#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৫
চৌদ্দটা দিন খুব দ্রুতই যেন কেটে গেলো। অবশেষে ঘনিয়ে এলো হলুদের দিন। বিয়ের দিন যত এগুচ্ছে রোজার মনে তত মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আদ্রিশের সাথে ওর বিয়ে, কথাটা ভাবলেই শিহরিত হয় মনপ্রাণ। বারবার শুধু ওর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথাই মনে হয়। ওদের বাড়িতে যাওয়া, থাকা, খাওয়া, ঘুরাঘুরি, কিছু ভুল বোঝাবুঝি, আবার সব ঠিক হয়ে যাওয়া, ওদের বিয়ের কথা হওয়া, আদ্রিশের বাচ্চামো, ওর নিজের বাড়াবাড়ি সবকিছু মিলিয়ে খুব অদ্ভুত এক অনুভূতি। প্রথম দিকে তো ও আদ্রিশকে একপ্রকার সহ্যই করতে পারতো না, ভাবতো লোকটা খুব খারাপ। নিজের কর্তৃত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে ওর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। লোকটা আসলেই ওকে খুব করে চায়। তবে দিনশেষে এসবকিছু পেছনে ফেলে ওই আদ্রিশের বউ হয়ে ওই বাড়িতেই যেতে হচ্ছে ওকে এটা ভেবেই ও নিজের ওপর অবাক হয় আজকাল। সত্যি, নিয়তি খুব অদ্ভুত। ভেবেই আলতো হাসলো রোজা। তপ্ত রোদ্দুরে ঢাকা সোনালী প্রকৃতি। হলদেটে একফালি সূর্যরশ্মি চুইয়ে এসে পড়ছে ওর ঘরের মেঝেতে, বারান্দায়। বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে আসছে মৃদু বাতাস। চকচকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে মোহময় সূর্য। আজ ওর গায়ে হলুদ। সদ্য গোসল সেরে আসা রোজা তার ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছছিলো। তখনি দরজায় টোকা পড়লো। চিন্তাজগত থেকে বেরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোজা গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। দরজার বাইরে রেশমি ফুফু দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে খাবারের ট্রে। সেখানে রোজার পছন্দের সব তরকারি আর পোলাও সাজিয়ে রাখা। রেশমি ফুফু ওকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে বললেন, ‘গোসল সারা হয়েছে? দেখি সর, ঘরের ভেতরে ঢুকতে দে।’
রোজা দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘শেষ। কিন্তু এত খাবার কার জন্য এনেছ? আমার জন্য হলে আগেই বলে দিচ্ছি, আমি এত খাবার খাবো না।’
রেশমি ফুফু জোর গলায় বললেন, ‘তুই খাবি না তোর ঘাড় খাবে। তোর জামাই খাবে।’
রোজা থতমত খেয়ে বলল, ‘জামাই খাবে মানে?’
রেশমি ফুফু বাঁকা হেসে বললেন, ‘তুই আমাকে যতটা বোকা ভাবিস, আমি অতোটাও বোকা না। তুই যদি খাবারগুলো না শেষ করিস তাহলে বাড়ির সবাইকে আমি সেদিন রাতের ঘটনা বলে দেব।’
রোজা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘সেদিন রাতের কথা মানে? কোন রাতের কথা বলছো?’
রেশমি বেগম চোখ ছোট ছোট করে বললেন, ‘তুই আর তোর জামাই যে জানালায় দাঁড়িয়ে প্রেম করছিলি সেই রাতের কথা। তুই কি ভাবিস চোখ থাকতেও আমি অন্ধ? রাহা-রাহী অন্ধ? ওহহো৷’
রোজা বোকার মতো প্রশ্ন করল, ‘তু তুমি কীভাবে জানলে?’
‘রাহা-রাহী বলেছে। ওরা দেখেছে।’
‘কী?’
রেশমি বেগম বিরস কন্ঠে বললেন, ‘তোর এখনো না হওয়া জামাই নাকি জানালা দিয়ে লুকাইয়া লুকাইয়া তোর সাথে দেখা করে। আবার নাকি চু-মুও খাস। এই তোর মাথায় কি আক্কেল-বুদ্ধি নাই? ঘরে দুই-দুইটা উপযুক্ত মাইয়া রাইখা এইসব করস লজ্জা করে নাই? সব শহরের বাতাসে ওড়ায়া দিছস নাকি?’
রোজা হতভম্ব হয়ে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার মানে সেদিন যা কিছু ঘটেছে সবকিছু রাহা-রাহী দেখে নিয়েছে ঘুমের ভান করে? আবার রেশমি ফুফুর কাছে সব উগলেও দিয়েছে? ছিঃ কি বিশ্রি ব্যাপার! মায়ের মতো এই মেয়ে দুইটারও সবদিকে দৃষ্টি থাকে। এই ঘটনা বোধহয় বাড়ির সবাইকে তারা বলেও দিয়েছে। ইশ, লজ্জায় রোজার ইচ্ছে করছিলো মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে পড়তে। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেশমি বেগম গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘খাম্বার মতো দাঁড়ায়া না থাইকা গিয়া বস। আমি নিজ হাতে খাওয়াইয়া দিই। তোর মায়ের হাতে মেলা কাজ। আইজ গায়ে হলুদ, কাল বিয়া। চইলা যাবি শ্বশুরবাড়ি। এর আগে পেটপুরে বাপের বাড়ির ভালোমন্দ খাওন খাইয়া নে। এই তোর শেষ খাওয়া।’
রোজা আৎকে ওঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? আর কখনো খেতে পারবো না নাকি?’
রেশমি বেগম বললেন, ‘পারবি না কেন? এইটা তোর নিজের বাড়ি, তোর অধিকার। আমি বুঝাইতে চাইসি যে, বিয়ার আগে আর পরের খাওনে তো খানিকটা পার্থক্য আছে সেইটা। এখন তুই একলা, তখন হবি দোকলা। বুঝলি?’
রোজা মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম।’
রেশমি বেগম হাতের মুঠো থেকে রোজার ফোনটা বের করে ওর হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘শোন রোজা, আমারে আবার এতোটাও দা-জ্জা-ল-নী মনে করিস না। আমি আসলে দেখতে চাইছিলাম তোর জামাই তোরে কেমন ভালোবাসে, কথা না কইয়া থাকতে পারে কি-না। এইজন্যই তোর সাথে এদ্দিন কথা কইতে দেয়নাই। কিন্তু এই পোলা যে পাগলের মতো বাড়িতে আইসা বইয়া থাকবো ভাবি নাই। সত্যিই তোরে অনেক ভালোবাসে। আর এই ঘটনা কিন্তু বাড়ির কাউরেই আমি বলিনাই। এইটা তোদের স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এইসব দেখা-সাক্ষাৎ করবার আগে আশেপাশে কে আছে না আছে দেইখা নিবি। বুঝলি?’
রেশমি বেগমের কথা আর আদ্রিশের প্রশংসা শুনে রোজার মন ভালো হয়ে গেলো। ও বিছানায় নিজের পাশে রেশমি বেগমকে বসিয়ে বলল, ‘আমাকে খাইয়ে দাও তো ফুপি।’
রেশমি বেগম হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুই সত্যিই ভাগ্যবতী মাইয়া। হীরের টুকরো জামাই পাইছিস একখানা। চেহারাসুরৎ মাশাল্লাহ। তোর সাথে মানাইবে ভালা। নে, এখন খাইয়া নে।’
রোজা হেসে বলল, ‘দাও।’
এদিকে আদ্রিশদের বাড়িতেও বিয়ের আয়োজন চলছে। এত এত মানুষের মাঝে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করাটা বেশ বিরক্তিকর মনে হলো ওর। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই কার্যক্রম সেরে রাত বারোটায় নিজের ঘরে চলে এলো ও। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে রোজাকে ফোন লাগালো। প্রতিবারের মতো এবারেও ভেবেছিল ফোনটা রেশমি ফুফু ধরবে। কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণিত করে এবার ফোন রিসিভ করলো রোজা। ঘুমঘুম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি? এত রাতে? কিছু হয়েছে?’
রোজার কন্ঠ শুনতে পেয়েই আদ্রিশের সব ক্লান্তি নিমিষেই চলে গেলো। তারপর ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘না কিছু হয় নি। এটলিস্ট তুমি ফোনটা ধরলে।’
ওপাশ থেকে রোজা বলল, ‘এখন রাখুন। আমি ঘুমাচ্ছি।’
‘ঘুমাচ্ছো মানে? হলুদের অনুষ্ঠান হয়নি তোমার?’
‘হয়েছে। সন্ধ্যা’তেই শেষ। এটা তো গ্রামাঞ্চল, তাই আব্বুরা বেশি রাত করতে চায়নি। আপনার কি এতক্ষণে শেষ হলো?’
‘হ্যাঁ।’
রোজা ধীরগলায় বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? ঘুমিয়ে পড়ুন, ফোন রাখছি।’
আদ্রিশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘গুড নাইট।’
‘শুভরাত্রি।’
স্বস্তি ও শান্তিপূর্ণ মন নিয়ে দু’জনেই ঘুমাতে গেলো। দু’জনের মধ্যে আর নেই কোনো বাঁধা, এবার শুধু এক হওয়ার পালা। কিছু স্বপ্ন সত্যিই অন্যরকম হয়, রুপকথার মতো। শেষ প্রহরের অস্ত যাওয়া চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দু’জনেই একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন। ভোর থেকেই রোজাদের বাড়িতে হইচই। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। সবাই কাজ আর সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। দুপুরের দিকে রোজাদের বাড়িতে আদ্রিশদের আগমন ঘটলো। সবকিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছিলো আদ্রিশের। নিজেকে বরের পোশাকে আবৃত দেখেও সবকিছুই স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। রোজাদের আশেপাশের প্রতিবেশীদের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে জীবনে প্রথমবারের মতো খানিকটা লজ্জা লাগছিলো ওর। তবে নিমিষেই সেটা কাটিয়ে ওঠতে পেরেছিলো। রোজার বাবা-চাচা সবাইকে তদারকি করতে ব্যস্ত। আপ্যায়নে কোনো ত্রুটিই রাখেনি তারা। নেহা-ফিহা-ইশা রোজার ঘরে বসে মজা আওড়াচ্ছে। উৎস আর তার বন্ধুরা আদ্রিশের সাথে সাথে রইলো। প্রাণোচ্ছল বিয়েবাড়ির আনন্দ নষ্ট করতে হঠাৎ করেই সেখানে আগমন ঘটলো রাফির। সে এতদিন গ্রামে ছিলো না, এইতো কিছুদিন আগে কেউ ওকে মেরে হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলো। তারই চিকিৎসা নিতে এতদিন সদরের হাসপাতালে ভর্তি ছিলো ও। কিন্তু রোজার বিয়ের খবর পেয়ে মাঝপথেই চিকিৎসা থামিয়ে নিজের দলবল নিয়ে হাঙ্গামা করতে ওদের বাড়িতে চলে এসেছে লাঠিসোটা নিয়ে। এই অবস্থা দেখে মুহূর্তেই বিয়েবাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। এদিকে, রাগে রাফির মাথা ফেটে যাচ্ছে। রোজার বিয়ে? আর ও আজকেই জানতে পারলো? ও কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেবে না। রোজা শুধু ওর-ই বউ হবে। তাই বিয়ে বাড়ির যা কিছু সামনে পাচ্ছে সেটার ওপরই ওর দলবল হামলা করছে। কেউ বাঁধা দিতে গিয়েও পারছে না। এদিকে রোজার বাবা-চাচা হতভম্ব। এই মুহূর্তে এসে রাফি যে এরকম কান্ড ঘটাবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি ওরা। উৎস ওর বন্ধুরা রাফিদের আটকাতে গেলে সে ইয়াদের মাথায় আঘাত করে বসে। এতে উৎস ক্ষুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এসব করছো কেন? এটা একটা বিয়ে বাড়ি।’
রাফি রাগী স্বরে বলে, ‘কোনো বিয়াটিয়া হইবে না এখানে। সব বন্ধ।’
‘মানে?’
‘আমি রোজাকে বিয়ে করমু, ওর সাথে অন্য কাউরো বিয়া হইতে পারে না। কিছুতেই না।’
উৎস রেগে বলল, ‘তোমার মতো একটা ফালতু ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দেব ভাবলে কি করে? যাও এখান থেকে।’
রাফি চিৎকার করে বলল, ‘আমি কাউরে পরোয়া করি না। আমি এই বিয়া কিছুতেই হইতে দিমু না।’
এমন সময় আজিজুর রহমান আর তার বড়ভাই সেখানে আসেন। রাফির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে তারা প্রচন্ড রেগে যায়। রোজার বাবা বলেন, ‘মেয়ে আমার, সিদ্ধান্তটাও আমার। তোমার মতো বখাটে ছেলের হাতে আমি কেন, কোনো বাপ-ই মেয়ে তুলে দেবে না। আর তুমি এখানে এসে যেভাবে হামলা করছো তাতে কিন্তু আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।’
রাফি বলে, ‘ডাকুন না তাইলে। আমি কী না করছি নাকি? আপনে জানেন আমার বাপের কত টাকা? আমি যদি কিছু না-ও করি তাইলেও আপনার মাইয়া সারাজীবন আরাম-আয়েশে কাটাইতে পারবো। কিন্তু হেরে আপনে আমার লগে বিয়া দিবেন না। কেন? আমি কি দেখতে অসুন্দর? সেইডাও না। খালি একটু উচ্ছন্নে গেছি। এইজন্য আপনেরা আমার লগে অবিচার করবেন সেইডা হইতে পারে না। আমি এই বিয়া হইতেই দিব না। দেখি কেমনে এই বিয়া দেন।’
পুরো ঘটনাটা দেখে-শুনে আদ্রিশ এবার নিজের রাগ সামলাতে পারলো না। ঘটনাস্থলে গিয়ে পেছন থেকে রাফির কলার চেপে ধরে ওকে একটা থাপ্পড় মারলো। আচমকা থাপ্পড় মারায় রাফির হাতের অস্ত্রশস্ত্র মাটিতে পড়ে গেলো। সেখান থেকে একটা লাঠি তুলে নিয়ে ইচ্ছামতো রাফিকে মারতে লাগলো আদ্রিশ। রাফির সাথে থাকা সাঙ্গপাঙ্গরা আদ্রিশকে দেখেই হতভম্ব। কারণ কয়েকদিন আগেই ওদেরকে বেধড়ক পিটিয়েছে আদ্রিশ, কারণটা ওদের অজানা। ভেবেছিল আদ্রিশ হয়তো পুলিশের লোক, তাই ওর সাথে আর লাগতে যায়নি। সেদিনের কথা মনে পড়লেই আঁৎকে ওঠে ওরা। একজনকে তো থাপ্পড় দিয়ে তিনটে দাঁত ফেলে দিয়েছিল, রাফির হাত ভেঙে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এসব কথা মনে পড়তেই ওরা রাফিকে বাঁচানোর কোনোদিকই খুঁজে পেলো না। আর আদ্রিশের সাথেই রোজার বিয়ে হচ্ছে, যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো রাফি হতবাক হয়ে গেলো। যখন দেখলো রোজার বাড়ির লোকেরা ওকে পুলিশে দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে তখন ও মনে মনে আরও ক্ষেপে গেলো। নিজের শরীরে আরকোনো শক্তি খুঁজে না পেয়ে আদ্রিশকে হুমকি দেওয়া গলায় বলল, ‘এর শেষ আমি দেইখা নিমু। আমার সাথে লাগতে আসলে কি কি হয়, সেইটা তখন বুঝাই দিমু সবাইরে। আপনেরা আইজ যেটা করলেন সেইটা মোটেও ঠিক করেন নাই। হাতে নয় ভাতে মারবো আপনাদের, কইয়া দিয়া গেলাম।’
বলেই পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাফি আর ওর সঙ্গীরা পেছনের জঙ্গলের দিকে ছুটে গেল। ওদেরকে ধরার জন্য গ্রামের কিছু লোকজনও ছুটে গেল। আনন্দঘন পরিবেশটাতে নিমিষেই মন খারাপ ভাব চলে এলো। সেজন্য ইনায়েত সাহেব এবারে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করতে বললেন। রোজা শান্তভাবে আর আদ্রিশ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতেই ‘কবুল’ বলার মাধ্যমে বিয়ে নামক একটি নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো আজীবনের জন্য।
——————————————-
চলবে…
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৬
রাফির করা ঘৃণিত এ কান্ডে গ্রামের লোকেরা বেশ ক্ষেপে গেলো। জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজে রাফি আর ওর সাথীদের বের করা হলো। তারপর সবাই মিলে একচোট মারধর করে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ইভটিজিংসহ আরও নানা অভিযোগ ছিলো ওর বিরুদ্ধে। সবশেষে চেয়ারম্যান বাড়ির বিয়েতে ওর করা অসভ্য কর্মকান্ডটাই যেন ওর জীবনের কাল হলো। আর ইমাদকে ফার্স্ট এইড দেওয়া হলো, বেচারার মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে গেছে। ওর ক্যামেরাটাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাইহোক, এসব ঘটনার ইতি টানা শেষে নির্বিঘ্নে বিয়ের বাকি নিয়মনীতি অনুসরণ করা হলো। এরপর এলো কনে বিদায়ের পালা। রোজাদের গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসতে স্বাভাবিকের চেয়ে আরও কয়েক ঘন্টা লেগে গেল যানজটের কারণে। তার মধ্যে কান্নাকাটি করা ও সারাদিনে পেটে কিছু না পড়ায় গাড়িতেই রোজার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেলো, দু’তিনবার বমিটমিও করলো। পুরো সময়টাতে আদ্রিশ বেদনার্থ নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রোজার হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো, ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো। কিন্তু মারামারির ঘটনাটার জন্য রোজা বেশ বিরক্ত ছিল ওর ওপর। কেন আদ্রিশ এসব ঝামেলায় জড়াতে গেল? অন্য লোকেরা তো ছিল, তাহলে ওকেই কেন বিয়ে করতে এসে বখাটের গায়ে হাত তুলতে হবে? মহা ধুরন্ধর আর রাগী এই পুরুষটির এই দিকটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না রোজা। ওদিকে, আদ্রিশের করুণ চেহারা দেখে ফিহাও গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রোজাকে অসহ্য লাগছিলো ওর। কিন্তু ও অসুস্থ বলে দিরুক্তি করলো না, নিজেই ওকে সামলানোর চেষ্টা করলো। আর ওদের তিনজনের কান্ড দেখে পেছনের সিটে বসা উৎস আর ইশা মিটিমিটি করে হাসতে লাগলো। হাসির শব্দ শুনে ফিহা জ্বলন্ত চোখে তাকালো। একটা ধমক দিয়ে ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে ক্ষোভ নিয়ে বলে, ‘তোদের সমস্যা কী ভাইয়া? একজন অসুস্থ মানবীকে সেবা করা কী অপরাধ? তোরা যেভাবে চোরের মতো হাসছিস আমার কিন্তু এটাই মনে হচ্ছে। প্লিজ স্টপ।’
এবার উৎস হাসি থামিয়ে ধীর গলায় বলল, ‘হাসি আসলে কি সেটা চেপে রাখা যায়? তুই পারবি? তোদের তিনজনই হচ্ছিস অদ্ভুত চরিত্র। ভাইয়ের ওপর রোজার না যতটা দরদ, তারচেয়ে বেশি দরদ উতলে ওঠছে তোর।’
ফিহা আবারও রাগ নিয়ে তাকালো। একহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে কটমট করে বলল, ‘কারণ ভাইটা আমার।’
উৎস কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘তাই নাকি? আর আমি তোর কেউ না? রোজাও তোর কেউ না? নিজের একটা ভাই থাকতে এমন দুশমনি কথাবার্তা কেমনে বলিস তুই? এমন বিভীষণের মতো আচরণ তোকে মানায় না।’
ফিহা উত্তরে কিছু বলার আগেই আদ্রিশ থমথমে গলায় বলল, ‘তোরা যদি চুপ থাকতে না পারিস তাহলে এক্ষুনি গাড়ি থেকে নেমে যা।প্যানপ্যান করে মাথা খাচ্ছিস, ইডিয়ট কোথাকার!’
আদ্রিশের ধমক শুনে সবাই চুপ করে গেলো। ফিহা বিশ্বজয়ীর হাসি হাসলো। রোজা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে বসে ওদের কথোপকথন শুনলেও ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করলো না। আদ্রিশদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বেজে গেল। রোজাকে বরণ করলো আদ্রিশের মা মিতালি। একমাত্র ছেলের বউ পেয়ে তিনি ভীষণ খুশি। সব রিচুয়ালস পালন শেষ করতে করতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল। এরপর রোজাকে আদ্রিশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ঠিক তখনই সকল রাগটাগ কর্পূরের মতো উবে গিয়ে লজ্জায় সিক্ত হয়ে ওঠলো রোজার মুখখানি। নেহা-ফিহা, ইশা ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে একসময় ওকে একা বসিয়ে বিদায় নিলো। আর ইনায়েত সাহেব আদ্রিশের সাথে লিভিংরুমে বসে দরকারি কথা বলছিলো। সবাই যাওয়ার পর দরজার কপাটটা হালকা চাপিয়ে ফ্রেশ হয়ে সালোয়ার-কামিজ পরে নিলো রোজা। সারাদিনের ক্লান্তিতে দু-চোখ ঘুমে বুজে আসায় ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো ও। মিনিট দশেকের ভেতর পুরোপুরি ঘুমে মগ্ন হয়ে গেলো। নির্জন ঘরটিতে ভেসে বেড়াচ্ছিলো রোজার গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।
ইনায়েত সাহেবের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে দোতলা’য় নিজের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো আদ্রিশ। নেহা-ফিহা-ইশা আর উৎস ডাইনিংয়ে বসে গল্প করছিলো। তখনই পেছন থেকে উৎস আদ্রিশকে বলল, ‘জীবনের প্রথম বাসররাত পালন করতে যাচ্ছো, এটা নিয়ে তোমার অনুভূতি কী ভাই?’
আদ্রিশ ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘তোকে বলতে হবে? ছোট ছোট’র মতো থাক। বেশি কথা বললে কানের নিচে একটা দিয়ে সোজা করে দেব।’
‘সে তুমি যা-ই বলো না কেন, ঘরে ঢোকার আগে আমাদের ফি’টা দিয়ে গেলেই চলবে।’
আদ্রিশ অবাক হয়ে বলল, ‘ফি’ মানে? কীসের ফি?’
‘বাসরঘরে ঢোকার ফি’।’
আদ্রিশ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘আমার ঘরে আমি ঢুকবো, তোদের কেন টাকা দেব? কী করেছিস তোরা আমার জন্য? না প্রেম করতে কোনো হেল্প করেছিস, না বিয়ে করতে হেল্প করেছিস। উপরন্তু তুই সবসময় রোজার সাইড নিয়ে আমার প্রেমের বারোটা বাজিয়েছিস। নূন্যতম লজ্জাবোধ থাকলে বেহায়ার মতো টাকা চাইতি না তুই উৎস।’
উৎস বিরস চোখে তাকিয়ে বলে, ‘রোজার সব খোঁজখবর আমি দিইনি তোমায়? এটা কীভাবে অস্বীকার করতে পারো তুমি? এই তার প্রতিদান? মাই গড!’
আদ্রিশ রুক্ষ স্বরে বলে, ‘আমি তো সেসব অস্বীকার করি নি। কিন্তু ওর খবর দেওয়ার আগে তুই যেভাবে আমার সঙ্গে ভাব দেখাতি, তাই আজ তোর প্রাপ্তির খাতাটা থাকবে শূন্য, জাস্ট শূন্য।’
বলেই আদ্রিশ গটগটিয়ে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেল। উৎস বিরস মুখ বসে রইলো। আর বাকি তিনজনের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠলো। খ্যাটখ্যাটে আদ্রিশের, গম্ভীর-শান্ত রোজা। দু’জন একসাথে কীভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো সামলায় এটাই এবার দেখার বিষয়।
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। প্রকৃতিতে বিরাজমান ঠান্ডা হাওয়া আর ধোঁয়াটে কুয়াশার জাল। একফালি চাঁদের টুকরো রাতটাকে আরও মোহনীয় করে তুলছে। আদ্রিশ যখন দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো, দেখলো বাতি নিভানো। খানিকটা চমকিত হয়ে ও দেখলো বেড সাইডের ল্যাম্প থেকে মৃদু হলদেটে আলো জ্বলছে। ও ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো বিছানায় রোজা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের ওপর পড়ে আছে। কাপড়টা একটু সরে যাওয়ায় ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। আদ্রিশের চোখে ঘোর লেগে এলো। ওর মনে হলো, ঘরে আলো থাকলে মুহূর্তটা এতো মায়াবী মনে হতো না। এ যেন স্বর্গসুখের মতো অনুভূতি! ভাবনার প্রহর থেকে বেরিয়ে আদ্রিশ চাপা নিঃশ্বাস ফেললো। চোখ তুলে রোজাকে পরখ করে দেখলো রোজা ঘুমিয়ে আছে। তাতে আপনাআপনিই ওর ভ্রু কুঁচকে এলো। ধীরপায়ে হেঁটে কাউচের ওপর বসে ভাবলো, বিয়ে বাড়ির মারামারির ঘটনার জন্য রোজা ওর ওপর এখনো রাগ করে আছে মনে হয়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় ইস্তফা দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। রোজাকে ঠিকঠাকমতো শুইয়ে দিতে গিয়ে দেখলো ওর গা হালকা একটু গরম হয়ে আছে। আদ্রিশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। বাড়ির সবাই মাত্র ঘুমিয়েছে, তাদেরকে বিরক্ত করতে ওর ইচ্ছে করলো না। রোজার ঘুমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য ব্যলকনিতে এসে খুব পরিচিত একজন ডাক্তারকে ফোন করে বিষয়টা জানালো এবং সেইমতো জ্বরের ঔষধ খাইয়ে দিলো রোজাকে। কপালে রুমাল ভিজিয়ে জ্বর নামানোর প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সেরে নিলেও দুর্বল রোজা বেশিকিছু টের পেলো না। আদ্রিশের টি-শার্টের কোণা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো আর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে চাইলে আদ্রিশ কান পাতলো। ও শুনতে পেলো রোজা বলছে, ‘আপনি, এখানে? সত্যিই? ভালোবাসেন তো, বলেছিলেন না? বসে থাকুন। যাবেন না কোথাও। আমি স্বপ্ন দেখছি; সেটা ভাঙতে চাই না।’
অস্পষ্ট গলায় এসব বলেই আবারও ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়লো রোজা। আর এসব শুনে আদ্রিশ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে দূরে সরে গেল। বুকের বাঁ-পাশে হাত রেখে হার্টবিটের কাঁপুনি অনুভব করে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো আদ্রিশ। অতঃপর মূল বিষয়টা বুঝতে পেরে নিঃশব্দে হেসে আবারও রোজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে গাঢ়ভাবে একটা চু-মু খেলো। তারপর গায়ের ওপর কম্বল টেনে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। সারাক্ষণ হম্বিতম্বি ভাব নিয়ে থাকা মেয়েটাও যে ঘুমের ঘোরে এভাবে কথা বলতে পারে ভেবেই নিজেকে সুখী সুখী মনে হলো ওর। নিজের প্রিয় মানবীটাকে বুকে জড়িয়ে চাঁদ দেখা, এই মুহূর্তটাই বাসররাতের সবচেয়ে সুন্দর উপহার বলে মনে হলো আদ্রিশের।
—————————————————————————
চলবে…