#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____২০
হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে অনুভব অপেক্ষা করছে। হাতে রিপোর্ট! কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে। এখন ডাক্তারকে দেখানো বাকি। আর তিনজন পর তার সিরিয়াল। এই সময়টাতে সে অনেক কিছু ভেবে নিল। রিপোর্টের ব্যাপারে পজিটিভ, নেগেটিভ সব ভাবলো। তার ভাবনার মাঝে ডাক পড়লো,
‘সিরিয়াল নাম্বার ২০৩।’
অনুভব উঠে দাঁড়ালো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। মধ্য বয়স্ক এক লোক কেবিনের মাঝামাঝি বসে আছে। মাথায় কালো মাফলার পেঁচানো। অনুভব সালাম দিয়ে বসে পড়লো। হাতের রিপোর্ট গুলো এগিয়ে দিতে দীর্ঘ সময় নিয়ে ডাক্তার দেখলেন। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট উল্টেপাল্টে দেখলেন। কম্পিউটারে কিছু খোঁজাখুঁজি করে এক পর্যায়ে জিগ্যেস করলেন,
‘অনুভব মোর্শেদ, না?’
‘হুঁ!’
‘বিয়ে করেছেন?’
এই প্রশ্ন আশা করেনি! ঠাস করে না বলতে গিয়ে অনুভবের মস্তিষ্কে প্রহরের মুখটা ভেসে উঠলো। এক ধরনের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়লো ভেতর জুড়ে। নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ প্রহরের উদয়ের দিনগুলো স্মরণ হলো। নিচু স্বরে বলল,
‘হুুঁ! বেশিদিন হয়নি। কয়েক মাস।’
ডাক্তার চোখ তুলে তাকালেন। বললেন,
‘প্রেমের বিয়ে? ভালোবাসেন?’
অনুভব উত্তর দিল না। অস্পষ্ট ভাবে হাসলো শুধু। যার উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দুটোই হতে পারে। ডাক্তার প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘আপনার সাথে কেউ আসেনি? গার্ডিয়ান কোথায়?’
‘আমাকেই বলুন। আমার অসুস্থতা সম্পর্কে ভালোমতো ধারণা আছে। বেশ কিছুদিন হলো বাঁ কিডনীতে চোখে অন্ধকার দেখার মতো ব্যথা হচ্ছে। অবস্থা যে ভালো নয় তা বেশ বুঝতে পারছি।’
‘অপারেশন হয়েছে কত বছর আগে? আগের রিপোর্ট গুলা দেখলে সুবিধা হতো।’
‘ওগুলো তো ঢাকাতে। সাথে নিয়ে আসা হয়নি। মোটামুটি বছর সাতেক আগে অপারেশন হয়েছে। দুইটা বৃক্ক নষ্ট ছিল। একটা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আরেকটা কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’
অনুভবের কন্ঠস্বর বেশ স্বাভাবিক। কোনো ভীতি নেই, অস্থিরতা নেই। যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বসে আছে। ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ইতস্তত করে বললেন,
‘যেটা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ওটার অবস্থা ভালো নয়। আউটলুক দেখে মনে হচ্ছে……..। আরো নিয়মমাফিক জীবন যাপন করতে হবে আপনার। অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। আর যতদ্রুত সম্ভব কিডনী হসপিটালে যোগাযোগ করতে হবে।’
ডাক্তার আরো কিছুক্ষণ উপদেশ দিলেন। অনুভব মাথা নেড়ে হুঁ হাঁ করলো শুধু। কানে কিছুই ঢুকলো না। মধ্য বয়স্ক এই লোকটিকে দেখে তার বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবার চেহারার সাথে লোকটির কোথায় যেন মিল। কতগুলো বছর হলো বাবাকে দেখা হয় না, একবার বাবা বলে ডাক দেওয়া হয় না। বাবার জীবনটা বড় কষ্টের ছিল। সেই জরাজীর্ণ জীবনটা আপন করে নিয়েছিল তার মা। একই গ্রামে বিয়ে করে সংসার পেতেছিল। কিন্তু দুঃখ-দূর্দশা তাদের পিছু ছাড়েনি। দুঃখ-দূর্দশা ভয়ংকর আর বাজে জিনিস। একবার কারো পিছু নিলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত দেহ ছাড়ে না। কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট হাতে নিয়ে অনুভব উঠে দাঁড়ালো। মনস্থির করলো ফেরার পথে বাবার কবরটা দেখে যাবে। বাবাকে তার অনেক কিছু বলার আছে। হয়তো এই পরিদর্শনই শেষ পরিদর্শন!
চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতে ডাক্তার ডাক দিলেন। সে পেছন ঘুরে তাকালো।
‘অনুভব! স্ত্রীর নাম কি?’
‘ওর নাম প্রহর।’
‘অল্পবয়সী একটা মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার নামে মেয়েটির জীবন কোনোভাবে নষ্ট করে দিলেন না তো?’
অনুভব উত্তর দিতে পারলো না। ডাক্তার নিজে থেকে বললেন,
‘এবার অন্তত মেয়েটির জন্য বাঁচার চেষ্টা করুন। মনে জোর রাখুন। বেস্ট অফ লাক।’
হাসপাতালের মেইন গেট পেরিয়ে পেছন ঘুরে তাকালো অনুভব। গেটে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘সিপিডি ট্রাস্ট হসপিটাল’! শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে সে হাঁটা ধরলো। পায়ের নিচে মাটির অস্তিত্ব টের পাচ্ছে না। নিজেকে কেমন হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিস্তৃত মহাশূন্যে একা ভেসে বেড়াচ্ছে সে। সম্পূর্ণ একা!
_______
সারাটা দিন বাহিরে কাটিয়ে রাতের বেলা অনুভব বাড়ি ফিরলো। একদম উচ্ছ্বসিত হয়ে! খাওয়া দাওয়া শেষ করে মামার সাথে গল্পগুজব করলো। মামির কানের কাছে গিয়ে শব্দ করে এটা ওটা জিগ্যেস করলো। মায়ের সাথে নানা ধরনের কথা বললো। এসবের ফাঁকে ফাঁকে প্রহরকে খুঁজে চলল। কিন্তু প্রহরকে দু একবার চোখে পড়লেও কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠলো না।
রাতের খাওয়া শেষ হতে অনুভব চায়ের আবদার করলো। তারপর নিজের রুমে বসে অপেক্ষায় রইলো প্রহরের। সে ধরেই নিয়েছিল প্রহর চা নিয়ে আসবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। চা নিয়ে এলো তার মামি। অনুভব চমকালো একটু। গ্রামে আসার পর থেকে প্রহর তাকে কেমন ইগনোর করছে। দু রাত হলো মায়ের সাথে ঘুমাচ্ছে। কি পীড়াদায়ক!
এতগুলো দিন সে এটাই চেয়েছে। প্রহর তাকে ইগনোর করুক, তার থেকে দূরে দূরে থাকুক। তার কোনো কিছুতে কর্তৃত্ব না ফলাক! এটাই সে চাইতো! কিন্তু প্রহরের এই উদাসীনতা সে মানতে পারছে না। চারপাশের সবকিছু কেমন ফিকে মনে হচ্ছে, মিথ্যে মনে হচ্ছে। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। প্রহরের অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতিতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতগুলো বছরের সেই অভ্যাস কিভাবে যাবে?
সময় অতিক্রমতার সাথে সাথে কাপের চা শীতল হয়ে উঠলো। অনুভব ছুঁয়েও দেখলো না। এক সময় বসা থেকে উঠে পড়লো। মোবাইলে সময় দেখে মায়ের রুমের দিকে এগোল।
ফাতেমা বেগম আধ শোয়া হয়ে ছিলেন। প্রহর মাথার চুলে তেল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছিল। ভেড়ানো দরজা ঠেলে অনুভব নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলো। তাকে এক পলক দেখে প্রহর চোখ নামিয়ে নিল। ফাতেমা বেগম বললেন,
‘ঘুমাস নাই অনুভব? কিছু বলবি?’
অনুভব এগিয়ে এসে মায়ের পায়ের কাছটাতে বসলো। মুখের দিকে চেয়ে বলল,
‘তোমার শরীর কেমন?’
‘ভালো তো! দেখছিস না একদম সুস্থ।’
‘ঢাকা ফিরবে কবে? প্রচুর শীত এখানে। এই শীতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।’
‘ফিরবো আর কিছুদিন পর। তুই ঘুমাস নাই কেন এখনো?’
‘ঘুমাব! থাকো তাহলে।’
অনুভব উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার আগে প্রহরের দিকে তাকালো এক নজর। প্রহরের মুখটা অস্বাভাবিক মলিন। গ্রামে আসার যে উচ্ছলতা ছিল তা নেই। চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ। চোখ জোড়া ফোলা ফোলা। মনে হচ্ছে অনেক কান্না করেছে। হুট করে অনুভবের হার্টবিট থেমে গেল। মা প্রহরকে তার অসুস্থতার কথা বলে দেয়নি তো?
অনুভবের মস্তিষ্ক জুড়ে ভয়ানক চিন্তা ঢুকে গেল। রুমে ফিরে কেমন ছন্নছাড়া লাগতে লাগলো নিজেকে। এতগুলো দিন প্রহরের থেকে নিজের কঠিন ও নির্মম সত্যটা লুকিয়ে রেখেছিল। প্রহর কি অবশেষে সব জেনে গেল? জেনে গেল যে এই অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীতে তার স্বামীর আয়ু বেশিদিন নেই? সে হারাতে চলেছে তার সর্বপ্রিয় মানুষটাকে? অনুভব আর ভাবতে পারলো না। দু হাতে মাথা চেপে ধরলো!
_______
মুখের সামনে থেকে কেউ লেপ টেনে সরাতে ভেতরে শীতল বাতাস প্রবেশ করলো। ভয়ানক বিরক্ত হলো অনুভব। পিট পিট করে চোখ খুলতে মোহাচ্ছন্ন মুখটা স্পষ্ট হলো। তার প্রত্যাশার থেকে খুব কাছাকাছি। কানের দুপাশের এলোমেলো চুলগুলো মুখ স্পর্শ করেছে প্রায়। উষ্ণ এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো অনুভবের দেহজুড়ে। লেপের ভেতর থেকে বাম হাতটা বের করলো। প্রহরের চোখের সামনের অবিন্যস্ত চুলগুলো আলগোছে গুছিয়ে দিল। ঠোঁটে দেখা দিল অস্পষ্ট ও ক্ষীণ হাসির রেখা। তৎক্ষনাৎ কানে এলো মিহি একটা উচ্ছ্বসিত সুর।
‘আর কত ঘুমাবেন মি. স্বামী? কত বেলা হয়ে গেছে! ‘
পিলে চমকে উঠলো অনুভবের। চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। মস্তিষ্ক খোলাসা হতে শুকনো ঢোক গিলল। প্রহর? সত্যি তো প্রহর! এই তো তার দিকে ঝুঁকে আছে পৃথিবীর নির্মল হাসিমাখা মুখটা। নিজের লাগামছাড়া ধ্বংসাত্মক অনুভূতি দ্রুত গুটিয়ে নিল অনুভব। লেপ টেনে মুখ ঢাকার চেষ্টা করলো। প্রহর ঝলমলে সুরে বলে উঠলো,
‘মামি ভাপা পিঠা করেছে। দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে ফেলুন তো। আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।’
প্রহরকে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল অনুভব। পরমুহূর্তে তার বুকের ভার নেমে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেল। বড় একটা চিন্তার ঝড় ধূলিসাৎ হয়ে গেল। নাহ! প্রহর তার অসুস্থতার ব্যাপারে কিছু জানে না। হয়তো গতকাল কোনো কারণে মন খারাপ ছিল। মেয়েটির থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতে কতটা কাঠখড় পোহাতে হয়েছে তাকে সেটা শুধু সে-ই জানে। এখন নিজেকে নিয়ে নয়, এই মেয়েটাকে নিয়ে বেশি চিন্তা হয়। সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।
‘তোমার বাবা-মার সাথে কথা হয়?’
‘হুঁ! হয়তো। আজ সকালেও মাকে পিঠার ছবি পাঠিয়েছি।’
‘বুঝলাম! রাতে তোমার বাবা আমাকে ফোন দিয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল বিষয়টা।’
তাদের মাঝে কি কথা হয়েছে বা বাবা হঠাৎ অনুভবকে কেন ফোন দিল প্রহর সেসব প্রশ্নে গেল না। হাসিমুখে বলল,
‘আপনি এত অবাক হচ্ছেন কেন? আমাদের গোটা জীবনটাই তো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারখানা। আমরা যেটা এক্সপেক্ট করে রাখি তার কত পার্সেন্ট জীবনে ঘটে বলুন তো? খুবই ক্ষুদ্র! দেখা গেল ভবিষ্যতে এমন সব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো যে আমাদের এই জটিল সম্পর্কটার মোড় ঘুরে গেল।’
অনুভব কিছু বলার মতো পেল না। প্রহর ব্যস্ত হয়ে পড়লো বিছানা গোছাতে। তার দিকে আড়াআড়ি দৃষ্টিপাত রেখে অনুভব জানালা খুলে দিল। কুয়াশার ঘন চাদর ভেদ করে মৃদু একটা সূর্যরশ্মি জানালা দিয়ে রুমে ঢুকলো। অনুভব সেখানে দাঁড়িয়েই প্রহরের দিকে মনোযোগ দিল। কুয়াশা জড়ানো এই শীতের সকালে, জীবনে প্রথম বারের মতো মনে হলো নিজের সাথে বড্ড বেইমানি করে ফেলেছে সে। নিজের সাথে, নিজের মনের সাথে, নিজের হৃদয়ের সাথে প্রতারণা করেছে। মনে হলো, নিজেকে এতটা কষ্ট না দিলেও পারতো। এতটা নির্দয় না হলেও পারতো! বুঝতে পারলো, কয়েক হাত দূরে থাকা যে মায়াবী পুতুলটাকে দেখার থেকে দৃষ্টিরোধ করে রেখেছিল সেটা ভুল ছিল।
‘কি হলো? আপনি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছেন? ফ্রেশ হচ্ছেন না কেন?’
অনুভব নড়ে উঠলো। প্রহরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
‘যাচ্ছি। মা ঘুম থেকে উঠেছে?’
‘হুঁ! রান্নাঘরে মোড়া পেতে বসে আছে। কিন্তু মায়ের শরীরটা বেশি ভালো না। শেষ রাতের দিকে হালকা জ্বর ছিল। আজ বরং একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।’
অনুভবের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সামান্য জ্বরের সংবাদও কলিজা কাঁপিয়ে দিল।
(চলবে)