#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৯
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হয়ে গেলো সেটা বুঝতে পারলো না রোজা। কিন্তু উক্ত কথাটি শুনে সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই আদ্রিশকে দেখতে পেয়ে থমকে গেলো সে। সুলতানা রোজার দৃষ্টি অনুসরণ করে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। তাঁর চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম যেন। তিনি হতভম্ব হয়ে আমতাআমতা করতে লাগলেন। গ্রামের রক্ষণশীল পরিবারের আটপৌড়ে বউ তিনি। আচার-আচরণের দিক দিয়ে খানিকটা কঠোর হলেও সেটা শুধু নিজের পরিবার আর মেয়ের জন্য। অন্যকেউ কি করেছে, তাঁর কতটুকু দোষ সেটা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। সবসময় নিজের মানুষগুলোর দোষ খুঁজে সংশোধন করতেই শিক্ষা দিয়েছেন বাড়ির মেয়ে-বউদের। সুলতানা খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। নিজের মেয়েকে শাসন করা প্রয়োজন বলেই প্রশ্নটা করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে এসে প্রেম-ভালোবাসা সংক্রান্ত একটি বিষয়ে আদ্রিশ এভাবে হস্তক্ষেপ করবে ভাবেননি তিনি। খুব ভালোভাবেই তিনি জানেন যে আদ্রিশ সবার মতো নয়। একটু অন্যরকম, ওর মধ্যে প্যাঁচগোচ নেই। সোজা কথা সরাসরি বলে দিতেই সে পছন্দ করে। রোজা মায়ের ভাবমূর্তি লক্ষ্য করছে কুটিল চোখে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোজা খুব ক্ষুন্ন হলো। রাগ হলো আদ্রিশের ওপর। কি দরকার ছিল, সরাসরি এ কথাটা সুলতানাকে বলে দেওয়া? রোজা না হয় বুঝিয়ে বলতো সবকিছু! এর আগেই লোকটা ঝামেলা পাকিয়ে বসলো। এদিকে আদ্রিশের জবাবেই সুলতানা তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে তার ফর্সা মুখখানা ঢাকা পড়লো। মায়ের গম্ভীর চেহারা দেখে রোজা বেশ আন্দাজ করতে পারছে সুলতানা মোটেও খুশি হয়নি এতে। দ্রুতপদে সেখান হতে চলে যেতেই রোজাও গেল মাকে সামলাতে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রোজা মিনমিন করে বলল, ‘আমার কথাটা একবার শুনবে প্লিজ? একবার…’
সুলতানা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘তোর মুখ থেকে একটা কথাও শুনতে চাইনা আমি। আগেই আন্দাজ করেছিলাম তোদের মধ্যে কিছু আছে। তুই আমার মেয়ে হয়ে এসবে জড়াতে পারলি?’
রোজা মাকে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি ভুল ভাবছো আম্মু।’
‘ওহ আমি ভুল ভাবছি? তুই বলতে চাইছিস ওর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই? ছেলেটার বলা কথাটা মিথ্যা?’
রোজা নিভে যাওয়া গলায় বলল, ‘আমি সেটা বলছি না। ও ওনি আমাকে পছন্দ করেন সেটা একান্তই ওনার ব্যাপার। আমার খেয়াল রাখেন নিজের ইচ্ছেতেই, আমার সব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেন নিজে থেকেই। আমি ওনাকে কখনো বলিনি যে সে আমাকে ভালো…’
সুলতানা রাগ সামলে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে কাল রাতে বাগানে ওর সাথে কি করছিলি? সকালে ওর ঘরে কি করছিলি? কাল রাতে এত ঘনিষ্ঠভাবে ছিলি যে…’
রোজা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এসব কথা সুলতানা জানলো কীভাবে? কোনো অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে একঘরে দেখাসাক্ষাৎ করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তিনি। কাল রাতের ঘটনা আর সকালে যে আদ্রিশের ঘরে কফি নিয়ে গিয়েছিল সেটা তো কেউ জানে না? তাহলে? রোজা অসহায় ভঙ্গিতে মা’কে যা কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করলো না কেন, সুলতানা ওর একটা কথাও বিশ্বাস করলেন না। রোজার জন্য নিজের বোনের সংসারে অশান্তি হতে দেবেন না। ভীষণ রাগারাগি করে রোজাকে অনেক কথা শোনালেন এবং রুম থেকে বের করে দিলেন। তখন রোজার মনে বেজায় রাগ৷ কারণ সুলতানা কখনো ওর সাথে এত রুক্ষ হয়ে কথা বলে নি। ওর সব রাগ-আক্রোশ গিয়ে পড়লো আদ্রিশের ওপর। আশপাশ একবার দেখে পা বাড়ালো আদ্রিশের ঘরের দিকে। আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে ও। সবসময় বাড়াবাড়ি করা? জানে না যে, রোজার মা কতটা রক্ষণশীল? কিন্তু ঘরে আদ্রিশকে পাওয়া গেল না। বিরক্ত রোজা নিচে এসে খুঁজলো, সেখানেও নেই। বাড়ির লোকজন যার যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। দারোয়ানের কাছ থেকে রোজা জানতে পারলো আদ্রিশ বাইরে বেরোয়নি। তার মানে বাড়িতেই কোথাও আছে। মানে ছাদে! রোজা দ্রুতপায়ে ছাদে পৌঁছালো। বেহায়া লোকটা ইটের ওপর পা তুলে বসে আছে৷ আকাশে ভেসে থাকা শুক্লাদশীর চাঁদ আর ঝিমতে থাকা তারাদের ভিড়ে চারপাশটা মোহময় হয়ে আছে৷ সেই মায়াবী আলোতে দৃষ্টি বিনিময় হলো দু’জনার। এক পলকের দেখায়ই রোজা বুঝে গেল মানুষটার জ্বর এখনো কমেনি, কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে। তবুও একটু আগের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়তেই ধুপধাপ পা ফেলে আদ্রিশের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদ্রিশ নিশ্চুপ থেকে রোজার কর্মকাণ্ড দেখায় মগ্ন হতেই রোজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘জ্বর কমেনি আপনার? ঔষধ খাননি?’
আদ্রিশ জবাবে বলে, ‘তোমাকে দেখলেই জ্বর বেড়ে যায়।’
অবান্তর কথায় বিরক্ত হয়ে রোজা সোজাসুজি প্রশ্ন করল, ‘আপনি মাকে এটা কী বললেন? কোনো ধারণা আছে আপনার এতে মা কতটা রেগেছে? মায়ের সামনে নিজেকে বেহায়া প্রমাণ না করলে কি হতো না?’
আদ্রিশ কথাটা আমলে নিয়েছে এমন ভাব করেই বলল, ‘শ্বাশুড়ির কাছে বেহায়া প্রমাণিত হলেই বা কী আসে- যায়?’
রোজা ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘আসে-যায়। মা কতটা ফালতু ভাববে জানেন আপনি? লাজ-লজ্জাহীন একটা ছেলে আপনি। ওফ…’
আদ্রিশ হাসলো। আপাদমস্তক রোজাকে পরখ করে ঘোর লাগা গলায় বলল, ‘হাবুডুবু খাচ্ছো তুমি।’
রোজা আশেপাশে তাকিয়ে তেমন কিছু বুঝতে না পেরে কড়া গলায় বলল, ‘মানে? জ্বর হয়ে মাথা গেলো নাকি আপনার? আমি কোথায় হাবুডুবু খাচ্ছি?’
আদ্রিশ গাঢ় শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো।’
এতক্ষণে ওর কথার মানে বুঝতে পারলো রোজা। আর তাতেই ওর রাগ হলো। লোকটাকে শাঁসাতে এসে নিজেই ফেঁসে গেল সে। সাজানো কথাগুলো তালগোল পাকিয়ে ফেললো। রাগী স্বরে বলল, ‘মাথা খারাপ হলে সবারই এমন মনে হয়। অবশ্য এটা দোষের কিছু নয়। কারণ, আমি তো আগে থেকেই জানি আপনার মাথায় যে গণ্ডগোল আছে।’
আদ্রিশ হাসলো। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘সেটা তো তোমাকে দেখার পর থেকেই৷ এইযে, আমার ভীষণ চু-মু খেতে ইচ্ছে করছে সেটা তুমি সামনে আছো বলেই। আচ্ছা, তুমি এত বোকা কেন মেয়ে? আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো আর ভাবছো, আমি সেটা বুঝতে পারবো না? নো নো, নো ওয়ে! এটা ভাবা নিছকই তোমার ভুল।’
রোজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই আদ্রিশ ওর মুখে আঙুল দিয়ে বুঝালো ও চুপ থাকবে। অসুস্থ লোকটাকে কথা শোনানোর ইচ্ছে হলো না বলে রোজা কপট রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই আদ্রিশ পেছন থেকে বলল, ‘তুমি এত অদ্ভুত কেন রমণী? আমার মতো ছেলেকে কেউ এভাবে কষ্ট দেয়? ইগনোর করে? আমি যে তোমাকে ভালোবাসি কেন বুঝো না?’
আদ্রিশের কন্ঠে কি যেন একটা ছিল, রোজা পুরোপুরি থেমে গেলো। বুকের মধ্যে তীব্র একটা যন্ত্রণা শুরু হলো তখনই। আসলেই তো, কেন সে এত ইগনোর করে লোকটাকে? সে নিজেই তো লোকটার প্রেমে পড়ে গেছে। তাহলে? দু-একটা ভালোমন্দ কথা তো বলতেই পারে। ও অন্যরকম এক ঘোরে থেকেই উত্তরে বলল, ‘সবসময় আমরা যা চাই, তা পাই না। তাই যেটা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই সেদিকে হাত বাড়িয়ে কী লাভ বলুন তো? তাতে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আরকিছুই নেই। তাই বোঝার ক্ষমতাটার চর্চা করা ইদানীং বন্ধ করে দিয়েছি।’
আদ্রিশ জ্বর নিয়েই দু-পা এগিয়ে এসে বলল, ‘তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমি মন পড়তে পারি। এত ভালোবাসো, তবুও কেন অস্বীকার করো? কেন এত কষ্ট পাও? কেন বুঝতে চাও না তোমার কষ্টগুলো তীক্ষ্ণ ফলার মতো আমার বুকে আঘাত দেয়? তোমার চোখেরজলের একেকটা ফোঁটা আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়; কেন বুঝো না?’
রোজা শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষটা ওকে এত বুঝে কেন? আদ্রিশ ওর ঘাড়ে চিবুক রাখতেই প্রচন্ড গরম অনুভত হলো রোজার৷ শক্ত কাঠের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে আদ্রিশকে বলল, ‘দেখুন, আপনার আমার পরিবারের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আপনারা যতটা আধুনিক, আমরা ঠিক ততটাই রক্ষণশীল। স্রোতের দু’প্রান্তের কখনো মিল হতে পারে না।’
আদ্রিশ অস্ফুটস্বরে বলল, ‘আমার তো একটাই অভাব, সেটা একমাত্র তোমার ভালোবাসা। আর এই অভাব নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে আমার একটা অপূর্ণ আক্ষেপ থেকে যাবে। একবার বলো না, ভালোবাসি! আমি সব ঠিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।’
রোজার যে কি হলো তখন, সে বুঝে ওঠতেই পারলো না। আদ্রিশের কাকুতিভরা কথাগুলো ওর মনে ঝড় বইয়ে দিচ্ছিলো। দু’ফোটা জল জমেছিল বোধহয় চোখের কোণে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো সেটা। রোজা খুব আস্তে নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতেই ও বলল, ‘ভালোবাসি বললেই তো আর আমরা এক হয়ে যাবো না।’
তারপর! একটা মিনিটের মধ্যে আরও অদ্ভুত এবং ভয়ানক কান্ড ঘটিয়ে বসলো আদ্রিশ। রোজাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর কপালে শক্ত একটা চুমু বসিয়ে ধুপধাপ করে নিচে চলে গেলো। ঠিক তখনি হুঁশ ফিরলো রোজার। যে ব্যাপারটা মিটমাট করার উদ্দেশ্যে ছাদে এসেছিল, এখন ওরই দৌলতে আরও ঘেঁটে গেলো সেটা। আদ্রিশের কথাগুলো ওকে এতটা ঘায়েল করে দিবে জানতো না ও। নিজেকে তো সামলে রেখেছিলই, তাহলে কেন ও দুর্বল হয়ে পড়লো এবং অজান্তেই মনের কথাটা প্রকাশ করে দিলো আদ্রিশের সামনে? কেন?
হৃদপিণ্ড ট্রেনের গতিতে ছুটছে রোজার। মনটা বড্ড অস্থির লাগছে ওর। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিচে নামলো ও। কিন্তু লিভিংরুমে পৌঁছাতেই ও হতভম্ব হয়ে গেলো। সোফায় বসেছিলো আদ্রিশ। ইনায়েত সাহেব, ইমতিয়াজ সাহেব আর আজিজুর রহমান, বাড়ির গিন্নিরা এমনকি রোজার মা-ও ছিল। উৎস, ওর বন্ধুরা, ইশা-ফিহা কেউই বুঝতে পারছিলো না আদ্রিশকে এত উচাটন কেন দেখাচ্ছে। ইনায়েত সাহেবের পাশ থেকে সরে তাঁর পায়ের কাছে বসে আদ্রিশ অনুরোধের সুরে বলছে, ‘রোজাকে আমার চাই আব্বু। ওকে হারালে আমি মরে যাবো দেখো। একমাত্র ওকেই আমি ভালোবাসি। ওকে আমার করে এনে দাও না আব্বু…’
——————————————-
চলবে…
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩০
হৃদপিণ্ড ট্রেনের গতিতে ছুটছে রোজার। মনটা বড্ড অস্থির লাগছে ওর। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিচে নামলো ও। কিন্তু লিভিংরুমে পৌঁছাতেই ও হতভম্ব হয়ে গেলো। সোফায় বসেছিলো আদ্রিশ। ইনায়েত সাহেব, ইমতিয়াজ সাহেব আর আজিজুর রহমান, বাড়ির গিন্নিরা এমনকি রোজার মা-ও ছিল। উৎস, ওর বন্ধুরা, ইশা-ফিহা কেউই বুঝতে পারছিলো না আদ্রিশকে এত উচাটন কেন দেখাচ্ছে। ইনায়েত সাহেবের পাশ থেকে সরে তাঁর পায়ের কাছে বসে আদ্রিশ অনুরোধের সুরে বলে ওঠল, ‘রোজাকে আমার চাই আব্বু। একমাত্র ওকেই আমি ভালোবাসি। রোজাকে হারালে আমি মরে যাবো দেখো। ওকে আমার করে এনে দাও না আব্বু।’
ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে ছেলের মুখে এই কথা শুনে ইনায়েত সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। আদ্রিশ যেন ছোট্ট বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসেছে। তার মুখে এক কথা। ইনায়েত সাহেব হালকা কেশে ইশারায় ওকে চুপ করতে বললেও আদ্রিশ নাছোড়বান্দা। এদিকে মিতালি-নিশিতা দুজনেই শান্ত চোখে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন। রোজার বাবা আজিজুর রহমান কি বলবেন বুঝতে পারছেন না, তার অস্বস্তি হচ্ছে। সুলতানা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন; আদ্রিশ যে এমন কান্ড করবেন তা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেন নি তিনি। রোজা এইসব দেখে একরাশ লজ্জা আর ভয় নিয়ে উপরতলায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে রইলো। এই মুহূর্তে আদ্রিশকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেহায়া লোকের উপাধি দিতে ইচ্ছা করলো ওর। সবার সামনে কীভাবে গড়গড় করে নিজের অনুভূতিটুকু প্রকাশ করে রোজাকে চাইলো আদ্রিশ? যেন ওদের মাঝে কত বছরের সম্পর্ক, কত বছরের প্রেম। রোজা একরাশ হতাশা আর অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করছে সবকিছু সমাধান হওয়ার আশায়। বাবার সামনে কীভাবে মুখ দেখাবে ও? আর মা? সুলতানা তো ওকেই ভুল বুঝবে। কীভাবে যে কি হবে ভাবতেই ওর হৃদযন্ত্রে হালকা কাঁপুনি অনুভব করলো। আচ্ছা, ভালোবাসার অনুভূতিগুলো ঠিক কেমন হয়? রোজা এই অভাবনীয় মুহূর্তে এসে মনোযোগ দিয়ে ভাবনার গহীনে পা রাখলো। দরজা জানালা বন্ধ করে একলা ঘরে বসে বেহায়া লোকটার কথা ভাবা? চুপিচুপি বালিশে মুখ গুজে তার কথা ভেবে অস্থির হওয়া? হাজারো লোকের ভিতরে শুধু বেহায়া মানুষটার কন্ঠস্বর শুনতে চাওয়াটাকে কি বলে আখ্যায়িত করবে? সকাল, দুপুর, রাতে এই মানুষটাকে নিয়ে কল্পনায় ডুবে থাকার মুহূর্তগুলোকে কি ভালোবাসা বলা যায়? আর এই সুন্দর মূহূর্তগুলোর সমাপ্তি ঘটেনা বলেই কি অনুভূতিগুলোও রয়ে যায় অসমাপ্ত? আর এই অসমাপ্ত অনুভূতিগুলোই বোধহয় ভালোবাসা। সত্যি, প্রেম নিরবে এসে কখন যে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো ভালোবাসার অনুভূতি; সেটা রোজা নিজেই টেরই পেলো না।
লিভিংরুমে তখনো আদ্রিশের অদ্ভুত ও অসংলগ্ন কথা চলতেই আছে। সবাই থমথম ভঙ্গিতে বসে আছে। ছেলের কথাগুলো শুনে ইনায়েত সাহেব পরিস্থিতি সামলাতে বললেন, ‘ঘরে যাও আদ্রিশ। এখন এসব কথা বলার সময় নয়।’
আদ্রিশ বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক কন্ঠে বলল, ‘তুমি রোজাকে পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করবে না?’
ইনায়েত সাহেব বোকাবোকা দৃষ্টিতে রোজার বাবার দিকে তাকালেন। ছেলের কান্ডে লজ্জায় তাঁর ইচ্ছা করছে কোনো গর্তে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে, কিন্তু তিনি বাড়ির কর্তা। হুট করে এখান থেকে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। এই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, পরিবারের কর্তা হওয়ার কত যন্ত্রণা। তাঁর নিজের ছেলে তাঁকে এমন লজ্জায় ফেলছে। আজিজুর সাহেব কি না কি ভাবছেন কে জানে? আদ্রিশের প্রশ্নে তিনি হালকা কেশে উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ করবো। কেন করবো না, অবশ্যই করবো। রোজা তো অনেক ভালো আর মিষ্টি মেয়ে।’
বাবার কথায় ভরসা পেলো আদ্রিশ। একেএকে মিতালি, নিশিতা আর ইমতিয়াজ সাহেবকে একই প্রশ্ন করলো। সকলেই পজেটিভ রেসপন্স করলো। আর বাড়ির ছোটরা তো আগে থেকেই রাজি। অতঃপর আদ্রিশ আজিজুর সাহেবের পাশে বসলেন। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে সরাসরি অনুরোধ করল, ‘আপনার মেয়েকে আমাকে দিয়ে দিন না আংকেল। আই প্রমিজ ওকে আমি খুব ভালোবাসবো, শুধু আপনি ওকে আমাকে দিয়ে দিন।’
বলেই আজিজুর সাহেবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কিছুটা সময় থেমে চেহারায় কাঠিন্যতা মিশিয়ে বলল, ‘আর আপনি না দিলেও সমস্যা নেই। আমি নিজেই ওকে নিয়ে নিতে পারবো।’
আজিজুর সাহেব এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘তোমার কি মনে হয়? আমি না দিলে আমার মেয়েকে তুমি নিতে পারবে? সবকিছু এতই সহজ? যে চাইলে আর পেয়ে গেলে?’
আদ্রিশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘অবশ্যই। কারণ ও আমাকে ভালোবাসে। সবচেয়ে বড় কথা, আমি ওকে ভালোবাসি।’
‘তুমি ভালোবাসো বলেই আমার মেয়ে তোমার হয়ে যাবে? আমার মেয়েকে আমিও ভালোবাসি, ওর মা ভালোবাসে। এত বছরের ভালোবাসার মানুষগুলোকে ছেড়ে ও তোমার সাথে যাবে এই ক’দিনের ভালোবাসার জন্য? ব্যাপারটা কেমন না?’
আজিজুর সাহেবের কন্ঠে রাগ নেই, তেজ নেই। খুবই শান্তভাবে, শালীনভাবে তিনি নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করছেন। তিনি যেন আদ্রিশের কথাগুলোয় বেশ মজা পাচ্ছেন। তাঁর কথা শুনে আদ্রিশ কপাল কুঁচকে বলল, ‘তার মানে আপনি আপনার মেয়েকে দেবেন না?’
আজিজুর সাহেব ব্যগ্র কন্ঠে বললেন, ‘আমি তো একবারও সেকথা বলি নি।’
আদ্রিশ অপলক দৃষ্টিতে তাকালো, ‘মানে? কি বোঝাতে চাইছেন আপনি আংকেল? দেখুন, আমার পরিবারের সবাই রাজি। এখন আপনারা মতামত দিলেই শুধু চলবে। আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি বলেই এসব আপনাকে বললাম। এখন আপনি ভেবে দেখুন কি করবেন।’
‘আমি ভাবলেই তো আর চলবে না। মেয়ে তো আমার একার না। ওর মা আছে, চাচা-চাচী আছে। তাছাড়া মেয়ের নিজস্ব মতামত থাকতে পারে। দেখা গেলো সবাই রাজি, কিন্তু আমার মেয়ে হুট করে ঠিক করলো তোমাকে বিয়ে করবে না। আমার মনে একটা প্রশ্ন বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে, সেই প্রশ্নের মানেটা আমাকে বোঝাতে পারো তাহলে আমি বিয়েতে রাজি। তারপর অন্যান্য সদস্যদেরকে তুমি যদি সবাইকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারো তাহলে আমি অবশ্যই তোমার সাথে রোজার বিয়ের অনুমতি দেব। নয়তো না। এখন আমি কি প্রশ্নটা তোমাকে করতে পারি?
আদ্রিশ রোজার বাবার কথা শুনে উৎফুল্ল হলো। তার মানে আজিজুর সাহেব নব্বই ভাগ মত দিয়েই ফেলেছেন। কিন্তু কোন প্রশ্ন করবেন এটা জানার কৌতূহল জাগতেই ও মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল, ‘অবশ্যই। বিয়ের মতো একটা রাজকার্য করতে গেলে এক-আধটু প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হয়।’
আজিজুর সাহেব হাসলেন। ওদিকে বাড়ির সবাই বিমূঢ় চেহারা নিয়ে দু’জনের কার্যকলাপ দেখছে। যেন কোনো সিনেমার শেষ অংশে টানটান উত্তেজনা রাখতে পরিচালক ভিন্ন কিছু ভেবে রেখেছে। মেয়ের বাবা রাজি, কিন্তু তার নাকি আবার প্রশ্ন আছে। সবার ভাবনার মাঝেই আজিজুর সাহেব আদ্রিশকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার বয়স কত?’
আদ্রিশ হকচকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো, ‘আঠাশ।’
আজিজুর সাহেব ঠোঁটে চওড়া হাসি ঝুলিয়ে বললেন, ‘তার মানে, তোমার বিয়ের বয়স আরো বছর সাতেক আগেই পেরিয়ে গেছে। যাইহোক, এটা কোনো সমস্যা না। আমি মূলকথায় আসি, তোমার আচার-আচরণে কেন মনে হচ্ছে তুমি এখনো বারো-তেরো বছরের ছোট্ট এক কিশোর? যে কি-না চকলেট খাবার বায়নার মতো বাবার কাছে বউয়ের আবদার করছে?’
আদ্রিশ কথার মর্মোদঘাটন করতে পারলো। আসলেই, ওর আচরণ একটু অস্বাভাবিক। সচরাচর এমন ব্যবহার সে করেই না বলতে গেলে৷ কিন্তু আজ ওর চিন্তাভাবনা সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আদ্রিশ নিচু স্বরে বলল, ‘জ্বর তো, তাই এমন ব্যবহার আসছে। তবে চিন্তা করবেন না, রোজা আমার সাথে থাকলে এসব জ্বরটর সেরে যাবে। ওর কাছে ‘ভালোবাসা’ নামক ঔষধ আছে।’
ঘরের সবাই নিঃশব্দে হেসে ফেললো। আজিজুর রহমান অট্টহাসিতে মেতে ওঠে ইনায়েত সাহেবের দিকে তাকালেন। নিজের হাসি সামলে তিনি বললেন, ‘আপনার ছেলে খুবই বুদ্ধিমান ভাই। এই বুদ্ধিমান ছেলের সাথে অবশ্যই আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি।’
ইনায়েত সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘সত্যি বলছেন ভাই? কোনো খোঁজখবর নিবেন না আমাদের ছেলের? তাছাড়া আপনার বড় ভাইয়ের মতামতের ও তো একটা ব্যাপার আছে।’
আজিজুর সাহেব আলতো হেসে বললেন, ‘আপনি জানেন না আপনার এই ছেলে কি কি করেছে।’
ঘরে সবাই প্রায় একসাথেই চমকালো, ‘মানে?’
আজিজুর সাহেব বললেন, ‘রোজা গ্রামে যাওয়ার পরপরই কোনো একদিন আপনার ছেলে বড় ভাইয়ের কাছে ফোন করে নিজের পছন্দের কথা সবকিছু খুলে বলে। রোজাকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে একটা সমস্যা হয়েছিল, তখনি জানতে পারে বড়ভাই। অবশ্য মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জন্য ক্ষমাও চায়। পরে আপনার ছেলের সম্বন্ধে খোঁজ নেয় বড়ভাই। ওর ব্যবহার আর কোয়ালিফিকেশন দেখে বড় ভাইয়েরও খুব মনে ধরে। আর বড় ভাইয়ের যেহেতু পছন্দ সেখানে আমার “না” বলার প্রশ্নই আসে না। সেজন্য মেয়ের জন্য আসা সম্বন্ধগুলোতে না করে দেই। সেটা আমি আর বড়ভাই ছাড়া আর কেউই জানে না। এখন যেহেতু ছেলে-মেয়ে দু’জন দু’জনের পছন্দ, সেখানে আমরা আর কি বাঁধা দেব বলুন!’
মতামত পেয়েই আদ্রিশ সেখান থেকে রুমে চলে এলো। মনে হচ্ছে বুক থেকে ভারী পাথরটা নেমে গেলো। ইশ, রোজাকে যদি নিজে এই খবরটা দিতে পারতো তাহলে সবচেয়ে বেশি শান্তি লাগতো। কিন্তু অহংকারী রোজা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। ওদিকে, এই ঘটনা শুনে সবাই যতটা না অবাক তারচেয়ে বেশি হতভম্ব হলেন সুলতানা। তাঁর স্বামী এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনাই করলো না? রোজা তো তাঁরই মেয়ে। এতক্ষণ যাবৎ তিনি পুরো ব্যাপারটা চুপচাপ করে শুনলেন। রোজা-আদ্রিশের বিয়েতে যে সবাই রাজি এটা পরিষ্কার বুঝে গেলেন তিনি। স্বামী-ভাসুর যেখানে রাজি সেখানে পতিভক্ত সুলতানা কখনোই দ্বি-মত করবে না। পাত্র ভালো, সুদর্শন, ভালো চাকুরি করে, এক্ষেত্রে পাত্রকে সোনার টুকরো বলাই যায়। তার ওপর রোজাকে ভালোবাসে। সচরাচর এমন পাত্র পেলে কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না৷ তবুও মনের দোটানাকে দূর করতে তিনি অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করলেন। তারপর তিনি নিশিতাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপা, আমার মেয়ে যদি তোর বাড়ির পুত্রবধূ হয় তোর সংসারে কোনো ঝামেলা হবে না?’
নিশিতা অবাক গলায় বলে ওঠল, ‘কীসের ঝামেলা?’
‘আমার মেয়ে তো গ্রামে বড় হয়েছে। নেহা-ফিহাদের মতো এত আধুনিক চলাফেরা করে নি। কথাও কম বলে। মোটামুটি কাজটাজ পারলেও এত লোকের কাজকর্ম তো একা সামলাতে পারবে না৷ তোর জা’ যদি এই নিয়ে ঝামেলা করে তাহলে তোর সংসারেও তো অশান্তি নেমে আসবে। তাই না?’
নিশিতা বোনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললেন, ‘মোটেও এমনকিছু হবে না। আমার বড় জা’-য়ের মতো ভালোমানুষ দু’টি তুই কোথাও পাবি না। একমাত্র ছেলের বউকে দিয়ে সে কাজ করাবে নাকি? আর সেই বউ যদি আমাদের রোজা-ই হয় তাহলে তো আরও না। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে ওকে। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, বড়ভাবীর মতো আর কেউ-ই রোজাকে এভাবে আগলে রাখবে না৷ তুই তো দেখেছিস আমার জা’-কে। খারাপ মনে হয়েছে তোর?’
সুলতানা ভেবে দেখলেন নিশিতার কথা যুক্তিযুক্ত। মিতালি খুবই নম্রভাষী মহিলা। রোজার সঙ্গে তার সম্পর্কও বেশ ভালোই। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘নাহ৷ তেমন মনে হয় নি।’
নিশিতা শান্ত গলায় বললেন, ‘তাহলে? তুই আর বিয়েতে অমত করিস না। তাছাড়া আমি তো আছি, রোজাকে দেখে রাখার জন্য। কোনো সমস্যা তৈরি হতেই দেব না। ওর জন্য আমার সংসারে সুখ বৈকি অন্যকিছু আসতেই পারে না। তুই চিন্তা করিস না।’
বোনের কথায় নিশ্চিত হয়ে ভরসা পেলেন সুলতানা। বিয়েতে দ্বি-মত করার সুযোগ থাকলেও শেষপর্যন্ত তিনি সেটা করলেন না। মনের কোণে রাগের স্ফুলিঙ্গটাকে ধামাচাপা দিয়ে তিনি হাসিমুখে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর হওয়ার জন্য দোয়া করলেন।
——————————————-
চলবে…