অনুপম ভালোবাসা পর্ব-১০

0
86

#অনুপম_ভালোবাসা(১০)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

নজরাত আন্দোলনে যোগ দিতে চেয়েছিল কিন্তু তরিকা বেগম কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি স্বামীকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন এখন সন্তান কে হারাতে চান না।
ইতিমধ্যে কতগুলো পরিবার তাদের সন্তানদের হারিয়ে আর্তনাদ করছেন দেখা যাচ্ছে তারপরও কোন ভরসায় মায়েরা তাদের সন্তানদের রাজপথে পাঠানোর ভরসা করবেন?
এমন চিত্র বেশিরভাগ পরিবারেই দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ তাদের ধিক্কার জানিয়ে বলছে, “আপনারা ঘরে বসে থাকেন আমরা প্রাণ দিয়ে সফল হলে তবে ঘর থেকে বের হ‌ইয়েন”।

দিন যত যাচ্ছে ততো মৃ ত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। হেলিকপ্টার থেকে মানুষকে গু লি করা হচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা বাসায় থেকেও প্রাণ হারাচ্ছে। এরফলে ছাত্ররা আরো সাহসী হয়ে উঠছে। প্রশাসন তাদের দমিয়ে রাখতে পারছে না, আর পারছেনা বলেই অনৈতিকভাবে ছাত্রদের উপর গু লি চালাচ্ছে। এর মাঝে আবার দ্বিতীয় পক্ষ, তৃতীয় পক্ষ ঢুকে ছাত্রদলের শান্ত আন্দোলনকে অশান্ত করে তোলে। নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়, মানুষ সেই পুরনো যুগে ফিরে যাই। রেডিও শোনে দিন পার করতে হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম চোখের সামনে আরেক যুদ্ধ দেখতে পায় যা তারা বই পত্রে এতদিন পড়ে এসেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব ঘোষিত গণমিছিল কর্মসূচিতে হাম লা চালিয়েছে আও/য়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন শিক্ষার্থী গুলি/বিদ্ধ হয়েছেন। বেশ কয়েকজনকে চা/পাতি দিয়ে কো পানো হয়েছে।এদের মধ্যে রাদ ছিল। দুপুর বেলা খবর পেয়ে দৌড়ে যায় নজরাত। এতো আহতদের ভীরে রাদকে খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে যায় নজরাত এর। বেচারাকে পিটিয়ে প্রায় আদ মারা করে ফেলেছে। স্বামীকে এমন অবস্থায় দেখে পাগল প্রায় নজরাত। পাশে শাশুড়ি মা অঝোর ধারায় কাঁদছেন। নজরাত কাছে যেতেই তাকে ধরে আরো কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। নজরাত নিজেই নিজেকে সামলাতে পারছে না এই মানুষটাকে কিভাবে সামলাবে তার জানা নেই। ডাক্তার বলেছেন ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। ঠিক কতদিন লাগবে তারা এখন বলতে পারছেন না।

এক সপ্তাহ পর রাদ কে তাদের বাসায় নিয়ে আসা হয়। হসপিটালে এত ভিড়ের মাঝে ছেলেটা ঠিক হবে না বলে মনে করেন লিপি বেগম তাই তিনি বাসায় নিয়ে আসেন। তরিকা বেগম জামাইকে দেখে যান। দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়ে গেছে তার। ঠিক এই কারণেই তিনি এসব আন্দোলন চান নাই। যেখানে মায়েরা তাদের সন্তানকে আকালে হারিয়ে ফেলবে এমন স্বাধীনতাকে নিয়ে চান না কখনোই। হয়তো এখানে মানুষ স্বার্থপর বলবে কিন্তু মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্য শুধু স্বার্থপর না সবকিছু করতে পারেন।

স্বামীর এই বিপদের দিনে ঘরে হাত ফুটিয়ে বসে থাকতে পারলো না নজরাত। লজ্জা শরম ভুলে স্বামীর ঘরে রওনা দিলো। তরিকা বেগম বাধা দিতে গিয়েও দিতে পারলেন না। এখানে বাধা দেওয়া তার অধিকারের মধ্যে পড়ে না।
কলিং বেলের শব্দ শুনে জুঁই এসে দরজা খুলে অবাক হয়ে বলে ছোট ভাবী! এসো ভিতরে এসো। আম্মা দেখো কে এসেছে। নজরাত ভিতরে ঢুকলে লিপি বেগম আসেন। তাকে দেখে নজরাত বলে,
__” উনার এমন অবস্থার সময় বাসায় বসে থাকতে পারলাম না আম্মা, তাই চলে এলাম। আমি কি ভুল করেছি?
লিপি বেগম ভীষণ খুশি হয়ে বললেন,
__” না মা একদম ঠিক করেছো।
তারপর জুঁই কে বলল,
__” তোর ভাবীর ট্রলি ব্যাগটা ঘরে নিয়ে যা।
জুঁই এর সাথে রাদ এর রুমে যাও, ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিবে।
নজরাত জ্বি আচ্ছা বলে জুই এর সাথে যায়।

রাদ এর রুমে ঢুকতেই তাকে দেখতে পেলো। হাত পায়ের ইঞ্জুরির জন্য বেচারা হাঁটাচলা করতে পারেনা তাই সারাদিন শুয়ে থাকতে হয়।
জুঁই ট্রলি ব্যাগটা রেখে চলে যায়। নজরাত নিঃশব্দে রাদ এর পাশে বসে। রাদ চোখ বন্ধ করে ছিল বলে নজরাত কে দেখতে পায়নি। কারণ বসার অনুভব করে চোখ মেরে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে যায় রাদ। একটু জোরেই বলে ওঠে,
__” তুমি এখানে? কখন এসেছো? এখন তো পরিস্থিতি একদম ভালো না তুমি বাসা থেকে একা বের হতে গেলে কেন?
__” আমি আসাতে আপনি খুশি হননি? তাহলে কি চলে যাব?
রাদ নির্বিকার মুখে বলল,
__” সেটা বলি নাই। এখন মেয়েরা রাস্তা ঘাটে একদম নিরাপদ না। এমনিতেই হাঁটাচলা করতে পারছি না তারপর নেটওয়ার্ক বন্ধ করে রেখেছে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছি না। জানো এই মুহূর্তে এক টুকরো সুখ হয়ে এসেছ তুমি।

এদিকে নজরাত এর চোখ পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেছে। দেখে রাদ বিচলিত হয়ে বলল,
__” এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন আমি তো তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই ওসব বলেছি।
__” সেজন্য কাঁদছি না। আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে ভেবে কাঁদছি। আপনি কেন গেলেন বলেন তো? আপনার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে একবার ভেবে দেখেছেন? আমার কথা একটুও ভাবেন না আপনি।
__” আমি তো মরে যাইনি বলো? তাহলে কষ্ট পাচ্ছো কেন এসব ভেবে। কতো ছাত্ররা নিজের কথা না ভেবে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, প্রাণ হারাচ্ছে। সেসব দেখতে গেলে তো আমি কিছুই করতে পারলাম না দেশের জন্য।
__” আমিও তো যেতে পারলাম না। ফেসবুকে আন্দোলন নিয়ে পোস্ট করাতে কিছু লোক হুম/কি দিয়েছে সেসব শুনে আম্মা কিছুতেই যেতে দিল না।
__” মেয়ে মানুষ তোমার যেয়ে কাজ নেই। কখন এসেছো? কিছু খেয়েছো?
__” বেশিক্ষণ হয়নি এসেছি।
__” ওহ তাহলে যাও ফ্রেশ হয়ে নাও ঐ যে বাথরুম।
নজরাত আচ্ছা বলে ফ্রেশ হতে যায়।

নজরাত ফ্রেশ হয়ে আসলে শাশুড়ি মা তার জন্য চিকেন ফ্রাই করে দেয়। মেয়েটা প্রথমবার তাদের বাসায় এসেছে তাই মন খারাপ থাকলেও এটুকু করতেই হলো।
নজরাত নিজে খাওয়ার সাথে সাথে রাদের মুখে একটু করে দিতে থাকে। রাদ খাবে না বললেও শুনে না।
খাওয়া শেষে দুজনে মিলে আন্দোলন নিয়ে কথা বলছে এমন সময় বাহির থেকে আর্তনাদ শুনতে পেয়ে নজরাত বলল,
__” আমি দেখে আসছি আপনি থাকুন।

ফারুক সাহেব কারো সাথে ফোনে কথা বলে দপ করে ফ্লোরে বসে পরেন। লিপি বেগম দৌড়ে এসে বললেন,
__” রাসেলের বাপ কি হয়েছে তোমার? এভাবে ফ্লোরে বসে পড়লে কেন? কার সাথে কথা বললে?

ইতিমধ্যে জুঁই আর নজরাত ও এসেছে। জুঁই বাবার পাশে বসে বলল,
__” আব্বা কি হয়েছে তোমার?
ফারুক সাহেব খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করলেন,
__” আমার রাসেল আর নাই!
লিপি বেগমের ভিতরটা ছ্যাদ করে জ্বলে উঠলো। উত্তেজিত হয়ে বললেন,
__” কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?

ফারুক সাহেব খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,
__” তোমার তো কষ্ট হ‌ওয়ার কথা না। একটা অন্যায় করেছে বলে ছেলেটাকে বাড়ি ছাড়া করলে। তোমার নাকি লজ্জা হত এই ছেলেকে নিয়ে অথছ তোমার ছেলে তোমাকে “শহীদের মা” বলে সম্মান দিয়ে গেল।

লিপি বেগম কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন,
__” ছেলের উপর রাগ অভিমান ছিল তাই বলে তো তার মৃ ত্যু কামনা করি নাই। মা হয়ে ছেলের মৃ ত্যু কামনা কিভাবে করবো আমি? আমার অন্তর টা ফেটে যাচ্ছে।
নজরাত লিপি বেগম কে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। জুঁই তার বাবাকে ধরে কাঁদছে। বাড়িটাতে পুরো শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

রাদ নিজের রুমে থেকে সবটাই শুনলো। শূন্য চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের কোণ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে তার।
.
.
নজরাত রাদ এর সাথে রয়ে গেল আর বাকিরা হসপিটাল থেকে লা শ এনে দাফনের জন্য গিয়েছে।

নজরাত কে কাছে পেয়ে বাচ্চাদের মত কান্না করে দেয় রাদ। মায়ের আড়ালে বড় ভাইয়ের সাথে ঠিকই যোগাযোগ রাখতো সে। ভাই তাকে যে ভীষণ ভালোবতো। এই তো কয়েক মাস আগে একদিন ভোর বেলা ভাই তাকে কল করে কান্না করে দেয়।রাদ তখন বিচলিত হলে রাসেল জানায় সে বাবা হতে চলেছে। সেই খুশিতে কান্না করছে। রাদ সেদিন প্রথমবারের মতো বাবা হওয়ার আনন্দ কিছুটা অনুভব করতে পারে ভাইয়ের কান্ড শুনে…..

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।