#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:২৫+২৬
“সত্যিটা না জেনে একটা ছেলের সাথে মিশিয়ে কী বলেছিলে, মনে আছে? এক্সিডেন্টলি সেই ছেলেটি আমার হাসব্যান্ড। তোমরা জানো, তবুও আমি কেঁদে ছিলাম। একজন ছেলে যদি ঐকথাগুলো বলত বিশ্বাস কর, আমি তেমন কিছু মনে করতাম না। কিন্তু যখন তোমরা মেয়ে হয়ে বলেছ, আমার মরে যেত ইচ্ছে করছিল।” ওদেরকে বলতে না দিয়ে নিজেই বললাম।
মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো একটু বেশিই বলে ফেললাম। ঠোঁট হেলিয়ে হাসলাম মৃদু। তাদের কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, তবে এইধরনের ভুল আর করো না।”
“তুমি কী ভালো গো। এতো সহজে সবকিছু ভুলে গেলে।”
অহি এগিয়ে এসে সরল ভাষায় বলে, ” ও তো এমনই, তাইতো আমার বেস্টফ্রেন্ড।”
একে একে সবার সাথে বন্ধুত্ব হলো। ওরা দুজন মেয়ে দুজন ছেলে। আগে সিনিয়র সিনিয়র ভাব নিত। ভার্সিটিতে ঘুরা হলো। আড্ডা দেওয়া হলো। ল্যাকের পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। হাওয়া বইছে। রাস্তার দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখলাম রৌধিকের মতো। একটা মেয়ের সাথে হেঁটে যাচ্ছে। চিন্তিত তার মুখ। কেমন শুকিয়ে গেছে। পড়নে ঢিলেঢালা শার্ট। উসকোখুসকো চুল। ব্যাগ নিয়ে ছুটলাম। রৌধিকের সামনে গিয়ে পথ আঁটকে দাঁড়ালাম। রৌধিক খেয়াল করল না। না তাকিয়েই সরে গেলেন। আমি আবার পথ আটকালাম। ভ্রু কুঁচকে বললেন, “সমস্যা কী?”
পরক্ষণেই বললেন, “তুমি?”
“হম। আমি। কোথায় যাচ্ছেন?”
“কাজ আছে, সরো।”
“না, সরব না। আগে বলুন কোথায় যাচ্ছেন?”
রৌধিক পাশের মেয়েটিকে হাঁটতে বললেন। মেয়েটি মুচকি হাসল। চোখ আড়াল হতেও বললেন, “বিরক্ত করছ কেন? আর চোখ মুখের এই হাল হয়েছে কী করে? খাওয়া-দাওয়া করো না না-কি! যাও বাড়িতে যাও। আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। বাড়ির কারো সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”
বলেই স্থির পা জোড়া গতিশীল করলেন। আমি আহামকের ন্যায় চেয়ে করল। আমাকে পাত্তা না দিয়েই চলে গেলেন। শূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম।
হাঁটছি। মাঝরাস্তায় এসে চোখ পড়ল ঝুলন্ত পত্রিকার উপরে। আগুনে পুড়ে যাওয়ার ছবি। বড় বড় অক্ষরে লেখা, “আহম্মেদ ইন্ডাস্ট্রিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। হাত পা জমে যাচ্ছে আমার। আমি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা হাতে নিলাম। আমাদের অফিসের ছবি। কি সব লিখেছে তারা। উপরে দৃষ্টি যেতেই দেখতে পেলাম কিছুদিন আগের তারিখ। যেদিন রৌধিক আমাকে মাঝরাস্তায় ফেলে এসেছিল। এতবড় একটা দুর্ঘটনা আমাকে কেন জানায়নি। বাড়ির সবার কী অবস্থা। ঘটনাটা কি আদৌ সত্য।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রৌধিকের নাম্বারে ফোন করলাম। ব্যালেন্স নেই। ব্যাগের ভেতরে রেখে এদিক ওদিকে ফ্লাক্সলোডের দোকান খুঁজলাম। ব্যালেন্স লোড করলাম। রৌধিকের নাম্বারে ফোন করলাম। তিনি রিসিভ করলেন। হ্যালো বলতেই ফোন রেখে দিলেন। তাকে আর পাওয়া গেল না। বাড়িতে ফোন করলাম সেখানেও কাউকে পাওয়া গেল না। কী করব কিছুই বুঝতে পারলাম না। রিক্সা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাড়িতে বড় একটা তালা ঝুলছে। দাড়োয়ান চাচাকে দেখতে পাচ্ছি না। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা, এখানে প্রবেশ নিষেধ।
একই রিক্সায় করে অফিসের সামনে গেলাম। পুলিশ পাহারায় রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এখনো কাজ করছে।
আদ্রিতা, বাবা মা কোথায় গেছে? হঠাৎ করেই আহির সারার কথা মনে পড়ল। আমরা তো একই অফিসে চাকরি করতাম। সারাকে ফোন দিতেই রিসিভ করল। যেন আমার ফোনের জন্যই সে অপেক্ষা করছিল।
“হ্যালো। সারা বলছিস। অফিসে কী হয়েছে বল তো?”
অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলে, “কী হয়েছে মানে তুই কিছু জানিস না?”
“আশ্চর্য তো! আমি জানি না বলেই তো তোর কাছে জানতে চাইছি। বলার হলে বল, নাহলে ফোন রাখ।”
“সেদিন মাঝরাতে খবর পেলাম আগুন লেগেছে। হন্তদন্ত হয়ে অফিসে যাই। শর্ট সার্কিটের ত্রুটির কারণে। এটা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছে। তবে আমাদের ধারণা, সবকিছু আরু করেছে। সেদিন তাকে অফিসের আশেপাশে ঘুরতে দেখা গেছে। শুনেছি, ব্যাংক থেকে অনেক টাকা লোন নেওয়া আছে। বাড়িটা বন্ধক রাখা ছিল। বাড়িটা ব্যাংকের দখলে। একমাস সময় দেওয়া হয়েছে। টাকা পরিশোধ করতে পারলে, বাড়িটা ফেরত পাবে।”
আমি স্তব্ধ। সারা ওপাশ থেকে বলেই চলেছে। কিন্তু কোনো কিছুই আমার কানে আসছে না। সবকিছু অস্পষ্ট। বসে পড়লাম রাস্তার মাঝখানে। সবকিছু আমার জন্য হয়েছে। আরু আমার উপর ক্ষোভের বশে আগুন লাগিয়েছে। আমার জন্য তাদের মস্তবড় একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। চোখজোড়া ছলছলিয়ে উঠল। নিজের অজান্তেই বড় একটা ক্ষতি করে ফেললাম। কিভাবে বাড়ি ফিরে যাবো।
তৎক্ষণাৎ কাঁধে হাত রাখল কেউ। চোখজোড়া মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ইভুকে নজরে এলো। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“কী অবস্থা করেছ চোখ মুখের? আয়নায় দেখেছ নিজেকে। চলো। কেঁদো না, বাড়িতে চলো।”
“আদ্রিতা, বাবা মা ওরা কোথায়?”
“আমাদের বাড়ি আছে। চলো। তুমিও সেখানে থাকবে।”
ইভু আমাকে ধরে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল। বোতল এগিয়ে দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে বলল। আমিও মুখে পানি ছিটিয়ে নিলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ি এসে থামল আমহৃদ বাড়ির সামনে। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। মনে হলো এই বাড়িতে আমি আরও এসেছি। কিন্তু কখনো চোখের দেখাও দেখি নি।
সোফায় বসে আদ্রিক আহম্মেদ এবং তার পাশে বসে আছে ইমতিয়াজ আমহৃদ। প্রাণের বন্ধু। রৌধিকের বউ করার জন্য তিনিই আদ্রিক আহম্মেদকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে বিয়েতে দেখা যায়নি। কিছুটা দূরে বসে আছে মৌমিতা এবং আদ্রিতা। মৌমিতাকে শান্তনা দিচ্ছে মিসেস মিতালী। তাদের মাঝেও বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক। কিছুটা দূরে বসে ফোন টিপছে ইয়ানাত।
মাথা নত করে বাড়িতে ঢুকলাম আমি। আমাকে দেখেও ক্ষিপ্ত হলেন মৌমিতা। হিংস্র বাঘের ন্যায় ছুটে এলেন। পরিস্থিতি বোধগম্য হওয়ার আগেই হামলে পড়লেন। একের পর এক চড় বসালেন গালে। গলা চেপে ধরলেন। খুক খুক করে কেশে উঠলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছে। যথারীতি চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। মৌমিতার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার হিংস্র শক্তির কাছে আমি তুচ্ছ।
“মা, কী করছ তুমি? ছাড়ো।”
আদ্রিতা কথায় ধ্যান ভাঙল সবার। আমার থেকে মৌমিতাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। অনেক চেষ্টার পর আদ্রিক আহম্মেদ মৌমিতাকে সরিয়ে নিলেন। রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
“পাগল হয়েছ তুমি মৌমি। এভাবে কেউ কাউকে ধরে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে।”
“আমি তো হওয়ার জন্যই ধরেছি। এই মেয়েটার জন্যই আমার সুখের সংসারে অসুখের ছাড়া নেমেছে। বিয়ে হয়েছে, মাস পেরুনোর আগেই আমাদের পথে নামতে হয়েছে।”
অশ্রু গড়াল চোখ বেয়ে। নিশ্চুপ আমি। রৌধিক বাড়ির পরিস্থিতি জানে বলেই আমাকে আনতে চায়নি। বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করতে বারণ করেছে। আগুন লাগার খবর পেতেই তিনি ছুটে গেছেন। হয়তো আমার কথা তখন মাথাই ছিল না। আর আমিই অন্যসব ভেবে বসে ছিলাম।
ফোড়ন কেটে বলে ইয়ানাত,
“সেদিনই বলেছিলাম, এই মেয়েটা এমনই। কিন্তু আমার কথা না শুনে উল্টো আমাকেই যা নয় তাই বলে রৌধিক বের করে দিতে বলেছে। তোমরাও ওর কথায় সায় দিয়েছিলে।”
ইভু ইনায়াতের কাঁধে হাত রেখে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। অতঃপর ইনায়াত রাগ দেখিয়ে উপরে চলে গেল। মৌমিতা থামল না। বলেই চলেছে, ” এই মেয়েটাকে টাকার বিনিময়ে আমার রৌদুর বউ করেছিলে না। টাকা তো পেয়েছে। এবার বিধেয় হও। আর কোনো দিন যাতে আমার চোখের সামনে তোমাকে দেখতে না পাই। তাহলে..
মিতালী মৌমিতাকে থামিয়ে দিলেন। আমাকে ধরে বললেন, “এই মেয়ে কী করেছে শুনি।”
“ওর জন্যই রৌদু আরুকে অফিস থেকে বের করেছিল।”
“আরুকে বের করতে কী জোনাকি বলেছিল? রৌধিক ছোট বাচ্চা নয় যে, জোনাকি তাকে যা বলবে তাই করবে। জোনাকি তুমি আমার সাথে এসো।”
মিতালী আমাকে নিয়ে উপরে চলে এলো। ফাস্ট এইড বক্স বের করলেন। তুলোর সাহায্যের রক্তগুলো মুছিয়ে দিলেন। স্যাভলন লাগাতেই ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। স্বযত্নে ড্রেসিং করে দিলেন। নিজের কাবার্ড থেকে পছন্দ করে জামা কাপড় বের করে হাতে দিয়ে বসলেন শাওয়ার সেরে নিতে। নেমে গেলেন তিনি। তাকে ডাক দিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, কথা বলতে গেলে গলায় ব্যাথা পাচ্ছি।
শাওয়ার সেরে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম, হট ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বসিয়ে ধীরে ধীরে গলায় ছ্যাঁকা দিতে লাগলেন। আমি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। মনে হলো, কোনো মা তার সন্তানকে ভালোবেসে সেবা করছে।
মাঝরাত। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে বুকের উপর ভারী কি অনুভব করলাম। ঘুম নামক জড়তা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। গলা ব্যাথায় শরীর যেন বড্ড ক্লান্ত। উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে মুখমণ্ডলের উপর। নিভু নিভু চোখের পাতা মেলে চাইলাম। অপ্রত্যাশিত মানুষের ন্যায় দেখে চমকে উঠলাম আমি। চিৎকার করার প্রয়াস করতেই ওষ্ঠদ্বয় গ্ৰথণ হলো পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতের আড়ালে। নেত্র জোড়া বড় বড় করে চাইলাম। খুব চেনা। অতিশয় প্রিয় এই সুবাস। হৃৎপিণ্ডে ছড়িয়ে গেল মাতাল করা স্পর্শ। আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের উপর তর্জনী ঠেকিয়ে হুস করলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে না-বোধক বোঝালেন। বোধগম্য হলো মানুষটি রৌধিক।
আমি দ্রুত বেডের উপর ভর দিয়ে উঠে বসলাম। পাশেই মিতা আন্টি ঘুমিয়ে আছে। রৌধিকের কানের কাছে মুখ এনে বিরবির করে বলি,
” আপনি, আপনি এখন এখানে কী করছেন?”
তিনি আমার কানের কাছে তার মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন, “আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি। কেন, কী হয়েছে?”
কম্পন ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। বেডশিট আঁকড়ে ধরলাম দ্রুত। দাঁতে দাঁত চেপে ধরলাম। সেকেন্ড খানিক ঝিম ধরে বসে রইলাম। ধাক্কা দিলেন তিনি। ধ্যান ভাঙল আমার। ফট করেই শুয়ে পড়লেন গা ছড়িয়ে। রৌধিককে টেনে তোলার প্রয়াস করতে করতে বললাম, “প্লীজ, উঠুন। আন্টি জেগে যাবে।”
“জেগে গেলে তো ভালোই হবে। ফাঁকা একটু স্পেশ পাওয়া যাবে। কতদিন মন খুলে একটু তোমাকে দেখা হয় না।”
“তাহলে আর কী করার, আমি যাই। তোরা মন, প্রাণ খুলে কথা বল।”
তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটল। রৌধিককে আর বলতে না দিয়ে মিতা আন্টি বললেন। আমি লজ্জানত হলাম। তিনি ফিরলেন না। মাথায় ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে চলে গেল। রৌধিক দাঁড়িয়ে চুমু ছুঁড়ে দিলেন।
সরে বসলাম আমি। রৌধিক আরেকটু এগিয়ে বসলেন। তার ডান হাতটা ললাটে ঠেকালেন। এপিঠ ওপিঠ করে বললেন, ” জ্বর নেই। গলা ব্যাথা করছে কী?”
“আপনি জানেন?”
“হম। আদ্রিতা বলেছে। কী দরকার ছিল, এখানের আসার। তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম দূরে থাকতে। ঝামেলা মিটে গেল নিয়ে আসতাম।”
বলেই কাঁধে মুখ গুঁজে দিলেন। নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন। চোখজোড়া গ্ৰথণ করে আরেকটু দৃঢ়ভাবে মুখ গুজলেন। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে,
“জানো, এতদিন শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। কীভাবে বাড়িটা ফিরে পাবো, বুঝতে পারছি না। এখনো কতোগুলো টাকা।”
চোখ ভিজে উঠল আমার। আমার জন্য সবাইকে বিপদে পড়তে হচ্ছে, কীভাবে বাড়ি ফিরে পাবে। আদৌও কি সম্ভব। রৌধিক ভ্রু কুঁচকালো। চোখের অশ্রুটুকু মুছিয়ে দিলেন স্বযত্নে। আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। বিনিময়ে কান্নার গতি তুলনামূলক বেড়ে গেল। রৌধিক আমাকে শান্তনা দিচ্ছেন। আমার থামার নামই নেই। না পেরে অবশেষে ধমক দিলেন। সাথে সাথে কান্না থেমে গেল। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমাকে নিয়ে বেডের উপর শুয়ে পড়লেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমিও বাচ্চাদের ন্যায় নিদ্রাচ্ছন্ন হলাম।
_________________
সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। বেলকেনিতে বসেছি আমি। অন্তরিক্ষে কালো মেঘের ভেলা। আমার সাথে মিলিয়ে তারাও মুখ ভার করে আছে। সামনেই একজোড়া চড়ুইপাখি। গাছের মগডালে বাসা বেঁধেছে। ডিমও পেরেছে। পাখিজোড়ার কতো আনন্দ অথচ আমার আনন্দ নেই। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। এই যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছি না। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন আমি। কারও সঙ্গে কোনো কথা হয় না। আমার সাথে কথা বলতে বারণ করেছে মৌমিতা। খাবারও ঘরে দিয়ে যায়। একা একা থাকতে আর ভালো লাগছে না। পায়ের দিকে তাকালাম। এখন হাঁটতেও কষ্ট হয়। রৌধিকের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে দেহটা। আজও সহ্য করতে হয়েছে তীব্র যন্ত্রণা। ইয়ানাত নামক মেয়েটা একদম আমাকে সহ্য করতে পারে না। যদি সম্ভব হতো আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিত। এইতো দুপুরের কথা। সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছি আমি। দরজা খুলে পার্পসে পা রাখতেই সূচালো কিছু পায়ে আঘাত করল। একটা দুটো নয়, সংখ্য অধিক। ডান পা রক্তে ভেসে গেছিল। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। ভারসাম্যহীন হয়ে বসে পড়েছিলাম মেঝেতে। অঢেল রক্ত ঝড়েছে পা থেকে। বেশ কয়েকটা পিন পায়ের সাথে গেঁথে ছিল। আমি একপায়ে ভর করে বেডের উপর গিয়ে বসলাম। পায়ে হাত স্পর্শ করতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছি। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করল কেউ। দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাতেই দেখলাম ইয়ানাতকে। পার্পোস থেকে পিন খুলে তুলে নিচ্ছে। তোলা শেষ করে আমার নিকট এসে হাঁটু মুড়ে বসল। আমাকে তোয়াক্কা না করে পা থেকে পিন খুলতে লাগল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। মুখ চেপে ধরলেন। টেনে টেনে বলল,
“একদম চুপ। একটাও কথা যাতে মুখ থেকে বের না-হয়।”
পলকহীন নেত্রযুগল দ্বারা দেখল তার কাণ্ড। বাকরুদ্ধ আমি। প্রবল যাতনায় পা অবশ হয়ে গেছে। ইয়ানাত তার কাজ শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করল। লহমায় ফিরে চাইলো। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
“এই ঘটনা যদি কেউ জানতে পারে, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। আমি কী করতে পারি, আশাকরি তোমার জানা হয়ে গেছে।
রৌধিকের বউ হয়েছ না। এবার ভোগ কর।”
“কী করেছি আমি। কেন করছেন এমন। [অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠস্বর আমার]
“কারণ আমার বোন ছাড়া কাউকে আমি রৌধিকের পাশে দেখতে পারব না। তারজন্যই আমি শেফাকে টাকা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে সরিয়ে ফেলেছি।”
“আমি তো আপনার বোনের মতোই।” আকুলতা মেশানো কণ্ঠ।
“বোন তো নয়।”
বলেই স্থির পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে গেলেন। আমি পায়ের হাত রেখে বসে ছিলাম।
কেন এমনটা করে ইয়ানাত। কে এই মেয়েটা। যদি তার বোন থেকেই থাকে তাহলে দেখতে কেন পাচ্ছি না। কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার গভীর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে প্রবেশ করল মিতা। আঁচল গুঁজে এসে বসলেন পাশে। মৃদু হেসে বললেন,
“কী হয়েছে জোনাকি, এত চুপচাপ কেন?”
“এমনিই আন্টি। ভালো লাগছে না। যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম।”
“হ্যাঁ। বলো, কী জানতে চাও।”
অস্বস্তি দানা বাঁধল চতুর্দিক। নিশ্চয়ই মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি কষ্ট পাবেন। অধর চেপে থেমে থেমে বললাম, “আপনার কোনো মেয়ে আছে?”
“মেয়ে না থাকলে ইয়ানাত কে? পাগল একটা।”
“ইয়ানাত নয়। অন্য কোনো মেয়ে। ইয়ানাতের ছোট। যার জন্য ইয়ানাত আমাকে সহ্য করতে পারে না।”
লহমায় চিকচিক করে উঠল নেত্রযুগল। পলকহীন, স্থির দৃষ্টি। ওষ্ঠদ্বয়ে ঝুলে থাকা মায়া মায়া হাসিটা গায়েব হলো। গম্ভীর হলেন তিনি। জবাব দিলেন না। কাজ আছে বলে উঠতে নিলেন। আমি হাত টেনে ধরলাম। বাঁধা দিলাম গমনপথে। ব্যাকুল কণ্ঠের বললাম, “প্লীজ।”
পূর্বের ন্যায় বসলেন তিনি। বাধ্যবাধকতা মিশ্রিত হাসি। আবেগপ্রবণ হলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, “ছিল এক কালে। এখন নেই। হারিয়ে গেলে। ইভু ইয়ানাতের প্রিয় ছিল। দুই ভাই বোন কাড়াকাড়ি করত, তাকে নিয়ে। মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দিত না। কতবার পড়ে ব্যাথা পেয়েছে, হিসেব নেই। পুচকির জন্য ওদের দুই ভাই বোনকে কত মে’রে’ছি, হিসেব নেই। রৌধিকের বউ করবে ঠিক করে রেখেছিল। রৌধিকও বিয়ে করতে রাজি। হুট করেই হারিয়ে গেল মেয়েটা। খুব আদরের ছিল, তাই ওর হারিয়ে যাওয়াটা ইভু ইয়ানাত সহ্য করতে পারেনি। মনে করে, ওর বোন ফিরে আসবে। তাই তোমার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করে।”
“ওহ্। কিভাবে হারিয়ে গেছে।”
তৎক্ষণাৎ ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো। মুষুলধারে বৃষ্টি। লহমায় বৃষ্টির ধারা ব্যালকেনিতে এলো। আর্দ্রতা ছড়িয়ে গেল জায়গায়টা। আন্টি প্রত্যুত্তর দেওয়া কুল পেলেন না। আমাকে রেখে ছাদের দিকে ছুটলেন। অনুমানসাপেক্ষ, বৃষ্টির নিমিত্তে পিচ্ছিল হয়েছে জায়গাটা। আন্টিকে যেতে না করে আমি ছুটলাম সেদিকে। পায়ে ব্যাথায় মাটিতে পা স্পর্শ করাই দায়। তবুও দেয়াল ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ছাদে পৌঁছালাম। ততক্ষণে আংশিক আর্দ্র জামা কাপড়। আমি দ্রুত জামা কাপড়গুলো তুললাম। ধীরে ধীরে হাঁটার সমীপে বেশ খানিকটা ভিজে গেছি। তৎক্ষণাৎ অন্তঃকরণে হানা দিল, বৃষ্টির ফোঁটা আমার দেহের উপর পতিত হচ্ছে না। আমি ফট করে উর্ধ্বে চাইলাম। আমার মাথার দেড়হাত উর্ধ্বে মস্ত কালো রঙের ছাতা। পাশ দিয়ে পেছনে না ফিরেই উপর থেকে পেছনে ঘুরার প্রয়াস করলাম। পা পিছনে পড়ে যেতে নিলেই বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতে কোমর জড়িয়ে নিল। ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরিয়ে নিল। রৌধিককে দেখে এক চিলতে হাসলাম আমি। লোকটা অদ্ভুত ধরনের। পরক্ষণে ভীত হলাম। তার সামনে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটব কিভাবে? নিশ্চয় দেখে ফেলল। সেই মুহুর্তেই ধমকে উঠবেন, কীভাবে পায়ে ব্যাথা পেলাম?
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]