অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব-২০+২১

0
345

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২০
#তাশরিন_মোহেরা

মুগ্ধের নিচের দিকটা রক্তে ভিজে গেছে। তার পায়ে গুলি লেগেছে। সে পা টা ধরেই আর্তনাদ করে চলছে। আমি তার এই অবস্থায় আঁতকে উঠি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি গুলিটা আসলে কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু আশেপাশে সন্দেহজনক কাউকে দেখা গেল না। মানুষগুলো আমাদের দিকেই চেয়ে আছে। মুগ্ধ আমার হাত খামচে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘ম্যাম, আমি ব্যাথা পাচ্ছি। খুব!’

আমার মস্তিষ্ক হঠাৎ অচল হয়ে যায়। এইটুকুন একটা বাচ্চাকে গুলি করার সাহস কে পায়? এদের কি বিবেক নেই? চারদিকে মানুষজন জড়ো হওয়া শুরু করেছে। কিন্তু এগিয়ে এসে ছেলেটাকে কেউ তুললো না। রক্তে ভেজা ছেলেটাকে নিয়ে আমি কি করবো বুঝে উঠছি না। পুরো শরীর অসম্ভব রকমের কাঁপছে আমার। এর মধ্যে দেখলাম মুগ্ধ কাঁদতে কাঁদতেই বেহুশ হয়ে পড়ছে। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,

‘দয়া করে কেউ সাহায্য করুন। বাচ্চাটার গুলি লেগেছে, এখনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। দয়া করুন! কেউ তো একটু সাহায্য করুন।’

আমি অঝোরে কেঁদে দিলাম। মুগ্ধের এমন অবস্থা আমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভীষণভাবে। একটা মধ্যবয়সী লোক এসে মুগ্ধকে পাজাকোলে তুলে নিলো। মুগ্ধ হুশ হারিয়েছে কিন্তু এর মাঝেও ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো। আমি মুখে হিজাব চেপে কান্নাদের কোনোমতে আটকে রাখলাম। লোকটা একটা গাড়িতে আমাদের তুলে দিলো। পাশের একটা মেডিকেলে আসতেই আমি তড়িৎ নেমে পড়লাম। ড্রাইভারটাকে অনুরোধ করে বললাম,

‘বাচ্চাটাকে একটু ভেতরে নিয়ে আসুন, প্লিজ!’

ড্রাইভারটা বিরক্ত হয়ে আমায় বললো,

‘এর জইন্য ভাড়া বাড়াই দেওন লাগবো।’

আমি আর্তনাদ করে বলে উঠলাম,

‘এমনটা করবেন না, প্লিজ। আমার কাছে খুব বেশি টাকা নেই। আর বাচ্চাটাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’

‘তো আমি কি করুম, আপা? গাড়িত উঠছেন অহন টেকা দিতে না করতাছেন। পোলাটারে ভিত্রে নিয়া যাইতেই তো মেলা কাম!’

আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম,

‘আচ্ছা আমি একটু পরেই আপনাকে টাকা পরিশোধ করে দেবো। ছেলেটাকে আগে ভেতরে নিয়ে আসুন, জলদি। এমন নির্দয় হবেন না।’

এতে ড্রাইভারটার মন কিছুটা হলেও গললো বোধহয়। সে মুগ্ধকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে এলো। আমি তড়িৎ মুখরকে ফোন দিয়ে বলি,

‘মুগ্ধের পায়ে গুলি লেগেছে। জলদি কাছের হাসপাতালটায় চলে আসুন।’

.

হাসপাতালের বেডে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে মুগ্ধ। পায়ে বেন্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে তার। বেশি রক্তক্ষরণ না হওয়ায় অবস্থা কিছুটা ভালো তার। এবার মুগ্ধের জ্ঞান ফেরার পালা। মুখর কেবিনের সামনে গম্ভীরমুখে পায়চারি করছে। সে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছে এই কয় ঘণ্টায়। সে এবার ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। দু’হাতে মাথা চেপে বসে আছে সে। আমি এ মুহুর্তে কি বলবো, কি করবো বুঝতে পারছি না। ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও আমার নেই। বেশ একটা কঠিন সময় পার করছে মুখর। তাকে কিছু বলতে গিয়েও অনেকবার ভাবতে হবে আমার। আমি চুপচাপ তার পাশে গিয়ে বসলাম।

মিনিট খানেক নিরবতার পর মুখর মুখ খুললো। ক্ষীণ স্বরে বললো,

‘আমি ভাই হিসেবে ব্যর্থ, মিস.তিথিয়া! এই একা শহরে মুগ্ধকে আমি একা ছেড়ে দিয়েছি।’

কথা বলতে গিয়ে মুখরের গলা কাঁপছে। কিছু বলতে গিয়েও যেন সবটা তার গলায় বিঁধছে। তার প্রত্যুত্তরে আমি কিছু বলতে পারলাম না। কেমন রাগ লাগছে নিজের উপর! আমার ভরসায় ছেলেটাকে ছেড়েছিলো মুখর। অথচ তার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আমি নিজেই ব্যর্থ!

মুখর আবারো বলে উঠে,

‘একটা বিশাল সাপ আমার পেছনে পড়ে আছে। ক্রমেই গিলছে আমার পুরো পরিবারকে। তাদের রক্ষা করতে গিয়ে আমি ব্যর্থ! ব্যর্থ এক পথহারা পথিক আমি!’

মুখরের কথার কিছুই আমি বুঝলাম না। শুধু অপলক চেয়ে আছি ভেঙে পড়া একজন শক্ত খোলসে মোড়া মানুষকে। হঠাৎ সেখানে হনহনিয়ে আসে একটি ছোটখাটো গোছের মহিলা। তার দৃষ্টি এলোমেলো। মুখরকে দেখতেই তার দিকে তেড়ে আসেন তিনি। মুখর মহিলাকে দেখেই তড়িৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। মহিলাটা মুখরের বুকের উপর আঁচড়ে পড়ে বলে উঠে,

‘মুখর, আব্বা আমার! আমার ছেলে কোথায়? আমার মুগ্ধ কোথায়? আমি দেখতে চাই!’

মুখর মহিলাকে জোরে জড়িয়ে বলে,

‘মা, তুমি এসেছো? মুগ্ধ ঘুমাচ্ছে ভেতরে, মা। আমাদের চিন্তায় ফেলে ডেভিলটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দেখো!’

দুজনের কথায় বুঝলাম মহিলাটা মুখর-মুগ্ধের মা। মুখরের মা মুখরকে ধরেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। আমারও বুক ভেঙে কান্না এলো। কিছু সময় দুজনেই নিঃশব্দে অশ্রুপাত করলো। মুখরের মা এবার কেবিন থেকে মুগ্ধকে দেখে এলো।
কিছুক্ষণ পর তিনি এসে মুখরের পাশে চেয়ারে বসলেন। চোয়াল শক্ত করে বললেন,

‘কাজটা কে করেছে তুই ধরতে পেরেছিস তো, আব্বা?’

ক্ষণেই মুখরের ভ্রু জোড়াও কুঁচকে এলো। নিঃশব্দে কিছু একটা ভাবলো সে। পরমুহূর্তেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার মায়ের দিকে ফিরে বললো,

‘এর একটা সুরাহা না করলে হয় না, মা। আমি আসছি!’

মুখরের মা তখনি পথ আটকে বলে,

‘এখন যাসনে, আব্বা! ওরা আমার মুগ্ধের পায়ে গুলি করেছে। এখন তোর কিছু হয়ে গেলে আমি তা সহ্য করতে পারবো না রে, মুখর!’

মুখর তার মায়ের হাত সরিয়ে বলে উঠে,

‘আমার কিছু হবে না, মা। আমি ফিরে আসবো!’

এই বলে এদিক সেদিক না দেখেই মুখর
হাসপাতাল ছাড়ে। পুরো দৃশ্যটা দেখেও আমি তাকে আটকানোর সাহস পাইনি। আমি জানি না মুখর কোথায়, কেন যাচ্ছে! তবে আমার বুঝতে বাকি নেই মুখর নিরাপদ কোথাও অবশ্যই যাচ্ছে না! নির্বাক হয়ে তাকে দেখছি আমি। ছেলেটার চোখটা ক্রমেই লালবর্ণ ধারণ করেছে। এই দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ চোখ রাখা দায়, যেন এতেই জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাবে সবটা!
আমি মনমাঝে বললাম,

‘মুখর সাহেব, যেখানেই গিয়ে থাকুন, সুস্থভাবে ফিরে আসুন। আপনার আম্মা আর ভাইয়ের জন্য হলেও আপনাকে শত বিপদের মুখ থেকে ফিরে আসতে হবে!’

(চলবে)

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২১
#তাশরিন_মোহেরা

মুখরের মা ফুঁপিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। আমি করুণভাবে চেয়ে আছি এক দুঃখে জর্জরিত জননীর দিকে। এক ছেলে তার বিছানায় আহত হয়ে পড়ে আছে আর অপরজন পাড়ি জমিয়েছে অজানা এক গন্তব্যের দিকে। দুই সন্তানের কষ্ট মহিলাটি কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। না জানি তার উপর কি যাচ্ছে!

কিছুক্ষণ পর মুখরের মায়ের জন্য এক কাপ কফি এনে তার কাছে এগিয়ে দিলাম। তিনি কান্না থামিয়েছেন, তবে তার ভেঙে পড়াটা দৃশ্যমান। সেই ভেঙে যাওয়া চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। অতি শুষ্ক এক হাসি হেসে তিনি আমার হাত ধরে তার পাশে বসালেন। তার পাণ্ডুর মুখখানা দেখে আমার বুকের ভেতরেও ঝড় বইছে! আমি চুপচাপ বসে আছি। তিনি আমার হাতের উপর হাত রেখেই বললেন,

‘তুমি নিশ্চয়ই মুগ্ধের ম্যাম, তিথিয়া তাই না?’

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,

‘জ্বি!’

তিনি আমার হাতখানা বুলিয়ে বললেন,

‘তোমার সাথে ঠিকমতো পরিচয়টাও হলো না, মা! কিছু মনে কোরো না। তবে আমার ছেলে দুইটা সবসময় তোমার কথা বলে।’

আমি খানিক অবাক হলাম। মুগ্ধ আমার ব্যাপারে বলে তা মানা যায়, কিন্তু মুখর আমায় নিয়ে তার মা’কে বলে তা কেন যেন বিশ্বাস হলো না।
তিনি আবারো বললেন,

‘আমার ছেলে দুটো আজ কেমন মৃত্যুর সাথে লড়ছে, দেখেছো? আমার বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও আমি কিছুই করতে পারছি না। আমি আমার দায়িত্ব পালনে বিফল, মা!’

তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমার চোখ বেয়েও অবারিত পানি ঝরছে। বাধভাঙ্গা এ পানিদের থামানো দায়। তাও চোখ জোড়া মুছে বললাম,

‘আপনি মোটেও বিফল নন। বরং একজন সাহসী মা। দুই ছেলেকে একা হাতে সামলেছেন সাত বছর, স্বামী ছাড়া। আপনি কিছুতেই বিফল হতে পারেন না, আন্টি।’

আমায় কথায় আন্টি বোধহয় কিছুটা দমলেন। তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন,

‘আমার বড় ছেলে মুখর অনেক কষ্ট সহ্য করেছে, মা। আমি জানি তার হৃদয় এতোদিনে পাথরে পরিণত হয়েছে! এতো কষ্টের মাঝে এখন মুগ্ধের এই অবস্থা দেখে ছেলেটা নিজেকে কি করে সামলাবে? বলো তো!’

কথা বলতে গিয়েও মানুষটার গলা কাঁপছে। সাথে ঠোঁট ভেঙে কান্না পাচ্ছে আমারও। আমি জানি মুখর অনেক কষ্ট মনে দেবেছিল। কিন্তু কখনো তার কষ্ট দেখার সুযোগ কিংবা সাহস কোনটিই আমার হয়নি। আমি বললাম,

‘মানুষটার জীবনে নিশ্চয়ই অনেক কিছু হয়ে গেছে, তাই না?’

তিনিও মাথা দুলালেন। ওড়না দিয়ে চোখ জোড়া বারবার মুছছেন। কিন্তু কিছুতেই চোখের পানিগুলো শুকোচ্ছে না। ওড়নার অর্ধাংশই ভিজে গেছে আন্টির।

মুগ্ধের এমন আচমকা গুলি লাগা, মুখর সাহেবের কোথাও চলে যাওয়া এসব কিছুই আমাকে একটা দিকেই নিয়ে যাচ্ছে বারংবার। সেদিনের অজানা নাম্বার থেকে আসা মেসেজটি। যাতে সে ব্যক্তি বলেছিলো মুখর সাহেবই তার বাবাকে মেরছেন। কিন্তু মুখরের ভেতরকার কিছুই আমার জানা নেই বলে তাকে অযথা সন্দেহ করাটাও উচিৎ না। তবে মুখরের অতীত জানার একটা আগ্রহ আমার প্রথম থেকেই কাজ করেছিলো। তাই আন্টিকে পেয়ে সেই কৌতুহলটা আর আটকে রাখতে পারলাম না। তাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,

‘কিছুদিন আগে, মুখর সাহেবের ফোনে একটা মেসেজ এসেছিলো। সেখানে লিখা ছিলো, মুখর সাহেব তার বাবাকে মেরেছেন। আর এর জন্য তার জটিল এক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কথাটা কতটুকু সত্য, আন্টি?’

মুখরের মা আবারো শব্দ করে কাঁদলেন। আমার হাতটা আঁকড়ে ধরে বললেন,

‘তুমি কি এ কথা বিশ্বাস করলে, মা? বলো? আমার ছেলে কি তার বাবাকে মারতে পারে?’

আমি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বললাম,

‘এ কথা আমি একদমই বিশ্বাস করি না। শুধু সত্যতা যাচাই করছি।’

তিনি আমায় বললেন,

‘শোনো তবে। হ্যাঁ আমার ছেলের হাতেই তার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

কথাটা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই থমকালাম আমি। কথাটা ঠিক শুনেছি তো? এই রহস্য উদঘাটনের জন্যই আজ থেকে পাড়ি জমালাম বহু বছর আগে। ঠিক মুখরের জন্মের সময়।

আমেনা হাসনাত আর হাসিবুল্লাহ্ শিকদারের একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে হয়েছে। চারপাশ মুখরিত করে তার আগমন। বাবার জীবনেও স্বচ্ছলতা ফিরে এলো মুহুর্তেই। একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি হয়ে গেল। আকিকাতে নাম রাখলেন মুখর শিকদার। বাবার স্বচ্ছলতা ফিরে আসায় বেশ কাটছিলো তিনজনের ছোট পরিবারটি।
মুখর যখন পাঁচ বছরে পা দেয় ঠিক ততোদিনে কোম্পানির হেড এরশাদ মুত্তাকীর সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে হাসিবুল্লাহ্ সাহেবের। তার দুই বছরের ছোট মেয়ে রূপন্তীকে নিয়ে এরশাদ সাহেব প্রায় সময়ই এ বাড়িতে আসতেন।

এমন করে মুখর আর রূপন্তীর বেশ সখ্যতা তৈরি হয়। কিন্তু এ সখ্যতা দিনের পর দিন যেন বিরক্তির কারণ হলো। মুখর যখন একটু বুঝতে শিখলো সে রূপন্তীর কাছ থেকে দূরে দূরেই থাকতে চাইতো বেশি। এর কারণটা মুখরের বাবা-মায়েরও চোখ এড়ালো না। রূপন্তী সারাটাক্ষণ মুখরের পিছু পিছু ঘুরতো। সকাল থেকে রাত অবধি মুখরকেই পাশে চাইতো বেশি। তার বাবাকেও একপ্রকার ভুলতে বসেছিলো সে।
রূপন্তী যখন কৈশোরে পদার্পণ করলো মুখরের জন্য তার পাগলামো আরও বেড়ে গেল। মুখরকে সামনে দেখতে না পেলে সে প্রায় পাগলের মতো হয়ে যেতো। কিছু খেতো না, কারও সাথে কথা বলতো না, জিনিসপত্র ভাঙচুর এসব তার নিত্যদিনের আচরণ ছিলো। এরশাদ সাহেব মেয়ের উপর ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে মেয়ের অবস্থার জন্য খুব কষ্টও হলো তার। মুখরের বয়স যখন ১৭ হলো, মুগ্ধ জন্ম নিলো। এদিকে মুগ্ধের আগমনে মুখর রূপন্তী থেকে আরও দূরে সরে গেল। রূপন্তী এতে মানসিক ভাবে ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়লো। এজন্যই এরশাদ সাহেব কিছু না দেখে হাসিবুল্লাহ্ সাহেবকে মুখর আর রূপন্তীর বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। হাসিবুল্লাহ্ ছেলের অমতে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না বলে এরশাদ সাহেবকে সরাসরি না করে দেন।
কোম্পানির হেড হয়ে একজন সামান্য কর্মচারীর হাতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এরশাদ সাহেব ফুঁসে উঠেন। মুখরেকে হাত করার উদ্দেশ্যে বাবা-মেয়ে মিলে এক গভীর ষড়যন্ত্র করেন।

এক রাতে হাসিবুল্লাহ্ সাহেবকে এরশাদ সাহেব তার বাড়িতে ডেকে পাঠান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ম’দ পান করিয়ে মাতাল করে তোলেন। মাতাল অবস্থায় রাস্তা ধরে বাড়ি আসার জন্য বেরিয়ে পড়েন হাসিবুল্লাহ্ সাহেব।
হাসিবুল্লাহ্ আসতে দেরি করায় আমেনা বেশ অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সে মুহুর্তেই মুখরের ফোনে কল আসে রূপন্তীর। সে মুখরকে বলে,

‘তোমার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে, মুখর। জলদি আমাদের বাসায় এসো!’

মুখর আর দাঁড়ালো না। এরশাদ সাহেবের উপহার দেওয়া গাড়িটায় চড়েই রওনা হয় সে। কিন্তু হায়! অর্ধেক যেতেই গাড়িটার ব্রেকফেইল হয়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখর বেশ ঘাবড়ে যায়। এমন সময় রাস্তায় গাড়িটার সামনে এসে পড়েন হাসিবুল্লাহ্! হাসিবুল্লাহ্কে গুরুতর আহত করার পর গাড়িটা পাশেই এক গাছের সাথে ধাক্কা খায়। এতে মুখরও বেশ গুরুতর আহত হয়। সে যাত্রায় মুখর বেঁচে গেলেও বেঁচে ফির‍তে পারেননি হাসিবুল্লাহ্। তার মৃত্যুর অনলে গত সাত বছর ধরে জ্বলছে ছেলে মুখর। বাবার শোকে বেশ কয়েক বছর পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো সে। কথা বলা অনেকাংশেই কমে গিয়েছে, তার চোখ দুটোও যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে ক্রমেই। ছেলের হাতে বাবার এক্সিডেন্ট হওয়ায় এই শহরে আর থাকতে পারেননি আমেনা। চারপাশের মানুষের কানাঘুঁষা তিনি আর নিতে পারেননি। এ অন্ধকার শহরের মায়া ত্যাগ করে চলে যান বাবার বাড়ি। মনের মধ্যে রেখে যান এক পাহাড়সম দুঃখ। তিনি জানেন তার স্বামীর আসল খুনি সেই এরশাদ। কিন্তু টাকার জোরে কেউ তার বিচার করবে না। টাকার কাছে আইন হার মানবে বারংবার। তাই মিছে ঝামেলা না করে তিনি পিছু হটে যান সহজেই। কিন্তু এতো বছর পর আপদটা পিছু ছাড়লো না দেখে আমেনার মাঝে আবারো জমা হয়েছে একরাশ ভয়।

সাত বছরের এমন করুণ কাহিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম চেয়ারে। মুখরের কথাটা এবার বোধহম্য হলো। এরশাদ সাহেবকে সে একটা বিষাক্ত সাপের সাথে তুলনা করেছে। সেই সাপ যে কিনা তার বিষ ছড়িয়ে সবটাই গিলে নিচ্ছে।
পরক্ষণেই মনে পড়লো প্রথমদিনের দেখা মুখরের সেই বুকের নিচের দাগটি। এই ক্ষতটা নির্ঘাত তার এক্সিডেন্টার জন্যই হয়েছিলো। বুকে হাত দিয়ে অনুভব করলাম কি ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে এখানটায়। সে যন্ত্রণা ভোগ করে মুখরের উদ্দেশ্যে বললাম,

‘কিভাবে এতো কষ্ট, এতো রাগ নিজের মধ্যে চেপে রেখেছেন, মুখর সাহেব?’

.

আজ তিনদিন হলো মুগ্ধ হাসপাতালে আছে। আর কিছু সময় পরই মুগ্ধকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। মুগ্ধের জ্ঞান ফিরেছে একদিন হলো। অবস্থা স্বাভাবিক থাকায় ডাক্তার বলেছেন তাকে দুইদিন পর রিলিজ দেওয়া যেতে পারে।
ছোট ছেলেটা জ্ঞান ফেরার পর তার মমতাময়ী মা’কে দেখেই তার বুকে ঝাপটে পড়ে। সে অতিশয় ভীত ছিল! আর যাই হোক, এইটুকু বয়সে সে গুলির মতো ভয়ানক কিছুর মুখোমুখি হয়েছে! সৃষ্টিকর্তাকে হাজারবার শুকরিয়া জানিয়েছি এই বিপদ থেকে ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে। আমি পাশে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মুগ্ধকে। জড়িয়ে ধরেই বুঝলাম সে কাঁপছে, ভীষণ ভাবে! আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে পরম আদরে বললাম,

‘কিচ্ছু হয়নি, বাবা। তুমি একদম ঠিক আছো, দেখো!’

আরও খানিক্ষণ জড়িয়ে রাখার পর সে বলে উঠলো,

‘আম্মু, ভাইয়া কোথায়?’

আন্টির ঠোঁটটা কেঁপে উঠলো। তিনি মনে মনে এই প্রশ্নের আশায়ই ছিলেন। তবে তার কাছে বোধহয় কোনো উত্তর নেই। আমার দিকে করুণভাবে চেয়ে আছেন তিনি।
কি বলবে মুগ্ধকে? তার ভাইয়া তো আজ তিনদিন হলো লাপাত্তা। আন্টি থেকে জানলাম সে নাকি ঐ এরশাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে গেছে। কিন্তু অতো বড় একজন মানুষের কাছে মুখর কিছুই না! চাইলেই লোকটা নিমিষে গায়েব করে দিতে পারে মুখরকে। হঠাৎ আঁতকে উঠলাম। ছেলেটা জেনেশুনে আগুনে পা দিতে গেছে! পরক্ষণেই তার উপর আবার ভীষণ রাগ হলো! রূপন্তী মেয়েটা তার সাথে এতোকিছু করেছে তারপরও কেন রূপন্তীকে ছেড়ে দিলো না সে? মেয়েটা তাকে শুধু কষ্টই তো দিয়েছে! রূপন্তীকে সামনে পেলে আমি বোধহয় রোস্ট বানিয়ে আস্ত চিবিয়ে খাবো তাকে!

(চলবে)