অনুভবের প্রহর পর্ব-২৭

0
472

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২৭

ঘুমের মধ্যে মৃদ্যু নড়ে উঠলো প্রহর। অনুভব তাকে পরম যত্নে আগলে নিল। গলা পর্যন্ত কাঁথা টেনে দিল। পলকহীন নেত্রে চেয়ে রইলো প্রহরের পানে। তার বেরঙ পৃথিবীতে ছিঁটেফোঁটা যা রঙ তা এই মেয়েটি বয়ে এনেছে। সংকটাপন্ন জীবন, ক্রমাগত দারিদ্র্যের করালগ্রাস, বাবাকে হারানো, শারীরিক যন্ত্রণাসহ নানাবিধ সমস্যার জীবনে মেয়েটার আচমকা পদচারণ। অনুমতি ব্যতিরেকে, সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে!

প্রথম দিন প্রহরের নিষ্পলক চাহনি কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকিয়ে দিয়েছিল তাকে। ওই চোখজোড়াতে কিছু একটা ছিল যা তাকে মুগ্ধ করেছিল। ব্যথা, যন্ত্রণা সহ্য করা হৃদপিণ্ডে মধুর এক অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়েছিল। প্রহর যখন প্রথমবার খাতা নেওয়ার অজুহাতে তার আঙুল ছুঁয়েছিল, সেই মুহূর্তে মেয়েটির প্রেমে পড়েছিল সে। তাকে নিয়ে অদ্ভুত অনুভূতির উদয় হয়েছিল। ভেবেছিল, সবটা বুঝি একতরফা। কিন্তু দিন কয়েক অতিক্রম হতে ভুল ভাঙে তার। মেয়েটা ছায়ার মতো তার পিছু নেয়। হুটহাট শূন্য থেকে যেন উদয় হয়। অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হয়। অনুভবের ভালো লাগলেও কালক্রমে অজানা এক ভয় জেঁকে ধরে। ফলস্বরূপ এড়িয়ে চলা শুরু করে মেয়েটিকে। কিন্তু তেমন সফল হতে পারে না।

বসন্তের এক উৎসবে মেয়েটা উতলা হয়ে যায়। এক পাহাড়সম ভালোবাসা নিয়ে তার দুয়ারে হাতছানি দেয়। আর দশটা পুরুষের মতো সে-ও ভীষণ খুশি হয়েছিল সেদিন। পৃথিবীটা হঠাৎ করেই ভালো লাগতে শুরু করেছিল। ভালো লাগতে শুরু করেছিল পথের ধুলো থেকে শুরু করে সব!

বর্ণিল এক পৃথিবী মুঠোয় করে প্রহর তার অনুভূতি ব্যক্ত করেছিল। এক আকাশ স্বপ্ন ছিল তার অভিব্যক্তি জুড়ে। ছিল নতুন জীবনের হাতছানি। অনুভব গ্রহণ করতে পারেনি সে ভালোবাসা। ধরতে পারেনি সে হাত! নিজের নিষ্ঠুরতম নিয়তির কাছে পরাজিত সে। সেজন্য সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রহরকে। প্রহরের ভালোবাসায় টইটম্বুর দৃষ্টিটা ক্ষণিক সময়ের মধ্যে সেদিন অশ্রুতে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছিল। সেই ভেজা দৃষ্টি তাতে কতরাত পুড়িয়েছে! কতরাত জ্বালিয়েছে!

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অনুভব। এত কষ্ট করেও শেষ রক্ষা হলো না। ঠিক নিজের অনুভূতির কাছে হার মানলো। প্রহরের কাছে ধরা দিল।

প্রহরের খোলা চুল স্পর্শ করলো সে। আঙুলে পেঁচিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলো। এক সময় অন্তরঙ্গ গলায় বললো,

‘প্রহর, ক্ষমা করে দিও আমায়। নিজের অনুভূতির উপর নিঃস্বার্থ হতে পারিনি আমি৷ তুমি আমার প্রতি দূর্বল জানার পরপরই আমার উচিত ছিল ক্যাম্পাস ত্যাগ করার। তোমার চোখের ত্রিসীমানায় না থাকার। এমন জায়গা লুকিয়ে পরা দরকার ছিল যেখানে তুমি চাইলেও আমার খোঁজ পেতে না৷ কিন্তু তা পারিনি! পারিনি আমি। অনুভূতি! এই একটা জায়গায় আমি ভীষণ লোভী। তোমাকে একটুখানি দেখার লোভ, তোমার কাছাকাছি থাকার লোভ সামলাতে পারিনি। স্বার্থপরের মতো ক্যাম্পাসে রয়ে গেলাম। বছরের পর বছর একই ক্লাসে পড়ে রইলাম। রয়ে গেলাম তোমার হাতের নাগালে, দৃষ্টির খুব কাছে। কিন্তু আমার মনে তীব্র সন্দেহ ছিল। ভেবেছিলাম, তুমি পাপা’স প্রিন্সেস। মোহ জন্মেছে আমার উপর। দুদিন পর কেটে যাবে। নিজে থেকে বিরক্তি চলে আসবে। আপনা-আপনি দূরে সরে যাবে। নিজের মতো করে ভেবে জীবনের চরম মাত্রার ভুল করেছিলাম। তোমার অনুভূতিকে ঠুনকো মনে করেছিলাম। তার জন্য আমি যতটা অনুতপ্ত, ততটা অনুতপ্ত নিজস্ব অভিমতের উপর। আমার উচিত ছিল তোমার থেকে বহুদূরে চলে যাওয়ার। তাহলে হয়তো তোমার জীবনটা ছবির মতো অন্য রকম সুন্দর হতো। ভবিষ্যতে কি হবে জানা নেই আমার। তবে যা-ই হোক, আমি সর্বদা তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমা করে দিও আমায়।’

অনুভবের গলা ধরে এলো। দ্রুত পাশ ফিরে ঝাপসা চোখ লুকাল। বাঁ কিডনিতে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। শরীর ঝিমিয়ে আসছে বার বার। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করলো।

__________

‘তোমার হঠাৎ সমুদ্র দেখার শখ জাগলো কেন?’

‘উঁহু! প্রশ্নে একটু ত্রুটি আছে। ত্রুটিপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেই না আমি।’

‘প্রহর! ঠিক করে বলো তো। তোমার মতলব ঠিক ভালো ঠেকছে না। আমাকে মেরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার প্লান করোনি তো?’

‘সেকি? আপনি বুঝে ফেললেন কি করে?’

ফিক করে হেসে ফেলল প্রহর। অনুভব কপাল কুঁচকালো। মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো,

‘সত্যি কথা বলবে? হুট করে সমুদ্র দেখার জন্য ব্যাকুল হলে কেন?’

‘আমি সমুদ্র দেখার জন্য ব্যাকুল হয়নি তো। আপনাকে পাশে নিয়ে, আপনার হাতে হাত রেখে সমুদ্র দেখার ইচ্ছে হয়েছে শুধু।’

অনুভবের ঠোঁটের কোণে হাসি দৃশ্যমান হলো। তা আড়াল করতে দ্রুত চায়ের কাপে চুমুক দিল। প্রহর আনমনে বললো,

‘জানেন অনুভব! আপনি আমার কাছে সমুদ্রস্বরূপ। আপনার দিকে তাকালে অদ্ভুত ভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। নিজের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, দুশ্চিন্তা সব কোন অতলে হারিয়ে যায় কে জানে। সমস্ত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার সমীকরণ ভুলে কেমন প্রশান্তি অনুভব করি৷ দেহ-মন জুড়ে এক ধরনের আলস্যপূর্ণ সুখ নেমে আসে। আপনি আমার কাছে রহস্যে ভরপুর এক সমুদ্র। আমার একান্ত নিজস্ব সমুদ্র। যে সমুদ্রকে স্পর্শ করতে, তার বুকে একটু ঠাঁই পেতে কত অপেক্ষা করেছি। কতকিছু সহ্য করেছি। এই সমুদ্রটা আমার কতটা প্রিয়, কোন ধারণা আছে আপনার? শুনুন! ঠিক এই সমুদ্রটার বুকেই আমি হাজার জনম অতিবাহিত করতে চাই। এই সমুদ্রে-ই আমি নিজের সমস্ত দুঃখ ভাসিয়ে দিতে চাই।’

দম নিল প্রহর। দৃষ্টিতে উচ্ছলতা মাখা। এবারে রসিকতার সুরে বললো,

‘এক সমুদ্র পাশে রেখে এবার আরেক সমুদ্র দেখতে চাই। দেখতে চাই কোন সমুদ্র বেশি সুন্দর। বুঝতে পেরেছেন?’

চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিতে ভুলে গেল অনুভব। অবাক হয়ে তাকালো প্রহরের দিকে। প্রহর বেশ স্বাভাবিক। হাসি হাসি মুখ। ছোট ছোট করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। অনুভবের মনে হলো, নিয়তি তার সাথে নিষ্ঠুরতা করেনি। সাধারণ মানুষ সারাজীবনে যা পায় না, সে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি পেয়েছে। প্রহরের কাছে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার পর তার ভেতর এক ধরনের অপরাধ বোধ কাজ করতো। মস্তিষ্কের সূক্ষ্ণ একটা অংশ জানান দিতো, আর কিছুদিন কঠোর থাকলেও হতো বুঝি। সে চলে গেলে প্রহর হয়তো তাকে দ্রুত ভুলতে পারতো৷ নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু আজ আবার উপলব্ধি করলো, প্রহর তার যাবতীয় চিন্তা ভাবনার উর্ধ্বে। এই মেয়েটার তীব্র অনুভূতি তাকে বারংবার অবাকের শীর্ষে পৌঁছে দিচ্ছে। চমকিত করছে বার বার। হাসলো অনুভব। ভেতর থেকে সমস্ত দ্বিধা দূর হলো। মনের ভেতর কোনো আফসোস নেই তার। মাঝে মাঝে ভুল সিদ্ধান্ত সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। প্রহর তাকে ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে। দুদিন পর সে থাকুক বা না থাকুক, প্রহর তার স্মৃতি গুলো স্বযত্নে আগলে রাখবে। এর থেকে বড় সত্যি পৃথিবীতে দ্বিতীয় কিছু নেই। এই মেয়েটার কাছে সে আজন্ম কৃতজ্ঞ!

অনুভব আচমকা ডাকলো,

‘প্রহর? কাছে আসো তো।’

‘হুঁ?’

চমকে উঠলো প্রহর। অনুভবের দৃষ্টি উপেক্ষা করে এদিক ওদিক তাকালো। আপাতত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা। একটু দূরে একটা টি স্টল। দোকানে কিছু লোকও দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বাবার ব্যক্তিগত ড্রাইভার মোতালেব চাচা। তাদের মাইক্রোবাসে করে সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এখন পথিমধ্যে আছে। শুরুতে অনুভব রাজি হচ্ছিল না। তাকে রাজি করাতে কম বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু হঠাৎ অনুভবের কি হলো? প্রহর কাছে এগিয়ে এলো। চিন্তিত স্বরে বললো,

‘আপনি ঠিক আছেন? কার সিকনেস আছে আপনার? বমি বমি পাচ্ছে?’

________

তোমায় নিয়ে একদিন সূর্যাস্ত দেখতে যাবো,
দেখতে যাবো সমুদ্রের বিশালতা
হাতে হাত রেখে দেখব সূর্য আর সমুদ্রের ডুবে যাওয়া প্রেম।

তুমি জানো!
সমুদ্র আর সূর্যে প্রেম কতটা গভীর?
কতটা দূরত্ব মাঝে।
তবুও দেখে ঠিক বেলা শেষে নিয়ম করে এক হয়ে মিশে দুজন।
তুমি কি বলবে, এই মিশে যাওয়াকে?

ভালোবাসা?
নাকি লোক দেখানো?
-রুদ্র

অনুভব থামলো। প্রহরের চেপে রাখা হাতটা শক্ত করে হাতের মুঠোয় পুড়লো। প্রহর ফিসফিস করে বললো,

‘সমুদ্র আর সূর্যের এই প্রেম লোক দেখানো না। এটা ভালোবাসা!’

সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। স্নিগ্ধ জল। গোধূলির মাতোয়ারা বাতাস সে জলে আলোড়ন তুলেছে। মাঝারি সাইজের ঢেউ ছন্দে ছন্দে দুলে উঠছে। আছড়ে পড়ছে বালুতীরে। প্রহর অনুভবের পায়ের তালে পা ফেলে আরেকটু এগিয়ে গেল। খালি পায়ে পানির শীতল স্পর্শ হতে শরীর কেঁপে উঠলো। অনুভবের কাছ ঘেঁষে এলো আরো। সমুদ্রের জলে ডুবন্ত সূর্য! জলরাশিতে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। ঢেউ খেলানো সমুদ্রপুরীকে অকল্পনীয় সুন্দর লাগছে। প্রহর প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। মনোমুগ্ধকর কন্ঠে বললো,

‘কি সুন্দর! ভীষণ সুন্দর!’

অনুভব সমুদ্র থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহরের পরনে লাল রঙা শাড়ি। হাওয়ায় শাড়ির লম্বা আঁচল উড়ছে। সাথে উড়ছে আধ খোলার খোপার চুল। প্রাণোচ্ছল মুখটাতে ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম ছটা প্রতিফলিত হচ্ছে। তাকে স্নিগ্ধময় এক সূর্য মনে হচ্ছে। যে সূর্য এক নিমেষে সব অন্ধকার দূর করে দেয়। এই সন্ধ্যা লগ্নে অনুভব মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো প্রহর নামক বহ্নিশিখার দিকে। যে বহ্নির তাপ বড় কোমল। একটা সময় প্রহর সমুদ্র থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অনুভবের দিকে তাকালো। অনুভবের ঘোর লাগা দৃষ্টি তার পানে দেখে থতমত খেল। কিছু বলার চেষ্টা করতে অনুভব শুধাল,

‘কে বেশি সুন্দর প্রহর? এই সমুদ্র নাকি তোমার নিজস্ব সমুদ্র?’

(চলবে)