#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১৭
‘পাশে এসে শুয়ে পড়ো। একফোঁটা স্পর্শ যেন না লাগে! একটু আধটু স্পর্শ করবে তো ভোরবেলা বাপের বাড়ি রেখে আসবো। চিরদিনের জন্য!’
অনুভবের কথায় প্রহরের মুখোভঙ্গির কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটলো না। কিছুক্ষণ নিজের জায়গা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। রুমের চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে বিছানার দিকে এগোল।
অনুভব বিছানার কিনার ঘেঁষে শুয়ে পড়েছে। দেয়ালের দিকে তার জন্য জায়গা রাখা। ওপাশে যেতে হলে অনুভবকে ডিঙিয়ে যেতে হবে। প্রহর সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। অনুভবের বন্ধ চোখজোড়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে অনুভব কিভাবে যেন টের পেল। সাবধানে পা জোড়া ভাঁজ করে জায়গা করে দিল। প্রহর আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বিছানায় উঠে পড়লো। দেয়ালের সাথে সেঁটে বাম কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।
অনুভব নড়চড়হীন। চিৎ হয়ে সটান শুয়ে আছে। মুখের এক পাশটা দেখা যাচ্ছে। প্রহর দীর্ঘ সময় অনুভবের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটাকে তার কত কিছু বলার আছে। এতগুলো বছর ধরে জমিয়ে রাখা অনুভূতির সাক্ষী করার আছে। অথচ সুযোগ পাচ্ছে না। কোথায় যেন বাঁধা। এত কাছে থেকেও মানুষটাকে ছুঁতে না পারার আক্ষেপ তার সারাজীবন থেকে যাবে।
প্রহর শ্বাস ফেলল। নিচু স্বরে জিগ্যেস করলো,
‘অনুভব ঘুমিয়ে পড়েছেন?’
অনুভব বরাবরের মতো নিরুত্তর। প্রহর হালকা নড়ে উঠলো। নিঃশ্বাস আটকে আসছে চাইছে বার বার। কয়েকটা গভীর শ্বাস নিয়ে সমস্ত উদ্বেগ ঝেরে ফেলে দিল। শান্ত স্বরে বলল,
‘একটু এদিকে সরে আসুন। ফ্লোরে পড়ে যাবেন তো!’
প্রতিত্তরে অনুভবের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে এলো তার। প্রহর আর ঘাটালো না। পায়ের নিচ থেকে আলাদা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে নিল। পাশের বাড়ির কান্নার শব্দ থেমে থেমে আসছে। রুমের নিস্তব্ধতা হৃদপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। প্রহর চোখ খিঁচে বন্ধ করলো। রাতের গভীরতার সাথে সাথে মৃদু পদধ্বনির শব্দ কর্ণকূহরে এলো তার। থপথপ করে পা ফেলার শব্দ। কখনো বা মেঝেতে চেয়ার টানার শব্দ। বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো তার। নিজের অজান্তে অনুভবের কাছ ঘেঁষে এলো৷ অপর পাশের মানুষটার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা এই মুহূর্তে মনে রইলো না। চোখ বন্ধ করে মুখ লুকালো। অনুভবের বাহু আঁকড়ে ধরলো ভরসায়!
সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে নিয়মমাফিক৷ ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার মৃদু শব্দ কানে আসছে। সময়ের পরিব্যাপ্তিতে শব্দটা ছন্দে রূপ নিয়েছে। ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে থাকা অনুভব সেই ছন্দের সাথে বেশিক্ষণ তাল মেলাতে পারলো না। একটা সময় ধপ করে চোখ খুলল। হাঁ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল! ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো নিশ্চিন্তে পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটির পানে। কিছুক্ষণ পর নিশ্চুপ রাত্রিতে একটা ভয়াবহ সত্য আবিষ্কার করলো। সেই সাথে বুঝতে পারলো আজ রাতে তার ঘুম হবে না। এইভাবে মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে ঘুম আসা অসম্ভব।
রুমে এখনো বাল্ব জ্বলছে। সেই আলোতে সে প্রহরের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ ও গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। প্রহর ঘুমিয়ে পড়েছে। তার ভারী নিঃশ্বাস অনুভবের কাঁধের কাছে আছড়ে পড়ছে। অস্বস্তিকর পরিবেশ। মেয়েটার এত কাছে কখনো তার আসা হয়নি। আজ তার মনে হচ্ছে, প্রহরের ছিঁটেফোঁটা স্পর্শে তার মৃত্যু নিশ্চিত। বড় বড় করে শ্বাস নিল সে। এভাবে প্রহর পাশে থাকলে তার প্রতিটা রাত নির্ঘুম কাটতে বাধ্য।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে মেঝেতে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেও শরীর নাড়াতে পারলো না। প্রহরের স্পর্শে কেমন আবিষ্ট হয়ে পড়েছে যেন। শেষ মুহুর্তে আর উঠতে পারলো না। নিজে থেকে প্রহরের বাহু হালকা ছুঁয়ে দিল। ডান হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলল,
‘ঠিক যতবার আমার দিকে তুমি প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়েছো, আমি ততবার খুন হয়েছি।’
____________
ক্লাস শেষ হতে প্রহর দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বন্ধুদের কবলে একবার পড়লে বের হওয়া কঠিন। আজকের সম্পূর্ণ বিকেলটা তখন ক্যাম্পাসে কাটাতে হবে। দ্রুতালয়ে হেঁটে এসেও সুবিধা করতে পারলো না। দুইতলার সিঁড়িতে আটকে ধরলো বন্ধুরা। প্রহর আর বাধ সাধলো না। জানে, লাভ হবে না। এমনিতে বেশ কিছুদিন হলো বন্ধু মহলে সময় দেওয়া হয় না। পুরোটা সময় অনুভবের পেছনে ব্যয় করছে। তবুও সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে না। ব্যথিত মনে সে বন্ধুদের সাথে ক্যাফেটেরিয়ার উদ্দ্যেশে রওনা করলো।
ক্যাফেটেরিয়ার গোল টেবিলে বসে অতি সন্তর্পনে চারপাশে নজর বুলালো সে৷ অনুভব বেশিরভাগ সময় ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দেয়। বিয়ের আগে সুযোগ পেলেই ক্যাফেটেরিয়ার আশপাশে ঘুরঘুর করতো সে। তবে আজ, এই মুহূর্তে অনুভবের সামনে পড়তে চাচ্ছে না। আড়চোখে সম্পূর্ণ ক্যাফেটেরিয়ায় নজর বুলিয়ে বুকে স্বস্তি পেল। অনুভব নেই!
‘স্বস্তি’ শব্দটা বেশিক্ষণ টিকলো না। চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিতেই উত্তর দিকের দরজা দিয়ে অনুভবকে ঢুকতে দেখা গেল। কয়েক সেকেন্ড থম মেরে সেদিকে তাকিয়ে রইলো প্রহর। জিহ্বায় চায়ের উষ্ণতা টের পেতে দ্রুত কাপ সরিয়ে রাখলো। মাথা যথাসম্ভব নিচু করে অনুভবের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করলো। কয়েক সেকেন্ড সময়ের ব্যবধানে বন্ধুদের বুঝতে না দিয়ে, চায়ের আড্ডা ফেলে রেখে সে সটকে পড়লো।
রিকশা করে যখন বাসায় ফিরলো প্রহর ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে গেছে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। অনুভব ফেরার আগে কিছু একটা রান্না করে রাখতে হবে। দিন চারেক হলো তার শ্বাশুড়ি মা গ্রামে গিয়েছে। গতরাতে ফোনে কথা হয়েছিল। তাড়াতাড়ি করে ঢাকা ফেরার জন্য প্রহর তাগাদা দিচ্ছিল। শ্বাশুড়ি মাকে ছাড়া বাসা একদমই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
অল্প সময় নিয়ে গোসল শেষ করলো প্রহর। ভেজা চুল মুড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে দরজায় টোকা পড়লো। অনুভব এসে গেছে! দ্রুত এগিয়ে গেল সে। তটস্থ হয়ে দরজা খুলতে ওপাশে এক নারীমূর্তি স্পষ্ট হলো। সহসা কিছু বলতে পারলো না প্রহর৷ চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। উচ্ছ্বসিত সুরে বলে উঠলো,
‘মা!’
মিসেস রাবেয়া হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন। প্রহর চোখের পলকে তাকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিসেস রাবেয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অশ্রু লুকিয়ে জিগ্যেস করলেন,
‘কেমন আছিস রে প্রহর?’
‘ভালো মা! তুমি কেমন আছো? বাবা? বাবার শরীর ভালো?’
মিসেস রাবেয়া চোখ মুছলেন। প্রহরের মুখটা সামনে এনে গাল মুছে দিলেন। স্মিত হেসে বললেন,
‘আমরা ভালো। অনুভব কোথায়? তোর শ্বাশুড়ি মা? কাউকে তো দেখছি না।’
‘অনুভব ফেরেনি এখনো। আর শ্বাশুড়ি মা কিছুদিন হলো দেশের বাড়ি গেছে। ঘুরতে! তুমি বসবে চলো, মা।’
প্রহর মায়ের মুখপানে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখে মুখে অপরাধ বোধের ছায়া গাঢ় হলো তার। একটা সময় মাথা নিচু করে বলল,
‘বাবা কি আমার উপর রেগে আছে মা? আসলো না যে?’
‘রেগে নেই। আসবে অন্য কোনো সময়। আজ কাজে আটকা পড়েছে।’
মিসেস রাবেয়া থামলেন। প্রহরের মুখের দিকে চেয়ে ব্যথিত হলেন। মেয়েটার গায়ের রঙ ঘোলা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালির আস্তরণ। মুখটা আগের তুলনায় অনেকটা শুকিয়ে গেছে। তিনি প্রহরের গালে হাত রাখলেন। মমতা মাখিয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘তুই সত্যি সত্যি ভালো আছিস তো মা? মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে না?’
প্রহরের চোখের কোণায় ফের অশ্রু জমতে শুরু করলো। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মা। কিন্তু বলতে পারলো না। অনুভবের জীবনযাত্রার সাথে মানিয়ে চলা যতটা সহজ সে মনে করেছিল ততটা সহজ নয়। প্রতিটা পদক্ষেপে মনে হচ্ছে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। সত্যি সত্যি কষ্ট হচ্ছে। তবে কষ্ট হলেও তার দুঃখ নেই। অনুভবের সাথে একই চালার নিচে থাকতে হলে এইটুকু কষ্ট সহ্য করতেই হবে। এই কষ্টটুকু নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যেতো৷ যদি অনুভব একটু কাছে টানতো। দুটো ভালো কথা বলতো৷ কখনো যদি কাতর দৃষ্টিতে তাকাতো। একটু চোখে চোখ রাখতো। আঙুল ছুঁইয়ে দুঃখ গুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করতো!
মেঘ লুকানোর মতো দ্রুত নিজেকে লুকিয়ে ফেলল প্রহর। জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসির রেখা টানলো। মাকে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘একদমই কষ্ট হচ্ছে না মা। আমি সত্যি ভালো আছি। ভীষণ ভালো আছি।’
___________
রাত ৮ টার দিকে অনুভব হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরলো। ফিরেই প্রহরকে তাড়া দিল ব্যাগ গুছানোর জন্য। বিস্মিত প্রহর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনুভবের দিকে চেয়ে রইলো। সপ্তাহ দুই হলো শ্বাশুড়ি মা গ্রামে। এখনো ফেরেনি। এই ফাঁকে কি অনুভব তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তাকে বাপের বাড়ি রেখে আসবে? চিরতরে? সে অস্ফুট স্বরে বলল,
‘ব্যাগ গুছাবো মানে?’
‘গুছাতে বলেছি গুছাও! এক প্রশ্ন কেন?’
অনুভবের ত্যাড়া উত্তরে প্রহরের ভয় দ্বিগুণ হলো। বুক কেঁপে উঠলো। অনুভবের হঠাৎ কি হলো? সবকিছু তো আগের মতোই চলছে। সে-ও তো মানুষটাকে তেমন বিরক্ত করছে না। সম্পর্কটা পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য সময় দিয়েছে। কিন্তু অনুভব? প্রহর কম্পিত কন্ঠে শুধাল,
‘আপনি আমায় বাবার বাসায় রেখে আসবেন অনুভব?’
শার্টের বোতামে হাত থেমে গেল অনুভবের। চোখ উল্টে তাকালো প্রহরের পানে। স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘আমরা গ্রামে যাচ্ছি। মা বলছে, আমরা না গেলে ঢাকা ফিরবে না। অল্প কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নাও। দ্রুত!’
এতক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাস টুকু বের করলো প্রহর। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো অনুভবের দিকে। ইচ্ছে করছে, অনুভবকে একটা বড়সড় চড় বসাতে। এভাবে কেউ কাউকে ভয় পাইয়ে দেয় বুঝি? সে তো ধরেই নিয়েছিল অনুভব তাকে বিনা নোটশে বাবার বাড়ি রেখে আসবে।
‘কি হলো? তাড়াতাড়ি করো। ১০ টার দিকে ট্রেন ছাড়বে। হাতে একদম সময় নেই।’
অনুভবের ধমকানো সুর শুনে প্রহরের রাগ ঝিমিয়ে এলো। সুপ্ত এক আনন্দানুভূতি তরলের মতো ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত দেহে। অনুভবের সাথে রাতের ট্রেইন জার্নি আর গ্রাম ঘুরে দেখার কথা ভাবতে শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। ছোট্ট করে ‘যাচ্ছি’ বলে দৌঁড় শুরু করলো।
(চলবে)