অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-১৯+২০

0
347

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তরীর কান্না থেমে গেল। পেছন ঘুরে তাকাতেই স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো এক পুরুষ অবয়ব। মাহমুদ পায়ের গতি বাড়িয়ে দূরত্ব কমালো। চাঁদের নরম আলোয় ক্রন্দনরত তরীর মুখখানা দেখে ম্লান হাসলো। কোন সতেজতা নেই সেই হাসিতে। নিস্তেজ কন্ঠে শুধালো,
-“বললেন না যে! কাঁদছেন কেন, তরী?”

তরী ফুঁপিয়ে উঠলো। মাহমুদ বলল,
-“আপনার বিয়ে হচ্ছে, এটা তো খুশির খবর। হাতে রিং ও পরেছেন। দেখি তো কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে আপনার হাত!”

মাহমুদের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান টের পেল তরী। কান্না রোধ করার চেষ্টা করলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
-“আমার কিছু করার ছিলো না।”

মাহমুদ হাসলো।
-“সত্যিই কি কিছু করার ছিলোনা? আপনি নিজের অপছন্দ মা-বাবাকে জানাতে পারতেন, তরী। প্রচন্ড ভীতু আপনি। আপনি আমায় বলুন তো, আপনি ঠিক কী চান?”

তরীর চোখমুখ লাল হয়ে আছে। ফিসফিস গলায় আওড়ালো,
-“আপনাকে চাই।”

-“আপনি ভুল বললেন, তরী। আমাকে চাইলে বাবা-মাকে অন্তত নিজের অপছন্দ জানাতে পারতেন। বলতে পারতেন আপনি তিয়াসকে বিয়ে করতে চান না!”

তরী কান্নায় ভেঙে পড়লো। হেঁচকি তুলে বলল,
-“আমি বাঁধা দিতে গেলেই সমস্যা আরো বেড়ে যেতো। বাবা তখনই বিয়ের ব্যবস্থা করে আমায় ঘর থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দিতেন। এতটুকু পর্যন্ত আসার রাস্তা থাকতো না। আমি চিনি আমার বাবাকে। সেজন্যই তখন আমি কিছু বলিনি। চুপ ছিলাম। আমার বাবা খা*রা*প মানুষ নন। কিন্তু তার একরোখা মনোভাবের জন্যই সবাই তার কাছ থেকে দূরে সরে যান। বাবা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতেই অটল থাকবেন। ছোটোবেলা থেকেই আমি বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলিনি। বাবা এখনো তেমনটা ভেবেই বড়ো চাচ্চুকে কথা দিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া তিনি মনে করেন ভাইকে কথা দিয়ে কথা ফিরিয়ে নেওয়া মানে ভাইকে অপ*মান করা। তিনি ইমেজ ধরে রাখার জন্য আমার মতকে কখনোই গুরুত্ব দেবেন না। তখন রিং পরানোতে বাঁধা দিলে আমি এই মুহুর্তে ছাদে আসতে পারতামনা।”

-“ভালো থাকুন, তরী।”
বলে পেছন দিকে পা বাড়ালো মাহমুদ। তরী ধপ করে নিচে বসে পড়লো।
-“আপনি আমায় কেন বুঝতে চাইছেন না! আমি আপনাকে চাই।”

মাহমুদ সিঁড়ি ঘরে পা রাখতে গিয়েও তরীর কথায় থেমে গেল। কদম বাড়ালো তরীর দিকে। একেবারে নিকটে এসে হাঁটু মুড়ে বসলো। থুতনিতে হাত রেখে তরীর মুখখানি তুলে ধরলো। ভীষণ যত্নে মুছে দিলো চোখের জল। তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। থেকে থেকে হেঁচকি তুলছে। মাহমুদ শান্ত স্বরে বলল,
-“আমাকে চাইলে যে সাহসী হতে হবে, তরী। পারবেন আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে?”

তরী কান্নামাখা চোখে বারকয়েক উপর নিচ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে খুব পারবে। মাহমুদ লম্বা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তরীকে নিয়ে। চিকন হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-“চলুন।”

তরী অবুঝের মতো প্রশ্ন করলো,
-“কোথায়?”

-” বিয়ে করব আমরা।”

তরীর পা থেমে গেল। বিস্ময়ে হতবাক তরীর মুখ ফোটে শব্দ বের হলোনা। মাহমুদ মলিন হেসে বলল,
-“আজ যদি এই হাত ছেড়ে যান, তবে আর কখনো আমায় পাবেন না তরী।”

তরীর মাথায় বাজ পড়লো। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো সে। মাহমুদ ফের বলল,
-“নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে শিখুন, তরী। দেখবেন সবটা সহজ হয়ে যাবে।”

হুট করেই এক শীতল হাওয়ায় ভেসে গেল তরী। কেমন করে যেন তার সাহস বেড়ে গেল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহমুদের হাত।
তুষ্ট হলো মাহমুদের হৃদয়। ঠোঁটের কোন জুড়ে মোহনীয় হাসির ঢেউ। তরীর হাতে হাত রেখে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। পকেটে হাতড়ে ফোন বের করে কাকে যেন কল দিলো। তরীকে নিয়ে রওনা হলো। গন্তব্য তরীর জানা নেই। সে নির্ভয়ে মাহমুদের সাথে এগিয়ে গেল। কারো সিদ্ধান্তকে পরোয়া করলো না মাহমুদ। ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টার ঘরে পৌঁছাতে ঢের বাকি। হুট করেই মনে পড়লো কিছু জিনিস প্রয়োজন। তরীকে ঘরে পাঠালো তার নিবন্ধন কার্ডের জন্য। এক ফাঁকে নিজের কাগজপত্র গুলো নিয়ে বেরিয়ে এলো। ভাগ্যিস মিঠু তাকে সবটা জানিয়েছে।

তরী ভয়ে ভয়ে নিবন্ধন কার্ড লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই মায়ের সামনে পড়লো।
-“রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছিস?”

তরী তোতলানো শুরু করলো,
-“ছা… ছাদে।”

মায়ের ভুরু কুঁচকে গেল। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“ছাদে কী করতে যাচ্ছিস?”

তরী হুট করেই বলে দিলো,
-“তিয়াস ভাইয়া কল দিয়েছেন। অরু ঘুমাচ্ছে তো, তাই ছাদে যাচ্ছি।”

মায়ের শরীরটা খা*রা*প লাগছে। তিয়াসের কথা বলায় মনে মনে খানিকটা খুশি হলেন। বললেন,
-“বারান্দায় কথা বললেই পারিস। যাচ্ছিস যখন ছাদে বেশিক্ষণ থাকার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”

-“আচ্ছা।” বলে তরী বেরিয়ে পড়লো। দরজার বাইরে বেরিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। হুট করে তার মাথায় এত বুদ্ধি কোথা থেকে এলো, ভেবে পেলো না। মাহমুদ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কোন সমস্যা হয়েছে?”

তরী মায়ের কথা খুলে বলতেই মাহমুদ তরীকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। সিএনজি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যেতেই তরীর ভয় হলো। আবারও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো। একবার মনে হলো লুকিয়ে এভাবে বিয়ে করা কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আবার মনে হলো এভাবে না হলে সে কখনো মাহমুদকে পাবেনা।
তরীর ভয়কাতুরে চেহারায় তাকিয়ে মাহমুদ তার হাতটি শক্ত করে ধরলো। চোখে চোখ রেখে ভরসার গলায় বলল,
-“আমি আছি তো, তরী।”

তরী ভরসা পেলো। নতুন এলাকায় মাহমুদের নতুন কিছু চলার সঙ্গী হলো। তারমধ্যে একজন তার কলিগ। সাক্ষী হিসেবে তারা থাকবে।
বিয়ে পড়ানোর সময় যখন তরীর অনুমতি চাওয়া হলো তখন তরী টলমল চোখে বসে রইলো। বুক কাঁপছে তার, হাত কাঁপছে থরথর করে। তরী কিছুই বলছেনা। মাহমুদের চেহারা মলিন হয়ে এলো। বলল,
-“আপনি না চাইলে আমরা বিয়েটা করবো না, তরী। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই।”

তরী চমকে তাকালো। মাথায় একটা ভাবনাই ঘুরপাক খেলো। এখান থেকে এভাবে ফিরে যাওয়া মানে তিয়াস ভাইয়ার সাথে জুড়ে যাওয়া, মাহমুদকে হারিয়ে ফেলা। তার সাধ্য নেই বিয়েটা আটকানোর। কেউ তার কথা শুনবেনা। তরী হুট করেই সম্মতি দিয়ে বসলো। মাহমুদ অবাক হওয়ার পাশাপাশি প্রশান্তি অনুভব করলো। সুখ সুখ অনুভূতি হলো। সাদামাটা ভাবে বাসার জামা পরেই বিয়েটা হয়ে গেল। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তরীকে নিয়ে গাড়ির খোঁজে ফুটপাত ধরে হাঁটলো মাহমুদ। তার ইচ্ছে হলো আজ রাতটা তরীকে নিয়ে শহরের আনাচকানাচে ঘুরবে। কিন্তু এখন বাসায় না গেলে তারীকে বি*প*দে পড়তে হবে। আপাতত পরিস্থিতি ঘোলাটে না করাই ভালো।

তরীর এই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে। হুট করে তো বিয়েটা করে নিলো, এখন কিভাবে মাহমুদের চোখে চোখ রাখবে? কিভাবে কথা বলবে ভেবেই অস্থির হয়ে উঠলো। শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসছে। মৃদু মৃদু শরীর কাঁপছে। মাহমুদের হাতের মুঠোয় থাকা নরম হাতের কম্পন টের পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাহমুদ। সরাসরি চোখ রাখলো তরীর লজ্জায় আরক্তিম মুখে। মাথা নিচু, চোখের পাপড়ি পলক ঝাপটাবার সাথে সাথে নড়েচড়ে উঠছে। মাহমুদ এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। তরীর হাত ছেড়ে নিজের দুহাতে কোমল গালজোড়া আলতোভাবে স্পর্শ করলো। গভীর চুম্বন করলো তরীর কপালে। তরী শক্ত হয়ে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো। তা দেখে হাসলো মাহমুদ। তাদের পবিত্র স্পর্শের সাক্ষী হলো ল্যামপোস্টের আলো, শাঁ শাঁ গতিতে চলমান গাড়ি, আকাশের চাঁদ।

তরী কাঁপা স্বরে বলল,
-“মা আমার খোঁজ করবেন।”

মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালো। পেলব কন্ঠে শুধালো,
-“আপনি খুশি তো, তরী?”

তরী মুখে জবাব দিলো না। সেদিনের মতো আজও মাহমুদের কনিষ্ঠ আঙুল মুঠোয় পুরে নিলো। ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে লজ্জালু হাসি। মাহমুদ স্বস্তি পেলো। তরী তার। একান্তই তার। শত বাঁধা আসলেও সে লড়ে যাবে, শুধু তরীকে তার পাশে চাই। মাহমুদ ভাবলো হুট করেই কেমন মেয়েটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লো সে। প্রথম প্রথম লজ্জা পাওয়া মেয়েটাকে আরেকটু লজ্জা দিয়ে ভড়কে দিতে দারুণ লাগতো। সেই দারুণ লাগা থেকেই তার বুকে ভয়*ঙ্কর প্রেমনদী তৈরি হলো।
সময়ের অভাবে দুজনের একসাথে আর খাওয়া হলোনা, সময় কাটানো হলোনা। তরীকে চারতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মাহমুদ তিনতলায় নেমে পড়লো। বাবা আর মা এখনো জেগে আছেন। ঘড়ির কাঁটা এগারো এর ঘর পেরিয়েছে। বাবার চোখমুখ শক্ত। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

তরী ঢোক গিললো। মা যেহেতু পাশে আছে, তারমানে ছাদ চেইক করে এসেছেন। সে তো মাকে ছাদে যাচ্ছে বলেই বেরিয়ে গেল। বাবাকে এখন কী জবাব দেবে?

#চলবে………

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বাসার পরিবেশ বেশ থমথমে। বাবার চোয়াল শক্ত, মায়ের চোখেমুখে চিন্তার আভা। ভয়কাতুরে তরীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। শুরু হলো কাঁপা-কাঁপি। ভয়ে বুক ধড়ফড় করে উঠছে। কন্ঠ নালি কাঁপছে। কী জবাব দেবে বাবাকে? বাবার ধারালো নজর তরীর তটস্থ চোখজোড়া দেখতে ব্যস্ত। জবাবের আশায় উৎকণ্ঠিত। তরীকে চুপ থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিলেন,
-“কথা বলছো না কেন? তোমাকে নিয়ে চিন্তা হয় না আমাদের?”

তরী কেঁপে উঠলো বাবার ধমকে। চোখে পানি টলমল করছে। রোধ হয়ে আসা কন্ঠ নালি ভেদ করে উচ্চারণ করলো,
-“বাবা আ..

-“আমি ছাদে ছিলাম বলে তোমার মেয়ে সোজা নিচে চলে গিয়েছে। নতুন নতুন বিয়ে ঠিক হলে ঢং বেড়ে যায়, হুহ।”

মিঠুর কন্ঠে ঠাট্টা প্রকাশ পেলেও আলগোছে সে বোনকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আছে। সে আন্দাজ করে নিয়েছে তরী মাহমুদের সাথেই ছিল। তরী চকিতে তাকালো মিঠুর দিকে। বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন,
-“আমি বাইরে থেকে আসার সময় তো দেখলাম না তোমায়।”

তরী থেমে থেমে বলল,
-“পেছন দিকে ছিলাম।”

বাবা এবার বড়োসড়ো ধমক দিলেন।
-”এতরাত পর্যন্ত বাড়ির পেছনে কী? তুমি জানো কত বি*প*দ হতে পারে?”

তরী মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবা ফের বললেন,
-“আর যেন এভাবে রাতবিরেতে বেরতে না দেখি। কথা বলার দরকার হলে ঘরে বসে কথা বলবে। যাও ঘরে যাও।”

আদেশ পেয়ে তরী কৃতজ্ঞ চোখে মিঠুর দিকে তাকালো। অল্পবয়সী মিঠু কত সহজেই বুঝদার হয়ে গেল। সবার আড়ালে একটুখানি হাসলো মিঠু। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো তরী। এখনো বুকের কাঁপন থামেনি। চোখ বুজে এলোমেলো ভাবে শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়। ফোনের আলো জ্বলছে অনেকক্ষণ ধরে। সাইলেন্ট থাকায় শব্দ হচ্ছে না। তরী ফোন উঠিয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখলো। মাহমুদ কল দিয়েছে। হুট করেই কেমন ভালোলাগা অনুভূত হলো, সাথে একরাশ ভয়। সামনে কোন ঝা*মে*লা অপেক্ষা করছে সেই ভয়টাই তরীকে কাবু করে নিচ্ছে। ধীরেসুস্থে মাহমুদের কল রিসিভ করলো। কথা বললোনা। মাহমুদ কোমল স্বরে ডাকলো,
-“তরী।”

চোখজোড়া আবেশে নিভে গেল তরীর। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো যেন। এত কেন ভালোবাসা মেশানো গলা তার? তরীর সাথে সাথে রাগ হলো। সবার সাথেই কি এমন মধুর সুরে কথা বলে? গাল ফুলিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাহমুদ তরীর চুপ থাকাতে উৎকণ্ঠিত হলো। জিজ্ঞেস করলো,
-“কোন সমস্যা হয়েছে, তরী?”

তরী রাগত স্বরে জবাব দিলো,
-“হলেই বা আপনাকে বলতে হবে কেন?”

মাহমুদ অডিও কল কে*টে ভিডিওতে আসলো। তরী গাল ফুলিয়ে সময় নিয়ে রিসিভ করলো। তবে ব্যাক ক্যামেরা অন করে বসে রইলো। মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“কী সমস্যা তরী? না বললে আমি বুঝবো কিভাবে? সামনে আসছেন না কেন?”

তরীর হুট করেই মনে হলো সে একটু ন্যাকা টাইপ আচরণ করছে। ভেবেই তার লজ্জা হলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে ক্যামেরার সামনে আসলো। মাহমুদ ফের শুধালো,
-“এবার বলুন, কী হয়েছে? কেন এত রাগ আমার ওপর?”

তরী মাথা নাড়ালো। বলল,
-“বাবা-মা জেগে ছিলেন। প্রশ্ন করছিল অনেক, সেজন্যই একটু মেজাজ খা*রা*প ছিলো।”

তরী ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে স্পষ্ট খেয়াল করলো মাহমুদের কপালে চিন্তার রেখা ফোটে উঠেছে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কী বলেছেন আপনি? কোন বড়োসড়ো সমস্যা হয়েছে?”

তরী মাহমুদকে আশ্বস্ত করলো।
-“চিন্তার কিছু নেই। মিঠু সবটা সামলে নিয়েছে।”

গাল ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ।
তার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। তরীকে ভীষণ আদুরে আদুরে লাগছে। ইচ্ছে করছে একটুখানি ছুঁয়ে দিতে। মেয়েটা তখন লজ্জাবতী গাছের মতো মিইয়ে যাবে, লুটিয়ে পড়বে তার বুকে। নিজেকে সামলে নিলো মাহমুদ। বলল,
-“এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।”

তরীর একটু মন খা*রা*প হলো। তবে টুঁশব্দ করলোনা। বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিলো মাহমুদের কথা। কল কেটে ঘুমাতে গেল। তার ঘুম হচ্ছে না। চোখ বুজলেই বারবার মানুষটি এসে কল্পনায় ধরা দিচ্ছে।
শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়লো তরী।

কল কে*টে মাহমুদ ঘুমালোনা। বারান্দায় দাঁড়ালো। চিন্তা করলো পরবর্তী ধাপ নিয়ে। এক সপ্তাহের মাঝে তরীর বিয়ে। তার আগেই সবটা সবাইকে জানাতে হবে। তরীর বাবা-মা জানার পর ভয়াবহ তান্ডব শুরু হবে। পরিবারকে না জানিয়ে এভাবে তরীকে বিয়ে করার ইচ্ছে তার ছিলোনা। পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছে। তরীকে পাওয়ার জন্য এই অন্যায় টুকু করতে হলো তাকে। তার ভ*য় হয় তরীকে নিয়ে। মেয়েটা পরনির্ভরশীল। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেনা। কখনো যদি মা-বাবার কথায় তার হাত ছেড়ে দেয়? বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালা করছে। মাহমুদ আর ভাবতে পারলোনা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

★★★

নাস্তার টেবিলে বসেও তরী খেতে পারলোনা। বুকের ভেতর ধুকধুক করছে। আতঙ্ক নিয়ে বসে আছে সবার সামনে। এই বুঝি বাবা সন্দেহজনক কিছু একটা প্রশ্ন করে বসলো। মা জিজ্ঞেস করলেন,
-“খাচ্ছিস না কেন, তরী?”

-“আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা।”
বলে তরী উঠে পড়লো। ব্যাগ কাঁধে তুলে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। মাহমুদের অপেক্ষা না করেই রিকশা নিয়ে চলে গেল। বাস স্টপেজে এসে অশান্ত চোখ দুটো মাহমুদকে খুঁজে বেড়িয়েছে। একটা বাস মিস দিলো। এই বাস মিস দিলে ক্লাস ধরতে পারবেনা। তাই একরাশ মন খারাপ নিয়েই বাসের সিটে চড়ে বসলো তরী। আকাশে কালো মেঘ জমলো। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে গেল। তরী বিষন্ন হলো। আকাশেরও বুঝি তার মতই মন খা*রা*প! জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলো।

লেকচার শেষ দিয়ে বের হলো তরী। চোখজোড়া বরাবরের মতোই মাহমুদকে খুঁজলো। মানুষটি কোথাও নেই। তীব্র মন খা*রা*প নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। কল দিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। তরী বাসে চড়তে যাবে এমন সময় হাতের কব্জিতে টা*ন পড়লো। আৎকে ওঠা তরী পিছু ফিরতেই দেখতে পেল চেনা মুখ। ঘেমে-নেয়ে একাকার, ক্লান্ত চেহারা। এলোমেলো চুল, চুপেচুপে ঘামে ভিজে আছে পরনের শার্ট।
তরীকে একপাশে টে*নে আনলো মাহমুদ। তরীর মায়া হলো, তবে গাঢ় হলো অভিমান। সারাদিনে তার কোন খোঁজ নেই। মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। মাহমুদ মলিন চেহারাতেও কেমন নিখুঁত হাসলো। শব্দহীন সেই হাসিতে তন্ময় হয়ে রইলো তরী। তার সমস্ত রাগ, অভিমান গলে পড়লো বরফের মতো। মাহমুদ বলল,
-“রা*গ করেছেন, তরী? সরি! সারাদিন দৌঁড়ঝাপের উপর ছিলাম। নতুন বাসা খুঁজতে বেরিয়েছি ক্লাস শেষ দিয়ে।”

তরী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
-“নতুন বাসা কিসের জন্য?”

মাহমুদ মেকি আফসোসের স্বরে বলল,
-“শশুর আব্বা ওয়ার্নিং দিয়েছেন যাতে দ্রুত নতুন বাসা খুঁজে নিই। উনার বাসায় থাকা চলবেনা।”

তরী ব্যথিত হলো। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছে। মানুষটিকে আর দেখবেনা সে! হুট করে তার চোখ পড়লো মাহমুদের ডান হাতে। চামড়া উঠে রক্ত ঝরছে। বিচলিত হয়ে মাহমুদের হাত টে*নে নিজের হাতের ভাঁজে তুলে নিলো। ছুঁয়ে দিলো কা*টা হাত। ব্যথাতুর কন্ঠে শুধালো,
-“কিভাবে এমন হলো?”

মাহমুদ হাত সরিয়ে নিলো। বলল,
-“কিছুনা। গাড়ি থেকে নামার সময় চলন্ত রিকশার সাথে লেগে সামান্য একটু লেগেছে। ঠিক হয়ে যাবে।”

তরী গরম চোখে তাকালো। রাগী গলায় বলল,
-“কতটুকু সামান্য আমি দেখতেই পাচ্ছি। চলুন আমার সাথে।”

মাহমুদকে টে*নে একটা ফার্মেসিতে নিয়ে গেল। ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো হাত। মাহমুদ তরীর পাগলামোতে হাসছে। তার ভীষণ সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। কে বলবে এই রণচণ্ডী রূপ ধারী মেয়েটি একটুখানি লজ্জা পেয়েই নুইয়ে পড়ে! ফার্মেসি থেকে বেরিয়ে মাহমুদ বলল,
-“খিদে পেয়েছে, তরী। দুপুরে খাওয়া হয়নি আমার।”

-“খেলেন না কেন? কিসের এত ব্যস্ততা আপনার?”
তরীর অধিকারবোধ মাহমুদকে ভীষণ অবাক করে তুলছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এই মেয়েটি তার লজ্জাবতী তরী। মাহমুদ তাকে জ্বালানোর পায়তারা খুঁজলো। করুণ গলায় বলল,
-“ডান হাতে ব্যথা হচ্ছে, তরী। খাবো কিভাবে? আপনি খাইয়ে দেবেন?”

কোথা থেকে সমস্ত অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরলো তরীকে। অশান্ত হয়ে বারবার চোখের পলক ঝাপটালো। মাহমুদ মৃদু হেসে বলল,
-“আচ্ছা সমস্যা নেই। বাসায় গিয়ে খেয়ে নেব।”

বাসায় যেতে এখনো ঢের দেরি। তরী নিচু গলায় বলল,
-“চলুন, আমি খাইয়ে দেবো।”

মাহমুদের চোখজোড়ায় ঝুমঝুম করা খুশি। সাথে খেয়াল করলো তরীর গাল দুটো ক্রমশ লাল হয়ে ফুলে উঠছে। ইচ্ছে হলো একবার গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে। পরক্ষণেই নিজের ইচ্ছেকে দমন করে হাত গুটিয়ে নিলো। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাবার অর্ডার করলো মাহমুদ। আধাঘন্টা পর দু’জনের খাবার দিয়ে গেল। মাহমুদের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরতেই তরী স্পষ্ট টের পেল, তার হাত অসম্ভব কাঁপছে। শরীর কাঁপছে। মাহমুদ শব্দ করে হাসলো। বলল,
-“ঠিক আছে তরী, আমি চামচ দিয়ে খেয়ে নেব। রেখে দিন।”

তরী রাখলোনা। কাঁপা হাত বাড়িয়ে ধরলো মাহমুদের মুখের সামনে। অরু আর মিঠুকে কতবার মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে, অথচ এখনই তার যতসব কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো। মাহমুদ বলল,
-“নিজে খাচ্ছেন না কেন?”

নিচু স্বরে জবাব দিলো তরী,
-“পরে খাবো।”

মাহমুদ তার কথা শুনলোনা। বলল,
-“আপনি এখনই খাবেন।”

তরী আর না করলোনা। মাহমুদকে খাওয়ানো ফাঁকে ফাঁকে নিজেও খেয়ে নিলো। বিল মিটিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতেই তরী চোখমুখ অন্ধকার করে বলল,
-“কবে উঠবেন নতুন বাসায়?”

-“কালই উঠবো।”

তরীর ভেতরটা তড়াক করে উঠলো। টলমল চোখ লুকিয়ে মাথানিচু করে হাঁটলো। জনমানবহীন নির্জন পথে এসেই থেমে গেল মাহমুদ। এদিকটায় মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। তরীর থুতনিতে হাত রেখে মুখ উঁচু করলো। ভেঁজা চোখদুটো যত্ন করে মুছে দিলো। ডান গালে ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিলো, অতঃপর বাঁ গালে। তরী চোখ বুজে নিলো। তার বন্ধ চোখের পাতাতেও ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিলো মাহমুদ। অনুরাগী স্বরে বলল,
-“যেখানেই থাকি না কেন? আপনি আমার হৃদয়ে থাকবেন, তরী।”

#চলবে….