#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___৩৫ (শেষ পর্ব)
প্রহরের মাথাটা অনুভবের কোলে রাখা। সারারাত এভাবেই ছিল। ডান হাতটা তার হাতের মুঠোয়। আচমকা অনুভব নড়ে উঠলো। অনুভূতির নিউরনে তীব্র আঘাত লাগলো। প্রহরের হাত এত শীতল কেন? এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চেঁচামেচি করে সবাইকে ডাকতে শুরু করলো। মুহূর্তে নার্স ছুটে এলো৷ ছুটে এলো কর্তব্যরত বয়স্ক ডাক্তার। এসে অনুভবকে বের করে দিল। বাইরে নাজমুল বসে ছিল। অনুভবকে টেনে নিয়ে গেল হসপিটালের শেষ মাথায়।
অনুভবকে রেখে দৌঁড়ে কেবিনের সামনে এলো নাজমুল। কোনো ওষুধপত্র আনতে হবে কি না তার জন্য অপেক্ষায় রইলো। কিন্তু তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হলো না। কর্তব্যরত হিন্দু ডাক্তার বাবু বেরিয়ে এলেন মিনিট দশেক পরেই! কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাঁর মুখ। নাজমুল হন্তদন্ত হয়ে জিগ্যেস করলো,
‘প্রহর কেমন আছে? বাহির থেকে কোনো মেডিসিন আনতে হবে?’
‘সে সকল মেডিসিনের উর্ধ্বে চলে গেছে। পৃথিবীর আর কোনো মেডিসিনই তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না।’
নাজমুল ভাবলেশহীন ভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ডাক্তারের পানে৷ যেন বুঝতে পারেনি তিনি কি বলছেন। ডাক্তার বাবু আরো সহজ করে দিলেন তাকে।
‘মেয়েটি আর বেঁচে নেই। মৃত্যুসময় আনুমানিক ৫ টা। দ্রুত ডেডবডি নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’
নাজমুলের কিয়ৎক্ষণ সময় লাগলো অনুধাবন করতে। সত্যিটা বুঝতে পেরে বুকে নিদারুণ ব্যথা শুরু হলো। প্রহর নেই! এই অমোঘ সত্যিটা তোলপাড় করে দিল মুহূর্তে।
ভোরের আলো ফুটেছে। কিচিরমিচির শব্দের দু চারটে শহুরে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। হসপিটালের বাইরে ব্যস্ততাময় একটা দিন শুরুর তোড়জোড় চলছে৷ অনুভব করিডোরের এক কোণার দিকে বসে ছিল। দৃষ্টি নত করে রাখা। ডাক্তার বাবু হেঁটে এগিয়ে গেলেন। হাতে ভাঁজ করে রাখা এক টুকরো কাগজ। মনটা ব্যথিত তাঁর। শেষের দিনগুলোতে মেয়েটার সাথে দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সহ্য করার অসহনীয় ক্ষমতা ছিল মেয়েটার। আহারে! তিনি কাছে যেতে অনুভব উঠে দাঁড়ালো। কিছু জিগ্যেস করার ফুরসত পেল না সে। ডাক্তার বাবু হাতে কাগজ টা ধরিয়ে দিলেন। ইশারায় পড়তে বললেন। অনুভব কপাল কুঁচকে ফের বসে পড়লো। হাতের কাগজটি খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলো।
”বরসাহেব,
প্রথম যেদিন আপনার অসুস্থতার কথা শ্বাশুড়ি মায়ের মুখ থেকে শুনলাম সেদিন আমার সাজানো-গোছানো পৃথিবী উলোটপালোট হয়ে গেলো। পরিচিত সবকিছু মুহূর্তে অপরিচিত হয়ে উঠলো। কাঁচের মতো ভেঙে চূড়ে যেতে লাগলো আমার সমস্ত স্বপ্ন। আমার আত্মবিশ্বাস আর মনের জোরে তখন একের পর এক করাঘাত। আপনাকে নিয়ে দেখা আমার সব স্বপ্ন আচমকা মুখ থুবড়ে পড়লো। আমার তখন কি যে কষ্ট! সারারাত বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদলাম। ভীষণ রকম কাঁদলাম। মা কত বোঝালেন। কিন্তু কিছুতেই আমার কান্না থামলো না। বার বার মনে হলো এত কষ্ট কেন আমাকেই পেতে হবে? সেই আমাকে কেন বার বার চরম দুঃখের দারপ্রান্তে পৌঁছাতে হবে? আমি কি জীবনে একফোঁটা সুখানুভূতি পাব না?
দুদিন পর আপনার জন্য ফের মনের জোর ফিরিয়ে আনলাম। আবার লড়াই করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। সাজানো-গোছানো সংসার নামক পালক ছেঁড়া পাখির যত্ন নিতে থাকলাম। তাকে এক সময় সুস্থ করে আগের মতো উড়িয়ে দিলাম। সব চলছিল আগের মতো। তবুও আমার মনের ভেতর তখন একরাশ ভয়। আপনাকে হারানোর তীব্র ভয়। এই পৃথিবীতে আমি সব সহ্য করতে পারবো। কিন্তু আপনাকে হারিয়ে ফেলার যে যন্ত্রণা তা সহ্য করতে পারবো না। আপনি এ ধরায় নেই, আমার কাছে নেই, আমার পাশে নেই! আপনাকে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে দূরে কোথাও রেখে আসলো। কোনোদিন আর চোখের দেখা দেখতে পেলাম না, ছুঁয়ে দিতে পারলাম না, ওই গভীর সমুদ্রে দুঃখ ঝেরে ফেলতো পারলাম না। এর চেয়ে কষ্টের কিছু আছে? দেখুন ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ জ্বালা করছে। বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা হচ্ছে। পৃথিবীর সব নিয়ম আমি মানতে পারবো। শুধু আপনি নেই, আমি আছি এই নিয়ম মানতে পারবো না৷ আপনি বিহীন পৃথিবী আমার নরক তুল্য। আমি শ্বাস নিতে পারবো না। এক মুহূর্তও নাহ!
জানেন! আপনার অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে পরম করুণাময়ের কাছে আকুল মনে দুটো জিনিস চাইছিলাম। হয় আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। না হয় আমার যেন কঠিন কোনো রোগ হয়৷ আমি যেন আপনাকে হারিয়ে ফেলার মতো তীব্র যন্ত্রণার মুখোমুখি না হই। পরম করুণাময় আমার প্রার্থনা শুনেছেন। দেখুন না! কেমন অকস্মাৎ আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। একদম সব যেন মিরাকলের মতো। ক্যান্সার জীবাণুর একটা কোষ রাতারাতি লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গেল। কোটি কোটি নতুন কোষ আক্রান্ত হলো। এসব আপনারা আমার থেকে লুকালেও সব বুঝতে পারি আমি। শরীর ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেছে আমার। নিঃশ্বাস নিতে পারি না ঠিকমতো। ফুসফুসে কি যে যন্ত্রণা! এই যে লিখতে গিয়ে কত কষ্ট হচ্ছে। অক্ষর গুলো এবড়োথেবড়ো হয়ে যাচ্ছে। হাতে শক্তি পাচ্ছি না একদম। কিন্তু আমাকে নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা সহ্য হয় না বলে আপনাকে বুঝতে দিই না। হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি সবসময়। অনুভব, আমি কি সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছি? আমাকে হারানোর যন্ত্রণা আপনি সইতে পারবেন?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি পারবেন অনুভব। আপনি ভীষণ কঠিন মনের। আপনার কঠিনতর খোলসে আবৃত তুলতুলে নরম ভালোবাসা আমি অনুভব করেছি বহু দেরিতে। যে মানুষটা একটা মেয়েকে এত এত ভালোবাসার পরো নিজেকে লুকিয়ে রাখে, তোলপাড় করা প্রিয় মানুষটা কাছে থাকার পরো নিজেকে এতটা লুকিয়ে রাখতে পারে, নিজেকে আড়ালে রাখতে সক্ষম হয় সে শক্ত মনের নয়তো কি! আপনাার সহ্যশক্তি অনেক বেশি। আমাকে ছাড়া বাঁচতে আপনার ভীষণ কষ্ট হবে এটা ঠিক। কিন্তু আপনি পারবেন অনুভব। আপনাকে পারতে হবে। আপনাকে বাঁচতে হবে। আমি চাই আপনি বাঁচুন। আমার এই অযৌক্তিক আবদার রাখবেন না? অনুভব, আমার একদম ধৈর্যশক্তি নেই। আমি ভীষণ বিড়াল স্বভাবের। গা ঘেঁষা স্বভাব। আপনার সঙ্গ ছাড়া এ পৃথিবী আমার কাছে অক্সিজেন বিহীন৷ অক্সিজেন ছাড়া মানুষ কত মিনিট বাঁচতে পারে, বলুনতো? দুই মিনিট নাকি তিন মিনিট?
অনুভব! আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমি ডায়েরি লিখতাম। আপনাকে পাওয়ার পর ডায়েরি লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। কিন্তু শেষ সময়ে এসে আবার ডায়েরি লেখা শুরু করেছি। আলাদা করে এই চিঠিটা কেন লিখছি জানি না। কিন্তু আমার মন বড় কু ডাক গাইছে। মৃত্যুর আগে নাকি মানুষ অনেক কিছু টের পায়। আলাদা এক গন্ধ অনুভূত হয়। আমারো কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আমি মারা যাচ্ছি তা ভীষণ করে টের পাচ্ছি। তীব্র রূপে টের পেলাম গতকাল ভোরে। আপনাকে বলা হয়নি সেকথা। গতকাল ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে দেখি শ্বাশুড়ি মা আমার শিয়রের কাছে বসে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাত্র দেখলাম। তারপর কোথায় যেন মিলিয়ে গেল!
জানেন? ইদানীং আমার লোভ হচ্ছে। বাঁচার লোভ! আপনার হাতে হাত রেখে, আঙুলে আঙুল আঁকড়ে রাখার লোভ। আপনার পায়ে পা ফেলে বসন্ত দেখার লোভ। চলুন না অনুভব! দুজন একত্রে বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসি। যদি আরো কয়েকটা দিন একত্রে কাটাতে পারি! আপনার বুকে মাথা রাখতে পারি! আচ্ছা, আপনার প্রথম চুমুর কথা মনে আছে? মনে আছে প্রথম জড়িয়ে ধরার অনুভূতি? আমার কিন্তু খুব করে আছে! এই দেখুন না! সেই অনুভূতি মনে পড়ায় আমার এখনো মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠছে।
আপনি জালালুদ্দিন রুমিকে চিনেন? উনার বিখ্যাত দুটি লাইন আমার ভীষণ পছন্দের। ‘Beyond the right and wrong, there is a garden. I will meet you there.’ বরসাহেব! চলুন নতুন কোনো পৃথিবীতে আবার দেখা করা যাক। রোগ-শোক মুক্ত নতুন এক পৃথিবী। যে পৃথিবীতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য থাকবে না। আপনি আমাকে অকপটে কাছে টেনে নিবেন। যে পৃথিবীতে আপনি শুধু আমার। আর আমি আপনার! তবে যে পৃথিবী-ই বলুন! সব পৃথিবীতে আমি আপনার পিছু নিবো। আপনার তোলপাড় করা আদরমাখা ভালোবাসার একমাত্র অংশীদার হবো। ভালোবাসি! ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে। এই পৃথিবীর ধূলোকণার অধিক পরিমাণ। অনুভব! আমার অনুভব!
ইতি
অনুভবের প্রহর”
চিঠির পাতাটা হাত থেকে খসে পড়লো অনুভবের। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। ভিজে উঠা চোখ দুটো লালবর্ণ ধারণ করলো। চেঁচিয়ে বললো,
‘এসব কি? প্রহর কোথায়? কেমন আছে ও?’
ডাক্তার বাবু একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। মমতা মাখিয়ে বললেন,
‘আপনার স্ত্রী আর নেই। আমি গিয়ে মৃতাবস্থায় পেয়েছি৷’
অনুভবের মনে হলো কান দিয়ে উত্তপ্ত লৌহদন্ড প্রবেশ করলো। উত্তপ্ত লৌহবস্তু ভেতরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে লাগলো। মুহূর্তে হৃদপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল। বিকট এক ঝড়ে এসে ভেতরটা লন্ডভন্ড করে দিল। ধারালো ছুরিকাঘাতে হৃদপিণ্ড ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে যেন। সে অপ্রকৃতস্থের মতো চেয়ে রইলো ডাক্তারের পানে। মৃগী রোগীর মতো শরীর কাঁপা শুরু হলো তার। গলার স্বর পেঁচিয়ে গেল। ডাক্তার বাবু তার মাথায় হাত রাখতে গিয়ে থেমে গেলেন। তিনি আরো কঠিন এক সত্য জানাতে যাচ্ছেন। ছেলেটার এই সত্যটা জানার অধিকার আছে। তিনি দ্বিধা ঝেরে বললেন,
‘আপনার স্ত্রী মা হতে যাচ্ছিল। বাচ্চার বয়স মাস দুয়েকের মতো। আপনাকে আগে জানাতে চেয়েছিলাম। আপনার স্ত্রী জানাতে বারণ করেছিল। পরে হয়তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু……. ‘
ডাক্তার বাবু আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন। অনুভবের দিন দুনিয়ায় গভীর অমাবস্যা নেমে এলো। আশপাশে তাকিয়ে মাতালদের মতো কিছু যেন খুঁজলো। কিন্তু গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। চারপাশ এত অন্ধকার কেন? কেউ নেই কেন? এত শূন্য কেন? তার সাহায্য প্রয়োজন। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার শ্বাস নেওয়া প্রয়োজন। তাকে প্রহরের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন। প্রহর অপেক্ষা করছে তো! উদভ্রান্তের মতো হাঁটতে গিয়ে সে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়লো৷ সাথে বুকের গহীন থেকে বেরিয়ে এলো গগনবিদারী চিৎকার। ফ্লোরে গড়িয়ে গড়িয়ে পাগলের মতো করতে লাগলো। হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। অন্য জগতের গহীন থেকে বেরিয়ে আসছে সে কান্নার সুর। তার কান্নায় হাসপাতালের করিডোরে ততক্ষণে মানুষ জমে গেছে। সবাই ছলছল নয়নে দেখছে সদ্য প্রিয়জন হারানো এক যুবককে।
নাজমুল এগিয়ে আসছিল অনুভবকে সামলানোর জন্য। কিন্তু কাছে এসে অনুভবের অবস্থা দেখে থমকে গেল সে৷ এত কষ্ট কেন পাচ্ছে ছেলেটা? জীবন এত ব্যথাতুর কেন? বেঁচে থাকা এত কষ্টের কেন? সত্যি! কিছু মানুষের পৃথিবীতে জন্ম হয় শুধু দুঃখ পাওয়ার জন্য। অনুভব তাদের দলে। আগামীকাল রাত ১২ টায় ফ্লাইট। দুজনের চিকিৎসার সমস্ত কিছু রেডি। তার মধ্যে একজন চলে গেল। অনুভবের অপারেশন নিকটে। ডোনার রেডি। নাজমুল খুব করে বুঝতে পারছে পৃথিবী উল্টে গেলেও অনুভব সার্জারি করাবে না৷ তার এখন এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বেশি কষ্টের! বেশি যন্ত্রণার!
পরিশিষ্ট:
জয়নুল আবেদীন মোটা ডায়েরি টা নেড়েচেড়ে দেখলেন। ডায়েরির প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘অনুভবের প্রহর’! অর্থাৎ কোনো একটা অনুভূতি বুঝতে পারার ক্ষণ বুঝাচ্ছে৷ সেই ক্ষণটা দীর্ঘ হতে পারে আবার অল্প সময়ের হতে পারে। আবার দুজনের নামও হতে পারে। তিনি চোখ তুলে তাকালেন। সামনে বসে থাকা সুদর্শন যুবকের দিকে আরেক নজর তাকালেন।
‘অনুভব৷ তুমি বলছো যে এই ডায়েরিটা আমি পড়ি। পড়ে এই কাহিনি নিয়ে একটা গল্প লিখি। তাই তো?’
‘জ্বি৷ আমি চলে যাওয়ার পর ডায়েরিটা পড়বেন। তবে কাহিনিতে একটু পরিবর্তন আনবেন। গল্পের অনুভব যেন সুস্থ থাকে। দারিদ্র্যতা থাকুক৷ কিন্তু তার বাবা-মা যেন বেঁচে থাকে। আর প্রহর মেয়েটার যেন অকালে ঝরে যেতে না হয়। সে যেন তার অদ্ভুত ভালোবাসা দিয়ে ছেলেটাকে মুড়িয়ে রাখতে পারে। তারা যেন একত্রে বার্ধ্যের শহর দেখে।’
‘তার মানে তুমি সুন্দর একটা হ্যাপি এন্ডিং চাচ্ছো৷ কিন্তু তাহলে তো তা বাস্তবতা বিবর্জিত হয়ে যাবে। বাস্তবে প্রতিটা সত্যিকার ভালোবাসার অদ্ভুত হৃদয়বিদারক পরিসমাপ্তি ঘটে৷’
‘বাস্তবতা বিবর্জিত হলে হোক! কল্পনায় আমরা সবাই সুখী।’
অনুভব উঠে দাঁড়ালো এবং প্রায় তৎক্ষনাৎ বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেল। জয়নুল আবেদীন তার পথপানে চেয়ে রইলেন। এই ছেলেটার সাথে পরিচয় তার অল্প দিনের। তাও আবার খুব অদ্ভুত উপায়ে। তার জানামতে ছেলেটার দুটো কিডনি নষ্ট। মাঝে মধ্যে ডায়ালাইসিস করে বেঁচে আছে৷ ছেলেটার চোখজুড়ে কি গভীর এক দুঃখসমুদ্র। এই দুঃখী ছেলেটাকে নিয়ে তার লিখতেই হবে!
_____
আকাশ জোড়া মেঘ। ঘনকালো মেঘ। ফুলেফেঁপে একাকার অবস্থা। যখন তখন বৃষ্টি শুরু হবে৷ শহরের সবার মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। সবার ঘরে ফেরার তাগিদ। ঘরে কেউ না কেউ অপেক্ষায় আছে। যার জন্য চরম ব্যস্ত হয়ে সবাই ঘরমুখী হওয়ার চেষ্টা করছে। শুধু চেষ্টা নেই অনুভবের। সে স্থির হয়ে এসেছে। তার জন্য পৃথিবীর কোথাও কেউ অপেক্ষায় নেই। কোথাও নেই! একদিন বৃষ্টির রাতে দেরি করে বাড়ি ফিরেছিল বলে প্রহরের সে কি রাগ! এখন রাতে না ফিরলেও অপেক্ষা করার মতো কেউ নেই। কেউ নেই শার্টের কলার চেপে শাসন করার! জীবন নামক উপহারটা এত দুঃখ আর হাহাকারে মোড়ানো কেন?
পকেটের ফোন বাজছে৷ অনুভব ভাবলেশহীন ভাবে কানে ধরলো।
‘হ্যালো অনুভব। আমি প্রহরের মা বলছিলাম।’
‘অহ। আসসালামু আলাইকুম।’
‘বলছিলাম আজ সন্ধ্যার পর একটু আমাদের এখানে আসতে পারবে? আজ একটু ভালো-মন্দ রান্না করবো।’
অনুভব তেমন আগ্রহ পেল না। তার এখন লোক সমাজ ভালো লাগে না। দু-চারজনের সমাবেশ ভালো লাগে না। কারো সান্নিধ্যে আসতে ইচ্ছে হয় না। সে না বলার জন্য মনস্থির করতে ওপাশে থেকে ভেসে এলো,
‘প্রহর নেই তিন মাস হয়ে গেল। আজ প্রহরের জন্মদিন বাবা। প্রতিবছর মেয়ে আমার কত উৎসুক থাকতো দিনটি নিয়ে। তুমি যদি আসতে বাবা! আমার মেয়েটা….’
ঝমঝম করে তীব্র বেগে বৃষ্টি শুরু হলো। অনুভব ব্রিজের একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। বৃষ্টির বেগ ভীষণ বেশি। গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। অনুভবের ভেতর কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া নেই৷ সে সমস্ত শারীরিক ব্যথা, বেদনার উর্ধ্বে চলে গেছে।কল কেটে গেছে অনেক আগে। কানে ফোন এখনো ধরে রাখা। সে ফোনটা পকেটে রেখে রাস্তায় বসে পড়লো। বাঁ পাশের কিডনিতে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। বুকের যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে৷ সেই সাথে বেড়ে চলেছে বৃষ্টির বেগ। আস্তে আস্তে তুমুল বর্ষণরত সে জলের সাথে মিশে যেতে থাকলো অনুভবের নিঁখাদ ভালোবাসার জল। একফোঁটা, দুইফোঁটা, তিনফোঁটা! একসময় দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। কাছে কোথাও বজ্রপাত হলো। একটু দূরে ছিটকে পড়লো আধমরা এক পাখি!
*সমাপ্ত*