অনুভূতির খাঁচা পর্ব-১১+১২

0
3

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-১১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

এমন সময় বাহিরের রুম থেকে শব্দ শোনা যায়। সুরভির বুকের ভেতর এবার ভয় ভয় করতে শুরু হয়। অভ্র সত্যিই তার কোনো সমস্যা তৈরী করল না তো?

সে দৌড়ে বের হলো বন্ধ রুম থেকে। দেখে তার বাবা ও ভাই বাসায় এসেছে। সোফায় বসে আছে। এ সময় তো তাদের বাসায় আসার কথা না। তাদের মুখটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার ভাবি ও মা’য়ের মুখেও চিন্তার ছাপ। সুরভি জিজ্ঞেস করল, “সবাইকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?”
তার বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন, “সব শেষরে মা… সব শেষ…” তার কন্ঠে হতাশা স্পষ্ট। তার বাবার এমন কন্ঠ আগে শুনে নি সুরভি। সব শেষ মানে? কী শেষ? কী হয়েছে?”
তাই তার বুকে ভয়ের তীব্রতা আরও বাড়ল। বুকের ভেতর ভয়ে ধকধক করতে শুরু করল।

সে সময় তার ভাই বলল, “বাবা চিন্তা করো না। কিছু হবে না। এখনো তো ল্যাব থেকে রেজাল্ট আসে নি। আর তুমি আর্থিক দিক থেকে একেবারে চিন্তা করো না। আমি জোহানের এলবাম রিলিজ হবার পরই বেতন পাব। সুরভিরও তো চাকরি আছে তুমি চিন্তা করো না।”
সুরভি তার চাকরি ছেড়ে এসেছে ব্যাপারটা ঘরে জানায় নি এখনো। এই মুহূর্তে জানানোটা উচিতও মনে হচ্ছে না।
সে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে? কেউ খুলে বলবে?”
তার ভাই জানায়, “আজ আমাদের হোটেলে খাবারের ইন্সপেকশনের জন্য কিছু সরকারি লোক এসেছিল। কে না’কি রিপোর্ট করেছে। বিরিয়ানিতে যে জর্দার রঙ ব্যবহার করা হয় তার পরিবর্তে না’কি ক্ষতিকারক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। তারা এসে কতকিছু করে হোটেল বন্ধ করে দিলো। ল্যাবে টেস্ট না হওয়া পর্যন্ত হোটেল খুলবে না।”
“যে প্যাকেট তারা নিয়েছে সেটা আমরা ব্যবহারও করি না। জর্দার রঙের প্যাকেট হলেও সেটা আমরা ব্যবহার করি না। জানি না কোথা থেকে এলো। আমার ভয় লাগছে এখন।” তার বাবা কাঁপানো গলায় বললেন। কথায় আরও যুক্ত করলেন, “কে আমাদের এমন ক্ষতি করতে চায়? জীবনে কারও খারাপ করলাম না। তাহলে সে আমার ক্ষতি করছে কেন? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।”
সুরভি যেয়ে তার বাবার কাছে বসে বলে, “চিন্তা করো না বাবা কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সাইদও তার কথায় সায় দিয়ে বলে, “সুরভি ঠিক বলছে বাবা। হোটেল বন্ধ থাকলেও আমার ও সুরভির বেতন দিয়ে ঘর তো চলবে। তুমি চিন্তা করো না।”

বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, “টাকার কথা না’রে বাবা। টাকা গেলে আবার আসে। সম্মান গেলে তো আসে না। এতবছর ধরে এই এলাকায় যে সম্মান কামিয়েছি ভুল কিছু বের হলে সব মাটিতে মিশে যাবে। আমার সম্মান মাটিতে মিশে যাবে। আমি সারাজীবন টাকা কামাই নি কিন্তু সম্মান কামিয়েছি। আমার সারাজীবনের অর্জন। আজ যখন তারা সব যাচাই করছিল তখন মানুষের দিকে আমার তাকাতেই লজ্জা লাগছিল আর যদি ল্যাবে খারাপ কিছু বের হয় আমি মরেই যাব।”
“বাবা এসব কী বলছ তুমি!” আঁত*কে উঠে সুরভি। তার ভয় ভয় করছে। কথাটা শুনতেই জান যেন গলায় আটকে আসছে। বাবা উঠে দাঁড়ালেন, “থাক তোমরা চিন্তা করো না। যা হবে আল্লাহর ইচ্ছা।”
সে ছোট ছোট করে পা ফেলে নিজের রুমের দিকে এগোল। বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সে। তাকে এভাবে দেখে ভয়ের তুফান উঠলো সুরভির বুকে। নিজের বাবাকে তো করুণ অবস্থায় দেখতে পারছে না।

মা তার কপালে হাত রেখে বললেন, “এখন কী হবে? কী করব আমরা? আমার তো কিছু মাথায় ঢুকছে না।” আর কাঁদতে শুরু করলেন।
“তুমি চিন্তা করো না মা। আমি দেখছি কি করা যায়।” তার ভাই বলল।
সুরভী উঠে গেল নিজের রুমে। সে ভালো করে বুঝে গেছে এটা অভ্রর কাজ। এতদিন সে অভ্র থেকে বিরক্তিবোধ করলেও এই মুহূর্তে তার ঘৃণা পাচ্ছে। প্রচুর ঘৃণা পাচ্ছে। মানুষটা নিজের কথা প্রমাণ করার জন্য এত নিচে নামতে পারে? তার সাথে যা করার করুক, কিন্তু পরিবারকের মাঝে টানলো কেন?

সে প্রথমে কল দিলো ইনারাকে। এই মুহূর্তে সে ছাড়া কেউ তাকে সাহায্য করতে পারবে না। তবে ইনারা নেট-এ ছিল না বলে তাকে পাওয়া গেল না। তার কল এলো রাতে। কল।ধরে সে নিজের দুঃখের কাহিনি বলবে এর পূর্বেই ইনারা বলল, “দোস্ত আমি তোকে কল দিতাম। জানিস এই জায়গাটা পুরো স্বর্গের মতো। এত সুন্দর, কল্পনার বাহিরে। আমার মন বসে গেছে এই জায়গায়। ইশশ তুই যদি থাকতি! শুন তোর বিয়ে হোক। তারপর আমরা আমাদের স্বামীর সাথে এ জায়গাতেই আসবো ঘুরতে। আমার এখানে এসে এত খুশি লাগছে। আমি দেশে এসে তোকে ছবি দেখানোর অপেক্ষা করছি কেবল।”
“তোকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। খুব ইনজয় করছিস তো?” তাকে এতটা খুশি দেখে তার সমস্যার বিষয় জানালো না সুরভি। ইনারা বলল, “আবার জিগায়। মজা মাস্তিতে দিন যাচ্ছে। আমার তো আসতে মন চাইছে না। এসেই আবার কাজ করা শুরু করতে হবে। প্যারাময় জীবন। আচ্ছা তুই তো কল করেছিলি। কেন? বলতো।”
“তেমন বিশেষ কিছু না। তোর ভাসুরের জন্য।”
“অভ্র ভাইয়া? তার আবার কী হলো?”
“তার ইন্টারভিউ আসছে তো আমাদের চ্যানেলে। তাই তার ব্যাপারে জানতাম।”
ইনারা দেশের বাহিরে বলে এত কিছু জানেনা। তাই মিথ্যায় বলতে হলো সুরভীর।
“দেখ সুরভি, ভাইয়া তোকে যে লিস্ট দিবে সে অনুযায়ীই কাজ কর। যা বলে তা কর। মাতব্বরি দেখিয়ে একটা কাজও এদিক-ওদিক করবি না। তাকে আমি ভালো করে চিনি না তবুও তার পাওয়ার সম্পর্কে জানি। ভাইয়া আমার সামনে একদিনের মাঝে একজনকে জেলে পৌঁছে দিয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রির এত পাওয়ারফুল একজনকে। ভাইয়ার ক্ষমতা এবং বুদ্ধি দুটোই আছে। এই দুটোর মিশ্রণ অনেক খারাপ।”
“সভ্য ভাইয়াও তার বাঁধা দেবার ক্ষমতা রাখে না?”
“সভ্য? দাদাজান নিজেই তাকে থামাতে পারে না। ভাইয়ার আসলে ইমোশনাল এটেচম্যান্ট নেই কারও সাথে।”
সুরভী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, “এমন ব্যক্তির কাছে আর কি আশা করতে পারি? আচ্ছা তাহলে তুই যা। দুলাভাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
“কাল রাতের ফ্লাইটে রওনা দিব জানেমান। কিছু সময়েই এসে পড়ব। আরও দুইদিন থাকতাম। কিন্তু মা কল করে জানাল অভ্র ভাইয়া এনগেজমেন্টের জন্য তাড়াহুড়ো করছে। এই শুক্রবারই এনগেজমেন্ট। এসে সব কাজ করতে হবে। আর শুন, তোরও কিন্তু আসতে হবে এনগেজমেন্টে।”
“দেখি দোস্ত।”
“না, দেখি বললে হবে না। তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড তোর আসতেই হবে। এখন রাখলাম। ওই অসভ্য ব্যাটা আমাকে ডাকে শুধু।” সে কল কেটে দেয়।

সুরভি পরে যন্ত্রণায়। সে কি করবে বুঝতে পারে না। একদিকে তার আত্নসম্মান। অন্যদিকে তার পরিবার। অস্থিরতা বাড়তে থাকে তার। মাথা ব্যাথা ধরে যায়। রাত কাটে। সে বসে থাকে বিছানার কোণায়। সারারাত মাথায় ভনভন করতে থাকে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা।
.
.
জোহান খুব আকুতি করে রাজি করার মায়াকে তাদের বাসায় যেতে। মায়া তো রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু জোহান এখন আর নিজের মা’কে কোনো প্রকার দুঃখ দিতে চায় না। দুঃখ, চিন্তা তার পাশেও ঘেঁষতে দিতে চায় না। এত বছর তার বাবার জন্য অনেক কিছু সহ্য করেছে। আর না। সে এখন তার মাকে পৃথিবীর ছোট বড় সব সুখ দিতে চায়। সব। তাইতো মায়ার সকল কথা শুনবে বলে ওয়াদা করে আনলো তাকে নিজ বাসায়।

বাসার সামনে যাবার পূর্বে জোহান অনুরোধ করে, “দয়া করে আমার মা’কে আপনার আসল রূপ দেখাবেন না।”
“আমার আসল রূপ মানে?”
“মানে আপনার খাটাশ স্বভাব আরকি।”
মায়া চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। জোহান মুহূর্তে তার বোকামির আভাস পায় আর সাথে সাথে বলে, “মানে আপনার রুষ্ট ব্যবহার। আমার মা খুব নরম প্রকৃতির মানুষ। অসুস্থও। সহ্য করতে পারবে না।”
মায়া তাকে পাত্তা না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
মা দরজা খুলে। মায়াকে দেখে খুশিমনে জড়িয়ে নেয়।
“আমি অনেক খুশি তুমি অবশেষে আমাদের বাসায় এসেছো।” মা বলে খুশি মনে। মা সহজেই সবাকে আপন করে নেয়। সকলের খুব আদর যত্ন করে। কিন্তু এই মুহূর্তে জোহানের খুব ভয় হচ্ছে। মায়াকে সে ডেকে তো নিয়েছে কিন্তু তার রুষ্ট ব্যবহারের কথা ভাবলেই ভয় হয়। মেয়েটা আমার মাথা উল্টাপাল্টা না কিছু বলে বসে। তার তো ঠিক নেই। এই মুহূর্তে তার মনে মনে দোয়া করা ছাড়া কিছুই করার নেই।

আশ্চর্যজনকভাবে মায়া মা’য়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করা তো দূরে থাক। একগাল হেসে বলে, “আপনি এত সুন্দর করে ডেকেছেন। না এসে পারি? কিন্তু আসব জানলে এভাবে খালি হাতে অন্তত আসতাম না। বাহ আন্টি খুব সুন্দর সাজিয়েছেন তো ঘরটা।” বলে সে ভেতর দিকে ঢুকে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ঘরটা।

এদিকে জোহান দরজাতেই দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। সে নিজেকে চিমটি কাটলো। সে কী স্বপ্ন দেখছে? এটা মায়া? আসলে মায়া চৌধুরী? এর পূর্বে সে কখনো মায়াকে এমন হাসিখুশি দেখে নি। যখনই দেখেছে রোবটের মতো গোমড়ামুখ করে থাকতে দেখেছে। তাকে হাসতে দেখাটাও তার জন্য ঝটকার মতো ছিলো।

মায়া তার পিঠের কাছে দু’টো হাত নিয়ে কিশোরীর মতো দুলতে দুলতে দেখতে থাকল তাদের বাসা। মা তার পিছনেই হাঁটছিলেন। তাকে বেশি খুশি দেখাচ্ছে। এতমাস পর তাকে এতটা হাসিখুশি দেখা গেল। তাকে দেখে জোহানে ঠোঁটেও হাসি এঁকে উঠে। সে দরজা বন্ধ করে ভিতরে গেল, তাদের দুইজনের কাছে। মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আহ্লাদিত স্বরে বলল, “মা আমাকে দেখেও এত বড় হাসি দেও না যতটা মায়াকে দেখে হাসছ।”
মা হেসে তার গাল টেনে আদর করে বলে, “তোমাকে দেখে তো সবসময়ই আমার ঠোঁটে হাসি আঁকে। তোমাকে জানিয়েছিলাম না একদিন সকালে হাঁটতে যে শরীরটা খুব দুর্বল লাগছিল? মাথা ঘুরিয়ে পরতে নিয়েছিলাম তখন একটি মেয়ে আমাকে এসে ধরে। যত্ন করে। বেঞ্চে বসিয়ে নারিকেল পানি খাওয়ায়। মেয়েটা মায়া ছিলো। এরপর প্রতিদিনই আমাদের দেখা হয় এবং মায়া আমার সাথেই হাঁটে আর গল্প করে। আমার খুব ভালো লাগে। খুব মিষ্টি মেয়ে ও।”
জোহান অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মায়ার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে আপনা-আপনি মৃদু হাসি এঁকে উঠে, “তাই? জেনে ভালো লাগছে।”
মায়াও তার দিকে তাকায়। একমুহূর্তের জন্য দুইজনের দৃষ্টিমিলন হয়। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নেয় দুইজন।

মা এবার মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “বলো কী খাবে তুমি?”
“আন্টি আমরা খেয়েই এসেছি। কিছু লাগবে না।”
“লাগবে না বললেই তো হবে না। আমি তোমাকে কিছু না খেয়ে যেতে দিব না। ”
জোহান তার মা’য়ের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “মা তুমি যে ছোটবেলায় আমার ফেভারিট হালুয়া বানিয়ে তা কেক শেপ-এ করতে? তা করো। আজ মায়ার জন্মদিন। কেক কাটব আমরা।”
“বলো কি?” মা আরও খুশি হয়ে গেছে। সে তাড়াহুড়ো করে নিজের চুল বেঁধে রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন, “আমি মজা করে বানিয়ে আনছি।”
মা যেতেই মায়া রেগেমেগে বলে ওঠে, “কী সমস্যা আপনার? আন্টিকে আমার জন্মদিনের কথা বললেন কেন? আমার জন্মদিন পালন করাটা বিরক্তির লাগে।”
“জন্মদিন একা পালন করলে তা বিরক্তিকর লাগে। অন্যকারো সাথে পালন করলে নয়। আসুন কোথাও যেয়ে বসি।”
জোহান হাঁটতে শুরু করে। তার পিছনে আসে মায়াও, “আপনি খুব বুঝেন মনে হয়।”
“বুঝি তাইতো বলছি। অনেকবছর একা একরুমে জন্মদিন পালন করেছি। খুব ভালো করেই বুঝি।”
মায়া কপাল কুঁচকে নেয়, “এত ভালো মা আছে আপনার, বন্ধুবান্ধব আছে, এত ফ্যান আছে তাও আপনি একা জন্মদিন পালন করতেন? ঠাট্টা করছেন?”
হাসে জোহান, “কারও খুশির জন্য সব হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। আর সবার পূর্বে নিজেকে।” শেষ কথাটা বলতে যেয়ে তার গলা কেঁপে উঠল।
মায়া সাথে সাথে তাকাল তার দিকে। এই বাক্যের সাথে সে নিজের জীবনটা মিলিয়ে নিতে পারছে। সে-ও হাসে, “বোধহয় জীবনে এমন বোকামি সবাই-ই করে।”

সে জোহানের রুমের ভেতর ঢুকে। দেখে তার রঙিন কক্ষটা। আসবাবপত্র হাল্কা রঙের হলেও জিনিসপত্রগুলো ভীষণ রঙিন ধরনের। সেখানে একদেয়াল ভরা তার মা এবং বন্ধুদের সাথের ছবি। অন্যদেয়ালে কিছু বাদ্যযন্ত্র লাগানো। সে কক্ষ পেরিয়ে বারান্দায় যাবার পূর্বে আবারও দেখে নেয় ছবির দেয়ালটা। দেয়ালটা দেখেই তার ঠোঁটে মিষ্টি একটি হাসি এঁকে উঠে। তার মনে পড়ে নিজের স্কুল কলেজের দিনগুলো। পিছনে তাকিয়ে হাঁটার কারণে বারান্দার দরজায় পা লেগে পরে যায় জোহানের উপর।
“এই’যে মায়া ম্যাম একটু আগে একজনের ভর্তা বানিয়ে এলেন সে এখন ঠিকমতো হাঁটতেও পাড়ছে না? এটা আজব। না’কে আমাকে ভর্তা বানানোর প্লানিং এ আছেন?
“সাট আপ। আপনার দরজার দোষ, আমার না। ইডিয়ট।”
জোহান হাসে। তাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করায়, “বেশি লাগে নি তো?”
মায়া তার বাহুতে রাখা জোহানের হাতের দিকে তাকায়। তারপর পিছিয়ে যায়। অবশ্য জোহান সেদিকে ধ্যানও দেয় না। সে যেয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনির এক কোণে। শীতল হাওয়া বইসে। বাতাসে অদ্ভুত সুবাস। সম্ভবত ব্যালকনিতে রাখা কিছু ফুলের এই সুবাস। মায়াও এসে দাঁড়ায় তার পাশে। কিছু করার নেই যে তার। জোহান বলে, “আপনার হাসিটা সুন্দর।”
মায়া চকিতে তাকায় তার দিকে, “কী বললেন?”
“আপনার হাসিটা সুন্দর। খানিকক্ষণ পূর্বেও যে আপনার ঠোঁটে বড় হাসিটা ছিলো, সে হাসিটা। এই হাসিতে আপনাকে সত্যিই মায়াবী দেখায়। আপনার চোখদুটো মায়ায় ভরে যায়।”
“মায়া…. মায়া তো সর্বনাশা। এই মায়াই তো জীবন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি এত বছরে একটি জিনিস শিখেছি যার মনে মায়া যত কম, তার জীবনে শান্তি ততই বেশি।”
“আপনার কথাগুলো অনেক আজব। আপনি জানেন?”
“হ্যাঁ জানি, ফুল অন এলিয়েনটাইপস। আমার বন্ধুরাও তাই বলতো।” বলে হাসে সে। সে মিষ্টি হাসিটি।
“আপনার বন্ধুও আছে?”
“আছে তো। আমার জীবনে খুশির কারণ আমার তিন বন্ধু এবং আমার ছোট বোন। সবাই যখন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, কেবল তারাই ছিলো আমার সাথে। আমার পাশে। আগে আরেকজন ছিলো যে আমাকে সবচেয়ে খুশি করতো কিন্তু সে অন্যকাওকে বেছে নিয়েছে। অন্যকেউ যে তার খুশির কারণ।” বুক চিরে দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো তার।
“বুঝাই যায় কতটা ভালোবাসেন আপনি তাদের। ওদের কথা বলার সময় আপনার ঠোঁটে মিষ্টি একটা হাসি থাকে। যখন ওয়াহেদ প্রথম আপনাকে মিষ্টি ডেকেছিল তখন আকাশ থেকে পড়েছিলাম। এখন বুঝলাম সে আপনাকে কেন…” জোহান সেখানেই থেমে যায়। বুঝতে পারে অসময়ে ভুল কিছু বলে ফেলেছে সে। চকিতে তাকায় মায়ার দিকে। একপলকে যেন তার চোখে ভেসে থাকা জল দেখতে পারে। এটা কি তার ভুল ধারণা? কল্পনা? মায়া চৌধুরীর চোখে জল, কথাটা তো অসম্ভব দেখা শোনাচ্ছে।
“আই এম সরি। আমি ইচ্ছা করে… ” মায়া তার কথা কেটে বলে, “আমার কিছুই আসেযায় না।”

তার কল আসে এমন সময়। কল ধরে সে কানের কাছে ধরে। কিছু কথা বলে। এমন সময় হিমশীতল বাতাস ছুটল। দমকা হাওয়া এলো। এলোমেলো করে দিয়ে গেল তার চুল। জোহান হাতে এগিয়ে তার চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দেয়। মায়া কল রেখে মুখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হয় দুইজনের। জোহান হাত পিছিয়ে নেয়। কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় না। এমন সময় হঠাৎ মা ডাক দিল। যখন যেতে নেবে তখনই মায়া বলল,”আমার যেতে হবে। আন্টিকে বলেন আমি আগামীকাল এসে হালুয়া খেয়ে নিব। এমনিতেও এখন বানাতে সময় লাগবে।”
“আমার উপর রাগ করে যাচ্ছেন।”
বাঁকা হাসে মায়া, “আমার রাগ উঠলে আপনাকে এই মুহূর্তে ব্যালকনির থেকে ঠেলা দিয়ে নিচেই ফেলে দিতাম। আমি আসি।”
আর এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে গেল সে। জোহান চোখ দুটো বড় বড় করে নিলো, “কী মেয়েরে বাবা!”
মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আসে, “মেয়েটা না খেয়েই চলে গেল। আচ্ছা ভালো কথা জিজ্ঞাসা করাই হলো না। তোমরা একে অপরকে চিনো কিভাবে?”
“ওই একটা রাক্ষুসি বসের কথা বলেছিলাম না। এটাই সে বস। সারাটাক্ষন ক্যাচক্যাচ করতেই থাকে। বুঝলে মা রাগ যেন নাকের ডগায় থাকে। এখানে এসে এত ভালো হলো কীভাবে হিসাব মেলাতে পারছি না।”
সে মুখ তুলে মা’য়ের পিছনে তাকায়। মায়াকে দেখতে পেল। সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন এই মুহূর্তেই অগ্নি দিয়ে ভস্ম করে দিবে। সাথে সাথে ঢোক গিলল সে। মায়া এগিয়ে এসে তার মা’কে হাসিমুখে বলল, “বলতে ভুলে গিয়েছিলাম আন্টি আগামীকাল সকালে জগিং এ আসব না। রাতে আপনার বাসায় এসে হালুয়া খেয়ে যাব কেমন?”
তারপর আবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে। তারপর চলে যায়। জোহান নিজের কপালেই হাত রেখে বলে, “আমার মুখই কিসমতের দুশমন।”

পরেরদিন অফিসে আসে না মায়া। সকলেই অবাক। যে মেয়ে এই ছয়মাসে ছুটির দিনেও কাজ করেছে সে এই প্রথম ছুটি নিলো। জোহান খবরটা পেয়ে খানিকটা চিন্তায় পড়ে যায়। গতকাল ফোন আসার তাড়াহুড়ো করে বের হলো মায়া। আজ অফিসেও আসে নি। সে ঠিক আছে তো?
.
.
ঘরের অবস্থা থমথমে। গতকাল থেকে সকলের দুশ্চিন্তায় ভুগছে। কাজের ঠিক নেই, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। মা খানিকটা অসুস্থও হয়ে বিছনায় পড়েছে। ঘড়ির কাঁটাও যেন আস্তে নড়ছে আজ। সুরভি বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল এবং কিছু চিন্তা করছিল। ঘড়িতে তখন আটটা ত্রিশ বাজে। অবশেষে সে উঠে দাঁড়ায়। একটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হলো। দরজায় থামাল তাকে রিধু। তার ভাবি, “সুরভি এত রাতে কোথায় যাচ্ছো? মা অসুস্থ, ঘরের অবস্থাও ভালো না। তুমি বাহিরে গেলে তোমাকে নিয়েও চিন্তায় আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।”
“সকলের চিন্তা দূর করতেই যাচ্ছি ভাবি।” বলে সে বেরিয়ে পড়ে।

রিকশা নিয়ে বিল্ডিংটির সামনে দাঁড় করায়। ভেতরে ঢোকার কথা বললেও তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অভ্রর গতকালের নাম্বারে কল দেবার পর সে ধরে না। একঘন্টা ধরে বাহির দাঁড়া করে রাখার পর ফজলু মিয়া তাকে এসে নিয়ে যায় উপরে। সে দেখে অভ্র ড্রইংরুমে বসে পা’য়ের উপর পা তুলে আয়েশে বই পড়ছিলেন। ফজলু মিয়া বলে, “ভাই আইসে মিস সুরভি, কন এখন আই কি করি?”
“তোমার কিছু করা লাগবে না। তুমি যাও।”
ফজলু চলে যায়। এখন রুমে কেবল আছে অভ্র এবং সুরভি। অভ্র মুখ তুলল না। একটিবারও তাকাল না তার দিকে। সুরভি মিনমিনে গলায় বলে, “সরি।”
“কেউ কী কিছু বলছে? শোনা যাচ্ছে না।”
“বলেছি সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। সরি।” এবার তার কন্ঠ খানিকটা উঁচু করে সে।
অভ্র বাঁকা হাসে, “সেদিন ইন্টারভিউর রুমে কথা বলার সময় তো খুব এনার্জি ছিলো। এখন সে এনার্জি কোথায় গেল?”
নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল সুরভির। নিজের উপর জেদ উঠছিলো। তার জন্য আজ মা-বাবাকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। বাবার সম্মানের প্রশ্ন উঠেছে। নিজের আত্নসম্মানটাও আজ ধরে রাখতে পারে না সে। এই লোকটার কাছে এত সহজে পরাজিত হলো। তার সাথে এসব কী হচ্ছ? প্রথমে আহনাফের দেওয়া আঘাত সহ্য করেছে। আর এখন এই লোকটার অন্যায়ের কাছে সমর্পণ করছে? এই চরম সত্যটা ভেবেই তার বুকের যন্ত্রণা বাড়ল। তার শরীর কাঁপছে। মাথা ঝিমাচ্ছে। খুব দুর্বল লাগছে নিজেকে। নিজ অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে, “মাফ করে দিন আমাকে। আমি…আমি সেদিন আপনার বিরুদ্ধে যেয়ে ঠিক করি নি। ক্ষমা করে দিন।”

নিজের জয়ে খুশি হওয়া অভ্র আনন্দ আয়েশে বই উপভোগ করছিল। সাথে সুরভির পরাজয়ও। তারপর হঠাৎ তার কন্ঠটা অন্যরকম শুনায়। সে সামনে তাকিয়ে দেখে চমকে উঠে সুরভির অবস্থা দেখে। সে দেখতে দেখতে সুরভি টলে পরে মেঝেতে।

অভ্র আ*তঙ্কে ছুটে যেয়ে সুরভিকে বাহুডোরে নেয়, “সুরভি…সুরভি কী হয়েছে তোমার?” তার গালে হাত রেখে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে। আভাস পায় সুরভির দেহ ভীষণ গরম। পুড়ছে যেন। সে আবার বলে, “তোমার দেখি জ্বর। ভীষণ জ্বর।”
সুরভি এত দুর্বলতার মাঝেও জোর দিয়ে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করে অভ্রকে। দুর্বল গলায় বলে, “ছুঁবেন না। খবরদার আপনি আমায় ছুঁবেন না। আপনাকে ঘেন্না লাগছে আমার। আপনি আমায়…” কথা বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে যায় সে।

চলবে….

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-১২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সুরভি এত দুর্বলতার মাঝেও জোর দিয়ে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করে অভ্রকে। দুর্বল গলায় বলে, “ছুঁবেন না। খবরদার আপনি আমায় ছুঁবেন না। আপনাকে ঘেন্না লাগছে আমার। আপনি আমায়…” কথা বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে যায় সে।

অভ্র তার গাল ধরে ডাকল তাকে, “সুরভি…সুরভি উঠো।”
তার কন্ঠে চিন্তা স্পষ্ট। সুরভি ওঠে না। চোখও খুলে না। সে বুঝতে পারে না কি করবে। এক দুই না ভেবে কোলে তুলে শোবার রুমে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে ডাকল ফজলু মিয়াকে। তাকে আদেশ করল ডাক্তার ডাকার জন্য। ফজলু মিয়া সাথে সাথে বেরিয়ে যায়।

অভ্র বসে সুরভির পাশে। তার শরীরে আবার হাত দেয়, জ্বরে পুড়ছে তার গা। সে রাগান্বিত সুরে বলে, “এই মেয়েকে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে আসতে কে বলেছে?”
পরে তার নিজেরই মনে পড়ে নিজের তৈরি করা সমস্যা কথা। তার সমস্যার কারণেই মেয়েটার এমন করুণ অবস্থা হয়েছে? ভাবতেই কেমন বিষণ্ণ লাগল তার। সে তো কেবল শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। মেয়েটা এমন এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে কে জানতো? নিজের উপর রাগ লাগছিল তার। সাথে বিরক্ত লাগছিল সুরভির উপর। সামান্য ক্ষমাই তো চেতে হতো। এর জন্য নিজের উপর জুলুম করতে হবে?

তার চোখ যেয়ে আটকায় সুরভির মুখের উপর। রাত্রীর চন্দ্রিমার জ্যোৎস্না এই অন্ধকার রুমে আলোর মতো কাজ করছে। সে চন্দ্রিমার জ্যোৎস্না বৃষ্টির মতো ঝরে পরছে, তার বিছানায় শুয়ে থাকা কৃষ্ণকলি কন্যাটির উপর। ছোট পুতুল পুতুল মুখটা মায়াবী দেখাচ্ছে। হিম বাতাসের ছোঁয়ায় তার কেশগুলো এলোমেলো হয়ে গেল।

অভ্র ভাবল, তার উঠে যাওয়া উচিত। রুমের বাতিটা জ্বালানো উচিত। কিন্তু সে উঠে না। ঠাই বসে রয় সেখানে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তার উঠতে মন চাইছে না। ভাল্লাগছে তার সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে। ইচ্ছা হলো এভাবে তাকিয়ে থাকতে। ব্যাপারটা তার জন্য অদ্ভুত। এর পূর্বে সে কোনো নারীর প্রতি এমন অনুভূতিটা আর হয় নি। আনমনেই তার হাত এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। আলতো করে তার চুলগুলো আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিলো। তখনই নড়ে উঠলো সুরভী। ধীরে চোখ গুলো খুলল। চোখ খুলতেই মৃদু আলোয় কারও চেহেরার দর্শন হলো। তবে পুরুষটাকে চিনতে সময় লাগলো তার। তার হাতের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করল তার মুখখানার উপর। কেঁপে উঠে সে। ঘাবড়ে যায়। লাফ দিয়ে উঠে বসে। ঘাবড়ে তাকায় চারদিক। বেডরুমে শুয়ে আছে সে। বাতি বন্ধ। এই ঘুটঘুটে আঁধারে কেবল চাঁদের আলো সহায়। সুরভি আ*তঙ্কিত হয়ে পিছিয়ে যায়, “আপনি কী করছেন আমার সাথে? আর আমি এখানে কী কেন? আর আমাকে বেডরুমে নিয়ে এসেছেন কেন? কী মতলব আপনার?”

“এই’যে মিস ক্যাঁক্যাঁ, তোমার ক্যাঁক্যাঁ করা বন্ধ করো তো। কান ধরিয়ে দিয়েছ। তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলে বলে তোমাকে কোলে করে তুলে আনলাম আর আমার উপর অহেতুক আরোপ লাগাচ্ছ?” অভ্র বলল। বিরক্তির সুরে। আরও যোগ করল, “তোমার উপর আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেও। সো নিজেকে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করো।”
সুরভি নিজেকে সংযত করে বলে, “দেখুন আপনার মুখ দেখারও আমার বিন্দুমাত্র শখ নেই। আমি কেবল আপনাকে অনুরোধ করতে এসেছি যে…আমার উপরের ক্ষোভ আমার পরিবারের উপর বের করবেন না। আমার বাবা মা’কে আমি কষ্টে দেখতে পারি না। দয়া করে…দয়া করে তাদের এসবের মাঝখানে আনবেন না। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। আপনি যা বলেছেন তা করেছি। প্লিজ এবার এসব ঝামেলা ঠিক করুন। আমার বাবার সম্মানের প্রশ্ন।”
“প্রথমে একটা কথা বলো। তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছ, তোমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, নিজের খেয়াল রাখতে পারো না?”
“সবই আপনার এবং আহনাফের মেহেরবানি। আপনাদের দুইজনের জন্য আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে গেছে।”
অভ্র খানিকটা চুপ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে, তার রাগের কারণে সুরভির অনেককিছু সহ্য করতে হয়েছে। সে সুরভিকে অসহায় দেখতে চেয়েছিল। এমন অসুস্থ নয়।
পরক্ষণেই তার ধ্যান যায় সুরভির কথায়, “ওয়েট, কী বললে তুমি? আহনাফ এসবের মাঝে কীভাবে এলো?”
সুরভি কথাটা বলে নিজেই বেকুব হয়ে যায়। অভ্রর সামনে আহনাফের কথাটা বলার মানে হয় না। অভ্রর সামনে সে নিজেকে আর অসহায় বা বোকা দেখাতে চায় না। কী বলবে সে? যে দুইবছর ধরে সে জানতো আহনাফের মনে কোথাও না কোথাও তার অতীতের প্রেমিকা আছে। আর তবুও তার সাথে থেকেছে। শেষ পরিণাম হিসেবে পেয়েছে তো বিশ্বাসঘাতকতা।

সুরভি মুখ ফিরিয়ে নেয়। কাঁপানো গলার সুর তার, “কিছু না। আপনার অনুমতি হলে আমি যেতে পারি?” শেষ বাক্যতে খোঁচা মারাটা স্পষ্ট ছিলো।
অভ্র বাঁকা হাসে, “অনুরোধও ঠেসমেরে করছ? ইন্টারেস্টিং। কিন্তু…” সে সুরভির দিকে ঝুঁকে। মুখোমুখি হয়ে বলে, “অনুরোধ গ্রাহ্য করা হলো না।”
অভ্রকে কাছে আসতে দেখেই সুরভি ঘাবড়ে পিছিয়ে যায়। জানালা দিয়ে ঝলকে আসা জ্যোৎস্নার বৃষ্টিতে দৃষ্টিমিলনের মধুর মুহূর্ত আসে। এতটা কাছ থেকে অভ্রকে দেখে নিশ্বাস ফেলতে ভুলে যায় সে। তার গালে উষ্ণ অনুভূতি হয়। সে কী লজ্জা পাচ্ছে? না, অসম্ভব। নিশ্চিত জ্বরের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। সাথে সাথে সে দৃষ্টিমিলনের সুতো কাঁটে। চোখ ফিরিয়ে নেয়।

অভ্রও উঠে দাঁড়ায়। বলে, “ফজলু ডাক্তার আনতে গেছে। উনি আসুক। তুমি রেস্ট নেও। তারপর ওকে বলব বাসায় দিয়ে আসতে।”
“আপনি আগে থেকেই অনেক মেহেরবানি করেছেন। দয়া করে কেবল আমার বাবার সম্মানটা তাকে ফিরিয়ে দিবেন। এতটুকুই যথেষ্ট হবে।”
বলে সে উঠতে নেয়। রওনা দেবার জন্য। তখনই অভ্র বলে, “আমার কথা অমান্য করার চেষ্টাও করবে না। তুমি জানো আমি কী করতে পারি।”
“আবারও হুমকি দিচ্ছেন?”
“না, ওয়ার্নিং দিচ্ছি। লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার কথা শুনলে সব ঠিক হয়ে যাবে, নাহয়… বাকিটা বুঝে নেও।”
সুরভি আসলে বুঝে নেয়। এই মুহূর্তে অভ্রের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নিজের পরিবারকে সমস্যা হয়ে রাখতে চাই না সে। আর পরিবারের জন্য আজ সে নিজের আত্মসম্মানকে পাশে রেখে অভ্রের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। যে মেয়ের কাছে নিজের আত্মসম্মান তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, আজ সে হেরে গেছে এমন এক লোকের সামনে।

অভ্র কক্ষের বাতি জ্বালায়। আলোয় ছড়িয়ে যায় চারপাশ। তার কক্ষটা বেশ সাধারণ। সাদা রঙের আসবাবপত্র এবং হাল্কা, সাধারণ শপিজ দিয়ে সাজানো। তবে বিছানার সামনের দেয়ালেই লাগানো বিশাল এক ফটোফ্রেম। ছবিতে অভ্রসহ আরও দুইজন রয়েছে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। কিশোর বয়সের দেখাচ্ছে তাদের। ছেলেটিকে দেখে সে অবাক হয়। চেনা চেনা লাগে তার।

“নক্ষত্র না উনি?” বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করে সুরভি, “সে আপনার বন্ধু? এত ভালো মানুষ আপনার বন্ধু কীভাবে হতে পারে? বিশ্বাস করাটা কষ্টসাধ্য। স্কুলে থাকতে ওয়েবসাইডে তার অনেক ডকুমেন্টারি পড়েছি। অনেক ভালো লিখতেন। অনেক শিক্ষা পাবার মতো ডকুমেন্টারি দিতেন চিত্রের সাথে। সে ডকুমেন্টারির সাথে মেলানো চিত্র। একটা কনটেস্টে জয়ী হবার পর আমার সাথে আলাদাভাবে মেসেজিংও হয়েছিল। সে অনেক সুইট। আমার সাথে দেখাও করতে এসেছিলেন। মানুষটা অনেক ভালো। বিশ্বাস করা মুশকিল যে উনি আপনার বন্ধু।”
তার কথায় অভ্রর মাঝে বিশেষ কোনো প্রভাব পড়েছে বলে সন্দেহ। সে পিছনে ফিরে সুরভিকে বলে, “তোমার না জ্বর? জ্বরের মধ্যে এত পটর পটর কিভাবে করো তুমি? আর একটা কথার উওর দেও তো, একদিনে এত কীভাবে অবস্থা খারাপ করলে নিজের?”
“আপনাকে ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য দেবার জন্য আমি বাধ্য নই।”
“ওহ তোমার এমন মনে হয়?” অভ্র আবার এগিয়ে আসে সুরভির দিকে। তার দিকে ঝুঁকে তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “ভুল মনে হচ্ছে তোমার। তোমার উপর কেন যেন বেশি রাগতে পারি নি। তাই বেশ সহজে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি। এই দেখো তোমার এক কথায় তোমার বাবার হোটেলের সমস্যা সমাধানের কথাও বলেছি। লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার কথা শুনলে তোমার কোনো সমস্যাই হবে না। বুঝেছ?”
সে সুরভির জ্বরের মাত্রা বুঝার জন্য তার মাথায় হাত রাখে। কিন্তু সুরভি বিরক্তি নিয়ে তার হাত সরিয়ে দেয়।
অভ্র আবার বাঁকা হাসে, “ইন্টারেস্টিং। এতকিছু হলো তোমার তেজ কমলো না। এত জেদি কেন তুমি?”
“ছোটবেলার সমস্যা। যাদের ভালোবাসি তাদের জন্য নিজের জীবন দিতে পারি আর যাদের ঘৃণা করি তাদের মন থেকে ঘৃণা করি।”
“আর আমাকে ঘৃণা করো?”
“আপনি যা করেছেন তারপর কী মনে হয় আপনার?”
“আসলে ভালোই হলো, অন্তত ঘৃণার সম্পর্কটা আছে আমাদের মাঝে।”
সুরভির বিরক্তির সীমা বাড়ে। সে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।
“এইখান থেকে নড়বে না। যদি আমার কথা মতো চলো তাহলে তোমার সামনে সব ঠিক করে দিব আমি। কেবল যদি আমার কথা মেনে চলো।” অভ্র সেখান থেকেই চলে যায় কিছু মিনিটের জন্য। ফেরত আসে স্যুপের বাটি সহ। গরম স্যুপের বাটি সুরভির সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, “খেয়ে নেও ভালো লাগবে। শক্তিও লাগবে, সাথে জ্বরও কমবে।”
“দেখুন মিস্টার অভদ্র আপনার হাতের অমৃতও আমি না খাই। কে জানে বিষ মিশিয়ে দিলেন না’কি?”
অভ্র চোখ রাঙিয়ে তাকায় তার দিকে, “তুমি অতিরিক্ত ত্যাড়া মানুষ। সাথে বোকাও। তাই প্রতি কথায় কথায় তোমাকে হুমকি দিতে হয়। আমাকে একটু তো ব্রেক দেও। এখন চুপচাপ লক্ষ্মী মেয়ের মতো স্যুপ খেয়ে নেও। ডাক্তার আসলে মেডিসিন নিয়ে বাসায় চলে যেও।”
অভ্র আবার তার হাতে স্যুপ দিতে নেয়।
“বলেছি তো খাব না। আপনি আমার কাজ সেরে যেতে দিন কেবল।” বলে সে স্যুপের বাটি সরাতে নিলেই গরম স্যুপ দুইজনের হাতে পরে যায়। ঘাবড়ে যায় সুরভি। আ*তঙ্কিত সুরে বলে, “সরি.. সরি ভুলে হয়ে গেছে। প্লিজ এর জন্য আবার আমার ফ্যামিলির ক্ষতি করেন না। প্লিজ।”
তাকে এমন ঘাবড়াতে দেখে কেন যেন তার ভালো লাগে না। সে স্যুপের বাটিটা পাশের টেবিলের রেখে আলমিরা থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসে। এসে বসে সুরভীর সামনে। তার হাতটা ছুঁতেই সুরভি আঁত*কে উঠে। সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয়। কিন্তু অভ্রও কম নয়। সে চোখ রাঙিয়ে তাকায় সুরভির দিকে। জোর করে তার হাত ধরে মলম লাগিয়ে দিতে থাকে।

সুরভি হাত পোড়ায় ব্যাথায় কান্না চলে আসে। সে চোখ বন্ধ করে চেপে ধরে। এই পীড়ার মাঝে হঠাৎ উষ্ণ ছোঁয়া পায় তার হাতে। আঙ্গুলে আঙুল ছোঁয়াল। অপ্রত্যাশিতভাবে তার বুকের ভেতর ধক করে উঠে। সে চোখ খুলে তাকায়। অভ্রর ছোঁয়ায় তার এমন অনুভূতি হয়েছে ভাবতেও নিজের উপর রাগ উঠে। সে হাত পিছিয়ে নেয়। কিন্তু অভ্র মানে না। সে আবারও ধরে সুরভির হাত। শক্ত করে। সে কুঁকড়ে যায়। লজ্জায় তার গালে লাল আভা ছড়িয়ে যায়। দোষটা সামনে বসা লোকটার। লোকটা মাত্রাধিক আকর্ষণীয় পুরুষ। তার মনে আছে, কলেজে প্রথম তার ছবি দেখেছিল খবরের কাগজে। ছবিটা এনেছিল তার এক ক্লাসমেট। পুরো ক্লাস সেই পত্রিকার অংশ নিয়ে টানাটানি করেছে। তারও দৃষ্টি আটকায় সে এমন এক সময় পত্রিকায়। সকল মেয়েরা তার ছবি দেখে পাগল হয়েছিল। জাতির প্রথম ভালোবাসা হয়েছিল সে সেকালে। এমন সুদর্শন পুরুষের দর্শনে সে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। যেন ঘোরে ডুবে যায়। আজও সে আকর্ষণ যায় নি এই মুখখানি থেকে। অভ্র চোখ তুলে তাকায়। চোখে চোখ মেলে। হয় অনিচ্ছুক নয়নবন্ধন। তার সুরমারঙা চোখখানা… তা থেকে যেন চোখ ফেরানো দায়। তবুও সুরভি চোখ নামিয়ে নেয়। অস্বস্তিকর এক অনুভূতি কাবু করে তাকে। এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। আচ্ছা অভ্র কী তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে? ছিঃ! সে কি ভাববে?

“আপনারও হাতে গরম স্যুপ পরেছে। আপনি মলম লাগাচ্ছেন না?” প্রশ্নটা চিন্তিত শুনালেও সুরভি প্রশ্নটা করে অনমনীয়তা বজায় রেখে।
অভ্র এক পলক তাকায় তার দিকে। সুরভির হাতে মলম লাগানো শেষে সযত্নে বালিশে রাখে। অনুভূতিশূন্য কন্ঠে বলে, “আমার ব্যাথা লাগে না।”
উত্তরটা বেশ অকপটে ছিলো। ব্যাথা লাগে না? এ কেমন কথা? ভূত প্রেত না’কি যে ব্যাথা লাগে না। মানুষই তো। মানুষের তো সকল অনুভূতিই হয়।
তার কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই অভ্র উঠে দাঁড়ায়। তার সামনেই কাউকে কল দিয়ে বলে আগামীকালের মধ্যে তার বাবার হোটেলের সকল সমস্যা সমাধান করতে এবং হোটেলের নামে সুনাম করতে। এর প্রয়োজন ছিলো না। সমস্যা সমাধান করলেও ঢের সাহায্য হতো। সে কথা বলার পূর্বে ফজলুমিয়া ডাক্তার নিয়ে হাজির। ডাক্তার তাকে দেখে কিছু ঔষধ দেয়। তারপর অভ্র তাকে ফজলু মিয়ার সাথে বাড়িতে পাঠায়। যাবার পূর্বে সুরভি আবার একপলক দেখে সে ছবির দিকে। মাঝখানে অভ্র। তার একপাশে দাঁড়ানো নক্ষত্র এবং অনুপাশে অচেনা এক চেয়ে। নক্ষত্রের ডকুমেন্টারি একসময় খুব জনপ্রিয় ছিলো। কিন্তু হঠাৎ সে গায়েব হয়ে যায়। আচ্ছা কোথায় সে? আর অভ্রর পাশের মেয়েটা কে?
.
.
আজ অনেকদিন পর সামির সাথে দেখা হয় জোহানের। মায়াকে অফিসে না পেয়ে ফাঁকি দিয়ে এসেছে সে সামির স্টুডিওতে। সামি তার কাজিন হয়, সাথে পুরাতন ব্যান্ডমেটও। তার সাথে গল্প করছিল অনেকদিন পর। আড্ডা জমেছে। পুরাতন দিনে এমন আড্ডা দিতো। আজ এই আড্ডায় পুরাতন কত স্মৃতি মনে পড়ে। সাথে নতুন জীবনের সুখ-দুঃখের কথাও বলে। এমন সময় সামি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তো ব্রো নতুন কোম্পানিতে কেমন লাগছে?”
“ধ্যুর বলিস না, জান বের করিয়ে দেয় কাজ করাতে করাতে। এই গানের ট্রেনিং নেও, এই নাচের, এইসেই। এত প্রাক্টিস তো ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেও করিনি।”
“বলিস কী? আমি তো ভেবেছি মায়ার কোম্পানির সেহেতু খুব ইনজয় করছিস। ও যে বিন্দাস মেয়ে।”
“বিন্দাস? কীসের বিন্দাস। রাক্ষুসি একটা রাক্ষুসি। বিশ্বাস করবি না সবারইকে খাটিয়ে মারে। আমার এই সিডিউল তো ওই-ই করল। খাটাইশ একটা।”
“মজা করছিস তুই আমার সাথে? ওর মতো হাসিখুশি ঘুরে বেড়ানো মেয়ে খাটাইশ?”
“একটা কথা বল, তুই ওকে কিভাবে চিনিস?”
“আরে মেহেদী ছিলো না? আমাদের জুনিয়র। আমাদের জুনিয়র ট্রেনার ছিলো। আমি ওকে অনেক হেল্প করতাম। একসময় ভালো খাতির হয়। ওর ক্যাম্পাসেও যাই একদিন। তখন মায়ার সাথে দেখা। ওর মতো মেয়ে আমি আর দেখিনি। সবার সাথে কথা বলতো, ঘুরে বেড়াত। এক জায়গায় ওর পা টিকতো না। কারও উদাসীন মুখ দেখলে না চিনলেও তাকে হাসিয়েই ছাড়তো। বিন্দাস ঘুরে বেড়াতো, কারও পরোয়া করতো না। যেন খোলা আকাশের পাখি ছিলো সে।”
জোহান কিছুটা অবাকই হয় কথাগুলো শুনে। হয়তো সামি ভুল কাওকে ভাবছে। মায়াকে আগে এমন ছিল? সে মায়া এবং এ মায়ার মাঝে জমিন আসমানের পার্থক্য। হঠাৎ তার মনে পড়ে গত রাতের কথা। মায়া কত মিষ্টি এভাবে কথা বলেছিল তার মায়ের সাথে। তাহলে কোনটা আসল মায়া?
এমন সময় সামি হঠাৎ বলে, “ওয়েট তোকে একবার বলেছিলাম মেয়েটার কথা। মেয়েটার কন্ঠে যেন মধু মিশানো। এত সুন্দর গান গায় যা বলার বাহিরে। ওর গান একবার শুনলে সে গানের রাজ্যে হারিয়ে যেতে মন চায়। কিছু মুহূর্ত ঘোর কাটতে চায় না।”
“মায়া গান গাইতে পারে? মায়া চৌধুরী?”
“হ্যাঁ, কেন জানিস না?”
“ওকে কখনো গান গাইতেই দেখলাম না।”
“জানি না। আমি অফার করেছিলাম আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করতে। কিন্তু ওর বাবার নিজের কোম্পানি ছিলো। আমি ভেবেছিলাম কিন্তু বছরে ওকেও দেখতে পাব গায়িকা হিসেবে। তারপর শুনি ও বিদেশে চলে গেছে। এনগেজমেন্ট ভাঙার পর। ও খুব ভালোবাসতো ওর ফিয়োন্সেকে। ছোটবেলার ভালোবাসা ছিলো ওর। মেহেদী বলেছিল, পাগল ছিলো না’কি সে ছেলের জন্য। এনগেজমেন্ট ভাঙার পর ফ্যামিলির সাথেও সম্পর্ক খারাপ হয় ওর। ওর ফিয়োন্সের বড় ভাইয়ের সাথে ওর বড় বোনের বিয়ে হতো। একারণে ওর এত খারাপ সময়ে ওর পাশে না থেকে দূর এক দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটার জন্য খারাপই লেগেছে।”
কথাটা শুনে চিন্তায় পড়ে গেল জোহান। ভীষণ খারাপ লাগছিলো তার। সে একদিন এই নিয়ে কতকিছুই না বলল। তা ভাবতেই এখন নিজের উপর জেদ উঠছে।
.
.
রাত তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। অভ্র তখনও বসেছিলো। পা’য়ের উপর পা তুলে। তার চোখমুখ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। এমন সময় ফজলু আসে। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আপনে হুদাই এতক্ষণ ধরে জেগে আছেন। যেয়ে ঘুমান। আপনের তো ঘুম না হলে করে মাথা ব্যাথা, না ঘুমাইলে কাল ঝিমঝিম ধরব মাথা।”
“যে তথ্য আনতে বলেছি, এনেছিস? ”
“আবার জিগায় ভাই। আপনি কইবেন আর কাজ হইব এমন হয়? সুরভি ম্যাডাম কাম দিসে ছাইড়া। ইন্টারভিউর দিন অন্য মাইয়ার লগে কুকীর্তি করতে ধরছে আহনাফরে, দিসে ঝারি, বিয়া দিসে ভাইঙা।”

অভ্রর চোয়াল শক্ত হয়। তার চোখে রাগ ভাসে। সে হাত মুঠোবন্দি করে নেয়। সে কাঠকাঠ গলায় বলে, “জানিস তো আহনাফের সাথে কী করতে হবে?”
“তা জানি ভাই। কিন্তু আমি এইটা বুঝলাম না আপনি সুরভি ম্যাডামের এত চিন্তা করতাসেন কে? এই সপ্তাহ আপনার বাগদান হইব মায়া ম্যাডামের লগে। তারে নিয়া না ভাইববা সুরভি ম্যাডামের এত চিন্তা করেন কেরে?”
অভ্র অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সাথে সাথে ফজলু মিয়া ভয়ে ভয়ে বলে, “বুঝসি বুঝসি ভাই যা করতে হইব বুঝসি।” বলে দৌড়ে পালায়।
.
.
ইনারা আসার পর সুরভি তার সাথে দেখা যায়। হোটেল নিয়ে সকল সমস্যা সমাধান হওয়ায় ঘরে শান্তি আসে তার। কিন্তু তার মনে এখনো শান্তি নেই। এক সপ্তাহে তার জীবন কিভাবে উলটপালট হয়ে গেল সে ভেবে কুল পায় না। কিন্তু ইনারার কাছে যেয়ে সে নিজের চিন্তা সব ভুলে যায়। তার সাথে কথা কথায় বললেই যেন তার মনের কষ্ট নিমিষে শেষ হয়ে যায়।

ইনারা তো তাকে দেখে খুশিতে আত্নহারা। সকল গল্প শোনায় তার ট্রিপের। জায়গাটার বিবরণ দেয়। সে জায়গার সৌন্দর্যের বিবরণ দেয়। তার ও সভ্যর গল্পন শুনায়। কিন্তু সে খেয়াল করে সুরভির কিছুতেই মন নেই। তার ঠোঁটে হাসি থাকলেও মুখে কেমন উদাসীনতা। সে সুরভিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে না কিছু। কারণ সে জানে সুরভি সরাসরি উওর দিবে না।
“তোর অফিস কেমন চলছে?” তার প্রথম প্রশ্ন।
আচমকায় এমন প্রশ্ন শুনে সুরভী ঘাবড়ে যায়। সে আমতা-আমতা করে বলে, “হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস যে?”
তার এমন অস্বস্তিকর ভাব ইনারার সন্দেহ দৃঢ় করে। এরপর সে জিজ্ঞেস করে, “আংকেল আন্টি সবাই ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ তারা ঠিক আছে।” নির্দ্বিধায় বলে সুরভি। সে সমস্যা তো আগেই সমাধান হলো। এখন তার পরিবারের সকলে ভীষণ খুশি। কিন্তু তার নির্দ্বিধায় এমন বলা উওর সন্দেহ গাঢ় করে ইনারার। সে জিজ্ঞেস করে, “আহনাফের সাথে তোর সম্পর্ক ঠিক আছে তো?”
প্রশ্নটা শুনে হতচকিত হয়ে যায় সুরভি। সে কি বলবে বুঝতে পারে না। লুকাবে ইনারা থেকে? কতদিন? আজীবন তো আর মিথ্যা বলতে পারবে না। তাই বলে দিলো, “আমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।”
ইনারা কপাল কুঁচকে নেয়, “আহনাফ কী করেছে?”
সুরভি মজা করে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চায়, “আহনাফ না তো। আমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। মনটা আর ওর উপর টিকছিল না। ভাবছি দুলাভাইয়ের মতো হ্যান্ডসাম কাওকে খুঁজবো।” বলে হাসে সে।
কিন্তু ইনারার চোখে মুখে এখন তেমন তীক্ষ্ণতা। সে কঠিন গলায় আবারও জিজ্ঞেস করে, “আহনাফ কী করেছে? সত্যি বল। তুই জানিস আমি মিথ্যা বললে ধরে নেব। তাই সত্যিটা বল।”
সুরভি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। তারপর সত্যিটা জানায় ইনারাকে। সেদিনের সকল খবর খুলে বলে। সবটা শুনে ইনারা রাগের আগুনে জ্বলে উঠে। সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়ায়। সে সোজা বাহিরের দিকে বের হতে থাকে।

সুরভি হতবাক। সে এসেছে ইনারার বাড়িতে। আর ইনারা তাকে ছেড়ে হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে? সে উঠে যায় ইনারার পিছনে। জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
ইনারা ক্রোধিত কন্ঠে বলে, “ওই আহনাফকে কিছু মুহূর্তের জন্য জাহান্নামের দর্শন করিয়ে হাস্পাতালে ভর্তি করতে।”

চলবে….