেয়নি তাহলে? না, অন্তু অত ছ্যা’চ’ড়া না। ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো এতে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে ফোন টেবিলে রাখতে যাবে তার আগেই আবার কল এলো। কাশফি এবার চোখ কুঁচকে ফেলে। বিরক্ত হয়ে কলটা রিসিভ করে কানে দেয়—
“জ্বি কে বলছেন?!”

অপর পাশ থেকে পুরুষালী পুরু কণ্ঠের গুরুগম্ভীর জবাব এলো — “আমদের আবার খুব শীগ্রই দেখা হচ্ছে ম্যাডাম, জানেন তো?”

কাশফি স্তম্ভিত তার মনোযোগ এর আগেও খাতার অঙ্কেই ছিল। সে কান থেকে ফোন নামিয়ে নাম্বারটা দেখে নিলো এবার কানে দিতেই অপর লাইনে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে শুনলো এরপর লোকটা হাস্কি কন্ঠে কিছুটা টেনে বলল,

“এবার যদি দেখা হয়ে যায় আমি আর পিছু ছাড়ছিনা। হয়ত সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে এটা বিশেষ সাইন…”

কাশফি প্রথমে কিছুটা পরিচিত কন্ঠ মনে হলেও এখন বুঝে গিয়েছে ব্যাটা রাতের রোমিও হয়ে পিরিতের আলাপ বসিয়েছে। চরম বিরক্তে সে হিসহিস করে বলল,
“আপনি রং নাম্বারে কল করেছেন ভাইয়া, রাখছি!”

“কাশফি…”
তৎক্ষণাৎ এই একটা সম্মোধনে কাশফির লোম দাঁড়িয়ে গেলো। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল শিহরন বেয়ে গেলো পরপর সে তার মেরুদন্ড সোজা করে বসা থেকে দাড়িয়ে হনহন করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার শ্বাস প্রশ্বাস বেগতিক, ফোন কান থেকে আরেকবার সরিয়ে ওড়নায় কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নেয়। আবার ফোন কানে দিতেই সেই নিষিদ্ধ গম্ভির পুরুষালী কণ্ঠ বলে উঠলো,

“আপনার ভয়ার্ত মুখ ভীষন মিস করছি আর আপনি আমায় ভাইয়া ডেকে খুন করছেন? ভেরি ব্যাড সানশাইন।”

এবার ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জেকে ধরলো তাকে, শিট! তার নাম্বার পেলো কোত্থেকে অবশ্যই কৌশিক মির্জার জন্য এসব নাম্বার জোগাড় করা বাম হাতের খেলা। কাশফি তার কাপা কাপা কন্ঠে কিছুটা আয়ত্ত এনে বলে—
“ঈশিতা আমার নাম কাশফি না! উল্টা পাল্টা পেট নেইমে ডাকবেন না জনাব।”

কৌশিক হেসে উঠলো তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল,
“বললেন না যে, আমাদের দ্বিতীয় দেখা নিয়ে আপনি এক্সাইটেড না?!”

কাশফি নিজের কন্ঠে ভয় আড়াল করে বেশ জোর গলায় বলে,
“এসব কিছুই হবে না!”

“যদি হয়?”

“আপনি কলকাঠি না নাড়ালে আমদের দেখা হচ্ছে বলে মনে হয়না।”

“এত বিশ্বাস?!”
কৌশিক মির্জার হিম ধরানো ঠাণ্ডা কন্ঠে কাশফির ভিতর আগাম ভয়ের সঞ্চারণ ঘটিয়ে ফেললো যেন। আসলেই কি সে লোকটাকে আবার দেখতে চলেছে?
ফোন শক্ত হাতে ধরে সে যথা সম্ভব শক্ত গলায় স্পষ্টত হয়ে বলে,

“জানেন আপনার মতো রাস্কেল আমি দুটো দেখিনি। যেই মানুষের সাথে আশেপাসে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে তাকে দ্বিতীয়বার দেখার ইচ্ছে নেই।”
পরপর কাশফি কল কেটে সাথে সাথেই নাম্বার ব্লক করে দিলো। তার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে। সাহস নিয়ে কথা গুলো বললেও এখন তার পা কাঁপছে, হয়ত এক কদম পা বাড়ালেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে। হাতে থাকা ফোনটা কেপে উঠলো মেসেজের টুং টাং শব্দে সে স্ক্রীনে তাকাতেই তার চোখ ছানবড়া।

“দ্বিতীয়বার নাম্বার ব্লক করেছেন কাশফি, মনে রাখবেন ১ আপনার লাকি নাম্বার ছিল তবে ২ আমার।
টিক টক টিক টক করে সময় ঘনিয়ে আসছে আপনার,
ফর নাও সুইট ড্রিমস মা’লেইডি।”

কাশফি তপ্ত নিশ্বাস ফেললো, দ্বিতীয় সুযোগ কৌশিক কাউকে দেয় না কিন্তু তাকে দিয়েছে, কৌশিক থেকে আড়ালে থাকার দ্বিতীয় সুযোগ। আদো কি এটা দ্বিতীয় সুযোগ নাকি কোন মাইন্ড গেইম? কাশফি কৌশিকের ভদ্র থ্রেট গায়ে তো মাখলোই না বরং এই নাম্বারটাও ব্লকলিস্টে ফেললো।

বোকা কাশফি হয়ত জানতো না যে কৌশিক মির্জা কোন কাঁচা খেলা খেলে না আর না নিজের জিনিসে কারো নজরদারি পছন্দ করে।
এটা তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত, Enigmatic ব্যক্তিত্বের কৌশিক মির্জার তৈরীকৃত ফাঁদ নয়, একটা প্রহেলিকা।

#চলবে…