অনপেখিত পর্ব-১৪

0
130

#অনপেখিত
পর্ব ১৪
লিখা: Sidratul Muntaz

মেহেকের মনে হলো তার শরীরটা বড্ড হালকা হয়ে যাচ্ছে। সে বিরাট উঁচু কোনো জায়গা থেকে নিচে পতিত হচ্ছে। তার দেহটা ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করে ফেললেই সে আর বাঁচবে না। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। সমাপ্তি ঘটবে তার অভিশপ্ত জীবনের। শরীরটা ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করতেই তীক্ষ্ণ একটা ঝাঁকুনি অনুভব হলো। মেহেকের চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। দৃষ্টি মেলে তাকাতেই সে নিজেকে পরিচিত একটি রুমে আবিষ্কার করল। ফারদিন বসে আছে তার বরাবর। সাথে উর্মি দাঁড়িয়ে। মেহেকের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল উর্মি। মেহেক বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে নিয়েই পায়ে ব্যথা পেয়ে গেল। ‘আহ্’ করে কঁকিয়ে উঠলো।

উর্মি কাছে এসে বলল,” সাবধানে আপা, পাঁয়ে ঔষধ লাগাইসি। ঔষধ মুইছেন না। জ্বলুনি আস্তে আস্তে কইমা যাইবো।”

মেহেক তাকিয়ে দেখল তার দুই পায়ে সাদা মাখনের মতো ঔষধ লাগানো। পায়ে তেলে চিটচিট করছে। যন্ত্রণাও হচ্ছে প্রচুর। পা দু’টি কি তার পুড়ে গেছিল? মেহেক উর্মির দিকে একবার, ফারদিনের দিকে একবার তাকাল। ফারদিন চেহারা শক্ত বানিয়ে চোখের দৃষ্টি কটমট করে চেয়ে আছে। ক্রমান্বয়ে রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে।

মেহেক আর্তনাদের মতো উচ্চারণ করল,” আমি এখানে কিভাবে আসলাম? কেন এখনও বেঁচে আছি আমি? মরে গেলাম না কেন?”

মেহেক কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই ফারদিন আকস্মিক বেগে তেড়ে এসে তার গালে একটা ঠাটানো চড় মারল। চড়ের দমকে মেহেক বিছানায় ছিটকে পড়ল। ফারদিন তীব্র চিৎকারে ফেটে উঠলো,” মরার খুব শখ হয়েছিল তাই না?”

মেহেক নির্বাক দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। মুখ দিয়ে টু শব্দ করতে পারল না। উর্মি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিন কাছে এসে শীতল কণ্ঠে বলল,” আর কখনও এতোবড় সাহস দেখালে ভয়ংকর শাস্তি দিবো, বুঝেছো?”

শেষ শব্দটা সে ধমকে উচ্চারণ করল। মেহেক কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। ফারদিন হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মেহেক গালে হাত রেখে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল। তার সাথেই কেন বার বার এমন হয়? নিজের ইচ্ছায় কি সে মরতেও পারবে না? এই অশান্তির জীবন নিয়েই তাকে জোর করে বেঁচে থাকতে হবে! এ কেমন অবিচার!

উর্মি কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” ভাইয়ার মাথাগরম হয়ে গেছে আপা। আপনি কষ্ট পাইয়েন না। আপনার শরীরে আগুন দেইখা ভাই ঘাবড়ায় গেসিল। আমি পাইপ খুইলা পানি ঢাইলা সাথে সাথে আগুন নিভাইসি। কিন্তু আপনি জ্ঞান হারায় ফেলসিলেন। আচ্ছা এইটা একটা কাজ করলেন আপা? ক্যান শরীরে আগুন দিতে গেলেন? আমি যদি তখন ওইখানে না থাকতাম তাইলে তো এতোক্ষণে পুইড়াই যাইতেন।”

” বেশ হতো। পুড়ে গেলেই ভালো হতো! মরতে পারতাম!”

” এইগুলা কি কন আপা? ক্যান মরতে চান আপনি? আপনার কিসের কষ্ট? যত কষ্ট তো আমাদের জীবনে। তাও আমরা বাঁইচা আছি না? আপনি এতো সুন্দর দেখতে, আপনাগো সয়-সম্পত্তির অভাব নাই। স্বামীও পাইসেন মনের মতো। তাও আপনার কিসের এতো দুঃখ?”

মেহেক মনে মনে হাসে। আফসোসের হাসি। আপাতদৃষ্টিতে তাকে দেখলে মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটি। অথচ তার ভেতরটা যে কত রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, তা কেউ জানবে না। বুঝবে না। এজন্যই হয়তো বলে, টাকা থাকলেই সুখী হওয়া যায় না। সৌন্দর্য্যও মানুষের জীবনে সুখ আনতে পারে না। বরং মাঝে মাঝে তো সৌন্দর্য্যই সুখের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

এই জগৎ সংসার বড়ই বৈচিত্রময়। নাহলে একজনের কাছে যেটা সুখের নাম অন্যজনের কাছে সেটাই কেন অভিশাপ? দুনিয়ার প্রত্যেকটি উপাদানই কি তাহলে আপেক্ষিক?

উর্মি বলল,” আপনি যখন আমাদের ঘরে কেরোসিনের বোতল নিতে আসছিলেন তখনি আমি বুঝছি আপনের মতলব ভালো না। তাই কেরোসিনের বোতলে কইরা পানি দিসিলাম। ভাগ্যিস তখন এই বুদ্ধিটা মাথায় আসছিল নাইলে আজকে আপনেরে আমি বাঁচাইতে পারতাম না। আপনি ক্যান এমন করলেন আপা? ক্যান করলেন?”

উর্মির চোখ দিয়ে গলগল করে পানি বেরোচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে তার চোখ,নাক,গাল। মেহেক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” এই পাগলী, তুই এতো কাঁদছিস কেন?”

” জানি না। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি আপা। আপনের জন্য আমি জানও দিতে পারি।”

” আমার তোর জান লাগবে না। আমি তোর জান দিয়ে কি করবো?”

” জানি না। কিন্তু যদি কখনও প্রয়োজন হয়, আপনার জন্য আমি জান দিয়া দিমু। আপনি কখনও আমাদের ছাইড়া যাইতে পারবেন না আপা। আমি তাইলে খুব কষ্ট পামু।”

আহারে! মেহেকের মনটা খুব খারাপ হলো। তার এই ক্ষুদ্র পরিসরের সর্বনাশা জীবনটাকে বাঁচাতে অন্য একজন তার জান দিয়ে দিতে চাইছে! এতো ভালোবাসা কোথায় পাবে মেহেক? উর্মিকে এই মুহুর্তে কিছু একটা দিতে খুব মন চাইছে। মেহেক বলল,” উর্মি, তুই আমার কাছে এখন বড় কিছু একটা চেয়ে ফেল তো। সাধ্য থাকলে আমি তোর চাওয়া পূরণ করবো।”

” আপাতত আমি চাই আপনি শুয়ে থাকেন, আরাম করেন। আর কখনও এমন করতে যাইবেন না কইলাম।”
উর্মি যেন তাকে চোখ বড় করে হুমকি দিল। মেহেক হেসে বলল,” আচ্ছা, যাবো না যাহ্। তোর চাওয়া পূরণ করলাম।”

উর্মি চোখের পানি মুছে খুব আনন্দের সাথে হাসল। ভোরের আযানের সুর ভেসে আসছে। উর্মি বলল,” আপনি থাকেন আপা। আমি নামাযটা শেষ কইরা আসতাসি।”

” ঠিকাছে।”

উর্মি বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই ফারদিন ভেতরে এলো। তার চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে৷

মেহেক সাথে সাথে উল্টোদিকে ঘুরে গেল। এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার। ফারদিনের দিকে তাকাতেও মন চাইছে না। মেহেকের ডানগাল এখনও উত্তপ্ত হয়ে আছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। ফারদিন নরম গলায় বলল,” স্যরি, মাথাগরম হয়ে গেছিল।”

মেহেক তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নির্দেশ দেওয়ার মতো বলল,” আমার ঘুম আসছে। আপনি লাইটটা নিভিয়ে দিলে আমি একটু ঘুমাবো।”

” তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে চাইছো না মেহেক?”

” না।”

” স্যরি বললাম তো। আর তুমি কি বোকার মতো কাজ করতে যাচ্ছিলে এটা? যদি কিছু হয়ে যেতো?”

” তাহলে কি হতো?”

” কি হতো মানে? তুমি বুঝতে পারছো না কি হতো?”

” হ্যাঁ। আমি মরে যেতাম। কিন্তু তাতে আপনার কি হতো?”

” আমার কি হতো মানে? তুমি মরে গেলে আমার কিছু না?”

মেহেক এইবার শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখ সরু করে কাটকাট কণ্ঠে বলল,” ভুল করেও করুণা দেখাতে আসবেন না আমাকে। আমি কারো করুণার পাত্রী হয়ে বাঁচতে চাই না। এতোদিন তো আমি মরে গেলেও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাহলে এখন হঠাৎ দরদ উতলে উঠছে কেন? আমার দুঃখের গল্প শুনে মায়া লেগেছে? ভাবছেন আপনার করুণা ভিক্ষা নেওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই? তাহলে জেনে রাখুন আপনি ভুল ভাবছেন। কারণ মেহেক কারো দয়ার পাত্রী হয়ে বাঁচার মতো মেয়ে না। আমি কালকেই আমার গ্রামের বাড়ি চলে যাবো। তারপর আপনার সাথে আমার সমস্ত হিসাব শেষ। আপনি আমাকে চুক্তির জন্য বিয়ে করেছিলেন না? আপনার বাগানবাড়ি আপনার কাছেই থাকবে। শুধু আমি আপনাকে মুক্তি দিবো। নিশ্চিন্ত থাকুন।”

ফারদিন চট করে কিছু বলতে নিচ্ছিল তখনই মেহেক হাতজোড় করল,” প্লিজ, নো সিম্প্যাথি। আমি সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য আপনার কাছে এসব শেয়ার করিনি বিশ্বাস করুন। আপনি জানতে চেয়েছিলেন তাই জানিয়েছি। এখন দয়া করে আমাকে দয়া দেখাতে আসবেন না। আমার এই দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবন নিয়ে আমাকে একাই থাকতে দিন। শান্তিমতো বাঁচতে দিন।”

” আর আমি? আমি কিভাবে বাঁচবো?”

ফারদিন ধারালো গলায় প্রশ্ন করল। মেহেক ভ্রু কুঁচকালো। ফারদিন কাছে এসে তৃষ্ণার্তের মতো বলল,” তোমাকে আমি প্রচন্ড মিস করছি মেহেক।এতো কাছে থাকার পরেও মনে হচ্ছে তুমি আমার চেয়ে যোজন যোজন দূরে আছো। আমি এই দূরত্বটা মেনে নিতে পারছি না।”

মেহেক নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করল,” এর মানে কি? কি বলতে চাইছেন?”

” মানেটা খুব পরিষ্কার। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছো না।”

” আপনি কি আমাকে জোর করে আটকে রাখতে চাইছেন?”

” জোর করে নয়, জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখতে চাইছি।”

” কেন চাইছেন? আপনার তো আমার কথা বিরক্ত লাগে, আমার দুষ্টুমি,খুঁনসুটিকে বাচ্চামি মনে হয়। আমি তো ইমম্যাচিউর।”

” আমার এই ইমম্যাচিউর মেয়েটিকেই লাগবে। ”

” আপনার সাথে আমার মেন্টালিটি মিলবে না।”

” মেন্টালিটি চুলোয় যাক। আমি শুধু বেঁচে থাকতে চাই। প্রতি মুহুর্তে স্বস্তিভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য হলেও আমার তোমাকে দরকার। আমার স্বস্তিটা হচ্ছো তুমি।”

ফারদিন মেহেকের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। মেহেক ঝট করে হাত ছাড়িয়ে বলল,” ছাড়ুন আমাকে। আপনার তো সুজি আপুকে বেশি পছন্দ। সে আপনার পাশে থাকলে আপনি আমাকেও ভুলে যান।”

” এখন থেকে তুমি পাশে থাকলে আমি দুনিয়া ভুলে যাবো। নিজেকেও ভুলে যাবো।”

” সব মিথ্যে কথা। আপনি মিথ্যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আমাকে।”

” না মিথ্যে নয়। সত্যি বলছি!”

” আপনি তো আমাকে ভালোই বাসেন না।”

ফারদিন আচমকা এগিয়ে এলো। তীব্র আকুলতা নিয়ে প্রশ্ন করল,” আমার ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার জন্য আমাকে কি করতে হবে বলো?”

মেহেক তৃপ্ত, পরিতুষ্ট। প্রিয় মানুষটির কাছে নিজের জন্য আকুতি দেখার মাঝে যে এতোটা শান্তি তা সে আগে জানতো না! আজকে তার সৌভাগ্যের দিন। চরম খুশির দিন। সে কিভাবে এই খুশি উদযাপন করবে? ফারদিনকে কি করতে বলা উচিৎ?

” আমি সারাদিন কিছু খাইনি। তাই আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। আমি চাই আপনি আমার জন্য রান্না করবেন।”

রান্না করতে গিয়ে আবার হাত পুড়ে ফেলবে না তো ফারদিন? মেহেকের তো পা পুড়েছে৷ ফারদিনের যদি হাত পুড়ে যায়? না, না, মেহেক আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারছে না। এতোক্ষণ ধরে রান্নাঘরে মানুষটা কি করছে? মেহেক শুধু শুধুই ফারদিনকে রান্না করার মতো কঠিন শর্তটা দিল। এখন যদি কোনো বিপদ হয়?

পায়ের যন্ত্রণায় মেহেক টিকতে পারছে না। আগুনে পোড়ার ব্যথা যে এতো তীক্ষ্ণ হয় তা সে আগে জানতো না। মেহেকের কিন্তু একদম ক্ষুধা পায়নি। কিন্তু ফারদিন বলেছে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে সে যেকোনো কঠিন কাজ করতে রাজি। মেহেকও তখন আবদার করল এমন সুস্বাদু কিছু বানাতে হবে যেটা মুখে দেওয়া মাত্রই ফারদিনের ভালোবাসার বিশুদ্ধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে মানুষটা রান্নার ‘র’ অবধি জানে না, সে কি করে মেহেকের জন্য সুস্বাদু খাবার তৈরী করবে? এটা তো নিতান্তই অসম্ভব! কিন্তু ফারদিনের মতে, ভালোবাসার কাছে সবকিছু সম্ভব হতে বাধ্য।’ Nothing is impossible in love।’ এটা ফারদিন নামক মনীষীর কথা।

মেহেকের হাসি পেল। সত্যিই কি ফারদিন তাকে এতো ভালোবাসে?ব্যাথাযুক্ত পা নিয়েই ধীরে ধীরে হেঁটে বহু কষ্টে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছালো মেহেক। পাঁয়ে যে কি অসহ্য যন্ত্রণা লাগছে! ঔষধ দেওয়ার কারণে যন্ত্রণাটা হয়তো তুলনামূলক কম। এটুকুও মেহেক সহ্য করতে পারছে না। অথচ যখন তার শরীরে আগুন দিয়েছিল তখন এতটুকুও যন্ত্রণা অনুভব হয়নি। কেন? এতোটা সাহস তার মধ্যে কি করে এসেছিল? এই সাহসের উৎসটা কি অতীতের বীভৎস স্মৃতিতে দগ্ধ হওয়ার কষ্ট? নাকি ওই মুহুর্তে ফারদিনের হঠাৎ প্রত্যাখ্যান পেয়ে বিষাক্ত দহনে ছাড়খাড় হওয়ার কষ্ট?

মেহেক রান্নাঘরের দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ফারদিন কি করছে? একটা বাটিতে অনেকগুলো টুকরো পাউরুটি রাখা। আচ্ছা, পাউরুটি কোথা থেকে এল? বাড়িতে কি আগেই ছিল? দুইটা ডিম ভেঙে সেই পাউরুটির মধ্যে ছেড়ে চামচ দিয়ে মেশানো হচ্ছে। এইটা আবার কেমন রেসিপি? মেহেক তো আগে কখনও এমন রান্না দেখেনি। আহারে, মাত্র কিছুক্ষণ রান্নাঘরে থেকেই তার সুদর্শন স্বামীটা কেমন ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। মেহেকের বড্ড মায়া লাগছে। সে কি এগিয়ে যাবে একটু?

পোড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে ফারদিনের কপালের ঘাম মুছে দিবে? উহুম, লজ্জা করছে। এই কাজ করা কিছুতেই সম্ভব না। তার চেয়ে ভালো মেহেক আড়ালেই লুকিয়ে দেখুক। মানুষটার সবকিছুই মেহেকের ভালো লাগে। এইযে সে আনমনে কপালের ঘাম মুছে কলের জলে হাত ধুঁয়ে নিচ্ছে, এটাও মেহেকের দেখতে ভালো লাগছে৷ সে হঠাৎ হাচি দিয়ে কপাল কুচকালেও মেহেকের দেখতে ভালো লাগে। সে ধমকালে ভালো লাগে, রাগলে ভালো লাগে,শাসন করলেও ভালো লাগে আর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন তৃষ্ণার্তের মতো তাকিয়ে প্রশ্ন করে,” তোমার কি হয়েছে মেহেক?”

মেহেক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেয়াল খামচে ধরে যখন কথাগুলো চিন্তা করছিল, তার পাঁয়ের যন্ত্রণাটা যেন ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে আসছিল। বরং মনে হলো পাঁয়ে কোনো যন্ত্রণাই নেই। অন্যরকম একটা শিহরণ অনুভব হচ্ছিল। সেই শিহরণের রঙ লাল। ফারদিন পেঁয়াজ হাতে নিয়েছে। রান্নাঘরটা কিন্তু বেশ বড়। দরজার মুখ চুলার পেছনদিকে থাকায় যে রান্না করছে সে মুখ ঘুরিয়ে না তাকালে কোনোভাবেই বুঝবে না যে রান্নাঘরে কেউ ঢুকেছে৷ তাই এই কয়েক মিনিটেও ফারদিন মেহেককে একবারও দেখতে পায়নি।

বেচারা এখন পেঁয়াজ হাতে নিয়েছে। সে গোল পেঁয়াজটা ঠোঁট বাঁকা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। হয়তো চিন্তা করছে কোনদিক থেকে কাটা শুরু করবে। মেহেকের যে কি হাসি পেল! হ্যাঁ মেহেকও রান্না জানে না। কিন্তু অন্তত সবজি কাটা-কুটির মতো সাধারণ বিষয় তো জানে! মাকে রান্নাঘরে কতবার কাটাকুটি করতে দেখেছে সে। সাধারণ জ্ঞান থেকেও তো এইসব বোঝা যায়।

ফারদিন ছুড়ি হাতে নিয়ে পেঁয়াজের মধ্যে খুব জোরে এক কোপ দিল। কিন্তু সেই কোপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ল তার আঙুলে। সাথে সাথেই আর্তনাদে কঁকিয়ে উঠলো সে। মেহেকের যেন হৃৎপিন্ডটা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল। কিসের পাঁয়ে ব্যথা? কিসের যন্ত্রণা? সবকিছু ভুলে সে এক দৌড়ে ফারদিনের কাছে ছুটে গেল।

ফারদিনের লম্বাটে আঙুল থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। খুব বেশি যে কেটে গেছে তা কিন্তু না। তবে রক্ত বের হচ্ছে প্রচুর। তাই দেখে মেহেকের ভয়ে আত্মা কাঁপা-কাঁপি অবস্থা। চোখে পানি চলে এলো। মুখ ভেঙে কেঁদেও ফেলল খানিকটা। ফারদিন ব্যথার দিকে পাত্তা না দিয়ে হাসার চেষ্টা করল। মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” আরে, কিছু হয়নি! আই এম ফাইন!”

” চুপ করুন আপনি। এখনি ঘরে চলুন। কিচ্ছু করতে হবে না। রান্নার গুষ্টি মারি। আল্লাহ, কতটা রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। এভাবে তো আপনার হাতের সব রক্ত শেষ হয়ে যাবে!”

ফারদিন এই কথায় মজা পেয়ে ফিক করে হেসে দিল। মেহেক ফারদিনের আঙুলটা নিজের মুখে পুরে নিল। ফারদিন অবাক হয়ে বলল,” এই, এই, কি করছো? ছি!”

মেহেক রক্ত চুষে নিতে নিতে বলল,” ছি এর কিছু নেই। আম্মা বলেছে, রক্ত বের হলে এমনি করে চুষে নিতে হয়। নাহলে শরীরের রক্ত কমে যায়। কারণ রক্ত পড়তে দিলে তো কমবেই। চুষে নিলে সেটা আবার শরীরেই ফেরত আসবে।”

ফারদিন এই কথা শুনে আরও হাসছিল। মেহেক রেগে আগুন হয়ে বলল,” আশ্চর্য! আপনি হাসছেন কেন? এতোবড় কান্ড ঘটিয়ে আবার হাসতে ইচ্ছে করছে আপনার?”

ফারদিন ভ্রু কুচকে বলল,” কেন? আঙুল কেটে গেলে হাসা নিষেধ নাকি? ”

” জানি না আমি। কিন্তু খবরদার হাসবেন না।”

” কেন হাসছি সেটা আগে বলি, তুমি রক্ত চুষে নিলে তো আমার শরীরের রক্ত তোমার কাছে যাবে। আমার কাছে তো ফিরে আসবে না, তাই না? ”

মেহেক হুশ ফিরে পাওয়ার মতো বলল,” ও, হ্যাঁ তাইতো!

মেহেক এই কথা বলেই আঙুলটা নিজের মুখ থেকে বের করল। তারপর উল্টোদিকে ঘুরে বেসিনের কল থেকে পানি ছাঁড়তে নিচ্ছিল। ফারদিন বলল,” এক মিনিট।”

” হুম?”

মেহেক ঘুরে তাকালো। ফারদিন একদৃষ্টে চেয়ে থেকে তার ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বলল,” তোমার ঠোঁটে কিছু একটা লেগে আছে।”
” কি লেগে আছে?”

মেহেক ঠোঁটে হাত দিতে নিলেই ফারদিন বাঁধ সাধল। ঠান্ডা গলায় বলল,” আমার রক্ত লেগে আছে।”

” ও।”

মেহেক হাত দিয়ে রক্ত মুছে ফেলতে নিচ্ছিল তখন ফারদিন আবারও বাঁধ সাধলো। ” উহুম। এভাবে মুছলে হবে না। তুমিই তো বলেছো, রক্ত চুষে নিতে হয়৷ ”

মেহেক থতমত খেয়ে বলল,” মানে?”

” মানে আমি চুষে নিতে চাই!”

মেহেক লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেল। ফারদিন মেহেকের মুখটা নিজের দিকে টেনে এনে আলতো করে ঠোঁট ছোয়াল তার ঠোঁটে। ধীরে ধীরে স্পর্শটা গভীরতার মাত্রা ছাড়াল। মেহেকের পা দু’টো ক্রমশ উঁচু আর ফারদিন নিচু হচ্ছিল। তারা দু’জন একে-অন্যকে তীব্রভাবে আলিঙ্গন করল। একটা স্বপ্নময় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেল দু’জন। ফারদিনের স্পর্শ ঠোঁট ছাড়িয়ে এবার মেহেকের গলার চারপাশে বিচরণ করতে লাগল। উষ্ণ চু’মুতে সে ভরিয়ে দিতে লাগল মেহের কণ্ঠমণির চারপাশ।

মেহেক ভয়ংকর লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” কেউ চলে আসবে। যদি দেখে ফেলে?”

” কি দেখবে?”

” জানি না।”

ফারদিন নাছোড়বান্দা হয়ে গেল। মেহেকের মুখ দিয়ে স্বীকার করিয়েই ছাঁড়বে এমন দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে বলল,” বলো কি দেখবে?”

ইশশ, ফারদিন ইচ্ছে করে তাকে এভাবে খোচাচ্ছে।আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো! দৌড়ে পালানোরও উপায় নেই। ফারদিন দুইপাশ দিয়ে দেয়ালে হাত ঠেঁকিয়ে তাকে আটকে রেখেছে। মেহেকের উত্তর না পেয়ে ফারদিন আবার প্রশ্ন করল,” কথা বলছো না কেন?”

মেহেক স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় একটু গলা ঝেরে নিল। তারপর পরিষ্কার কণ্ঠে বলল,” আপনি যা করছেন তাই দেখবে।”

” কি করছি আমি?”

মেহেকের মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। মাথা নিচু করে জোরে শ্বাস ফেলে আবারও বলল,” অস*ভ্যতা করছেন।”

ফারদিন ভ্রু কুচকে দূরে সরে দাঁড়াল এবার। দুষ্টুমি বাদ দিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,” কি? অস*ভ্যতা?ঠিকাছে, আর কখনও করবো না। স্যরি।”

ফারদিন কথা শেষ করে হাতের কাটা আঙুলের দিকে নজর দিল। মেহেক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ফারদিনের গম্ভীর মুখটার দিকে চেয়ে বলেই ফেলল,” আচ্ছা ঠিকাছে।”

ফারদিন উদাসীন চোখে তাকালো,” কি ঠিকাছে?”

মেহেক লজ্জা কাটিয়ে বলল,” ঠিকাছে মানে আপনি করতে পারেন।”

ফারদিন সুন্দর করে হাসি দিয়ে বলল,” কি করতে পারি?”

মেহেক লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে কাঁপছে।

ফারদিন আবার জিজ্ঞেস করল,” বলো? কি করতে পারি আমি?”

মেহেক লজ্জার মাথা খেয়ে বলল,” আমাকে আদর করতে পারেন।”

“কি? শুনিনি? আরেকবার?”

” ধ্যাত্তেরিকি!” মেহেক বিরক্তি আর লজ্জায় পালাতে নিচ্ছিল তখনি ফারদিন তাকে টেনে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। মেহেকের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আবার।

চারদিকে নীরবতা। এই মুহুর্তে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্যকিছুই শোনা যাচ্ছে না। ফারদিন খুব কাছে এসে আলতো করে মেহেকের কোমড় জড়িয়ে ধরল। তার তপ্ত নিঃশ্বাস মেহেক অনুভব করতে পারছে। প্রতিটি প্রশ্বাসের সাথে একটা পরিচিত সুগন্ধ লুটিয়ে পড়ছে। এই সুগন্ধই তাকে মনে করিয়ে দেয়, প্রথম দেখাতেই তার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষটির কথা, রাগান্বিত স্বরে ধমক দেওয়া সেই রাগী মানুষটির কথা,যার হাসি দেখতে মেহেক ভালোবাসে, যার ব্যক্তিত্ব মেহেককে মুগ্ধ করে, যার তীক্ষ্ণ নাকের ডগায় জমে থাকা তুখোড় মেজাজটাও মেহেকের অত্যন্ত পছন্দ।

মেহেক চোখ বন্ধ করে আকুল অপেক্ষায় মগ্ন ছিল। এই অপেক্ষা জীবনের প্রথম ভালোবাসার অতুল স্পর্শ অনুভবের অপেক্ষা। কিন্তু অপেক্ষা যেন শেষই হচ্ছে না। ফারদিন এতো দেরি করছে কেন? এখন আর ফারদিনকে অনুভবও করতে পারছে না সে। ফারদিন তার আশেপাশে আছে এটাও মনে হচ্ছে না। আশ্চর্য! কি হচ্ছে? মেহেক কি চোখ খুলে তাকাবে? তাকানোর আগেই ফারদিন হালকা কেশে পরিষ্কার গলায় বলল,
” তুমি তাহলে বিছানায় গিয়ে রেস্ট নাও মেহেক। আমি তোমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসছি।”

মেহেক চোখ খুলতেই দেখতে পেল ফারদিন তার থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে এবং তার পেছনেই উর্মি এসে দাঁড়িয়েছে। মেহেক হতভাগ্য অনুভব করল। এই মেয়েটা কি আসার আর সময় পেল না? ধ্যাত!

চলবে