অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব-২৯+৩০

0
280

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৯
#তাশরিন_মোহেরা

মুখর সাহেব ইশারা করে তার মুখের দিকে হাত নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

‘ব্রাশ করছেন?’

তার নড়তে থাকা ঠোঁট দেখে বুঝলাম সে কি বলছে। এরপরই নিজের অবস্থা বোধগম্য হলো আমার। সাথে সাথেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলাম। মাথায় হাত দিয়ে দেখি ওড়নাটা মাথায় আছে কিনা! নাহ, ওড়নাটা মাথায় দিয়েই এসেছিলাম! সাথে সাথে রুমে গিয়ে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম চটজলদি।
মুখর হুট করে আমার বাসায় এসে পড়লো কেন? কাল তো খুব ভাব করে আমার পুরো কথা না শুনেই ফোনটা কেটে দিলো। আজ কি হলো তার?
মুখে অনেক কিছুই বলছি তবে মনে মনে আমি খুব খুশি। আলমিরা থেকে জামা বের করলাম। সে প্রথমবার বাসায় এসেছে বলে কথা! নতুন একটা জামা না পড়লে হয় নাকি!
তাই সাদার মধ্যে হলুদ ফুলের একটা থ্রি-পিস পড়লাম, গায়ে কাপড়টার হলুদ ওড়নাটা ভালোমতো জড়িয়ে নিলাম। মাথায়ও টেনেছি হালকা! মুখর সাহেবের সামনে যতবারই গিয়েছি, মাথায় আমার হিজাব ছিল বলে মাথায় ওড়না না টেনে যেতে ইচ্ছে হলো না। ফিটফাট হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি মুখর আব্বার ঠিক মুখোমুখি বসে আছে। ছেলেটার সাহস আছে বলতে হয়! আর আব্বা তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছেন। বেশ তীক্ষ্ণভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন বোঝাই যায়! আমাকে দেখে মুখর অমায়িক হাসলো। আর সেই হাসিতেই কুপোকাত হয়ে গেলাম আমি! মনে মনে হাজারো প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে। কেননা কিছুক্ষণ আগ অবধিও আমি ভেবেছি মুখরের সাথে আমার বোধহয় আর কখনো দেখা-ই হবে না! কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল!
মুখর দু’প্যাকেট মিষ্টি এনেছে। ভাবছি আব্বা কিনা মিষ্টি দেখেও খুশি হননি? আব্বার তো মিষ্টি খুবই পছন্দের। আব্বার দিকে তাকাতেই দেখলাম তিনিও আমার দিকে রাগান্বিত চোখে চেয়ে আছেন। বেশ খানিকক্ষণ এমন চোখাচোখি চললো। বুঝতে পারলাম না এ মুহুর্তে আমার কিছু বলাটা আদৌও মানানসই হবে কিনা! এ রেষারেষিতেই দেখলাম মুখর গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,

‘আসলে আঙ্কেল, আমার ছোট ভাই, ইয়ে মানে মিস.তিথিয়ার ছাত্র মুগ্ধের ঠিক এক মাস পরেই বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। তাই বলছি, মিস.তিথিয়া যদি মুগ্ধকে এই একটা মাস পড়ায় তবে বেশ ভালো হতো আরকি!’

মুখরের কথা শুনে আশাহত হলাম। আমি কিনা মন মাঝে ভেবে চলেছি মুখর আমায় একপলক দেখার আশায় বাসা এসে পড়েছে সাতসকালে। কিন্তু এখন যেন কাহিনী সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। সে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকেই আব্বার কাছ থেকে আমার বাইরে যাওয়ার অনুমতি নিতে এসেছে।
এদিকে আমি হাত কচলেই যাচ্ছি! আব্বার ভাবভঙ্গি দেখার সাহস আমার নেই। আব্বা হয়তো ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন যে তার সামনে বসা ব্যক্তিটিই মুখর শিকদার। সেই মুখর শিকদার যাকে ভালোবাসার কথা আমি আব্বাকে জানিয়েছিলাম। আর তখনই আব্বা আমার গালে কষে এক চড় লাগিয়েছিলেন।
আব্বা হালকা কেশে বললো,

‘তোমাকে আমার কিছু বলার নেই। যা বলার আমি আমার মেয়েকে বলেছি! আর এটাই শেষ কথা।’

আমি ক্ষীণ স্বরে আব্বাকে বললাম,

‘আব্বা, মুগ্ধের যে পরী…’

আব্বা আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে চাইলেন। যেন এক্ষুণি গিলে খাবেন আমায়! মনটা সাথে সাথেই মিইয়ে গেল। আব্বা এমন কেন করছেন আমার সাথে? ছলছল চোখে মুখরের দিকে আড়চোখে চাইলাম। তার চোখমুখের ভাব স্পষ্ট নয়। সে কিছুক্ষণ ভাবুক হয়ে আব্বাকে বললো,

‘তার মানে আপনি বলছেন মিস.তিথিয়াকে আপনি বের হতে দেবেন না কিছুতেই, তাই তো?’

আব্বা হাত ভাঁজ করে বসে আছেন চোয়াল শক্ত করে। তিনি যে মারাত্মক রেগেছেন তা চোখ দেখেই বুঝতে পারছি আমি! মনে মনে বললাম, ‘অযথা চেষ্টা করে লাভ নেই, মুখর সাহেব। আব্বা মানবেন না!’

মুখর আমাকে তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে চোখ বুজে আশ্বস্ত করলো। কিন্তু এই আশ্বাসে আমার মন মানলো না! আব্বা কিছুতেই রাজি হবেন না! মুখর সাহেব এমন সময় কাকে যেন ফোন করলো। আমি আহত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছি! মুখর-মুগ্ধের সাথে পথচলা বোধহয় এখানেই শেষ আমার!

ওপাশ হতে ফোন রিসিভ হতেই মুখর আব্বার দিকে আড়চোখে চেয়ে বললো,

‘হ্যালো, মা! হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভেতরে এসো!’

আমি অবাক হলাম অনেক। মুখর ‘মা’ বলছে মানে আন্টিকে ফোন করেছে সে? আর আন্টিকে ভেতরেই বা আসতে বলছে কেন?
মস্তিষ্কে জট পাঁকতে নিলেই দরজা ঠেলে ভেতরে এলো আন্টি আর মুগ্ধ। মুগ্ধ আমাকে দেখেই দৌঁড়ে ঝাপটে ধরলো আমায়। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ম্যাম, আপনি কি আর আসবেন না আমাকে পড়াতে? আমি আপনি ছাড়া আর কারো কাছেই পড়বো না কিন্তু!’

আমার কি অবাক হওয়া উচিৎ তা ভেবে পেলাম না। তবে মনে মনে ভীষণ গর্ববোধ হলো। আন্টিকে দেখেই মাথা নেড়ে সালাম জানালাম। বিস্মিত চোখে মুখরের দিকে দেখলাম। সে মুচকি হাসছে! ছেলেটা কি গোল পাঁকাচ্ছে আসলে? তার মুচকি হাসিটা ভীষণ সন্দেহজনক!

আন্টি হুট করে আব্বার পাশে এসে বসলেন। এরপর অভিযোগ করে বললেন,

‘আরে, জহির ভাই! আমাকে তো একদম ভুলেই গেলেন দেখছি!’

আব্বা আন্টি দেখে হঠাৎ চমকে উঠলো। এরপর একগাল হেসে আন্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

‘আমেনা, তুই? কেমন আছিস রে?’

আন্টি এবার বললো,

‘আল্লাহ ভালো রেখেছে, আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো আছি! আপনাকে দেখেও খুব একটা খারাপ আছেন বলে মনে হয় না, হাহা!’

আন্টি এবার মুখর আর মুগ্ধের দিকে চেয়ে বললো,

‘এই যে আমার দুই ছেলে, মুখর আর মুগ্ধ! মুখরকে শেষ যখন দেখেছিলেন, সে বেশ ছোট ছিল!’

আব্বা আন্টির সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো,

‘আচ্ছা! বাহ, তোর ছেলেটা তো দেখি বেশ বড় হয়ে গেছে।’

আন্টি উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘এটা তো আপনারই মেয়ে, তাই না জহির ভাই?’

আমি এতোটা সময় হতবুদ্ধির মতো সবটা গিলেছি! আব্বা আর আন্টির কথোপকথনের মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝিনি। বিস্ময়ের শেষ চূড়ায় পৌঁছে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হয়েছে আমার! আন্টির দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকাতেই তিনি হেসে উঠলেন। আমার থুতনিতে তার হাত ছুঁইয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বললেন,

‘তিথিয়া মা তো কিছুই বুঝছে না।’

আব্বার দিকে দেখলাম, তিনি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খানিক আগের সেই বিধ্বংসী রূপ ধারণ করা মানুষটা মুহুর্তেই ভেজা বেড়াল হয়ে গেল, খুব ভাবালো আমায়!
আন্টি আমাকে হাত ধরে সোফায় বসালেন। সবটা বিস্তারিত খুলে বললেন।

আব্বা আর আন্টি ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় একসাথে বড় হয়েছেন। আন্টির একজন অভিভাবক হিসেবে সর্বদা তার পাশে থেকেছিলেন আমার আব্বা। তবে দীর্ঘ বিশ বছর একত্রে পথ চলার মাঝপথে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু কারণে দু’পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখান থেকেই তাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আন্টি আন্টির পথে আর আব্বা আব্বার পথ একাই চলেছেন তখন থেকে। আর আজ মুখরের মাধ্যমেই তাদের পুণর্মিলন হয়।

কথার মাঝপথে আন্টি হঠাৎ বেশ আবেগী হয়ে পড়েন। টলমল করা চোখ দুটো বারবার মুছে যাচ্ছিলেন তিনি। আব্বাকেও অনেকটা নড়বড়ে দেখালো!

সাথে আমার মস্তিষ্কও সচল হয়ে উঠলো। মনে হাজারটা প্রশ্ন ভীড় করতে লাগলো। সেই প্রশ্নের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার আগেই সুমি ট্রে হাতে নাস্তা দিয়ে গেল টেবিলে।
এই যা! চমকের পিঠে চমক পেতে পেতে আন্টিদের নাস্তা দেওয়ার কথা-ই বেমালুম ভুলে গেলাম আমি। ইশারায় সুমিকে হালকা ধন্যবাদ জানালাম। মেয়েটা না থাকলে কি লজ্জায় না পড়তাম আজ!

অনেক বলে কয়েও আন্টিদের বেশিক্ষণ বসাতে পারলাম না। আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভালো একটা সময় কাটতো আমার! আন্টি আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসে বলেন,

‘আব্বার কথা ভেবো না। কাল থেকে আমার ছেলেটাকে পড়াতে এসো প্রতিদিন, কেমন? সে যে তুমি ছাড়া আর কারো কাছেই পড়তে চায় না।’

আমি মুচকি হাসলাম। আন্টি আব্বার সাথে আরো মিনিট খানেক কথা বললেন। সেই সুযোগে মুখর আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তাকে পাশে দাঁড়াতে দেখে ফিসফিস করলাম,

‘ভালোই তো সারপ্রাইজ দিলেন, মুখর সাহেব!’

মুখর ঠোঁট টিপে বললো,

‘সারপ্রাইজান্বিত হওয়ার জন্য আমি ধন্য।’

মুখরের এমন অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করা দেখে হাসি পেল ভীষণ। মুখর এবার দ্বিগুণ ফিসফিসিয়ে বললো,

‘কাল আরো অনেক সারপ্রাইজ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, মিস.তিথিয়া!’

এই বলে সে সামনে চেয়ে রইলো। আমি কণ্ঠে খাদ নামিয়ে বললাম,

‘কি সারপ্রাইজ?’

মুখর রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললো,

‘সারপ্রাইজ কি তা বলে দিলে সারপ্রাইজড হবেন কি করে, বলুন তো, মিস.তিথিয়া? অপেক্ষা করুন। অপেক্ষার ফল বেশ মিষ্টি হয়!’

এই বলে সে আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে আরো একবার বাঁকা হাসলো। আন্টির পিছুপিছু গিয়ে দরজা ছাড়লো। এবারো ছেলেটা আমার ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো একটা কথা বলে চলে গেল! আমার মন নিয়ে খেলতে তার এতো ভালো লাগে কেন? মনে মনে যাতাকলে পিষে ফেললাম মুখরকে আমি! এরপরই সর্বাঙ্গে শিউরে উঠলো এই ভেবে যে কালকের সারপ্রাইজটা আসলে কি হতে পারে?

(চলবে)

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩০
#তাশরিন_মোহেরা

মুখররা চলে গেলেই সোজা পায়ে আব্বার কাছে এলাম। তিনি মাত্র সোফায় বসেছেন। মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার! আব্বা আমাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় পাশে বসতে বললেন। আমিও বসলাম।

ভয়ে ভয়ে ডাকলাম,

‘আব্বা?’

আব্বাকে ভীষণ চিন্তিত দেখালো। চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে আছে। আমার দিকে চেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আব্বা। সাহস কিছুটা বাড়লো আমার! আব্বার রাগটা একটু বেশিই! এ কারণেই আব্বাকে একটু ভয় পাই আমি। আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরে তিনি বললেন,

‘আমি জানি মা, তোর মনে এখন অনেক প্রশ্ন জমেছে! হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল।’

আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আব্বা, আপনি কি আগে থেকেই মুখরকে চেনেন?’

আব্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

‘তুই যখন প্রথম আমাকে মুখর শিকদারের কথা বলেছিলি, আমি তখনই চিনেছি!’

আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আব্বা তবে এতোদিন মুখরকে না চেনার ভান করেছিলেন! কিন্তু কেন? তাকে চেনেন বললেই হতো! এই বিষয়টা লুকিয়ে রাখার কি হলো?

আব্বার মুখে এখন আগের মতো রাগত্ব ভাবটা নেই। বরং সে চেহারাটায় ফুটে উঠেছে একঝাঁক অনিশ্চয়তা। জর্জরিত মুখশ্রীটার দিকে চেয়ে থাকতেই আব্বা আমাকে বললেন,

‘তিথি মা, প্রতিটা মেয়েরই তো বিয়ে করতে হয়। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি একা কি করে থাকবো রে?’

কণ্ঠটা বেশ শীতল আব্বার। তাই কথাটা বেশিই আঘাত হানলো আমার বুকে। আসলেই তো! কখনো যদি আমার বিয়ে হয়ে যায়, এই বাসায় আব্বা একা কি করে থাকবে? চিন্তাটা আমার মাথায় প্রায়সময় এলেও আমি তা আগে পাত্তা দেইনি কখনো। কেননা আমি ভেবেছি আমার জীবনে কোনো ছেলের প্রয়োজন নেই। আর যদি কখনো কোনো ছেলের প্রয়োজন হয়, তবে আব্বার খাতিরে তাও বিসর্জন দিয়ে দেবো। কিন্তু বলা যতটা সহজ, করা তার চাইতে হাজারগুণ কঠিন। মুখরের দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে এ কাজটা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে আমার ক্ষেত্রে। কেননা আমি চাই আমার প্রিয় মানুষটার সাথে আজীবনই কাটাতে!

আব্বা আবারো বললেন,

‘মুখর ছেলেটাকে তুই ভালোবাসিস, তাই না?’

আব্বার কথায় সম্বিৎ ফিরে পাই। তবে আব্বার প্রশ্নে কিছুটা নুইয়ে পড়ি। কারণ আব্বাকে বারবার ‘মুখরকে ভালোবাসি’ বলতে গিয়ে মুখে বিঁধছে আমার। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ বলে আমি চুপ করে বসে থাকি। আব্বা এবার তা বুঝতে পেরে বললেন,

‘কিন্তু মুখরও কি তোকে ভালোবাসে?’

আমি ভীষণ রকম চমকালাম। মুখর আমাকে ভালোবাসে কিনা তার উত্তর সত্যি বলতে আমার কাছে নেই! মাঝেমধ্যেই আমার মনে হয় মুখর আমায় ঘৃণা করে আবার মাঝেমধ্যেই ভাবি সে আমার প্রতি দূর্বল। কিন্তু সঠিক উত্তরটা আসলে কি তা আমি জানি না! আর আমি কিনা সঠিক উত্তরটা না জেনেই তাকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করে রাখছি! ছিঃ!
মুখর যদি আমায় ভালোই না বাসে তবে আমার একপাক্ষিক ভালোবাসাটায় লাভটা কি?

আব্বা আমার এমন চুপ হয়ে যাওয়াটা ধরতে পেরে বললেন,

‘একপাক্ষিক ভালোবাসা বড্ড খারাপ রে, মা! তোকে খুব কাঁদাবে। কাঁদাতে কাঁদাতেই তোকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে ছাড়বে।’

আব্বার প্রতিটা কথা আমার বুকে ভীষণ আঘাত করছে। আসলেই কি আমার ভালোবাসাটা একপাক্ষিক? কিন্তু আমি তো কখনোই একপাক্ষিক ভালোবাসাটা চাইনি!

আব্বা বসা থেকে উঠে বলে উঠলো,

‘মনে মনে যদি বিয়ে করার প্ল্যান করে থাকিস, তবে তা বাদ দিয়ে দে! আমি তোর বিয়ের অনুমতি তোকে কখনোই দেবো না। এক্ষেত্রে আমায় স্বার্থপর বলতে পারিস!’

.

রাত তিনটে ত্রিশ! আমার চোখে ঘুম নেই। আব্বার বলা প্রতিটা কথা আমার বারবার মনে পড়ছে। আর বারবারই চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। মুখর আমায় ভালোবাসে কিনা তা জিজ্ঞেস করার সাহস আমি সঞ্চার করতে পারছি না! আর আব্বা তো বলেই দিয়েছেন, তিনি আমার বিয়েটা হতে দেবেন না। তা হোক মুখরের সাথে কিংবা অন্য কারো সাথে। আম্মার মতো আজীবন ধুকে ধুকে মরতে হবে আমায়!

হঠাৎ দরজায় হালকা ঠকঠক আওয়াজ হলো। প্রথমে চমকে উঠলেও পরে স্পষ্ট শুনতে পেলাম আব্বা ডাকছে। এতো রাতে আব্বা আমায় ডাকছেন কেন? জলদি পায়ে দরজা খুললাম। দেখি আব্বা দরজার ধারেই বসে আছেন। তার পুরো শরীর ঘামে জবজবে হয়ে আছে। আমি এ দৃশ্যে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হাত পা ঠান্ডা হয়ে কাঁপছে আমার! তড়িৎ আব্বাকে ধরে দেখি তিনিও কাঁপছেন। আমায় ক্ষীণ স্বরে অস্পষ্ট ভাষায় বলছেন,

‘বুকটা ব্যাথা করছে, তিথি!’

আমি কি বলবো বা কি করবো বুঝে উঠছি না। হঠাৎ আব্বাকে এই অবস্থায় দেখে আমার পুরো শরীরটাই অবশ হয়ে গেছে। তাও বললাম,

‘আব্বা, কিছু হবে না, আব্বা! একটু শক্ত থাকুন।’

আমি আব্বাকে কাঁধে ভর দিয়ে কোনোরকমে সোফায় বসালাম। তিনি অনবরত বলে যাচ্ছেন,

‘আমার ভালো লাগছে না রে, মা! তিথি! তিথি রে!’

আব্বার এমন গোঙানি শুনে আমার কাঁপুনি আরো বেড়ে গেল। কপালে ঘাম জমছে! তা মুছে তড়িৎ ফোনটা নিলাম। কাকে ফোন করবো ভেবে না পেয়ে শেষমেশ মুখরকে কল করলাম। সে ফোন না ধরায় দু’বার মিসড কল হলো। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মুখর ছাড়া আমি কাকেই বা ভরসা করবো এ মুহুর্তে। রূপক ভাইকে কল করলে সেও ফোন ধরলো না। রাত তিনটায় কাউকে আশা করাটাও বোকামি হবে আমার! মুখরকে শেষবারের মতো একবার ফোন করলাম। বেশ খানিকক্ষণ রিং হতেই ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ হতে ঘুমঘুম শব্দে মুখর হ্যালো বললে আমি তৎক্ষণাৎ তাকে বলে,

‘মুখর সাহেব, আব্বার বুকে ব্যাথা উঠেছে। তাকে এখনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। সাহায্য করুন!’

কথাটুকু বলার মাঝপথেই আমি ডুকরে কেঁদে দেই। এই কান্নাটা অনেকক্ষণ যাবৎই আটকে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি! মুখর আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বললো,

‘আমি এক্ষুণি আসছি, মিস.তিথিয়া! কাঁদবেন না। এক্ষুণি আসছি আমি!’

তার সান্ত্বনায় কিছুটা কাজ হলো বোধহয়। সাহসটা বাড়লো আমার। মুখর আসার অপেক্ষা করতেই আব্বার পাশে বসলাম। আব্বাকে পানি দিলাম। তিনি এক চুমুক পান করে আবারো বলছেন,

‘আমাকে মাফ করে দে, মা। একটা ভালো বাবা হতে পারিনি আমি! আর এখন তোকে ছেড়েই চলে যাচ্ছি।’

আব্বার কথা শুনে কান্নারা ঝাপটে চলে আসতে চাইলো। আমি ধমকে আব্বাকে বললাম,

‘অযথা এসব কি বলছেন, আব্বা?’

মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম বারকয়েক। বুকের দিকটায় খানিকক্ষণ ঢলে দিলাম। তখনি দেখলাম মুখর এলো। তার সাহায্যে কাছের একটা হাসপাতালে আব্বাকে ভর্তি করানো হলো।

হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি অনবরত কেঁদেই চলেছি। অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠেছে আমার! হেঁচকির মাঝেও কান্না থামছে না। আশেপাশে সবকিছুই অন্ধকার দেখছি আমি। অনেকবার চেয়েছি, আব্বা নামক মানুষটার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে। চেয়েছি আম্মার মতো আব্বাকে ফেলে হারিয়ে যেতে। কিন্তু এই মুহুর্তে এসে আব্বাকে হারানোর ভয়টা আমার গলা টিপে ধরেছে যেন! মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছে, হাত-পা নাড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি আমি। মনে মনে বারবার বলছি,

‘আব্বা, আমাকে একা ফেলে যাবেন না, প্লিজ!’

পাশে এসে দাঁড়ালো মুখর। অশ্রুভরা টলমল চোখে তার দিকে দেখলাম। সেও পীড়িত চোখে আমাকে দেখলো। চোখ বন্ধ করে আমায় শান্ত হতে বললো। কিন্তু এতে যেন আমার কান্না দ্বিগুণ বেড়েছে। আমি ওড়না চেপে কাঁদছি তো কাঁদছিই! মুখর এবার হেচকা টেনে আমায় তার বুকের মাঝে ঝাপটে ধরলো। মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে হাত বুলিয়ে দিলো খানিক। তার ছোঁয়ায় আরো শব্দ করে কাঁদলাম। সে বললো,

‘কিচ্ছু হবে না আপনার আব্বার! এতো ভেঙে পড়বেন না, মিস.তিথিয়া। আমি আছি তো!’

(চলবে)