অনুভবে তুমি পর্ব-৩০

0
637

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_৩০
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

সবাই ইভানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু ইভান এখন পর্যন্ত আসলো না।এভাবে কাউকে কিছু না বলে কই গেলো ইভান?
শুধু ইভান না,তার টিমের শুভ্র,নীলয়,দিশানও নাই।অথচ কিছুক্ষন আগে সবাই একসাথেই ছিলো।
এদিকে অনেক রাতও হচ্ছে।অতশীর আম্মু আর দাদীর ভয় হতে লাগলো।তাদের মেয়ের সাথে বার বার এমন কেনো হচ্ছে?অতশী শুধু দোয়া পড়ছে,আল্লাহ ইভানের সাথে খারাপ কিছু যেনো না হয়!

প্রায় রাত বারোটার দিকে ইভান বাসায় প্রবেশ করলো।ইভান কে দেখে সবার শরীর শিহরে উঠলো।কারো মুখে কোনো কথা বের হলো না।কারন ইভানের পুরো শরীর রক্তে মাখা ছিলো।সে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলো না।
ইভানের এরকম অবস্থা দেখে সবাই ইভানকে ধরার জন্য এগিয়ে গেলো।কিন্তু ইভান কাউকে ধরতে দিলো না। ইভানের এমন অবস্থা থেকে অতশীর পুরো শরীর অবশ হয়ে গেলো।হঠাৎ ইভান অতশীর হাত ধরে টেনে বিয়ের আসরে নিয়ে গেলো।অতশীর হাতও রক্তে মাখামাখি হলো।
ইভান চিৎকার করে বললো,কাজি সাহেব কই?তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়ান।
ইভানের মা ইভানের এমন অবস্থা দেখে বললো,বাবা কি হয়েছে তোমার?শরীরে এতো রক্ত কেনো?এই বলে ইভানের মা ইভানের শার্ট খুলতে ধরলো।কিন্তু ইভান খুলতে দিলো না।সে আবারো বললো,কাজি সাহেব তাড়াতাড়ি বিয়ে টা পড়ান।
অতশী তখন বললো, কি হয়েছে আপনার?আপনি এমন করছেন কেনো?
ইভানের বাবা এগিয়ে এসে বললো, বাবা হসপিটালে চলো।পাগলামি করো না।তোমাকে ভীষণ দূর্বল লাগছে।
–না বাবা ঠিক আছি আমি।তুমি বিয়ে পড়ানো শুরু করতে বলো।
ইভানের বাবা বুঝতে পারছে ইভানের কনডিশন ভালো না,কিন্তু ইভান তো সেদিকে নজরই দিচ্ছে না।
ইভান এখনো অতশীর হাত শক্ত করে ধরে আছে।এদিকে ইভানের হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে।আর সেই শক্তে অতশীর বিয়ের লাল শাড়ি একদম মাখামাখি হয়ে গেলো।

কাজি সাহেব পাত্রের এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।তিনি বিয়ের কাজ শুরু করতে ভয় পাচ্ছেন।ইভান তখন আবার রিকুয়েষ্ট করলো।প্লিজ কাজি সাহেব দেরী করেন না।
কাজী সাহেব সেই কথা শুনে বিয়ের কাজ শুরু করে দিলো।
অতশী বুঝতে পারছে না কিছু?ইভান কেনো এমন করছে?সে হাসপাতালে না গিয়ে কেনো বিয়ে পড়ানোর জন্য এতো তাড়াহুড়ো করছে!

হঠাৎ ইন্সপেক্টর আকরাম আসলেন বিয়ের আসরে। তিনি এসেই ইভান কে এম্বুলেন্স এ তোলার জন্য বললেন।কিন্তু ইভান কে ধরতে যেতেই ইভান বললো আমাকে কেউ টাচ করবে না।খবরদার আমার আশেপাশে আসবে না।আমি আগে বিয়ে করবো তারপর হসপিটালে যাবো।

অতশী তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো,আপনি আগে হসপিটালে যান।বিয়ে টা কিন্তু ইমপরটেন্ট নয়।আপনার সুস্থ থাকাটাই সবচেয়ে বেশি ইমপরটেন্ট।
ইভান তখন বললো, আমি এক কথার মানুষ।আমি কখনোই কথা দিয়ে কথা অমান্য করি না।আজ আমি বিয়ে করতে চাইছি,সেইজন্য আজকেই বিয়ে করবো।এই বলে ইভান কাজি সাহেব কে বললো,কি হলো কাজি সাহেব? একটু জলদি করেন।আমি তো আর সহ্য করতে পারছি না।
কাজী সাহেব সেই কথা শুনে আবার বিয়ের কাজ শুরু করলেন।
এদিকে ইভান একদম নেতিয়ে পড়ছে।তার চোখ বুজে আসতে ধরছে।
সে শুধু কবুল বলার জন্য অপেক্ষা করছে।
অতশী ইভানের এমন অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আপনি এমন পাগলামি কেনো করছেন?
তখন কাজি সাহেব বললো,বলো বাবা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
ইভান শান্তভাবে বললো কবুল।তার মুখ থেকে কিছুতেই কথা বের হচ্ছে না।তবুও সে জোর করেই বের করলো।
অন্যদিকে আকরাম ইভান কে এম্বুলেন্স এ নেওয়ার জন্য বার বার নির্দেশ দিচ্ছে।ইভান তখন চিৎকার করে বললো,অতশীর কবুল বলা শুনে তবেই যাবো আমি।প্লিজ আমাকে কেউ জোর করে নিয়ে যাও না।
অতশী তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো আপনি কেনো এমন পাগলামি করছেন?একটু বোঝার চেষ্টা করুন।ইভান তবুও শুনলো না।
অতশী যখন বললো আলহামদুলিল্লাহ কবুল, ইভান সাথে সাথে অতশীকে জড়িয়ে ধরলো। আর তার কপালে একটা কিস করে বললো, আমাদের মনে হয় আর একসাথে সংসার করা হলো না।সরি অতশী,ক্ষমা করে দিও আমাকে।সংসার করা না হলো তোমাকে বিয়ে তো করতে পারলাম।এই বলেই ইভান অতশীর গায়ের উপরই পড়ে গেলো।
অতশী তা দেখে চিৎকার করতে লাগলো।ইভান!ইভান!আপনি কথা বলছেন না কেনো?উঠুন!উঠুন!

ইভানের বাবা আর দেরী না করে ইভান কে এম্বুলেন্স এ ওঠালো।

মুহুর্তের মধ্যে বিয়ে বাড়ির আনন্দ মাটির সাথে মিশে গেলো।
ইভানের মা ছেলের এমন অবস্থা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।সেজন্য সবাই ইভানের মায়ের মাথায় পানি দিতে লাগলেন।
এদিকে কেউই বুঝতে পারছে না আসলে হয়েছে টা কি?
ইভানের এমন অবস্থা দেখে নেহা বার বার শুভ্র কে ফোন দিতে লাগলো।কিন্তু শুভ্র ফোন রিসিভ করলো না।
মুহিব সাহেব ইভান কে এম্বুলেন্স এ তুলে দিয়ে নিজেও ছেলের সাথে চলে গেলেন।
এদিকে অতশী শুধু চিৎকার করে করে কাঁদছে আর ইভান ইভান বলে ডাকছে।
অতশীকে থামানোর জন্য অতশীর দাদী আর আম্মু শক্ত করে ধরলো।তবুও অতশী ইভানের কাছে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে লাগলো।

মৌরি তখন কাঁদতে কাঁদতে অফিসার আকরাম কে জিজ্ঞেস করলেন,কি হয়েছিলো ভাইয়ার?ভাইয়ার এমন অবস্থা কিভাবে হলো?

অফিসার আকরাম তখন বললো,তোমার হাজব্যান্ড করেছে।মানে সন্ত্রাসী অয়ন।
মৌরি অয়নের নাম শোনামাত্র চমকে উঠলো আর বললো,ইমপসিবল অফিসার!অয়ন এটা কখনোই করতে পারে না।অয়ন কখনোই ভাইয়ার উপর এট্যাক করতেই পারে না।

অফিসার আকরাম তখন বললো,কেনো মারতে পারে না?ইভানের সাথে কি অয়নের বন্ধুর সম্পর্ক ছিলো?ওরা কি বন্ধু?

মৌরি সেই কথা শুনে চুপ করে রইলো।
আকরাম তখন বললো যদি ইভান অয়নের সাথে বন্ধুত্ব করেও থাকে তাহলে সেটা মিথ্যা নাটক ছিলো।অয়ন কে ধরার জন্য ইভান এর এটা একটা চাল ছিলো।একজন সন্ত্রাসী কখনোই সি আই ডি অফিসারের বন্ধু হতে পারে না।
–ইমপসিবল!এটা হতেই পারে না।আপনি মিথ্যা বলছেন।

আকরাম তখন বললো,এটাই সত্যি।সন্ত্রাসী অয়ন কে ধরতে গিয়েছিলো ইভানের টিম।কিন্তু অয়নের অনেক লোক থাকায় এরা মাত্র চারজনে পেরে উঠতে পারে নি।ইভান পুলিশ কে ফোন দিলে পুলিশের টিম সেখানে উপস্থিত হয়।কিন্তু তার আগেই সব কিছু শেষ হয়ে যায়।
শুভ্র সাথে সাথে মারা যায়।দিশান আর নীলয় কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।অবস্থা খুবই শোচনীয়। কিন্তু ইভান কে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে নি।সে শুধু বলছে ওকে আগে বাসায় নিয়ে যাও।কারণ আজ ওর বিয়ে।অতশী বসে আছে ওর জন্য।সেজন্য সে একা একা ড্রাইভ করে চলে আসে।

অয়নের মা তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, অফিসার অয়নের কোনো ক্ষতি হয় নি তো?অয়ন কেমন আছে?
আকরাম কোনো উত্তর দিলো না।
মৌরি তখন বললো, কি হলো? চুপ করে আছেন কেনো?অয়ন কোথায়?

তখন অফিসার বললো,অয়ন মারা গেছে।আর ও বেঁচে থাকলেই কি হতো?ওর তো অনেক আগেই ফাঁসির অর্ডার হয়ে গেছে।
মৌরি সেই কথা শোনামাত্র সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
অয়নের মা আর এক মুহুর্ত ও দেরী করলো না।অয়ন অয়ন বলে চিৎকার করতে লাগলেন। আর দৌঁড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।

অয়নের লিডার জানতে পেরেছে সি আই ডি অফিসার অয়ন কে সাহায্য করছে।তাকে বাঁচানোর জন্য সব রকমের চেষ্টা করছে।আবার অয়নের বোনকেই বিয়ে করছে।
সেজন্য অয়নের লিডার অয়নের আস্তানার খোঁজ করতে থাকে আর পেয়েও যায়।
সেজন্য তিনি অয়ন কে চিরতরে শেষ করার জন্য তার সমস্ত সন্ত্রাসবাহিনীদের নিয়ে অয়নের আস্তানায় আক্রমন করে।
অয়ন আর তার সহচরী রা প্রানপণ লড়াই করে।কিন্তু এতোগুলো সন্ত্রাসীদের সাথে তারা পেরে উঠতে পারে না।এদিকে ইভান অয়নদের নজর রাখার জন্য দিশান কে ওর আস্তানার আশেপাশেই রেখেছিলো।কারন ইভান বুঝতে পেরেছে যেকোন সময় অয়নদের উপর এট্যাক হতে পারে।এজন্য দিশান ইভান কে ফোন করে কথাটা বলার জন্য।কিন্তু ইভান ব্যস্ত থাকায় ফোন ধরতে পারে না।সেজন্য দিশান বাসাতে আসে বলার জন্য।অয়নের উপর হামলার কথা শুনে ইভান আর এক মুহুর্ত ও দেরী করে না।শুভ্র,নীলয় আর দিশান কে সাথে করে নিয়ে চলে যায় সেখানে।ইভান কল্পনাও করে নি অয়নের লিডার এতোগুলো সন্ত্রাস নিয়ে অয়ন কে এট্যাক করতে আসবে।
ইভান অয়ন দের বাঁচানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।কিন্তু অয়নের লিডারের সন্ত্রাসী রা সংখ্যায় এতো বেশি যে ইভানরা হিমশিম খেয়ে যায়।এই পরিস্থিতিতে ইভান পুলিশেরও হেল্প নিতে পারছে না।কারন পুলিশ যদি বুঝতে পারে ইভান অয়নের সাথে হাত মিলিয়েছে,তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে,তখন ইভান কে সবাই দ্রোহী বলে ঘোষণা করবে।

হঠাৎ চার পাঁচজন সন্ত্রাসী অয়ন কে শক্ত করে ধরে একের পর এক ছুরিকাঘাত করতে থাকে।
ইভান তা দেখে কিছুক্ষনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।ইভান আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।সে অয়নকে বাঁচাতে গেলে পিছন দিক থেকে কে যেনো তাকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে।
ইভান তাকাতেই দেখে সে আর কেউ নয়,ভার্সিটির সেই ছাত্র নেতা আহসান।সে একগাল হেসে বললো,খুব পাখনা গজিয়েছিলো তোর,আমার পিছনে লাগতে এসেছিলি?যা শেষ করে ফেললাম।এখন দুইজন একসাথে মাটির নিচে বসে প্লান কর,কিভাবে আমাকে শেষ করবি?
অয়ন নিজেও অবাক হলো।সে কখনোই ভাবতে পারে নি ভার্সিটির ছাত্রনেতা আহসানই তাদের লিডার।অয়ন কে একের পর এক ছুরি দিয়ে আঘাত করায় সে সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলো।আর তখনি সে মারা যায়।

এই আহসান ই হলো অয়নের লিডার,যে তরুন ছাত্রদের ব্লাকমেল করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়।তাদের দ্বারা অপরাধ করায়।আর এই আহসানই সেই সারোয়ার রাকিব সরকারের মেয়ের জামাই।ইভান সেদিনই বুঝতে পেরেছিলো এসব কাজ আহসানেরই।আহসানই সন্ত্রাসী দের নেতা।সেজন্য সে অনেক পরিকল্পনা ও করেছিলো।কিন্তু তার আগেই আহসান তার দলবল নিয়ে এসে সবকিছু শেষ করে দিলো।

এদিকে শুভ্রও অনেক আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।দিশান,নীলয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়।

কিছুক্ষন পর পুলিশ আসে সেখানে।পুলিশ সেখানে যাওয়ার আগেই আকরাম আহসান কে সাবধান করে দেয়।সেজন্য আহসান তাড়াতাড়ি করে কেটে পড়ে।

যারা যারা আহত হয়েছে সবাই কে এক এক করে এম্বুলেন্স এ ওঠানো হলো। কিন্তু ইভান কিছুতেই এম্বুল্যান্স এ উঠলো না।সে আহত অবস্থাতেই গাড়ি ড্রাইভ করে তার বাসায় চলে আসে।

অয়নের আস্তানায় আসলে কি হয়েছিলো? কে আসল অপরাধী? তার সত্যতা যাচাই না করে ব্রেকিং নিউজ দেওয়া হলো,সি আই ডি অফিসার ইভান সন্ত্রাসী অয়ন কে ধরতে গিয়ে মারাত্নকভাবে জখম হয়েছে।তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য অয়ন কে খুন করে ফেলে।কিন্তু তার পার্টনার শুভ্র ওখানেই মারা যায়।দিশান আর নীলয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়।

ব্রেকিং নিউজ শুনে অয়নের পরিবার পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাস করলো যে ইভান অয়ন কে ধরার জন্য এই বন্ধুত্বের নাটক করেছে। ইভানই অয়ন কে মেরে ফেলেছে। ইভান যে অয়নের সাথে এতোবড় একটা প্রতারণা করবে সত্যি তারা ভাবতে পারে নি।

অতশী নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারছিলো না।তার পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেলো।একদিকে ইভান মৃত্যু শয্যায় অন্যদিকে তার ভাই মারা গেছে।

#চলবে,