#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১
রোজার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারটা আদ্রিশ মানতে পারলো না। সারাটা পথ মুখটা থমথমে করে রাখলো সে। রোজা ওর দিকে একবার চোখ তুলেও তাকালো না, একমনে বাইরের দৃশ্যাবলি অবলোকনে ব্যস্ত। ওর এই অবহেলা দেখে আদ্রিশের মাথায় রাগ চড়লো। অতি সন্তপর্ণে বা-হাতটা দিয়ে চেপে ধরলো রোজার ডান হাতটি। আচমকা চমকে ওঠে চোখদুটো বড় বড় করে তাকালো রোজা। মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে গিয়েও চুপ মেরে সিটের সাথে লেপ্টে রইল। পেছনে দু-জন ঘুমে ঢুলছে, ইশা বসে ফোন স্ক্রল করছে৷ রোজার চক্ষুজোড়া দপ করে জ্বলে ওঠলো। আদ্রিশ পরোয়া করলো না, একমনে সামনে তাকিয়ে দক্ষ হাতে ড্রাইভিং করায় ব্যস্ত সে। রোজা হাত মোচড়াতে থাকলে আরও শক্ত করে ধরে রাখে সে। অগত্যা হাল ছেড়ে দিলো রোজা। চোখমুখ খিঁচে কয়েকটা ভয়ঙ্কর গালি ছুঁড়লো মনে মনে। গলায় কান্নার দলা পাক বেঁধে ঘুরতে লাগলো। দু’ফোটা জল গাল ছুঁয়ে আদ্রিশের হাতের ওপর পড়তেই সে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। রোজা আড়চোখে একবার দেখলো ওকে। লোকটার মতিগতি, হাব-ভাবে বোঝা যাচ্ছে সে কিছুতেই রোজার পিছন নেওয়া ছাড়বে না। এ কোন মুসিবতে পড়লো রোজা? দী-র্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে শক্ত হয়ে বসে রইল রোজা। দু-পাশের জঙ্গলাবৃত গাছপালা ছাড়িয়ে একসময় বাড়ি এসে পৌঁছালো ওরা। গেইটের সামনে গাড়ি এসে থামলে ইশা নেহা-ফিহাকে ডেকে দেয়। ওরা নেমে যায়। রোজা তখনো নামে না। কারণ আদ্রিশ ওর হাত টেনে ধরে রেখেছে। নেহা একবার রোজাকে আসতে বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। ইশা-ফিহাও নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে চলে যায়। ওরা সবাই যেতেই রোজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘অনেক হয়েছে, আপনি কী এবার আমার হাতটা ছাড়বেন?’
আদ্রিশ অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে বলে, ‘আমার দিকে তাকাও। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মানে কী?’
রোজা অন্যদিকে দৃষ্টি রেখেই জবাবে বলল, ‘তাকাবো না।’
আদ্রিশের দৃষ্টি প্রখর হয়, ‘কেন?’
‘আপনার ব্যবহার আমার পছন্দ নয়। এইযে, হুটহাট অভদ্রের মতো আমার হাত ধরেন সেটাও আমার অপছন্দ।’
‘আমাকে-ও তোমার অপছন্দ?’
রোজা উত্তর দেয় না, কথা বাড়াতে চায় না। ওকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আদ্রিশের মেজাজ চটে যায়। আলতো করে একটান দিতেই রোজা ওর দিকে ঝুঁকে আসে। হিজাবটা সরে যায়। হতচকিত রোজা নিজেকে সামলিয়ে ওঠে বসতেই আদ্রিশ ‘ফুঁ’ দিয়ে ওর মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। রোজা ওর বুকে জোরে একটা ধাক্কা মারে, কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা হয় না। দুটো হাত-ই চলে যায় আদ্রিশের মুঠোর ভেতর। রোজা কটমট করে বলল, ‘ছাড়ুন বলছি…’
‘আগে আমার দিকে তাকাও।’
‘কখনোই না।’
আদ্রিশ রোষপূর্ণ কন্ঠে বলল, ‘খুব বেশি তেজ তোমার, তাই না?’
রোজা দায়সারা ভাবে বলল, ‘আপনার যা মনে হয়, তাই৷ আমাকে যেতে দিন।’
‘যেতে দেব। তার আগে আমার দিকে তাকাও।’ ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল আদ্রিশ।
রোজা বিরক্তির সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছালো। আদ্রিশের ব্যবহার আর কথার মারপ্যাঁচে তালগোল পাকিয়ে বাধ্য রোজা ওর দিকে তাকালো। তারপর নিভে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘এবার যেতে দিন।’
‘আমার চোখের দিকে তাকাও।’
রোজা ভড়কে গিয়ে বলল, ‘এমনটা কথা ছিল না। তাকাতে বলেছেন তাকিয়েছি। চোখের দিকে তাকাতে হবে কেন?’
আদ্রিশ গম্ভীর কন্ঠে যুক্তি প্রদর্শন করলো। বলল, ‘চোখের দিকে তাকালেই না আমার মনের কথা বুঝতে পারবে।’
‘আপনি আমাকে যেতে দিন। শুধু শুধু বিরক্ত করবেন না আমায়। আমি এসব পছন্দ করি না।’
‘কেন তোমার জন্যই অনুভূতি জন্মালো মনে? তুমি এত কঠিন কেন মেয়ে?’ আদ্রিশ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রোজার দিকে।
রোজার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তাই সে চুপ করে থাকলো। অস্বস্তিতে জমাট বেঁধে আছে মন-মস্তিষ্ক। আদ্রিশের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা বহাল রাখলো এবং একপর্যায়ে যখন বেখেয়ালে আদ্রিশের থেকে ওর হাতটা আলগা হয়ে এলো, ঠিক তখনই নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুতপদে নামতে গেল রোজা৷ কিন্তু তখনকার মতো ব্যর্থ হলো। রোষাগ্নি চক্ষুতে আগ্নেয়গিরির ন্যায় রক্তিম আভা দেখতে পেল আদ্রিশের চোখে। ফিনফিনে বাতাসে এবার হিজাব পুরোটাই সরে গেল রোজার। এলোমেলো কিছু চুল এসে পড়ে মুখের ওপর। একটানে ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আদ্রিশ শীতল চোখে ওকে একপলক দেখে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। রোজা ভড়কে গিয়ে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে যেন। লোকটা ওর এত কাছে? রোজা ভাবতে পারে না কিছু। ললাটে স্পর্শ হয় আদ্রিশের উষ্ণ ওষ্ঠজোড়া। রোজার শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোত বয়ে যায়। ঘেমে ওঠে সে। রোজা কম্পিত হাতে ওর মুখ চেপে ধরে বলে, ‘এ-এটা পা-প। কী করছেন আপনি?’
আদ্রিশ নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে, ‘বোঝাপড়া করতে চাচ্ছি।’
রোজা নির্জীব কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কী-সে-র বোঝাপড়া?’
আদ্রিশ ওর গালে নিজের ডান হাতটা রেখে সোজা হয়ে বসে। রোজা তখনো চোখ নামায় নি। বিস্ময় নিয়ে ওর কর্মকান্ড দেখে চলেছে। কিছুই বোধগম্য বা বিশ্বাস হচ্ছে না। ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে আদ্রিশ বলল, ‘শুনো মেয়ে, তুমি আমাকে এড়িয়ে চলে প্রতিনিয়ত বুকের ভেতর দহনক্রিয়া সৃষ্টি করে যাচ্ছো, আমি ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না, কাজে মন বসাতে পারছি না তোমার জন্য৷ তোমাকে দেখার আগ অবধি আমার সবকিছু স্বাভাবিক ছিল, তোমাকে দেখার পর থেকেই সব অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। তোমার সাথে দেখা না-হলে আমার এই অসুখটা হতো না। তুমি কেন আমাদের বাড়িতে আসলে মেয়ে? কেন এলে তুমি? এলেই যখন, মেনে নিতে পারছো না কেন তুমি আমাকে?’
রোজা সবটা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আপনাদের বাড়িতে আসাটা-ই কী আমার অপরাধ? আপনাদের টাকায় খাচ্ছি-ঘুরছি-ফিরছি, এর মূল্য চান আপনি?’
আদ্রিশ জোর গলায় বলল, ‘তুমি যেমন আমাকে বুঝো না, আমার কথাগুলো-ও বুঝো না। কেন মেয়ে?’
রোজা গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। আদ্রিশ আটকালো না। এরপর রোজা রোষপূর্ণ কন্ঠে বলল, ‘আপনি কমপক্ষে আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। তাই বড়-র মর্যাদাটা বজায় রাখবেন ভাই-য়া।’
আদ্রিশ চমকালো, থমকালো! রোজার মুখ থেকে ‘ভাই-য়া’ ডাকটি শোনার থেকে এক বোতল বিষপান করে জীবন উৎসর্গ করা যেন স্বস্তির মনে হলো ওর। ততক্ষণে রোজা সদর দরজায় পৌঁছে গেছে। রোজাকে আর হাতের কাছে না পেয়ে আদ্রিশ গাড়ি থেকে নেমে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অতঃপর অনেকটা চেঁচিয়ে-ই বলে ওঠল, ‘ভাই-য়া ডাকার শাস্তি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থেকো মাই গার্ল। এত জ্বালাবো যে, আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।’
রোজার হাসি পেয়ে গেল অজান্তেই৷ পরক্ষণেই অতি কষ্টে হাসি চেপে ঢুকে পড়লো বাড়িতে। আদ্রিশ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর চেহারা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
টেবিলে রাতের খাবার সাজানো হয়েছে। সবাই পেটে ক্ষিধে নিয়ে বসে আছে বাড়ির মুরুব্বি দুজনের জন্য। উৎস বাড়িতে নেই। বন্ধুদের কী একটা পার্টি আছে সেখানে চলে গেছে। নিশিতা মাংসের বাটিটা এনে রাখতেই ইনায়াত সাহেব আর ইমতিয়াজ সাহেব চলে এলেন। মিতালি ইশার প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘আদ্রিশ কোথায়? আসে নি? ফিহা তুই ওকে ডাকিস নি?’
খেতে খেতে ফিহা বলল, ‘আসছে।’
রোজা কথাটায় গুরুত্ব দিলো না। নিজের মতো খেয়ে চলেছে। ধপ করে পাশের চেয়ারটাতে কেউ বসতেই রোজা চমকে তাকালো। হতচকিত দৃষ্টিতে আদ্রিশের বাঁকা হাসিটা চোখে পড়তেই উৎকন্ঠিত চোখজোড়া সরিয়ে খাবারে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। আবারও? ওর পাশেই কেন? রোজা মুখটা কালো করে খাচ্ছে। মিতালি আদ্রিশের খাবারটা প্লেটে দিতেই সে মুখ কুঁচকে বলল, ‘সবজি পছন্দ না মা। তুলে না-ও এটা।’
মিতালি রেগে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘তো? কী দেব?’
আদ্রিশ কিছু বলার আগেই রোজা সবজি নিলো নিজের জন্য। অন্য কোনো দিকে ওর মনোযোগ নেই। কে খাচ্ছে না খাচ্ছে তাতে ও পাত্তা দিচ্ছে না। রোজাকে সবজি নিতে দেখেই আদ্রিশ উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘সবজি-ই দাও।’
শুনেই রোজা তাকালো। পুরো ঘটনাটি মস্তিষ্কে ধরা পড়তেই ছোট ছোট রোষিত চোখে দেখল। এত বজ্জাত কোনো লোক হয়? আদ্রিশ ক্রুর হাসছে। রোজার রাগে গা জ্বলে গেল। তৎক্ষনাৎ সে নিজেকে সামলে নিলো। ওর বিরক্তিকর মুখশ্রীটা দেখে বেশ লাগলো আদ্রিশের৷ আজকাল প্রিয় মানুষটির সবকিছুই এত ভালো লাগে কেন ওর? খাওয়া শেষে ঘরে যাওয়ার সময় করিডরে দেখা হয়ে গেল রোজার সঙ্গে৷ দ্রুতপদে সে স্থান ত্যাগ করার প্রয়াসে যেতে নিলেই রোজার পথ আটকালো আদ্রিশ। রোজা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাতেই কঠোর গলায় সে বলল, ‘আমার হৃদয়কে বশ করার অভিনব কৌশল প্রয়োগ করেছ তুমি। সে হৃদয়কে পোড়াতে চাইলে তাঁর দহনে তুমি নিজেই পুড়ে যাবে মেয়ে। আমাকে যত এড়িয়ে যাবে, যত জ্বালাবে তাঁর চেয়ে বেশি তোমাকে জ্বালাবো আমি। মনে রেখো তুমি।’
এটুকু বলেই আদ্রিশ সে স্থান ত্যাগ করলো। পেছনে রেখে গেল বিস্মিত, হতবিহ্বল রোজা নামক মেয়েটিকে।
—————–
প্রথম সেমিস্টারের এক্সাম শেষ হয়েছে আজ এক সপ্তাহ। খুব বেশি ভালো না হলেও তেমন খারাপও হয় নি রোজার পরীক্ষা। তাতে বরং ও একটু স্বস্তি-ই পেল। আদ্রিশের গোঁয়ার্তুমি, আর হুটহাট যাতনার কারণে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে নি সে৷ নয়তো রেজাল্ট বেশ ভালো হতো ওর। একটা আফসোস থেকে গেল রোজার মনে। সকালবেলা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেই হঠাৎ মাইগ্রেনের ব্যথা ওঠলো। রাত জেগে পড়ার ফলস্বরূপ এই অসহ্যকর ব্যথা। ফলে রোজার আজ ভার্সিটি যাওয়া হয়ে ওঠলো না। সারাক্ষণ রুমেই শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিলো। এদিকে বেলা গড়াতেই ব্যস্ত হয়ে ওঠলো আদ্রিশদের বাড়ির পরিবেশ। একপ্রকার তোরজোড় আর হট্টগোল লেগে গেল যেন। মাথা যন্ত্রণা একটু কমতেই রোজা গোসল সেরে নিলো। চুলে তোয়ালে জড়িয়ে চলে গেল বারান্দায়। রোদে বসে ভেজা চুলগুলো শুকিয়ে নিচ্ছিলো। হঠাৎ বিপরীত দিকে চোখ পড়তেই আদ্রিশকে নজরে এলো ওর। ব্যলকনিতে বসে আছে সে। হাঁটু অবধি ঢাকা একটা প্যান্ট আর খালি গায়ে দু-পা চেয়ারের ওপর তুলে নিউজ পেপার পড়ছে সে। দুপুরের প্রথম প্রহরের কড়া রোদ এসে পড়ছে ওর ব্যলকনির গাছগুলোতে। ক্ষ্যাপাটে হাওয়ার ঝাপটায় চুল ওড়ছে অবিরাম। কিছু চুল নাকে-মুখে এসে পড়ছে। কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই লোকটির। শক্ত-সামর্থ্য, পেটানো শরীর আদ্রিশের। খানিকটা লজ্জা পেল রোজা। ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। দেয়াল ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে দেখলো বেলা প্রায় একটা। এই সময়ে তো আদ্রিশের বাসায় থাকার কথা নয়। তাছাড়া আজ ছুটির দিন-ও না। তাহলে ও বাসায় কেন?
———–
চলবে…