#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বিষন্নতায় নিস্তেজ হয়ে আসা তরীর চোখ জোড়া আশার আলো দেখলো। টলমলে চোখ সতেজ হলো। মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখের পাতা বন্ধ করে ভরসার দৃষ্টিতে তাকালো।
আয়েশা সুলতানা সামনে ঘোর বি*প*দে*র আশঙ্কা করছেন। অন্যকিছুকে ভয় পান না তিনি। ভয় শুধু সম্মান নিয়ে। কেউ যেন তার, তার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলতে না পারে। এসব তার অন্তরে সহ্য হবেনা। তিনি এবার খানিকটা নরম হলেন। দরজার দিকে আগত তরী আর মাহমুদকে থামিয়ে বললেন,
-“তোমরা যা করেছো, তাতে আমার যেমন খা*রা*প লাগছে! তেমন তরীর মা-বাবার ও খা*রা*প লাগবে। এটা স্বাভাবিক। কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারার মতো অসম্মান আর কিছুতে নেই। তরীর বাবা ভাইয়ের কাছে অসম্মানিত হয়ে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। তরী বাবা-মা থেকে দূরে সরে যাবে।”
তরীর ভেতরটা অজানা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা-মা তাকে দূরে ঠে*লে দিলে সে সইতে পারবেনা। বাবা সত্যটা জানার পর তাকে মা*রু*ক, কা*টু*ক সে কিচ্ছুটি বলবেনা। তবে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পারবেনা। তার সবাইকে চাই। কেন সবার মতের এত অমিল? বাবা তার মতামত না নিয়ে চাচাকে কথা না দিলে কি খুব ক্ষ*তি হয়ে যেত? অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো তরী। মাথার ভেতর বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীর আর এগোতে চাইছেনা। মাহমুদের হাত ছাড়িয়ে ধপ করেই নিচে বসে পড়লো। চমকে উঠে দ্রুত তরীকে ধরলো মাহমুদ। রামি আর আয়েশা সুলতানাও এগিয়ে এলেন। তরীকে ধরে বসিয়ে দিলেন। পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরে বললেন
-“পানি খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”
ঢকঢক করে সবটা পানি গিলে নিলো তরী। গলাটা যেন শুকনো মরুভূমি হয়ে ছিল। মাহমুদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“বেশি খা*রা*প লাগছে, তরী?”
তরী এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে জানালো সে ঠিক আছে। তেজহীন গলায় বলল,
-“আমি বাসায় যেতে চাই।”
ঘন্টাখানেক আগের হাসিহাসি মেয়েটা কেমন দুঃখের সাগরে হারিয়ে গেল। ক্ষণিকেই জীবন হয়ে উঠলো দুর্বিষহ। মাহমুদ উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
-“তুমি আগে ঠিক হও। তারপর বাসায় যাবে।”
তরীর একরোখা শান্ত জবাব।
-“এক্ষুণি বাসায় যাবো আমি।”
আয়েশা সুলতানা বাঁধ সাধলেন।
-“তোমাকে ঠিক লাগছেনা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। তারপর বাসায় যেও।”
তরী মলিন ঠোঁটে হাসলো। চোখ জোড়া নিভু নিভু। ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
-“আমি ঠিক আছি। এখন বাসায় না গেলে দেরি হয়ে যাবে। সাধারণত ক্লাসের পর আমি বেশিক্ষণ বাইরে থাকিনা।”
এবার কন্ঠে জোর দিলেন আয়েশা সুলতানা।
-“আসার আগে এসব ভাবা উচিত ছিল। খেয়ে একটু আরাম করে তারপর যাবে। নয়তো মাহমুদ তোমায় দিয়ে আসবেনা।”
তরীর এই বিষন্নতার মাঝেও বড্ড হাসি পেল। তবে চেপে রাখলো সে হাসি। যেন সে ছোট্ট অরু। বাসায় না দিয়ে আসলে সে যেতে পারবেনা।
তরীকে রেখে দিলেন আয়েশা সুলতানা। খাবার খেয়ে একেবারে বের হলো। দালানের বাইরে বেরিয়ে মাহমুদ আলতো হাসলো। তার ঠোঁটের ওই নিটোল হাসি তরীকে একবুক প্রশান্তি এনে দেয়। বরাবরের মতো এবারও মুগ্ধ হলো সে। মাহমুদ কোমল স্বরে বলল,
-“দেখলে তো, মা কেমন গলে গেল। ঠিক এভাবেই তোমার বাবাকে মানিয়ে নেব।”
তরী বিদ্রুপ হেসে বলল,
-“এত সহজ না। বাবা কঠিন মানুষ।”
চোখে চোখ রাখলো মাহমুদ। অপলক তাকিয়ে রইলো শান্ত চোখে। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-“যদি গলাতে পারি? কী দেবে আমায়, তরী?”
তরীও একইভাবে জবাব দিল,
-“আপনি কী চান?”
মাহমুদ মৃদু হাসলো। চোখজোড়া ক্ষীণ করে বলল,
-“সেটা নাহয় সময়ই বলবে।”
তরী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। তবে কিছু বললো না। মাহমুদ তাকে নিয়ে সিএনজিতে চড়লো। তরীর হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিলো। বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁইয়ে দিলো তরীর হাতের তালুতে। ভুরু কুঁচকে শুধালো,
-“মেয়েদের সবার হাতই কি এমন তুলতুলে থাকে? মিতুর হাতও যতবার ধরেছি, ততবারই এমন লেগেছে।”
তরীর চোখে প্রশ্নের মেলা। বুকের ভেতর অজানা আতঙ্কের ঢেউ। ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে রোধ হয়ে আসা গলায় শুধালো,
-“মিতু কে?”
মাহমুদ নিঃশব্দে হাসলো। তরীর এই ভয়কাতুরে চেহারা তাকে বড্ড আনন্দ দিচ্ছে। মেয়েটা তাকে নিয়ে জেলাস ফিল করে। ব্যাপারটা তার ভালোলাগলো।
জবাব না পেয়ে তরীর ভেতরটা তড়পাচ্ছে। কোথা থেকে এক আকাশসম অভিমান এসে জড়ো হলো। মুখ ঘুরিয়ে চলন্ত গাড়ির বাইরে তাকালো। গালদুটোর ফোলা ভাব ক্রমশ বাড়ছে। মাহমুদ মিটিমিটি হাসলো। আর অভিমান বাড়তে দেওয়া যায়না। অনুরাগী স্বরে ডাকলো,
-“তরী!”
লাভ হলোনা, তাকালোনা তরী। বরং তার হাতের মুঠোয় থাকা নিজের চিকন হাত ছাড়িয়ে নিলো। মাহমুদ আরেকটু কোমল হল।
-“তাকাও না,তরী!”
এবারও তরীর অবস্থার পরিবর্তন হলোনা। অভিমানে চোখজোড়া পানিতে চিকচিক করছে। মাহমুদ জোর করে তার দিকে ফেরালো। গোলগাল মুখশ্রী আঁজলা করে দু-হাতের ভাঁজে তুলে ধরলো। যত্ন করে মুছে দিল ওই নোনাজল। মাহমুদ বলল,
-“আমার অভিমানিনী, এত অভিমান কেন কর? মিতু আমার বোন। তোমার জায়গা শুধুই তোমার।”
তরী নাক টা*ন*লো। অভিমানের বরফ গলে পড়লো। নিজের কাজে এবার ভীষণ লজ্জা হলো। তার চোখে অল্পতেই পানি এসে যায়। সে চাইলেও কিছুতেই আটকাতে পারেনা। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো ভাবে ফেললো। মাহমুদ বুঝতে পেরে হাসলো। বলল,
-“তোমার রাগ, অভিমান, পাগলামি সব তো আমার জন্যই।”
তরীর নাক টে*নে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো মাহমুদ। সামনের পথেই সে নেমে যাবে। সিএনজি তরীকে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। সামনেই নেমে পড়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল মাহমুদ। তাকে পেছনে ফেলে সিএনজি এগিয়ে গেল। তরী মাথা বের করে পেছনে তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ না মাহমুদ দৃষ্টি সীমানার বাইরে যায়। মাহমুদ অদূরে মিলিয়ে যেতেই তরী সামনে দৃষ্টি ফেরালো। স্মৃতি রোমন্থন করে হাসলো মেয়েটা। আগে মাহমুদকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াতে চাইতো। আর এখন তার পরিবর্তন ঘটেছে। মন সারাক্ষণ মানুষটার কাছাকাছি থাকতে চায়।
বাসায় ফিরেই দেখলো মায়ের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তরী জামাকাপড় পাল্টে বাবাকে ফোন করলো। মিঠু বিকেলে খেলতে বেরিয়েছে, এখনো আসেনি। মা তরীকে বাঁধা দিলেন। দুর্বল গলায় বললেন,
-“আমি ঔষধ নিয়েছি। তুই এত অস্থির হবিনা।”
কয়েকদিন ধরেই জ্বর আসছে যাচ্ছে। তরীর মা কাউকেই জানায়নি। এখনও ভালোভাবে জ্বর এসেছে। প্রচন্ড ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। তরী দুটো কম্বল নামিয়ে মায়ের শরীরে দিল। তবুও কাঁপুনি কমছেনা। পাশে অরু মুখ ছোটো করে দাঁড়িয়ে আছে। তরী আর মায়ের বাঁধা মানলোনা। বাবাকে বারকয়েক কল দেওয়ার পর তিনি ব্যাক করলেন। তরীর চোখে পানি, গলা ধরে আসছে। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
-“বাবা, মায়ের প্রচন্ড জ্বর এসেছে। শরীর কাঁপছে। কাঁথা, দুটো কম্বলেও কাঁপুনি কমছেনা।”
তরীর বাবা চিন্তিত হলেন। বললেন,
-“একটু অপেক্ষা কর। আমি এক্ষুণি এসে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”
কান থেকে ফোন নামিয়ে মায়ের পাশে বসলো তরী। কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মিঠু হেলেদুলে বাসায় ফিরলো। স্বভাবসুলভ মা মা বলে কয়েকবার হাঁক ছাড়লো। মায়ের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে মায়ের ঘরে আসলো। অরু ভীত চোখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। তরী আপু মায়ের কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মায়ের চোখমুখ ফ্যাকাশে, কেমন শুকনো হয়ে আছে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো মিঠু। জিজ্ঞেস করলো,
-“মায়ের কী হয়েছে আপু?”
তরী চোখমুখ অন্ধকার করে জবাব দিলো,
-“জ্বর এসেছে। কমছেই না।”
অরু দাঁড়ানো থেকে মায়ের পাশে খাটে উঠে বসলো। মায়ের শরীরের উপর উঠে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা দিয়ে নিস্তেজ হয়ে রইল। তরী আস্তে করে বলল,
-“নেমে পড়, অরু। মা ব্যথা পাবে।”
অরু নামলোনা। মাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। যেন ছেড়ে দিলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।
বাবা এসেই মাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। বাসায় অরু আছে বিধায় তরীকে রেখে গেলেন। মিঠুকে মানানো গেল না। পাগল হয়ে ছুটে চললো মায়ের সাথে। সে যতই পাগলামি করুক। দিন শেষে মায়ের কাছে এসেই শেষ দম ফেলে। তরীর মুঠোফোনে মাহমুদের দেওয়া কল, মেসেজের ভীড়। সেদিকে খেয়াল রইলো না তার।
★★★
রাত্রি দশটা। রাস্তার মোড়ে দানবীয় ল্যাম্পপোস্ট গুলো হরিদ্রাভ আলো ছড়িয়েছে। যানবাহনের শব্দে মাথা টনটন করে উঠছে। মাথা ধরে সিটে হেলে রইলেন তরীর মা। জ্বর এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে। তাই ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা। তরীর বাবা চিন্তিত গলায় শুধালেন,
-“খুব কি কষ্ট হচ্ছে, রুবিনা?”
তরীর মা মাথা দুলিয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় জানালেন,
-“একটু খা*রা*প লাগছে।”
তরীর বাবা একহাতে আগলে রাখলেন স্ত্রীকে। ড্রাইভারকে তাড়া দিলেন দ্রুত গাড়ি টা*ন*তে।
একরোখা স্বভাবের মানুষ হলেও তরীর বাবা স্ত্রী, সন্তানের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। দো*ষ একটাই, তিনি একরোখা। নিজের সিদ্ধান্তকেই সঠিক মনে করেন।
বাসার সামনে এসে একহাতে স্ত্রীর বাহু চেপে ধরলেন। অন্যহাত হাতের মুঠোয় নিলো মিঠু। চারতলা পর্যন্ত এসে বেল দেওয়ার পরপরই দরজা খুলে গেল। যেন তরী বাবা মায়ের অপেক্ষাতেই ছিল। মাকে ধরে ঘরে পৌঁছে দিল। অরুকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছে।
খাবার শেষ করে ঘরে ঢুকেছে সবাই। তরী মাত্র ফোন হাতে নিতেই মাহমুদের অনেকগুলো কল, মেসেজ পেলো। সে কল ব্যাক করলো। মাহমুদ রিসিভ করেই চিন্তিত গলায় শুধালো,
-“বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে, তরী? এতবার কল দিলাম, মেসেজ দিলাম, রিপ্লাই করলেনা?”
তরী লম্বা শ্বাস নিলো। মায়ের অসুস্থতার কথা জানালো। মাহমুদ কী বলল শোনা গেল না। বাবার ডাক পড়তে ‘পরে ফোন করছি’ বলে তরী তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল।
#চলবে………….
#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
শরীরে হাত রাখা যাচ্ছে না প্রচন্ড তাপমাত্রায়। থার্মোমিটারে শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ছাড়িয়ে ১০৪ এ থেমেছে। ঘন্টা দুয়েক না যেতেই আবারও তীব্র জ্বরে বেঘোরে পড়ে আছেন তরীর মা। কাঁপুনির সাথে দাঁতে দাঁত ঠকঠক শব্দে বারি খাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কেমন কষ্ট হচ্ছে। যেন ভীষণ কষ্ট করে এক একটা শ্বাস নিচ্ছেন। বাবার ডাক পেতেই ছুটে এলো তরী। অস্বাভাবিক জ্বরে শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে বারবার। এবারে তরী ঠিক তেমনটাই করল, যেমনটা অরু করেছিল। কাঁথা, কম্বলেও যখন কম্পন কমছিলনা, তখন মাকে ঝাপটে ধরে রইলো দু-হাতে। রাত অনেক হয়েছে। এদিকে মায়ের অবস্থা বেগতিক দেখে তরী বলল,
-“বাবা, মাকে হাসপাতালে নিয়ে চল।”
তরীর বাবার এই মুহুর্তে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেলো। মেয়ের কথায় সংবিৎ ফিরতেই স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সাথে তরীও যাচ্ছে। মাঝে তরী মিঠুকে জাগিয়ে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। অরুর খেয়াল রাখতে বলে গিয়েছে৷ মিঠুর মনটাও কেমন ছোট্ট হয়ে আছে। একটু আগেই চোখের পাতায় ঘুমেরা ভীড় জমিয়েছে। এখন দুশ্চিন্তায় সেই ঘুমের রেশ বহু বহু মাইল দূরে গিয়ে ঠেকেছে।
গাড়ির জন্য কিছুক্ষণ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। অতঃপর হাসপাতালে এসে উপস্থিত হলো তারা। মাকে ভর্তি করানো হলো।
বাবা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। শক্ত-সামর্থ্য চেহারার মাঝে কী যেন এক করুণ ছাপ দেখা দিল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তরী বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের অসুস্থতায় এই মানুষটা এমন ভেঙে পড়েছে। যখন জানবে সে তাদের অজান্তে, অমতে বিয়ে করে নিয়েছে, তখন কতটা চুরমার হয়ে যাবেন! ভেবেই তরীর শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। ঠান্ডা হয়ে এলো হাত পা।
দুরুদুরু বুক নিয়ে মায়ের শরীর ছুঁয়ে দেখল। জ্বর এখনো মনে হচ্ছে আগের মতোই আছে। শ্বাস টেনে টেনে নিচ্ছেন। পায়ের দিকে কম্বল টেনে দিতে গিয়ে আরেকবার শিউরে উঠলো তরী। মায়ের পায়ের দিকটা একেবারে বরফ শীতল। অথচ উপরের অংশটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
কোনভাবে বাবা-মেয়ে মিলে রাতটা চেয়ারে হেলান দিয়ে কাটিয়ে দিল। ফজরের আজান পড়তেই মসজিদে চলে গেলেন বাবা। সেখান থেকে এসেই তরীকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। বাসায় ছোটো ছোটো দুজন কি করছে একা একা, কেজানে?
তরী বাবাকে রেখে বাসায় চলে এলো। অবাক হলো সে। কলিংবেল চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে মজে থাকা মিঠু জেগে আছে! যাকে ঠেলেও সকালে ঘুম থেকে তোলা যায়না, তার চোখজোড়া চাতক পাখির মতো কিছু জানতে চাইছে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মিঠু,
-“মা কেমন আছে, আপু? জ্বর কমেছে?”
মিঠুর অস্থিরতা কমাতে খানিকটা মিথ্যের আশ্রয় নিলো তরী। বলল,
-“এখন জ্বর কম আছে।”
-“আমি একবার গিয়ে দেখে আসি?”
মিঠুর চোখেমুখে ভাসছে ব্যাকুলতা। অস্থিরতায় একজায়গায় স্থির নেই ছেলেটা। ছটফট করছে। তরী বলল,
-“যাবি, এখন নয় পরে। অরু ঘুমাচ্ছে?”
মিঠু হাঁপিয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“রাতে জেগে গিয়ে তোমাদের কাউকে না দেখে খুব কাঁদছিল। একটু আগেই ঘুমিয়েছে।”
তরী বলল,
-“তুই একটু ঘুমিয়ে নে। আমি নাশতা বানিয়ে নিচ্ছি। একসাথে মাকে দেখতে যাবো।”
চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে অনিদ্রায়। তবুও মিঠু বলল,
-“এখন ঘুম আসবেনা।”
তরী জোর করে পাঠিয়ে দিল মিঠুকে। ছেড়ে দেওয়া শরীরটা কেমন শক্ত হশে উঠলো। কোমরে ওড়না বেঁধে কাজে লেগে পড়লো তরী। কাজকর্ম শেষ দিয়ে অরুকে ঘুম থেকে জাগালো। নাশতা করার সময় ছোট্ট অরুর চোখ দুটো পিটপিট করে এদিক-ওদিক ঘুরছে। আজ বাবা বা মা কাউকেই দেখছেনা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তরীর দিকে। ঘুম ভাঙা কন্ঠের রেশ এখনো কাটেনি। ভাঙা ভাঙা গলায় শুধালো,
-“মা আর বাবা কোথায়?”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“মায়ের অসুখ করেছে তো। তাই বাবা মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।”
অবুঝ অরু প্রশ্ন করলো,
-“মায়ের অসুখ করেছে কেন?”
-“সেটা তো আল্লাহ জানেন, অরু। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, আমরা মায়ের কাছে যাব।”
অরু আর দ্বিরুক্তি করলোনা। তরীর হাতে খেয়ে নিলো ঝটপট। তরী তাকিয়ে দেখলো মিঠুর খাওয়া শেষ। একটু খানি খেয়েই উঠে গিয়েছে। সে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি। সবকিছু গুছিয়ে ছোটো ভাই-বোন দুটোকে নিয়ে তরী হাসপাতালে চলে গেল। এর মাঝে মাহমুদের এত এত কল, মেসেজ সব উপেক্ষা করলো। তরী আর ফোনের দিকে মন দেওয়ার সময় পেলোনা।
★★★
মায়ের যাবতীয় টেষ্ট করানোর পর রিপোর্ট এলো। সবটা স্বাভাবিক। কোন ধরনের প্রবলেম দেখা দেয়নি। তবে ভর্তি রইলেন তরীর মা। এবারেও স্ত্রীর পাশে রইলেন তরীর বাবা। ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিলেন বাসায়। জ্বরের প্রকোপ কমতির নাম নেই বরং থেকে থেকে বাড়ছে। করোনা টেস্ট করা হলো। তেমন কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। রাতে তরীর বাবাকে ডাক্তার ডেকে জানালেন,
-“আপনারা রোগী অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান।”
অস্থির হয়ে পড়লেন তরীর বাবা। দিনের বেলা আত্মীয়-স্বজন রা অনেকেই দেখে গেলেও রাতে থাকার মতো কেউ নেই। সবাই সন্তান, ব্যস্ততা এসব অজুহাতে কেটে পড়েছেন। রাতারাতি ভাইকে ফোন করে পরামর্শ নিলেন হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারে। তিয়াসের বাবা বললেন,
-“তুই এখন ডাক্তার যেখানে নিতে বলে, নিয়ে যা। আমি সকালে পৌঁছে যাবো। এখন তো অনেক রাত হয়েছে।”
তরীর বাবা মেয়েকেও আর ঝামেলায় ফেলেন নি। রাতারাতি স্ত্রীকে নিয়ে এম্বুলেন্স এ উঠলেন। যতবার গাড়ির ডাকটা কানে বেজে ওঠে ততবারই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
★★★
অরু কখনো মাকে ছাড়া থাকেনা। রাতে তার সাথে ঘুমায় ঠিকই, কিন্তু তার মনে একটা ভরসা থাকে মা বাসায় আছেন। অরুকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে ফোন হাতে নিলো তরী। মায়ের খোঁজ নিতে হবে। সারাদিনের ব্যস্ততায় তার মাত্রই চোখ পড়লো মাহমুদের নম্বর। ফোন, মেসেজের ভীড়। তাকে একটু পরেই ফোন দেবে। আগে মায়ের খবর নেওয়া দরকার। বাবাকে ফোন করলো তরী। এম্বুলেন্স এর ডাক শোনা যাচ্ছে। বুকের ভেতর ভয়েরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তরী কাঁপা-কাঁপা গলায় বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো,
-“মায়ের এখন কী অবস্থা, বাবা?”
তরীর বাবা নিস্তেজ হয়ে এলেও, সন্তানের কাছে ভেঙে পড়লেন না। তিনি ভেঙে পড়লে যে মেয়েটাও ভেঙে পড়বে। সন্তানগুলো কার কাছে ভরসা খুঁজবে?
নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলেন,
-“তোর মাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”
আৎকে উঠলো তরী। মায়ের বড় কোন ক্ষতি হলো বুঝি! তড়িৎ প্রশ্ন করলো,
-“মায়ের অবস্থা কি খুব খা*রা*প?”
-“চিন্তার কিছু নেই। এই হাসপাতালে দেখছি চিকিৎসা ভালোনা। তাই অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেয়েকে মিথ্যে বলে শান্তনা দিলেন। একা বাসায় দুশ্চিন্তা করে নিজে না আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে!
বাবার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি তরীর। তবুও বাবাকে বোঝালো সে বিশ্বাস করেছে। অরু ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠছে। আস্তে করে তার বুকের উপর হাত রাখলো তরী। আবারও মাহমুদের কল। সময় না নিয়ে রিসিভ করলো। ফোন কানে তুলতেই মাহমুদের ব্যাকুলতা টের পেলো,
-“তরী, কোথায় তুমি? সব ঠিক আছে? তোমাকে গতরাত থেকে কল, মেসেজ কোথাও পাচ্ছিনা!”
মাহমুদের ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভীষণ অস্থিরতায় পায়চারি করছে মানুষটা। তরী ফুঁপিয়ে উঠলো। মাহমুদ আরও অস্থির হয়ে উঠলো,
-“এই তরী, কাঁদছো কেন? বলোনা আমায়, সব ঠিক আছে? তুমি ঠিক আছো?”
তরীর হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। রোধ হয়ে আসা গলায় বলল,
-“মা, মা ভালো নেই। এখন অন্য হাসপাতালে শিফট করেছে।”
মাহমুদ চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
-“আন্টির এখনো জ্বর কমেনি?”
-“তরী হেঁচকি তুলে জবাব দিলো,
-“নাহ্।”
মাহমুদ কোমল হল।
-“তরী, আগে কান্না থামাও। আন্টির কিচ্ছু হবেনা। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। তুমি কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
মাহমুদ কল কেটে দিলেও তরী ঘুমালোনা। ঘুম আসলোনা চোখে।
★★★
মাহমুদের চিন্তা অন্য জায়গায়। আগামীকালই শুক্রবার। তরীর কথা অনুযায়ী কালই তিয়াসের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা। অথচ তার এখনো তিয়াসের সাথে কথা বলা হয়নি। তরী কাছ থেকে নম্বরও নেওয়া হয়নি। তরীর মায়ের শরীর স্বাভাবিক হলে হয়তো বিয়েটা কালই হয়ে যেতে পারে। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলো সে। রাতে তারও ঘুম হলোনা। সকালে মাকে তরীর মায়ের অসুস্থতার কথা জানানোর সময় রামি শুনলো। আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“আমাদের দেখতে যাওয়া উচিত। আমাদের সাথে তো কোন ঝগড়াঝাটি হয়নি। আর হলেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”
মাহমুদ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল হাসপাতালে তরীর মাকে দেখতে যাবে। এখন মাকেও সঙ্গে নিল। রামি এসে যোগ দিল তাদের সাথে। সেও যাবে। মাহমুদ না করলোনা। তরীকে ফোন করে হাসপাতালের নাম জেনে নিল।
তরীর বাবা চেয়ারে বসে আছেন। একটু পরই আবার কতগুলো টেস্ট করাতে নিয়ে যাওয়া হবে তরীর মাকে। সেখানে মাহমুদ আর তার মা, ভাইকে দেখে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি ওদের এখানে আশা করেননি। ভেবেছেন ভাই সকালে আসবে বলেছে, সেই এসেছে। তবে উনাদের দেখে কোনরূপ রূঢ় ব্যবহার করলেন না। চুপচাপ রইলেন। একঘন্টা সময় পর তিয়াসের বাবা এলেন। মাহমুদের মা বাসায় গেলেন না। তিনি হাসপাতালে থেকে তরীকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন রেস্ট নেওয়ার জন্য। এতেও তরীর বাবা হ্যাঁ, না কিছুই বলেন নি। তিয়াসের বাবা আবার আধাঘন্টা না পেরোতেই কাজ আছে বলে চলে গেলেন। মাহমুদ ঘোরাফেরায় রইলো। ডাক্তারের সাথে কী কী যেন বলছে। এই মুহূর্তে একজন বড়ছেলের ভীষণ অভাববোধ করলেন তরীর বাবা। রিপোর্ট আসলো। তরীর বাবাকে ডাকা হলো ডাক্তারের চেম্বারে। উনার চোখমুখ মলিন। আতঙ্কিত চেহারা দেখে মাহমুদ তরীর বাবার সামনে সাহস করেই বলে ফেললো,
-“আমিও যাবো আপনার সাথে, চলুন আঙ্কেল।”
তরীর বাবা একবার গম্ভীর হয়ে বললেন,
-“তার দরকার নেই।”
মাহমুদ বারণ শুনলোনা। তরীর বাবার সাথে ঢুকে পড়লো। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন,
-“রিপোর্ট খুব একটা ভালো নয়। রোগীর অবস্থা সিরিয়াস।”
#চলবে……..