অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব-৩৭+৩৮

0
360

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩৭
#তাশরিন_মোহেরা

কুমিল্লা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি আর আব্বা। গত সাতদিন যাবৎ আব্বাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা চালিয়েছি। কখনো হাত জোড় করে কেঁদেছি, কখনো রেগে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছি, কখনো বা অভিমান করে না খেয়ে থেকেছি। কিন্তু আব্বার মন আমি গলাতে পারিনি। আব্বাকে এও বলেছি যে, মুখরকে আমার দরকার নেই। আমি মুখরকে সম্পূর্ণ ভুলে যাবো। তারপরও আমায় যাতে অন্য কারো সাথে বিয়ে না দেয়। এই পোড়ামনটা যে আর কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে রাজি নয়। কিন্তু আব্বার ‘না’টা আর ‘হ্যাঁ’ হলো না। অগত্যা আব্বার সিদ্ধান্তটাই মাথা পেতে নিলাম বরাবরের মতো। সকল পিছুটান ফেলে, মনের উপর পাথর দেবে নিজেকে সামলে নিলাম। কয়েকবার চেয়েছি এ ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু আমার চাওয়াটা প্রতিবারের মতো চাওয়া-ই থেকে গেল।

ফোনটা ব্যাগে পুরতে গিয়ে দেখি আজ সাতদিন যাবৎই তা বন্ধ করে রেখেছি। কেননা আমি বেশ নিশ্চুপ হয়েই এ জায়গাটা ছাড়তে চাই। কারো ফোন যাতে আমায় বিভ্রান্ত করে না দেয়! কেন যেন কান্না পেয়ে গেল ফোনটা হাতে নিতেই। আদৌও কি আমার নীরবে যাওয়াটা ঠিক হবে? আদৌও কি আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকবে? আমি না থাকাতে কি আসলেই কেউ কষ্ট পাবে?
প্রশ্নগুলো করতে গিয়ে মনটা আমার বারবার একই মানুষকে ইঙ্গিত করতে লাগলো। একই মুখ বারবার ভেসে উঠতে লাগলো নেত্রজোড়ায়। এমন সময় দরজার কাছে এসে আব্বা গলা খাকারি দিলেন। আমি পিছু ফিরে আব্বাকে দেখলাম না। আব্বার প্রতি কেমন যেন ঘৃণা জন্মে গিয়েছে আমার! নিজের মেয়ের প্রতি এমন অবিচার এ ইহজগতে বোধহয় কোনো বাবা-ই করেনি।
শান্ত গলায় আব্বা বললেন,

‘যাওয়ার আগে আমেনাকে গিয়ে একটু দেখা দিয়ে আসি চল।’

কথাটায় যেন গা আরও ঘিনঘিন করে উঠলো আমার। মুখরকে মুখের উপর না বলে কি করে আব্বা আবার তার বাসায় যাওয়ার কথা বলতে পারে? রাগে পিত্তি জ্বলে উঠলেও আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখরের মুখোমুখি আমি কিছুতেই হতে পারবো না। ছেলেটাকে আমি গত ক’দিন খুব বেশি উপেক্ষা করেছি। আমি চেয়েছি সে যাতে আমায় ঘৃণা করুক। নিজ থেকেই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাক। আর এ অবস্থায় কি করে আমি তার সামনে যাই?
আব্বাকে একবার ক্ষীণ স্বরে বললাম,

‘আপনি যান, আব্বা। আমার যাওয়ার মন নেই।’

কিন্তু আব্বা বললেন,

‘আমি একা কি এখন অতো হাঁটতে পারি রে? বয়স তো কম হলো না। আর আমেনাও তোকে দেখার জন্য জোর করবে। এতো কথা না বলে আয় তো!’

.

আব্বা আর আমি মুখরদের ড্রয়িংরুমে বসে আছি। কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছি আমি। আমার পাশ ঘেঁষেই বসেছে মুগ্ধ। মুখর এখন বাসায় নেই। মনে মনে অস্বস্তিটা হালকা কমলো আমার। মুখরের সামনে আমি এখন পড়তে চাই না কিছুতেই। আন্টি আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে সামনেই বসলেন।

মিনিট খানেক কথা বলার পর আব্বা আমাদের যাওয়ার খবরটা আন্টিকে শোনালেন। আমাদের কুমিল্লা যাওয়ার খবরটা শুনেই যেন আন্টির সারা মুখ জুড়ে অন্ধকার নেমে এলো। তিনি কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,

‘হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, জহির ভাই?’

আব্বা ক্ষীণ হাসলেন। কিছুই বলছেন না তিনি। আন্টির দিকে তাকিয়ে আমার মনটাও কেন যেন ছোট হয়ে গেল। আন্টি খানিক নিরবতা রেখে হুট করে বলে উঠলো,

‘আমার ছেলেটার জন্যই এমন করছেন আপনি তাই না? আমার ছেলেটা তিথিয়া মা’কে বিয়ে করতে চেয়েছে তাই?’

আন্টির কথায় আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। আব্বাও কিছুটা থতমত খেল যেন। আন্টি আহত চোখে চেয়ে আছেন আব্বার দিকে। আব্বাও আন্টির চাহনিতে আমতা আমতা করতে লাগলো। সত্যি তো এটাই। আব্বা মুখরের কাছ থেকে আমায় আলাদা করতে চাইছে বলেই আমায় অন্য কারো সংসারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। একথা সরাসরি আন্টিকে বলতেও পারছে না আব্বা। আমতা আমতা করতেই করতেই আব্বা চুপ হয়ে গেল। আন্টিকে বলার মতো ভাষা তার নেই। আন্টি এবার শান্ত হয়ে বললেন,

‘আপনি কেন আমার ছেলেকে মেনে নিচ্ছেন না জহির ভাই? সে আমার ছেলে বলে?’

আব্বা হঠাৎ ঘামতে শুরু করলেন। আন্টিকে ধমকে বললেন,

‘আমেনা!’

আন্টি আমার দিকে আড়চোখে একবার দেখলেন। আন্টির কথাটা আমার সন্দেহজনক মনে হলো। কেননা আমি যতবারই আব্বাকে মুখরের কথা বলেছি ঠিক ততবারই আব্বা আমায় এ কথা বলেছেন,

‘আমেনার ছেলেকে আমি কিছুতেই মেনে নেবো না!’

মন মাঝে বিড়বিড় করলাম, নিশ্চয়ই আন্টির সাথে আব্বার আগে কোনো না কোনো ঝামেলা হয়েছে। তার জের ধরেই আব্বা মুখরকে আমার স্বামী হিসেবে মানতে পারছেন না।
আমার ভাবনার মাঝপথেই মুখর দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। তার আসাতে আমরা সবাই তার দিকে ফিরি। সে ড্রয়িংরুমে আমাদের দেখে অনেকটাই অবাক হয়। তার চোখ জুড়ে বিস্ময়ের ছাপ। সে চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখ নামিয়ে ফেলি। ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে আমার ভেতর! যেন আমি খুব বড় কোনো ভুল করে ফেলেছি! মুখর আমার কাছ থেকে চোখ সরিয়েছে কিনা তা দেখতেই আমি আড়চোখে একবার তাকালাম তার দিকে। সে এখনো আমার দিকেই চেয়ে আছে। এতে আমাদের দুজনের মাঝে চোখাচোখি হয়ে যায়। আমি আবারো চোখ নামিয়ে চোরের মতো এদিক সেদিক তাকাতে থাকি। আব্বা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে রাগত্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠে,

‘চল, তিথি! আর বসার দরকার নেই এখানে। আমেনা, তোর সাথে আর কখনো দেখা হবে না আশা করি। ভালো থাকিস!’

আন্টি জর্জরিত চোখে চেয়ে আছে আমাদের দিকেই। আমি মেঝেতে তাকিয়েই আব্বার পিছু নিলাম। তখনি দেখলাম মুখর পথ আটকে দাঁড়ায়। এলোমেলো চোখ আব্বাকে জিজ্ঞেস করে সে,

‘আর দেখা হবে না মানে? আঙ্কেল আপনি কি বলছেন এসব? কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?’

আব্বা রাগ নিয়ে মুখরকে বলে,

‘পথা ছাড়ো, মুখর। যা জিজ্ঞেস করার তোমার মা’কে করো। যেতে দাও আমাদের। অনেক কাজ পড়ে আছে।’

মুখর একটাবার আমার দিকে তাকালো। কি মনে করে যেন সে দরজাটা আটকে দিলো। আব্বা ধমক দিয়ে বললেন,

‘কি ব্যাপার? কি হচ্ছে এসব?’

আব্বার ধমকে আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। আব্বা এবার আন্টির দিকে চেয়ে আন্টিকেও ধমকালেন,

‘আমেনা, তোর ছেলেকে এসব ফাজলামো বন্ধ করতে বল। কি করছে টা কি ছেলেটা?’

মুখর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কি যেন বললো। আন্টিও দেখলাম তার ছেলের কথায় সায় দিলেন নীরবে। যেন কিছু করার অনুমতি দিলেন। ঠিক তখনি মুখর আমার হাতটা খপ করে ধরে তার পাশে এনে দাঁড় করায় আমায়। তার এই কান্ডে চোখ ছানাবড়া আমার। বিস্মিত চোখে চেয়ে আছি আমি তার দিকে। এদিকে আব্বা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন তৎক্ষণাৎ। মুখরকে চিৎকার করে বলে উঠেন,

‘এসব কি অসভ্যতামো চলছে, মুখর? তিথিয়াকে এক্ষুণি আমার কাছে দাও। দাও বলছি।’

মুখর আমার বাহুটা আলতো করে চেপে বেশ শান্তভাবে বললো,

‘অনেকদিন তো হলো মিস.তিথিয়াকে আপনার কাছে রেখেছেন। এবার না হয় এই মুখরের কাছেই থাকতে দিন।’

আব্বার রাগটা এবার সীমা ছাড়িয়েছে। মুখরের কথাটা শুনে আমার কানটা হঠাৎ গরম হয়ে উঠলো। আমি ভীতসন্ত্রস্ত চোখে আব্বার দিকে তাকালাম। দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বললেন তিনি,

‘বাড়াবাড়ি কোরো না, মুখর।’

মুখর হঠাৎ তার সুর পরিবর্তন করে ভয়ংকর হয়ে উঠলো। চোয়াল শক্ত রেখে গম্ভীর গলায় বললো,

‘বাড়াবাড়ির এখনো কি দেখলেন আপনি? একটা যুবতী মেয়েকে এভাবে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকে রাখতে লজ্জা লাগলো না আপনার?’

‘আমার মেয়েকে আমি আটকে রেখেছি তাতে নিশ্চয়ই তোমার অনুমতি নিতে হবে না আমায়!’

‘মুরব্বী বলে এতোদিন সম্মান দেখিয়েছি বলে ভাববেন না ভবিষ্যতেও এমন সম্মান দেখাবো। পিতৃত্বের নাম করে যা তা করছেন আর আমি এসব ছাড় দিয়ে দেবো ভেবেছেন? সব সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছেন আপনি মি.জহির!’

পরিস্থিতিটা যত আগাচ্ছে আরো জটিল হয়ে উঠছে যেন। এদিকে আব্বা আর মুখরের ঝগড়া দেখে আমার প্রাণ প্রায় যায়-যায় অবস্থা! পরিস্থিতি বেসামাল দেখে আর বসে থাকতে পারলেন না আন্টি। মুখরের সামনে এসে তাকে বহুকষ্টে থামায় আন্টি। এরপর আব্বার দিকে এগিয়ে বলতে লাগলেন,

‘জহির ভাই, আপনি বসুন। মাথা ঠান্ডা করুন। এরপর সবটা ভেবে দেখবেন না হয়।’

আব্বা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো একেবারে। অতিরিক্ত রাগে তিনি লালবর্ণ ধারণ করেছেন। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন বারবার। আব্বাকে দেখেই আমার মনের মাঝে কেমন যেন ভয় ঢুকে গেল। কেননা কিছুদিন আগেই আব্বা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। চিৎকার করে তিনি আন্টিকে বললেন,

‘কি ভেবে দেখবো, আমেনা? তোর ছেলে এসব কি শুরু করেছে? আমার মেয়েটাকে এভাবে নিজের কাছে বন্দী করে রেখে আমার সাথে এ কেমন বেয়াদবি তার? কিছু বল তুই তোর ছেলেকে!’

আন্টি খুব কষ্টে আব্বাকে সোফায় বসিয়ে শান্ত করলেন। প্রায় মিনিটখানেক পর আব্বা শান্ত হওয়ায় মুখর আমাকে টেনে ডাইনিং টেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে আমার বাহু ধরে বললো,

‘আপনার ফোন এতোদিন বন্ধ ছিলো কেন, মিস.তিথিয়া? আপনার আব্বা আবার ঝামেলা করেছে আপনার সাথে? আর কোথায় যাওয়ার কথা বলছিলেন তখন তিনি?’

মুখরের প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। মুখরকে অনেকদিন পর দেখে আমার মনটা কেঁদে উঠলো। আমি নিচু হয়ে মেঝেতে তাকিয়ে বললাম,

‘আব্বা আমায় বিয়ে করিয়ে কুমিল্লায় চলে যেতে চান।’

মুখর আমার বাহু থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মানে?’

আমি অপরাধী চোখে একবার মুখরের দিকে তাকালাম। তারপর বললাম,

‘আমরা কুমিল্লায় চলে যাবো একেবারের জন্য।’

মুখর হঠাৎ করেই কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। তার চোখমুখে কেমন একটা কষ্ট কষ্ট ভাব। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম তার চোখ দুটো ছলছল করছে। আমি আর তার সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। মুখরের এই মুখশ্রী আমি সইতে পারছি না। পেছন ফিরে পালাতে গেলাম আমি। তখনই মুখর আমার হাতটা ধরে বলে উঠলো,

‘যাবেন না, মিস.তিথিয়া! আমাকে ছেড়ে যাবেন না আপনি। প্লিজ যাবেন না। আমি আপনাকে ভীষণ রকমের ভালোবাসি! আমায় এভাবে ফেলে চলে গেলে খুব অন্যায় হবে। খুব!’

(চলবে)

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩৮
#তাশরিন_মোহেরা

‘যাবেন না, মিস.তিথিয়া! আমাকে ছেড়ে যাবেন না আপনি। প্লিজ যাবেন না। আমি আপনাকে ভীষণ রকমের ভালোবাসি! আমায় এভাবে ফেলে চলে গেলে খুব অন্যায় হবে। খুব!’

মুখরের আধভেঁজা বেদনাময় কণ্ঠে কথাগুলো কেমন যেন করে ঠেকলো আমার কানজোড়ায়। বুকটা ধুকপুক করতে করতেই যেন হুট করে থেমে গেল। সবকিছু উপেক্ষা করে চারিদিকে ধ্বনিত হতে লাগলো একটাই বাক্য, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’। ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’ কথাটা শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাক্যটা দেখতে যত ছোট হোক না কেন, এর মাহাত্ম্য অনেক। অন্তত মুখরের মতো শক্ত নীতিবদ্ধ ব্যক্তিত্বের কাছে আমি এটাই আশা করি।
মুখরের সাথে আমার প্রথম দেখাটা খুবই আজব প্রকৃতির ছিল। এরপর থেকেই তার সাথে একটু আধটু খুনসুটিতেই কেটে গেল অনেকটা মাস। আমি গম্ভীরমুখো মহৎ ব্যক্তিত্বের এই ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলাম, যে কিনা মুচকি হাসাতেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আমায় ভয় দেখাতো। তাকে ভালোবাসাটা কেমন অজান্তেই হয়েছে আমার! ভালোবাসাটাকে ভালোলাগা বলে ক’বার যে ভুল করেছি! ক’বার এই ভালোবাসাটাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে রাস্তায় অন্য ছেলের দিকে হা করে মিনিটখানেক চেয়ে থেকেছি। তবে চোখ যে আমার বারংবার এক মানুষকে দেখতেই অভ্যস্ত! এই চোখ কি আর অন্য কোনো পুরুষের রূপে মোহাবিষ্ট হতে পারে? এই মন কি আর অন্য কারো দিকে আকৃষ্ট হতে পারে?

তবে এই গম্ভীরমুখো ছেলেটা এখন বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তার গাম্ভীর্যের চোয়ালটা ভেঙে ধীরে ধীরে এখন হাসিমুখে পরিণত হয়েছে। অন্যদের কাছে ছেলেটা এখন তার অনুভূতিদের প্রকাশ করতে পারে। প্রাণখুলে হেসেখেলে চারদিক মাতাতে পারে এই মুখর! তাই তার আমাকে ভালোবাসার কথাটা হুট করে বলে ফেলাতে আমি ভীষণ চমকে গেছি। তাকে ভালোবেসেছি আমি বহু আগে, তবে ভালোবাসার কথাটা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি। ‘ভালোবাসি’ এই ছোট্ট কথাটা যেন মুহুর্তেই আমার জন্য খুব কঠিন কিছু হয়ে গেল। আর এই ছেলেটা কিনা এই কথাটাই আমায় কথাচ্ছলে বলে দিল? আমার প্রতি তার এই ভালোবাসাটা হলো কি করে? কবেই বা আমি তাকে নিজের প্রেমে ডুবিয়ে দিলাম। আব্বা যখন বলেছে মুখর আমায় বিয়ে করতে চায়, আমি সে রাত সারাক্ষণ চিন্তা করেছি। জানতে চেয়েছি মুখর আমায় কেন ভালোবাসলো? কিন্তু এর উত্তর আমি বের করতে পারিনি! যে মানুষটা আমায় ভালোবেসেছে তার কাছেই এর উত্তম উত্তর থাকা উচিৎ তাই না?

কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর জানার মতো পরিস্থিতিতে আমি এখন নেই। যা হওয়ার কথা ছিল তা এখন হচ্ছে না! বরং যার ভয়টাই আমি পেয়েছি তা-ই হচ্ছে! তাই এ মুহুর্তে মুখরের বেদনামাখা মুখশ্রী আমি দেখতে পারবো না! কিছুতেই পারবো না। বুকের উপর কি যেন দেবে আছে মনে হলো আমার! দেবে থাকা এই অদৃশ্য কিছুই আমায় ক্ষণে ক্ষণে দূর্বল করে ফেলছে। মনটা কেঁদে বলছে, ‘যা তিথি! মুখরের কাছে যা। তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনের সব ব্যাথাদের নিস্তার দে!’
কিন্তু আমার পা দুটো অবশ হয়ে আছে। মুখরের কাছে আমি যেতে পারবো না। পরিস্থিতিটা এখন এসবের নয়! আমি একটুও পিছু ফিরলাম না। মুখরের কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। যা হবার হবে, কিন্তু আমার এই পোড়া কপালের সাথে মুখরকে কিছুতেই সংযুক্ত করতে পারবো না আমি! সে থাকুক তার মতোই! সমউ সবটা ঠিক করে দেবে।
একঝাঁক পিছুটান ফেলে চুপচাপ এগিয়ে গেলাম ড্রয়িংরুমের দিকে। তবে পর্দার আড়াল হতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথোপকথন তখনই আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিলো। আন্টি আর আব্বা বসে কথা বলছেন সেথায়। আন্টি আব্বার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘অতীতকে মনে চেপে কেন আপনি আপনার বর্তমান আর ভবিষ্যৎটা নষ্ট করছেন, জহির ভাই?’

আব্বার রাগটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। তিনি অস্বাভাবিক রকমের শান্ত হয়ে আছেন। আন্টির কথায় তিনি কিছুই বলছেন না। উত্তর না পেয়ে আন্টিও আব্বাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,

‘আমাদের মাঝে অতীতে যা হয়েছে তা থেকে সরে আসুন, জহির ভাই। আপনি আপনার ফুটফুটে মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করছেন! তিথিয়া যাকে মন থেকে মানছে না তার কাঁধে সারাটাজীবন ঝুলে থাকাটা তিথিয়ার জন্য অন্যায় হবে। আর এই বিষয়টা আপনি ছাড়া ভালো আর কে বুঝবে, বলুন তো!’

আব্বা কেমন যেন চটলেন। বিরক্তি নিয়ে বললেন,

‘আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তোর এসব ভাবা উচিৎ ছিল, আমেনা। আমার মনে হয় না আমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি! তাই এতো বছর পর অতীতটাকে আর টেনে আনিস না।’

তাদের কথোপকথন ভীষণ অগোছালো ঠেকলো আমার কাছে। ভ্রু কুঁচকে বেশ খানিকক্ষণ ভাবলাম। কিন্তু নাহ! বিষয়টা আরো গভীরভাবে ভাবা দরকার। এমন সময় পেছন হতে কেউ গলা খাকারি দিলো। আমি শিউরে উঠলাম হঠাৎ। পেছনে তাকিয়ে দেখি মুখর হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো সে,

‘এখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? যান, আপনার আব্বার সাথে কুমিল্লায় চলে যান। বিয়ের করার তো খুব শখ জন্মেছে!’

এটুকু বলে সে অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে পাশে তাকিয়ে রইলো। তার চোখমুখ জুড়ে কেমন একটা কোমল ভাব। আমার কেন যেন মায়া হলো। কিন্তু এখনের কথোপকথনটা একদমই মিস করা যাবে না। তাই মুখরকে ইশারায় চুপ হতে বলে ফিসফিস করলাম,

‘থামুন, জরুরি কিছু শুনছি!’

সেও আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকলো। আমার হাবভাবটা তার মাথায় ঠেকছে না। আমি তার হাত ধরে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে বোঝালাম পর্দার আড়ালে যা হচ্ছে তা শুনতে। আমি আবারো মনোযোগ দিলাম তাতে। আব্বা হঠাৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। রাগটা আবার চড়াও হয়েছে তার মাথায়। গলাটাও কেমন কাঁপা কাঁপা। চরম রাগ তিনি আন্টিকে বলছেন,

‘তোর সাথে জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়েছি আমি। উঠতি বয়সে তোর প্রেমেও পড়ে গিয়েছিলাম। প্রায় পাঁচটা বছর তোকে গোপনে ভালোবেসেছি। কিন্তু ভালোবাসার কথাটা যখন তোকে প্রকাশ করলাম তুই আমায় প্রত্যাখ্যান করলি। আর ক’দিন পর বিয়ে করলি আমারই কাছের বন্ধু হাসিবকে। আমি কি করে মেনে নিতাম বল! নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি! ভালোবেসেছি বলে তোকেও দোষারোপ করতে পারিনি। এর বাইরে তুই আমার কাছ থেকে কি আশা রাখিস? তোর ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়েটা কি করে মেনে নেবো?’

আন্টি হু হু কেঁদে উঠলেন। এদিকে আমার ঠোঁট জোড়া আপনাআপনিই একে অপর থেকে আলাদা হয়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে মুখরের দিকে চাইতেই দেখলাম তার মুখাভঙ্গিও একই! আমরা দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে রইলাম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে! আন্টির কান্না দেখে আব্বার মনটা বোধহয় কিছুটা গললো। তবে অভিমানটা গেল না। অভিমানী সুরে তিনি বলছেন,

‘ভালোবাসাটা আমার জীবনে কখনো ঠাঁই পায়নি। তোকে হারানোর বেশ কয়েকটা বছর আমি সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে যাই। কোনোকিছুতেই নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারছিলাম না। কষ্টে মনটা অসাড় হয়ে গিয়েছিলো। আর তুই তখন নতুন স্বামী, সংসার নিয়ে মজে ছিলি! আমার কথা কি একবারও মনে পড়েনি তোর, আমেনা? আমায় এভাবে নিঃশব্দে প্রত্যাখ্যান করে কি করে এতো খুশি থাকতে পারলি তুই?’

আন্টি তার কান্না থামিয়ে বলে উঠলেন,

‘আমি কখনোই আপনাকে প্রত্যাখ্যান করিনি, জহির ভাই! আমি তো আপনাকে নিজের ভাই ছাড়া অন্য কোনো চোখে কখনো দেখতেই পারিনি। তাই আমাকে দেওয়া আপনার প্রেমের প্রস্তাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম আমি। আমি চাইনি ভালোবাসা নামক বিষয়টা এভাবে আমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে চলে আসুক। আর হাসিবকে আমি প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। যার কারণে তার সাথে থাকার লোভটা সংবরণ কর‍তে পারিনি আমি। আমায় ক্ষমা করে দেবেন, জহির ভাই! ক্ষমা করে দেবেন।’

আন্টিকে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে মুখর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সে কথোপকথনটা সেখানেই থামাতে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। এতো বছর পর দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির প্রলেপটা দূর্বল হতে চলেছে। এর মাঝে কারোরই হস্তক্ষেপ করা উচিৎ নয়। আমি তাকে ইশারায় শান্ত হতে বললাম। আব্বার ভীতটাও এবার নড়বড়ে হলো। তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন সোফায়। মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনায় লিপ্ত হলেন। আন্টিও নাক টেনে কাঁদছেন। আব্বা একবুক কষ্ট নিয়ে বললেন,

‘তোর পর তিথির মা’কেই আমি মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম। সেও কারো প্রেমের কাঙাল হয়ে আমায় বাধ্যগত ভাবে বিয়েটা করেছিল। তাই আমরা একে অপরকে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিলাম। তবে আমার অতিরিক্ত ভালোবাসাটাই তাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আর আমি কিনা বারংবার মেয়েটাকেই দোষারোপ করেছি!’

আন্টি কান্নাটা থামিয়ে হঠাৎ দৃঢ় হয়ে উঠলেন। বললেন,

‘জহির ভাই, আপনি কি তবে চান যে আপনার মেয়েটাও এভাবে আপনারই মতো করে আজীবন ধুকে ধুকে মরুক?’

আব্বা কেমন যেন ছটফট করতে লাগলো। আন্টি এই সুযোগে আরো বললেন,

‘ফুটফুটে মেয়েটা ক’দিনেই কেমন শুকিয়ে মলিন হয়ে গেছে। মেয়েটার চেহারায় বেদনার ভাব স্পষ্ট, জহির ভাই। আপনি বাবা হয়ে কিছুতেই মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারেন না।’

আব্বা মাথাটা চেপে ধরলো শক্ত হাতে। ঘামতে শুরু করলো তৎক্ষণাৎ। শ্বাস নেওয়াটাও বাড়লো ভীষণ। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দৌঁড়ে পর্দার আড়াল হতে আব্বার কাছে ছুটে যাই। আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ছলছল দৃষ্টিতে। আমার মুখটা আলতো হাতে স্পর্শ করে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। আমি এতে ভীষণ চমকে উঠি। ভয়ে সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো আমার। কিছুদিন আগের ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না তো! জলদি মুখরের সাহায্য আব্বাকে আবারো হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো!

(চলবে)