অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-২৯+৩০

0
434

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বারান্দার শীতল হাওয়া শরীরে শিরশিরে অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। একহাতে অপরহাতে ঘষে চলেছে তরী। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল, অথচ তাদের সম্পর্কের উন্নতি হলোনা। তরীর প্রেমে ব্যাকুল মাহমুদ একটিবার দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাবা বাসায় থাকেন না বললেই চলে। তরী ঠিক করলো অরুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার পথে একবার দেখা করবে মাহমুদের সাথে। বারান্দা ছেড়ে ছুটে এলো ঘরে। মুঠোফোন হাতে তুলে চিরপরিচিত নাম্বারে ডায়াল করলো। খানিক সময়ের মাঝেই রিসিভ হলো। শোনা গেল গভীর সেই কন্ঠস্বর।
-“তরী!”

তরী চুপটি করে শুনলো। জবাব দিলোনা। ছোট্ট এই ডাকে যেন হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু ভালোবাসা প্রকাশ পায়। তরী আবার শুনতে চায় তার নাম।
নিরবতার অবসান ঘটলো না দেখে মাহমুদ ফের ডাকলো,
-“তরী!”

তরী চোখ বুজলো। অতঃপর অনুরাগী স্বরে জবাব দিলো,
-“হুঁ।”

-“কথা বলছো না যে?”

-“শুনছি।”
তরীর ছোট্ট জবাবে মাহমুদ শুধালো,
-“কি শুনছো?”

-“আপনাকে।”
তরীর প্রেমময় স্বরকে উপেক্ষা করলো মাহমুদ। নিচুস্বরে বলল,
-“পরে কথা বলছি। ক্লাসে আছি আমি।”

তরীকে বলার সুযোগ না দিয়েই মাহমুদ খট করে লাইন কে*টে দিল।
তড়িৎ বার্তা পাঠালো তরী।
❝ছুটি নিন। অরুকে নিতে যাবো, তখন দেখা করবো আপনার সাথে।❞

ফোন রেখে কাজে লেগে পড়লো তরী।

★★★

মাহমুদ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আসা বার্তা পড়লো। তার ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো। বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি যেন আজ পেতে চলেছে! চোখেমুখে লেগে আছে নজরকাড়া নিটোল হাসি।

ছাত্র-ছাত্রীরা ফিসফাস করছে মাহমুদকে নিয়ে। যার কিছু কিছু মাহমুদের কর্ণধারের বাড়ি খাচ্ছে।

-“হ্যাঁ স্যার নিশ্চয়ই প্রেম করে। দেখলিনা কিভাবে কথা বলেছে। আবার মিটিমিটি হাসছে।”

অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লো মাহমুদ। দ্রুত ফোন পকেটে ঢুকিয়ে গলা পরিষ্কার করে একটু কঠোর হলো। অথচ কঠোরতা তার স্বভাবের সাথে যায় না। এতেও যেন তার বিব্রতভাব কাটছেনা। হুট করেই ক্লাস থেকে বিনা বার্তায় বেরিয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক বাইরে ঘুরেফিরে নিজেকে ধাতস্থ করে ক্লাসে ফিরলো।
ক্লাস শেষ হতেই ইমার্জেন্সি বলে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেল মাহমুদ। রিকশায় চড়ে অরুর স্কুলের সামনে এসে থামলো। এখনো স্কুল ছুটি হতে ত্রিশ মিনিট বাকি। শীতের নরম রোদ মিষ্টি ভালোলাগার জন্ম দিচ্ছে। ঠিক ত্রিশ মিনিট নয়,গুণে গুণে পঁচিশ মিনিট যেতেই তরীর অবয়ব দেখা গেল। মাহমুদের হৃদয় শীতল হলো যেন। তরী এসে রিকশা থেকে নামলো।
কিছুক্ষণ যেতেই স্কুল ছুটি হলো। একে একে বাচ্চারা গেইট দিয়ে বেরিয়ে আসছে। অরু তরীকে দেখেই ছুটে এসে ছোটো ছোটো হাত দুটো দিয়ে কোমর আঁকড়ে ধরলো। তরী অরুর কাঁধ থেকে ব্যাগ খুলে নিল। হুট করেই পেছন থেকে কেউ কোলে তুলে নেওয়াতে ভড়কে গেল অরু। কোলে চড়ে দেখলো মাহমুদ। এতক্ষণ তাকে নজরে আসেনি। অরু গাল ফোলালো। নেমে যেতে চাইলো কোল থেকে। মাহমুদ আদুরে স্বরে বলল,
-“অরু পাখি কি আমার সাথে কথা বলবে না?”

অরু ফুলো ফুলো গালে, পিটপিট চোখে তাকিয়ে বলল,
-“নাহ্!”

-“আমার দো*ষ কোথায়?”

-“তুমি আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছো কেন?”

মাহমুদ অপরাধী চোখে তাকালো। বলল,
-“সেখান থেকে আমার কলেজ দূরে হয়ে যায় যে।”

তবুও অরুর রাগ কমলোনা। মাহমুদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার রাগ ভাঙাতে। বলল,
-“আচ্ছা কী করলে রা*গ কমবে? চকলেট? চিপস? নাকি অন্যকিছু?”

অরু আড় চোখে তাকালো। তার রাগ একটু একটু কমছে বোধহয়। তবুও চুপ করে রইলো। মাহমুদ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“কী খাবে?”

এবার কথা বলল অরু। ফুলকো ফুলকো গাল দুটো স্বাভাবিক হয়েছে। তবুও একটু ভাব ধরে চিপস, চকলেট দেখিয়ে দিয়ে বলল,
-“এগুলো নেবো।”
মাহমুদ নিঃশব্দে হেসে কিনে দিল। তাকে কোলে নিয়ে তরীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।

রিকশায় চড়ে মাহমুদ বলল,
-“চলুন মামা।”

মৃদুমন্দ বাতাসে সামনের ছোটো চুলগুলো বেশ বিরক্ত করছে তরীকে। মাহমুদ একহাতে সেগুলো সরিয়ে দিল। অরু তার চিপস, চকলেট নিয়েই ব্যস্ত। তরী বা মাহমুদ পাশ ফিরে তাকালে হয়তো তাদের সর্ব*নাশ দেখতে পেত।

★★★

ফুটপাতের ভ্যানে একজন লোক জামাকাপড় বিক্রি করছেন। মিঠুর অত রাখঢাক নেই। যখন যেখানে যা পছন্দ হয়,নিঃসংকোচে কিনে নেয়। রাতে ট্রাউজার পরে ঘুমাতে আরাম পাওয়া যায়। মিঠু ধরে দেখলো ট্রাউজার ভালোই আছে। দামাদামি করার পর ভ্যানের লোকটি বললেন,
-“আরো বিশ টাকা বাড়তি দিন।”

মিঠু বলল,
-“এই দামে দিলে দিন। না দিলে আমি যাচ্ছি। আপনার লস হলে দিতে হবেনা।”

লোকটি বললেন,
-“আর দশ টাকা বাড়তি দিন। কথা বাড়িয়েন না।”

মিঠু বলল,
-“আপনি যদি বলেন ’ ফ্রি-তে তোমার পিঠ চুলকে দেব’
তবুও আমি দশ টাকা বাড়তি দেব না।”

শেষমেশ নিজের ঠিক করা দামেই ট্রাউজার কিনে সামনে এগোলো দুই বন্ধু। রামি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিঠুর কাজ দেখলো। সে হেসে কুটিকুটি। বলল,
-“আমি তোর পিঠ চুলকে দেব। আমাকে দশ টাকা দে। তুই না জমিদারের বংশধর? তাহলে এত ছ্যাঁচড়ামো করলি কেন?”

মিঠু ভাবলেশহীনভাবে বলল,
-“যদি ছ্যাঁচড়ামি করতাম, তাহলে আরো কম দামে নিতে পারতাম।”

রামি বলল,
-“তুই এক কাজ কর। ভালো ইনকাম হবে। ছ্যাঁচড়ামো কোর্স সেন্টার খুলে ফেল। সবাই তোর কাছ থেকে শিখবে ছ্যাঁচড়ামো কিভাবে করতে হয়।”

-“বুদ্ধি ভালো দিয়েছিস।”

রামি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-“এই খুশিতে আমাকে ট্রিট দে।”

রামি পকেটে হাত দিল। একশ টাকার নোট বেরিয়ে এসেছে। টাকাটা পকেটে রেখে আফসোসের সুরে বলল,
-“পকেটে দুই টাকা নেই বলে তোকে ট্রিট দেওয়ার মতো রিস্ক নিতে পারলামনা।”

মিঠু বলল,
-“তুই আসলেই ছ্যাঁচড়া।”

এতে মিঠুর খুব একটা এসে গেল না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে গেল। হঠাৎই থেমে গেল। চোখদুটো লাল হয়ে এলো। একটু একটু পানি জমছে। রামি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। তাদের বয়সি একটি ছেলে মায়ের বয়সি একজনের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করছে। সাথে ভদ্রমহিলা হেসে উঠে কানমলা দিচ্ছেন। মিঠুর কাঁধে হাত রাখলো রামি। সংবিৎ ফিরতেই শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিলো মিঠু। রামির উদেশ্যে বলল,
-“চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। রামির কাছে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন শব্দ বা বাক্য নেই। সেও আর কথা বাড়ালোনা। সামনে এগিয়ে গেল। মুহুর্তের হাসিহাসি বন্ধুত্বের মাঝে কালো মেঘ জমলো। হৈ-হুল্লোড় থেমে নিস্তব্ধ হলো সবকিছু।

★★★

বাবা বাড়ি ফেরার পর থেকেই থমথমে মুখে বসে আছেন। কোন কথা বলছেন না তরীর সাথে। তরী যাই জিজ্ঞেস করছে, জবাব পাচ্ছে না। আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“কী হয়েছে বাবা। আমি কোন দো*ষ করেছি? এভাবে চুপ করে আছো কেন?”

বাবা আরো গম্ভীর হলেন। তরীর ভেতরে ত্রাসের রাজত্ব। বড়ো কোন দোষ না করলে বাবা এমন চুপচাপ থাকেন না তাদের সাথে। তরী অস্ফুট স্বরে আরেকবার ভয়ে ভয়ে ডাকলো,
-“বাবা!”

বাবা অরুকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“স্কুল ছুটির পর কোথায় গিয়েছিলে, মা?”

অরু মাহমুদের কথা বলে দিল। তরী ঢোক গিললো। বাবার যা জানার তা জানা হয়ে গেল। তার মানে তিনি মিথ্যে শোনেননি। তিয়াসের বাবাই আজ কল দিয়ে উনাকে ডেকে তরীর ব্যাপারে কথা বললেন।
মাহমুদের সাথে দেখা ঘটনা রংচঙ মিশিয়ে বাড়িয়ে বললেন। অপমানিত হলেন তরীর বাবা। থমথমে ভাব নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মেয়েকে ছোটো থেকে যেভাবে দেখে এসেছেন তা যেন এক পলকেই মিথ্যে হয়ে গেল।
এবার ভয়ার্ত তরীর মুখোমুখি হলেন। কঠিন স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
-“কতদিনের সম্পর্ক?”

তরী মাথা নিচু করে আছে। বাবা হুংকার ছাড়লেন,
-“প্রশ্ন করেছি আমি।”

কেঁপে উঠলো তরী। কন্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। ভয়ে মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারিত হচ্ছেনা। থরথর করে হাত পা কাঁপছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে সত্যিটা বলার। বাবা আবারও ধমকে উঠলেন। তরী হুট করেই বলে ফেললো,
-“আমরা বিয়ে করে ফেলেছি বাবা।”

তরীর বাবা থমকে গেলেন। এতক্ষণের তেজ মলিন হয়ে এলো। শরীরের ভর ছেড়ে দিলেন। তরীর কথাটুকু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শান্ত গলায় একবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কবে বিয়ে করলি?”

তরী কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দিল,
-“যেদিন চাচা-চাচি আংটি পরিয়ে গিয়েছেন, সেদিন।”

বাবা আর কিছুই বললেন না। মেয়ের এত অধঃপতন মেনে নিতে পারলেন না। শুধু বললেন,
-“চলে যেও তোমার ঠিকানায়। আমার অনুমতি ছাড়া যখন বিয়ে করতে পেরেছো, তখন সংসারও করতে পার। আমি বাঁধা দেবো না।”

বাবার শান্ত কথায় স্পষ্ট রাগ, অভিমান খুঁজে পেল তরী। একবার ডাকলো,
-“বাবা!”

-“পারলে আজই চলে যাও।”
কথাটুকু বলেই বাবা চলে গেলেন।
যদি বিয়ের ব্যাপারটা সামনে না আসতো, তবে মাহমুদ -তরীর জন্য সবটা সহজ হতো। বাবাও হয়তো মেনে নিতেন। তরীর বাবার কষ্টটা হলো তাদের অমতে তখনই কেন মেয়ে বিয়ে করলো? তিয়াসের বাবার কাছে ছোটো হলেন তিনি। বাবার এই অভিমান না তরীকে বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়!

তরী ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বাবা রাতে আর খেলেন না। সকালে তরীকে যেতেও বললেন না, কথাও বললেন না। সোজা না খেয়ে বেরিয়ে গেলেন।

#চলবে…….

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বাড়ির পরিবেশ থমথমে। দুদিন যাবত বাবা কথা বলছেন না, ঘরে খাচ্ছেন না। তরী উদাসী ভঙ্গিতে বসে রইলো। যতবার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, ঠিক ততবারই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ছোটো থেকেই তো ভালোবাসা দিয়ে এই বাবা নামক মানুষটি বড়ো করে এসেছেন। মাথায় ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন। এখনো তাদের কথা ভেবে লোকজনের বিয়ে নামক উস্কানিমূলক বাক্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। সে কি-না বাবার অনুমতি বিহীন বিয়ে করে নিলো? মাহমুদকে সে যেমন ভালোবাসে, বাবাকে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সে কি পারতোনা ভয়ডর কাটিয়ে একটিবার বাবার সাথে কথা বলতে! হয়তো বাবা মেনে যেতেন। একটু নয়, অনেকখানিই কষ্ট করতে হতো তাদের। তরী ভাবতে পারলোনা কিছুই। বাবা আজও না খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সাহস করে বাবাকে খেতে বলল তরী। তিনি উপেক্ষা করলেন। যেন কিছুই শুনতে পাননি। এই দুঃসময়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাহায্য করতে পারেন না। তরী অজু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইলো বাবাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আজ তার বোধদয় হল। মুনাজাতে কাঁদল অনেকটা সময়। মায়ের জন্য দোয়া করলো।

-“হে আল্লাহ, আপনি বড়ো দয়ালু। উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমার মতো গুনাহগার বান্দাকে আপনার দরবারে কবুল করুন। সকল কবর বাসীর সাথে সাথে আমার মা’কে ও জান্নাতের উচ্চ মকাম দান করুন। পিতামাতার অবাধ্যতার জন্য আপনি আমায় ক্ষমা করুন। আমার বাবাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুস্থতা দান করুন আল্লাহ। আমার ছোটো ছোটো ভাই-বোন দুটোর কষ্ট কমিয়ে দিন। দিনরাত মায়ের জন্য তাদের আহাজারিতে আমার অন্তর ফেটে যায়। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছিনা। আমি জানি আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করুন আমায়। হিদায়াত দান করে আপনার পথে চলার তাওফিক দান করুন। আপনি যা জানেন, আমি তা জানিনা আল্লাহ। আপনি জানেন কিসে আমার ভালো আর কিসে মন্দ। আপনার পরিকল্পনা, নিয়ামতের অপেক্ষায় আছি আমি। যতটুকু নিয়ামত দান করেছেন তার জন্য হাজার হাজার শুকরিয়া। যা বলে শেষ করার সাধ্য আমার নেই।”

টপটপ করে চোখের পানিতে কপোল জোড়া ভিজে গেল। এখন একমাত্র ভরসা আল্লাহ। সে বাবাকে যেমন চায়, তেমন স্বামীকেও চায়। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে আছে। নিশ্চিয়ই তিনি যা কিছু করেন, বান্দার ভালোর জন্যই করেন।

★★★

রাত নয়টার পর কলিংবেলের শব্দ হলো। বাবা বাসায় আটটার পরই চলে আসেন। মিঠুও ঘরে। তরী মাথায় কাপড় দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে দরজা খুলে দিল। অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার শব্দ ভান্ডার যেন ফুরিয়ে এসেছে। আয়েশা সুলতানা হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলেন। সাথে আরও চারজন মানুষ আছে। মাহমুদ সবার পেছনে দাঁড়ানো। ইরা, বড়ো ভাইয়া আর রামিও এসেছে। তরী নিরবতা কাটিয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। নম্র ভাবে ভেতরে আসার আহবান জানালো সবাইকে। বাবা সামনের রুমেই বসা ছিলেন। আয়েশা সুলতানাকে পরিবার সমেত দেখে তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। তবে কিছুই বললেন না। ভাবগতি গাম্ভীর্যপূর্ণ। যেন তিনি ধারণা করে ফেলেছেন আয়েশা সুলতানার আসার উদ্দেশ্যটা কী!

বাবার রাগের ব্যাপারে তরী মাহমুদকে জানিয়েছিল বটে। তবে সে যে হুট করে পরিবার নিয়ে এভাবে চলে আসবে এটা ভাবেনি!

আয়েশা সুলতানা গলা ঝাড়লেন। ভদ্রমহিলা ভদ্রভাবেই কথার শুরু করলেন।

-“কেমন আছেন ভাই সাহেব?”

তরীর বাবার থমথমে চেহারায় জবাব এলো,
-“সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়! আমার বিপদের সময় আপনারা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তাতে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। তবে ছেলেমেয়েকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাপোর্ট দিতে পারছিনা।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আয়েশা সুলতানা। বললেন,
-“আপনার মতো প্রথমে আমিও ব্যাপারটি জানতাম না। যখন জেনেছি তখন সত্যি বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছি। আমি নিজেও ওদের এভাবে বিয়েটাকে সাপোর্ট করিনা। ছেলেমেয়ে দুজন-দুজনকে পছন্দ করে। অথচ আমরা অবিভাবক কেউই অবগত ছিলাম না। তারা দুজনে মিলে আমাদের সাথে খোলাখুলি আলোচনায় বসতে পারতো। তরী আপনার মেয়ে। তাকে সবার চেয়ে আপনি ভালো চিনবেন। আপনার মেয়ে ভীতু প্রকৃতির। তার এই ভীরুতার কারণেই আজ আপনিও কষ্ট পাচ্ছেন। অবশ্য তার ভয় পাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনার মতো কঠোর ব্যক্তিত্বের একজন বাবার কাছে নিজের পছন্দ জাহির করার মতো সৎ সাহস তার ছিলনা। এখন হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম। ভুল তো করেই ফেলেছে। আমরাই বাবা-মা। আমরা ছাড়া আর ওদের বুকে টেনে নেওয়ার মতো কে আছে?”

মেজাজ এমনিতেই দুদিন যাবত খা*রা*প হয়ে আছে। রাগ সামলাতে না পেরে হাঁকিয়ে উঠলেন তরীর বাবা। রুক্ষ গলায় বললেন,
-“তাই বলে এভাবে বাবা মায়ের সম্মান নিয়ে খেলবে? তখন ওর রিং পরানো হয়ে গিয়েছে আর সে বিয়ে করে বসে আছে। আমার সম্মানটা কোথায় গেল ভেবে দেখেছেন?”

উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তরীর বাবা। এতোদিনের সবার উপর জমানো রাগ, অভিমান, কষ্ট একসাথে ঝেড়ে ফেলছেন।
আয়েশা সুলতানা ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েই শান্ত গলায় বোঝালেন,
-”বিয়ের ঠিক করার আগে মেয়ের মতামত চাইলে নিশ্চয়ই আপনার সম্মান খুঁইয়ে যেত না! সন্তানের বিয়েতে যেমন বাবা মায়ের মতামতের প্রয়োজন আছে, তারচেয়ে বেশি মতামত প্রয়োজন সন্তানের। কারণ সংসারটা তার। পুরো একটা জীবনের ব্যাপার। আপনি বাবা। আজ আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। একমাস, দুমাস কিংবা এক বছর পর হলেও মেয়ের জন্য আপনারই মন পুড়বে। আর কারো পুড়বেনা। আপনাদের বিপদের মুহুর্ত টুকু না হয় মনে করুন। তখনও আপনার সন্তানদের কাছে থাকার মতো কেউ ছিলনা। এখনও থাকবেনা। দিন শেষে বাবা সন্তানদের জন্য আর সন্তান বাবার জন্যই আছেন। তাহলে কার উপর এতটা অভিমান জমিয়ে রেখেছেন?”

তরীর চোখে পানি টলমল করছে। মাহমুদ আজ কোন কথা বলছেনা। তার বিবেকহীন কাজের জন্য সে নিজেও লজ্জিত। তাই মাথানিচু করে বসে রইলো। অবশ্য তখন এটা ছাড়া তার মাথায় আর কোন বুদ্ধি কাজ করেনি। ইরা মলিন হেসে বলল,
-“দেখুন না আঙ্কেল, আমার বাবা নেই। তাই আমি জানি বাবা হারানোর ব্যথা কী! আপনি থাকা সত্ত্বেও যখন মেয়েকে পর করে দেবেন, আমার চেয়েও বেশি কষ্ট আপনারা দুজনই পাবেন। কারণ দুজন জীবত থাকা সত্ত্বেও একে অপরের কাছে মৃ*তে*র মতো থাকবেন। এটা কি ভালো হবে? শান্তি পাবেন আপনি? নাকি তরী শান্তিতে থাকবে?”

মাহমুদের বড়ো ভাইও মুখ খুললো,
-“আমার ভাইয়ের মাঝে কি কোন কমতি আছে? আপনার যদি তার কোন কাজ অপছন্দ হয়, তবে সে নিজেকে শুধরে নেবে।
শুধু একটা ভুলের জন্য বাবা-মেয়ে কিংবা ওদের দুজনকে আলাদা করবেন না। আপনার কাছে এই একটাই অনুরোধ।”

তরীর বাবার চেহারার থমথমে ভাব কিছুটা কমে এসেছে। তিনি কিছু একটা ভাবছেন বোঝা যাচ্ছে। রামি ছটফট করছে কখন তরীর বাবার মুখ দিয়ে রাজি শব্দটি শুনবে! তবে বড়োদের মাঝে কোন কথা বলছেনা।

সবাই তরীর বাবার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। তিনিও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“আপনার সময় লাগলে আপনি সময় নিন। আমাদের আপত্তি নেই।”

অগত্যা তরীর বাবা জবাব দিলেন।
-“আমি ভেবে জানাবো আপনাদের।”

সকলের মুখে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখা গেল। বাবা তরীর সাথে কথা বললেন।
-“সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর, তটিনী।”

তরীর চোখে আনন্দের অশ্রু। চোখে পানি নিয়ে উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে। পেছন পেছন ইরাও উঠে গেল।
রামি, মিঠু দুজনই ছুটে মিঠির ঘরে গেল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কোলাকুলি করলো দুজন। বাবার ভেবে দেখাকে মিঠু যে করেই হোক হ্যাঁ তে পরিণত করবে। মা যাওয়ার পর এই বোনই তো দ্বিতীয় মা হয়ে তাদের আগলে রেখেছে। রাতে শুয়ে পড়ার পর এই বোনই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মিঠু টের পেলেও ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতো। সেই বোনকে কষ্ট পেতে দেয় কী করে?

★★★

তরীর হাতে হাতে কাজ করতে গিয়ে ইরা বলল,
-“চিন্তা করো না, তরী। তোমাকে আমার জা করে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হবোনা।”

তরী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। আল্লাহ কতটা দয়ালু। তার কাছে চাইলেই সব পাওয়া যায়। বাবা তার সাথে কথা বলেছে, আপাতত এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। ঘন্টা খানেক পূর্বেও যে দুনিয়াকে বিষাক্ত মনে হয়েছে, সেই দুনিয়াকে এখন আনন্দের মেলা, সুখের সমুদ্র মনে হচ্ছে। অল্পতেই নিরাশ হলে হয়না। আল্লাহকে ভরসা করে ধৈর্য ধরলে আল্লাহ তার বান্দাকে নিরাশ করেন না। আপনি আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তিনি দেবেন, যা আপনার জন্য উত্তম। সময় মতো আপনি আপনার পাওনা পেয়ে যাবেন। ধৈর্য হারালে চলবেনা।

সবার রাতের খাবার দুজনে মিলে তৈরি করে নিচ্ছে হাতে হাতে।
অরু মাহমুদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। মাহমুদ ইশারায় কাছে ডাকলেও গেল না। উঠে পড়লো মাহমুদ। অরুকে কোলে তুলে নিলো। সে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। মিঠুর কাছে শুনেছে তার আপুকে নাকি মাহমুদ ভাইয়া নিয়ে যাবে। তাই অরু ভীষণ রেগে আছে। মাহমুদ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“অরু পাখির মন খা*রা*প কেন? কেউ বকেছে?”

অরু ফোলা ফোলা গালে থমথমে স্বরে জবাব দিলো,
-“আমার আপুকে তোমায় নিয়ে যেতে দেবো না।”

মাহমুদের বড়ো ভাই অরু গাল টে*নে বলল,
-“আমরা সাথে তোমাকেও নিয়ে যাবো। আমার দুটো বউ লাগবে। একটা আছে, আরেকটা তুমি হবে। তোমাকে ও বিয়ে করবো।”

অরু গাল থেকে হাত সরিয়ে নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-“তুমি বুড়ো। আমি বুড়োলোক বিয়ে করবোনা।”

হো হো করে হেসে উঠলেন বড়ো ভাইয়া। ওদিকে মিঠু আর রামির বেশ আলাপ চলছে চুপিসারে। একজনও ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না।
সবার রাতের খা*বা*র শেষ হতেই মাহমুদরা বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আজ অরু এখন পর্যন্ত ঘুমায়নি। সবাই বেরিয়ে যেতেই সে দরজা ধরে দাঁড়ালো।

-“যাও বের হও। আমার আপুকেও নিতে দেবোনা। আমিও বুড়োলোক বিয়ে করবোনা।”
বলেই ঠা*স করে সবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল অরু।
বাইরে দাঁড়িয়ে তিন ভাই উচ্চ স্বরে হাসলো।

★★★

অনেকদিন পর তরীর মামা ফোন করেছেন। তরীর বাবা মাহমুদ আর তরীর বিয়ের ব্যাপার নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন। মামা বললেন,
-“বিয়ে যেহেতু করে নিয়েছে তখন আর বাঁধা হয়ে লাভ কী দুলাভাই। তাছাড়া ছেলে অনেকগুলো মাস আপনার চোখের সামনে চলাফেরা করেছে। আপনার নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে ধারণা আছে। সবটা ঠিকঠাক হলে আমার মনে হয়না বাঁধা দিয়ে কোন লাভ হবে। মেয়ে যদি সুখী হয় তখন আপনি নিজেও তৃপ্তি পাবেন।”

শা*লা*র সাথে কথা বলেও বেশ অনেকক্ষণ ভাবলেন তরীর বাবা। পরদিন বাইরে আরো কয়েকজনের সাথে বিষয়টি আলোচনা করলেন। অনেকেই মাহমুদ -তরীর বিয়ের পক্ষেই মতামত দিলেন। কয়েকজন অবশ্য খোঁচা দিতে ছাড়লেন না। কিছু পরনিন্দাকারী, টক্সিক মানুষ না থাকলে কি দুনিয়া চলে!
বাইরে আলোচনা হওয়ায় তিয়াসের বাবার কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছালো। সব ভালোর মাঝে তিনি এক বি*শ্রী কাহিনী রটানোর চেষ্টায় নামলেন। আশেপাশের অনেককেই তরীর বাবার সঙ্গে মাহমুদের মায়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা তুলতে উস্কে দিলেন। ব্যাপারটা কানে আসতেই লজ্জায় টেকা গেলনা। তরীর বাবা আগের মতোই গম্ভীর হয়ে গেলেন।
তরীর মনে পূনরায় আতঙ্ক ভর করলো। তার জীবনের সুখটা পেতে পেতে না আবার হারিয়ে ফেলে!

#চলবে………