অনুভবের প্রহর পর্ব-১৩

0
536

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৩

প্রহর সম্মোহনের মতো ধীরপায়ে অনুভবের দিকে এগোতে লাগলো। এগিয়ে এসে খুব কাছাকাছি দাঁড়ালো। নিত্যদিনকার মতো অনুভব সরে গেল না বা ধমক দিল না। সে যেন নিজের মাঝে নেই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। টিনের চালে সৃষ্ট বৃষ্টির ঝমঝমানি শব্দ, শীতল বাতাস, আর একে অপরের বুকের ধুকপুক শব্দে বিভোর হয়ে গেল দুজন। প্রহর এক সমুদ্র মায়া নিয়ে অনুভবের চোখে চোখ রাখলো। এটা সেই সর্বনাশা প্রেমিকার দৃষ্টি, যুগে যুগে যে দৃষ্টিতে পুড়েছে হাজারো প্রেমিক। যে দৃষ্টির উত্তাপে পাথরসম হৃদয় ঝলসাতে বাধ্য! অনুভবের কঠিন হৃদয়ও পুড়ে গেল। অনুভূতির দগ্ধ উনুনে হারিয়ে ফেলল নিজেকে। হিতাহিত জ্ঞান রইলো না।

প্রহর ডান হাত উঁচু করে অনুভবের গাল স্পর্শ করলো। গাল ছুঁয়ে হাতটা ধীরে ধীরে গলার কাছে আনলো। উন্মুক্ত গলায় শীতল স্পর্শ পেতে অনুভব চোখ বন্ধ করলো। প্রতিটি লোমকূপ কেঁপে উঠলো তার। ঠান্ডা এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো শিরা থেকে উপশিরায়। প্রহর যেন সম্মতি পেয়ে গেল। অনুভবের বন্ধ চোখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলো। একটুপর পায়ের উপর ভর দিয়ে অনুভবের সমান সমান হওয়ার চেষ্টা করলো। দু হাতে অনুভবের মুখ চেপে ধরে ডান গালে ঠোঁট ছোঁয়াল। অনুভব পূর্বের মতোই নির্বিকার।

প্রহর থামলো না। অনুভবের থুতনিতে, বাম গালে ঠোঁটের স্পর্শ দিল। কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে অনুভবের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করলো। অনুভব পাথরের মূর্তির মতো বন্ধ চোখে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার বাম হাতটা ইতোমধ্যে প্রহরের পিঠ স্পর্শ করেছে। প্রহরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ দেখা দিল। দৃষ্টি আটকে গেল তিরতির করে কাঁপতে থাকা অনুভবের ভেজা ওষ্ঠদ্বয়ে। সে আর অপেক্ষা করলো না। পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে অনুভবের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি যেন মৃদু নড়ে উঠলো। ধপ করে চোখ খুলল অনুভব। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় মস্তিষ্ক খোলাসা হলো৷ চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো একটা মৃতদেহ। তড়িৎ গতিতে এক ধাক্কা দিয়ে প্রহরকে সরিয়ে দিল। ধাক্কার বেগ এতটা বেশি ছিল যে প্রহর হুড়মুড় করে টেবিলের উপর গিয়ে পড়লো। ব্যথায় চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো সে। টেবিলের কর্ণার পেটে গেঁথে গেছে যেন! পেট চেপে ধরে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো। একটুপর চেঁচিয়ে বলল,

‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি? এভাবে কেউ কাউকে ধাক্কা দেয়?’

অনুভবকে নিরুত্তর দেখে অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ডু ইউ নিড টু বি সো হার্টলেস?’

‘তোমাকে কাছে আসতে বারণ করেছি না? আজ যা করেছ এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। একেবারে মেরে ফেলবো।’

‘আমি একা করেছি? আপনি কিছু করেননি? আপনাকে স্ট্যাচুর মতো উপভোগ করতে বলেছিল কে?’

‘শাট আপ!’

অনুভবের ধমকে প্রহর হালকা কেঁপে উঠলো। যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মুখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো সে। অনুভব তার দিকে ফিরেও তাকালো না। দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরলো। মাথা ঝিম ঝিম করছে তার। চোখের সামনে সবকিছুর দুটো প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে যেন। কানের ভেতর শনশন শব্দ হচ্ছে। সে এলোমেলো ভাবে পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

অনুভব চলে যেতে প্রহর পেট চেপে ধরে অস্ফুট শব্দ করলো। কুঁজো হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। ভেজা জামা সরিয়ে দেখলো পেটের বাম পাশে চামড়া ছিঁড়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিন্দু বিন্দু রক্ত ভেসে উঠেছে। অনুভবকে মনে মনে জঘন্য এক গালি দিল সে। বজ্জাত ছেলে! একটুর জন্য মাথা ফেটে যায়নি তার। এত জোরে কেউ ধাক্কা দেয়? মাথাটা যদি দেয়ালে গিয়ে লাগতো? ভেজা ওড়না দিয়ে সে কাটাছেঁড়ার জায়গা চেপে ধরতে তীব্র জ্বলুনি অনুভব করলো। দ্রুত ওড়না সরিয়ে নিল। ড্রেস পাল্টাতে হবে। মনে মনে নিজেকেও গালি দিল। তাকে এত উতলা হতে কে বলেছিল? জনমের মতো শিক্ষা হলো। আপাতত চুমু খাওয়ার শখ মিটে গেছে তার।

লাগেজ থেকে শুকনো কাপড় বের করলো সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ওয়াশরুমের কাছে গেল। ডান পায়ের গোড়ালিতে অনেকটা ব্যথা পেয়েছে। টেবিলের পায়ার সাথে লেগেছিল। এই ছেলের যে কি হাল করতে ইচ্ছে করছে তার! এর মাথার চুল একটা একটা করে ছিঁড়তে পারলে একটু শান্তি পেতো। চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল সে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ বেড়ে যাচ্ছে ক্রমেই। শীতে হাত-পা কুঁকড়ে আসছে প্রহরের। সে দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে অনুভব রেসপন্স করলো না। আবার রাগটা তরতর করে বেড়ে গেল। বাজখাঁই গলায় বলল,

‘দরজা খুলবি নাকি লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলবো?’

ওয়াশরুমের ভেতর অনুভব চমকে গেল। প্রহরের কন্ঠের তীব্রতা চৈত্রের কড়া রোদকেও হার মানাচ্ছে। সে দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো। বুকের ভেতর এখনো ধুকপুক করছে। এক্ষুণি কি করতে যাচ্ছিল সে? এতবড় ভুল সে কি করে করতে যাচ্ছিল? দু গালে হাত ঘষে সে প্রহরের ঠোঁটের স্পর্শ মোছার চেষ্টা করলো। ঠোঁটজোড়া ঘষতে ঘষতে লাল বানিয়ে ফেলল। কয়েক সেকেন্ড পর দরজায় কড়াঘাত বেড়ে গেল। প্রহর ফের চেঁচিয়ে বলল,

‘দরজা খোল বজ্জাত ছেলে। দেখি তোর কত সাহস! ধাক্কা দিয়ে ওয়াশরুমে দরজা আটকে বসে আসিস কেন? সাহস থাকলে আমার সামনে আয়। তোর নামে আমি কেস করবো। মার্ডার কেসের আসামি করে জেলে পুড়বো তোকে। দরজা খোল বলছি!’

অনুভব চেঁচামেচির মধ্যে গেল না। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘আমি গোসল করছি। দরজা খুলতে পারবো না।’

‘আমি ভেজা কাপড়ে কতক্ষণ থাকবো? ও বুঝেছি! তুই তো আমাকে নিউমোনিয়া ধরিয়ে মেরে ফেলতে চাস। আমি মরে গেলে ওই জিরো ফিগারের সিমরানকে বিয়ে করতে পারবি। তোর মতলব বুঝতে পারবো না ভেবেছিস? তুই হলি খোলা বইয়ের মতো। তোকে পড়তে আমার এক সেকেন্ড সময়ও লাগে না। এবার সাহস থাকলে দরজা খোল!’

খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। মৃদু একটা শব্দ। অথচ তাতেই প্রহরের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। এতক্ষণ তো শুধু শুধু অনুভবকে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে যে হুট করে দরজা খুলবে সেটা ভাবেনি। কিন্তু অনুভবের তো দরজা খোলার কথা নয়। অন্তত দুই-তিন দিন তার চোখে চোখ রাখার কথা নয়।

প্রহর শুকনো ঢোক গিলল। অনুভব দরজা খুলে বাইরে বের হলো। তার দিকে তাকাল না। আলনার দিকে যেতে যেতে বলল,

‘চেঞ্জ করে নাও।’

প্রহরের আর কিছু বলার সাহস হলো না। এমনিতে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। কত বার তুই তুকারি করেছে। শিট! সত্যি সত্যি তাকে যদি গলা টিপে মেরে ফেলে? সর্বনাশ। ভয়ে ভয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে তবে স্বস্তি পেল।

______________

‘আমি কিছুদিনের জন্য গ্রামে যেতে চাচ্ছি অনুভব।’

ভাতের প্লেটে অনুভবের হাত থেমে গেল। প্রহরও মুখ তুলে ফাতেমা বেগমের দিকে তাকালো। অনুভব বলল,

‘কেন মা? হঠাৎ করে গ্রামে যাবে কেন?’

‘তোর মামু ফোন দিয়েছিল। কয়েক মাস হলো যাই না। কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসতে বলছে। এতদিন তোকে একা রেখে যেতে চাচ্ছিলাম না। এখন তো প্রহর আছে। কোনো চিন্তা নেই আমার!’

অনুভব বুকের ভেতর বিপুল শূন্যতা অনুভব করলো। তার একান্ত কিছু শূন্যতার নৈরাজ্য আছে যেটা তার মা অবধি জানে না। সে এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে পানি দিয়ে গিলল। বলল,

‘থাক। যেতে হবে না মা। মামুকে এখানে আসতে বলো।’

‘তাই কি হয় রে! তোর মামি, মামাতো ভাই-বোন, প্রতিবেশী ওদের কতদিন হলো দেখি না। একবার ঘুরে আসি। বেশিদিন থাকবো না। তিন-চার দিন মাত্র! প্রহর তোর খেয়াল রাখবে।’

প্রহর এতক্ষণ চুপচাপ ভাত নেড়ে যাচ্ছিল। এবার বলল,

‘তা না হয় রাখলাম। কিন্তু আপনার না গেলে হয় না মা? এখানেই কোথাও ঘুরতে যেতে পারি আমরা।’

‘নারে পাগলি! এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। কতদিন হলো গ্রামে যাই না। কিছুদিন গ্রামের খোলা মাঠ-ঘাট, মুক্ত প্রকৃতিতে শ্বাস নিতে চাই।’

প্রহর আর কিছু বলল না। অনুভব চুপচাপ খেতে লাগলো৷ আড়চোখে একবার প্রহরের প্লেটের দিকে তাকালো। এক চামচ ভাত প্রহর মিনিট বিশেক হলো নেড়েচেড়ে যাচ্ছে। প্লেটের এক কোণায় বেগুনের টুকরোগুলো এখনো অবহেলার পড়ে আছে। ওর যে খেতে কষ্ট হচ্ছে সেটা খুব করে বুঝতে পারলো। এসব বুঝতে জ্যোতিষি হতে হয় না। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করলো সে। প্লেটে পানি নিয়ে বলল,

‘কখন যাবে মা?’

‘ভোরবেলার ট্রেনে উঠিয়ে দিবি। কাপড়চোপড় সব গুছিয়ে ফেলেছি।’

‘এত তাড়াতাড়ি যাবে? দু-একদিন পর না হয় যাও?’

‘নারে! তোর মামুকে বলেছি। দুপুরবেলা স্টেশনে নিতে আসবে আমায়।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

অনুভব রুমে ঢুকে গেল। প্রহর নিজের প্লেটের ভাতটুকু দ্রুত শেষ করলো। ফাতেমা বেগম আরেক চামচ ভাত উঠিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু প্রহর বাঁধ সাধলো। পানি খেয়ে হাত ধুয়ে ফেলল সে। পুরনো অভ্যাসবশত ভেজা হাতটা ফাতেমা বেগমের আঁচলে মুছে ফেলল। কাজটা করার পর হুশ ফিরলো তার। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলল,

‘আসলে খাওয়া শেষে রোজ মায়ের আঁচল দিয়ে হাত মুছতাম। অভ্যাস হয়ে গেছে।’

ফাতেমা বেগম প্রচন্ড খুশি হয়েছেন প্রহরের কাজে। প্রহর যে তাকে আপন করে নিতে পেরেছেন তাতে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। প্রহরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘আমি খুশি হয়েছি। দোয়া করি, সুখী হও মা! পৃথিবীর সব সুখ তোমাদের দুজনের হোক।’

প্রহরের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। হুট করে ফাতেমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আপনি সুস্থ আছেন তো মা? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ।’

‘পাগল মেয়ে! আমি অসুস্থ হতে যাব কেন? সম্পূর্ণ সুস্থ আমি।’

ফাতেমা বেগমের কথা শুনে আশ্যস্ত বোধ করলো প্রহর। তাকে ছেড়ে দিয়ে দুজন খোশগল্পে মেতে উঠলো। কিছুক্ষণ পর মাদুর উঠিয়ে বাসনকোসন সব রান্নাঘরে রেখে এলো প্রহর। ফাতেমা বেগমের নামাযের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে। তিনি রুমে চলে গেলেন। রান্নাঘর, বসার ঘরের লাইট নিভিয়ে ফুরফুরে মেজাজে প্রহর রুমে ঢুকলো। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে আড়চোখে অনুভবের দিকে তাকালো। অনুভবকে দেখে প্রচন্ড শকড হলো সে। শকড হওয়ারই কথা! অনুভব টেবিলে বসে পড়ছে। তার সামনে মোটা একটা বই খুলে রাখা। এটা তার কাছে বিরল দৃশ্যের মতো। অনুভবকে পিঞ্চ মেরে কিছু বলতে গিয়ে মনে পড়লো সে তো অভিমান করেছে। বিকেলের ঘটনার পর থেকে সে অনুভবের সাথে আর কথা না বলার জোরালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনুভবকে না দেখার ভান করে গিয়ে বিছানায় বসলো সে। বিছানা আর টেবিলের মধ্যবর্তী দূরত্ব খুবই কম। প্রহর কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও সামলে নিল নিজেকে। হুট করে পেটের কথা মনে পড়লো। মলমজাতীয় কিছু লাগিয়ে রাখতে হবে। না হলে ব্যথা কমবে না! জামা উঁচু করে সে আঘাতের জায়গাটা পরখ করতে অনুভব একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হুড়মুড় করে বলল,

‘কি করছো? মাথা খারাপ তোমার?’

(চলবে)