অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী ২ পর্ব-১৬+১৭

0
251

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ব্রেক টাইমে কফিতে চুমুক দিতে দিতে অবনির সাথে খোশগল্পে মেতেছে সুহা।
অবনি ইনিয়েবিনিয়ে ইবতেসামের কথা জিজ্ঞেস করতে চাইলো। কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পেল না। সুহা তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করলো অবনিকে। শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী জানতে চাস? এতটা মোচড়ামুচড়ি না করে বলে ফেল।”

অবনি অপ্রস্তুত হাসলো। দ্বিধা নিয়ে বলল,
“ইবতেসাম?”

এতটুকু বলেই ঢোক গিলে নিলো। এই মুহূর্তে সুহাকে তার বড্ড ভয় হচ্ছে। মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে।
সুহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি রীতিমতো বিরক্ত। নিজেই নিজের উপর বিরক্ত। ইচ্ছে করে পালিয়ে বেড়াতে।”

অবনি একটু সাহস করে সুহার হাতে হাত রাখলো। চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বলল,
“জীবনকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখ। অতীত ভুলে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা কর। এভাবে জীবন চলে না সুহা। হয়তো আমি তোকে নিয়ে আজ ভাবছি। যখন আমি বিয়ে করে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাব, তখন সব কিছুর চাপে তোর কথাটাও ভুলে যাব। তাই বলে যে একেবারে ভুলে যাব, তেমন নয়। সারাদিন তো আর তোকে নিয়ে ভাবার সময় পাবো না।”

সুহা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো। তার মাথায় কী চলছে, সেটা আন্দাজ করতে পারলো না অবনি।
চুপচাপ কফি শেষ করে সময় দেখলো। আরও পাঁচ মিনিট সময় আছে। সুহা নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। কাজ করতে করতে একসময় তার হাত থেমে গেল। কিছু একটা ভাবনা তাকে থামিয়ে দিল।

★★★

সাদাদ অফিসের জন্য বের হচ্ছে। ঈশিতার স্কুল যাওয়ার সময়। ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে এলো। এক্ষুণি তার স্কুলের গাড়ি এসে পড়বে। সে বায়না ধরলো আজ পাপার সাথে বের হবে। সাদাদ মেয়েকে নিয়ে বের হলো। পাপার কনিষ্ঠ আঙ্গুল মুঠোবন্দি করে নিলো ঈশিতা। দুটো বিনুনি ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আপন খেয়ালে। সাদাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার আর মেয়ের বন্দি হাতজোড়ায়। ভীষণ ভালোলাগছে। যেদিন ঈশিতাকে প্রথম কোলে নিয়েছিল, সেদিনই মনে হয়েছে তার জীবন পরিপূর্ণ। বাবা হওয়ার স্বাদ পূর্ণ হওয়ার মাঝে যে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি আছে, সাদাদ এখন পর্যন্ত সেই তৃপ্তিটা অনুভব করে। ঈশিতা যখন পাপা বলে হাজার বায়না করে, তখনই মনে হয় কী যেন চেয়েছি, আমি তারে পেয়েছি! ইরা দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের অদৃশ্য হওয়া দেখলো।
ঈশিতা হুট করেই এক থমকে যাওয়া প্রশ্ন করলো।
“আচ্ছা পাপা, সবাই আমাকে কেন বলে, আমি তোমাদের মেয়ে না? তুমিই বলো পাপা, আমি তো তোমাদেরই মেয়ে।”

সাদাদের হৃৎস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। মেয়েকে জবাব দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রথমে শান্ত করা জরুরী। বড়ো দম নিয়ে আলতো হাসলো। ঈশিতার গালে হাত রেখে বলল,
“সবাই তেমায় ক্ষে*পা*নো*র জন্য দুষ্টুমি করে বলে। তুমি কখনোই এসবে রা*গ করবে না। তোমার ছোটো চাচ্চুকেও সবাই ছোটোবেলায় এসব বলে ক্ষে-পা*তো। তাই বলে কি তোমার চাচ্চু এসব মাথায় নিয়েছে?”

ঈশিতা ফিক করে হেসে ফেললো। উৎসুক হয়ে বলল,
“ছোটো চাচ্চুকেও এসব বলতো? চাচ্চু নিজেও তো অমিকে এটা বলে থাকে।”

সাদাদের বুকের উপর থেকে বোঝা নেমে গেল। প্রত্যুত্তরে সেও হাসলো। বলল,
“হ্যাঁ, ছোটোবেলায় সবাইকেই বড়োরা দুষ্টুমি করে এসব বলে থাকে।”

মাথা দুলিয়ে এগিয়ে গেল ঈশিতা। সে জানে, পাপা তাকে মি*থ্যা বলবে না। সে প্রফুল্লচিত্তে এগিয়ে গেল।

অরু ক্লাস শেষে বের হলো। বন্ধুদের সাথে আজ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে হলে ফিরবে। সবার হাতে হাতে টং দোকানের চা। খুব আয়েশ করেই সবাই এক একটা চুমুক বসাচ্ছে। মিথুন টাইমার অন করে বন্ধুদের নিখুঁত সময়ের ছবি ক্যামেরা বন্দি করলো। অরু চশমার ফাঁক দিয়ে ঝাপসা কিছু দেখলো। চোখ বুজে আবারও তাকালো। হাস্যজ্জ্বল চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসছে রামি। নিজের ভ্রম ভেবে সবার সাথে আড্ডায় মনোযোগ দিল। বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারলোনা। রামি পেছনে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠলো,
“অরু।”

অরুসহ তার সব বন্ধুরা পেছনে তাকালো। সবাই রামিকে আগেও অরুর সাথে দেখেছে। বিয়ের পর ছবিও দেখেছে। সে ক্ষেত্রে চিনতে অসুবিধা হয়নি। রামি এগিয়ে এসে অরুর পাশে দাঁড়ালো। তার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকা সকলের উদ্দেশ্যে চমৎকার হাসি উপহার দিলো। বিনিময় হলো কুশলাদি। অরুকে বলল,
“সবার সাথে আড্ডা শেষ হলে আমাকে একটা কল দিস।”

অরুর বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠলো,
“তার প্রয়োজন নেই। আপনার বউকে এখনই নিয়ে যেতে পারেন। আমরা প্রতিদিনই একে অপরের দেখা পাই।”

রামি কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। অরু সবাইকে বিদায় জানিয়ে রামির পাশে পা মিলিয়ে হাঁটলো। রামি হাঁটার মাঝেই অরুর হাত মুঠোবন্দি করে নিলো। অরু দাঁড়িয়ে পড়লো। রামি ওদিকে না তাকিয়েই বলল,
“আমাকে এগোতে দিবি না, অরু? আর কত সময় একই জায়গায় থেমে থাকবো?”

অরুর মুখের বুলি বন্ধ হয়ে গেল। রুদ্ধ গলার ফাঁক গলিয়ে কেবল একটি শব্দ বেরিয়ে এলো,
“মানে?”

রামি অরুর দিকে ফিরলো। মিটিমিটি হেসে বলল,
“আমি পথ এগোনোর কথা বলেছি। তুই চাইলে আমি সবরকম ভাবে এগোতে পারি।”

অরু গলা ঝেড়ে হম্বিতম্বি করে বলল,
“হাঁটো। আমি কি তোমায় ধরে রেখেছি না-কি?”

“কখন এসেছি, জিজ্ঞেস করবি না?”

“কখন?”

“মায়ের সাথে দেখা করেই তোর কাছে এসেছি।”

“ওহ্।”

“শুধু ওহ্?”

অরু কেমন অস্থিরতা অনুভব করছে। অযথাই ঠিক করা চুল কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। রামি তা দেখে হাসলো। ঠান্ডা গলায় বলল,
“তোকে এই রূপেও ভালোলাগছে। তবে রণচণ্ডী রূপটাই আমার বেশি পছন্দ।”

অরু ধীরে ধীরে নার্ভাস হয়ে পড়ছে। কান দিয়ে তাপ বের হচ্ছে তার। কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে রা*গ*টা*ও কেমন উবে গেল। মেকি রা*গে*র ভান করতে গিয়েও ধরা পড়ে গেল।
“আজকাল বেশিই কথা বলছো।”

কথা খানা বলতে গিয়ে অনুভব করলো রাগ প্রকাশ করার পরিবর্তে একেবারে শান্ত হয়ে গিয়েছে৷ রামি ঠোঁট টিপে হাসলো। আকস্মিকভাবেই আবিরের সাথে দেখা। তাদের দেখে আবিরও দাঁড়িয়ে পড়লো। একপলক রামি আর অরুর হাতে দৃষ্টি দিয়ে চলে গেল।
“অরু!”

রামির ডাকে তার দিকে ফিরলে অরু। প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। রামি স্মিত হেসে গভীর স্বরে বলল,
“সেদিন কার জন্য সেজেছিস, আর কার চোখে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিস?”

এবার অরু নিজেও মুখ আড়াল করে হাসলো। আবিরের পরিবার দেখতে আসবে বলে সাজলেও রামির জন্য পার্মানেন্ট হয়ে গেল। অরু আড়াল করতে চাইলেও রামির নজরে ওই হাসি ধরা পড়ে গেল। অনেক তো হলো ঠান্ডা অনুভূতি। রামি ছটফট করে উঠলো অরুকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। বলল,
“এমন হাসবি না অরু। লোকে ভয় পাবে। রাক্ষসীদের হাসিও এরচেয়ে বেটার।”

অরু ফোঁস করে উঠলো।
“তোমার হাসি খুব সুন্দর, তাইনা? এমনি এমনি তো গরু বলি না আমি!”

“অরু এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। যখন জানিসই আমি গরু, তখন মানুষ হয়ে গরুকে বিয়ে করতে গেলি কেন?”

“বাধ্য হয়ে।”

রামির গলা ধীরে চললো।
“সত্যিই কি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিস?”

“আমি ছাড়া আর কে যেচে পড়ে গরু বিয়ে করতে যেতো?”

খোঁচাটা তীরের মতো এলেও পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রামি হেসে বললো,
“গরুর জন্য এতটুকু যখন ভেবেছিস, এবার কষ্ট করে তার দায়িত্বটাও নিয়ে নে।”

★★★

টানা তিনদিন ইবতেসামের দেখা নেই। এখন আর সুহার বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে না। আজও বাসার নিচে চেক করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সুহা। সবার কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচে থাকার মাঝে সে শান্তি খুঁজতে চায়।
রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই মুঠোফোন কেঁপে উঠলো টুংটাং শব্দে। সুহা স্ক্রিনে চোখ রেখেই বার্তা দেখে নিলো।
“একটু নিচে আসবেন সুহা? মনে হলো যুগ যুগ ধরে আপনাকে দেখি না।”

সুহা অবাক হলো। ইবতেসাম তাকে নিচে যেতে বলছে? বিছানা ছেড়ে দ্রুত জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। নিচে তাকিয়ে ইবতেসামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আজ সাথে গাড়ি নেই। তার জানালার দিকে মুখ করেই দাঁড়ানো।
মিঠু সুহার উপস্থিতি টের পেল বোধহয়। কী-বোর্ডে হাত চললো।
“আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন, সুহা? ঝটপট ঘরের আলো জ্বালান তো।”

সুহা আলো জ্বালানোর প্রয়োজন মনে করলো না। কঠিন হৃদয়ের মানবী কাঠকাঠ প্রশ্ন লিখলো।
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

মিঠু মেসেজ দেখে অগোছালো হাসলো। শরীরে এখনোও সকালের শার্ট জড়িয়ে আছে। চুল এলোমেলো, শরীরে আজও কাঁ*টা*ছে*ড়া দাগ। এত এত মলিনতার মাঝেও সুহাকে একপলক দেখে তার হৃদয় সতেজ হয়ে উঠলো। সে লিখলো,
“ না পাওয়া আমায় আপনাকে ভুলতে দেয়না।”

পরপর বার্তা আদান-প্রদান চললো।
“পেয়ে গেলেই মানুষ ভুলে যায়।”

“আমি আপনাকে হঠাৎ হঠাৎ মনে করতে চাইনা, সুহা। সবসময় পাশে চাই। যতটা পাশে থাকলে মনে করার প্রয়োজন পড়বে না।”

“ফুল ছিঁড়তে এসে কাঁটার আ*ঘা*ত ছাড়া কিছুই পাবেন না।”

“আ*ঘা*তে*ও স্বস্তি আছে। যদি বলা যায় “ফুল তো পেয়েছি”।

“আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন।”

“আরেকটু বিরক্ত করবো। এক কাপ চা নিয়ে আসুন তো।”

সুহা অধৈর্য হয়ে পড়েছে। জানালার পাশ থেকে সরে ফোন রেখে শুয়ে পড়লো। চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। তবুও চোখ বুজে শুয়ে রইলো। ছটফট করতে করতে আধাঘন্টার বেশি সময় কাটলো। বিছানা ছেড়ে আবারও জানালার পাশে এসে দেখলো। ইবতেসাম এখনো তার জানালায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
এক সময় বিরক্ত হওয়া ছেড়ে সে নিজেও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

রাতে কাঁ*টা*ছে*ড়া নিয়েই বাড়ি ফিরলো মিঠু। মাঝেমাঝেই শরীরে এমন ক্ষ*ত দেখতে পান বাবা। আজও দরজা খুলে মিঠুর অবস্থা দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“এসব আর কত?”

মিঠু নিজের ঘরে যেতে যেতেই বলল,
“বিয়ে করিয়ে দাও।”

বাবা স্পষ্ট শুনতে পেয়ে উঁচু গলায় বললেন,
“আগে ইচ্ছে থাকলেও এখন নেই। মেয়ের বাপের কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? তুই দুদিন পর উপরে ট*প*কে গেলে ওই মেয়ের দু*র্দ*শা সৃষ্টি হোক, সেটা আমি চাই না।”

মিঠু থেমে গেল।
“যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা কি বিয়ে করে না?”

বাবা বললেন,
“বিয়ে করিয়ে দিলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে?”

“না, শুধু ঘরে বউ আসবে।”

ছেলে এখন বড়ো হয়েছে। চাইলেও ছোটোবেলার মতো শাসন করতে পারেন না। মা মা*রা যাওয়ার পর থেকেই ছেলেটা অতিরিক্ত রুক্ষ হয়ে উঠেছে তাঁর সাথে। দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে দিনকে দিন। বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“পছন্দ আছে না-কি?”

মিঠু ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়েছে। বাবার প্রশ্নটি তার কর্ণধারে পৌঁছালো না।

★★★

আয়েশা বেগমের নির্দেশে অরুকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। অমির সাথেও অরুর সাপেনেউলে সম্পর্ক। সবার সাথে তার সম্পর্ক একমাত্র ঝগড়ার। মাহমুদ সব বাচ্চাদের জন্য চকলেট এনেছে। অরুও বাদ যায়নি। তাকেও দেওয়া হয়েছে। নিজের খাবার শেষ করে অমির চকলেট মুখে দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। মুহূর্তেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুললো অমি। সবাই অরুর দিকে তাকিয়ে আছে। সে চকলেট মুখে নিয়ে চো*রে*র মতো তাকিয়ে রইলো। রামি এসে শান্ত করলো অমিকে।
“চাচ্চু এক্ষুণি অনেকগুলো চকলেট এনে দেব তোকে।”

অমি শান্ত হয়ে বসলো। অরুকে শুনিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে বলল,
“চাচ্চু আমাকে অনেকগুলো চকলেট দেবে।”

অরু ফিসফিস করে বলল,
“বেশি করে আনতে বলবি। আমার নাম বলবি না।”

অমি জোর গলায় বলল,
“তুমি আমার চকলেট খেয়ে নিয়েছো না? তোমার জন্য চাচ্চু কেন চকলেট নিয়ে আসবে? ”

অরু থতমত খেয়ে উঠে গেল। গতকালই রামির সাথে ঝগড়া করে বলেছিল তার কিনে দেওয়া কিছুই নেবে না। অথচ আজই চকলেট আনার কথা বলে ফেললো। রামি সহ সকলেই মুখ টিপে হাসছে। অতিরিক্ত আদর পাওয়া চঞ্চল স্বভাবের মেয়েগুলো বয়স বাড়লেও নিজের মানুষদের কাছে আহ্লাদী থেকে যায়। সেই ৭-৮ বছরের বাচ্চার মতো নিজেকে প্রকাশ করে।

#চলবে…….

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বুকের ভেতর গুড়ুক গুড়ুম বজ্রপাত। বর্ষা নামলো আয়োজন করে। দূরের কারেন্টের তারে বসে আছে নাম না জানা একটি পাখি। সকাল সকাল চায়ের কাপে ঠোঁট ভিজিয়ে ক্ষীণ চোখে পাখিটি পর্যবেক্ষণ করছে মিঠু। পাশে আরও একটি পাখি হলে মন্দ হতো না। তার ঘরের পাশাপাশি জীবনটা অন্তত গোছানো হতো। সে বাইরে থেকে বেপরোয়া হয়ে ফিরলেই কেউ একজন ধমকের সুরে তাকে শাসিয়ে যাবে। নিজ দায়িত্বে সবটা ঠিক করে দিয়ে একটু পরই নরম গলায় ডেকে উঠবে,“খাবার দিয়েছি, খেতে আসো।”
মিঠু আপনমনে হাসলো। এই পাখিটি সুহা হলে বেশ হয়।
অরু মিঠুকে নাস্তা করতে ডাকতে এসেছে। তাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে দরজায় পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জহুরী চোখে পর্যবেক্ষণ করলেও বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়াতে পারলোনা। তার পূর্বেই মিঠুর চোখে ধরা পড়ে গেল। সন্দিহান গলায় মিঠু জিজ্ঞেস করলো,
“কী চাই?”

অরু দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মিঠুর চারপাশে ঘুরে বেড়ালো। ভুরু কুঁচকে নিলো মিঠু।
“এই অ*স*ভ্য, এমন করছিস কেন?”

অরু হাসি আরও প্রশস্ত করে বলল,
“বড়ো অ*স*ভ্য কী ঘটিয়ে বসে আছে, সেটাই জানতে এসেছি।”

মিঠু সাবধানী গলায় বলল,
“সবাই কি তোর মতো না-কি?”

অরু চোখ পিটপিট করে ঢং করে বলল,
“বলো বলো, হেল্প পাবে। আমার আবার দয়ার শরীর।”

“তুই হলি ঘষেটি বেগম। ষ*ড়*ষ*ন্ত্রে*র উৎপত্তিটাই তো তোর কাছ থেকে। তোকে বিশ্বাস করা আর পানি চিবিয়ে খাওয়া সমান কথা।”

“আরে ঘষেটি বেগম কখনো মীর জাফরের সাথে বে*ঈ*মা*নী করে না। বলো, কথা দিচ্ছি মীর জাফরকে জিতিয়ে ছাড়বো।”

“তুই ঘষেটি বেগম হলেও আমি বরাবরই আলাভোলা সিরাজ উদ-দৌলা ছিলাম। প্রতিনিয়ত তোর ষ*ড়*য*ন্ত্রে*র শি*কা*র হয়ে এসেছি। খবরদার আমাকে মীর জাফর বানানোর চেষ্টা করবি না!”

“এত বড়ো মি*থ্যা অপ*বাদ! মীর জাফরের বংশধর।”

মিঠু ব্যঙ্গ হেসে বলল,
“ওই বংশধরে তুই নিজেও আছিস।”

অরু সূঁচালো চোখে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই বলল,
“আমার বংশ আলাদা।”

“গরিবের কথা একদিন হলেও ফলে। আগে বিশ্বাস করিসনি। এখন এসে বিশ্বাস করছিস? ছোটোবেলায় যখন বলতাম তোকে ড্রেন থেকে তুলে এনেছি, তখন তো খুব দেমাক দেখিয়ে বাবার কাছে বিচার দিতি।”

“এত কথা বলে আমাকে ভুলিয়ে দিতে পারবে না। বলো, কোন ফুল পছন্দ করে প্রজাপতির মতো উড়ছো?”

মিঠু ভাবলেশহীন বলল,
“তোকে কেন বলবো?”

“তুমি কি ভেবেছো, আমি অনুমতি না দিলে তোমার ফুল নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারবে?”

“আপদ বিদায় করে দেওয়ার পরও নি*র্ল*জ্জে*র মতো এই বাড়িতে কী? যা এখান থেকে।”

“আমাদের মপটা খুঁজে পাচ্ছি না। ফ্লোর নোংরা হয়ে আছে। তোমাকে মপ হিসেবে ব্যবহার করলে কেমন হয়?”

“তুই অলওয়েজ কামের বেডি। লুকটাও কামের বেডির মতো। এখন চিন্তাটাও কামের বেডির মতো করছিস, অ*স*ভ্য।”

দুজনের কথা কা*টা*কা*টি*র মাঝে রামি এসে উপস্থিত হলো।
“কীরে, কী নিয়ে ঝগড়া করছিস দুজন?”

রামিকে দেখতে পেয়েই মিঠু চ*টে গেল।
“আপদ তোর ঘাড়ে উঠিয়ে দিয়েছি। তবুও আমার ঘরে কী করে আসে? এই চিড়িয়াখানার জ*ন্তু*টা*কে আজই বন্দি কর। দুনিয়ার মানুষগুলোকে জ্বালিয়ে খেল।”

রামি মিঠুর সাথ দিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উদাসী গলায় বলল,
“আমার জীবনটাকে কি আর শান্তি দিলো? ঘাড়ে তো উঠিয়ে দিলি। প্রতিনিয়ত আমাকে আ*ক্র*ম*ণ করতে আসে।”

অরু দুজনের কথা শুনে ফুঁসে উঠছে। কোমরে দু’হাতে রেখে নাকের পাটা ফুলিয়ে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো। রামি ভয়কাতুরে গলায় মিঠুর উদ্দেশ্যে বলল,

“দেখ্, দেখ্, কা*ল*না*গি*ন কেমন ফোঁস ফোঁস করছে।”

অরু বালিশ হাতে নিয়ে এলোপাতাড়ি দুজনকে মা*র*লো। রামি আলতো হাতে অরুর গালে চ*ড় বসাতেই অরুর হাত থেমে গেল। রামির কানে বজ্রপাতের শব্দ হলো যেন! ঘুরে ঘুরে স্ক্রিনে অরু আর মিঠুর মুখটাই দেখাচ্ছে। যেন সে ম*হা*পা*প করে বসে আছে। মিঠু, রামির পেটে কয়েকটা ঘু*ষি বসিয়ে গালে চ*ড় বসালো।
“শা*লা, আমার বোনের গালে হাত তুললি কেন?”
অরু পাশ থেকে আরেকটা বালিশ নিয়ে মা*র*ছে রামিকে।

রামি অবলার মতো হা করে বসে রইলো। দুই ভাই-বোন তাকে তুলোধুনো করে যাচ্ছে। একটু আগে দল তার ভারী ছিল। এখন মিঠু দল পরিবর্তন করে ফেললো? অরু ক্লান্ত হয়ে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দেখলো পানি নেই। তাই বেরিয়ে এলো। মিঠু ধপ করে রামির পাশে শুয়ে পড়লো। প্রফুল্লচিত্তে বলল,
“চিল ম্যান। অরুর দলে নাম না লিখালে যে আমাকেও আর কতক্ষণ পি*টি*য়ে প্লেট বানিয়ে দিতো।”

রামি ঘৃণা ভরা চোখে তাকিয়ে বলল,
“ছিঃ! বন্ধু নামের ক*ল*ঙ্ক।”

মিঠু হাসতে হাসতে বলল,
“কোন জায়গায় ক*ল*ঙ্ক, পরে দেখিয়ে দিস। আগে আমার ফোন?”

“সেটাই দিতে এসেছি। কিন্তু এখন আর দেব না। ভাই-বোন দুইটাই চি*টা*র। ”

মিঠু বলল,
“তুই কী ভেবেছিস? ফোন না দিয়ে এখান থেকে বের হতে পারবি?”

দু’জনের মাঝে আবারও ফোন নিয়ে ধস্তাধস্তি লেগে গেল। ডাইনিং থেকে অরু ডেকে উঠলো।
“দুই ব*ল*দ খেতে আসো।”

★★★

সামনেই ইলেকশন। ইদানীং কাজের চাপে সুহার সাথে দেখা করার সময় পায় না মিঠু। আজ অরুকে নিয়ে বের হলো। শুক্রবার ছুটির দিন। সুহার বাসার সামনে এসেই গাড়ি থামলো। মিঠু ফোন কানে চেপে সুহার জানালার দিকে তাকালো। দু-বারের মাঝে সুহা ফোন ধরলো।
“কী সমস্যা?”

“নিচে আসুন। আপনার বাড়ির লোক এসেছে।”

সুহা চমকে উঠলো। তার বাড়ির লোক মানে? মামা এসেছেন? বুক ধড়ফড় করছে। আতঙ্কিত গলায় শুধালো,
“বাড়ির লোক মানে?”

“সেটা নিচে আসলেই দেখতে পাবেন।”
ওড়না মাথায় দিয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে নিচে নেমে এলো সুহা। ঢোক গিলে তাকাতেই দেখলো ইবতেসামের পাশে একটা মিষ্টি চেহারার মেয়ে দেখা যাচ্ছে। তার পরিবারের কেউ নেই। মেয়েটাকে এর আগেও ইবতেসামের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছিল সুহা। প্রশ্নাত্মক চোখে তাকাতেই মিঠু বলল,
“আমার বোন। আপনার কাছে থাকুক কিছুক্ষণ। আমি এসে নিয়ে যাবো।”

অরু একগাল হেসে শুধালো,
“কেমন আছো ফুল?”

সুহা স্তব্ধ হলো। মেয়েটির মতোই মিষ্টি মেয়েটির কথা। এইটুকুতেই তার মনে ধরে গেল মিষ্টি মেয়েটিকে। সুহা নিজেও হাসলো। বলল,
“ভালো। তুমি কেমন আছো মিষ্টি পরী?”

অরু গোমড়া মুখে বলল,
“তুমি আমায় পরী ডাকছো? কিন্তু পঁচা মিঠু আমায় অ*স*ভ্য, চিড়িয়াখানার বা*ন্দ*র ডাকে। অরু একটা নির্ভেজাল মিষ্টি মেয়ে। এটা সে বুঝতেই চায়না!”

সুহা মিঠুকে চিনলোনা। বলল,
“তোমার নাম অরু?”

“হুম। আর তোমার নাম ভাইয়া বলেছে আমায়, সুহা।”

সুহা মিষ্টি হেসে অরুকে নিয়ে বাসায় আসলো। গল্পগুজব করতে করতে কাটিয়ে দিল বেশখানিকটা সময়। অরুর জন্য কফি বানাতে গিয়ে সুহা জিজ্ঞেস করলো,
“চিনি কতটুকু দেব?”

“মিঠুর জন্য যতটুকু দাও, আমিও ততটুকুই খাই।”

সুহা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“বারবার মিঠু বলছো। আচ্ছা, এই মিঠু আবার কে গো?”

অরুর চোখ চড়কগাছ। বলল,
“মিঠুকে চেন না?”

সুহা নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে না বোধক মাথা নাড়ালো।
অরু শুধালো,
“ইবতেসামকে চেনো?”

“হ্যাঁ, তোমার ভাইয়া।”

“ভাইয়াকে বাসায় মিঠু নামেই ডাকে সবাই।”

“ওহ্। কিন্তু তোমার ভাই কতটুকু চিনি খায় আমি তো জানি না।”

অরু অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কোনদিন ভাইয়ার জন্য কফি বানাওনি?”

সুহা চোখ জোড়া ক্ষীণ করে বলল,
“না। আমাদের মাঝে সম্পর্ক অতটা মজবুত নয়।”

“কেমন মজবুত, সে আমি জেনে গিয়েছি। ভাইয়া বাসায় বসে তোমার কথা ভেবে মুচকি হাসে। আজ আমার কাছে ধরা পড়ে বাধ্য হয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে এসেছে।”

সুহা কথা বাড়ালো না। অরুকে নিজের মতো করে ভাবতে দিল। দুপুরের রান্নাটাও দুজনে মিলে করলো। অরু মেয়েটা ভীষণ মিশুক। কত সহজেই তাকে আপন করে নিয়েছে। অনেক বছর পর কাজিনদের সাথে কাটানো সময়ের স্বাদ পেল যেন। বিকেলে মিঠু এসে অরুকে নিয়ে গেল। মন খা*রা*প হয়ে গেল সুহার। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী যেন ভেবে আজ নিজ থেকেই মিঠুকে কল দিল। মিঠু যেন চমকে গেল। ভাবলো ভুলবশত কল এসেছে। সে প্রথমবারেই রিসিভ করলো না। দ্বিতীয়বার আর কোন কল এলোনা। এবার মিঠুর মনটা ছটফট করে উঠলো। কেন রিসিভ করলোনা? পরক্ষণে নিজেই কল ব্যাক করলো। সুহা চুপ করে আছে। মিঠু কোমল স্বরে ডাকলো।
“সুহা, কল দিয়েছেন?”

আড়ষ্টতা নিয়ে জবাব দিলো,
“হুম।”

“কিছু বলবেন?”

সুহা উসখুস করে বলল,
“না, তেমন কিছু না। অরুকে আবার নিয়ে আসবেন।”

মিঠু চোখ বুজে বলল,
“আপনি চলে আসুন না ওর কাছে! আমারও সুবিধা হয়।”

সুহা কথা কাটানোর জন্য বলল,“আমি ফোন রাখছি।”

“বাবাকে আপনার কথা বলে দিয়েছি, সুহা।”

সুহা আকস্মিক কথা শুনে মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো,
“কী?”

“হ্যাঁ, বলেছি বিয়ে করিয়ে দিতে।”

“আপনি বিয়ে করুন, যা ইচ্ছে করুন। কিন্তু আমার নাম কেন বলবেন?”

“বলিনি তো। তবে শীঘ্রই বলবো। হতে পারে আজ।”

“দোহাই লাগে আপনার। এমন কিছুই করবেন না।”

মিঠু বলল,
“ঠিক আছে, বলবোনা। আপনি বিনিময়ে কী দেবেন আমায়?”

“আপনি কী চান?”

“আপনাকে চাই।”

সুহা হাল ছেড়ে দিল। ফোঁস করে তার নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ পেয়ে হাসলো মিঠু। মন্থর স্বরে বলল,
“আপনাকে হারানোর বিনিময়ে আমি আপনাকেই চাই। বলুন, দেবেন কি-না? তবে আমি আপনার শর্ত মানতে রাজি আছি।”

#চলবে….

(রি-চেইক করা হয়নি।)