অধ্যায়টা তুমিময় পর্ব-১১+১২

0
0

#অধ্যায়টা_তুমিময়
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১১+১২

সময়ের চাকা ঘুরতে শুরু করলে তাঁকে আটকাবে কার সাধ্যি আছে। দায়িত্ব দেখে পিছিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো যখন দায়িত্ব নিতে শিখে যায়! তখন একজন দায়িত্ববান মানুষের থেকেও তাঁরা ভালো দায়িত্ব পালন করতে জানে। তাঁরা নিজেদের দায়িত্ব তখন জোর করে নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেয়। অবসর সময়ে পরিবারের প্রতিটা মানুষের কথা চিন্তা করে মগ্ন থাকে। কার কিসে ভালো হবে কিসে খারাপ, সেই একটা চিন্তাই তাঁদের মাথায় ঘুরে। যেমন-টা মেঘ। সে শিখে গেছে দায়িত্ব নেওয়া। তাই তো পরিবারের সব থেকে দায়িত্ববান মানুষটা যখন ভুল করছিলো। তাঁকে কড়া কথা, মিষ্টি কথা, বুঝিয়ে ভালোবেসে সঠিক পথে এনে দাঁড় করিয়েছে মেঘ। কিছুদিন আগেও স্ত্রীকে নিয়ে যাঁর হাজারটা অভিযোগ আজ তাঁকে নিয়েই তাঁর হাজার চিন্তা। প্রেগন্যান্সির সময় কি খাবে, কি করবে, কি করাবে সব যেন তাঁর একার টেনশন। অবশ্য সবার ভালোই লাগে এসব দেখতে। সময় বিকাল পাঁচটা বেজে চৌত্রিশ মিনিট। একে একে সবাই ফিরে এসেছে নিজের কর্মস্থল থেকে। কেউ ফ্রেশ হয়ে চা কফি খেতে ব্যস্ত তো কেউ ফ্রেশ হতে। কেউ ফিরেই হাত পা ছড়িয়ে সোফায় শুয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে টুং-টুং আওয়াজ। এই আওয়াজ করাটাও একটা আর্ট, যা সবাই পারে না। ক্যালেন্ডারের পাতাটা জুন শেষে জুলাইতে গিয়ে ঠেকেছে। মাসের প্রথম বেতন পেয়েই সবার জন্য কিছু না কিছু কিনে বাড়িতে পা রাখলো মেঘ। ক্লান্ত মুখখানা বড্ড বেসামাল হয়ে আছে। দায়িত্ব নেওয়া যতটা সহজ, পালন করা ঠিক ততোটাই কঠিন। বাড়িতে পা রেখেই সবাইকে কাছে ডাকলো মেঘ। মোটামুটি সবাই বাড়িতে, শুধু রূপ, আর পলাশ বাকি। সবাই ড্রইংরুমে আসতেই তুলে দেওয়া হলো সবার হাতে গিফট। প্রতিটা মানুষের আনন্দ যেন আকাশ সমান। হাতের একটি খাম নিয়ে এগিয়ে গেলো আলতাফ হোসেনের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো তাঁর সামনে। হাঁটুতে ভর দিয়ে আলতাফ হোসেনকে জড়িয়ে ধরলো মেঘ। হাতের খামটা এগিয়ে দিয়ে বললো।

_ আমার জীবনের প্রথম বেতন এই খামে দেওয়া হয়েছে। সামনের মাস থেকে অবশ্য ফোনেই আসবে। একাউন্ট খোলা নিয়ে কিছু সমস্যার জন্য এই মাসে ফোনে টাকা আসবে না বলে জানিয়েছিলো। আজ হাতেই বেতনটা দিয়ে দিয়েছে। কিছুটা আমি খরচ করেছি সবার জন্য। বাকিটা তোমায় দিলাম। আমি চাই এই টাকাটা নিয়ে তুমি বাজারে যা-ও। নিজের পছন্দ মতো বাজার করে মুখে তৃপ্তি নিয়ে বাড়িতে ফেরো। আর কিছু চাই না ছোট বাবা বিশ্বাস।

আলতাফ হোসেনের চোখটা ভিজে এলো। নিজের অজান্তে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই চশমাটা ঘোলাটে হয়ে এলো। খুশিতে চেয়েও কিছু বলতে পারলেন না। অতিরিক্ত খুশির জন্য মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না। ছোটবেলা থেকে সব কিছুতেই উদাস থাকা ছেলেটাও দায়িত্ব নেওয়া শিখে গেছে। এটা ভাবতেই খুশিরা যেন ঘিরে ধরলো। বহু কষ্টে মেঘের মাথায় হাত রাখলেন তিনি। চোখের পানি আড়াল করে বললেন।

_ ছোট্ট ছেলেটা বড় হয়ে গেলো বুঝি।

আর কোন কথা বলতে পারলেন না তিনি। অতিরিক্ত কষ্টে যেমন মানুষের কথা হারিয়ে যায়, তেমনি অতিরিক্ত খুশিতেও হারিয়ে যায় কথা। তেমনটাই হলো আলতাফ হোসেনের। তাই তিনি ড্রইংরুম ত্যাগ করে নিজের রুমে চলে গেলেন। হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেলো ড্রইংরুমে। ততোক্ষণে রূপ, পলাশও ফিরে এসেছে । সব কিছু শুনে তাঁদেরও খুশি দেখে কে? পারলে ভাইকে নিয়ে নাচতো তাঁরা, নেহাৎ ভাইটা বড় হয়ে গেছে। সবার এই আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করা কোন লেখক বা লেখিকার কাম্য নয়। এমন হৈ-হুল্লোড়ের মাঝেই কেটে গেলো একটি বেলা। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। ফ্রেশ হয়ে সবে বসেছিল জোনাকি। চোখমুখ ঢেকে মাথাটা নিচু করে কোন চিন্তায় মগ্ন ছিলো সে। হঠাৎ কোন কাগজের খচখচ শব্দে চোখ তুলে তাকালো। মেঘ তাঁর দিকে একটি পেকেট এগিয়ে রেখেছে। জোনাকি অবাক হলো না। সবার জন্য যখন কিছু না কিছু এনেছে, তাঁর জন্য আনবে এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু সবাইকে দেওয়ার পরও যখন তাঁকে কোন প্যাকেট দেয়নি, তখন সে ভেবেছিলো হয়তো শুধু তাঁর পরিবারের জন্য এনেছে। কিন্তু এখন এটা দেখে সে বুঝলো, না তাঁর জন্যও মেঘ কিছু একটা এনেছে। নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকার মধ্যেই আবারও খচখচ শব্দ হলো। চিন্তা থেকে বেরিয়ে চোখ তুলে উপরে তাকালো। মেঘ তাঁর দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়েছে, সে না ধরায় আবারও হয়তো শব্দ করলো। মেঘের হাত থেকে সে প্যাকেটটা নিলো। প্যাকেটটা নিয়ে আলমারি দিকে এগিয়ে গেলো। প্যাকেটটা রাখতেই মেঘ বললো।

_ খুলে দেখলে না কেমন হয়েছে।

_ ভালোই হয়েছে।

_ যদি পছন্দ না হয়।

_ ভালোবেসে কেউ কিছু দিলে সেটা পছন্দ না হওয়ার কি আছে। সেটা নিজের হাজার টাকার কেনা জিনিসের থেকে দামি। কারণ সেটা কেউ ভালোবেসে উপহার দিয়েছে।

_ বাহ্, যুক্তিতর্কে তুমি বড্ড পাকা।

_ কি জানি, বুঝি কম।

_ তুমি কম বুঝলেও তোমার মনটা ভালোই বোঝে। কাকে কতটা কষ্ট দিলে সে ব্যথা পাবে, কোন ভাবে কথা বললে ভালো হবে, কিভাবে বুঝালে খুব সহজেই কেউ সবটা আয়ত্তে আনতে পারবে! এই সব তোমার মন জানে।

_ আমিও আপনার সাথে একমত। একাকিত্ব মানুষকে যেমন মানুষ থেকে অমানুষ করে দেয়, তেমনি পৃথিবীও চিনতে শেখায়। ভালো খারাপ সব কিছুর প্রার্থক্য বোঝার ক্ষমতা চলে আসে। কারণ সাত বছরটা কম সময় নয় জনাব।

আজ জোনাকির কথায় দীর্ঘশ্বাস, বা খারাপ লাগা কিছু লাগলো না মেঘের। সে জানে অন্যায় করলে তাঁর জন্য তাঁকে প্রতি পদে পদে কথা শুনতে হবে। তাই সে জোনাকির কথাটা এরিয়ে বললো।

_ একটা অনুরোধ করবো।

_ হু করুন, যদি রাখার মতো হয় তাহলে রাখবো।

_ আমার দেওয়া গিফট, সবাই সবার ইচ্ছে মতো পড়তে পারলেও তুমি পারবে না।

_ কেন আমাকে কি আলমারিতে তুলে রাখার জন্য দিয়েছেন।

_ না, আমি চাই না মনে কোন দ্বিধা রেখে আমার দেওয়া প্রথম গিফটটা তোমার শরীরে ছোঁয়াও। যদি কখনো মনে হয়, আজ ভেতরে কোন খারাপ লাগা নেই আমার জন্য সেদিন না-হয় পড়লে।

_ যদি কখনো সেই দিনটা না আসে।

_ অপেক্ষা করবো।

_ অপেক্ষা বড্ড খারাপ জনাব। না ভালো থাকতে দেয়, না ভালো রাখতে দেয়।

_ কেউ যদি শূন্য থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারে, আমার ফিরে আসার। তাহলে আমি কেন পারবো না? আমার কাছে তো তাও এক পারসেন্ট আছে, তাঁর কাছে তো তাও ছিলো না।

_ কারণ তাঁর সব থেকে প্রিয় সংখ্যা ছিলো শূন্য। তাই সেই সংখ্যা তাঁর সাথে বেঈমানী করেনি।

_ আমার সংখ্যাও আমার সাথে বেঈমানী করবে না, আমার বিশ্বাস।

_ বিশ্বাস রাখা ভালো, কিন্তু অন্ধবিশ্বাস না।

_ কখনো কখনো চেনা পথঘাটও অচেনা বানাতে হয়, আপন মানুষের হাতটা ধরার জন্য। কারণ আমি রাস্তা চিনলে তো সে আমাকে হাত ধরে রাস্তা চিনাবে না।

_ আজকাল কি প্রেম নিয়ে গবেষণা করছেন নাকি।

_ বউ যদি ভালোবাসার শিক্ষক হয়, স্বামীকে তো প্রেম নিয়ে একটু গবেষণা করতেই হয় কি বলো তুমি?

_ জানি না, লাইট অফ করছি শুয়ে পরুন।

_ আজ ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।

_ তাহলে?

_ আজ আমার সাথে রাতের শহরে হাঁটবে জোনাকি।

_ রাত অনেক হয়েছে পাগলামি ছারুন। কাল অফিস আছে তো শুয়ে পরুন।

_ মাঝে মাঝে পাগলামি না করলে জীবনের আসল মানে বের করা যায় না। চলো না, এই অন্ধকার শহরে কার কতটা দুঃখ সেটা মেপে আসি।

_ দুঃখ কি করে মাপে।

_ দীর্ঘশ্বাস গুনে।

_ পাগল হয়েছেন।

_ সে-তো অনেক আগেই হয়েছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেদিন কারো ভেজা চুল, উন্মুক্ত বুক আর পেট দেখে পুরোপুরি হয়ে গেছি।

_ তাহলে পাবনা চলে যান।

_ আমার এই পাগলামি কোন পাগলা গারদে সারবে না। জোনাকি নামের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই রমনীর মন গহীনে ঠাই পেলেই হবে।

_ লজ্জা সরমের বালাই নেই অসভ্য।

_ কিছু না করতেই এভাবে অসভ্যের তকমা লাগাবে না গায়ে, বুকে লাগবে। কিছু করার পর না-হয় চরিত্রহীনার দায়ে জেলে দিয়ো! আমি কিছু মনে করবো না। সত্যি বলছি কিচ্ছু মনে করবো না।

_ কি খারাপ আপনি।

_ হুম জানি, তো যাবে আমার সাথে রাতের শহরে হাঁটতে।

_ না।

_ আমার আজ যখন ইচ্ছে জেগেছে সেটা আমি পূরণ করেই ছারবো।

এই কথা বলেই জোনাকিকে কোন সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে নিলো। হঠাৎ শূন্যে ভাসতেই জোনাকি চোখমুখ খিঁচে নিলো। চিৎকার করে বললো।

_ এই এই, কি করেছেন। নামান বলছি একদম ভালো হবে না বলছি।

_ এতো ভালো দিয়ে কি হবে, মাঝে মাঝে একটু আধটু খারাপ হলে দোষ কোথায়।

_ আমি কিন্তু চিৎকার করবো।

_ আমি কি বারণ করেছি নাকি। চিৎকার করে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙাে। সবাই এসে দেখুক মিস্ জোনাকি মিস্টার মেঘের কোলে। পুরাই সিনেমার মতো। সবার মাঝে কিন্তু ছোট বাবা, পলাশ ভাইয়া, আলিফ, রূপও আছে। আর তোমাকে নিয়ে মজা করার জন্য নিঝুম তো আছেই। চিৎকার করো তাড়াতাড়ি।

মেঘের কথায় জোনাকি ভরকে গেলো। এখন যদি এই অবস্থায় বাড়ির লোকেরা তাঁকে দেখে ফেলে কি ভাববে তাঁরা। ছি্ লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। কি খারাপ লোক, আমাকে ফাঁদে ফেলে এখন ঢং করা হচ্ছে। আর কিছু বললো না জোনাকি। জোনাকিকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ মুচকি হাসলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সদর দরজা খুলে তাঁরা বাহিরে বেরিয়ে এলো। বাহিরে বের হতেই জোনাকি ছোটাছুটি করলো। বারবার বললো নামিয়ে দিতে। অগ্যত মেঘ কিছু উপায় না পেয়ে জোনাকিকে নামিয়ে দিলো। পুরো পাড়া শুনশান নীরবতা। দুই একটা কুকুর মাঝে মাঝেই ঘেউঘেউ করে উঠছে। লেইম পোস্টের হলদে আলোয় রাতের কাল আঁধার কিছুটা হলদে লাগছে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় চলে এলো। গাড়ির কোন শব্দ নেই। হয়তো এখন মাঝরাত তাই। তবুও কিছুক্ষণ পর পর শাঁই শাঁই করে ছুটে চলছে মালবাহী ট্রাকগুলো। দশমিনিট পনেরো মিনিট পর পর সেই ট্রাকগুলো দেখা যাচ্ছে। বাকিটা সময় পুরো রাস্তা ফাঁকা। রাতের শহরে হাঁটলে একটু অন্য রকম অনুভূতি হয়। যে কখনো রাতের শহরে হাঁটেনি সে কখনো বুঝবে না, সেই অনুভূতি কেমন। অনেকটা পথ অতিক্রম করে, নিরবতা ভেঙে মেঘ বললো।

_ আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই রাতের শহরে হাঁটতে বের হতাম। কখনো একা,কখনো বন্ধু বা রূপকে নিয়ে। জানো জোনাকি যখন আমি আমেরিকা ছিলাম, বাংলাদেশের অনেক অভ্যস সেখানে গিয়ে আমি চেঞ্জ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এই রাতের শহর দেখা কখনো চেঞ্জ করতে পারিনি। বহুদিন রাতের শহর একা একা হেঁটেছি। কথা বলেছি তাঁদের সাথে।

_ কথা কি করে বলেছেন।

_ রাতের শহর কথা বলতে পারে তুমি জানো না?

_ ভারি অদ্ভুত কথা বলছেন তো আপনি। শহর কি করে কথা বলে। আর শহর কেন গ্রামও কথা বলতে পারে না।

_ এই বিষয়ে আমি তোমার বিরোধিতা করলাম।

_ মানে।

_ সারাদিনের এই ব্যস্ত শহরটা রাতের আঁধারে কেমন নিরব হয়ে যায়। তখন তাঁদের কত কষ্ট হয় জানো। তাঁরা আমার সাথে তাঁদের কষ্ট শেয়ার করতো। আমি শুনতাম, মাঝে মাঝে উত্তরও দিতাম। কবিতা পড়ে শোনাতাম। ওরা তখন নিরবতা ভেঙে আমার কবিতার প্রসংশা করতো। একটি কবিতা শুনবে জোনাকি?

_ উঁহু, আপনার ওই ভাঙা রেকর্ডে কবিতা শোনাতে হবে না।

_ আমি খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে পারি, ওরা আমায় বলেছে।

_ কারা?

_ রাতের শহর।

_ আচ্ছা তো শোনান, না শুনলে তো বকবক করেই যাবেন। ছেলেদের এতো বকবক করতে আমি আগে কখনো দেখিনি।

অনুমতি পেয়ে মেঘ বসে পড়লো পিচঢালা রাস্তায়। জোনাকি দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ দুটো বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথের চিরপরিচিত সেই কবিতাটা শুরু করলো মেঘ।

_ প্রহর শেষের আলোর পথে, সেদিন চৈত্র মাস।
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।
এই সংসারের নিত্য খেলায়, বাটে-খাটে হাজার লোকের হাস্য পরিহাস।
মাঝখানে তাঁর তোমার চোখে আমার সর্বনাস।
আমের বনে দোলা লাগে, মুকুল পরে ঝরে। চিরকালের চেনা গন্ধ হাওয়ায় ওঠে ভ—–

বাকিটা পড়ে শোনাতে পারলো না মেঘ, খুব জোরেই ছুটে গেলো একটি মালবাহী ট্রাক। ট্রাকের তিব্র বাতাসে নিজের মনোযোগ সরে গেলো মেঘের। মনে মনে দু’চার গালি দিয়ে সামনে তাকালো মেঘ। হঠাৎই তাঁর চোখটা আঁটকে গেলো জোনাকির উপর। পিচঢালা রাস্তায় জোনাকির নিথর শরীরটা অবশ হয়ে পরে আছে। একটু পর পর ঝাঁকি দিয়ে উঠছে জোনাকির শরীর। নাক মুখ থেকে ছুটতে রইলো তিরতির করে রক্ত। হাত-পা ভিষণ ভাবে কাঁপতে রইলো। কাঁপতে কাঁপতে সেই হাত স্থীর হতে শুরু করতেই জোনাকি বলে চিৎকার করে উঠলো মেঘ। দৌড়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরলো জোনাকির সামনে। জোনাকির হাত তখনো হাল্কা কাঁপছে। পুরোপুরি স্থীর হওয়ার আগেই জোনাকির মাথাটা নিজের হাঁটুর উপর রাখলো। জোনাকির চোখটা স্থীর হয়ে মেঘের পানে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ থেকে, খুব কষ্টে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো মেঘের হাঁটুতে। মেঘ বুকে জড়িয়ে নিলো জোনাকিকে।

_ জোনাকি, জোনাকি প্লিজ কথা বলো। কি হয়েছে তোমার, কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বলো। এই এই কিছু হবে না তোমার কিচ্ছু হবে না। জোনাকি ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন, আমি মেঘ। তোমার মেঘ দেখো। দেখো আমি, আমি।

জোনাকি বলেই শহর কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো মেঘ। ততোক্ষণে জোনাকি স্থীর হয়ে মেঘের বুকে লুটিয়ে আছে।

পর্ব ১২

হাসপাতালের ছোট্ট ঘর গুলো বড় আপন হয়! যখন প্রিয় মানুষগুলো বেডে শুয়ে কাতরাতে থাকে। ফিনাইলের গন্ধটাও নাকে সয়ে যায়, যখন আপন মানুষটার কষ্ট ভরা মুখটা সামনে ভাসে। যে কারো মৃত্যু সংবাদে বুক কাপে, যখন কাছের মানুষটা মৃত্যু দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘড়ির কাঁটা যেন তখন এক জায়গায় আঁটকে থাকে। দিন যেন ফুরিয়ে যেতে ভুলে যায়। রাতের আঁধার যেন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সেই জানে হাসপাতালের করিডরে বসে অপেক্ষা করা কতটা কষ্টের, যে অপেক্ষা করে। আপন মানুষটা যখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তখন বুঝতে পারি মানুষটা হৃদয়ে কতটা গভীরে লুকিয়ে আছে। অপারেশন থিয়েটারের দরজায় জ্বলতে থাকা লাল বাতির দিকে নজর মেঘের। কখন কেউ বেরিয়ে আসবে! কখন কেউ বলবে চিন্তা নেই সব ঠিক আছে, তারই অপেক্ষায়। টিশার্টটা রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। চোখেমুখে বিষন্নতা ঘেরা। এলোমেলো হয়ে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে মেঘ। পাশে কেউ নেই যাকে জড়িয়ে কাঁদবে মেঘ। কিছু অচেনা মানুষের সাহায্য নিয়ে জোনাকিকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে সে। হাসপাতালের সব ফর্মালিটি পূরণ করতেই জোনাকিকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। রিসিপশন ডেস্ক থেকে বাড়িতে ফোন দিয়ে সবটা জানানো হয়েছে। যখন মেঘ ফোন করলো, তখন কিছুই বলতে পারেনি। সব কথা আঁটকে এসেছে গলায়। শুধু বলেছিলো। ভাইয়া আমার জোনাকি। আর কিছু বলতে পারেনি, ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছে। রিসিপশনের মেয়েটা সবটা বুঝতে পেরে মেঘের থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। কিছুটা আন্দাজ করে সবটা বলে। ওপাশের মানুষটা হন্তদন্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিলো। মেয়েটি বুঝতে পারলো তাঁরা আসছে। তারপর কেটে গেছে প্রায় আধাঘন্টা। এখনো মেঘ অপারেশন থিয়েটারের সামনেই বসে আছে। মেঘের ঠোঁট কেটে গেছে। হাতেরও কিছু অংশ ছিলে গেছে। তবুও তাঁর কোন ভাবান্তর নেই। শরীরের যন্ত্রণার থেকেও তাঁর হৃদয়ের যন্ত্রণাটা বেশি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ তাঁর কলিজায় ছুরি চালিয়েছে। কেউ খুব জঘন্য ভাবে তাঁর হৃদয়টাকে টুকরো টুকরো করছে। সেই যন্ত্রণাটা সয্য করা মেঘের কাম্য নয়। দৌড় পায়ে হেঁটে এলেন আলতাফ হোসেন, পলাশ, রূপ, আলিফ, প্রিয়া, মনি, শাপলা। আলতাফ হোসেন এগিয়ে এসেই মেঘ বলে ডাক দিলেন।

_ মেঘ বাবা।

আলতাফ হোসেনের ডাক শুনে চোখ তুলে সামনে তাকালো মেঘ। চোখদুটো জলে টুইটুম্বুর। ছোট বাবাকে দেখে মেঘ দৌড়ে এলো। রক্ত মাখা শরীরটা বিছিয়ে দিলো তাঁর বুকে।

_ ছোট বাবা আমার জোনাকি। আমার জোনাকি কথা বলছে না। ওকে বলো না কথা বলতে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি কথা বলার, ও কোন কথাই বললো না। ছোট বাবা ওর না হাত কাপছিলো। শীতের সময়ে ঠান্ডার মতো করে। ওর চোখটা স্থির হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ও আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু বলতে পারেনি। ওর শরীর থেকে দেখো কত রক্ত ঝড়ে পড়েছে দেখো দেখো।

মেঘ এই কথা বলেই নিজের শরীরের দিকে ইশারা করলো। সবার চোখেই পানি চিকচিক করছে। এই মুহূর্তে মেঘের সামনে কেঁদে দেওয়া ঠিক হবে না। এমনই নিজের অবস্থা ভালো না। একদম ভেঙে পড়েছে, বাড়ির সবাইকে কাঁদতে দেখলে আরো ভেঙে পরবে। সবাই নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখলো মেঘের সামনে। পলাশ এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত দিতেই, ভাইকে জড়িয়ে আবারও কাঁদতে রইলো মেঘ।

_ জানিস ভাই ও আসতে চায়নি, আমিই জোর করে নিয়ে বের হলাম। আমার জন্য আজ ওর এই অবস্থা। আমি দায়ী, এই তোরা পুলিশে ফোন কর আমাকে ধরিয়ে দে। বলবি প্রতারনা করেছি, সাথে মেরে ফেলার প্ল্যান। আরে করনা ফোন কর।

আর কথা বলতে পারলো না, ভাইয়ের বুকেই ঢলে পড়লো। জ্ঞান হারায়নি, কিন্তু ভেতরে শক্তি হারিয়ে ফেললো। অসুস্থ হয়ে পড়লো মেঘ। এভাবে মেঘের ভেঙে যাওয়া দেখে সবাই যেন অস্থির হয়ে উঠলো। মেঘকে তুলে একটি চেয়ারে বসালো। তিন ভাই মিলে ওকে সামলানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু যাঁর প্রিয়তমা মৃত্যুর দুয়ারে, সে কি শান্ত থাকে। অশান্ত হৃদয়টা বারবার মোচড় দিয়ে ওঠে।

শাপলা বিভিন্ন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিজেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেলো। যেহেতু সে ডাক্তার তাই তাঁর বেশি অসুবিধা হলো না। কিন্তু তাঁকে অনেক চেষ্টা করতে হয়েছে, যেহেতু সে এই হাসপাতালের আন্ডারে নেই। তবুও তাঁর চেষ্টা বিফলে যায়নি। আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলে আলিফ আর রূপ সেই এক্সিডেন্টর স্থানে গেলো। কিন্তু তেমন কিছুই পেলো না। যেহেতু রাতের মালবাহী ট্রাক তাই তাঁর কোন খোঁজ পেলো না। পলাশ এবং আলতাফ হোসেন মেঘকে সামলানোর চেষ্টা করতে রইলো। একটি নার্স ডেকে মেঘের ছোটখাটো চিকিৎসা করালো। মেঘ নাছোড়বান্দা কিছুই সে করবে না। তবুও তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে করানো হলো। মনি অসহায় হয়ে এক কোণে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। সে মেঘ আর জোনাকির এমন অবস্থা দেখতে পারছেন না। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে, দু’জনেই তো দু’প্রান্তে থেকে কষ্ট পেয়েছে, এটা আল্লাহর কেমন পরীক্ষা। হয়তো এরপরই সুখের দিন শুরু। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কিন্তু মেয়েটা শেষ পর্যন্ত বাঁচবে তো? এই একটা কথা মাথায় এলেই সব উত্তর এলোমেলো হয়ে যায়।

————-
রাতের শেষ হয়ে দিনের সূচনার প্রথম ধাপ, ফজরের আজান। মুয়াজ্জিনের মধুর কন্ঠ জানান দেয় আর কিছুক্ষণ পর নতুন সকালের জন্ম হবে। মুমিনদের ঘুম ভেঙে যাবে, আর শয়তানের দল আরামে ঘুমটা গভীর করবে। পরিবারের কারো চোখে ঘুম নেই। সবাই তাকিয়ে আছে একটি বন্ধ দরজার দিকে। নজরটা সেখান থেকে চাইলেও কেউ সরাতে পারছে না। একসময় তাঁদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে খোলা হলো সেই বন্ধ দরজা। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো তিনজন মানুষ। যাঁদের মাঝে শাপলাও আছে। তিনজন কিছু একটা নিয়ে কথা বলছেন। শাপলার মুখ বিষন্নতায় ঘেরা,তাহলে কি শেষ রক্ষা হলো না। মেঘ সবাইকে বেরিয়ে আসতে দেখেই ছুটলো।

_ স্যার জোনাকি, জোনাকি কেমন আছে। ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো ওর? ও ভালো হয়ে যাবে তো? ও আবার কথা বলবে তো? ও-না তখন আমার সাথে কথা বলেনি,আবার বলবে তো কথা। কিছু বলুন না।

_ দেখুন, আমি কি বলবো জানি না, আপনাদের কাজিনের থেকে সব জেনে নিন। তিনিই সব দেখেছেন জেনেছেন তাঁকেই জিজ্ঞেস করুন। তারপর ডাক্তার চলে গেলেন। তাঁর পেছন পেছন আরো একজন চলে গেলো। শাপলার দিকে তখন নজর পড়লো সবার। ছোট ভাইয়ের বউ তাই চেয়েও কোন জোর করতে পারছে না মেঘ। তবুও নিজেকে খুব স্বাভাবিক রেখে বললো।

_ শাপলা ও বেঁচে আছে তো? আবার আমার সাথে ঝগড়া করবে? প্লিজ চুপ করে থেকো না বলো কিছু।

_ ভাইয়া জোনাকি আপুর ভাগ্য ভালো নাকি আপনার ভালোবাসার জোর আমি জানি না। শুধু জানি অনেক বড় কিছু হওয়ার থেকে আল্লাহ হেফাজত করেছেন। চলন্ত ট্রাক বারি দিয়ে গেছে। যদি বারিটা মাথায় বা বুকে লাগতো, হয়তো আপুকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। কিন্তু বারিটা আপুর বা কাঁধে লেগেছে। তাই বামহাত ভেঙে গেছে। আর আপনি হয়তো আপুর মাথায় চোট দেখেছেন, সেটা ট্রাকের বারির জন্য হয়নি! হয়েছে পিচঢালা রাস্তায় থুবড়ে পড়ার জন্য। মাথায় লেগেছে আঘাত এবং রক্ত জমাও হয়েছে, কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে ঔষধের মাধ্যমে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হাতের আঘাত ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। চিন্তা করবেন না আপুকে চব্বিশ ঘণ্টা I.C.U তে রাখা হবে, তারপর বেডে দিয়ে দিবে। আর মাথায় আঘাত পাওয়ার জন্য নাকমুখ থেকে রক্ত এসেছে। এটা স্বাভাবিক বিষয় ডাক্তারের কাছে। আমি ডাক্তার না হলে হয়তো আপনাদের মতো আমারও ভয় হতো। কিন্তু আমি এসব বিষয়ে জানি তাই ভরসা দিয়ে বলছি কোন সমস্যা নেই। আল্লাহর অশেষ রহমতে বড় কোন বিপদ হয়নি। আর সব থেকে বড় বিষয় আপু ভালো আছে।

শাপলার কথায় সবাই সস্থি পেলো। সবাই এবার স্থীর হয়ে বসলো। জোনাকি ভালো আছে শুনেও এক ফোঁটা সুখের জল গড়িয়ে পড়লো। ধীর পায়ে আবারও মাথাটা দেয়ালে লাগালো। একটু ভালোবাসতে গিয়ে কতবড় একটা ক্ষতি করে দিলো মেঘ। তাঁর ভালোবাসা জোনাকির জন্য ক্ষতিকর। এই কথাটা ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে এলো। তখনই কাঁধে হাত দিলো মনি। চোখ খুলে মনিকে দেখে চোখের জলটা মুছে মনিকে বললো।

_ জোনাকি সুস্থ হয়ে গেলে, আমি আবার ফিরে যাবো ভাবি।

_ মানে কি বলছো এসব।

_ যা বলছি সত্যি বলছি। আমার ভালোবাসা জোনাকির জন্য ক্ষতিকর।

_ কি পাগলের মতো কথা বলছো। স্বামীর ভালোবাসা কখনো কোন স্ত্রীর ক্ষতিকর হয় নাকি।

_ কিন্তু জোনাকির হয়েছে।

_ সেটা একটা এক্সিডেন্ট, সেখানে তুমি নিজেকে কেন দায়ী করছো। মাথা ঠান্ডা করো।

_ আমি ঠিক আছি ভাবি, শুধু জোনাকির সুস্থ হওয়ার দিন গোনা।

তাহলে কি শুরু হওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে।

———————

দশ মিনিট হলো জোনাকিকে বেডে শিফট করা হয়েছে। জোনাকির জ্ঞানও ফিরে এসেছে। আস্তে আস্তে সবাই জোনাকিকে দেখতে গেলো। ভালো খারাপ জানতে চাইলো। কিন্তু জোনাকির চোখ দু’টো একটি মানুষের অপেক্ষায় কাতরাতে রইলো। মানুষটা কি নেই, নাকি তাঁর সামনে আসছে না। যখন সে ব্যথায় কাতরাতে রইলো, তখন মেঘের সেই ছটফটানি সে দেখেছে। হয়তো তখন তাঁর হুঁশ ছিলো না, কিন্তু তাঁর চোখে এখনো ভাসছে সেই বেকুল হওয়া মেঘের মুখখানা। কবিতার ঘোরে জোনাকি কখন মাঝ রাস্তায় চলে গেছে তা খেয়াল করেনি। হঠাৎ নিজের দিকে ট্রাক ধেয়ে আসতে দেখে জোনাকি চমকে উঠছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততোক্ষণে। খুব জোর ধাক্কা দিয়ে গাড়িটা সাই সাই বেগে হারিয়ে গেলো। আর জোনাকি ছিটকে গিয়ে পড়লো পিচঢালা রাস্তায়। ওর নিথর দেহটা যখন তরতর করে কাঁপছিল, তখন কয়েক মুহূর্তে সে মনে করেই নিলো! সে আর বাঁচবে না। অথচ মহান আল্লাহ তাঁকে যেমন বিপদ দিয়েছেন, তেমনি বিপদ থেকে রক্ষাও করেছেন “আলহামদুলিল্লাহ” । চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জোনাকি মনিকে বললো।

_ ভাবি তোমার দেওয়র আসেনি।

জোনাকির কথায় মনি চোখ তুলে তাকালো। জোনাকির ডান হাতটা আকরে ধরে বললো।

_ এক্সিডেন্টের পর থেকে ওকে এখনো কেউ বাড়িতে নিতে পারেনি। এমনকি সেই রক্ত মাখা টিশার্ট টাও খোলেনি। রূপ বললো, বাড়িতে যাবি না মানলাম কিন্তু টিশার্ট কেন চেঞ্জ করবি না। উত্তরে সে কিছুই বললো না। তোমার অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে ছোট বাবাকে জড়িয়ে সে কি কান্না তোমায় কি বলবো। ওকে দেখলেই বুঝবে। তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে সত্যি, ক্ষত তোমার শরীরে হলে কি হবে ব্যথাটা মেঘ পেয়েছে। এখন তো তোমার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে বারবার। বলছে তাঁর জন্য এসব হয়েছে। তাঁর ভালোবাসা তোমার জন্য ক্ষতিকর। তাই তো সবাই এলেও সে তোমার সাথে দেখা করতে এলো না। বললো তুমি ভালো আছো, এটাই অনেক। ও তোমাকে দূর থেকেই দেখবে।

_ সে কেন নিজেকে দায়ী করছে। সে কি আমাকে ট্রাকের সামনে ধাক্কা দিয়েছে, নাকি জোর করে মাঝ রাস্তায় দাঁড় করিয়েছে।

_ ওই যে জোর করে তোমায় রাতের শহর দেখতে নিয়ে গেছে। ও যদি না নিতো তাহলে নিশ্চয়ই এমন হতো না।

_ তোমার দেওয়র কে বলো আমি ডাকছি।

_ আচ্ছা।

তারপর মনি চলে গেলো। মনি চলে যেতেই পাঁচ মিনিট পর মেঘ কেবিনে ঢুকলো। চুল গুলো এলোমেলো, মুখে বিষন্নতা, চোখ দু’টো ফুলে টুইটুম্বর। ঠোঁটের নিচে কালো দাগ, হাতে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। লোকটাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে কতটা কষ্টে আছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনি বললো।

_ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন আপনি! এখন কি আমাকে উঠে আসতে হবে আপনার কাছে।

জোনাকির কথায় মেঘ ঘাবড়ে গিয়ে ছুটে এলো কাছে। পাশের একটি টুল টেনে পাশেই বসলো। মেঘ বসতেই জোনাকি বললো।

_ কি অবস্থা আপনার। চেহারার একি হাল করেছেন। মনে তো হচ্ছে আমি না আপনি অসুস্থ। আর এই রক্তমাখা টিশার্ট চেঞ্জ করেননি কেন? পাগল হয়ে গেছেন নাকি।

মনির কথায় মেঘ কিছু বললো না,শুধু শুঁকনো হাসলো। সেটা দেখে জোনাকি ডান হাতটা মেঘের মুখে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো।

_ এভাবে নিজেকে দায়ী করবেন না, আমার কষ্ট হবে। এটা ভাগ্যে ছিলো তাই হয়েছে, এখানে না আপনার কোন দোষ না আমার। তাই নিজেকে একদম অপরাধী ভাববেন না। আর আমি যেতে না চাইলে আমাকে কেউ জোর করে নিতে পারতো না। তাই এটা ভেবে তো মোটেও কষ্ট পাবেন না। আমিও আপনার সাথে যেতে চেয়েছি। মুখে না বললেও মন থেকে কিন্তু আমার হ্যা উত্তর ছিলো। জীবনের কিছু ভুল আমাদের অনেক কিছু দেখায় এবং শেখায়। আমার যদি এক্সিডেন্ট না হতো, আমি কি কখনো দেখতাম আপনি আমার জন্য কতটা অস্থির হন। কতটা পাগলামি করতে পারেন। কিছু ভেঙে যাওয়া খারাপের জন্য নয় ভালোর জন্যও হয়। আপনার এই চুপসে যাওয়া মুখখানা দেখে তো মনে হচ্ছে আমি মরে গেলেই ভালো হতো?

জোনাকির কথায় চমকে উঠলো মেঘ। জোনাকির ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরলো।

_ প্লিজ জোনাকি এভাবে বলো না, আমি মরে যাবো। তোমার কিছু হয়ে গেলে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। প্লিজ আর কখনো বলো না।

_ ঠিক আছে বলবো না, তবে বলুন এখন থেকে আর এই বিষয় নিয়ে গিল্টি ফিল করবেন না।

_ আচ্ছা।

_ আরো একটি কথা।

_ কি?

_ রাতের শহর কথা বলে কিনা আমি জানি না। আর সে আপনার প্রশংসা করতো কিনা তা-ও জানি না। কিন্তু সত্যি আপনি খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। মন থেকে বলছি।

বিনিময়ে মেঘ হাসলো।

চলবে…