অনুভূতির খাঁচায়
অন্তিম পর্ব [প্রথম অংশ]
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
তিন বছর পর
‘ইসমাত ভবনে’ হৈচৈ মেতে আছে। ছোট্ট সিয়ারার চিৎকার চেঁচামেচিতে সম্পূর্ণ ইসমাত ভবন মেতে আছে।
সিয়ারা এদিক থেকে ওদিক দৌড়াচ্ছে। তার পিছনে দৌড়াচ্ছে সভ্যের মা। হাতে খাবার নিয়ে। সে কিছুতেই খাবে না। সভ্যের মা বলে, “আমার দাদুমণিটা না ভালো, আসো খেয়ে নেও। দাদীর পা ব্যাথা হয়ে গেছে তো।”
ইনারা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সে কাল রাত দেরিতে এসেছে। নতুন মুভি একদিন আগেই রিলিজ হয়েছে তাই প্রমোশনে ছিলো। এখন তার কাজ শেষ। দুইমাসের ব্রেক নিবে। রাতে দেরিতে আসার কারণে একটু আগে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নিচে নামে। নিচে নামতেই সিয়ারার দুষ্টুমিতে দেখে। সিয়ারা শুধু দৌড়েই যাচ্ছে। সে যেয়ে সিয়ারাকে কোলে তুলে নিলো। তার ফোলা ফোলা গালে লম্বা একটা চুমু খেয়ে কেটে কাতুকুতু দিয়ে বলল, “দুষ্টু মেয়ে দাদীমণিকে কেউ এভাবে বিরক্ত করে?”
“খাবো না।” সিয়ারা থেমে থেমে বলল।
“ঠিকাছে তাহলে মা খেয়ে নিলাম।” বলে সে হা করে। সভ্যর মা হেসে তাকে ভাতের নলা দিতে গেলে সিয়ারা তার দাদুমণির হাত ধরে নেয়, “না না খাবো।”
“আমার হিংসুটে মেয়ে।” আরেকটা চুমু খায় সিয়ারার গালে। তারপর তাকে কোলে করে নিয়েই যেয়ে বসে সোফায়। সভ্যর মা সিয়ারাকে খাওয়ানোর সময় বলে, “তোকে না বলেছিলাম ওকে এত কোলে নিবি না। তোর এখনো সবে দুইমাসে পড়েছে প্রেগন্যান্সি। সিয়ারার সময় যে কমপ্লিকেশন হয়েছিল তোর নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া লাগবে।”
সে সভ্যর মা’কে একপাশ থেকে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে আদুরে স্বরে বলে, “তুমি তো আছো আমার খেয়াল রাখার জন্য।”
“বলছি কি ক’দিনের ছুটি নে কাজ থেকে।”
“দুইমাসের ব্রেক নিয়েছি মা। তারপর ছোটখাটো প্রজেক্ট নিব। শর্ট ফিল্ম বা প্রচারিত জিনিসের আরকি। সাতমাসের সময় আবার লম্বা ব্রেক নিব।”
“একদম ভালো করেছিস। সভ্য কী আজকে আসবে?”
“আসবে না মানে? জনাব আমাকে ছাড়া তো থাকতে পাড়ে নিজের মেয়েকে না দেখলে তো তার জীবন বের হয়ে যাবে।”
সভ্যর কথা শুনে সিয়ারা লাফিয়ে উঠে, “বাবা…বাবা।”
ইনারা তার গাল টেনে বলে, “বাবা রাতে আসবে। সারাক্ষণ বাবা আর বাবা। নয়মাস পেটে তোকে আমি রেখে তোর লাথি ঘুষি খেয়েছি বুড়ি। তোর বাবা না। বাবা মেয়ে একে অপরকে পেলে তো আমাকে ভুলেই যায়।”
সিয়ারা তার কথা না বুঝে গালে হাত দিয়ে ডানদিকে মুখ ঝুঁকায়।
কলিংবেলের শব্দ শুনে ইনারা উঠে দাঁড়ায়, “মনে হয় সুরভি এসে পড়েছে।” বলে সে দৌড় দেয় দরজা খুলতে।
সভ্যর মা পিছন থেকে বলে, “এই দৌড়াদৌড়ি করিস না।”
কে শুনে কার কথা! সে দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলে সুরভিকে দেখে জড়িয়ে ধরতে নেয়। কিন্তু সুরভিকে তাকে না দেখার মতো করে পাশ দিয়ে দৌড়ে যেয়ে ধরে সিয়ারাকে। ইনারা হাত এখনো উঁচু করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
অভ্র একটুপর লাগেজ নিয়ে এসে ইনারাকে দেখে সরু দৃষ্টিতে তাকায়, “তোমার কী কোনো শক লেগেছে?”
তখনই ইনারার নাটক শুরু হয়,”দুলাভাই দেখেন এই মেয়ে আসার পর আমার সব পাত্তা উধাও হয়ে গেছে। এখন আর কেউ আমাকে দুই পয়সার পাত্তা দেয় না।” বলে নাটকীয় কান্না শুরু করে।
অভ্র বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে, “এই মেয়ে তোমারই মেয়ে।”
“তো তাই বলে আমার সব পাত্তা চুরি করে নিবে?”
অভ্র চোখ ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়।
সুরভি সিয়ারাকে কোলে নিয়ে কতগুলো চুমু খায় তার গালে মুখে। তাকে কোলে নিয়ে বসে এক বড় বক্স বের করে ব্যাগ থেকে। দেখো, “দেখো তো সিয়ামণি সুরু মা তোমার জন্য কী কী এনেছে!”
বক্সে কুকিস ও কাপকেক ভরা। তা দেখে সিয়ারার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সিয়ারা তার ছোট্ট হাত দিয়ে সিয়ারার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “সুরু মা বেস্ট।” বলে একটা হাতে কুকি নিয়ে ছোট ছোট কামড় দেয়।
তার দাদী বড় নিশ্বাস ফেলে, “হলো আর ওর ভাত খাওয়া। সুরভি ওর খাওয়া শেষে আমরা কিন্তু মার্কেটে যাব। তোমার লেহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে মাথার ওড়নাটা এখনো নেওয়া হয় নি।”
“আচ্ছা মা।”
ইনারা দৌড়ে এসে সোফায় বসে, “আমিও যাব।”
“একদম না। এমনিতেই এই কয়দিন সারাদিন কাজে দৌড়াদৌড়িতে ছিলি। কাল থেকে আবার অনুষ্ঠান শুরু। এখন তুই রেস্ট করবি?”
“মা এখন তুমিও আমাকে পাত্তা দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছো। বড়বউ আসবে বলে আমার এখন আর পাত্তা নেই। হুঁহ ইনারা রাগ করেছে।” বলে সে মুখ ফুলিয়ে নেয়।
“নাটক করে লাভ নেই। আজ সারাদিন তোকে রেস্ট করতেই হবে। আমি তোর পছন্দের ম্যাংগো কাস্টার্ড বানিয়েছি। ভাত খেয়ে ওটা খাবি। খালি পেটে খেলে মাইর দিব।” বলে মা চলে গেলেন।
সিয়ারা তালি দিলো তখন, “মা বকা খেয়েছে। বকা খেয়েছে।”
ইনারা ছোট ছোট চোখে তাকায় তার দিকে, “মা বকা খায় নি কিন্তু সিয়ারাকে এখন ভাত না খেয়ে কুকি খেলে ঠিকই সিয়ারাকে বকা দিবে।”
“না কুকি খাব। খাব। খাব।” সে মুখ ফুলিয়ে সুরভির কোল থেকে নেমে অভ্রর কাছে গেল। তার পা’য়ের কাছে যেয়ে দুইহাত হাওয়ায় তুলল। অভ্র মোবাইলে কাজ করছিল। তাকে দেখে হেসে তাকে কোলে তুলে। তার মুখের কুকি ক্রাম্বাল রুমাল দিয়ে মুছে দেয় আদর করে। সিয়ারা তোঁতলিয়ে বলে, “বড় পাপ্পা বেস্ট।”
অভ্র হাসে। তাকে বুকে শুইয়ে রেখে নিজে মোবাইলে কাজ করতে থাকে।
ইনারা সুরভির দিকে ঝুঁকে বলে, “তোর জামাই সবার সাথে খাটাইশের মতো কথা বললে কি হবে বাচ্চাদের যে আদর করে বিয়ের পর পর তোর জন্য ফুটবল টিম বানায় দিবে।”
সুরভি চোখ বড় বড় করে তাকায় ইনারার দিকে, “সে কথাটা বলেছে তুই কীভাবে জানিস? আমি তো তোকে বলিনি।”
ইনারা বেক্কলের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সজোরে হেসে দেয়। হেসে গড়াগড়ি করতে শুরু করে সোফার মধ্যে।
অভ্র তারে কান্ডে অবাক হয়ে তাকায়। সিয়ারাও ড্যাবড্যাব করে তার মায়ের হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।
“মা কেন হাসে?”
অভ্রও জিজ্ঞেস করে অবাক হয়ে, “ওর কী হয়েছে?”
সুরভি ইনারার মুখে হাত রেখে বলে, “মিরকির ব্যারাম উঠছে ম্যাডামের।”
অভ্র বিরক্তি প্রকাশ করে, “তোমাদের জ্বালায় পাড়ি না। তিনবছর পর এখন তোমাকে বিয়ে করার সৌভাগ্য হচ্ছে। রিপোর্টার হয়েছ একবছর আগে। এই এক বছর তোমার পিছনে ঘুরার পর হ্যাঁ বললে। এখন দুইদিন পর বিয়ে আর জোহান এই মুহূর্তে বিদেশে গেছে, সভ্য অফিসের কাজে ব্যস্ত, মায়ার সাথে যোগাযোগ করতে পাড়ছি না চারদিন হলো। তোমাদের শপিং হয় নি। এই ঘর দেখে কেউ বলবেই না বিয়েবাড়ি। এখন আবার ইনারা। থাকো তোমরা।”
অভ্র সিয়ারাকে কোলে তুলে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। তার এমন রাগ দেখে ইনারা বলে, “আমি কী করলাম ভাই?”
সুরভি হাত নাড়িয়ে বলল, “আরে গত একসাপ্তাহ ধরে ভালো করে ঘুমায় না তাই মাথা গরম। শিক্ষামন্ত্রী হয়েছে কি-না! তো অনেক কাজ থাকে। এর মধ্যে কি একটা প্রজেক্ট ছিলো সভ্য ভাইয়া পঞ্চসুরের গ্রুপ এক্টিভিটিতে ব্যস্ত থাকার কারণে সেটা উনার সামলাতে হয়েছে। লাস্ট এক সাপ্তাহে সব কাজ গুছাচ্ছিল। বিয়ের পর না’কি এক সাপ্তাহ ছুটি… ” বলতে যেয়ে থেমে গেল। ভয়ে ভয়ে তাকাল ইনারার দিকে। ভুল মানুষের সামনে ভুল কথা তুলে ফেলল সে! সে আমতা-আমতা করে বলল, “মা… মা ডেকেছিল।”
ইনারা একগাল হেসে তার হাত ধরে বলে, “বিয়ের পর একসাপ্তাহ ছুটি। হানিমুনে যাবা তোমরা জান? আমার ভাসুর এত রোমেন্টিক হবে দেখে তো বুঝাই যায় না।”
“যাহ নিলজ্জ মেয়ে!”
“বাসররাতে এমন লজ্জা পেলে আমার আর খালামণি উপস চাচী হওয়া লাগবে না।”
“তোর সাথে কথা বলা আর মাথায় হাতুড়ি মারা এক কথা।” বলে সুরভি উঠে গেল।
ইনারার কোনো কাজ না থাকায় সে ফোন বের করল। ফেসবুকে ক্রল করছিল তখন একটা নিউজ দেখতে পেল…
সুপারস্টার জোহান এখন দেশে নিজের নাম ছড়িয়ে বিদেশেও নিজের গানের সুর ছড়াতে ওয়ান্ডার রেকর্ডের সাথে নতুন কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা করতে গেছেন নিউইয়র্কে।
.
.
আমেরিকা, নিউইয়র্কের একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছে জোহান। সে বারবার নিজের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। এখান থেকে তার আবার দেশে ফেরার কথা। চার ঘন্টায় তার প্লেন আছে। সে বিরক্তি নিয়ে নিজের সামনে বসা এজেন্টকে বলে, “আর কতক্ষণ? আমার ফ্লাইট আছে আবার। আপনাদের বসের কি টাইম ম্যানেজমেন্ট এর সেন্স নেই?”
“স্যার একটু অপেক্ষা করুন। ম্যামের সাথে আপনার দেখা করার কথা আটটায়। এখনো তিন মিনিট বাকি। আমাদের ম্যাম কখনো লেইট করে না। ম্যাম সব কিছুতে পার্ফেক্ট।”
কথাটা শুনে জোহান বিরক্ত হলো। কারণ এমন এক মানুষ তার চেনা আছে। অথবা ছিলো। সে আবার মোবাইলের দিকে তাকাল। সামির সাথে কথা বলেছে তাদের গ্রুপ এক্টিভিটি নিয়ে। দুইবছর হলো তারা আবার পঞ্চসুর হিসেবে গান শুরু করেছে। বছরে একবার তারা পঞ্চসুর হিসেবে কামব্যাক করে আর বাকিমাস নিজেদের কাজ করে থাকে।
“ম্যাম এসে পড়েছে।” তার পাশে বসা ছেলেটা বলল। তার কথা শুনে জোহান সামনে তাকায়। দেখে ব্লু প্যান্ট ও স্কাই ব্লু শার্ট পরা একটি মেয়ে তাদের দিকেই আসছে। তার চুলগুলো কোমড় ছাড়িয়েছে। তাকে দেখেই জোহান যেন নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। তার হৃদ স্পন্দন বাড়ল অস্বাভাবিকভাবে। নিজ অজান্তেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে একটি শব্দ বেরিয়ে আসে, “মায়া!”
ছেলেটার কন্ঠে তার ধ্যান ভাঙে, “স্যার উনি আমাদের মেনেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের হেড। মায়া চৌধুরী।”
মায়া তার চোখের চশমাটা তুলে মাথায় রাখল। হাত বাড়াল জোহানের দিকে, “হ্যালো মিস্টার জোহান। আপনার নামে অনেক শুনেছি, দেখেছি। হোপ সো আপনি আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করবেন। আপনার স্টারডম আমরা আরও ছড়াতে পাড়ব।”
জোহান কপাল কুঁচকায় তার কথায়। তার ভীষণ বিরক্ত লাগল। মায়া এমন ভাবে কথা বলছে যেন এই প্রথমবার তাকে দেখেছে। তাকে চেনেই না।
জোহান উত্তরই কিছু বলল না। মায়ার সাথে হাত মিলাতেই তার বুক পিঞ্জরায় অনুভূতিরা ছটফট করতে শুরু করল। সে বসে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল মায়ার দিকে। কিন্তু মায়া তার দিকে একবারও তাকাল না। তার সাথে আসা ছেলেটি তাদের কন্টেক্টের সব বুঝাল। কিন্তু জোহানের সেদিকে ধ্যানই নেই। তার ধ্যান এখন সম্পূর্ণ মায়ার উপর। তার উপর রাগ, অভিমান, দুঃখ সব ভাসছে। সে হঠাৎ তিনবছর আগে যে গেল আজ তার দেখা পাচ্ছে জোহান। না কোনো কথা, না কোনো খোঁজ। যেন একবারে উধাও হয়ে গিয়েছিল সে। আরও বেশি রাগ উঠছে মায়ার ব্যবহারে। মায়া যেন তাকে চিনেই না। সে অপরিচিত কোনো লোক।
কথার মাঝে মায়া তাদের বলে গেল ওয়াশরুমে। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই হঠাৎ হাতে টান অনুভব করে সে। অনুভব করে কেউ একজন তার হাত ধরে টান দিয়েছে। সে মাথা ঘুরিয়ে দেখে জোহান। জোহানকে দেখে সে কিছু বলে না। অন্যকেউ হলে এতক্ষণে মাথা ফাটিয়ে দিত।
জোহান তার হাত ধরে নিয়ে যেয়ে এক দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। মায়া বিরক্তির সুরে বলে, “এটা কোন ধরনের বেয়াদবি?”
“বেয়াদবি? আমি বেয়াদবি করছি। তাহলে তুমি কী করলে? তিনবছর আগে হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলে। তারপর আজ দেখা দিচ্ছো। আর এমন ব্যবহার করছ যেন আমাকে চিনোই না।”
মায়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
জোহান আবার জিজ্ঞেস করে, “ওহ হ্যাঁ আশরাফ বলেছিল আতিফ না’কি নিউইয়র্কে সিফট হয়েছে। এখন অনেক বড় ডাক্তার? আতিফের সাথে এখানে এসেছ তুমি তাই না? ওর তো ত্রিশ বছর হয়ে গেছে। তোমারও হবে। তাহলে তোমার সো কল্ড ওয়াদা পূরণ করেছ?”
“আমি এখন এনগেজড।”
কথাটা শুনে যেন জোহানের উপর বজ্র পড়ে। যেন খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে পানি এসে পড়ে। সে ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে। রাগে, দুঃখে, অভিমানে তার চিৎকার করতে মন চাইছে। তবুও সে চুপ। সে মায়ার থুতনিতে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরায়, “আমার কথা তোমার একবারও মনে পড়ে নি মায়া? এতবছরে একবারও না? আমি তো এক মুহূর্তের জন্যও তোমায় ভুলতে পাড়লাম না।”
“কেন? তুমিই তো বলতে সময়ের সাথে সাথে অনুভূতি হারিয়ে যায়। তাহলে তোমার হারায় নি এখনো?”
জোহানের গলা ধরে আসছিল। তার খুব করে ইচ্ছে হলো মায়ার কেশগুলো ছুঁয়ে দিতে। ইচ্ছাটায় গুরুত্ব দিলো না। তার গলা ধরে এলো, “তোমার জন্য হারায় নি। হয়তো কখনো হারাবেও না। কিন্তু তুমিই হারিয়ে গেলে।”
বলে দূরে সরে সে। ভারী কন্ঠে বলে, “কনগ্রেটস এনগেজমেন্টের জন্য।”
“থ্যাঙ্কিউ।” মায়া দৃঢ় স্বরে বলে।
জোহান কেমন বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকায় তার দিকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নেই। আর মিটিং এ যায় না। তার ইচ্ছা নেই আর। সে সোজা বেরিয়ে যায় রেস্টুরেন্ট থেকে। যাবার সময় আতিফের সাথেও তার দেখা হয়। তাহলে মায়ার আতিফের সাথে আজ প্লান ছিলো? জোহানের এই সময় নিজের উপরই রাগ হয়। প্রেমে পড়াটাই তার দোষ ছিলো। সে জানতো সুখ তার কপালে নেই। তাহলে কেন সে আবারও সুখের আশায় ছিলো? মায়া নামের সুখপাখিটা যে অন্যকারো কপালে ছিলো। ভাবতেই তার বুকে ভীষণ ব্যাথা উঠলো।
এবার সে সত্যিই চাইতো সে যেন এই ভালোবাসাটাকে জলদিই ভুলে যাক। কিন্তু এবার যত ভুলতে চাইলো আরও মনে পড়লো তার মায়াকে। মায়ার নয়নজোড়া তার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে সোজাভাবে দাঁড়াতেও পাড়ছিলো না। পাশে দেয়ালের সাহায্যে দাঁড়াল। তারপর কষ্টে এক ঘুষি দিলো সে দেয়ালে। হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লো। সেখানেই বসে পড়ে সে।
.
.
আতিফ রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখে মায়া টেবিলে বসে আছে। সাথে সজীব। মায়ার এসিস্ট্যান্ট। আতিফ যেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “মায়া জোহানের সাথে তোমার কী কথা হয়েছে দেখলাম বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি ডাকলাম উওর ফিলো না।”
সজীব তখনই দাঁড়ায়, “মিস্টার জোহান চলে গেলে? মিটিং এর মাঝখানেই? ভেরি আনপ্রফেশনাল। আমি এখনই দেখে আসছি ম্যাম।”
মায়া মাথা নাড়ায়। সজীব গেলে আতিফ তার সামনের টেবিলে বসে, “ছেলেটাকে আর কত কষ্ট দিবে? মায়া আসলেই তোমার মনে মায়া দয়া নেই।”
“তোমার বেশি দরদ উতলে পড়ছে ওর জন্য? নিজের জন্যই কষ্ট পাচ্ছে৷ ওরই বেশি ভবিষ্যৎবাণীর শখ ছিলো। ভবিষ্যতে যদি অনুভূতি না থাকে! তাই দূরে গিয়ে ওকে বুঝালাম ভালোবাসলে অনুভূতিরা সবসময়ই মনের খাঁচায় বন্দী থাকে।”
“তুমি এটা একারণে করেছ কারণ জোহান তিনমাস তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। তার শাস্তি দিয়েছ।”
“তো আমি অস্বীকার করছি না’কি? আমি তো আগেই বলেছি আমি যাদের ভালোবাসি তাদের দেওয়া কষ্ট সুদসহ ফিরিয়ে দেই। আর ওকে তো আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
“তাই ওকে সহ নিজেকেও কষ্ট দিয়েছ। তোমার কী মনে হয় মাঝেমধ্যে তোমার চোখ যে লালবর্ণ হয়ে থাকে তুমি যে সারারাত কান্না করো তা আমি বুঝি না? তুমি ইন্টারন্যাশনালি এন্টারটেইনমেন্টে অফার পাচ্ছো চারবছর ধরে। তুমি তিনবছর আগে কেবল জোহানের জন্য এত বড় অফার মানা করে এসেছিলে। তারপর সেদিন রাত তিনটায় আমাকে কল করে বললে তুমি অফার এক্সেপ্ট করেছ। আমি যেন আমার সাথে তোমারও ফ্লাইট বুক করি। তুমি এখানে তিনবছরের জন্য কন্ট্রাক্ট সাইন করেছ। কেবল তিনবছরের জন্য কেন কন্টাক্ট সাইন করেছ আমি জানি না ভাবছ? কাল তুমি একবারে আবারও দেশে শিফট হয়ে যাবে। তাহলে অকারণে আজ ছেলেটাকে কষ্ট দেবার কী দরকার ছিলো?”
“আমি তো শুধু বলেছি আমি এনগেজড। ওই গর্দভ নিজেই নিজের মস্তিষ্কে বাকি সব কল্পনা করে নিলে আমার কী দোষ?” মায়া নিজের বাম হাত তুলে বলে, “ওই আমাকে রিং পরিয়েছিল। অফকোর্স আমি ওর সাথেই এনগেজড। এতটুকুও মাথায় ঢুকে নি ওর?”
আতিফ হাসে, “তুমি একটা জিনিস বটে। তো সি-ই-ও ম্যাডাম কেবল আপনাকে এই কোম্পানিতে রাখার জন্য যে দেশে নতুন ব্রাঞ্চ খোলা হবে তার কী খবর?”
“মোটেও আমার জন্য না। এটার প্লানিং কয়েকবছর ধরেই চলছে। কেবল আমি রেজিগনেশন দেওয়ার সময় ফাইনালাইজড হয়েছে।”
“বাট তুমি এখন সি-ই-ও হবে তো। পার্টি তো লাগবে।”
“পার্টি তো আমারও লাগবে। তোমার আর ক্যাথরিনের বিয়েতে যে থাকব না।”
আতিফ হাসে, “তোমার আর জোহানের বিয়েতে ওকে নিয়ে থাকার চেষ্টা করব। যদি সে এত সময় দেয়। তো কাল রাতে যাচ্ছো অবশেষে দেশে।”
মায়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, “অবশেষে যাচ্ছি আমার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে।”
.
.
মায়া নিজের দেশে পা রাখে আজ তিন বছর পর। এয়ারপোর্টের বাহিরে আসতেই মায়াকে এসে ঝাপটে ধরে তন্নি। তন্নি ও আশরাফ তাকে রিসিভ করতে এসেছিল। তাদের সাথে সে প্রথমে বাসায় যায় না। সোজা যায় মেঘবাড়ির সামনে। তবে গাড়ি থেকে নামে না। জানালা খুলে দেখে ভেতরের দৃশ্য। মেঘলা উঠানে বসে বই পড়ে শোনাচ্ছে তার আশেপাশে বাচ্চাদের। পাশে কিছু বাচ্চারা ফুটবল খেলছে, তো কিছু মেয়েরা কুতকুত খেলছে। বাড়ির সিঁড়িতে বৃদ্ধ মহিলারা বসে গল্প করছে। রিয়াদ এক ট্রেতে কতগুলো চা’য়ের কাপ নিয়ে এসেছে। সে বৃদ্ধ মহিলাদের তা দিয়ে মেঘলার কাছে আসলো। মেঘলা একগাল হেসে তার থেকে কাপটি নিলো। দৃশ্যটা দেখে বড় এক নিশ্বাস ফেলে হাসল মায়া। তার পাশে বসা তন্নি বলল, “যেয়ে কথা বলবি না?”
“উঁহু, এতটুকু দেখেই শান্তি লাগছে। যেদিন ওর আঘাতগুলো প্রথম দেখেছিলাম সেদিন থেকে তৌফিককে শাস্তি দেওয়া পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি।”
“শাস্তি? এত সহজ মৃ’ত্যু তো ওই জানোয়ার ডিসার্ভই করে না।”
“থাক বাদ দে। বাসায় চল। সন্ধ্যায় আবার সুরভি ও অভ্রের হলুদের জন্য রওনা দিতে হবে।”
“এটা বল যে জোহানকে দেখার জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে আপনার।”
কথাটায় মায়া মৃদু হাসে। জানালার ওপাড়ে আবার মেঘলাকে দেখে। তৌফিকের আসল মৃত্যুর ব্যাপারে তারা কয়জন বাদে কেউ জানে না। এখানে আনার একমাস পর্যন্ত তৌফিক বেঁচে ছিলো। প্রতিদিন সে যেমন মেয়েদের যন্ত্রণা দিতো তাকেও মেয়েরা একই যন্ত্রণা দিয়েছিলো। কিন্তু তার এত সহ্য ক্ষমতা ছিলো না। একমাস পর এই যন্ত্রণাময় জীবন সহ্য করতে না পেড়ে দেয়ালে মাথা মেরে মেরে নিজেকেই শেষ করল তৌফিক। আত্নহ’ত্যা করে পরকালেও পাপের ঝুলিটা আরও বাড়িয়ে চলে গেল।
.
.
বৃষ্টিবাড়ি নামক রিসোর্টে বিয়ে হবার কথা অভ্র আর সুরভির। অভ্র নিজে এই রিসোর্টটি বুক করেছে। ঢাকার বাহিরের দিকে। রিসোর্টটার আশেপাশে খোলামেলা। চারদিকে গাছ-গাছালি, পুকুর। রিসোর্টে ছোট ছোট ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝখানে বড় একটি স্থান খালি আছে। যেখানে তাদের অনুষ্ঠান হবে। কেবল কাছের কয়জন নিয়েই তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ করবে। আগামী শুক্রবার বড় করে অনুষ্ঠান হবে। জায়গাটা দেখে সবার অনেক পছন্দ হলো। সকলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই আসার সময় দেখে আজকের হলুদের জন্য স্টেজ বানানো হচ্ছে। সভ্য সেখানে মানুষদের কাজের নির্দেশনা দিচ্ছে। হাতে কফির মগ। ইনারা তাকে দেখে ধীর ধীর পা’য়ে তার কাছে যায়। তার পিছনে যেয়ে দুষ্টু হাসি দেয়। তার কানের কাছে এসে ‘ভাউ’ করে চিৎকার দিলে সভ্য পিছনে তাকায় মুখ বানিয়ে, “ওয়াও আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।”
ইনারা চোখমুখ কুঁচকে নেয়। সভ্য জিজ্ঞেস করে, “আমার প্রিন্সেস কোথায়?”
“মাঝেমধ্যে প্রিন্সেসের আম্মুরও খোঁজ নিয়ে দেখেন জনাব। আপনার প্রিন্সেস আসার পর তো আমার জন্য আপনার সময়ই হয় না।”
“এত বড় মিথ্যা কথা বলছেন মহারাণী!” সভ্য দুষ্ট হেসে তার দিকে এগোয়। তার পেটে হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে বলে, “তাহলে ও আসলো কোথা থেকে?”
ইনারা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়, “অসভ্য লোক কোথাকার!”
সভ্য শব্দ করে হেসে দেয়। এমন সময় সিয়ারা আসে সুরভির সাথে। সভ্যকে দেখতেই সুরভির কোল থেকে নেমে ‘বাবা’ ‘বাবা’ করে সভ্যর দিকে দৌড়ে আসে। সভ্যও ইনারার হাতে মগটি দিয়ে নিচে বসে দুইহাত মেলে তার রাজকুমারীকে বুকে ভরে নেয়। তারপর দাঁড়ায় তাকে কোলে তুলে। সিয়ারা কতগুলো চুমু খায় সভ্যর গালে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “বাবা মিস করেছি।”
সভ্যও তার গালে গাঢ় একটা চুমু খায়, ‘”বাবা প্রিন্সেসকে বেশি মিস করেছে।”
ইনারা ভেংচি কেটে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ প্রিন্সেস বাবাকে মিস করেছে, প্রিন্সেসের বাবা প্রিন্সেসকে মিস করেছে। প্রিন্সেসের মা কি ইনভিজিবল না’কি?”
সিয়ারা ও সভ্য ঠোঁট টিপে হাসে। ইনারা এতে আরও তেলে বেগুণে জ্বলে উঠে, “খুব হাসি পাচ্ছে না। বাবা মেয়ে ভালো টিম বানিয়েছ। আমার পুচকু আসুক। আমার টিমে থাকবে। দুইটার একটাকেও তখন পাত্তা দিব না।”
সিয়ারা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে ইনোসেন্ট মুখে বলে, “নো নো মা, আই লাভ ইউ এত্তগুলা।”
ইনারা বুকে হাত রেখে বলে, “ওলে আমার রসগোল্লাটা। মা তোকে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তুই এত কিউট কেন? একদম রসগোল্লার মতো। গাল দুইটা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে।” বলে টুস টুস করে কতগুলো চুমু খায় সিয়ারার গালে।
সভ্য বলে,” আর আমি?”
ইনারা একগাল হেসে তার অন্য হাতে কফির মগ ধরিয়ে দিয়ে বলে, “যেমন আপনার কফি তেমন আপনি। তেঁতো।”
“লজ্জা লাগে না এসব বলতে। মেয়েরা এখনো আমার পিছু ঘুরে। আর আমি কেবল তোমার পিছনে ঘুরি। এত হ্যান্ডসাম স্বামী পেয়েও কদর করলে না।”
“অন্যকাওকে পাত্তা দিলে আপনার হাড্ডি গুড্ডি আস্তো থাকবে? অসভ্য লোক কোথাকার!”
সিয়ারা ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে। মাথায় হাত রাখে, “মা বাবা একদম টম এন্ড জেরি।”
ইনারা তাকে কোলে নিয়ে বলে, “এই বুড়ি তোকে আজ সবজি খাওয়াচ্ছি দাঁড়া।”তারপর সভ্যকে বলে, “এখন ওকে ঘুম পাড়াই, নাহলে রাতে কান্নাকাটি করবে। আমার জন্য কফি পাঠিয়ে দিয়েন তো। এক্সট্রা সুগার দিয়ে।”
“জানি মহারাণী।”
ইনারা সুরভিকে নিয়ে ভেতরে যায় তাদের রিসোর্টের কটেজে। তাদের যাবার কিছুক্ষণ পরই সামি ও জোহান আসে। সভ্য তাদের যেয়ে জড়িয়ে ধরে। জোহানকে এমন মনমরা দেখা গেলে সভ্য জিজ্ঞেস করে, “এর আবার কী হলো?”
সামি মুখ টিপে হাসে, “ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গেছে। দেবদাস মোডে আছে এখন।”
জোহান বিরক্তি নিয়ে তার দিকে। তারপর সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “আমার রুমটা কোন দিকে?”
“এখনই রুমে চলে যাবি? এদিকে কাজ চলছে। আমি এখানেই আছি। আয় আড্ডা দেই।”
“অভ্র আর তুই ভাই বারবার কল দিচ্ছিলি বলে এসেছি, নাহলে আসতাম না। ভালো লাগছে না। মাথা ব্যাথা খুব।”
“আচ্ছা যেয়ে রেস্ট কর। অনুষ্ঠানের সময় রেডি হয়ে আসবি কিন্তু।”
“দেখি।”
“এখানে কটেজ গুলোর নাম ফুলের নামে। তোর আর সামির কটেজের নাম নয়নতারা। দাঁড়া লোক ডেকে দেই।”
“লাগবে না আমি খুঁজে নিব।”
জোহান যাবার পর সভ্য সামিকে বলে, “বেচারা বেশিই ছ্যাঁকা খেয়েছে।”
“সেই লেভেলের। মায়া আসছে তো?”
“বাংলাদেশে এসেছে। এখন তন্নির বাসায়। সন্ধ্যায় রওনা দিবে।”
“বেচারা ওকে দেখে কীভাবে রিয়াক্ট করবে তা দেখার জন্য তর সইছে না আমার।”
.
.
সন্ধ্যাবেলা,
চারদিকে সাজানো হয়েছে মৃদু আলোর ঝুলানো লাইট দিয়ে। রিসোর্টের উঠানে নীল রঙের ফুল দিয়ে স্টেজ করা হয়েছে। সামনের টেবিলে হরেক রকম মিষ্টি, হলুদ, কেক আর সাজানোর জিনিস। সেখানে হলুদ পাঞ্জাবি পরে বসে আছে অভ্র ও তার পাশে হলুদ লেহেঙ্গায় সুরভি। তাদের মাঝখানে নীল রঙের লেহেঙ্গা পরা ছোট সিয়ারা। আজ অভ্র ও সুরভি বাদে সকলেই নীল রঙের পোশাক পরেছে। হলুদের থিম।
জোহানের না চাইতেও বের হতে হয়। সভ্য এসে দশবার তাকে বকা ও হুমকি না দিলে সে বেরই হতো না। সে দেখে অলরেডি হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ইনারা, সভ্য, সামি, ঐশি, ইরফান সবাই মিলে তাদের হলুদ লাগাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে তারা। তাদেরকে দেখে জোহানের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠলো কিন্তু তার সেখানে আর যেতে ইচ্ছে হলো না। তার ভীষণ তৃষ্ণা পেলে সে একপাশে যায় টেবিল থেকে কোল্ডড্রিং নেওয়ার জন্য। সে কোকের গ্লাস হাতে নিয়ে আবারও স্টেজের দিকে তাকাতেই থেমে যায়। স্থির হয়ে যায় কয় মুহূর্তের জন্য। সে অতি চেনা মুখ দেখতে পায় সেখানে। নীল জামদানী পরা সদ্য এক অপ্সরী যেন মেঘের রাজ্য থেকে নেমে এসেছে। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এটি নেহাৎ তার কল্পনা। কিন্তু পরক্ষণে যখন সে দেখল মায়া ইনারাকে জড়িয়ে ধরেছে, সভ্যর সাথে কথা বলছে, সুরভি অভ্রকে হলুদ মাখছে তখন তার ধ্যান এলো। সে মায়াকে কল্পনা করছে না, বাস্তবে মায়া এসেছে এখানে।
তাকে দেখে জোহান স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এরপর মায়া মুখ ফেরায়। তার চোখ যেন খুঁজছে কাউকে। হঠাৎ তার এসে চোখ আটকায় জোহানের দিকে। আর তার দিকেই আটকে থাকে। এতক্ষণ ধরে জোহান নিজেকে শান্ত রাখলেও এখনো শান্ত রাখতে পাড়ল না। রাগে তার মাথা আরও বেশি ধরে গেল। সে শব্দ করে গ্লাসটা রাখল টেবিলে। মায়া যদি তাকে ছেড়ে সবার সাথে এত হেসে কথা বলতে পাড়ে, তিন বছর হারিয়ে যাবার পর অন্যকারো সাথে বাগদান করেও তার দিকে সরাসরি তাকাতে পাড়ে, তাহলে সে কেন পাড়বে না?
জোহান মিথ্যে হাসি তার ঠোঁটে এঁকে নিজেও উঠে পড়ে স্টেজে। স্টেজে উঠে একবারও মায়ার দিকে তাকায় না। উলটো হাসিমুখে যেয়ে সুরভি ও অভ্রকে হলুদ লাগায়। অবশেষে একটু লাগায় সিয়ারার নাকে। যার কারণে সিয়ারা মুখ ফুলিয়ে নেয়।
জোহান হেসে উঠে দাঁড়ায়। তাকায় মায়ার দিকে। স্বাভাবিক ব্যবহার করে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল সে মায়াকে। অথচ তাকে এত কাছ থেকে তাকে দেখে তার সেখানেই নিশ্বাস আটকে যায়।
রূপালী পাড়ের নীল জামদানী পরেছে মায়া। তার চুল এখন আর কাঁধ পর্যন্ত এসে থেমে নেই কোমর ছড়িয়েছে, সে খোলা চুলে লাগানো বেলিফুলের মালা। তার ডাগর ডাগর নয়নজোড়া নীল কাজলে ভরা। তাকে দেখে জোহান যেন নিজের মধ্যে নেই। সবই ভুলে যায়। মুহূর্তে তার হৃদয়খানার অবস্থা বেহাল হয়ে যায়।
সকলে তাকে দেখে মিটিমিটি হাসছিল। কিন্তু যখন সিয়ারা বলল, “বাবা চাচ্চু স্টাচু স্টাচু খেলছে কেন?” আর সকলে জোরে হেসে দেয়। জোহান লজ্জা পেয়ে যায় সবার সামনে। সে মাথা চুলকায়। না, মায়ার দিকে এখন আর তাকানো তার উচিত হবে না। মায়া নিজের তার পরিবর্তে অন্য কাওকে বেছে নিয়েছে। তাকে এমন বেহায়ার মতো দেখাটা নিজের জন্য একটা অসম্মানের ব্যাপার।
সে আবার নিচে নেমে যেতে চাইলে সামি তাকে ধরে নেয়। অভ্র বলে, “একটা গ্রুপ ফটো না হলে হয়? ছবি তুলে যাও।”
জোহান ইরফানের পাশে যেয়ে দাঁড়ালে ঐশি বলে, “ভাই তুমি আমার জামাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কী করবে বলো তো?” বলে তাকে সরিয়ে দেয়। তার পাশে এসে দাঁড়ালে সামিও তাদের মাঝে ঢুকে পড়ে। অবশেষে সে এসে দাঁড়ায় মায়ার পাশেই। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। শত বুঝায় নিজের মনকে, মায়ার দিকে সে কিছুতেই তাকাবে না। কিন্তু চোখজোড়া সেদিকেই যেয়ে আটকায়। একবার আড়চোখে তাকাতেই যেয়ে যখন মায়াও তার দিকে তাকায়, চোখে চোখ পড়তেই তার বুকে ঝড় নেমে আসে। সে আর থাকতে পাড়ে না সেখানে। সে ক্যামেরাম্যানকে জিজ্ঞেস করে, “ছবি তোলা হয়েছে না?”
“জ্বি স্যার ।আপনার আর ম্যামের কাপল পিক তুলে দিব কয়টা?”
“আমরা কোনো কাপল না।” সে রাগান্বিত স্বরে কথাটা বলে যেতে নিলেই মায়া তার বাহু ধরে নেয়। তার কাছে এসে বাহু ধরেই শান্তস্বরে উওর দেয়, “তুলুন।”
জোহান কপাল কুঁচকায়। বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করে, “ফাজলামো করছ তুমি?”
“কী ফাজলামো করলাম?”
জোহান দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। পাড়ে না। সে মায়ার হাতটা ধরে টেনে স্টেজ থেকে নামায়। সামি তখনই উচ্চস্বরে বলে, “অভ্রভাই দেখেন আপনার আগে আরেকজনের বিয়ে হয়ে যায় না’কি!”
জোহান মায়ার হাত টেনে গান বাজনা থেকে দূর থেকে নীরব জায়গায় আনলো। পুকুরপাড়ের এদিকটায় আপাতত কেউ নেই। এসেই সে ক্ষোভে তাকাল মায়ার দিকে। প্রথমেই প্রশ্ন করল, “কেন এসেছ তুমি এখানে?”
“অভ্র সুরভির বিয়ে। ইনারা, আমার বন্ধুবান্ধব সবার কথা মনে পড়ছিল। আসব না?”
“এতবছর পর তোমার সবার কথা মনে পড়ছে? তিন বছর আগে যখন সবাইকে রেখে গিয়েছিলে তখন মনে পড়ে নি?” ক্ষোভে কথাটা বলে সাথে সাথে তার মাথায় আসে, “ওয়েট তোমার সবার সাথে যোগাযোগ ছিলো?”
“হ্যাঁ।” নির্বিকার উওর মায়ার।
উওরটা জোহানের বুকে তীরের মতো লাগে। সে এক’পা পিছিয়ে যায় আপনা-আপনি। অবিশ্বাস্য সুরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সবার সাথে যোগাযোগ ছিলো, সবার সাথে কথা বলেছ। আমি আমি তোমাকে এত কল দিলাম, এত যোগাযোগের চেষ্টা করলাম তুমি একবার আমার খোঁজ নিলে না? ওহ হ্যাঁ খোঁজ নিবে কেন? এখন তো তোমার জীবনে আতিফ আছে। তুমি কী খুব সুখে আছো ওর সাথে? ও তোমাকে কী আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে মায়া?”
মায়া উওর দেয় না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জোহানকে। এতদিন পর সামনা-সামনি এত সময় ধরে দেখতে পাড়ছে। এতদিনের জোহানের সব খবর তার কাছে আছে। তার সব গান সে প্রত্যেকদিন শুনেছে, সে টিভিতে যেখানে ছিলো সব দেখেছে, ইনারা ও সভ্য থেকে তার খোঁজ নিয়েছে। এমনকি সৌমিতা আন্টি থেকেও। এক কথায় জোহানের সব খবর তার কাছে ছিলো।
মায়ার চোখ ভিজে আসলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে আলতো হাতে নিজের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দেয়।
এমন সময় জোহানের চোখ যায় তার হাতের দিকে। মায়ার হাতে এখনো তার দেওয়া আংটি দেখে সে খপ করে তার হাত ধরে নেয়। সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি না আতিফের সাথে এনগেজড তাহলে আমার পরানো রিং এখনো তোমার হাতে কেন?”
অসমাপ্ত…
(আগামীকাল সমাপ্ত হবে ইনশাআল্লাহ।)
অনুভূতির খাঁচায়
অন্তিম পর্ব [শেষ অংশ]
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি না আতিফের সাথে এনগেজড তাহলে আমার পরানো রিং এখনো তোমার হাতে কেন?”
মায়া না বুঝান ভান করে, “আমি তো বলেছি এনগেজড হয়েছি। আতিফের সাথে এনগেজমেন্ট করেছি তা তো বলিনি। যে আমাকে এই রিংটা পরিয়েছে তার সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছে আমার। আর আতিফের আগামী মাসেই বিয়ে। তার কলিগের সাথেই।”
“ইউ মিন তুমি আমার সাথে এনগেজড এই কথা বলেছ?”
“এখনো প্রশ্ন করছ? আসলেই তুমি একটা গর্দভ।”
“আর তুমি একটা ইনসেন্সিটিভ মানুষ। ফেলে দেও এই রিং। এখন আর এটার কোনো মানে নেই।” বলে জোহান যেতে নিলে মায়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কপাল কুঁচকে তাকায়, “আর তোমার কথার মানে কী?”
“মানে বুঝতে পাড়ছ না? বলেছি রিংটা ফেলে দিতে। আমাদের মাঝের সব তুমিই শেষ করে গিয়েছিলে।”
“তোমারই তো মাথায় ভূত চড়েছিল যে ভবিষ্যতে তোমার অনুভূতি থাকবে কি-না তা দেখতে চাইতে তুমি। কী এখন নেই?”
জোহান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় চোয়াল শক্ত করে। মায়া এবার রেগেমেগে আগুন হয়ে যায়। সে জোহানের কলার ধরে একহাত দিয়ে, অন্যহাত দিয়ে তার গাল চেপে ধরে মুখ ফেরানোর চেষ্টা করে। জোরগলায় প্রশ্ন করে, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। এখন তোমার সব অনুভূতি শেষ? তাহলে এভাবে প্রেমনয়নে তাকাও কেন আমার দিকে? যেন আমায় দেখে সারা পৃথিবী ভুলে গেছিলে।”
জোহান তার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়, “যাও তো বিরক্ত করো না। আমার সামনেও আসবে না।”
“কেন আমি যখন বলেছিলাম তুমি আমাকে সে তিনমাস যে কষ্ট দিয়েছ তার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে। তুমি তো বলেছিলে শাস্তি মাথা পেতে নিবে।”
জোহান অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মায়ার দিকে, “শাস্তি? তুমি এই তিনবছর আমাকে শাস্তি দিয়েছ? প্রতিটি মুহূর্তে আমার মনে হতো আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে তোমাকে ছাড়া। কতরাত তোমার ব্যলকনির দিকে তাকিয়ে নির্ঘুম কেটেছে খেয়াল আছে তোমার?”
“আর তুমি কোনো দোষ করো নি তাই তো? নিজেকে এত কষ্টে গুছানো আমিটাকে সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দিয়েছ। যেখানে আমি নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছিলাম সেখানে তুমি আমার বুকের অনুভূতি উথাল-পাথাল করে দিলে। তোমার প্রেমে পড়ার পর আমার আসা ড্রিম জব আমি রিজেক্ট করেছি কারণ আমি তোমার থেকে দূরে থাকতে চাই নি। যে আমার জন্য আমার ক্যারিয়ার সব ছিলো আমি সে ক্যারিয়ারও তোমার জন্য ত্যাগ করতে রাজি ছিলাম। অথচ তুমি বারবার আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে। কাছে আসলে, ভালোবাসলে, সাথে কতগুলো কষ্ট দিয়ে গেলে। আমি শপথ করেছিলাম জীবনে কাওকে দ্বিতীয় সুযোগ দিব না। তোমাকে দিয়েছিলাম। সে রাত তিনটা পর্যন্ত তোমার অপেক্ষা করেছি। তোমাকে বারবার মনে করিয়েছি কাওকে দ্বিতীয় সুযোগ দেই না। তারপরও তুমি বুঝো নি। সেদিন আমি কোম্পানিতে কথা বলে এই জবের জন্য রাজি হই। আমি তখনও ভেবেছিলাম আমি যাবার পর তুমি অন্তত বুঝবে অতীত ধরে রাখলে ভবিষ্যত কখনোই থাকে। এখন আমি আসার একদিন আগে তুমি যদি বলো যে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও এটা আমার দোষ? ওহ আর হ্যাঁ সাথে এটাও বলেছিলে ভবিষ্যতে অনুভূতি থাকবে কি-না তা দেখা যাবে। তাই তোমাকে সময় দিয়েছিলাম যেন তুমি দেখতে পারো তোমার অনুভূতি আছে কি নেই।”
জোহান ক্ষেপানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, “তোমার সাথে কথাও বলতে চাই না।” বলে আবার যেতে নিলে মায়া স্বাভাবিকভাবে বলে, “ঠিকাছে। আমি চেয়েছিলাম দেশে আবার শিফট হয়ে যাব। যেহেতু তুমি আর আমার সাথে কথাই বলতে চাও না সেহেতু ফেরত চলে যাই।”
কথাটা শুনে থামে জোহান। ভ্রু কুঁচকে তাকায় মায়ার দিকে। সে সামনে কী বলে তা শোনার জন্য অপেক্ষা করে।
মায়া হেসে বলে, “সেখানে আমার একটা কলিগ আছে আহসান নামের। ও আমাকে গত একবছর ধরে ডেইটে যাবার জন্য রিকুয়েষ্ট করছিল। দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম, জিম করে বডি ফিটনেসও ভালো, ব্যবহারও অনেক ভালো। আর অফকোর্স তার কামিটমেন্ট ইস্যু নেই। যেহেতু আমরা এখন আর এনগেজড না তাহলে আমি ওর আয়াথে ডেইটে যেতেই পারি।”
“তোমার হাসিটা দেখতে এই মুহূর্তে আমার অনেক বিরক্তি লাগছে তুমি জানো?”
মায়া ঠোঁট টিপে হাসে, “আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে আর দেখতেই হবে না তোমার। ফ্লাইট বুক করছি শনিবারের।” বলে সে যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে নেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তোমার সাহস তো কম না, তিনবছর পর এসে আবার যেতে চাচ্ছো?”
সে মায়াকে নিজের দিকে টেনে নিলো। কাছে আসতেই মায়া দুষ্টু হাসি আঁকল তার ঠোঁটে, “কেন তোমার তো আমাকে দেখতে মন চাইছিল না। হাসি দেখতেও বিরক্তি লাগছিল। তাহলে আমি চলে গেলেই তো হলো। যেয়ে সবার আগে আহসানকে…..”
“তোমার কি মনে হয় আমি বুঝি না আমাকে জ্বালানোর জন্য তুমি কোন আহসান বাহসানের বাণী শোনাচ্ছ?” জোহান মায়ার পিঠে হাত রেখে তাকে নিজের টানল। কেমন মলিন কন্ঠে বলল, “তোমাকে ছাড়া আমার জীবন শূন্য হয়ে গিয়েছিল জানো? আমি জানি তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি দোষ করেছি। তুমি আমাকে অন্য যেকোনো উপায়ে শাস্তি দিতে। আমি একটা শব্দও করতাম না। কিন্তু তুমি তো আমাকে অনুভূতিশূন্য করে দিয়েছিলে। এই মুহূর্তে আমার তোমার উপর অভিমান করে থাকা উচিত। আমি ভেবেছিলাম যেদিন তোমার সাথে দেখা হবে তোমার দিকে ফিরেও তাকাব না। কিন্তু তোমাকে দেখার সাথে সাথে আমার সব রাগ, অভিমান কোথায় হারিয়ে গেল। আচ্ছা তোমার কী আমার থেকে দূরে থাকতে একটুও কষ্ট হয় নি?”
মায়া দু’হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল। স্মিত হাসল, “হয়েছে তো। কতরাত আমারও নির্ঘুম কেটেছে। আমাদের মুহূর্তগুলো ভেবে হেসেছি তারপর হঠাৎ তোমাকে মনে করে কান্না করে দিয়েছি।”
“আমাকে শাস্তি দিতে যেয়ে নিজেকেও এতটা কষ্ট দেবার কী প্রয়োজন ছিলো।”
“প্রয়োজন তো ছিলো। যেন এরপর আমাকে দূরে সরানোর কথা বললেও তোমার বুকে কাঁপে।” বলে সে মৃদু হাসল। কিন্তু জোহান হাসল না। তার নয়নজোড়া সিক্ত হয়ে গেল। সে মায়ার পিঠে রাখা হাতটা দিয়ে তাকে নিজের দিকে টানল। তাকে খানিকটা উঁচু করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। ভাঙা কন্ঠে বলল, “প্লিজ মায়া আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি আর কখনো তোমার থেকে দূরে যাবার কথা বলব না। তোমাকে ছাড়া আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। এত বছর আমার কাছে সব ছিলো। অতীতে যা হারিয়েছি তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি কিন্তু আমার ভেতর শান্তি ছিলো না। আমি একটা শান্তির নিশ্বাস ফেলতে পাড়ি নি এই তিনবছর। প্রতি মুহূর্ত আমার তোমার শুন্যতা অনুভব হতো। তোমাকে হারানোর, তোমার অন্যকারো হবার ভয় হতো। তুমি অন্যকারো হয়ে যাবে এই কথাটা ভাবতেই আমার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হতো। তুমি আমার সব শান্তি। আমার সুখ।”
মায়া কথাগুলো শুনে কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কী অতিরিক্ত করে ফেলেছে? তার কী উচিত ছিলো জোহানের সাথে যোগাযোগ করা?
সে হঠাৎ অনুভব করলো জোহান তার গলায় ঠোঁট ছুঁইয়েছে। তার ছোঁয়ায় আজই তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। সে আরও জোরে জোহানকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “তুমি কিন্তু আজও কোনো এক্সকিউজ ছাড়া ভালোবাসি বলো নি।”
জোহানও তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যেন একটু ছাড় দিলেই আবারও হারিয়ে যাবে। তার মুখ তুলে কানে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
“এই নির্জন রাতের গানে তোমার নয়নে ডুবে যদি থাকি,
বিরহের আঁধার ভুলে তোমার সুবাসে যদি মেতে থাকি,
তোমার ছোঁয়ায় ভুলে যাই এই জগৎ -সংসার
তাহলে কী বুঝবে ও মায়াবিনী তোমায় ভালোবাসি!”
জোহান মায়াকে ছেড়ে তার নীল কাজল মাখা চোখে ডুব দেয়। আলতো করে তার কপালের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে একদম কোমর পর্যন্ত তার চুলগুলো ছুঁয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করে, “আমার অনুরোধ রেখেছ তাহলে।”
“এখন নিজের ফিউচার হাসবেন্ডের একটা অনুরোধ তো রাখাই যায়।”
“ফিউচার হাসবেন্ড?” জোহান ভ্রু নাচায়। তার কোমরে হাত রেখে বলে, “একবার বিয়ে করে নেই মেডাম তারপর সারাদিন আপনার এই চুলে মুখ ডুবিয়ে রাখব।”
“তার জন্য সবুর করতে হবে।”
এতটুকু কথাতেই জোহানের চোখেমুখে মেঘ নেমে আসে, “আবার কিসের সবুর?”
“আমার কোম্পানি এখানে নতুন ব্রাঞ্চ খুলছে। ওটার সি.ই.ও হবো আমি। আপাতত কয়মাস এই কাজে মনোযোগ রাখতে হবে। আর তুমিও বিদেশের কোনো লেবেলের সাথে কাজ করতে চাচ্ছো তা আমি জানি। সেদিনে ধ্যান দেও। তারপর বিয়ের কথা ভাববো। ডোন্ট ওয়ারি এবার কোথাও যাব না। এছাড়া বিয়ের আগের প্রেমই তো করা হয় নি। মানে -অভিমানেই দিন কেটে গেল।”
“তো ম্যাডাম প্রেম করতে চান না’কি?” জোহান তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললে মায়া তার মাথায় টোকা মারে, “সারাদিন এই চলে না মাথায়?”
“ওকে যাও। তোমার কথা রাখলাম। দুইজনের কাজ সামলে নিয়ে তারপর বিয়ে করব। কিন্তু আমার এক শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“বিয়ের পর দুইমাস আমরা ওয়ার্ল্ড ট্যুর দিব। কেবল তুমি আর আমি। আমি তোমার সাথে সারা পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই।”
মায়া হাসে তার কথায়, “আমিও।”
তারা ফেরত আসে অনুষ্ঠানে। তাদের হাত ধরে আজ তো দেখে সবাই উৎসুকভাবে চিৎকার করতে শুরু করে। জোহান লজ্জায় মাথা চুলকায়। সামি বলে, “ভাই যেভাবে রাগে তেড়ে গিয়েছিলি ভেবেছিলাম রাগে চিৎকার চেঁচামেচি শুনব, এখন দেখছি দুইজনে লাল টমেটো হয়ে আছিস।”
সভ্য বলে, “প্রেমিক পুরুষ বলে কথা। যতই সিংহের মতো গর্জন করুন, প্রেমিকার সামনে ভেজা বেড়ালই হতে হয়।”
“যেমন তুই।” বলে শব্দ করে হাসল সামি। তখন সভ্য তার জ্বলায় মরিচ লাগিয়ে বলল, “হ্যাঁ ভাই তোর মতো আজীবন সিঙ্গেল থাকা ব্যক্তি কথাটা বুঝবে না।”
এই কথা শুনে সামির হাসিমুখ গোমড়া হলেও সবাই হেসে দেয়।
মায়া সিয়ারার সামনে যেয়ে বসে। তার পার্স থেকে একটি প্রজাপতির ডিজাইনের ডায়মন্ড নেকলেস বের করে তার গলায় পড়ায়। ইনারা তাকে বাঁধা দেয়, “আপু এত দামী নেকলেস বাচ্চাকে পরিও না। হারিয়ে ফেলবে।”
“হারালে আরেকটা বানিয়ে দিব। আমি আমার ভাগ্নির জন্য এনেছি তুই মাঝখানে কথা বলছিস কেন?” তারপর সে সিয়ারাকে বলে, “তুমি আমাকে চিনেছ?”
সিয়ারা দ্রুত মাথা নাড়ায়। সে চিনেছে। ইনারা বলে, “চিনবে না? সাপ্তাহে তিন চারবার তো তোমাকে ফোনে দেখেই।” বলে দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটে। জোহানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে সরু চোখে তাকেই দেখছে। জোহান আগে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল অনেকবার, মায়ার সাথে তার কথা হয় কি-না! সে পরিষ্কার মিথ্যে বলেছিল, হয় না।
মায়া সিয়ারার ছোট ছোট হাত দু’টি ধরে বলে, “এখন খালামণি এসেছি। খালামণি সিয়ারার জন্য এত্তগুলা প্রিন্সেস ড্রেস এনেছ। খালামণি সিয়ারার সাথে অনেক খেলবে, তাকে সাজাবে, প্রিন্সেস বানাবে। সিয়ারা খালমণির কাছে আসবে না?” মায়া দু’হাত মেলে তাকে কোলে নেওয়ার জন্য।
সিয়ারা লাজুক হেসে প্রথমে সুরভির ওড়নার পিছে লুকায়। তারপর উঁকি দিয়ে মায়াকে দেখে লাফ দিয়ে তার কোলে উঠে পড়ে।
মায়া সিয়ারাকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালে জোহান সিয়ারার গালে চুমু দিয়ে তাকায় মায়ার দিকে। তার তাকানো দেখে মায়া লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। সিয়ারার সাথে কথা বলতে থাকে।
সুরভি বলে, “এখানে সাক্ষাৎ লিজেন্ড পঞ্চসুর আছে অথচ এত শান্ত মহল? একটা গান হবে না?”
সকলে তার কথায় একমত হয়। সামি যেয়ে গিটার নিয়ে আসে। সবার আগে সভ্য গান ধরে, তারপর জোহান। তারপর একসাথে পঞ্চসুর তাল মেলায়,
আজ বলবে হঠাৎ কেও এসে হেসে আলতো চোখে চোখে
আজ বলবে হঠাৎ কেও এসে হেসে আলতো চোখে চোখে
তোর জন্য এসেছি আমি ভালোবাসতে যে তোকে
কিছু স্বপ্ন এনেছি কুড়িয়ে রেখে দে নয়তো দে উড়িয়ে,
কিছু স্বপ্ন এনেছি কুড়িয়ে রেখে দে নয়তো দে উড়িয়ে,
তোকে বলবো ভাবি কিছু অল্প কথায়
তুই স্বপ্নে ছিলি ছিলি গল্প কথায়
আজ তোর নামে রাত নামে দিন কেটে যায়…
সভ্য গান থামালে জোহান তার গিটারের সুর ধরে তাকায় মায়ার দিকে। চোখ টিপ মেরে তার গান শুরু করে,
চুপি চুপি বলো কেও যেনে যাবে
যেনে যাবে কেও যেনে যাবে…
ভয় করিনা তবু কোন কিছু
যদি তুমি আমি রই একসাথে…
.
.
নিচে প্রদীপের আলো ছেয়ে আছে আর আকাশে চন্দ্র তারার। চারপাশ সোনালী ও লাল ফুল দিয়ে সাজানো। মাগরিবের পর বিয়ের আয়োজন শুরু হয়েছে। স্টেজের সামনে সাদা শেরোয়ানিতে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। সভ্য তার শেরোয়ানি ঠিক করে দিচ্ছে।
অভ্র একটু নার্ভাস টোনে জিজ্ঞেস করে, “ঠিক লাগছে?”
সভ্য হাসে তার দিকে তাকিয়ে, “অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে ভাইয়া। পার্ফেক্ট লাগছে। তোমার মনে আছে ভাইয়া। অস্ট্রেলিয়ায় যখন প্রথম গিয়েছিলাম। তুমি আমাকে স্কুলের জন্য এভাবে রেডি করিয়ে দিতে। আজ দেখো আমি তোমাকে তোমার বিয়ের জন্য রেডি করিয়ে দিচ্ছি।”
অভ্র তার কথায় মৃদু হাসে। সত্যি তার মনে পড়ে যায় দৃশ্যগুলো। তার এতটুকু ছোট ভাইয়া আজ এত বড় হয়ে গেল যে তারও বাচ্চা আছে। সে সভ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর সভ্য বিরক্তির স্বরে বলে, “ভাইয়া আমি মাত্রই
চুল ঠিক করেছিলাম। ধ্যুর!”
এবার অভ্র শব্দ করেই হেসে দেয়। ছোটবেলায়ও এই একইভাবে কথাটা বলতো সভ্য।
অভ্র বলে, “যেয়ে দেখে আয় তো মা কোথায়?”
“আচ্ছা যাচ্ছি।”
সভ্য যাবার কিছুক্ষণ পর মেঘলা ও রিয়াদ আসে। অভ্র তো মেঘলাকে দেখে রেগে যায়, “তোর এখন আসার সময় হলো? তোর একমাত্র বন্ধুর বিয়ে কোথায় একসাপ্তাহ আগে আসবি অথচ সবার শেষে আসছিস। লজ্জা আছে?”
মেঘলা ভয়ে জোরপূর্বক হাসে, “শান্ত হ ভাই৷ আশ্রমে বাচ্চাদের, বড়দের সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়। দুইদিনের জন্য আসলে তো সব এলোমেলো হয়ে যাবে। বহুকষ্টে একদিনের জন্য সবাইকে সব বুঝিয়ে এসেছি।”
“একদিনের জন্য মানে? কাল চলে যাবি?”
মেঘলা বকা খাবার ভয়ে আহ্লাদী গলায় বলে, “রাগ করিস না’রে। ওরা তো আমার বাচ্চাই। ওদের ছাড়া মন বসে না। আচ্ছা এসব বাদ দে। সুরভি কোথায়?”
“ওর জন্যই তো আধা ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে।”
“সবুরে মেওয়া ফলে। আরেকটু অপেক্ষা কর।”
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আজ এখানে আমার প্রিয় সবাই আছে কেবল আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটা বাদে।” কথাটা বলে কাঁপানো বড় নিশ্বাস ফেলে সে।
মেঘলার হাসিটা নিমিষে মলিন হয়ে যায়। তার নয়ন জোড়া হয়ে যায় সিক্ত। তবুও সে তার কষ্ট গিলে সামনে এসে দাঁড়ায় অভ্রের। তার হাতের ব্যাগ থেকে একটি ঘড়ি বের করে অভ্রের হাত ধরে নিজের হাতে নেয়। ঘড়িটা তার হাতে পরাতে পরাতে বলে, “গগণের শেষ স্মৃতি ছিলো আমার কাছে। তোর মনে আছে কলেজে থাকতে আমি আর তুই কত ঘুরে ওর জন্য এই ঘড়িটা কিনেছিলাম। ও চারবছর ধরে এটা খুলেই নি। যতদিন পর্যন্ত আমি জোর করে না ওর হাত থেকে খুলেছি।” বলে হাসল মেঘলা। কষ্টের হাসি, “আজ যদি গগণ থাকতো তাহলে তোকে বর বেশে দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হতো।” সে এবার তাকায় অভ্রের দিকে, “জানিস আজ আমি সবচেয়ে বেশি খুশি। আমার বন্ধু, আমার ভাই তার প্রাণকে নিজের করে পেতে যাচ্ছে। আমি দেখেছি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে তুই যখন ওর কথা বলতি তোর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠতো। যখন ওর সাথে কথা বলতি হাসি তোর মুখ থেকে যেত না। যেদিন ওকে প্রথম দেখেছিলি যেন স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিলি। ওর সাথে দেখা করার সময় এমন নার্ভাস হচ্ছিল যেন কোনো যুদ্ধ করতে যাচ্ছি।”
অভ্রও হাসে, “তুই আর গগণ কত মজা নিয়েছিলি।”
মেঘলা তাকে ঘড়িটা দেখিয়ে বলে, “আজও গগণ তোর সাথে আছে। যদিও ওর সাথে থাকার জন্য কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই। ও তো আমাদের হৃদয়ে আজীবন জীবিত থাকবে। তবুও এই আমানত তোর কাছে রাখ।”
সুরভিকে গেইটে আনা হলে সে সবার আগে ইনারাকে খবর দিতে বলে। ওকে ছাড়া সুরভি এগোবেই না। ইনারা সকাল থেকে ব্যস্ত। দুইদিকের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে তাকে। এর উপর সিয়ারা। তার প্রাণের বান্ধবীর বিয়ে আজ। সব পার্ফেক্ট হওয়া চাই।
দশমিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর ইনারা এলো। হাঁপাচ্ছে সে। দৌড়েই এসেছে। শীত শীত আবহাওয়াতেও ঘামিয়ে গেছে। সুরভি তার এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে, “তোর এই অবস্থা কেন?”
ইনারা পা থেকে মাথা পর্যন্ত সুরভিকে দেখে। সাদা লেহেঙ্গা পরেছে সে। একদম হাল্কা সাজ। সাদা গয়না। মাথায় একটি সাদা ও সোনালি রঙের ওড়না। তাকে দেখে ইনারার চোখ ভিজে গেল। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল তাদের কতগুলো মুহূর্ত। সে প্রথম দেখা থেকে শুরু করে বন্ধু হওয়া, পরিবার হওয়া, হাসি ঠাট্টা থেকে শুরু করে বন্ধু হারানোর দুঃখ সব ভাগ করে নেওয়া।
সুরভি তার চোখে পানি দেখে এগিয়ে এসে তার গালে হাত রেখে গাল মুছে বলল, “বিয়ে করে তোর থেকে দূরে যাচ্ছি না, আরো কাছে আসছি। এখন থেকে প্রতি শুক্র শনিবার একই সাথে কাটাবো। তাই কান্না বন্ধ কর। তোর এই অবস্থা কেন এই কথা আগে বল।”
ইনারা একগান হাসে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ায় সবাই অবাক হয়ে তারদিকে তাকিয়ে থাকে। তার দিকে একগুচ্ছ সাদা ফুলের গুচ্ছ এগিয়ে দিয়ে বলে, “জান বিয়ের পরও আমিই তোর ফার্স্ট প্রায়োরিটি থাকব সবার সামনে প্রমিজ কর।”
তার কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। সুরভিও হাসে। ফুলগুলো নিয়ে বলে, “তোর ঢঙ কমবে না তাই না?”
ইনারা উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। এই মুহূর্তে তার প্রিয়র কথা খুব মনে পড়ছে। আজ সে থাকলে হয়তো কোনো শূন্যতা থাকতো না। সে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। কষ্টটা বুকে দাবিয়ে রেখে সুরভিকে ছেড়ে এক গাল হেসে বলে, “জান তোকে অপ্সরী থেকে কম লাগছে না আজ। মনে হচ্ছে সদ্য অপ্সরী মেঘের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছে।”
“তুই আর তোর চিজি ডায়লগ।”
“সত্যি করে বলতো আমার মতে এত সুন্দর প্রশংসা দুলাভাই করতে পাড়ে?”
সুরভি কিছুক্ষণ ভাবার নাটক করে। তারপর হঠাৎ বলে, “একদম না।”
সুরভির মা বলে, “তোদের শেষ হলে এখন চল। অভ্র অপেক্ষা করছে তো।”
সুরভি ইনারার হাত ধরে। রওনা দেয় নিজের নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে।
অভ্র মেঘলার সাথে কথা বলছিল। মেঘলার নজর হঠাৎ থেমে যায়। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অভ্রকে বলে, “পিছনে তাকিয়ে দেখ। কিন্তু হৃদয় সামলে।”
অভ্র পিছনে তাকায়। দেখে সুরভি আসছে। সাদা রঙের লেহেঙ্গায় তাকে শুভ্রফুলের মতো দেখাচ্ছে। হাতে সাদা রঙের ফুলের গুচ্ছ নিয়ে এগিয়ে আসতে তার দিকে। তার মাথার উপর একটি লাল রঙের ওড়না ধরে আনছে চারজন। এইদিনের কল্পনা অভ্র আগেও হাজারোবার করেছিল কিন্তু এত সৌন্দর্য কল্পনাও ধারণা করতে পাড়ে নি। সে অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। তার কেমন নার্ভাস লাগছে। এমনটা সহজে তার সাথে হয় না।
তাকে এক দৃষ্টিতে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘলা বলে, “ভাই এভাবে তাকিয়েই থাকবে না’কি এগিয়ে নিজের বউকে নিতেও যাবি।”
বউ শব্দটা শুনে অভ্রর অনুভূতির পাখিরা যেন খাঁচা ছেড়ে আকাশে উড়াল দিয়েছে। সত্যিই তো, আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপর সুরভিনী তার হবে। তার বউ।
সে এগিয়ে গেল। স্টেজের দুটো সিঁড়ি নেমে হাতে এগিয়ে দিল সুরভির দিকে। সুরভি তার কাজলমাখা দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাতেই অভ্রর তো সেখানেই বেহাল অবস্থা হয়ে যায়। তবুও সে নিজেকে সামনে সুরভির হাতে একখানা চুমু খায়। তাকে নিয়ে আসে স্টেজে। উঠে তার পাশে হাঁটার সময় বলে, “তোমাকে এই দিনে হাজারোবার কল্পনা করেছিলাম। তোমাকে আজ আমার কল্পনা থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে সুরভিনী। ”
সুরভি লাজুক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মৃদু স্বরে বলে, “আপনাকেও আমার কল্পনা থেকে বেশি সুদর্শন লাগছে।”
দুইজনকে সামনা-সামনি দুই সোফায় বসানো হয়। লাল ওড়নাটা রাখা হয় সুরভির মাথায়। মাঝখানে একটি সাদা ওড়না ধরে সভ্য ও ইনারা। কাজি আসে। তারপর চন্দ্রের জ্যোতির সাক্ষীতে আরেকটি ভালোবাসার গল্প সম্পূর্ণ হয়। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয় সুরভি ও অভ্র।
.
.
রাত একটার দিক। বড়রা শুয়ে পড়েছে। অন্যসবাই ব্যস্ত অভ্র ও সুরভির বাসরে গেইট ধরতে। এদিকে মায়া ও জোহান বসেছিলো পুকুরের পাশে। দুইজনের পা ভেজানো পানিতে। পা এর সাথে মায়ার আনার কলির নিচের অংশটাও ভিজে গেছে। আজ সাদার মধ্যে লাল ও সোনালী কাজের লেহেঙ্গা পরেছিল মায়া। ইনারা নিজের ও মায়ার জন্য একইরকম আনারকলি এনেছিল। সে না’কি তার দুই বোনের সাথে ম্যাচিং করে পড়বে।
পুকুরপাড়ে পা ঝুলিয়ে মায়া মাথা রেখেছিল পাশে বসা জোহানের কাঁধে। তাকিয়ে দেখছিল একটু আগে তারাভরা আকাশে মেঘ জমার দৃশ্যটা।
“তুমি আমাদের বিয়েতে কী রঙ পরবে মায়া?”
প্রশ্নটায় মায়া তার দিকে তাকায়, “তুমি তো কিনেই রেখেছ।”
“আমি?” অবাক হয় এই উওরে জোহান।
“সেদিনের নীল লেহেঙ্গাটা তুমি কিনেছ আমি জানি। ওটাই আমাকে দিবে। আমি ওটা পড়ব।”
“ওহ তাহলে এখন আর তোমার লাল পছন্দ হয় না?”
মায়া জোহানের গাল টেনে বলে, “লাল রঙ আমার পছন্দ কিন্তু তোমার ভালোবাসার রংটা যে নীল। আমি যখন নীল রঙ পরি তোমার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকাটা আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।”
তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। জোহান বলে, “মনে হয় বৃষ্টি হবে।”
“হয়তো। চলো ভেতরে যাই।”
মায়া উঠে যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে নেয়, “উইড ইউ লাইক টু ডান্স?”
জোহান উঠে মায়ার এক হাত ধরে নিজের কাঁধে রেখে তার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নেয়। অন্য হাত ধরে বাতাসের শোঁশোঁ শব্দের সুরে দুলতে থাকে। তাকায় মায়ার চোখে। মায়া সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। এতে খানিকটা বিরক্ত হয় জোহান, “মায়া, তোমার মনে কি আমার জন্য একটু মায়া জাগে না? এত বছর পরে তোমার চোখে চোখ রেখে নিজেই হৃদযয়ের তৃষ্ণা মেটাতে চাচ্ছি। তাও দিচ্ছি না। এত নির্দয় কেন তুমি?”
মায়া লাজুক হাসল, “তোমার চোখে তাকালে যে আমার অনুভূতির প্রজাপতিরা আমার নিয়ন্ত্রণে আর থাকে না। আমার অনুভূতির খাঁচা ছেড়ে উড়ে যায়। আমার হৃদয়ের অবস্থা বেহাল করে দেয়।”
মায়ার এই লাজুক ভঙ্গি যেন জোহানের বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে তুলল। সে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। এক সময় আকাশের বুক চিরে ঝরল পানি। ভিজিয়ে গেল তাদের দু’জনকে। বৃষ্টির এই ছোঁয়ায় প্রেমের অনুভূতিটা আরও গাঢ় করল। জোহান বাহুডোরে ভরল মায়াকে। কপালে একটা গাঢ় চুমু খেল।
.
.
সুরভি বসে আছে একগুচ্ছ ফুলের মাঝে। অপেক্ষা করছে তার অভ্রের। সারাকক্ষে ফুল ছড়ানো এর মাঝে বসে আছে সুরভি। হঠাৎ কেমন ভয় লাগতে শুরু করে তার। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। দরজা খুলার শব্দে তার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। বিচলিত হতে থাকে সে। বুকের ভেতরের ধুকপুক বাড়ে। সে তার লেহেঙ্গাটা চেপে ধরে। তবুও নিজেকে শান্ত করে উঠে দাঁড়ায়। সালাম দেয় অভ্রকে। অভ্রর মুখে সালামের উওর শোনার পর পর সে দেখে অভ্র তাকে কোলে তুলে নেয়। সে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “করছেনটা কী?”
অভ্র কিছু বলে না। সোজা পিছনের দরজা দিয়ে বাহিরে নিয়ে যায় তাকে।
রিসোর্টের এই অংশটা সবার শেষে। সবগুলো কটেজ থেকে একটু দূরে। এই কটেজের পিছনে প্রাইভেট ব্যাকইয়ার্ড আছে। যা অভ্র যত্ন করে নিজে সাজিয়েছে তার সুরভিনীর জন্য। অভ্র সুরভিকে নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে যায়। যা সাজানো কতগুলো সাদা ফুল, জ্বলন্ত দিয়া ও ঝুলন্ত লাইট দিয়ে। যদিও বাতাসের বেগের কারণে কতগুলো দিয়া নিভে গেছে। তবুও সৌন্দর্য মোটেও কমে নি।
অভ্র তাকে ব্যাকইয়ার্ডে এসে নামায়। সুরভি জায়গাটা দেখে মুগ্ধ হয়। সে দৌড়ে জায়গার মাঝখানে যেয়ে দাঁড়ায়। চারদিকে ঘুরে দেখছে, “আপনি এসব করেছেন? আমার মনে হচ্ছে আমি কোন স্বপ্নের রাজ্যে এসে পড়েছি।”
অভ্র বাঁকা হেসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, “আমার জীবনই তোমার রাজত্ব আর তুমি এই রাজ্যের রাণী সুইটহার্ট।”
সুরভি কেঁপে উঠে তার ছোঁয়ায়। হাত রাখে তার পেটে রাখা অভ্রর হাতের উপর। তাকায় আকাশের দিকে। চোখ বন্ধ করে বলে, “আপনাকে পাওয়া আমার ভাগ্য। আমি সত্যিই ভাগ্যবতী যে আপনাকে আমার করে পেয়েছি। আমার ভাগ্য এত ভালো হবে আমি কখনো কল্পনা করারও সাহস পায়নি।”
হঠাৎ সে অনুভব করল তার গালে শীতল জলের ছোঁয়া। এক বিন্দু, তারপর দুই, তারপর ঝড়ে পড়ল তাদের উপর মেঘকন্যার আশির্বাদ। চোখ খুলে তাকাতেই দেখল বৃষ্টি ঝরছে। যা দেখে সে হাসল। হঠাৎ এ শীতল বৃষ্টি মাঝে অনুভব করলেও তার কানের কাছে আসা উষ্ণ নিশ্বাস। অভ্র বলল, “দেখলে আমাদের বিয়ে উপলক্ষে আমার আমন্ত্রণ আসমানও গ্রহণ করল। উপহার পাঠাল বৃষ্টির রূপে।”
তার কথা শুনে সুরভি পিছনে তাকাতেই অভ্র স্থির হয়ে গেল কিছু মুহূর্তে জন্য। সুরভির গালে, মুখে, চোখের পাতায়, কেশে বৃষ্টির জলের অলঙ্কার তার সৌন্দর্য যেন হাজারোগুণ বাড়িয়ে দিলো। অভ্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে, “আজ তোমাকে আমার কল্পনা থেকেও বেশি সুন্দর লাগছিল একটুখানি পূর্বেও। এখন যে বৃষ্টির সাজে তোমার সৌন্দর্য হাজারোগুণ বেড়ে গেল এই সৌন্দর্যের প্রশংসার যে শব্দ নেই। কী করে করি বলো?”
সুরভি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। অভ্র তার থুতনিতে হাত রেখে তার মুখ তুলে। তার লাজুকমাখা মুখখানা অভ্রর ব্যকুলতা আরও বাড়িয়ে তুলে। সে আলতো করে চুমু খায় সুরভির কপালে, চোখের পাতায়, গালে, অবশেষে ঠোঁটে। শেষ চুমুখানা কাঁপিয়ে তুলে সুরভির দেহের শিরায় শিরায়। সে খামচে ধরে অভ্রর হাত। অভ্র মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। তার দুষ্টু দৃষ্টি দেখে সুরভি মুখ লুকায় তার বুকেতে। অভ্র তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “জানো সুরভি তোমায় যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই আমার হৃদখানা তোমার হয়ে গিয়েছিল। আমার অনুভূতির খাঁচায় এই হৃদয় বন্দী হয়ে গিয়েছিল তোমার নামে।”
.
.
রিসোর্টের ঠিক মাঝে একটা প্যাটিওতে বড় দোলনা লাগানো। ছাদবিহীন এই ঘরে দোলনার উপর ইনারার বৃষ্টি দেখতে ভালোই লাগছিলো। ইনারা পা হাওয়ায় তুলে রেখেছিল। সে যখনই দোল খাচ্ছিল তার পা ভিজে যাচ্ছিল বৃষ্টির জ্বলে। সাথে তার লাল সাদা আনারকলিটাও অর্ধেক ভিজে গেছে। হঠাৎ সে অনুভব করে কেউ তার পিছনে এসে বসেছে। তার ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন হয় না। এই ঘ্রাণ যে তার প্রিয় মানুষটির। তার অসভ্যের!
সে জিজ্ঞেস করে, “আপনার রাজকুমারী ঘুমিয়েছে?”
সভ্য পিছ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে হাত রাখে। টেনে তার পিঠ নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়, “জ্বি মহারাণী। আপনি ঘুমাবেন না?”
“ইচ্ছে হচ্ছে না। দেখো, কী সুন্দর দৃশ্য।”
“এই দৃশ্য আমার মহারাণীর সৌন্দর্যের কাছে কিছুই নয়।”
ইনারা পিছনে ফিরে একবার সভ্যকে দেখে আবার সামনে তাকায়। তার হাতের উপর হাত রেখে। পা তুলে নেয় দোলনায়। সভ্যের বুকের উপর মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকায়।
“কী দেখছ এমন ধ্যান দিয়ে?” সভ্যের প্রশ্ন।
“ভাবছি।”
“কী?”
“মনে হচ্ছে এই সেদিন আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। কী তুমুল ঝগড়া করেছিলাম আমরা! আপনি ছিলেন মিস্টার অসভ্য। তারপর কত উথাল-পাথাল গেল আমাদের জীবনে। বিরহের পরও কত কঠিন ছিলো আমাদের মিলন। আজ আমরা একসাথে। আমার ভালোবাসার অংশ দু’টো আছে আমাদের সাথে। আজ অভ্র ভাইয়া ও সুরভিরও ভালোবাসার পূর্ণতা পেল। প্রথমবার মন ভাঙার পর সুরভির জন্য আমার খুব চিন্তা হতো জানেন? কিন্তু কথায় আছে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। অভ্র ভাইয়া থেকে সুরভিকে আর কেউ ভালো রাখতে পাড়বে, এর’চে বেশি কেউ ভালোবাসতে পাড়বে বলে মনে হয় না।”
“আমারও একইভাবে জোহানের জন্য চিন্তা হতো। আমিও চাইতাম ওর জীবনে এমন কেউ আসুক যে ওকে আবার ভালোবাসায় বিশ্বাস শেখাবে। কিন্তু সে মানুষটা মায়া হবে এটা ভাবি নি। দু’টো ভাঙা মন একে অপরকে পূর্ণ করতে পারে জানা ছিলো না।”
ইনারা খানিটা মুখ তুলে তাকায় সভ্যর দিকে, “আমি চাই সকলে এই অনুভূতি অনুভব করুক।”
“কোন অনুভূতি?”
“এই ভালোবাসার। সকলের একটিবারের জন্য হলেও এই ভালোবাসার সুন্দর এবং অসুন্দর অনুভূতিটি অনুভব করা উচিত। এই অনুভবের কষ্টের মাঝেও সুখ আছে। পাওয়ার মাঝেও পূর্ণতা আছে আর বিরহের মাঝেও। আমি চাই প্রত্যেকটি প্রেমি একটিবারের জন্যে হলেও হারিয়ে যাক, ভেসে যাক, বিলিন হয়ে যাক এই ভালোবাসার অনুভবে…..”
সমাপ্ত…