অনপেখিত পর্ব-১০

0
71

#অনপেখিত
পর্ব ১০
লিখা Sidratul Muntaz

ফারদিনের মেজাজ বর্তমানে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের রূপ ধারণ করেছে। সে মেহেকের কাছে এসে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ” এই মেয়ে, উঠো৷ সমস্যা কি তোমার?”

রাগের দমকে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছিল।কিন্তু মেহেক চোখ বুজে পড়ে আছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। ফারদিন এভাবে আরও কয়েক বার ডাকার পরেও যখন কোনো রেসপন্স পেল না তখন কিছুটা শান্ত হলো। মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে মেহেকের নাকের সামনে আঙুল দিয়ে দেখল শ্বাস আছে কি-না। অনেক সময় উঁচু জায়গা থেকে পড়ে মানুষ দম আটকে ফেলে। ফারদিন মেহেককে পাঁজাকোলায় নিয়ে বিছানায় শোয়াল।

মেহেকের শ্বাস আছে। এর মানে শুধু অজ্ঞান হয়েছে সে। ফারদিন উর্মিকে ডাকল। সেকেন্ড না গড়াতেই উর্মি প্রায় দৌড়ে এলো। সে আপাতত ফারদিনকে খুবই ভয় পাচ্ছে। ফারদিনের কণ্ঠে নিজের নামে ডাক শুনলেই জড়োসড়ো হয়ে পড়ছে। যেহেতু সুজির মাথায় আঠা সে ঢেলেছিল অর্থাৎ মেহেকের কুকীর্তির অর্ধেক অংশীদার সে নিজেও। তাই ফারদিন মেহেককে যা শাস্তি দিবে উর্মিকেও সেই একই শাস্তি পেতে হবে। এই ভয়েই উর্মি সদা তটস্থ। ভীত ভীত কণ্ঠে বলল,” জ্বী ভাইয়া,ডাকছেন?”

ফারদিন চিন্তিত হয়ে বলল,” দেখো তো কি হয়েছে? মেহেক চোখ খুলছে না।”

উর্মি মাথায় দুইহাত চেপে আর্তনাদের সুরে বলল,” হায়হায়, আপায় কি মইরা গেল নাকি?”

” আরে ধূর, মরবে কেন? সেন্সলেস হয়ে গেছে। কিভাবে কি হলো বুঝলাম না। তুমি এক কাজ করো। বাথরুম থেকে পানি এনে ওর নাকে-মুখে স্প্রে করতে থাকো। আমি এক মিনিটে আসছি।”

” আচ্ছা, ঠিকাছে।”

ফারদিন চলে যেতেই মেহেক খিকখিক করে হেসে উঠল। উর্মি অবাক হয়ে বলল,” আপা, আপনের কি হইছিল?”

” কিছুই হয়নি। বরকে বুদ্ধু বানালাম। এটা হচ্ছে বিপদের সময় বকা থেকে বাঁচার এবং ইন্সট্যান্ট বরের কোলে উঠার নিঞ্জা টেকনিক। বুঝেছিস?”

” কি যে করেন না আপনি৷ আমি তো সত্য ভাবছিলাম। মনে করছিলাম ফারদিন ভাই আপনেরে আসলেই তুইল্লা আছাড় মারছে আর আপনে ফিট হয়া গেছেন।”

মেহেক মুখে হাত দিয়ে কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। হঠাৎ দেখল ফারদিন দরজার বাহিরে থেকে রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেকের হাসি মুহুর্তেই বন্ধ হয়ে গেল৷ উর্মি কথা বলেই যাচ্ছিল।

” ভাই যখন আমারে ডাকছিল আমি যেই ভয় পাইছি। আমি তো ভাবছি এখন আমারেও তুইলা আছাড় মারবো আপনের মতো। কারণ সুজি আপার চুলে আঠা ফেলার ব্যাপারে তো আমিই আপনারে সাহায্য.. ”

মেহেক চট করে উর্মির হাত খামচে ধরল। উর্মি থতমত খেয়ে মেহেকের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। ফারদিন ওদের কিছুই বলল না আপাতত। চুপচাপ চলে গেল। উর্মি নেতিয়ে পড়া কণ্ঠে বলল,” এখন কি হইবো আপা?”

মেহেক ঠোঁট উল্টে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,” জানি না।”

” আপা, আপনি আরেকবার লুকান। এইবার আমিও আপনার সাথে লুকামু।”

সুজি আর আনজীরকে ঘিরে বসে আছে সবাই। পূর্বিতা আর ওয়াসীম তো হাত তালি বাজিয়ে গান গাইছে। উজান মাঝখানে বসে বাহিরে থেকে কিনে আনা ফাস্ট ফুড খাচ্ছে আরাম করে। ওয়াসীম চাইছে এই বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে একটা জমজমাট পার্টি দিতে। পূর্বিতা বলল,” অবশ্যই হবে। বড় একটা অনুষ্ঠান তো মাস্ট। কিন্তু সুজানা, তোরা যে এতোরাতে বিয়ে করেছিস সাক্ষী কিভাবে যোগাড় করলি? আর আমাদের জানাসনি কেন?”

আনজীর বলল,” আমি তো জানাতেই চেয়েছিলাম তোদের। সুজানা দেয়নি। আর সাক্ষী নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। কাজী অফিসে আরও একজোড়া দম্পতি গেছিল বিয়ে করতে। তাদের কাছেও সাক্ষীর অভাব। পরে আমরা বদলাবদলি করে সাক্ষী হয়েছি৷ আমাদের বিয়ের সময় ওরা ছিল সাক্ষী আর ওদের বিয়ের সময় আমরা ছিলাম সাক্ষী।”

ওয়াসীম বলল,” দারুণ তো। কিন্তু হঠাৎ এতো তাড়াহুড়া কেন করলি বুঝলাম না।”

সুজানা বলল,” শুভকাজে দেরি করতে নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব কাজ সেরে ফেলেছি৷ তোরা চিন্তা করিস না। আমেরিকা গিয়ে বড় করে পার্টি দিবো।”

” সেটা তো এমনিতেই দিতে হবে। পার্টি না দিলে কি আমরা তোদের শান্তিতে থাকতে দিবো? ফারদিন তো আমাদের ঠকিয়েছে। তোরা কিন্তু সেটা পারবি না।”

সবাই হাসছিল খুব। ফারদিন যে পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কারো হুশ নেই। হঠাৎ ফারদিন এগিয়ে এসে মুখ-চোখ কুঁচকে হুংকার ছাড়ল,” এই তোরা কি ফাজলামি শুরু করেছিস? এসব কি হচ্ছে?”

তার মেজাজে কারো কোনো ভাবান্তর হলো না। সুজানা তো কোনো পাত্তাই দিল না। ওয়াসীম মুখ কালো করে জবাব দিল,” ফাজলামি হবে কেন? ওরা তো বিয়ে করেছে দোস্ত। একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। এইখানে তুই ফাজলামির কি দেখলি?”

” সুজানা, ওঠ। আমার তোর সঙ্গে কথা আছে।”

চোয়াল শক্ত করে প্রায় আদেশের মতো বলল ফারদিন।

সুজানা আনজীরের হাত চেপে ধরে বলল,” উহুম। তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই৷ তাছাড়া আমি আমার বরকে ফেলে তোর সাথে কেন কথা বলবো? আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে না? তাই আগামী এক সপ্তাহ আমি শুধু আমার বরের সঙ্গেই কথা বলবো। অন্যকারো সঙ্গে না।”

পূর্বিতা দুই হাত গালে রেখে বলল” হাউ রোমান্টিক!”

ফারদিন বহু কষ্টে রাগ সংবরণ করল। আনজীরের দিকে চেয়ে বলল,” আনজু, তুই এদিকে আয়। কথা আছে।”

আনজীর উঠতে নিচ্ছিল। সুজানা হাত ধরে টেনে ওকে বসিয়ে বলল,” এই, তুমি কোথায় যাচ্ছো? চুপচাপ বসে থাকো। আগামী এক সপ্তাহ শুধু তুমি আমার পাশে বসে থাকবে এবং আমার কথাই শুনবে। অন্যকারো কথা শুনতে পারবে না। গট ইট?”

আনজীর বাধ্যের মতো বলল,” ওকে সুইটহার্ট। স্যরি ফারদিন।”

সুজি আনন্দে আনজীরের কাঁধে মাথা রেখে গান গাইতে শুরু করল,” আরে ও প্রাণের রাজা, তুমি যে আমার.. পাশে পাশে থেকো মোর, চাই না কিছু আর..”

আনজীরও সুর মিলিয়ে গাইল,”আরে ও আমার রানী, আমি যে তোমার… তুমি ছাড়া জীবনে, নেইতো কিছু আর!”

ফারদিন রাগে শুধু বোমার মতো ফুলছিল। তাকে যেন কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না! বন্ধুরা হাত তালি বাজিয়ে সুজি আর আনজিরের গানে সুর মিলাচ্ছে। সবার আজকে কত আনন্দ! যেন ঈদ চলে এসেছে। অথচ ফারদিনের ইচ্ছে করছিল সেন্টার টেবিলটা লাথি মেরে ভেঙে ফেলতে। সে খুব দ্রুত ওই জায়গা থেকে চলে এলো।

পেয়ারা গাছের নিচে এসে বসল ফারদিন। আজ অনেকদিন পর, তার চোখ দু’টো অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে আসছে। তার একে একে সব স্মৃতি মনে পড়ছিল। সুজির সাথে প্রথম দেখা, প্রথম ভালো লাগার মুহুর্ত, সুজির জন্য সাজিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো, সবকিছু বিষাক্ত সুচের মতো হৃদয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। ফারদিন পাঞ্জাবীর পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার আর সুজানার পুরনো ছবিগুলো দেখতে লাগলো। আহারে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো! আর কখনও ফিরে আসবে না। সুজানা আর কখনও তার দিকে তাকিয়ে হাসবে না, লজ্জায় লাল হয়ে বলবে না, ” ফারদিন স্টপ ইট!”

আর কখনও সুজানার কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখা হবে না। সবকিছু যেন দুঃস্বপ্নের মতো পাল্টে গেল। আর ফারদিনের ঘুম ভাঙল এখন! সবটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল, সে আসলে কতটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। সুজানা এখন পুরোপুরি অন্যকারো। ফারদিন এটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ফারদিন এখন সুজানার যন্ত্রণাগুলো হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছে৷ সে মেহেককে বিয়ে করে সুজানাকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছিল সুজানা যেন সবটুকুর শোধ কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে নিল৷ ফারদিনের গলার কাছে দলা পাকানো একটা কষ্ট কাঁটার মতো আটকে আছে৷ সে না পারছে উগড়ে ফেলতে আর না পারছে নিগড়ে নিতে।

মেহেক নীরবে ফারদিনের পেছনে এসে দাঁড়ালো। ফারদিন মোবাইলে সুজানার ছবি দেখছে। এইটা দেখে মেহেকের ছোট্ট মন ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। তার বর এখনও অন্য একটি মেয়ের প্রতি আসক্ত। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও তার ছবি দেখছে। আড়ালে কাঁদছে!এতো ভালোবাসা! তার জন্য কেন এই ভালোবাসা নেই? সে কি একটুও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? ফারদিন হঠাৎ কি মনে করে যেন পেছনে তাকালো। মেহেককে দেখতে পেয়েই অপ্রস্তুতভাবে চোখের জল মুছল। গলা পরিষ্কার করতে কাশি দিল।

মোবাইলটা পকেটে পুরে অস্বস্তি নিয়ে বলল,” তুমি কখন এলে?”

” মাত্র। বসতে পারি?”

” বসো।”

মেহেক ফারদিনের পাশে বসলো। ফারদিন রুক্ষ কণ্ঠে বলল,” সুজানার চুলে আঠা তুমি লাগিয়েছো? সত্যি করে বলো।”

মেহেক মাথা নিচু করে উত্তর দিল,” হুম।”

” কেন?”

মেহেক অপরাধীর মতো তাকিয়ে আছে। নরম কণ্ঠে বলল,” বিশ্বাস করুন। আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমার সাথে যে শয়তানটা আছে সে আমাকে বাধ্য করেছে কাজটা করতে।”

” শয়তান মানে?”

” শয়তান মানে শয়তান! আমাদের সবার সাথেই তো মনে মনে একটা শয়তান থাকে তাই না? ওই শয়তান আমাদের দিয়ে জোর করে ভুলভাল কাজ করায়। আমিও শয়তানের প্ররোচনার স্বীকার।”

মেহেক দুইহাতে কান ধরল। ওই সময় তাকে সম্পূর্ণ একটা অবুঝ শিশুর মতো দেখাল। বাচ্চারা ভুল করলে তাদের নিষ্পাপ চেহারায় যেমন ভীতি আর অপরাধবোধের এক স্পষ্ট সংমিশ্রণ দেখা যায়, মেহেকের চেহারাতেও দেখা যাচ্ছে। ফারদিন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে।

বকুল গাছের নিচে হঠাৎ দেখা গেল সুজানা আর আনজিরকে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে খুব হাসছে তারা। সুজানা আনজিরের শার্টের কলার চেপে ধরে কি যেন বলছে। তাতেই আনজির হাসিতে প্রায় ভেঙে পড়ছে। ফারদিন আহত দৃষ্টিতে দেখছে ওই দৃশ্য।

মেহেক ফারদিনের গম্ভীর চেহারা দেখে আরও ভড়কে গেল। তার কপালে আজ বিরাট দুঃখ আছে।মেহেক ভ*য়ে চোখ বন্ধ করে নিল। এখন কি হবে? ফারদিন কি তাকে মা*রবে? ব*কবে? ভ*য়ে মেহেকের ছোট্ট প্রাণপাখি উড়াউড়ি করছে!

ফারদিন হঠাৎই মেহেকের ঘাড়ের পেছন দিক চেপে ধরে ঠোঁটে গভীর চুমু দিল। যা মেহেককে সম্পূর্ণ স্তম্ভিত করে দিল। তার ছোট্ট শরীর কারেন্টের শক খাওয়ার মতো কেঁপে উঠল। মুহূর্তেই চোখ দু’টো খুলে এতো বড় বড় হয়ে গেল। স্তব্ধীভূত হয়ে তাকিয়ে রইল সে। কি হচ্ছে তার সাথে? যে ঘটনা স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না তা কি বাস্তবে ঘটছে? এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না! ফারদিন তাকে বকা না দিয়ে চু’মু দিচ্ছে? তার বোম্বাই ম’রিচ এর মতো বরটা হঠাৎ এতো মিষ্টি হয়ে গেল কি করে?

ফারদিন কাজটা করেছে শুধুই সুজানাকে দেখানোর উদ্দেশ্যে। সে যদি আনজিরকে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারে তাহলে ফারদিনও পারে। যতক্ষণ সুজানা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক ততক্ষণ ফারদিন চু’মু দিয়ে গেল মেহেকের ঠোঁটে! গভীর আবেগে শুষে নিতে লাগল মনের সমস্ত অতৃপ্তিটুকু। আর মেহেক, স্তব্ধমূর্তির মতো গাঁট হয়ে বসে রইল। বুকের মধ্যে অনবরত দামামা বেজে যাচ্ছিল তার। যেই মাত্র সুজানা আনজিরের হাত ধরে বকুল গাছের নিচ থেকে চলে গেল তখনি ফারদিন ছেড়ে দিল মেহেককে।

বিশাল একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো মেহেকের ভেতর থেকে। বড় বড় চোখে ভীষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ফাঁকা ঢোক গিলল কয়েকবার। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিল সে দম আটকেই ম*রে যাবে। ফারদিন নির্লিপ্ত চোখে মেহেকের অবস্থা পরখ করেই উঠে চলে গেল। স্তম্ভিত মেহেক বোকার মতো বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ, একা, একা!

প্রায় পৌনে একঘণ্টা ধরে মেহেক লিখছে। একই লাইন বার-বার লিখছে। লাইনটি হলো,” আমার রাগী বর আমাকে চু’মু দিয়েছে!” এতোক্ষণে মোট একশো চুরাশি বার লেখা হয়ে গেছে। তাও মেহেকের কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া রোমাঞ্চকর মুহূর্তটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে! একবার বিছানার দিকে আঁড়চোখে তাকালো মেহেক। ফারদিন আরাম করে শুয়ে একের পর এক সিগারেটে সুখটান দিয়ে যাচ্ছে। একটু আগে ওমন ভ*য়ংকর একটা কান্ড করেও লোকটা কি নির্লিপ্ত! যেন কিছুই হয়নি!

মেহেককে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারদিনের অস্বস্তি হচ্ছে। সে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল হঠাৎ,” কি ব্যাপার? কিছু বলবে?”

মেহেক তার চোরাদৃষ্টি ফিরিয়ে নিল দ্রুত। ডায়েরীর দিকে নজর দিল। পাশ কাটানো গলায় বলল,”উহুম।”

” তুমি কি করছো?” বলেই মেহেকের ডায়েরীর দিকে তাকাল ফারদিন।

” কিছু না!” ওরনার নিচে দ্রুত হাতের ডায়েরীটা আড়াল করার চেষ্টা চালালো মেহেক। ফারদিন তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে বসল। দরাজ গলায় বলল,” আমার দিকে তাকিয়ে কি লিখছো? দেখি আমি!”

মেহেক অসহায় কণ্ঠে বলল, ” না। আপনি দেখবেন না।”

ফারদিন নিষেধ শুনল না। উঠে এসে মেহেকের হাত থেকে ডায়েরীটা প্রায় ছিনিয়েই নিল। মেহেকের মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে। ফারদিন অবাক হয়ে বলল,” এসব কি লিখেছো?”

মেহেক লজ্জায় নুইয়ে ফেলল। নিচু গলায় বলল,” দিন আমি পেইজগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।”

ফারদিন ডায়েরী দিল না। রাগী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,”কয় লাইন লিখেছো?”

মেহেক কথা বলল না৷ ফারদিন নিজেই গুণে দেখল, প্রায় একশো চুরাশি বার লেখা হয়ে গেছে। সে চোয়াল শক্ত করে বলল,” এখন একশো চুরাশি বার কান ধরে উঠ-বস করবে তুমি।”

” কি?” মেহেক যেন আকাশ থেকে পড়ল।

” আমি তো বাংলাতেই কথা বলছি। না বোঝার তো কিছু নেই। কান ধরে উঠ-বস করো আর বলো ‘আমি আর জীবনেও শয়তানি করবো না।'”

মেহেক কাঁদো কাঁদো মুখে কান ধরল। সে বুঝতে পারছে সুজির চুলে আঠা লাগানোর শাস্তিই তাকে দেওয়া হচ্ছে এখন। উঠ-বস করতে করতে বলল,” আমি আর জীবনেও শয়তানি করবো না।”

এইভাবে ত্রিশবার উঠ-বস করার পর মেহেক হাঁপিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। ফারদিন চোখ রাঙানি দিয়ে বলল,” কি ব্যাপার? বসলে কেন? এখনও তো একশোবারও হয়নি। উঠো। গেটআপ।”

” আমি একটু পানি খাবো।”

” আগে একশো শেষ করো। তারপর পানি পাবে। এর আগে না।”

” এমন করছেন কেন? কেউ পানি চাইলে দিতে হয়। নাহলে মরার আগে পানি পাবেন না।”

” আমি মরার আগে পানি পাবো কি পাবো না সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি আগে নিজের চিন্তা করো। উঠো।”

” আমার হাঁটুতে ব্যথা করছে৷ আমি আর পারছি না।”

” শয়তানি করার আগে এটা মনে ছিল না? এরপর থেকে যখন শয়তান আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে তখন যেন এই হাঁটুর ব্যথার কথা মনে থাকে।”

ফারদিন ডায়েরী আর কলম মেহেকের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,” যাও ভাগো।”

মেহেক এগুলো তুলে নিয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার আচরণে বিস্মিত ফারদিন। এই মেয়ের সাথে সংসার করা কিছুতেই সম্ভব না! সে বউ না বরং বাচ্চা মেটেরিয়াল!

মেহেক উর্মিদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আজরাতে তার উর্মির সঙ্গেই থাকার কথা ছিল। পরদিন সকালে মেহেক সুজির কাছে ক্ষমা চাইতে গেল। যদিও সে যেই কান্ড করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য! কিন্তু সুজির ব্যবহার দেখে মেহেক হতভম্ব হয়ে গেল।

সুজানা হাসিমুখে বলল,” আরে মেয়ে, এইটা কোনো ব্যাপারই না৷ তোমার বয়সে থাকতে এমন দুষ্টুমি আমরাও কত করেছি! তাছাড়া তুমি চুলে আঠা না লাগালেও কিন্তু আমি চুল কাটতাম। কারণ আমার বরের ছোট চুলই বেশি পছন্দ। তুমি যে তোমার ভুলটা বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। আমি কিছু মনে রাখিনি। আর তুমিও মনে রেখো না।”

মেহেক সত্যিই খুব অবাক হলো। বিয়ের পর সুজির এতো পরিবর্তন? না, না, আজকে থেকে আর সে সুজিকে ঘৃণা করবে না। সুজি আপু অনেক ভালো! সুজি আপু বেস্ট!

বিয়ে উপলক্ষে সুজানা আর আনজীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কক্সবাজার ঘুরতে যাবে। সেখান থেকে ইনানী বিচ, হিমছড়ি ঝরণা আরও অনেক জায়গায় ঘুরবে। আমেরিকা ফিরে গেলে আবার কবে না কবে তাদের বাংলাদেশে আসা হয় তার ঠিক নেই৷ তাই তারা সব সুন্দর জায়গা একবারে ঘুরে যেতে চাইছে। ঠিক হলো সকাল নয়টা নাগাদ বেরিয়ে সারাদিন সবাই ঘুরবে৷ এরপরদিন সবাই একসাথে ঢাকা রওনা হবে।

কক্সবাজারে মানুষের উপচে পড়া ভীর। সবসময়ই এইরকম ভীর থাকে তবে এখন যেহেতু বর্ষাকাল, সমুদ্র দেখার উপযুক্ত সময়! তাই ভীরের পরিমাণটাও একটু বেশি। চারদিকে মানুষ ছুটোছুটি করছে, ছবি তুলছে। আর সুজানা যখনই সুযোগ পাচ্ছে ফারদিনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে আনজিরের সাথে আহ্লাদীপণা করছে। এমনিতেই সারাদিন আনজীরের সাথে চুইংগামের আঠার মতো লেগে আছে সে। তার উপর যখনই ফারদিনকে দেখছে, তখনই এমন কাজ করছে যেন ফারদিন রেগে ঢোল হয়ে যায়।

এইতো কিছুক্ষণ আগে ফারদিনের সামনে সুজানা আনজীরের পায়ের উপর পা রেখে ঠোঁটে চুমু খেল। ফারদিন ওই দৃশ্য দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেছিল। তারপর আর সেদিকে যায়নি। সুজি যে তাকে জ্বালানোর জন্যই এসব করছে সেটাও সে ভালোমতো বুঝতে পারছে। আর সত্যি বলতে সে জ্বলছেও। ভেতরে ভেতরে জ্বলে খাঁক হচ্ছে। শুধু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। কারণ সুজি আর আনজীর তো তার সঙ্গে কথাই বলে না!

সবাই যখন সমুদ্রের পানিতে ইচ্ছেমতো দাপাদাপি করছে ফারদিন তখন বিচের এক কোণায় চুপ করে বসে সিগারেট টানছিল। সে সাতার কাটতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু আজকে তার পানিতেই নামতে ইচ্ছে করছিল না। কারণ পানিতে নামলেই সুজি আর আনজীরের আদিখ্যেতা দেখতে হবে। যেটা সে এই মুহুর্তে একদম সহ্য করতে পারছে না। সকাল থেকেই সে দু’জনকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে।

ওয়াসীম ফারদিনকে একা বসে থাকতে দেখে তার পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করল,” কিরে দোস্ত, বসে আছিস কেন? পানিতে নামবি না? সমুদ্রে কি বিড়ি টানতে এসেছিস?”

ফারদিন কাঠখোট্টা স্বরে বলল,” মানুষের ন্যাকামি দেখার চেয়ে বিড়ি টানাই ভালো।”

” কে ন্যাকামি করছে?”

” সুজিকে দেখিসনি? কি শুরু করেছে ও? বিয়ে কি শুধু এ পৃথিবীতে ও একাই করেছে? বর কি শুধু ওরই আছে? মানে এমন ভাব করছে যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে! আজাইরা!”

” তুই ওদের সুখ সহ্য করতে পারছিস না কেন? এখনও কি সুজির মধ্যেই আটকে আছিস?”

” আমার বয়েই গেছে ওর মধ্যে আটকে থাকতে। কি আছে ওর মধ্যে যে আমি আটকে থাকবো?”

” তোর চাল-চলন তো সুবিধার না দোস্ত। আচ্ছা, তুই মেহেকের সাথে ঘুরছিস না কেন? বেচারি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুই ওকে সঙ্গ দিলেই তো পারিস। সুজি যেমন তার জামাই নিয়ে মেতে আছে তুইও তোর বউ নিয়ে মেতে থাক! শোধবোধ! ”

” বউ? আচ্ছা সত্যি করে একটা কথা বলতো ওয়াসীম, মেহেককে তোর বউ বলে মনে হয়?”

” এটা আবার কেমন প্রশ্ন? বউ মনে হবে না কেন? ও কত সুইট একটা মেয়ে! দেখলেই তো আদর আসে।”

” আমার আদর আসে না। ইনফ্যাক্ট ওকে বউ বলেই মনে হয় না। মনে হচ্ছে যেন একটা বাচ্চা দত্তক নিয়ে এসেছি এতিমখানা থেকে। বিয়ে যে করেছি সেটাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই বাল!”

ওয়াসীম হো হো করে হেসে উঠল। ফারদিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” বুঝেছি তোর সমস্যা কোথায়। কিন্তু তোকে তো এটাও বুঝতে হবে যে মেহেক ছোট। ষোল বছরের কিশোরী বিয়ে করে তার মধ্যে বাইশ-তেইশ বছরের তরুণীর মতো এটিটিউড চাইলে তো হবে না বন্ধু!”

ফারদিন গম্ভীর মুখে সিগারেটে টান দিতে লাগল। ওয়াসীম বলল,” আরে ঠিক হয়ে যাবে।এই বয়সের মেয়েদের একটা প্লাস পয়েন্ট কি জানিস? এরা হয় একদম মাটির পুতুলের মতো। যেভাবে গড়বি সেভাবেই থাকবে। দেখবি একটা সময় তোকে ছাড়া কিছুই বুঝবে না।”

ফারদিন বিরক্তি নিয়ে বলল,” ও এমনিতেই আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। আর এখানেই আমার সবচেয়ে বেশি প্রবলেম। আমি জানি না ওকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবো। কিন্তু আমি জাস্ট পারছি না। আমার পক্ষে সম্ভব না। ওকে আমি ডানে বললে ও বামে বুঝে৷ পেছনে বললে সামনে বুঝে। মানে এক কথায় ইম্পসিবল! আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং জীবনেও হবে না।”

” এখনি এই কথা কিভাবে বলছিস? ওকে আগে বড় হতে দে। তারপর দেখবি তোর শখ-আহ্লাদ সবই পূরণ করবে।”

” ততদিনে আমার জীবন-যৌবন শেষ হয়ে যাবে।”

কথাটা বলেই তাচ্ছিল্য হাসল ফারদিন। ওয়াসীম বলল,” তাহলে পিচ্চি মেয়েটাকে বিয়ে করলি কেন?”

” যখন বিয়ে করেছি তখন বুঝিনি। তাছাড়া বিয়ের আগে আমি জেনেছিলাম ওর বয়স আঠারো। বিয়ের পর দেখি ষোল। আর যে ছবি দেখেছিলাম সেখানে ভালোই ম্যাচিউরড লেগেছিল। অথচ বাস্তবে দেখি পুরাই বাচ্চা একটা।”

ওয়াসীম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,” তাহলে তুই এখন কি করবি?”

” আমি ঠিক করেছি মেহেককে ডিভোর্স দিবো।”

” হায়হায়, ডিভোর্স কেন দিবি? মেয়েটার লাইফ শেষ হয়ে যাবে।”

” ডিভোর্স নিলে কারো লাইফ শেষ হয় না ওয়াসীম। বরং আমার সঙ্গে থাকলেই ওর ক্ষতি। আমি ওকে কখনও সুখে রাখতে পারবো না। আর না পারবো নিজে সুখে থাকতে৷ সো আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই বেটার। ”

” যাহ, এমন করিস না। মেয়েটা খুব কষ্ট পাবে।”

” সারাজীবন কষ্ট করার চেয়ে অল্প সময়ের এই কষ্টটাই কি ভালো না?”

মেহেক খুব সুন্দর একটা ঝিনুকের মালা কিনেছে। এই মালায় তাকে দেখতে কেমন লাগছে সেটা জানার জন্য অনেকক্ষণ ধরে সে ফারদিনকে খুঁজছিল। কিন্তু কোথাও পাচ্ছিল না। মানুষটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল হঠাৎ করে? একটু পরেই তার নজরে পড়ল ফারদিনকে। মেহেক দৌড়ে ছুটে যাচ্ছিল। কিন্তু থেমে গেল তার পাশে সুজিকে দেখে।

সুজানা হাত ধরে টেনে ফারদিনকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। মেহেকও তাদের পেছন পেছন গেল তারা কি করে দেখার আশায়। সুজানা ফারদিনকে ঝাউবনের কাছে নিরিবিলি একটা জায়গায় এনে দাঁড় করাল। মেহেক ওদের থেকে অনেকটা দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের কথা শোনা যাচ্ছে না। শুধু মুখের অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে। ফারদিন ধমকের সুরে বলল,” আমাকে এখানে কেন এনেছিস?”

” কথা আছে তাই।”

” আমি তোর সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।”

” না চাইলেও তোকে কথা বলতে হবে। ”

” কেন? আমি কি তোর হুকুমের গোলাম?”

” হ্যাঁ তাই৷ কথা শোন।”

” হাত ছাড়।”

” ছাড়বো না।”

ফারদিন জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল। সুজানা বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল,” ওকে ফাইন। হাত ছাড়লাম। এখন অন্তত শোন!”

ফারদিন কোনো জবাব না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সুজানা নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ওয়াসীমের থেকে শুনলাম তুই নাকি মেহেককে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছিস?”

” ঠিক শুনেছিস।”

” কিন্তু কেন?”

” সেই কৈফিয়ৎ তোকে কেন দিবো?”

” ফারদিন খুব খারাপ হবে কিন্তু। তুই মেহেককে ডিভোর্স দিতে পারিস না।”

” কেন পারি না? আর তোর সমস্যা কি? আমার লাইফ, আমি যা ইচ্ছা তাই করবো। তুই ইন্টারফেয়ার করার কে? আর আমি তোর কথা শুনবোই বা কেন? তুই কি আমার বস লাগিস?”

” আমি জানি তুই এটা আমার উপর রাগ থেকে করছিস। ফারদিন দ্যাখ, আমি যা করেছি সেটা সবার ভালোর জন্যই করেছি৷ তোর, আমার, মেহেকের, সবার ভালোর কথা চিন্তা করেই করেছি। তুই এখন প্লিজ মেহেককে কষ্ট দিস না।”

” আমার ভালো-মন্দ ডিসাইড করার রাইট তো তোকে আমি দেইনি। আমি লাইফে কি করবো না করবো সেটা তুই আমাকে শিখিয়ে দিবি না। নো ওয়ে!”

সুজানা ফারদিনের গালে হাত রেখে বলল,” ফারদিন, তুই আমার কথাটা একটু শোন দোস্ত। মেহেক তোকে অনেক ভালোবাসে।”

ওইটুকু দৃশ্য দেখেই মেহেকের বোঝা হয়ে গেল তাদের মধ্যে কি ধরণের কথোপকথন হচ্ছে। যদিও তার কিশোরী মনের অবান্তর ধারণাটুকু নিতান্তই ভুল ছিল। মেহেক আর সেখানে দাঁড়ালো না। চোখের জল নিয়ে ফিরে এলো। তার জন্মটা কি আসলেই শুধু কাঁদার জন্য হয়েছিল? এজন্যই বুঝি কপালে এতো দুর্ভোগ।

চলবে