#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫
ভাবনার প্রহর কাটিয়ে ডাইনিংয়ে বসা সকলকে উদ্দেশ্য করে সুহানা শেখ গম্ভীর গলায় বলে ওঠলেন, ‘যার ক্ষিধে পাবে সে-তো নিজে থেকেই খাবে। তোমরা এত চিন্তা করছো কেন? খাওয়ায় মন লাগাও।’
এতক্ষণ যাবৎ ধৈর্যসহিত মেয়েদের অতিরিক্ত কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে আদ্রিশ। গম্ভীর মুখভঙ্গি করে বসে থাকা আদ্রিশ এ পর্যায়ে নিজের প্লেটটা সশব্দে পাশে সরিয়ে রাখলো। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। চোখে এক সমুদ্র তৃষ্ণা, কাউকে না দেখার জ্বালাপোড়া। রোজাকে সন্ধ্যা থেকে একপলকের জন্যও সে দেখে নি। ব্যস্ততার ভিড়ে ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও খোঁজ নিতে পারে নি। হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ। কি হলো রোজার? খেতে নামে নি কেন আজ? কিছু কি হয়েছে? নাকি শরীর খারাপ? ওর তো আবার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে কাউকে বলে না। আর ওকে দেখলেই তো পালিয়ে বেড়ায়, রাগ দেখায়, ক্যাটকেট করে একগাদা উপদেশ শুনিয়ে দেয়। এককথায় ওকে নিয়ে দু-দন্ড ভাবেও না নিষ্ঠুর রোজানুটা। কেন যে ওর জন্যই মন-মস্তিষ্ক আজকাল উত্তপ্ত হয়ে থাকে জানে না আদ্রিশ। অনুভূতিগুলোর যন্ত্রণায় বেঁচে থাকাটাই যেন অর্থহীন মনে হয় ওর। প্রতিটি নিঃশ্বাসে, অনুভবে মায়াবী রমণীটাই ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করে। কিন্তু যার জন্য এসবকিছু অনুভব করে, হয়তো সে মেয়েটার অনুভবের মধ্যে আদ্রিশ নেই। মনে মনে রাগ হয় ওর। কিন্তু রাগ হলেও সেই মুহূর্তে সামলে নিলো নিজেকে। পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে রিজভীকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো প্রবলেম হলে ভনিতা না করে যে কাউকে জানাবে। আজ রাতটা আমাদের বাসায় কাটিয়ে যাও! তোমার কোনো প্রবলেম আছে?’
রিজভী ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘আজ না। কাজের প্রেশার ইদানীং খুব বেশি৷ কাল সকালেই অফিসে ছুটতে হবে। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার বিষয়টিও কনফার্ম করতে হবে। তাছাড়া… ‘
রিজভী আরকিছু বলতে নিলেই ইশা নেহার গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে, ‘নেহা আপু, তুমি কিছু বলো। আজ থেকে যাক না আমাদের সদ্য হওয়া হবু দুলাভাই।’
ইশার বেসামাল কথাবার্তায় নেহা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। রিজভী আড়চোখে সেটা লক্ষ্য করেই অমায়িক হেসে বলল, ‘এখনো হবু-ই। পুরোপুরি দুলাভাই যেদিন হয়ে যাব, সেদিন থেকেই শ্বশুরবাড়ির ওপর পরিপূর্ণ অধিকার পেয়ে যাব। তখন থেকে যাওয়ার জন্য জোর করতে হবে না। থাকব, গল্প করব, আড্ডা দেব সবার সাথে। ওটাই থাকার উপযুক্ত সময়। বাই দ্যা ওয়ে, আমার আরেক শালিকে তো এখনো দেখতে পেলাম না।’
পাশ থেকে ইমতিও কথায় সায় মিলিয়ে বলল, ‘তাই তো!’
সুহানা শেখ মুখ গোজ করে সেখান হতে চলে গেলেন। অসহ্য লাগছে তার। ফিহার খাওয়া শেষ পথে। রোজাকে ডাকার জন্য চেয়ার ছেড়ে ওঠতে নিলেই আদ্রিশ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘তুই বস। খাওয়া ছেড়ে ওঠার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমি তো এখন ওপরেই যাচ্ছি, ডেকে দেব। আসছি।’
একথা বলে আদ্রিশ সেখান থেকে চলে আসে। দোতলায় ওঠে রোজার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দু-বার নক করার পরে কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ঠেলতেই পূর্ণরূপে দরজাটা খুলে যায়। আদ্রিশ ভেতরে ঢুকে রোজাকে দেখতে পায় না৷ পা বাড়ায় ব্যলকনির দিকে। রোজা মগ্ন ছিল নিজের চিন্তার জগতে। নিজের পেছনে আকস্মিক কারোর অস্তিত্ব টের পেয়ে পেছনে ঘুরতেই কারো বুকের সাথে ধাক্কা খায়। নিজেকে সামলে সামনে তাকাতেই লম্বাটে এক সুদর্শন পুরুষের চোখের গভীরে হারিয়ে যায়। পরক্ষণেই রাগ মাথায় চড়ে বসে, চোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা। দু-হাত একসাথে করে এক ধাক্কা দিয়ে আদ্রিশকে সরিয়ে দেয়। হন্তদন্ত হয়ে রুমে ছুটে আসে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জোরালো গলায় বলে, ‘রুমে আসুন এবং এ ঘর থেকে বেরিয়ে যান।’
আদ্রিশ রুমে এসে অবাক হয়ে বলে, ‘রাগার মতো কিছু করেছি কী?’
‘জানি না।’
‘খেতে যাওনি কেন?’
রোজা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। সেভাবে থেকেই কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘আপনাকে বলতে হবে?’
আদ্রিশ শান্ত থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘নিচে সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। ওদিকে ফিরে আছো কেন? আমার দিকে ঘুরো।।’
রোজা ব্যগ্র কন্ঠে বলে ওঠল, ‘আপনার মুখদর্শন করতে চাই না কখনো।’
আদ্রিশ আহত হয়। জ্বলজ্বল করে ওঠে রক্তিম চোখজোড়া। তবুও শান্ত গলায় বলে, ‘কি করেছি আমি? এভাবে কথা বলছো কেন?’
রাগে টগবগ করছে রোজা। আদ্রিশের কথা শুনে যে কেউ-ই ওকে নিরীহ ভাববে। কিন্তু লোকটা তা নয়। এতদিন চুপ করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু আজ ওকে বলতেই হবে কিছু শক্তপোক্ত কথা। রোজার ধৈর্যের সীমারেখা অতিক্রম করে জিজ্ঞেস করল, ‘মিস্টার আদ্রিশ, আপনি কী করেছেন জানতে চান?’
আদ্রিশ দৃঢ় গলায় বলল, ‘অবশ্যই।’
রোজা দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুরু করল, ‘সেই প্রথম থেকে স্পাইয়ের মতো আমার পিছু লেগে আছেন। ভালোবাসার কথা বলে বলে প্রতিনিয়ত আমার মাথা খাচ্ছেন। যখন আপনার প্রস্তাবে রাজি হচ্ছি না তখন মানুষকে দিয়ে আমাকে অপমান করেছেন, নিজেও হ্যারজ করছেন। আপনি সারাক্ষণ বুঝাতে চান না যে আমার প্রতি আপনার আলাদা অনুভূতি আছে? আসলে সেসব মিথ্যে। বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এই অন্যায় কাজটা করতে পারতেন না। ওপরে ওপরে যতই ভালো সাজার অভিনয় করুন না কেন আপনার মতো নিচু মানসিকতার জঘন্য লোক আমি দুটো দেখি নি। আপনি আমার ওপর নিজের কর্তৃত্ব, অধিকার ফলান সবসময় অন্যায়ভাবে। যেটা আমার মোটেও পছন্দ নয়, সেজন্য আপনাকে যথেষ্ট এড়িয়ে চলতে চাই। কিন্তু আপনি সেসব গ্রাহ্যই করেন না, নিজের মর্জিমতো চলছেন আর সবার চোখে আমাকে খারাপ, লোভী, স্বার্থপর প্রমাণ করছেন। খুব বড় অন্যায় করেছেন। কোনোদিন মাফ করবো না আমি। এই বাড়িতে থাকতে আসাটাই আমার পাপ হয়েছে। আপনি হীরা, হীরার পেছনে ছুটুন৷ সামান্য সোনার সাথে হীরাকে মানায় নাকি? জানতে চান না সবসময় আমি আপনার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি কি-না? আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার জন্য আমার মনে কোনো অনুভূতি নেই, আপনাকে নিয়ে কিছু অনুভব করি না আমি। তাই এসব বন্ধ করুন। আমাকে মুক্তি দিন অসহ্য যন্ত্রণা থেকে। দয়া করুন।’
আদ্রিশের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রোজার কথাগুলো দহনক্রিয়ার ন্যায় বক্ষপিঞ্জর পুড়াচ্ছে। চোখের কোণে জলরাশি জমা হয়েছে। এতদিন পরেও রোজার মনের কোথাও জায়গা নিতে পারে নি সে? কিছুই অনুভব করে না? অথচ অনুভবের অনুভূতির যন্ত্রণায় কাতর সে। রোজার শক্ত কথাগুলোর বিপরীতে আদ্রিশ রেগে ওকে টেবিলের সাথে ঠেসে ধরলো৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলল, ‘কিছু অনুভব করো না? কিছু না? এতদিন সব অনুভূতি অপাত্রে দান করেছি? আহ, কি বোকা আমি! আগেই বোঝা উচিৎ ছিল তোমার মতো পাষাণীর হৃদয় কখনো গলবে না। ভুল আমি। বারবার অন্যায় অন্যায় করেছি বলছো যে, কি অন্যায় করেছি আমি যে ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছো? কী করেছি?’
আদ্রিশের ব্যবহারে হতভম্ব রোজার গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। রোজা এই প্রথম, আদ্রিশের চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল, ‘জোরজবরদস্তি করার স্বভাবটা আজও গেলো না। আমাকে জিজ্ঞেস না করে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন মিস্টার আদ্রিশ।’
কথাটুকু শেষ করার পরেও আদ্রিশ ছাড়লো না রোজাকে৷ প্রেয়সীর চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পেয়ে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে মন। মস্তিষ্ক ঘোলাটে হয়ে নষ্টরুপ ধারণ করতে চাইছে। ঠিক সেসময় অভাবনীয় একটি কান্ড করে বসলো আদ্রিশ৷ রোজার মাথার পেছনে বা-হাতটি দিয়ে চেপে ধরে ওর মুখটা সামনে নিয়ে আসলো। রোজার ওষ্ঠজোড়ায় আচমকা কামড়ে ধরলো আদ্রিশ। হতভম্ব রোজা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ওকে কিল-ঘুষি মারতে থাকলেও নিজের একান্তে করা কাজটি থেকে সরে আসে নি আদ্রিশ। কামড়ের দাপটে রোজার যখন মনে হলো সে জ্ঞান হারাবে, তখনই বিষাক্ত কামড়গুলো সিক্ত হলো অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়ায়। এক তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের ওষ্ঠচুমুতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল রোজা। ওর চোখের পানি দেখেও সরে নি আদ্রিশ। নিজের কার্যটুকু শেষ করে মাথা উঁচিয়ে রোজার কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাগে জর্জরিত কন্ঠে বলল, ‘অকারণে দোষারোপ করে চলেছো আমাকে, যেখানে জানিই না আমার দোষটা কোথায়! কিন্তু আজ, এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমার সব অনুভূতিকে মেরে ফেললাম। আর কখনো আদ্রিশ কাউকে চাইবে না, কারো অনুভবে সিক্ত হবে না, পাগল প্রেমিকের ন্যায় ছুটে যাবে না। মুক্তি দিয়ে দিলাম তোমাকে। প্রতিনিয়ত দহনে পুড়ে মরবে, কারোর দীর্ঘশ্বাসের কারণ হবে। আমার সম্পত্তির অধিকার বুঝে নিতে জানলেও আর কখনো চাইবো না তোমাকে, কখনো না, কোনোদিন না।’
ত্রাসিত, শঙ্কিত রোজা বোবা বনে গেল। আদ্রিশ ওর দু-বাহু ছেড়ে দিতেই কয়েক কদম পিছিয়ে গেল রোজা। আদ্রিশ ওর না প্রেমিক-না স্বামী, অথচ আজ অচেনা অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছে সে। ততক্ষণে আদ্রিশ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। বাড়ির লোকজন নিচে কাজে ব্যস্ত থাকায় দোতলার এক কোণের ঘরটিতে কি-কান্ড ঘটে গেছে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় নি। বিস্মিত রোজা ধীরপায়ে হেঁটে দরজাটা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়লো। কোনো পুরুষের ছোঁয়া ওর ঠোঁটে লেগে আছে ভাবতেই নিজের চুল খামচে ধরলো। দু-হাত দিয়ে পাগলের মতো ঘষতে লাগলো ঠোঁটজোড়া। রাখবে না সে আদ্রিশের মতো কোনো বেপরোয়া মানুষের ছোঁয়া, কোনো অনুভূতি। রোজা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ওষ্ঠজোড়া ঘষতে থাকে, একসময় চামড়া ছিলে রক্ত বেরিয়ে আসে। ভাবান্তর হয় না রোজার, নিজের কার্যে সফল হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ কামড়ের দাগগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেছে ফরসা মুখশ্রীতে। ব্যর্থ রোজা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়লো একসময়।
————————————————————–
চলবে…
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬
ভালোবাসাকে ভালো রাখতে চাওয়ার যে প্রবণতা সেটাই হলো আসল ‘ভালোবাসা।’ রোজা যদি নিজে থেকে ভালো করে বুঝিয়ে আদ্রিশকে বলতো তাহলে হয়তো আদ্রিশ ওকে মুক্তি দিয়েই দিতো। ওর কাছে সবার আগে প্রিয় মানুষটির ভালো থাকাটা নির্ভর করে। আদ্রিশ জানতো, এত সহজে রোজার মনে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব নয়। তবুও সময় দিয়েছিলো, পাশাপাশি নিজে যতটা পারে রোজার খেয়াল রেখেছে। কিন্তু আজ যখন রোজা আদ্রিশের ভালোবাসাকে অপমান করেছে, ওর টুকরো টুকরো অনুভূতিকে ছোট করেছে তখন আর নিজেকে সামলাতে পারে নি৷ বেদনার্থ হৃদয়ে যখন বারান্দার জানালাটার কাচের টুকরো ওর হাতে ঢুকে কেটে গিয়েছিল, বেধড়ক শব্দে ঘুম থেকে জেগে গিয়েছিল রোজা। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ব্যলকনিতে ছুটে আসে রোজা৷ তখনি পাশের ব্যলকনিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সাক্ষী হয় সে। রক্তাক্ত হাতটির দিকে তাকিয়ে আঁৎকে ওঠে। আদ্রিশ তখনো নির্বিকার, রক্ত চুইয়ে পড়ছিল। রোজার কাছে অভিনয়ই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু ও ভুল ছিল। যখনি আসল ঘটনা ধরতে পারলো তখনি ছুটে গিয়েছিল আদ্রিশের ঘরে নিজে থেকে, প্রথমবারের মতো। যদিও খানিক আগের ঘটনা ওর মস্তিষ্কে ছিল, কিন্তু লোকটার বিপদে এগিয়ে যাওয়াটাই বেশি প্রয়োজন বলে মনে হলো ওর। একগাদা কথা শুনিয়ে আদ্রিশের হাতে ব্যান্ডেজও করে দিয়েছে রোজা। আদ্রিশ দ্বিরুক্তি করেনি, একটা শব্দব্যয় করে নি৷ ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুধু কম্পিত কন্ঠে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসোনি রোজানু!’
রোজার পা আটকে এসেছিল। মাথা নাড়িয়ে শুধু বলল, ‘ভালোবাসি নি।’
আদ্রিশের গম্ভীর কন্ঠ, ‘তবে এলে কেন?’
রোজা তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘আমি তো আপনাদের মতো নির্দয় নই। যাদের বাড়িতে থাকছি, পড়ছি, অন্ন ধ্বংস করছি তাঁদের বিপদে এগিয়ে আসবো না এতোটাও অকৃতজ্ঞ মনে করবেন না।’
আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘সবার প্রতি এত কৃতজ্ঞতা তোমার? আমার প্রতিও?’
‘না। বিবেচনাবোধ থেকেই ছুটে এসেছি। অন্যকিছু ভেবে নিবেন না।’
আদ্রিশ হেসে ওঠল, ‘তোমার কাছে আমার অপরাধটা ঠিক কী, জানা নেই৷ আমার জানামতে, সজ্ঞানে তোমার সাথে কোনো অন্যায় করি নি আমি। জানি না কে তোমাকে কি বলে কান ভাঙানি দিয়েছে। এতদিন আমাদের বাড়িতে থেকেও যখন আমার প্রতি সামান্য বিশ্বাস রাখতে পারলে না সেখানে ‘ভালোবাসা’ শব্দটিই তো বেমানান রোজানু।’
তারপর আদ্রিশ একটু থেমে হাত থেকে ব্যান্ডেজটা খুলে ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। রোজাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলল, ‘কখনো আসবে না আমার কাছে। আমি তোমাকে ভুলতে চাই।’
প্রায় সবার জীবনেই কোনো না কোনো সময় ভালোবাসা এসে উঁকি দেয়। ভালোবাসার অনুভূতি চিরন্তন। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভালোবাসা শব্দটির অনুভূতি একইরকম হয়। হঠাৎ হঠাৎ মনে জেগে ওঠা এক টুকরো সুখানুভূতি, আনন্দ, অস্থিরতা। সময়ে-অসময়ে, রাত-বিরেতে প্রিয় মানুষটির কথা মনে পড়লেই নিজের অজান্তেই মুখবিবরে ছলকে ওঠে একরাশ রক্তিম আভা। লজ্জা, ভয়, আনন্দ আর সুখ নিয়েই তো অনুভূতি। আর অনুভূতিরা যেখানে প্রগাঢ় হয় সেখানেই তো জন্ম নেয় ভালোবাসা নামক চার অক্ষরের একটি অনুভূতি। প্রেম হয়ে যায় মনের অগোচরে। রাগ-ঘৃণা, লজ্জা-অপমান থেকে প্রেমের অনুভূতি সজাগ হয়। প্রেমে সুখের সাথে সাথে বেদনাও থেকে যায়। আদ্রিশের ঘর থেকে ফিরে আসার পর বুকের মধ্যে চিনচিনে এক ধরণের ব্যথা অনুভূত হচ্ছিলো রোজার। সেটা কী বুঝতে পারছে না।
আদ্রিশের প্রতিটি কথার গভীরে গিয়ে ভেবেছে রোজা। আদ্রিশ একটু ডেস্পারেট। কিন্তু একজন বিচক্ষণ ছেলে। সে নিজের ফুফুর কাছে গিয়ে রোজার নামে উলটাপালটা কথা বলেছে এটা অবাস্তব মনে হলো রোজার। তাহলে সত্যিই কী ও আদ্রিশকে ভুল ভেবেছে? অজান্তেই মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো রোজার।
————————————————————-
ঘটনাক্রমে সেদিন রাতে ইশা আর নেহাকে সুহানা শেখ নিজের সাথে নিয়ে দোতলার অন্য আরেকটি কামরাতে ঘুমান। ফিহা থাকে রোজার সঙ্গে। কিন্তু সে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় নি রোজার মনোভাব। রাতে অবশ্য খেয়াল করেছিল রোজার মন খারাপ, জিজ্ঞেস করলেও বেশিকিছু উত্তর দেয়নি রোজা। ফিহাও সেজন্য আর ওকে ঘাঁটায় নি। এনগেজমেন্টের আয়োজনে অধিক কাজ করতে হয়েছে ওকে। সেজন্য বিছানায় শুয়ে পরা মাত্রই গভীর ঘুমে ডুবে যায়।
রোজা এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল ভোরের আলো ফোটামাত্রই। বাড়ির সবাই ঘুম থেকে জাগার আগেই। যাওয়ার আগে উৎস নিজের সাধ্যমতো বোনকে বুঝিয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। আদ্রিশের সাথে অনাকাঙ্খিত ওই ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর রোজা ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিল। তাই আর এ বাড়িতে একটি মুহূর্ত কাটাতে ওর মন সায় দেয় নি। পাছে লোকটা যদি বাড়িতে অশান্তি করে বসে, তাহলে তো রোজা কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। তাই বাড়ির সদস্যরা ঘুমে বিভোর থাকা অবস্থায়ই সে উৎসকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায়। রোজা যে ভোরবেলা কখন বেরিয়ে গেল একটুও টের পায় নি ফিহা! সকালবেলা যখন নাস্তার টেবিলে কেউ রোজাকে দেখতে পেল না, সবাই খুব অবাক হলো। ঘরদোর, ছাদ, বাগান, বাড়ির বাইরে সব জায়গায় খোঁজ করেও রোজাকে পেলো না। ঘরে গিয়ে ফিহাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে নেহা জোর গলায় ডেকে ওঠলো ও। ঘুমঘুমু চোখ মেলতেই রোজার নিঁখোজ হওয়ার খবরটি শুনলো ও। পরক্ষণেই নিদ্রা কেটে গেল ওর। নিজেদের ঘরটিতে চোখ বুলিয়ে রোজার জিনিসপত্র খুঁজলো, কিন্তু বইপত্র-পোশাক সবকিছুই উধাও দেখে সবাই ভড়কে গেল। ফিহা উৎকন্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বাগানে, ছাদে দেখেছ? ভালো করে দেখেছ তো?’
নেহা হতাশ কন্ঠে বলল, ‘সব জায়গায় দেখেছি, কোথাও নেই।’
ফিহা চিন্তিতমুখে বলল, ‘বলো কী? গেল কোথায় তাহলে?’
নেহার হাত-পা টেনশনে কাঁপছে, ‘আমার কিন্তু অনেক চিন্তা হচ্ছে।’
ফিহা জবাবে বলল, ‘কাল আমরা কত আনন্দ করলাম, রোজা কিন্তু এটেন্ডই করেনি। ইনফেক্ট নিচে অবধি নামে নি। রাতে যখন ঘুমাতে এলাম তখন ওকে মনমরা দেখাচ্ছিলো। কারণ জিজ্ঞেস করার পরেও কিছু বলে নি। অগত্যা হাল ছেড়ে দিই। আমি অনেক ক্লান্ত থাকায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছি। রোজা আমার পাশেই ঘুমিয়েছিল। কিন্তু কখন যে ওঠে বেরিয়ে গেল আমিতো টেরই পাই নি।’
ইশা গালে হাত দিয়ে বলল, ‘কোথায় খুঁজবো ওকে?’
ফিহা জিজ্ঞেস করল, ‘ফোন করেছিলে?’
‘ফোন সুইচড অফ। আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘উৎস ভাইয়াকে জানিয়েছো? ভাইয়া কিছু তো করতে পারতো।’
নেহা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ভাইয়া বাসায় নেই, জানেও না৷ বোধহয় জগিং করতে বেরিয়েছে। ফোন নট রিচেবল।’
এমন সময় সুহানা শেখ ঘরে ঢুকলেন। ওদের শেষ কথাবার্তা কিছু তাঁর কানে যেতেই ফোড়ন কেটে তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘গিয়ে দেখ কোনো ছেলেপুলের সঙ্গে পালিয়ে গেল নাকি! গ্রামের মেয়েরা হঠাৎ শহরে আসলে যা হয় আরকি! চাকচিক্যময় শহরে বাস করতে করতে ওদের নজরে পড়ে বড়লোকের ছেলেপেলে। আর একটু রূপ-যৌবন থাকলে তো কথাই নেই৷ সবাইকে রুপে মুগ্ধ করে কথার জাদুতে মন গলিয়ে ফেলে। ওই মেয়ের তো পরীর রুপ। চরিত্র কেমন হবে তা আন্দাজ করাই যায়।’
ফুফুর মুখে রোজার সম্বন্ধে কটু কথা শুনে ফিহার মাথায় রক্ত টগবগ করতে লাগলো। চড়া গলায় বলে ওঠলো, ‘হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনই সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে যেও না ফুপি। রোজার মতো ভালো, ভদ্র মেয়েকে নিয়ে এসব লাগামহীন কথা বললে আমি কিন্তু চুপ করে থাকব না। তোমার কিন্তু সেসব শুনতে ভালো লাগবে না। ঠোঁটকাঁটা হিসেবে আমার কিন্তু বদনামই আছে। তাছাড়া গ্রামের মেয়েদের নিয়ে যে পিএইচডি করে বসে আছো, তা তুমি শহরে বসবাস করেও এমন নিচু চিন্তাধারা কীভাবে নিজের মনের মধ্যে পোষণ করো?’
ফিহা ছোটবেলা থেকেই একটু প্রতিবাদী মনোভাব পোষণ করে। সেজন্য অন্যদের যেমন তিনি খুব ভালোবাসেন, ঠিক ততোটাই অপছন্দ করেন ফিহাকে। মেয়েদের এতো ঠোঁটকাঁটা হলে চলে নাকি? বেয়াদব, অসভ্য কোথাকার। সুহানা শেখ গর্জে ওঠে বললেন, ‘ভুলে যাস না, সম্পর্কে আমি তোর গুরুজন। তোর ফুফু হই। যার জন্য এত সাফাই গাইছিস গিয়ে দেখ কোন কীর্তি ঘটিয়ে বসে আছে।’
ফিহা নিজের রাগ সামলালো। এখন মাথা গরম করা ঠিক হবে না। আগে রোজার খোঁজ চাই। নিজের চোখদুটো বন্ধ করে বড় করে দম নিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘সে তো দেখবোই। তবে তুমি এত ভবিষ্যৎ বাণী করছো কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। তোমার কী পছন্দ নয় রোজাকে?’
সুহানা শেখ কথাটা অতি সন্তপর্ণে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার পছন্দে-অপছন্দে কার কী এসে যায়? তবে তোর বোনটাকে আমার তেমন সুবিধের মনে হয় নি। লোভ…’
ইশা মায়ের কথাবার্তায় বেশ লজ্জিত বোধ করলো। রোজা যে খুব ভালো একটা মেয়ে বোঝাই যায়। মায়ের কাছ থেকে এরকম লাগামহীন কটুক্তি সে আশা করে নি। একেতো বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির, তার মধ্যে সুহানা শেখের অবান্তর কথায় সে বিরক্ত। মায়ের দিকে কড়া, সূক্ষ্ম চাহনি নিক্ষেপ করলো ইশা। সুহানা শেখ চুপ হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। রোষাগ্নি দৃষ্টিতে ফিহাকে একপলক দেখে নিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে নেহার মাথা কাজ করছে না। তার মধ্যে ফিহা আর ফুফুর ঝামেলাটা অসহ্য লাগছে৷ ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে সে বলল, ‘ফিহা দয়া করে তোরা চুপ কর। বাড়ি থেকে একটা মেয়ে উধাও আর তোরা এখানে কথা কাটাকাটি করছিস? এবার খালামণিকে কি জবাব দেব? নিচে তো আম্মু রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।’
ফিহা বিষন্ন মুখে বলল, ‘চলো নিচে যাই।’
হঠাৎই ইশা বলে ওঠলো, ‘আদ্রিশ ভাইয়াকে একবার জানালে হতো না? খোঁজটোজ নিয়ে দেখতো?’
ফিহা চট করে ওর দিকে ফিরে তাকালো। বলল, ‘ঠিক বলেছিস তো৷ উৎস ভাইয়া কখন ফিরবে কে জানে। আদ্রিশ ভাইয়াকেই দেখছি জানাতে হবে ব্যাপারটা। ভাইয়া কোথায়?’
‘এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।’
ফিহা গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে ঘর থেকে এক ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আমি আদ্রিশ ভাইয়াকে বলে কিছু একটা করছি। তোমরা নিচে যাও।’
————————————————–
চলবে…