অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-৩৫+৩৬

0
406

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বিষাদময় হয়ে উঠলো তরীদের বাড়ি। বাবা সবার আড়ালে ঘরে ঢুকলেন। দরজার খিল দিয়ে স্ত্রীর ব্যবহৃত জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে কথা বলছেন। পুরুষ মানুষ যতটাই শক্ত থাকুক না কেন? একটা পর্যায়ে এসে তারা আবেগী হয়ে ওঠে। সেই পর্যায়টা কন্যা বিদায় দেওয়ার মুহুর্তেই হুট করে আসে। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঝড় নামে।
অরু আর মিঠুকে তরী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। একা হয়ে পড়েছেন বাবা। আজ নিজেকে সত্যিকার অর্থেই একা লাগছে। ভীষণ একা। যতটা একা হলে আর পৃথিবীর স্বাদ গ্রহন করার ইচ্ছে থাকেনা!
তবুও পরিস্থিতি আমাদের বাঁচতে বাধ্য করে। আমরা বাঁচি কারো টা*নে। কিসের যেন একটা দায়বদ্ধতা থাকে আমাদের। পরক্ষণেই কিছু একটা অনুভব করি। হয়তো উপলব্ধি করি জীবন নামক রেলগাড়ীটি সত্যিই বৃথা অথবা জীবন এত সুন্দর কেন? আমি তাকে আরো কাছ থেকে জানতে চাই। পৃথক পৃথক মানুষের ক্ষেত্রে ধারণাটা ভিন্ন।

বিভীষিকাময় জীবন পার করে মাহমুদ-তরীর জীবনে নামলো আষাঢ়ের ঝুমঝুমি বৃষ্টি। এই আষাঢ়ে তরী সদ্য ফোটে ওঠা এগুচ্ছ কদম ফুলের মতোই সুন্দর মাহমুদের কাছে। আলোকসজ্জায় জমজমাট ফ্ল্যাটের একটা ঘরেই তরী বসেছিল। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বারান্দাটা তাকে খুব করে টা*ন*লো। মেহেদী রাঙানো হাত দুটো শক্তপোক্ত গ্রিল ছুঁয়ে দাঁড়ালো। জীবনের প্রতি অদ্ভুত এক টা*ন কাজ করে তার। স্বপ্নগুলো রঙিন হয়ে ওঠে। যখনই অরু, মিঠু আর বাবার কথা ভাবে, নিমিষেই ফিকে হয়ে যায় সবকিছু। সব সুখ, উল্লাস ঝরঝর করে ভেঙে পড়ে।
তরীর ভীষণ দুঃখ হয়। মন খা*রা*পে*র মাঝেই তার সিঁদুর রাঙা নরম হাত দুটোতে আলতো হাতের ছোঁয়া পড়ে। তরীর পুরনো ভাবনা কে*টে নতুন ভাবনায় ডুব দেয়। আবছা আলোয় বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে ওই হাতের মাঝে। মাহমুদ শব্দ করলোনা। শব্দহীন পেছনে দাঁড়ালো। আজ আর বাঁধা নেই। নিজ থেকে প্রথম তরীর খুব নিকটে এলো। তরীর হাত ছেড়ে মাহমুদের হাত দুটো তরীর কোমর স্পর্শ করলো। পেছন দিক থেকেই জড়িয়ে ধরলো তাকে। আবেগঘন মুহূর্ত সৃষ্টি হলো। দুদিক থেকেই কোন বাঁধা নেই। চোখ বুজে নিলো তরী। ঠোঁটে ক্লান্তির মাঝেও একটুখানি প্রশান্তির ছাপ। বুকের ভেতর দুরুদুরু ভয় আজ ঠেলে বেরিয়ে গেছে। এখন কেবল আছে ভালোবাসা। মাহমুদের কন্ঠস্বর প্রসক্ত।

-“সৃষ্টিকর্তা আমায় একটুকরো সুখ দিয়েছেন, তরী। আমি তার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবোনা। তিনি আমার আর্জি শুনেছেন। তোমায় আমার করে দিয়েছে, তরী। তার কাছে কতটা আকুতি করে তোমায় চেয়েছি, তরী তুমি জানো না।”

তরী অবাক হয়। এই মানুষটা তাকে এতটা চেয়েছে? অনিমন্ত্রিতভাবে আসা প্রেম তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে বহুদূর। তরী শুধায়,
-“আপনি আমায় ঠিক কবে থেকে মুনাজাতে রেখেছেন?”

মাহমুদ আলতো হাসে। হিসহিসে হাসির শব্দে কান ধাঁধিয়ে যায় তরীর। উষ্ণ শ্বাস গলার কাছটাতে পড়তেই একটুখানি মিইয়ে যায়।
মাহমুদ বলল,
-“তোমাকে আল্লাহর কাছে চাইবো, আমি কখনোই ভাবিনি। প্রথম দেখাতেও আমার চোখে তোমার জন্য কোন ভালোলাগা ছিলোনা। কেবল একরাশ স্তব্ধতা ছিলো। পরপরই তোমাকে নিয়ে কৌতুহল হতো। তারও অবশ্য কারণ আছে। তুমি আমাকে দেখলেই পালাতে৷ পরে যখন পালানোর কারণটা উপলব্ধি করলাম তখন আমার ইন্টারেস্টিং লাগলো। ভাবলাম একটু বিভ্রান্ত করা যাক তোমায়। কিন্তু দিন দিন তুমি আমার চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়েছো। আমাকে জড়িয়ে ফেলেছো তোমার মাঝে। তবুও আমি প্রথমদিকে ভাবতাম এটা কেবলই মুগ্ধতা। ধীরেধীরে বোধদয় হলো আমার। অজান্তেই তোমাকে চেয়ে বসলাম মুনাজাতে। সেদিন নিজেই অনেকটা বিস্মিত হলাম নিজের কাজে। আহবান ছাড়াই আমার জীবনে প্রেমের বৃষ্টি নামলো। খাঁ খাঁ করা রোদ্দুরে এক পশলা বৃষ্টি ঝরালে আমার হৃদয়ে। তারপর থেকে রোজ নিয়ম করে চাইলাম। তোমার কাছে তোমাকে নয়, খোদার কাছে আমার সুখকে।”

তরীর চোখেমুখে বিস্ময়, ভালোলাগা, মুগ্ধতা, ভালোবাসা সবকিছুই জায়গা করে নিয়েছে। তার চোখজোড়া ব্যাকুল ভঙ্গিতে মাহমুদকে দেখতে চাইলো। মাহমুদের হাত ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেহেদি রাঙানো নরম হাত দুটো মাহমুদের গালে জায়গা করে নিলো। ঘোর নিয়ে খুঁটিয়ে মাহমুদকে দেখলো। মাহমুদও মুগ্ধতার চোখে স্নিগ্ধ এক মানবীকে অবলোকন করলো। যার উপর একমাত্র তারই হক রয়েছে৷ আজ মেয়েটা ভয়ঙ্করভাবে তাকে টানছে। উষ্ণ ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলো তরীর প্রশস্ত ললাটে। আবেশিত হলো তরী। চোখজোড়া তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

★★★

কাক ডাকা ভোর, অথচ একরত্তি ঘুম নেই চোখে। সারারাত নিষুপ্তিহীন কেটেছে তরীর। মাহমুদ উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। বালিশে হেলান দিয়ে তার খালি পিঠে হাত ছুঁইয়ে দিলো তরী। লজ্জায় রাঙা হলো গাল দুটো। অল্প ভেজা চুল মেলে দিয়েই মাহমুদের পিঠে মাথা রেখে এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো। উপুড় হয়ে থাকা মাহমুদের ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো। সেও তরীর মতোই জেগে আছে। তবে প্রকাশ করলোনা। কিছু ভালোলাগা নিরব হয়, একান্তই ব্যক্তিগত। তরীর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সে নিজেকে মাহমুদের বাহুডোরে আবিষ্কার করলো। তার চুলের ভাঁজে চিকন আঙ্গুল চালিয়ে দিল। হুট করেই সময়ের কথা মনে পড়তেই সে সময় দেখলো। নয়টার চেয়ে একটু বেশি সময় হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাদের ডাকতেও এলোনা! তরী ঝটপট নিজেকে ছাড়িয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো। মাথায় লম্বা ঘোমটা টে*নে পরিচত মুখ খুঁজতে ব্যস্ত। ইরার সাথে দেখা হতেই সে স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-“কাউকে খুঁজছো তরী? অরু আর মিঠুকে? তারা নাস্তা করে বেরিয়েছে রামির সাথে। তুমি মাহমুদকে ডেকে তুলে দুজনে নাস্তা করে নাও।”

তরী ভাবলো হয়তো ইরা ভাবি লজ্জাজনক কোন কথা বলবেন। সে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিতেই ইরার স্বাভাবিকতায় অবাক হলো। ভালোলাগলো তার। তরী মাহমুদকে ডেকে দিয়ে ফের বেরিয়ে এলো।
দুজনে নাস্তা করতে বসেছে একসাথে। অনেকেই ঠোঁট চেপে হাসছেন। তরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অস্বস্তিতে তার খাওয়া থেমে গেল। মাহমুদ খেয়াল করতেই জিজ্ঞেস করলো,
-“খাচ্ছো না কেন?”

ইরা সবটা তদারকি করছিল। সে বেশ শব্দ করেই বলল,
-“বিয়ে, সংসার সবটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে হাসাহাসি করে একজন নতুন মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলা উচিত না।”

যাদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, তাদের মাঝেই একজন বলল,
-“এটা সব নতুন বউদেরই বুঝতে হয়। যারা মজা বুঝেনা, তাদের সাথে কথা বলাই বৃথা।”

ইরা রাগ করলোনা। মৃদু হেসে বলল,
-“অবশ্যই মজা করবেন। তবে সে এখন এখানে সম্পূর্ণ নতুন। নিজেকে সবটার সাথে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। এভাবে করলে সবারই খা*রা*প লাগা কাজ করে। যখন সবার সাথে মিশে যাবে, তখন এই মজাটা সেও উপভোগ করবে।”

মাহমুদ আর কথা বললোনা। তরীর দিকে খাবার এগিয়ে ইশারায় খেতে বললো। ভাবি নিজেই সবটা সমাধান করে দিলেন। তরী কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো। সত্যিই তার এতক্ষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। ইরা বিনিময়ে হাসি উপহার দিলো।

তরীর বাসা থেকে মেহমান আসলো। আশ্চর্য হলো সাথে চাচাকে দেখে। তিনি এগিয়ে এসে তরীর মাথায় হাত রাখলেন। তরীর নম্রতা দেখে তিনি মন থেকেই চাইতেন ভাইয়ের মেয়েটা নিজেদের কাছেই থাকুক। মেয়েটা তাদের নিজ হাতে গড়া মানুষ। অন্তত তাকে নিয়ে কোন আতঙ্ক থাকবেনা। ইচ্ছেমতো চালানো যাবে। তিয়াসের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন তরীকে নিয়ে তার আপত্তি নেই। হুট করেই ভাইকে বিয়ের কথা বলে বসলেন। তাদের সুসম্পর্কের কারণে তরীর বাবাও আর না করলেন না। সবটা ঠিকঠাকই ছিলো। মাঝখান থেকে মেয়েটার মতামতের তোয়াক্কা করলেন না কেউই। নিজেরাই নিজেদের অপ*মান ডেকে এনে মনমালিন্য করলেন। অহমিকায় অন্ধ হয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরাট দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। দুঃসময়ে আপনজন হয়েও পাশে থাকার প্রয়োজন মনে করেন নি। সবসময় কাজের বাহানায় দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছেন। এখন অবশ্য তিনি লজ্জিত। ভাইয়ের বারবার অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। আজ আবারও তরীর বাবা ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসে রইলেন। ক্ষো*ভে*র বশে দুজনই দুজনকে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন। তবে আজ ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব ভুলে একে অপরকে বুকে টে*নে নিলেন। পুরুষরা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের মাঝের দূরত্ব ঘুচাতে পারে, নারী তত তাড়াতাড়ি পারেনা। তাদের মনে ভালোবাসার মতোই ঘৃণাটাও তীব্র। আজ তরীর বাবা আর চাচার মাঝে তার মা আর চাচি থাকলে এতটা দ্রুত সবটা ঠিক হতো না। তারা নিজেদের ইগো ধরে রাখতে হলেও দূরত্ব বৃদ্ধি করতেন আরো কিছুকাল।

তিয়াসের বাবা বললেন,
-“সুখে থাকিস, মা। তোদের দুঃসময়ে পাশে থাকিনি। তবে আজ আর নিজেকে একা মনে করবিনা। চাচা-চাচি তোদের পাশে আছি।”

তরীর ভীষণ ভালোলাগলো সবটা ঠিক হয়ে যাওয়াতে। সৃষ্টিকর্তা চাইলে কি-না করতে পারেন? কিছুই তার ক্ষমতার বাইরে নয়। তরী বলল,
-“বেয়া*দবি করার জন্য আমাকেও ক্ষমা করবেন চাচ্চু। সেদিন আমিও আপনাদের সাথে খা*রা*প ব্যবহার করেছি। আর মিঠুর কথায় মনে কষ্ট ধরে রাখবেন না। ছোটো মানুষ মুখে যা এসেছে বলে ফেলেছে।”

তিয়াসের বাবা হেসে বললেন,
-“আমার মনে আর কারো জন্যই রাগ অবশিষ্ট নেই।”

একবুক প্রশান্তি নিয়ে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলো তরী। সকলের যাওয়ার মুহূর্তে তরীর বাবা তাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা তুললেন। মাহমুদ সকলের কাছে কিছু কথা বলার অনুমতি চাইলো, বিশেষ করে মায়ের কাছে।
-“আমি কিছু কথা বলতে চাই মা।”

আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“বল।”

মাহমুদ বিনয়ের সাথে নরম সুরে বলল,
-“তরী আপাতত তার বাবা আর ভাই-বোনের সাথেই থাকুক। তাদের দেখার জন্য এখন তরীকে দরকার। পরে নাহয় কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তরী এখানে সবার সাথে থাকবে।”

আয়েশা সুলতানা চুপ করে আছেন। কিছুই বলছেন না। সকলেই উনার জবাবের প্রতিক্ষায় বসে আছেন। তিয়াসের বাবা তরীর বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তিনতলা তো এখনো খালিই পড়ে আছে। এতটা ঝামেলা করার দরকার কী? জামাই তার পরিবার নিয়ে সেখানে উঠলেই সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।”

তরীর বাবার ব্যাপারটা মনে ধরলো। বললেন,
-“মন্দ বলো নি ভাইয়া। আমি আসলে ভেবে দেখিনি।”
অতঃপর মাহমুদ আর আয়েশা সুলতানার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“আমাদের বাসায় উঠলে ভালো হতো। ভালোলাগতো আমার।”

মাহমুদ কিছু বলার আগেই আয়েশা সুলতানা জবাব দিলেন।
-“আপনাদের বাসায় উঠতে আমাদের সমস্যা নেই। তবে আমরা ঠিক তেমনটাই থাকবো, যেমনটা পূর্বে ভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলাম।”

তরীর বাবা বললেন,
-“ছিঃ! ছিঃ! এখন আপনারা আমার আত্মীয়।”

আয়েশা সুলতানা বাঁধা দিলেন।
-“তবে আমরা থাকতো পারবোনা আপনার বাসায়। আমাদের সম্পর্ক সব জায়গায় ঠিক থাকলেও বাড়িতে থাকাকালীন বাড়ির মালিক আর ভাড়াটিয়ার মতোই সম্পর্ক থাকবে। এখানে যেমন ভাড়া দিয়ে থাকি, ওখানেও তেমন ভাড়া দিয়েই থাকবো। আপনি যেমন আত্মসম্মানের জোর ধরে রাখতে চাইছেন, তেমনই আমিও চাই আমার ছেলের সম্মান বজায় থাকুক।”

আয়েশা সুলতানার উপর আর কথা বলার মতো ভাষা পেলেন না তরীর বাবা। সকলেরই আয়েশা সুলতানার সিদ্ধান্ত পছন্দ হলো। তবে এ বাসা ছাড়তে ছাড়তে আপাতত তরী তার বাবার কাছেই থাকবে।

#চলবে…….

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

আজ এক জায়গায় দাওয়াত পড়েছে বিধায় মাহমুদের বড়ো ভাইয়া তরীকে সাথে নেওয়ার জন্য তরীর বাবাকে ফোন করলেন। দাওয়াতের মূল উপলক্ষ্য মাহমুদ আর তরীর বিয়ে। তাদের নিয়েই পরিবারসহ দাওয়াত পড়েছে। বড়ো ভাইয়া ফোন হাতে নিয়ে বসে আছেন। রিং হলেও কোন রেসপন্স নেই। ইরা পাশেই জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখছে।

সকালে বাবার ফোন বেজে উঠলো। বাবাকে আশেপাশে না দেখে ছোট্ট অরু চোখ ডলতে ডলতে ফোন রিসিভ করে কানে তুললো।
-“হ্যালো কে?”

-“আমি তোমার বুড়ো বর বলছি গো, সুন্দরী বউ।”
কন্ঠস্বরে সম্পূর্ণ ঠাট্টার সুর টের পেলো অরু।

সকাল সকাল তার মেজাজ খা*রা*প হয়ে গেলো। চেঁচিয়ে বললো,
-“এই কে বলছেন?”

হাসির শব্দ ভেসে আসছে। অরুর নাকের পাটা ফুলে উঠলো। সাথে গাল দুটোও ক্রমশ ফুলে উঠছে। নিমিষেই বুঝে গেল ফোনের ওপাশের মানুষটি কে!
বড়ো ভাইয়া বললেন,
-“আমি তোমার বর বলছি গো, বর।”

অরু রাগ ঝেড়ে বলল,
-“হি হি করে হাসছেন কেন? দাঁত ব্রাশ করেছেন?”

করুন সুর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
-“না, টুথপেষ্ট, ব্রাশ কিছুই নেই। তুমি কিনে দেবে?”

অরু বুঝলো সত্যিই ব্রাশ, টুথপেষ্ট নেই। সাথে সাথে নাক চপে ধরলো। দুর্গন্ধ লাগছে প্রকাশ করতেই “উঁহ”
শব্দ করলো।
তরী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কার সাথে কথা বলছিস, অরু?”

অরু নাকে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
-“নাও, মাহমুদ ভাইয়ার ভাই। তুমিও নাকে হাত দাও। উনি ব্রাশ করেন নি। প্রচুর দুর্গন্ধ আসছে।”

তরী হাসতে হাসতে ফোন হাতে নিলো। মুঠোফোনেও যে কারো মুখের দুর্গন্ধ টের পাওয়া যায়, তা অরু না বুঝালে সে বুঝাতোই না।

ফোন কানে তুলে সালাম দিলো তরী।
ভাইয়া সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
-“আঙ্কেল কোথায় তরী? আজ আমাদের দাওয়াত আছে সকলের। তুমি আর মাহমুদ যাচ্ছো। সেটা বলতেই আঙ্কেলকে ফোন করলাম।”

তরী মৃদুস্বরে বলল,
-“বাবাকে দেখছিনা। ঘরে ফিরলে কল ব্যাক করতে বলবো।”

ভাইয়া মেনে গেলেন।
নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখতেই বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল। মাহমুদও বেরিয়ে এসেছে। মিঠু ঘুমাচ্ছে। সে ছাড়া সকলেই টেবিলে উপস্থিত। তরী বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
-“বড়ো ভাইয়া কল দিয়েছেন, বাবা। তোমার সাথে কথা বলবে।”

মাহমুদ বলল,
-“আমাদের আজ দাওয়াত আছে। আপনার পারমিশন নিতেই বোধহয় ভাইয়া কল দিয়েছেন!”

তরীর বাবা মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও মুখে প্রকাশ করলেন না। তারা চাইলেই এখন তরীকে তার বাবার পারমিশন ছাড়া যেকোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। অথচ ভদ্রতা বজায় রেখে পারমিশন চাইতে কল করেছেন। নাস্তা করার আগেই তরীকে বললেন,
-“আমার ফোন এনে দে, তটিনী।”

তরী ফোন বাড়িয়ে দিতেই বাবা কল দিলেন মাহমুদের বাসায়। ওদের যাওয়াতে তিনি আপত্তি করেননি। মাহমুদ হাসলো। তার হাসি অগোচরেই থেকে গেল। চাইলে শুধু সে নিজেই পারমিশন নিতে পারতো। তবুও ভাইয়াকে দিয়ে কল করালো। দুজন পারমিশন চাওয়াতে প্রকাশ না করলেও তরীর বাবা যে সন্তুষ্ট হলেন তা বোঝাই যাচ্ছে। এভাবেই একটু একটু করে মনে জায়গা করে নেবে সে। একজন বড়ো ছেলের অভাব সে পূরণ করবে। জানেনা কতটা পারবে, তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে।
তরী অরুকে খাইয়ে দিচ্ছে। মাহমুদ অরুকে রাগিয়ে দিতেই বলল,
-“বাবা, অরু আর ভাইয়ার বিয়েটা কবে দিচ্ছেন?”

অরুর খাওয়া থেমে গেল। সে চোখ পাকিয়ে তাকালো মাহমুদের দিকে। তরী, বাবা সকলেই মিটিমিটি হাসছেন। আজ অরুকে রাগাতে তরীও যোগ দিল। বলল,
-“হ্যাঁ বাবা। আমরা দু-বোন এক বাড়িতে থাকবো। অরুকে নিয়ে তোমারও আর বাড়তি চিন্তা থাকলো না।”

অরু টুকটুক চোখে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে তেজী গলায় বলল,
-“তুমি আমায় ও বাড়ি কেন নিতে চাইছো, আমি বুঝিনা ভেবেছো?”

তরী না বোঝার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন?”

অরু আরেকটু তেজ ঢেলে বলল
-“তুমি পায়ের উপর পা তুলে খাবে আর আমাকে দিয়ে কাজ করাবে। আমি সব জানি। আমিতো ছোটোবোন, তুমি আদেশ করলেও না করতে পারবোনা। তাই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছো।”

তরীর চোখ চড়কগাছ। সাথে বড্ড হাসি পেলো। মাহমুদ ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“তরী, অরুকে সবকাজ শিখিয়ে দিও। আমাদের বাড়ি গেলে তো তাকে আবার কাজ করতে হবে।”

-“আমি কাজের মেয়ে না। কতটা স্মার্ট আমি, তুমি দেখেছো?”
অরুর রাগ বাড়িয়ে সকলেই আনন্দ পাচ্ছে। বাবা অরুর রাগকে কান্নার দিকে যেতে দেখে আদুরে স্বরে বললেন,
-“কে বলেছে আমার মা’কে বুড়োলোকের সাথে বিয়ে দেবো? তার জন্য ঘোড়ায় চড়ে সুদর্শন রাজকুমার আসবে।”

অরুর কান্না খানিকটা রোধ হয়ে এলো। যোখান থেকে শুরু হলো, সেখানেই থেমে গেল। সাথে তরী আর মাহমুদের সাথে বড্ড রাগ করলো।

★★★

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছে তরী। একটুপরই তারা বের হবে। মাহমুদ ফ্রেশ হয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। চেয়ারের উপর তোয়ালে ছুঁড়েই তরীর কাছাকাছি ঘেঁষলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়নার মাঝেই তরীর দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। তরী জমে গেল। নড়চড় করলো না। গালদুটো ক্রমশ আরক্তিম হলো। ভীষণ ভালোলাগা মুহূর্তেও তার ভয়ঙ্কর লজ্জা হচ্ছে। ঢোক গিলে মাহমুদের কাছ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলো। সরতে পারলোনা। শক্ত হয়ে আটকে রইলো মাহমুদের হাতের বন্ধনে। দুল খানিক সরিয়ে কানে শব্দ করে চুমু খেলো মাহমুদ। তরী চোখজোড়া আবেশে বন্ধ করে নিলো। ঘন হয়ে এলো মাহমুদের শ্বাস।
গভীর স্বরে বলল,
-“তুমি এই দুদিনেই ভীষণ ভয়ঙ্কর সুন্দরী হয়ে উঠেছো, তরী। আগের তুলনায় তোমাকে আমার আরো বেশি পেতে ইচ্ছে করে।”

তরীর ঠোঁটে লজ্জালু হাসি। মুখ লুকাতে এদিক ওদিক তাকালো। মাহমুদ তরীর এলেমেলো দৃষ্টিতেও মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে। তরী কেবল মাহমুদের ক্ষীণ চোখজোড়ায় ব্যাকুলতা টের পাচ্ছে। এতটা কাছে থেকেও মানুষটা কতটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে। লম্বা শ্বাস নিলো তরী। এবার নিজ থেকেই মাহমুদের উপর শরীরের ভর ছেড়ে দিল। সরে যাওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র ছটফট করলোনা। মৃদু স্বরে বলল,
-“আমি তো আপনার কাছেই আছি। যতটা কাছে হলে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা, ঠিক ততটা কাছে।”

মাহমুদের স্বর গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। তরীর ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল,
-“যেই তটিনীতে একদিন ভেসে গিয়েছিলাম, সেই তটিনীতে এবার আকন্ঠ মুগ্ধতায় ডুবে থাকতে চাই।”

তরী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে শার্টের কলারে আলতো হাত রাখলো। হুট করেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। মাহমুদের গলায় অধর ছুঁইয়ে ঝটপট সরে দাঁড়ালো। মাহমুদ আর তার নাগাল পেলোনা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই হিসহিসিয়ে হেসে বলল,
-“অসময়ে বড্ড জ্বালাচ্ছো, তরী। এই মুহূর্তে বের হতে না হলে জমের কাছে তোমার রক্ষা থাকতো না।”

তরীও হেসে বলল,
-“যেই জমের কাছে প্রেম আছে, তার কাছ থেকে রক্ষা পেতেও চাই না।”

চোখজোড়া ক্ষীণ করে রগঢ় করে মাহমুদ বলল
-“তাই না? খুব প্রেম পাচ্ছে?”

তরী জবাব না দিয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তৈরি হয়ে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তরী আর মাহমুদ বের হলো। অরুকে কোলে তুলে আগে আগে সিঁড়ি ধরে নামলো মাহমুদ। গাড়িতে চড়েই একহাতে তরীর হাত আঁকড়ে ধরলো। এদিকে অরুকে কোলে নিয়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

★★★

রামি আর মিঠু দুজনই ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন টিচার তাদের দুজনকে দুষ্টুমির জন্য ওয়ার্নিং দেন। আজ একেবারে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। রামি মাঝেমাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে স্যারের দিকে। তিনিও আবার ওদের দুজনের দিকে চোখ রাখছেন। কান থেকে হাত সরিয়ে নিলো মিঠু। বেচারার হাত প্রচন্ড ব্যথা হয়ে আছে। তা দেখে স্যার তেড়ে এসে মা*রতে গেলেন। মিঠু বেঞ্চ ছেড়ে দৌঁড়ে টিচার ডেস্কের সামনে চলে গেল। স্যার পূর্বের জায়গায় ফিরে ডেস্কের উপর দিয়ে মা*র*তে যেতেই ডেস্কসহ মিঠুর গায়ে পড়তে নিলেন। দু’হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে মিঠু। স্যার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। তিনি ওভাবে থেকেই মিঠুকে আঘাত করতে চাইলেন। স্যার সহ ডেস্ক ধরে রাখার শক্তি না পেয়ে ডেস্ক ছেড়ে একপাশে সরে গেল মিঠু। স্যার ধপ করে ডেস্ক নিয়ে পড়লেন। ছাত্র-ছাত্রী সকলেই মুখ চেপে হাসছে। সবাই উনাকে” জম “স্যার বলে ডাকে। সেই জম স্যারকে জমের মুখে পড়তে দেখে কেউই মজা নিতে বাদ রাখলোনা। কারো হাসিরই শব্দ হলোনা। রামিটা একটু আওয়াজ করে হেসেই নিজের সর্ব*নাশ ডেকে আনলো। ক্ষেপা বাঘ মিঠুকে ছেড়ে রামির দিকে তেড়ে এলেন। যতদূর হাত চলেছে, রামিকে বেতের আঘাত করলেন। মিঠু নিজেই স্যারের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো।
-“স্যার ওর ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন আর কাল থেকে দুষ্টুমি করবোনা। এভাবে মা*র*লে রামি অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

স্যার মিঠুকেও আচ্ছামতো পি*টি*য়ে শান্ত হলেন। দুই বন্ধু মা*রে*র দাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বের হলো। মাঠে ঘাসের উপর বসেই একে অপরকে পানি এগিয়ে যত্ন নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পরক্ষণেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে স্যারের কথা মনে করে হেসে কুটিকুটি হয়ে পড়লো। কেউ দেখলে বলবেই না একটু আগে দুজনকে স্যার বেধড়ক মা*র মে*রে*ছে।

★★★

দাওয়াত থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল। তরীর ভীষণ মাথা ধরেছে। অরু আর তরীকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো মাহমুদ। ভাইয়া আর ভাবি কাল তাদের নিজের বাসায় চলে যাবেন।
অরুকে কোলে নিয়েও তরীর মাথাটা আলগোছে নিজের ঘাড়ের দিকে টে*নে নিলো মাহমুদ। অরুর আড়ালেই ভীষণ যত্নে তরীর মাথায় চুমু খেলো। পিঠের উপর হাত নিয়ে বলল,
-“ভালো হয়ে যাবে ব্যথা। তুমি চুপটি করে চোখ বুজে থাকো।”

#চলবে…….