অনপেখিত পর্ব-১৬

0
127

#অনপেখিত
পর্ব ১৬
লিখা Sidratul Muntaz

” জানেন, আমি যেদিন প্রথমবার আপনাকে দেখি মনে হয়েছিল জীবনের সবচেয়ে সুদর্শন মানুষটিকে দেখছি। আমার দুঃখ দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ জীবনটাকে হয়তো আপনি সুখ দিয়ে পূর্ণ করবেন এবার। আমি ভীষণ খুশি ছিলাম বিয়ের আগের দিন অবধিও।

কিন্তু বিয়ের দিন থেকেই যেন এক চুটকিতে সব বদলে যেতে লাগল। আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানতেই না’রাজ! প্রথম রাতেই বুঝিয়ে দিলেন আমার প্রতি কতটা বিরক্ত আপনি। আমি কিন্তু তখনও হতাশ হইনি। মনের গোপনে কোথাও ঠিকই আশা ছিল যে আপনি একদিন আমায় এক্সেপ্ট করবেন।

জানি আপনি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে বিয়ে করেছিলেন। তবুও মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা ছিল যে আপনি হয়তো আমায় ভালোবাসবেন। কিন্তু বার-বার আমার আশা ভঙ্গ হয়েছে। এখন না স্বপ্ন দেখতেও খুব ভ*য় লাগে আমার। যদি তা ভে*ঙে যায় তাহলে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।

সেদিন ওয়াসীম ভাইয়ার সাথে আপনার কথাগুলো শুনেছিলাম আমি। আমাকে নিয়ে আপনার বিভ্রান্তি শেষ হয়নি তবুও আপনি আমাকে স্পর্শ করেছেন। ভাবতেও অবাক লাগে যে সেই স্পর্শে ভালোবাসা কোথাও ছিল না। শুধু চাহিদা ছিল। সবসময় আমি শুধু পুরুষের চাহিদার বস্তুই হয়ে থাকব কেন বলুন তো? কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা কি আমার নেই?

আপনার জীবনে এসে ইতোমধ্যে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় ফেলেছি আপনাকে। আমি চাই না আপনি আর আমার প্রতি বিরক্তি ধরে রাখুন। তাই আমি বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকবেন।

ইতি
মেহেক।

ডায়েরীর লেখাগুলো পড়ে ফারদিন নির্বাক হয়ে গেছে।সুই*সাইড কর‍তে যাওয়ার আগে ডায়েরীতে হবে এইসব লিখেছিল মেয়েটা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুঁড়ে গেল ফারদিনের। সেই ঠোঁটে আঙুল দিতে গিয়ে সিগারেটের খোঁচায় আঙুলটাও পুড়ে গেল! তার একহাতে চায়ের কাপ,অন্য হাতে সিগারেট ছিল। টেনশনে এই অবস্থা হচ্ছে। সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছে। মনটা বেজায় খারাপ। সাথে মেজাজটাও।

মেহেক তাকে কিছু না জানিয়েই জামাল চাচাকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। ঘুম থেকে উঠে ফারদিন এই ঘটনাটি জানতে পেরে হতভম্ব। আর ডায়েরীর লেখাগুলো পড়ে রীতিমতো বাকরুদ্ধ সে। ফয়জুন্নিসা আজ সকালেই আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। না জানিয়ে এসেছিলেন ছেলে আর ছেলের বউকে সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু ফারদিন বউ নিয়ে চট্টগ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফয়জুন্নিসা চাইছেন ফারদিন যেন যত দ্রুত সম্ভব মেহেককে নিয়ে ঢাকায় ফেরে। এখন সে মাকে কি জবাব দিবে? মেহেক এমন একটা কাজ কেন করল কিছুই বুঝতে পারছে না ফারদিন।

ফারদিন মেহেককে ছাড়াই ঢাকায় পৌঁছাল ভোর ছয়টার মধ্যে। বাড়ি পৌঁছালো সকাল আটটায়। সেখানে সুজানা, আনজীর,ওয়াসীম,পূর্বিতা সব বান্দরের দল একসাথে হাজির হয়েছে৷ তারা ভোর পাঁচটা থেকে এখানে এসে অপেক্ষা করছে মেহেক-ফারদিনকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। ফারদিন যখন ফ্ল্যাটে এসে দরজায় নক করল, ওয়াসীম দরজা খুলে দিয়ে সবাইকে নিয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ফারদিন ঘরে ঢুকে দেখল ড্রয়িং রুম পুরো নীরব। থমথম করছে সিমেন্ট রঙের কার্পেটের মেঝে, সাদা রঙের বল সোফা, নেভানো ঝাড়বাতি। সবকিছু এতো পিনপতন কেন? আর দরজাটাই বা খুললো কে? চারপাশে চোখ বুলিয়ে সে যখন ক্লান্ত পায়ে ঘরে প্রবেশ করল তখনি কলিজা কাঁপানোর মতো দরজার আড়াল থেকে চিৎকার করে উঠলো বন্ধুরা।

ফারদিন ওদের কান্ড দেখে বেজায় বিরক্ত হলো। সুজানা আর পূর্বিতা বাইরে উঁকি মেরে খোঁজার চেষ্টা করছে মেহেক কোথায়? এতক দেরি করে আসার জন্য ফারদিনকে পেটে,পিঠে কিল-ঘুষি মারল ওয়াসীম আর আনজীর।

ফারদিন জিজ্ঞেস করল,” তোরা কখন এসেছিস?”

আনজীর পাঁচ আঙুল দেখিয়ে উত্তর দিল,” ভোর পাঁচটা থেকে এসে বসে আছি তোদের অপেক্ষায়। শালা! এতো দেরি করলি কেন? ডেটিং সেরে আসলি নাকি?”

ওয়াসীম টিপ্পনী কাটল,” আরে ধূর, বউয়ের সাথে আবার ডেটিং কিসের? ওদের জন্য তো মিনি হানিমুন ছিল এটা।”

সবাই হৈহৈ করে উঠলো। ফারদিনের চেহারায় বিরক্তি ভাব প্রকট হয়ে উঠল। মেহেকের নাম শুনেও বিরক্ত লাগছে। সে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা, আম্মু কোথায়? তোদের আম্মুর সাথে দেখা হয়েছে?”

আনজীর মুখ ভার করে বলল,” না,না, আন্টি তো ঘরে দরজা আটকে লুকিয়ে আছে। তুই না এলে আমাদের সাথে দেখাই করবে না।”

” মানে?”

সুজানা বলল,” আরে স্টুপিড, আন্টিই তো আমাদের দাওয়াত করেছে। এখন বল মেহেক কোথায়?”

ফারদিন ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” জানি না।”

” জানি না। ”

” জানিস না মানে? মেহেক আসেনি?”

পূর্বিতা বলল,” আসবে না কেন? ও নিশ্চয়ই ফাজলামি করছে। মেহেক নিচে আছে বোধহয়। আসছে।”

ফারদিন ক্ষীণ গলায় জানতে চাইল,’ আম্মু কই?”

হুট করেই হাজির হলেন মিসেস ফয়জুন্নিসা। ভারী উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন,” কই,কই আমার ডটার ইন লো কই?”

ফারদিন উঠে দাঁড়াল মাকে দেখে। কয়েক কদম এগিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে নিলে ফয়জুন্নিসা ধমক দিয়ে বললেন,” তুই সর, বউমাকে দেখতে দে আগে।”

ফারদিনের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সুজানা ভীষণ অবহেলায় হাত দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো বলল,” যাহ,যাহ, সর,সর! তোর দাম কমে গেছে।”

ফারদিন পিছিয়ে হতাশা ভরা কণ্ঠে বলল,” আসেনি তোমার বউমা।”

সুজানা আর পূর্বিতার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল এবার। ফারদিন মায়ের সাথেও নিশ্চয়ই তামাশা করবে না! ফয়জুন্নিসা কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকালেন,” আসেনি মানে? কেন আসেনি? কোথায় সে? আমি না বার-বার করে বলে দিলাম বউমাকে নিয়ে আসতে? আরে ওকে দেখার জন্যই তো সেই সকাল থেকে বসে আছি।”

” ও না আসতে চাইলে আমি কি করব? আমাকে বলছো কেন? আশ্চর্য! ”

তীক্ষ্ণ মেজাজে কথা বলেই ফারদিন হনহন করে নিজের ঘরে যেতে লাগল। পূর্বিতা জীভ কেটে বলল,” ইশ, ওদের মধ্যে আবার ঝগড়া হয়েছে নাকি?”

সুজানা বলল,” কে জানে কি হলো?”

ফয়জুন্নিসা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার ছেলেটা কি তবে বিয়ে করে সুখী নয়?

দরজা খুলে রুমে ঢুকতেই ফারদিন চমকে উঠলো। তার ঘরের সারা বিছানায় গোলাপের পাপড়ি, মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো বেলী ফুল,দেয়ালে দেয়ালে হালকা আলোর লাইট জ্বলছে, রজনীগন্ধা, অর্কিড ঝুলে আছে। এক কথায় হুলুস্থুল অবস্থা। ফারদিনের মুখ দিয়ে আপনা-আপনিই বেরিয়ে এলো,” হোয়াট দ্যা ফা**ক!”

বিছানার উপর কাঁধের ব্যাগটা ছুড়ে মারল সে। রাগে মাথার শিরা দপদপ করছে। রুমটা ফুলের মিষ্টি সুভাষে ভরে আছে। যা তার রাগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। সুজানা আর পূর্বিতা ধীরপায়ে ফারদিনের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পেছনে আনজীর আর ওয়াসীম।

ফারদিন গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,”এইসবের কি দরকার ছিল?”

ওয়াসীম ইতস্তত মুখে বলল,” তোদের তো বাসর হয়নি। তাই আমরাই ব্যবস্থা করলাম আর কি। সুজানা আর আনজীরের বেলায় চট্টগ্রামে করেছিলাম না? তাহলে তুই বাদ যাবি কেন?”

ফারদিন তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” অনেক উপকার করেছিস। এইবার দয়া করে বের হো। সহ্য হচ্ছে না তোদের।”

” বউয়ের রাগ আমাদের উপর দেখাচ্ছিস কেন? আজব!”

পূর্বিতা জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে দোস্ত? মেহেক কোথায়? তোদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে?”

ফারদিন গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বলল,” মেহেকের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না!”

বন্ধুরা একে-অন্যের দিকে তাকাল। আনজির ফিসফিস করে বলল,” আমার মনে হয় ওকে একা ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। ”

সুজানা বলল,” মেহেকের সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো।”

সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠল ফারদিন,” খবরদার ওকে কেউ ফোন করবি না। আমার পারসোনাল লাইফে আমি তোদের ইনভলব করতে চাই না৷ তোরা নিজেদের চড়কায় তেল দে প্লিজ।”

পূর্বিতা বলল,” এভাবে কেন বলছিস? তোর ভালো-মন্দ দেখার অধিকার বুঝি নেই আমাদের? তাছাড়া মেহেকের ফোন নাম্বার আমাদের কারো কাছে নেই। তাই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না। তোকেই বলতে হবে পুরো ব্যাপারটা। নয়তো আমরা বুঝবো কি করে? বল না কি হয়েছে?”

ফারদিন উঠে বসতে বসতে শীতল গলায় বলল,” মেহেক আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”

সবার চেহারায় বিস্ময় খেলে গেল। সুজানা প্রায় চোখ-মুখ কুঁচকে আওড়াল,” হোয়াট?”

ফারদিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” আমি ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি ও কোথাও নেই। জামাল চাচার সাথে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। অথচ একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজনটাও মনে করেনি। আর কি একটা স্টুপিড লেটার লিখে গেছে। যেন তার চলে যাওয়ার পেছনে সব দোষ আমারই ছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না শা’লা যে আমি কি ভুলটা করলাম!”

সুজানা শ্লেষের ভঙ্গিতে বলল,” আসলেই বুঝতে পারছিস না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভং ধরছিস?”

“মানে?” ফারদিন মেজাজ নিয়ে তাকাল।

সুজানা বলল,” মেহেক যেই কাজটা করেছে, ওর জায়গায় আমি হলে সেটা আরও আগেই করতাম।”

” তুই কি বলতে চাস ক্লিয়ার করে বল।” ফারদিনের গলা চড়ে গেছে। রাগে নাকের ডগা কাঁপছে।

পূর্বিতা ইশারায় সুজানাকে থামতে নির্দেশ দিল। কিন্তু সুজানা শুনল না। সে বলে গেল,” বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েটাকে কতবার কাঁদিয়েছিস তুই হিসাব আছে? নিজের দোষগুলো চোখে পড়ছে না? ও না হয় অভিমান করে চলে গেছে তাই বলে তুইও ওকে না নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসবি? তোর উচিৎ ছিল ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ওর কাছে ক্ষ’মা চাওয়া। তা না করে তুই এখানে এসে মেজাজ দেখাচ্ছিস? দিজ ইজ নট ফেয়ার।”

অনেকগুলো কথা একসাথে বলে থামল সুজানা। ফারদিন খিটমিট করে বলল,” তাহলে কি করা উচিৎ ছিল আমার? ওইটুকু মেয়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো এখন? ওর অভিমান ভা’ঙানোর জন্য ন্যাকামি করব? পারব না এতো ঢং করতে। এমনিতেও যথেষ্ট করেছি আমি। তাতেও যদি ও না বুঝে তাহলে আমার কিছু করার নেই।”

পূর্বিতা বলল,” ঘাড়ত্যাড়ার মতো কথা বলিস না ফারদিন। তোর উচিৎ মেয়েটাকে গিয়ে নিয়ে আসা। আর পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার কিছু নেই। তোকে দেখলে ওর অভিমান এমনিই গলে যাবে। হয়তো ও তোকে পরীক্ষা করার জন্যেই এই কাজটা করেছে।”

ফারদিন রুক্ষ গলায় বলল,” তাই বলে এখনি ওকে করতে হবে এসব? আম্মু কি ভাবছে ওর সম্বন্ধে? এটলিস্ট ও একবার আমাকে জানাতে পারতো!”

আনজীর বলল,” আহা, বাচ্চা মেয়ে। ভুল করেছে। ওকে মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা তো তোর।”

” তাহলে তো ডিসকাশনই শেষ। বাচ্চা মেয়ে বলে ও যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এজন্যই শা’লা আমি বাল্যবিবাহ করতে চাইনি।”

ওয়াসীম ফিক করে হেসে দিল। বন্ধুরা চোখ বড় করে তাকাল ওর দিকে। ফারদিন কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ওয়াসীম বলল,” স্যরি, স্যরি, বাল্যবিবাহের কথা শুনে হাসি পেয়ে গেছে। আচ্ছা মেহেক কি জানে ফয়জুন্নিসা আন্টি যে ওকে ডেকেছেন? জানার পরেও রাগ দেখিয়ে চলে যাওয়াটা তো এক প্রকার বেয়াদবি।”

ফারদিন শান্ত গলায় বলল,” মেহেক আম্মুর কথা কিছু জানে না।”

সুজানা বলল,” তাহলে তো এখানে মেহেকের কোনো দোষই নেই। তুই ওকে বলিসনি কেন?”

” বলার জন্য সময় তো লাগবে বা’ল৷ ও তো সেই সময়টা না দিয়েই চলে গেছে।”

” ঠিকাছে, তাহলে এখন তুই ওকে গিয়ে নিয়ে আয়। আন্টির কথা জানলে ও নিশ্চয়ই না এসে থাকতে পারবে না! প্রবলেম সোলভ!”

ফারদিন চুপ করে রইল। উত্তর দিল না কোনো।

একা একা বাপের বাড়ি চলে আসায় বাসন্তী মেয়ের উপর বেজায় রেগে আছেন। গ্রামের মানুষ এমনিই সব ব্যাপারে খুঁত ধরার জন্য বসে থাকে। মেহেক বিয়ের পর প্রথমবার বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে তাও স্বামী ছাড়া! ব্যপারটা নিয়ে কানাঘুঁষা হচ্ছে খুব। পাড়া-প্রতিবেশীরা আকার-ইঙ্গিতে নানান কথা শুনিয়ে দিচ্ছে বাসন্তীকে। সেজন্যই বাসন্তী রেগে ঢোল হয়ে আছেন। কোনো কথা বলছেন না সকাল থেকে। দুপুরে সবাই যখন খেতে বসবে, মেহেক মুখ ভার করে বলল,” খাবো না আমি।”

মোজাম্মেল শাহ বললেন,” কেন খাবি না? কেউ কি কিছু বলেছে তোকে?”

মেহেক বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে নালিশ জানাল,” আম্মা আমার সাথে কথা বলছে না। আমি যে এসেছি, একবার আমাকে জড়িয়ে পর্যন্ত ধরেনি। যেন এখানে এসে বিরাট অন্যায় করেছি আমি।”

কাঁদো কাঁদো মুখে কথাগুলো বলল মেহেক। বাসন্তী ঝাঁঝ মাখা কণ্ঠে বললেন,” ঢং করবি না ফাজিল মেয়ে। আসার পর থেকে তোকে জামাইয়ের ব্যাপারে কয়বার প্রশ্ন করেছি আমি? কোনো উত্তর দিয়েছিস?”

মেহেক আব্বার দিকে চেয়ে বলল,” এতোদিন পর আমি এসেছি আর আম্মা সকাল থেকে জামাই জামাই করছে, কেমন লাগে বলোতো আব্বা? আমার বুঝি কোনো দাম নেই?”

বাসন্তী বললেন,” বিয়ের পর বাপের বাড়িতে মেয়েদের জামাই ছাড়া কোনো দাম থাকে না৷ এটাই সত্যি কথা!”

মোজাম্মেল শাহ বললেন,” থামো তুমি। কিসব আজে-বাজে কথা বলছো! জামাই আসেনি তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে৷ তাছাড়া এতো বড় ঘরের ছেলে, গ্রামে-টামে এসে অভ্যাস নেই হয়তো৷ আমাদের এখানে থাকতেও ওর কষ্ট হতো। আসেনি এতেই বরং ভালো হয়েছে। এ বছর আমি শহরে ফ্ল্যাট কিনছি না, সেখানেই একেবারে জামাইকে দাওয়াত করব৷ ”

মেহেক সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল,” মোটেও না আব্বা। আমাদের বাড়িতে থাকতে উনার কোনো অসুবিধা হবে না৷ তুমি শুধু শুধু নিজের বাড়িকে ছোট ভেবো নাতো! এই বাড়ি আমার জন্মস্থান। আমার কাছে এই জায়গাই সবচেয়ে সুন্দর। ”

বাসন্তী রাগী কণ্ঠে জানতে চাইলেন,” তাহলে জামাই কেন আসেনি? বল!”

মেহেক চুপ করে রইল। পাশেই মাটির চুলায় বসে রান্না করছিলেন মেহেকের মেজো চাচী। তিনি বললেন,” দেখো গিয়ে আবার জামাইয়ের সাথে ঝগড়া-টগড়া করে এসেছে নাকি তোমার মেয়ে। করতেও পারে, ওর বিশ্বাস কি?”

বাসন্তীর বুক আশংকায় ধুকপুক করতে লাগল। ফারদিন কি মেহেকের অতীতের ব্যাপারে সব জেনে গেছে? সেজন্যই কি মেহেককে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে? ভেবেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল বাসন্তীর। মেয়ের সংসারটা কি তবে আর টিকবে না?

উদাস মুখে পুকুরের ধারে বসে আছে মেহেক। চারদিকে অন্ধকার। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঠিক উঠানের মাঝ বরাবর। সেই আলোতে আশেপাশের পরিবেশ আবছা দেখা যাচ্ছে শুধু। মেহেকের মন গাঢ় বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। সে এখানে এসেছে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গেল অথচ ফারদিন একবার খোঁজ পর্যন্ত নিল না। তার কি মেহেকের কথা একটুও মনে পড়ছে না? ভেবেই ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে লাগল মেহেকের।

বেশ খানিকক্ষণ পর, চাঁদের আনম্র আলোয় মেহেক হঠাৎ দেখতে পেল লম্বা-চওড়া একটা অবয়ব ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পিচ্ছিল রাস্তায় সে খুব সাবধানে হাঁটার চেষ্টা করছে। বাড়ির মাথায় এসে তার পা ভুলবশত কাঁদায় পড়ে গেল। ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে হাঁটছিল ফারদিন৷ তবুও শেষ রক্ষা হলো না৷ তার মুখ থেকে বিরক্তিসূচক শব্দ বেরিয়ে এলো,” শিট!”

বাসন্তী খামারঘর থেকে বেরিয়ে ফারদিনকে দেখে হতভম্ব৷ তার হাতে বেতের ঝুড়ি ধপ করে পড়ে গেল। ফারদিন আন্তরিক হেসে শাশুড়ীকে সালাম দিল।

বাসন্তী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। চেঁচিয়ে মেহেকের বাবাকে ডাকতে লাগলেন। এদিকে মেহেক স্তব্ধ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে অবাক চোখে দেখছে প্রিয় মানুষটিকে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই কি তিনি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন? নাকি ভ্রম?

মেহেককে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাসন্তী ধ’মকে উঠলেন,” এই মেয়ে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেখছিস না জামাইয়ের পায়ে কাঁদা লেগেছে? যা কলপাড়ে নিয়ে যা। জামাইয়ের পা ধুঁয়ে দে।”

মেহেক কথা বলল না। কোনমতে মাথা নেড়ে কলপাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।

মুহূর্তেই আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভ’রে গেছে। সবাই জামাই দেখতে এসেছে। যে-ই ফারদিনকে দেখে, সে-ই মুখ উজ্জ্বল করে বলে ওঠে,” মাশআল্লাহ”

মেহেকের তখন গর্বে বুক ফুলে ফেঁপে ওঠে। এই জীবনে গর্ব করার মতো সে একটা স্বামী পেয়েছে বটে! এই নিয়ে তার আনন্দের শেষ নেই। সবচেয়ে খুশি হয়েছেন ছোট খালা। মেহেকের আসার খবর পেয়েই তিনি প্রায় ছুটি এসেছিলেন। ফারদিনের সঙ্গে তিনি টানা তিন ঘণ্টা গল্প করলেন৷ ছোটখালা সহজে কাউকে পছন্দ করেন না। খুব নাকউঁচু মানুষ তিনি৷ কিন্তু ফারদিনকে প্রথম দর্শনেই পছন্দ করে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি মেহেককে বললেন,” জানিস মা, তোর বর হিসেবে কিন্তু আমি সবসময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছেলেটিকে কল্পনা করেছি। কিন্তু ফারদিনকে দেখার পর মনে হয়েছে ও শ্রেষ্ঠর থেকেও বেশি কিছু।”

গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষ ফারদিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবার এক কথা,” কি সুন্দর বর হয়েছে মেহেকের, আকাশের চাঁদ পেয়েছে মেহেক! সোনার টুকরো ছেলে একদম!”

মেজো চাচী এসব দেখে হিংসায় জ্বলে কয়লা হচ্ছিলেন। ফারদিন আসার পর থেকেই তিনি দরজা আটকে বসে আছেন। মাঝে মাঝে আবার দরজার ফাঁক থেকে উঁকি দিচ্ছেন, আড়ি পাতছেন, তাও নিজে থেকে এসে কথা বলতে আসছেন না।

বাসন্তী খুব ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছেন। এমন হুট করে মেয়ের জামাই চলে আসবে তা কে জানতো। এর মধ্যে মেহেক একবারও ফারদিনের সঙ্গে কথা বলেনি। সে মনে মনে ঠিক করেছে, আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবেও না যতক্ষণ না ফারদিন নিজে থেকে আসবে কথা বলতে!

চলবে