অনুভবে তুমি পর্ব-৩৩

0
628

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_৩৩
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

শহরের নাম্বার ওয়ান সন্ত্রাসী মারা যাওয়ার পরও প্রতিদিন একের পর এক ক্রাইম হচ্ছে!যেখানে সেখানে লাশ পাওয়া যাচ্ছে।কাউকে গুলি করা হচ্ছে না হয় কাউকে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে।এ নিয়ে এখন নতুন বিতর্ক চলছে।কারণ অয়ন আর তার পুরো গ্যাং কেই তো একেবারে নিশ্চিহ্ন করেছে সি আই ডি।তাহলে নতুন করে আবার কোন সন্ত্রাসের জন্ম হলো!আজ ও গলাকাটা পাঁচজন মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সবাই সাধারণ নাগরিক।না আছে তাদের কোনো অর্থ সম্পদ না আছে তাদের কারো সাথে কোনো শত্রুতা।তাহলে কে করছে এসব?আর কেনোই বা করছে?

ইভান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! সারারাত ঘুম জেগে এখন দিনের বেলা ঘুমাচ্ছে।হঠাৎ ইভানের ফোনে রিং বেজে উঠলো।ইভান ঘুম ঘুম চোখেই কল রিসিভ করলো।
অপর পাশ থেকে বললো,হ্যালো স্যার!কোথায় আপনি?আজকের সকালের নিউজ শুনেছেন?
ইভান সেই কথা শুনে বললো, না শুনি নি।পরে শুনে নেবো।
–স্যার আজকেও পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেছে।আর পাঁচজনই ছিলো সাধারণ জনগন।
–হুম। এই বলে ইভান ফোন রেখে দিলো।

অন্যদিকে ইভানের পুরো পরিবার সকালের নাস্তা করছে।ইভান ঘুমাচ্ছে দেখে কেউ আর তাকে ডাকতে গেলো না।ইভানের ছোট ভাই দুটিকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে ইভানের আম্মু।অতশী নাস্তার প্লেট সামনে রেখ চুপচাপ আছে।সে একটুও খাচ্ছে না।ইভানের বাবা হঠাৎ খেয়াল করলো অতশীকে।
কি হলো মা?খাচ্ছো না কেনো?
–এই তো খাচ্ছি!এই বলে অতশী হাত দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করতে লাগলো।কিন্তু একবারও খেলো না।সে অন্য একটা বিষয় নিয়ে ভাবছে।
হঠাৎ ইভানের গলা শোনা গেলো।সে তার রুম থেকেই চিৎকার করে রিয়াকে ডাকছে।রিয়া?রিয়া?তাড়াতাড়ি এক মগ কফি নিয়ে আয়।
রিয়া ইভানের কথা শোনামাত্র কফি রেডি করতে গেলো।আর রেডি হওয়া মাত্রই কফি নিয়ে ইভানের রুমের দিকে চলে গেলো।
মৌরি তখন বললো,রিয়া দাঁড়া।তুই যাস না।কফির মগ টা অতশীর হাতে দে।কারণ আমার মনে হয় ইভান ভাইয়ার সব কাজ এখন অতশী ভাবীর করা উচিত।

মৌরির কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকালো।অতশী নিজেও অবাক!কি বলছে মৌরি?

মৌরি তখন বললো,সবাই এভাবে তাকাচ্ছো কেনো আমার দিকে?আমি কি ভুল বললাম কিছু?ভাইয়া রাগ করে আছে বুঝলাম,তাই বলে কি বউ কে এখন অমান্য করবে?যত কিছুই হোক অতশী ভাইয়ার বউ।এরকম আলাদা থাকা,কথা না বলা এসব ঠিক হচ্ছে না।

অতশী সেই কথা শুনে বললো, মৌরি চুপ করো।কি বলছো এসব?আমি ওনার রুমে যাবো না কিছুতেই।

তখন ইভানের আব্বু বললো,মৌরি ঠিক বলছে।ইভান যেটা করছে সেটা ঠিক হচ্ছে না।বিয়ে টা স্বীকার করছে অথচ বউ অস্বীকার করছে!এটা মারাত্মক অন্যায়।অতশী তুমি আজ থেকে ইভানের ঘরেই থাকবে।দেখি ও কি করে?

অতশী তখন বললো, বাবা এভাবে জোর করবেন না।ওনার যেটা ভালো মনে হচ্ছে উনি সেটাই করছেন।তাছাড়া আমি ওনার রুমে থাকলে ওনার প্রবলেম হয়ে যাবে।উনি ঠিক করে ওনার কাজ করতে পারবেন না।

অতশীর কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। রিয়া তখন বললো যখন এতই সমস্যা তাইলে বিয়ে ক্যান করলো?

সবাই আলাপ আলোচনা করতেই ইভান নিজেই আসলো ডাইনিং রুমে।আর এসেই রিয়াকে বকতে লাগলো।
–আমার কফি কই?এতো লেট করছিস কেনো?
রিয়া কিছু বলার আগেই ইভান রিয়ার হাতে কফির মগ দেখতে পেলো।আর সেটা হাতে নিতে নিতে বললো,এই তো রেডি করেছিস কফি।তাহলে রুমে দিয়ে আছিস নে কেনো?
ইভান যেই এক চুমুক দিয়েছে সে সাথে সাথে কফির মগ টা রিয়ার হাতে দিয়ে চিৎকার করে বললো, এটা কি?কফি না শরবত?কতক্ষন আগে বানায়ছিস?

রিয়া তখন বললো, আসলে স্যার অনেক আগে বানায়ছি।
–তাহলে দিয়ে আসিস নি কেনো রুমে?
–কিভাবে দিয়ে আসবো?সবাই বলছে অতশী ম্যাডাম কে দিয়ে আসতে।আর অতশী ম্যাডাম বলছে উনি যাবেন না।সেজন্য আমিও চুপচাপ এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।
ইভান সেই কথা শুনে অতশীর দিকে তাকালো।আর বললো,অতশী নাস্তা করা শেষ তোমার?
অতশী মাথা নাড়লো।
ইভান তখন বললো তাহলে জলদি এক মগ কফি রেডি করো আমার জন্য।
এই বলে ইভান তার রুমে চলে গেলো।

সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো। তারা ভাবলো কি আর ইভান করলো কি?সবাই ভেবেছে ইভান এই কথা শুনে রাগান্বিত হবে।কিন্তু ইভান তো অতশীকেই পারমিশন দিলো।

অতশী এখন কি করবে বুঝতে পারলো না।কারন ইভান কে বোঝা বড় দায়।সে রাগ করে বললো না মন থেকে বললো তা বোঝা গেলো না।
অতশীকে চুপচাপ দেখে রিয়া বললো, ম্যাডাম আসুন তাড়াতাড়ি। তা না হলে স্যার রাগ করবে।
মৌরি সেই কথা শুনে অতশীর গা টেলা দিয়ে বললো, ভাবী যান এখন।এতোক্ষন তো আমাদের কথাকে গুরুত্বই দিলেন না।এখন তো ভাইয়া নিজেই অর্ডার করেছে।এখন তো অবশ্যই যাবেন।

অতশী সেই কথা শুনে বললো,আমি বাবার কথা শুনেই কিন্তু যাচ্ছি।তোমার ভাইয়ার কথা শুনে না।এই বলে অতশী কফি রেডি করতে গেলো।কিন্তু কফি রেডি করতে গিয়ে তার মন টা খারাপ হয়ে গেলো।তার চোখে জল চলে এলো।কারণ অতশী অয়নের জন্য ডেইলি ডেইলি চা আর কফি বানাতো।আজ তার সেই ভাইয়া নাই।এইভাবে অয়ন হারিয়ে যাবে অতশী কল্পনাও করে নি কখনো।
অতশীকে এরকম অন্যমনস্ক দেখে মৌরি বললো,তোমার ভাইয়াকে কখনো নিজের হাতে কফি বানিয়ে খাওয়ার সৌভাগ্য হয় নি।আমি অনেকবার চেয়েছিলাম বানাতে কিন্তু উনি আমাকে বানাতে দেন নি।উনি আমাকে বলতেন,তুমি পারবে না।এসব কাজ তোমার দ্বারা হবে না।তবে আমি বুঝতে পারতাম উনি তোমার হাতেই কফি খাবেন বলে আমাকে বানাতে দিতেন না।
অতশী সেই কথা শুনে বললো,ভাবী ভাইয়া আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো।জানি না সব ভাই তার বোনকে এভাবে ভালোবাসে কিনা?কিন্তু অয়ন ভাইয়ার এই ভালোবাসা যে ক্ষনিকের জন্য ছিলো তা বুঝতেই পারি নি।এই বলে অতশী চোখ মুছে নিলো।

মৌরি তখন বললো, অতশী কফি টা আবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।যাও ভাইয়াকে দিয়ে এসো।
অতশী তখন বললো, আমাকে তো শুধু বানাতে বলেছে,ওনার রুমে তো নিয়ে যেতে বলে নি।রিয়া গিয়ে দিয়ে আসবে।যাবো না আমি।

মৌরি সেই কথা শুনে অতশীর হাত ধরে বললো, তুমি এখনো স্বামীর গুরুত্ব বুঝতে পারছো না ভাবি।একজন মেয়ে মানুষের কাছে তার স্বামীই হলো সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।প্লিজ ভাবি তুমিও ভাইয়ার সাথে তাল মিলাও না।ও রাগ করছে দেখে তুমিও যদি রাগ করে থাকো তাহলে কিন্তু কখনোই তোমাদের মধ্যে মিল হবে না।একজন কঠোর হলে আরেকজন কে নরম হতে হবে।একজন আগুন হলে অপরকে হতে হবে পানি।ভাইয়া সবসময় সন্ত্রাসীর পিছনে ছুটে বেড়ায়।সারাদিন নানা রকম টেনশনের মধ্যে থাকে।সেজন্য ভাইয়ার মেজাজ সবসময় একটু গরম।তুমিও যদি ওর মতো ব্যবহার করো তাহলে কিন্তু প্রবলেম কখনোই সলভ হবে না।

অতশী সেই কথা শুনে বললো, আমাকে তুমি কি করতে বলছো এখন?উনি যেখানে নিজের মুখে বলে দিয়েছে ওনার আশেপাশে যেনো না থাকি,ওনার রুমে যেনো না যাই,ওনার সাথে যেনো কথাও না বলি সেখানে আমি নিজের থেকে কি করে ওনার কাছে যাবো?

মৌরি তখন বললো, যদি ভাইয়া এমন টাই চাইতো তাহলে সে তোমাকে এ বাড়িতে আনতো না।আর এখন তো নিজের মুখেই বললো কফি বানাতে। আর কিভাবে সে বোঝাবে?যাও তুমি দেরী না করে রুমে চলে যাও।

অতশী মৌরির কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে ইভানের রুমে চলে গেলো।
রুমের দরজা খোলাই ছিলো।অতশী রুমে ঢুকে দেখে ইভান খুব মনোযোগ দিয়ে নিউজপেপার পড়ছে।অতশী সেজন্য চুপচাপ কফির মগ টা নিয়ে ইভানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
ইভান অতশীর উপস্থিতি টের পেয়ে বললো,এক কাপ কফি রেডি করতে এতো টাইম লাগলো?না জানি অন্য কিছু অর্ডার করলে কি হতো?
অতশী তখন বললো কই রাখবো মগটা?
ইভান সেই কথা শুনে অতশীর দিকে তাকালো আর ওর হাত থেকে মগ টা নিয়ে বললো,টেবিলের উপর একটা মোবাইল রাখা আছে।আজ থেকে এটা তুমি ইউজ করবে।
মোবাইলের কথা শুনে অতশী একটুও খুশি হলো না।অথচ তার একটা নিজস্ব মোবাইলের স্বপ্ন অনেক দিন ধরেই ছিলো।আজ কেনো জানি একটুও আনন্দ লাগছে না।

অতশী সেই কথা শুনে বললো,দরকার নেই ফোনের।ফোন দিয়ে কি করবো আমি?

–আজব মেয়ে তো তুমি।ফোন দিয়ে মানুষ আবার কি করে?কথা বলবে আম্মু আর দাদীর সাথে। তোমার বান্ধুবীদের থেকে ভার্সিটির খবর নেবে।

–ভাইয়া ফোন ইউজ করা মোটেও পছন্দ করতো না।আজ ভাইয়া নেই তাই বলে কি আমি ভাইয়ার আদেশ অমান্য করবো?

ইভান অতশীর কথা শুনে হাসতে হাসতে শেষ হয়ে গেলো।সে বললো তুমি কি মেন্টাল নাকি!বেশি কথা না বলে ফোন টা নিয়ে এসো।
অতশী সেই কথা শুনে টেবিলের কাছে চলে গেলো।গিয়ে দেখে বড় একটা এন্ড্রয়েড ফোন।সাথে একটা গিফট বক্স।যার উপরে লেখা, ❝Love you Forever❞
অতশী লেখা টা দেখে চমকে উঠলো। এটা তো ইভানের হাতের লেখা।
–কি হলো?নাও মোবাইল টা।
অতশী সেই কথা শুনে শুধু মোবাইল টা হাতে তুলে নিলো।
ইভান তখন বললো, বক্সটা কে নেবে?
-কিসের বক্স এটা?
–জানি না।
–তাহলে আমাকে নিতে বলছেন কেনো?
–নিতে বলছি সেজন্য নিবে।
অতশী তখন বক্স টাও তুলে নিলো।
ইভান তখন অতশীর কাছে গিয়ে বললো, দরকারি সব নাম্বার ফোনে সেভ করে নিও।আমার নাম্বার যদি দরকারী মনে হয় তাহলে সেটাও সেভ করে নিতে পারো।

অতশী ইভানের কথা শুনে বললো, আপনি সবসময় এমন ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলেন কেনো?সব কথাই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বলেন।একটু ভালো করে বলতে পারেন না?
–আমি খারাপ কি বললাম?আমার নাম্বার টা দরকারী তো নাও হতে পারে তাই না?
অতশী তখন বললো হ্যাঁ ঠিক বলেছেন।আপনার নাম্বারের দরকার নেই।আর আপনার সাথে আমি কেনো কথা বলতে যাবো?
ইভান কোনো উত্তর দিলো না।সে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললো, চিনি বেশি হয়েছে,আমি এতো বেশি চিনি খাই না।নেক্সট টাইম অল্প করে দিও।

অতশী তখন বললো, কিসের জন্য গিফটা জানতে পারি কি?
–এমনি ইচ্ছা হলো।এখন চলে যাও।কাজ আছে আমার।
অতশী তখন গিফট বক্স টা আর মোবাইল টা টেবিলের উপর রেখে বললো,আপনার জিনিস আপনার কাছেই রাখুন।এই রকম লোকের জিনিস আমি নেই না।এই বলে অতশী চলে গেলো।
ইভান তখন পেপার আর কফির মগ টা রেখে অতশীর হাত টেনে ধরলো, এগুলো রেখে যাচ্ছো কেনো?এগুলো তো তোমার জন্য।
–নিবো না আমি।
–কেনো নিবে না?
–এমনি।
ইভান তখন অতশীর হাত ধরে টেনে তার কাছে আনলো,আর বললো আমি কিন্তু এখনো তোমাকে ক্ষমা করি নি।সো এতো বেশি ভাব দেখিও না।আমি এখনো রেগে আছি তোমার উপর।তুমি এর আগেও আমাকে না বলে ছেড়ে গিয়েছিলে।এইবার নিয়ে দুইবার হলো।বেশি তর্ক না করে এগুলো নিয়ে চলে যাও।জিনিস গুলো ভীষণ দরকারী। এই বলে ইভান অতশীর এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে গিফট বক্স টা দিলো।

অতশী জিনিসগুলো নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে রুমে চলে গেলো।মৌরি অতশীকে এরকম একা একা কথা বলতে দেখে বললো, কি হয়েছে ভাবী?এতো রাগী লুকে কাকে বকছো?
–তোমার ভাইয়াকে?
–কেনো?কি করেছে সে?
অতশী তখন গিফট বক্স আর মোবাইল টা মৌরির হাতে দিয়ে বললো, এগুলো তোমার ভাইয়া আমাকে গিফট করলো।
–ওয়াও!কি বলছো এসব?তার মানে ভাইয়া সব ভুলে গেছে।ভাইয়া তোমাকে আবার ভালোবাসতে শুরু করেছে!
ইতশী সেই কথা শুনে বললো,দূর যেটা ভাবছো সেরকম কিছু না।উনি এখনো রেগে আছেন।আর সেই আগের মতোই কড়া কড়া কথা শোনালেন।
সেইজন্যই তো আমার এতো রাগ হচ্ছে।আমাকে সহ্য করতে পারছেন না,আমাকে দেখতে ভালো লাগে না। আবার গিফটের উপর লিখেছেন ❝Love you Forever❞

#চলবে,