#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৬ (প্রথমাংশ)
#তাশরিন_মোহেরা
পড়নের ওভারকোটটা হালকা সরিয়ে মুখর চেয়ার টেনে বসলো অফিসারের সামনে। তার হাতে থাকা ফাইলগুলো টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারলো। অফিসারের চেহারাটা তখন দেখার মতো! ভয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মাঝে এক কনস্টেবল এসে মুখরকে জিজ্ঞেস করলো,
‘স্যার, কিছু আনবো? চা কিংবা কফি?’
মুখর ইশারায় বললো কিছু লাগবে না। ছেলেটা তারপরও একগাল হেসে মুখরকে এক কাপ কফি এনে দিলো। মুখরকে ‘স্যার’ ডাকা আর তাকে এমন তোষামোদ করাটা আমার ঠিক হজম হলো না।
এরশাদ সাহেব পাছেই দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠলেন,
‘এই ছেলেটা-ই আমার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগিয়েছে! একে এক্ষুণি জেলে ভরুন অফিসার।’
মুখর তার থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে বাঁকা হাসলো। কপালটা খানিক চুলকে অফিসারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
‘এজেন্সির পক্ষ থেকে আপনাকে কি বলা হয়েছিলো মি.মুজিব?’
অফিসারটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে জবাব দিলেন,
‘ন্যায়ের সাথে ভিকটিমদের কেস সামলে নেওয়া, স্যার!’
মুখর এবার চোখমুখ কঠিন করে অফিসারের দিকে চেয়ে বললো,
‘তাহলে এই লোকটা থেকে টাকা নিয়ে একপাক্ষিক বিচারের কারণ কি?’
তার একহাত এরশাদ মুত্তাকীর দিকে তাক করা। অফিসার এবার তার কপালের ঘাম মুছে আমতা আমতা করতে লাগলো। তার দূর্নীতি ধরা পড়ে যাওয়ায় এভাবে ভয় পাচ্ছে নাকি মুখরের অগ্নিদৃষ্টিতে সে এমন করছে তা বুঝতে পারলাম না। তবে মুখরের দৃষ্টি আজ অন্যরকম দেখালো আমার কাছে। মনে মনে অঙ্ক কষলাম, মুখর এখানে ঠিক কি পরিচয়ে এসেছে? কেনই বা সবাই তাকে মান্য করছে কিংবা তাকে ‘স্যার স্যার’ বলে ডাকছে। আন্টির দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম তিনিও হতভম্বের মতো সবটা অবলোকন করছেন। নিজের ছেলেকে যেন তিনি নিজেই চিনতে পারছেন না।
মুখর টেবিলে ছুঁড়ে দেওয়া ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই ফাইলে এরশাদ মুত্তাকীর দূর্নীতির সকল প্রমাণ আছে। এখানে তিনি কিভাবে কে ও মিলস এন্ড ফ্যাক্টরিজ কোম্পানিটির মাধ্যমে ব্ল্যাক মানি আয় করছেন তার পুরো প্রমাণ আছে।’
এরশাদ সাহেব এবার ক্ষিপ্ত হয়ে মুখরের দিকে তেড়ে আসতে থাকে। কিন্তু পেছনে মুখরের বন্ধুদের জন্য তা পারা গেল না। অফিসারও তার দিকে দেখে চোখ পাকিয়ে শান্ত হতে বলেন। এরশাদ সাহেব চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠে,
‘মুখর, তুমি কিন্তু মোটেও ভালো করছো না! আমি তোমার সাথে ঠিক কি কি করতে পারি তার হিসেব নেই তোমার!’
মুখর হঠাৎ করেই হো হো করে হেসে উঠলো। গগনবিদারী হাসিটা দেখেই অফিসার আর এরশাদ সাহেবের মুখটা পাংশুটে আকার ধারণ করলো। মুখর হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,
‘খুব হাসলাম, আঙ্কেল!’
মুখর এরশাদ সাহেবের চেয়ারের দিকে এগিয়ে তার দিকে ঝুঁকে চোখমুখ কঠিন করে বলে উঠলো,
‘আপনার যতদিন ক্ষমতা ছিলো আপনি অন্যের উপর জুলুম করতে পেরেছেন। কিন্তু এখন? এখন আপনার কোনো ক্ষমতা নেই! সবটা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছি। আপনার কোম্পানিটা গুড়িয়ে দিয়েছি আমি! এখন কিসের বদৌলতে আপনি আমার ক্ষতি করবেন, মি.এরশাদ?’
এরশাদ সাহেবের মুখটা ভয়ে নীলবর্ণ ধারণ করেছে। উপস্থিত সবাই মুখরের এ কথায় শিউরে উঠে, শিউরে উঠলাম আমিও। কি যেন ছিলো তার কথায়!
মুখর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফাইলগুলো দেখে এরশাদ সাহেবকে বললো,
‘এই ফাইলগুলো একবার আদালতে গেলেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে, মুত্তাকী সাহেব। এখন টাকা দিয়েও কিছু করতে পারবেন না আপনি।’
এরশাদ সাহেবের মুখভঙ্গি এবার বদলায়। মুখরের কাছ এসে হঠাৎ করুণ সুরে বলতে থাকে,
‘কি চাও তুমি, মুখর? এবারের জন্য আমায় ছেড়ে দাও। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো, ভাই!’
মুখর আবারো একটা অট্টহাসি দিলো। এরশাদ সাহেবের কান্ড দেখে আমার এবার বিরক্ত লাগলো। মানুষটা এখন ক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন দেখে করুণা নিচ্ছেন। অদ্ভুত বে’হা’য়া তো!
আন্টিও ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেয়। মুখর ফিসফিস করে এরশাদ সাহেবকে বলে,
‘আমার বাবার খুনি আমার কাছে এসেই করুণা চাইছে। ব্যাপারটা একটু বেশিই হাস্যকর হয়ে গেল না?’
এরশাদ সাহেব মাথা নিচু করে ক্ষমা চেয়েই যাচ্ছেন মুখর থেকে। মুখরের চোখে মুখে ঘৃণার আভাস দেখা গেল। আজ তার জন্যই মুখরকে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হয়েছে, মা আর ভাই থেকে আলাদা থাকতে হয়েছে এতো মাস!
মুখর চেয়ার টেনে আয়শ করে বসলো। হাত ভাঁজ করে বিজ্ঞের মতো বললো,
‘চলুন, মি.এরশাদ! একটা ডিল করা যাক তবে। আপনিও আজীবন জেল খাটা থেকে বেঁচে গেলেন আর আমারও বাবার খুনের প্রতিশোধ নেওয়াটা হলো।’
আমিসহ উপস্থিত সবাই অবাক হলাম মুখরের কথায়। এরশাদ সাহেব জেল খাটা থেকে বাঁচবেন মানে? কি চাইছে মুখর? তন্মধ্যে মুখরের মতো একই পারফিউম দেওয়া ছেলেটা বলে উঠলো,
‘কি বলছেন ভাই? লোকটাকে জেলে পাঠানোর এতো প্ল্যানের কি হবে?’
মুখর ছেলেটাকে ইশারায় শান্ত হতে বললো। আমিও মনোযোগ দিয়ে দেখছি মুখর আসলে কি চায়! তাকে আজ সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাচ্ছে। খুবই রহস্যময় একজন!
মুখর এরশাদ সাহেবকে কাছে ডেকে বলেন,
‘আমি যা বলবো তা-ই করবেন তো, মুত্তাকী সাহেব?’
এরশাদ সাহেব দুদিকে মাথা দুলিয়ে বোঝালেন তিনি রাজি। মুখর বাঁকা হেসে বললো,
‘কোম্পানিটা আমার নামে লিখে দিন, এরশাদ মুত্তাকী!’
এরশাদ সাহেব সাথে সাথে আঁতকে উঠে ভীষণভাবে। অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি আমরা সবাই। মুখরের সিদ্ধান্তে বেশ জমে উঠেছে পরিবেশ! ফাটাফাটি একটা চুক্তি করেছে এরশাদ সাহেবের সাথে। কোম্পানি হারিয়ে লোকটা এবার পথে বসবেন। কিছু বলার কিংবা কিছু করার সাধ্যি থাকবে না আর তার!
এরশাদ সাহেব হতবুদ্ধির মতো বসে আছেন। তার মাথায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে এ মুহুর্তে। ভাবার সময়টুকু নেই তার হাতে। মুখর যেন এরশাদ সাহেবের এই ভঙ্গিমাটা-ই দেখতে চেয়েছে। তার মুখটা দেখে খুশি-খুশি মনে হলো। সে এরশাদ সাহেবকে আরও অপ্রস্তুত দেখতে বললো,
‘ভেবে দেখুন, মি.এরশাদ! এতো নামীদামী কোম্পানির হেড জেলে গেলে সম্মানটা ঠিক কোথায় যাবে? তার চাইতে কোম্পানিটা আমার নামে লিখে দেওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?’
এরশাদ সাহেব বেকায়দায় পড়লেন এবার। দুই নৌকায় পা দেওয়াটাও সম্ভব নয়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন তিনি,
‘সেদিনই তোমাকে মেরে ফেলা উচিৎ ছিলো, মুখর! সেদিন তোমার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে গেলে আজ এদিন আমার দেখতে হতো না।’
মুখরের বাঁকা হাসিটা যেন থামছেই না। তার এ হাসি দেখে মনে মনে আমার ভীষণ স্বস্তি লাগলো। মনের উপর থেকে ভারী একটা বোঝা নেমে গেল যেন!
‘কোম্পানিটা লিখে দাও, পাপা! এর বাইরে আর কিছু করার নেই।’
পেছন হতে মেয়েলি এক স্বর ভেসে এলো। তা অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলাম রূপন্তী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এগিয়ে এসে কোম্পানির দলিলটা এগিয়ে দিলো এরশাদ সাহেবের হাতে। রূপন্তীর মুখটা মলিন হয়ে আছে ভীষণ রকমের। চোখের নিচেও কালি জমেছে হালকা। চোখ দুটো ফুলে আছে, বোধহয় কান্না করে এসেছে!
শেষমেশ মুখরের নামেই লিখে দেওয়া হলো কে ও মিলস এন্ড ফ্যাক্টরিজ কোম্পানিটি। মুখর দলিলটা নিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। রূপন্তী মুখরের দিকে চেয়ে অভিমান নিয়ে বললো,
‘পাপাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি অস্ট্রেলিয়ায়। আশা করি, তোমায় খুশি করতে পেরেছি।’
এই বলে রূপন্তী ভেঙে পড়া এরশাদ মুত্তাকীকে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো থানা হতে। মুখরের চারজন বন্ধুরা এগিয়ে এসে একসাথেই বলে উঠলো,
‘এই লোকটাকে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?’
মুখর হেসে বলে উঠলো,
‘চিন্তা করিস না তোরা! অবশেষে আপদটার ছাড়া পেলাম এটাই অনেক!’
(চলবে)
#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৬ (শেষাংশ)
#তাশরিন_মোহেরা
মুখরকে দেখে আবেগে কেঁদই দিলো মুগ্ধ। দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো ভাইয়াকে। মুখরও তার ‘মিনি ডেভিল’ কে কোলে তুলে নিলো। তার গালে অজস্র চুমু এঁকে দিলো মুখর। কান্না জড়ানো কণ্ঠেই মুগ্ধ বলে উঠলো,
‘কোথায় ছিলে ভাইয়া তুমি? তোমাকে কত্ত মিস করেছি আমি জানো?’
মুখর মুগ্ধের চুলগুলো এলোমেলো করে বললো,
‘একটা কাজে শহরের বাইরে ছিলাম। আর তুই এই ক’দিনে এতো শুকিয়েছিস কেন বল তো?’
মুগ্ধ গাল ফুলিয়ে বললো,
‘তুমি মিথ্যা বলছো, ভাইয়া! কাজের জন্য শহরের বাইরে গেলে একটা কল করতে পারলে না? আর আম্মু মাঝরাতে তোমার জন্য কাঁদতোই বা কেন বলো তো? আর ম্যাম, ম্যাম ও কেঁদেছে অনেকবার।’
মুগ্ধের কথায় মুখর আড়চোখে আমার দিকে একবার দেখলো। বাঁকা হেসে বললো,
‘তাই নাকি? ম্যাম ও কেঁদেছে?’
লজ্জায় আমার মাথাটা কাঁটা গেল! মুগ্ধের কাছ থেকে এতো লুকিয়ে কাঁদার পরও ছেলেটা টের পেয়ে গেল? চোখ খিঁচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কাঁদিনি এ কথায়ও স্বীকার করা যাচ্ছে না!
মুখর মুচকি হেসে সবাইকে নিয়ে সোফায় বসলো। আন্টি আর মুগ্ধের কৌতুহলে সবটা খুলে বলছে মুখর।
মুখরের সাথে যে চারজন আজ উপস্থিত হয়েছে তারা হলো রাদিফ, তানজীব, সরব আর মাহদী! এর মধ্যে সরব আর রাদিফ মুখরের দু’বছরের ছোট অর্থাৎ রূপক ভাইয়ের সমবয়সী। তানজীব আর মাহদী মুখরের সহপাঠী থেকে একসময় কাছের বন্ধু হয়ে যায়।
এদের একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম রাদিফ ছেলেটা দেখতে বেশ লম্বা তবে মেদহীন। শরীরের বেশ কয়েক জায়াগার হাড় দৃশ্যমান, কোথায়ও মাংসের ছিটেফোঁটা নেই। চুলগুলো আর্মিদের মতো ছোট ছোট করে ছাটা। দেখতেও বেশ চুপচাপ ধরনের। বেশ ভদ্রই লাগলো ছেলেটাকে।
তানজীব ছেলেটা দাম্ভিকতায় ভরা মনে হলো আমার। ঝাকড়া চুলের বাহারে তার একটা অন্যরকম ভাব ফুটে উঠেছে চোখমুখ জুড়ে। ফর্সা চামড়ার ছেলেটার মুখে ছোপ ছোপ দাঁড়ি গজানোতে তাকে বেশ সুদর্শন বলা চলে।
তানজীবের পাশে বসে থাকা চশমা এঁটে রাখা ছেলেটি হলো মাহদী। হাবভাব বেশ বিজ্ঞের মতোই। হাসিখুশি ছেলেটার গায়ের রঙ একটু চাপা। চুলগুলো তার ঘাড় অবধি নেমেছে, তা দেখতে অতোটাও খারাপ দেখাচ্ছে না। সামনে চলে আসা চুলগুলো বারবার হাত দিয়ে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে সে। মুখে হাসি ধরে রেখেছে সেই প্রথম থেকেই। এই হাসিতেই বোধকরি অনেকেই কুপোকাত হওয়ার উপক্রম।
শেষমেশ আসি সরবের কথায়। এ ছেলেটাই গায়ে মুখরের পারফিউম মেখে ঘুরে বেড়ায় চারদিকে। গম্ভীরমুখো ছেলেটা যে প্রায়ই মুখরকে অনুসরণ করে তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। সুঠামদেহী শরীর নিয়ে রক্তচক্ষু দিয়ে সবাইকে দেখছে সে। সবসময়ই বোধহয় এমন চাহনি নিয়ে থাকে সে। ছোটখাটো বলে দেখতে একটু ভয়ংকরই লাগছে তাকে।
মুখর কোথায় ছিল তা জানতে চাইলে সে বললো,
মুখরের বাবা হাসিবুল্লাহ্ মারা যাওয়ার পর প্রায় তিনটে বছর মুখরের জীবন বেশ দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। বাবার ব্যবহৃত কোনোকিছুই তার সামনে এলে সে আত্নগ্লানিতে ভুগতো। নিজেকে বারবার দোষারোপ করতো যে সে-ই তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। চোখের সামনে দিনদিন মায়ের ভেঙে পড়াটাও দেখতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে একুশ বছরের যুবকটিকে!
ঠিক তখনই দেবদূতের মতো মুখরের জীবনে আসেন সুলেমান শাহ্। বাবার পর তিনিই অনেকটা অভিভাবকের মতো অবদান রাখেন মুখরের জীবনে। সুলেমান শাহ্ একটা সিক্রেট এজেন্সির হেড ছিলেন। জর্জরিত মুখরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তিনি মুখরকে একাকিত্ব থেকে বের করে নিয়ে আসেন। মুখরের দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম সুলেমান শাহ্ এর কথা বলতেই মুখরের চোখ চিকচিক করে উঠে।
মুখর হঠাৎ মলিন হয়ে বলে উঠে,
‘কিন্তু মানুষটা আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। যে প্রতিশোধটা মনে মনে দীর্ঘদিন যাবৎ পুষে রেখেছেন, তা আর শেষমেশ পূরণ করে যেতে পারেননি।’
আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিসের প্রতিশোধ?’
মুখর প্রত্যুত্তরে বললো,
‘এরশাদ মুত্তাকীর সাথে আঙ্কেলের ব্যক্তিগত কিছু শত্রুতা ছিলো। যার জের ধরেই তার এ এজেন্সিটা খোলা। কিন্তু এরশাদ ধরা পড়ার আগেই মৃত্যু হয় আঙ্কেলের। আর তার অবর্তমানে এজেন্সির হেড হিসেবে আপাতত আমিই নিয়োজিত আছি!’
মুখর এজেন্সির হেড এ কথা শুনেই আমার ওষ্ঠাধর একে অপর হতে আলাদা হয়ে যায়। চোখ বড় করে আন্টির দিকে তাকাই। দেখি সেও আমার মতো বিস্মিত হয়ে গেছেন। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এজেন্সিটা কেমন, মুখর সাহেব? এমন কোনো সিক্রেট এজেন্সির কথা তো কখনো শুনিনি!’
আমার কথার উত্তর দিয়ে উপহাস করে তানজীব বলে উঠলো,
‘বিসিটি’ এর নাম কি কখনোই শুনেননি? বাংলাদেশে থেকেও এদেশের খবর রাখেননা? আপনাকে তো দেশদ্রোহীতার জন্যে জেলে পাঠানো উচিৎ!’
তানজীবের কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। আসলেই কি দেশদ্রোহী হিসেবে আমায় দেশচ্যুত করবে এরা? মুখরের দিকে অনিশ্চিত চোখে তাকালাম। সে মুচকি হেসে আমাকে আশ্বাস দিলো, এসব কিছুই হবে না। এরপর বর্ণনা করলো,
‘বিসিটি’ এর পূর্ণরূপ বাংলাদেশ ক্রাইম ট্রাইবুনালস। এটা মূলত একটি সিক্রেট এজেন্সি। দেশের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা দূর্নীতিবাজদের লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করাটাই এই এজেন্সির মূল উদ্দেশ্য। ঠিক যেমনটা আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি এরশাদ মুত্তাকীকে।’
মুগ্ধ এতোটা সময় ধরে চুপচাপ সবার কথা শুনছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে না পেরে বলে উঠলো,
‘তার মানে তুমি ঐ এজেন্সিটার প্রধান শিক্ষক, তাই না ভাইয়া?’
মুগ্ধের কথায় হো হো করে হেসে উঠলো সবাই। আমারও খুব হাসি পেয়ে গেল। সবাইকে হাসতে দেখে মুগ্ধ বোকা বনে গেল তৎক্ষণাৎ।
তখনই আব্বার ফোন আসায় বুঝতে পারলাম বেশিক্ষণ আর এ বাসায় থাকা হবে না। আন্টি থাকার জন্য অনেক অনুরোধ করার পরও থাকতে পারলাম না। আব্বার ইদানীং প্রেশারটা বেড়েছে খুব! তারউপর অনিশ্চিতভাবে আমাকে রূপক ভাইয়ের ভরসায় ছেড়েছেন। কিন্তু রূপক ভাইকেও অযথা কষ্ট দিতে ইচ্ছে হলো না, তাই তাকে থানা থেকেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন যদি বাসায় গিয়ে না পৌঁছি তবে কেয়ামত হয়ে যাবে আজ! দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম মুখর সাহেব এগিয়ে এলো আমার কাছে। কোমল কণ্ঠে বললো,
‘আরেকটু পর গেলে কি হয় না, মিস.তিথিয়া?’
আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘ইতোমধ্যেই অনেক দেরি করে ফেলেছি! আজ আর থাকা যাবে না, মুখর সাহেব।’
‘তাহলে চলুন, আমি এগিয়ে দেই।’
‘না না, অযথা কষ্ট করবেন না। এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা পাড় করে এসেছেন, কিছু সময় বিশ্রাম নিন!’
‘তাই বলে আমি যে আপনাকে একা ছেড়ে দেবো তা তো হয় না, মিস তিথিয়া!’
‘আপনি শুধু শুধুই ভাবছেন। আমি তো ছোট বাচ্চা না, তাই না?’
‘না তা নন। কিন্তু মাঝেমধ্যে তো মুগ্ধ থেকেও বাচ্চা হয়ে যান। নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেন।’
‘মজা করছেন, মুখর সাহেব?’
‘আমি তবে এগিয়ে দেই?’
‘দরকার নেই, বললাম তো!’
‘দরকার আছে, বললাম তো!’
‘জেদ করবেন না, মুখর সাহেব।’
‘জেদের এখনো দেখলেনই বা কি, মিস.তিথিয়া! আমার জেদের কাছে আপনি নিতান্তই কচি খুকী!’
আমাদের দীর্ঘ এক কথোপকথনে বিরক্ত হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তানজীব বলে উঠলো,
‘দরজার কাছে দাঁড়িয়েই কি আজকের দিনটা পার করার ইচ্ছে আছে নাকি তোর, মুখর?’
তানজীবের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে খুবই বিরক্ত আর বাকি তিনজন মিটিমিটি হাসছে। ঈষৎ লজ্জা পেলাম। সামান্য এগিয়ে দেওয়া নিয়ে এতো বকবক করে ফেললাম আমি। তখনই আন্টি এ সমস্যার সমাধান দিলেন। বললেন,
‘মুখর আব্বা! তুই এখন রেস্ট নে। তানজীবরা না হয় তিথিয়া মা’কে এগিয়ে দেবে।’
তন্মধ্যে মাহদী হাসিমুখে বলে উঠলো,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! এটুকু ভরসা তো করতেই পারিস আমাদের উপর, ব্রো।’
আন্টির কথা-ই শেষমেশ রইলো। চার বন্ধু আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পিছু ফিরে মুখরকে একবার দেখলাম আমি। তখনই দেখলাম সেও আমার দিকে চেয়ে আছে। এই ক’দিনে মুখরের মুখে খোঁচা দাঁড়িরা হালকা গজানোর সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তাতে আগের সৌন্দর্য একটুখানিও কমেনি মুখরের। বরং দাঁড়িতে ছেলেদের অসম্ভব সুন্দর দেখায় তারই নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছে সে আমায়। আমাদের চোখাচোখি হওয়াতে মুখর আমার দিকে সেকেন্ড খানেক তাকিয়েই হঠাৎ চোখ টিপ মারলো। সাথে সাথেই চমকে উঠলাম আমি। আর মুখর তার এই লজ্জাটুকু ঢাকতে না পেরে ঠোঁটে হাত দিয়ে পালালো। পেছনে ফেলে গেল একঝাঁক অস্বস্তি! কিন্তু এই অস্বস্তিটা আমার মোটেও খারাপ লাগছে না! বরং লজ্জায় ছেয়ে গেছে আমার পুরো শরীর। ভালোবাসার মানুষের প্রতিটা পদক্ষেপেই যেন প্রেমের আভাস পাওয়া যায়। আর ধীরে ধীরে এই প্রেমটা যেন আরও গাঢ়তর হতে থাকে।
(চলবে)