অনুভবে তুমি পর্ব-৪৪+৪৫

0
716

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_৪৪
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

স্যার,ইভান এইমাত্র বাসায় আসলো।মনে হয় আজ আর ডিউটিতে যাবে না।
–তুই কি করে বুঝলি?
–আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।তখন ইভান বললো,না আজ আর সে কোনো ডিউটিতে যাবে না।আজ রাতে সে বাসাতে একটু রেস্ট নিতে চায়।
কেয়ারটেকার লতিফের কথা শোনামাত্র মুহিব সাহেব তাড়াতাড়ি করে বাসা থেকে বের হয়ে এলেন।তারপর গাড়ির মধ্যে যেয়ে ওনার পুরো শরীর কালো একটা ড্রেসে ঢেকে নিলেন।

মুহিব সাহেব এখন মুন্নি বেগমের গ্রাম দৌলতপুরে যাচ্ছেন।কারণ মুহিব সাহেব ইতোমধ্যে খবর পেয়ে গেছেন যে,ইভান মুন্নি বেগমের খোঁজ পেয়ে গেছে।আর মুন্নি বেগমের আত্নীয় স্বজনকে খোঁজার চেষ্টা করছে।সেজন্য তিনি মুন্নি বেগমের সেবায় নিয়োজিত মহিলা দুইদিকে আরো বেশি সতর্ক অবলম্বন করার জন্য বলতে যাচ্ছেন।ইভানরা সারাদিন যেভাবে তদন্ত করছে মুহিব সাহেব কিছুতেই মহিলা দুইটির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন নি।কিন্তু এই মুহুর্তে এই মহিলা দুইটির সাথে কথা বলা ভীষণ প্রয়োজন ওনার।
কিন্তু মুহিব সাহেব এটা জানেন না যে মুন্নি বেগমের সেবায় নিয়োজিত মহিলা দুইটিকে সারা দিন রাত চোখে চোখে রাখছে শুভ্র,দিশান,আর নীলয়।ইভান বাসায় রেস্ট নেওয়ার জন্য আসলেও সে ওদের কে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে।আর ওরা সেভাবেই কাজ করছে।

প্রতিটা রজনী নির্ঘুমে কাটিয়ে আর প্রতিটা দিন কোনো বিশ্রাম না নিয়ে অতশীকে পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে ইভান আজ অনেক বেশি ক্লান্ত।শুধু একবার নয় এর আগে আরো দুইবার অতশী এইভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছিলো।আর সেজন্য ইভানকে এইভাবে পাগলের মতো খুঁজতে হয়েছিলো।দুইবার ই অতশীকে সে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় পেয়েছে।তবে এবার যে কি হবে ইভান ভাবতেই পারছে না।ইভান সেজন্য অনেক বেশি আতংকের মধ্যে আছে।কারণ ইভানের শুধু এখন একটাই ভয়,যদি অতশী সন্ত্রাসীদের হাতে পড়ে যায় তাহলে তো আর রেহাই নাই তার।কি যে করবে তারা সেটা উপরওয়ালাই ভালো জানে।সে কি এবারও অতশীকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাবে?না বড় কোনো বিপদের মধ্যে আছে অতশী?এসব ভাবতেই ইভানের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে,তার পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে।ইভান সেজন্য তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে উঠে বসলো।সে আর নিতে পারছে না এই যন্ত্রনা।না,এভাবে তাকে কিছুতেই শুয়ে থাকা যাবে না।তাকে এখনি বের হতে হবে।এই ভেবে ইভান শার্ট টা গায়ে দিয়েই দরজা খুলে বের হলো।যেহেতু এখন রাত এক টা বাজে।সেজন্য চারদিকে নিরবতা বিরাজ করছে।ইভান কে ক্লান্ত আর অনেক বেশি চিন্তিত দেখে শুভ্র জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছিলো বাসায়। তারা সবাই মিলে বলেছে আপনি কিছুক্ষন রেস্ট নিন স্যার।আমরা দেখছি এদিকে।ইভান সেই কথা শুনেই বাসায় এসেছে।কিন্তু সে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না।অতশী কোথায় আছে,কিভাবে আছে এটা না জানা পর্যন্ত সে কি করে আরামে ঘুম পারতে পারে?

ইভান যে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে সেটা লতিফ টের পেলো না।কারণ কিছুক্ষনের জন্য তার দুচোখের পাতা একটু লেগে এসেছিলো।সেজন্য লতিফ গেট বন্ধ করে পাশেই একটা বেঞ্চে শুয়ে পড়েছে।ইভান লতিফকে ঘুম পাড়া দেখে আর ডাক দিলো না।সে গেট খুলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।

এদিকে গ্রামে পৌঁছতে তিন ঘন্টা লাগলো মুহিব সাহেবের।তিনি পৌঁছেই মহিলা দুইটিকে ফোন দিলেন।আর মুন্নি বেগমকে নিয়ে আসতে বললেন। মহিলা দুইটি মুহিব সাহেবের কথামতো বাসা থেকে বের হয়ে অন্য একটা রাস্তা দিয়ে মুন্নি বেগমের বাড়ি চলে গেলেন। এবং তাকে কোলে করে উঠিয়ে মুহিব সাহেবের কাছে চলে গেলেন।এদিকে দিশান, শুভ্র আর নীলয় মহিলা দুইটিকে বাসা থেকে বের হতে দেখে তাদের পিছু নিলো।কিন্তু মহিলা দুইটি যে কোনদিকে গেলো তারা কিছুই বুঝতে পারলো না।তারা তিনজন তিনদিকে চলে গেলো।তবুও মহিলা দুইটির কোনো দেখা পেলো না।কারণ তারা ভাবতেই পারে নি মহিলা দুইটি মুন্নি বেগম কে নিয়ে এই রাতের বেলাতেই পালাচ্ছে।
মুহিব সাহেব তাড়াতাড়ি করে মুন্নি বেগমকে গাড়িতে ওঠালেন,আর মহিলা দুইটিকেও ওঠালেন।তারপর
মহিলা দুইটিকে দুইটি টাকার বান্ডিল হাতে দিয়ে বললেন,তোমাদের আজ থেকে অন্য কোনো গ্রামে থাকতে হবে।আর মুন্নি বেগমের যেনো সেবার কোনো কমতি না হয়।মহিলা দুইটি টাকার বান্ডিল পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো।তাদের মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না।মুহিব সাহেব তখন বললো, সি আই ডি পিছনে লেগেছে তোমাদের,সেজন্য অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।ওনারা ঘুরেপেঁচিয়ে এমনভাবে প্রশ্ন করবে,যে তোমরা ভুল করে সত্যি কথাটা বলে দিবে।সেজন্য তোমাদের এ গ্রামে থাকাই যাবে না।আমি শুনেছি তোমরা সি আই ডি দের দেখে একদম দূর্বল হয়ে গেছো।কি সব আবোলতাবোল বলেছো?
মহিলা দুইটি সেই কথা শুনে বললো, স্যার আমরা তো কিছুই বলি নি।
–স্টপ।তোমরা আসলে কোনো কাজেরই না।কত করে বোঝালাম যে তোমরা কিছুই জানো না বা এই মহিলাকে তোমরা চেনো না সবসময় এটাই বলবে।তবুও ভুলভাল বলেছো।

এদিকে ইভানও মুন্নি বেগমের গ্রামে এসে গেছে। ইভান হঠাৎ খেয়াল করলো রাস্তার পাশে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।ইভান সেজন্য তাড়াতাড়ি করে তার নিজের গাড়ি থামালো।আর গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেলো।ইভান তখন জোরে জোরে করে ডাকতে লাগলো।তবুও কারো কোনো সাড়াশব্দ পেলো না।ইভান সেজন্য শুভ্রকে ফোন করে বললো তোমরা তাড়াতাড়ি একটু রাস্তার কাছে এসো।এখানে একটা কালো রঙ এর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই।
শুভ্র সেই কথা শোনামাত্র সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে রাস্তার দিকে চলে গেলো।তারাও দেখতে পেলো কালো রঙ এর গাড়িটিকে।হঠাৎ তাদের কে অবাক করে দিয়ে গাড়ির ভিতর বসে থাকা লোকটি তাড়াতাড়ি করে গাড়ি স্টার্ট দিলো।আর এক টানে চলে গেলো।ইভানরা তা দেখে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো।তারা কিছুই বুঝতে পারলো না।দিশান তখন বললো, স্যার গুড নিউজ আছে।আপনার ধারণাই সঠিক। মুন্নি বেগমের সেবা করা মহিলা দুইটি কাল আমাদের মনে হয় মিথ্যা কথা বলেছে।তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।তারা এই রাতের বেলা বাসা থেকে বের হয়ে কই যেনো উধাও হলো?
–কি বলছো এসব বোকার মতো?কই উধাও হলো?তোমরা ফলো করো নি তাকে?
–করেছি স্যার।কিন্তু ওনারা অন্য এক রাস্তা দিয়ে চলে গেছে সেজন্য আমরা খুঁজে পাই নি।
–ওহ মাই গড।কি করলে তোমরা এটা?চলো দেখি মুন্নি বেগম ঠিক আছে কিনা?এই বলে ইভান দৌঁড়ে মুন্নি বেগমের বাড়ি চলে গেলেন।কিন্তু গিয়ে দেখে রুমের ভিতর মুন্নি বেগম নাই।
তারমানে মহিলা দুইটি মুন্নি বেগমকে নিয়ে পালিয়েছে।ইভান আর এক সেকেন্ড দেরী করলো না।সাথে সাথে গাড়ি নিয়ে পালটা ধাওয়া করলো।কিন্তু এতোক্ষনে মুহিব সাহেব সবাইকে নিয়ে অন্য কোনো গোপন জায়গায় চলে গেছেন। ইভান সেজন্য আবার ফিরে এলো মুন্নি বেগমের গ্রামে।সে মুন্নি বেগমের ঘর পুরো তছনছ করলো,কিন্তু কোনো ক্লু পেলো না।কারণ ঘরে কিছুই ছিলো না তেমন।এদিকে দিশান রা ভয়ে একটা কথাও বললো না।তারা কি করে এতো বড় একটা ভুল করলো?ইভান এবার অনেক বেশি রেগে গেলো ওদের উপর।কারণ ওরা জোর করেই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।সে থাকলে নিশ্চয় কিছু একটা করতে পারতো।দিশানরা কি করে এতো বড় একটা ভুল করলো।তারা সবাই মিলে আফসোস করতে লাগলো।

শুভ্র তখন বললো স্যার, সন্ত্রাসী রা মনে হয় খবর পেয়ে গেছে যে আমরা মুন্নি বেগম কে ফলো করছি।সেজন্যই তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।আর মহিলা দুইটি আগে থেকেই সবকিছু জানতো।
ইভান তখন বললো না,এরকম কিছু না।আমার মনে হয় সন্ত্রাসীর সাথে মুন্নি বেগমের গভীর কোনো সম্পর্ক আছে।সেজন্য তার সেবার জন্য এই মহিলা দুইটিকে রেখেছে।যদি নিকটতম মানুষ নাই হতো তাহলে মুন্নি বেগমকে তো একেবারে মেরেই ফেলতো।তাকে নিয়ে আর পালিয়ে যেতো না।
হঠাৎ দিশান খাটের নিচে একটা ছোট বাক্স দেখতে পেলো।সে তাড়াতাড়ি করে বাক্স টা বের করলো আর সাথে সাথে তালা ভাংলো বাক্সের।কিন্তু বাক্সের মধ্যে শুধু কাপড় ছিলো।দিশান সবগুলো কাপড় বের করতেই হঠাৎ সে একটা প্রেসক্রিপশন দেখতে পেলো।মুন্নি বেগমের প্রেসক্রিপশন ছিলো এটা।ঢাকার নামি দামি একটা হসপিটালে প্রায় পাঁচ বছর আগে চিকিৎসা করা হয়েছে মুন্নি বেগমের।ইভান প্রেসক্রিপশনটা তাড়াতাড়ি করে হাতে নিয়ে নিলো এবং ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো।রোগীর নাম মুন্নি বেগম লেখা আর মুন্নি বেগমের স্বামীর নাম আকবর লেখা।ইভান প্রেসক্রিপশন টা হাতে নিয়ে ভালো করে ভাবতে লাগলো। কারণ মুন্নি বেগমের গ্রামের নাম তো দৌলতপুর,কিন্তু এখানে প্রেসক্রিপশনে মুন্সিগঞ্জ লেখা।তা দেখে ইভানের মাথাটা একদম চক্কর দিয়ে উঠলো।সে বুঝতেই পারছে না কি হচ্ছে এসব?আর তার কি করা উচিত?তবে ইভান বুঝতে পারলো এই মুন্সিগঞ্জ ই হয় তো মুন্নি বেগমের আসল ঠিকানা।আর সন্ত্রাসীর সাথে তার যেহেতু যোগসূত্র আছে সেজন্য এলাকা চেঞ্জ করে মুন্নি বেগম কে এই দৌলতপুরে রেখেছে। আর মুন্নি বেগমের ঠিকানায় এই গ্রামের নামই আছে।কিন্তু প্রেসক্রিপশনে ভুল করে আসল ঠিকানা টা দিয়ে দিয়েছে।ইভান সেজন্য অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো কাল তারা সবাই মুন্সিগঞ্জে যাবে।আর পুরো এলাকা খুঁজে দেখবে মুন্নি বেগম আর আকবর কে?

সকাল হয়ে গেছে।সেজন্য ইভানরা আজ আর কোনো মিশনে যাবে না।কারণ কাল তারা সবাই মিলে মুন্সিগঞ্জ যাবে।ইভান সবাইকে ভালো করে বোঝালো যেনো এই কথা কেউ জানতে না পারে।এমনকি তোমাদের পরিবারের সাথেও শেয়ার করবে না কথাটা। এটা আমাদের অনেক বড় একটা সিক্রেট কথা।এবার যেনো কোনো ভুল না হয়।সবাই মাথা নাড়লো।আর যে যার বাসায় চলে গেলো।

ইভান নিজেও তার বাড়ি চলে গেলো।ইভান বাসায় গিয়ে দেখলো লতিফ গেট লাগিয়ে দিয়েছে।তার মানে সে ঘুম থেকে উঠেছে।ইভান গাড়ির হর্ণ দিতেই লতিফ গেট খুলে দিলো।ইভান গাড়ি নিয়ে বাসার ভিতর ঢুকে গাড়ি টা পার্কিং করতেই লতিফ এগিয়ে গেলো ইভানের কাছে। আর তাকে জিজ্ঞেস করলো,স্যার আপনি আবার কখন বের হয়েছিলেন?আপনার তো আজ কোনো ডিউটি ছিলো না?
ইভান সেই কথা শুনে বললো, আংকেল আমি কখন ডিউটিতে যাবো আর কখন যাবো না সেটা আমার পার্সোনাল বিষয়। আমি এসব বিষয় কারো সাথে শেয়ার করি না।এই বলে ইভান তার রুমে চলে গেলো।লতিফ ইভানের কথা শুনে অনেক বেশি ভয় পেলো।কারণ মুহিব সাহেব যদি জানতে পারে ইভান বাসাতে ছিলো না তখন তো তার উপর ভীষণ রেগে যাবে।এখন কি করবে লতিফ এসব ভাবতেই মুহিব সাহেব ও বাসায় ঢুকলো।মুহিব সাহেব বাসায় ঢুকেই লতিফ কে বকা শুরু করলো।ইভান যে বাসা থেকে বের হয়েছে তুই সেটা বলিস নি কেনো?আমি আজ অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।ইভান আমার গাড়ি দেখে ফেলেছে আজ।মুহিব সাহেব লতিফের সাথে কথা বলতেই ইভানও আসলো সেখানে।কারণ সে গাড়ির চাবি নিতে ভুলে গেছে।ইভানকে দেখে তার বাবা ভয়ে কুঁকড়ে গেলো।কারণ ইভান কেনো জানি অন্য রকম ভাবে দেখছে তাকে।
এদিকে ইভান এতো সকালে তার বাবাকে দেখে বললো,বাবা আপনি?মসজিদে গিয়েছিলেন?
মুহিব সাহেব সেই কথা শুনে মাথা নাড়লো।ইভান তখন বললো,বাবা আজ একটু বাসাতেই থাকিয়েন।আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে।বাসা তে একজন থাকা দরকার।
মুহিব সাহেব এবারও মাথা নাড়লেন।হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন অতশীর কোনো খবর পেলি?
–না।এই বলে ইভান আবার তার রুমে চলে গেলো।আর গিয়েই সিসি টিভির ভিডিও দেখতে লাগলো।

ইভান দেখতে চাইলো তার বাবা কখন বাসা থেকে বের হয়েছে?কারণ তার বাবা মসজিদে গেলে সবসময় পাঞ্জাবি আর টুপি পড়ে আর হাতে একটা জায়নামাজ থাকে।আজ তার কোনোটাই ছিলো না।তাহলে তার বাবা গিয়েছিলো কোথায়?আর কেনোই বা তাকে মিথ্যা কথা বললো?

ইভান ভিডিও ব্যাক করে দেখলো দুই এক ঘন্টা আগে বাসা থেকে বের হয় নি মুহিব সাহেব।ইভান অনেক বেশি আশ্চর্য হলো।সেজন্য সে ভিডিও আরো ব্যাক করতে লাগলো।ইভানের মাথা একদম ঘুরে গেলো।যখন সে দেখলো তার বাবা রাত এক টায় বাসা থেকে বের হয়েছে।এর মধ্যে আর একবারও বাসায় আসে নি।ইভান বুঝতে পারলো না কিছু।তাহলে তার বাবা গিয়েছিলো টা কোথায়?ইভান তার বাবাকে জিজ্ঞেস করার জন্য যেতে চাইলো।পরে আবার ভাবলো না এখনি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে না।যদি সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে তখন তার বাবা সিসি টিভির ক্যামেরা সম্পর্কে জেনে যাবে।সেজন্য ইভান কিছুই জিজ্ঞেস করলো না তার বাবাকে।

তবে মুহিব সাহেবের সন্দেহ হলো কিছুটা।মুহিব সাহেব ভেবেছেন ইভান তাকে দেখে ফেলেছে। তা না হলে ইভান কিছু একটা টের পেয়েছে যার কারণে তখন ওভাবে জিজ্ঞেস করলো তাকে। মুহিব সাহেব সেজন্য ইভানকে থামানোর জন্য অতশীকে ব্যবহার করতে চাইলো।
তিনি মনে মনে অন্যরকম একটা প্লান করলেন।

#চলবে,

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_৪৫
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

ইভানরা মুন্সিগঞ্জ পৌঁছে গেলো।এদিকে মুহিব সাহেব ইভানের হঠাৎ মুন্সিগঞ্জ যাওয়া দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন।তিনি শুধু ভাবতে লাগলেন হঠাৎ ইভান মুন্সিগঞ্জে কেনো গেলো? মুহিব সাহেবের একটাই ভয় ইভান যদি মুন্সিগঞ্জে একবার তার পরিচয় বলে তাহলে সবাই চিনে যাবে তাকে।কারণ মুন্সিগঞ্জের সকল লোক মুহিব সাহেব কে ভালো করেই চেনে।কিন্তু মুহিব সাহেব কখনোই তার পরিবারের লোকদের মুন্সিগঞ্জের কথা বলে নি।এটা যে ইভানদের গ্রামের বাড়ি তা ওরা কেউই জানে না।ইভানরা জানে শহরেই তাদের বাসা।আর তার দাদা-দাদি অনেক আগেই মারা গেছে।মুহিব সাহেব বুঝতে পারলেন এবার আর ওনার রেহাই নাই। ইভান যেভাবে পিছনে লেগেছে যেকোন মুহুর্তে তার সম্পর্কে জানতে পারে।সেজন্য মুহিব সাহেব অন্য লোকের দ্বারায় ইভানকে খবর দিলো যে, তিনি অতশীর খোঁজ জানেন।তাড়াতাড়ি করে যেনো ইভান সেই জায়গায় চলে আসে।ইভান অতশীর কথা শোনামাত্র আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না।সাথে সাথে রওনা দিলো।মুহিব সাহেব এবার ইভানকে অতশীকে খোঁজার জন্য ব্যস্ত রাখবেন।যাতে করে ইভান আর তার পিছনে না ছুটে বেড়ায়।

এদিকে অতশীকে অন্ধকার একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছে মুহিব সাহেব।কারণ অতশী মুহিব সাহেবের ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছে।এখন তিনি অতশী কে ছেড়ে দিতেও পারছেন না, আবার মেরে ফেলতেও পারছেন না।সেজন্য তিনি এখন ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যেই অতশীকে খাবার দেয় মুহিব সাহেব।যখন খাবার দেওয়া হয় শুধুমাত্র তখনি অতশীর হাত পা খুলে দেওয়া হয়।অতশী অনেক চেষ্টা করেও এই ঘর থেকে বের হতে পারে নি।সে শুধু দিন রাত দোয়া পড়তে থাকে যাতে শীঘ্রই ইভান তার খোঁজ পায় আর তার বাবার আসল পরিচয় জেনে যায়।

এদিকে ইভান অতশীর কথা শুনে সবাইকে সাথে নিয়ে সেই জায়গায় চলে এলো।ইভান গাড়ি থেকে নেমেই লোকটিকে আবার ফোন দিলো। লোকটি যে ঠিকানার কথা বলেছিলো সেখানেই তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।ইভান লোকটিকে দেখামাত্র এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলো কই অতশী?কই?ইভান একদম হাঁপাতে লাগলো।
লোকটি তখন একটা পোস্টার দেখিয়ে বললো স্যার আপনি এই মেয়েটাকে খুঁজছেন না?ইভান পোস্টার টি হাতে নিয়ে বললো হ্যাঁ।এখন বলো কই সে?লোকটি তখন বললো,স্যার এই নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তি টা আমি কিছুদিন আগে দেখেছিলাম।সেজন্য মেয়েটিকে দেখেই চিনতে পেরেছি।
ইভান তখন লোকটির গা ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,এই শালা,আসল কথা বল।এতো পেঁচাচ্ছিস কেনো কথা?অতশী কই? কই দেখেছিস তাকে?
লোকটি ইভানকে এমন রাগান্বিত দেখে বললো, স্যার আপনি রাগ করতেছেন কেনো?কই আমাকে একটু ধন্যবাদ দিবেন,আমার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন তা না করে উলটো রাগ দেখাচ্ছেন?
ইভান লোকটির কথা শুনে আরো বেশি বিগড়ে গেলো।ইভানকে এমন রাগান্বিত দেখে শুভ্র এগিয়ে এলো।আর বললো,ভাই এতো বেশি ন্যাকামি না করে বলো অতশী কই?তুমি কই তাকে দেখেছো?
লোকটি তখন বললো, কিছুক্ষন আগে একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো এখানে।সেই গাড়ির ভিতর ছিলো মেয়েটি।মেয়েটির হাত পা মুখ বাঁধা ছিলো।গাড়িটির দরজা খোলা থাকায় আমি উঁকি দিয়ে গাড়ির ভিতর দেখতেই মেয়েটিকে দেখে ফেলি।আমি মেয়েটিকে দেখামাত্র চিৎকার করে উঠি।আর তখনি লোকগুলি গাড়ি স্টার্ট দেয়।
লোকটির কথা শুনে ইভান কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।কারণ সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না লোকটিকে।কিন্তু দিশান লোকটিকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো। ইভান হঠাৎ শুভ্র কে বললো একে ধরে নিয়ে চলো আমাদের সাথে।লাঠি দিয়ে কয়েকটা আঘাত করলেই সব ভন্ডামি বের হয়ে যাবে।
–স্যার কি বলছেন এসব?আমি যা দেখেছি সেটাই বললাম।এখন আপনারা বিশ্বাস করবেন কি করবেন না সেটা আপনাদের ব্যাপার।আমাকে যেতে দিন স্যার।আজকাল কারো ভালো করতে নেই।এই বলে লোকটি চলে যেতে ধরলো।কিন্তু শুভ্র লোকটিকে যেতে দিলো না।সে লোকটির গলা টিপে ধরে বললো, আমাদের সাথে ফাজলামি করিস?জানিস আমরা কে?আমরা হলাম সি আই ডির লোক।সি আই ডির নাম শোনামাত্র লোকটি ভয় পেয়ে গেলো।তিনি আর একটা কথাও বললেন না।
এদিকে দিশান ইভানকে বললো,স্যার লোকটির কথা তো সত্যও হতে পারে।চলেন আমরা ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখি।ইভান সেই কথা শুনে বললো লোকটি মিথ্যা কথা বলছে দিশান।অতশীর যদি চোখ মুখ বাঁধাই থাকে তাহলে সে কি করে এক দেখাতেই চিনে ফেললো?নিশ্চয় এর পিছনে সন্ত্রাসীদের একটা হাত আছে।একে নিয়ে চলো আমাদের সাথে।সেই কথা শুনে দিশান আর শুভ্র লোকটিকে গাড়িতে ওঠালো।লোকটি তা দেখে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।স্যার আমাকে বাড়ি যেতে দিন।বাড়িতে আমার বউ বাচ্চা আছে।ইভান সেই কথা শুনে লোকটির বাড়ির ঠিকানা চাইলো।লোকটি প্রথমে বলতে চাইছিলো না।ইভান তখন লাঠি দিয়ে জোরে করে একটা আঘাত করলো।লোকটি তখনও তার বাড়ির ঠিকানা বললো না।এবার ইভান রাগ করে একের পর এক আঘাত করায় লোকটি বললো, স্যার বিশ্বাস করুন আমি কিছু করি নি।এক লোক কিছু টাকা আমার হাতে গুজে দিয়ে বললো চার জন লোক আসবে এখানে।তুই শুধু পোস্টার টা দেখিয়ে এই কথাগুলো বলবি।আমি সেজন্য মোবাইল করেছিলাম আপনাদের।বিশ্বাস করুন স্যার আমি জানতাম না আপনারা সি আই ডির লোক।তাহলে কখনোই এভাবে মিথ্যা কথা বলতাম না।ইভান লোকটির কথা শুনে বললো যে লোকটি এসব বলতে বলেছে তার চেহারা কেমন?
–লোকটি শ্যাম বর্নের,আর খাঁটো সাইজের ছিলেন। লোকটির চাপ দাঁড়ি ও আছে।
ইভান লোকটির কথা এখনো বিশ্বাস করতে পারলো না।লোকটি আরো অনেক কথা লুকাচ্ছে।সেজন্য ইভান লোকটিকে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখলো।আর আবার মুন্সিগঞ্জ চলে গেলো।

মুন্সিগঞ্জ গিয়ে ইভান প্রথমে প্রতিটা বাজারে গিয়ে মুন্নি বেগম আর আকবরের কথা জানতে চাইলো।তারপর একে একে প্রতিটা বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কেউই তাদের চিনতে পারলো না।আর চিনবেই বা কি করে আকবর মারা গেছে সেই অনেক বছর আগে, আর মুন্নি বেগমও সেই থেকে গ্রাম ছাড়া হয়েছে।তবে মুহিব সাহেব মাঝে মাঝে আসতো এই গ্রামে।ইভানরা যখন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মুন্নি বেগম আর আকবরের কোনো খোঁজ পেলো না তারা তখন নিরাশ হয়ে চলে যেতে ধরলো।ঠিক তখনি প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হলো।সেজন্য ইভানরা আর চলে যেতে পারলো না।তারা সবাই মিলে মুন্সিগঞ্জেই রয়ে গেলো।এলাকার চেয়ারম্যান ইভানদের নিয়ে তার বাড়ি চলে গেলেন।আর অনেক খাতির যত্ন করতে লাগলেন।
ইভানের মন টা স্থির হতে পারছিলো না।সে শুধু ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু বৃষ্টি কিছুতেই থামলো না।বৃষ্টির সাথে সাথে তুমুল বেগে বাতাসও বইতে লাগলো।এদিকে চেয়ারম্যান ইভানদের আদর যত্নের কোন কমতি রাখলেন না।চেয়ারম্যান ভেবেছে ইভান অবিবাহিত। সেজন্য তিনি তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন। সেজন্য ওনার মেয়েকেই খাবার পরিবেশন করতে বললেন।ইভানের খাবারের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিলো না।সে শুধু ভাবছে কখন বের হবে এই বাসা থেকে।তার অস্থিরতা কিছুতেই থামছিলো না।

চেয়ারম্যান ইভানের গ্রামের ঠিকানা জানতে চাইলো।তার বাবা কি করে বা তারা থাকে কোথায় এসব জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ইভান তখন বললো তারা শহরে বড় হয়েছে।আর তার বাবা একজন নামকরা উকিল।চেয়ারম্যান ইভানের কথা শুনে খুব খুশি হলেন।তিনি খুশি হলেন এটা ভেবে যে ইভানের ফ্যামিলিও অনেক ভালো।সে শুধু নিজে একজন সি আই ডি অফিসার নয়।তার বাবাও একজন উকিল।এমন ঘরই তিনি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলেন।কিন্তু নিজের মুখে বলতে পারছিলেন না।সেজন্য বুদ্ধি করে তিনি ইভানদের বাসার ঠিকানা নিয়ে নিলো।আর ইভানকে জানায় শহরে গেলে তার বাসায় যাবে।

বৃষ্টি পড়ার গতি কিছুটা কমে গেছে।তবে এখনো টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।ইভান সেজন্য আর এক মুহুর্ত ও দেরী করলো না।সবাইকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।তবে সে চেয়ারম্যান এর ব্যবহার এ এতোটাই মুগ্ধ হলো যে যাওয়ার সময় তার ফোন নাম্বারও দিয়ে গেলো আর বলে গেলো কখনো কোনো দরকার হলে অবশ্যই যেনো তার সাথে যোগাযোগ করে।

হঠাৎ চেয়ারম্যান ইভান কে জিজ্ঞেস করলো তারা কেনো খুঁজছে এই মানুষ দুইজনকে?তারা কি অপরাধ করেছে।ইভান তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বললো।চেয়ারম্যান আকবরের কথা শুনে বললো,আপনারা যে কোন আকবর কে খুঁজছেন বুঝতে পারছি না।আমি শুনেছি একসময় আকবর নামে একজন নামকরা সন্ত্রাসী ছিলেন এই গ্রামে।
সন্ত্রাসীর নাম শুনে সবাই চমকে উঠলো। ইভান তখন জিজ্ঞেস করলো তিনি কই আছেন এখন?বা ওনার আত্নীয় স্বজন এদের কোনো খোঁজ দিতে পারবেন?
–আকবর বেঁচে নেই।আর ওনার আত্নীয় স্বজনের ব্যাপারে কিছু জানি না।তবে ওনার একজন ছেলে আছে।খুবই ভালো মানুষ তিনি।বাবার মতো সন্ত্রাসী হয় নি।শহরে পড়ালেখা করে ওখানেই চাকরি পেয়েছে।আর ওখানেই বিয়ে শাদি করেছে।
ইভান কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা আকবরের সেই ছেলের নাম কি?
চেয়ারম্যান সাহেব কোনো দ্বিধা ছাড়াই বললেন মুহিব চৌধুরী।
মুহিব নাম শোনামাত্র ইভানের মনে হয় পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। এদিকে দিশান,শুভ্র আর নীলয় একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। ইভান তখন বললো আপনি শিওর যে ওনার ছেলের নাম মুহিব?
–কি বলছেন এসব?শিওর মানে?ওনাকে সবাই ভালো করেই চেনে।আপনি গ্রামের সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।মুহিব সাহেব কে চেনে না এমন কোনো লোক নেই এ গ্রামে।
ইভান চেয়ারম্যান এর কথা শুনে তার বাবার ছবি দেখিয়ে বললো দেখেন তো ইনি সেই মুহিব নাকি?
–হ্যাঁ ইনিই সেই মুহিব।তখনকার সময়ে আমাদের গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষিত ছেলে ইনি।এখনকার ছেলেমেয়েরা ওনার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তারাও পড়ালেখায় ভীষণ মনোযোগী হয়েছে।
ইভান আর স্থির থাকতে পারলো না।তবুও সে কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো কিন্তু এ মুহিবের তো বাবা মার নাম অন্য।ওনার বাবা মার নাম তো আকবর ও মুন্নি নয়।
চেয়ারম্যান সেই কথা শুনে বললো,আকবর আর মুন্নি তো মুহিবের নিজের বাবা মা না।ওনারা মুহিব কে দত্তক নিয়েছে।
ইভান আর এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে গেলো।ইভানের এমন অবস্থা দেখে দিশান,নীলয় আর শুভ্র কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না।ইভান কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

#চলবে,