অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
জানালার কাঁচ ভেদে শীতের সকালের মিষ্টি সোনালী রোদ্দুর এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল সুরভিকে। শীতের মৌসুমে কম্বল মুড়ে শুয়ে ছিলো সে। তার ফোনে এলার্ম বেজেই যাচ্ছে। কিন্তু তার ঘুম ভাঙার নাম নেই। তার মা’য়েরও ডাক শোনা যায়, “সুরভি… এই সুরভি আজ তোর অফিস নেই?”
অফিসের কথা শুনে এক লাফ দিয়ে উঠে সে। তার সামনের দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকায়। সকাল সাড়ে আটটা বাজে। তার নয়টায় অফিসে উপস্থিত থাকতে হবে। অথচ বাসা থেকেই তার অফিসের পথ আধা ঘণ্টা।
সে দ্রুত উঠে তৈরি হয়ে নেয় অফিসে যাবার জন্য। আলমিরা থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে দৌড় দেয়। তবে দরজা থেকেই ফেরত আসে। তার টেবিলের উপর রাখা একটি ছবির ফ্রেম হাতে নেয়। ছবিটিতে তার সাথে আরও দুইটি মানুষ আছে। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, তার বন্ধুরা। ইনারা ও প্রিয়। তাদের ছবিটা দেখে হাসি এঁকে উঠে তার ঠোঁটের কোণে। সে আলতো করে ফ্রেমটায় চুমু খেয়ে ফেরত রাখে। আবারও দৌড়ে পালায়। ড্রইংরুমে যেতেই তার মা ধরে ফেলে, “ট্রেনের মতো কোথায় ছুটে যাচ্ছিস?”
“মা খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। যেতে দেও।”
“দেরির কথা ঘুমানোর সময় মাথায় আসে না। সুযোগ পেলেই কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম দেয়। নাস্তা না করে যেতে দিচ্ছি না। আয় বস।”
সুরভীকে জোর করে বসানো হয়। তার ভাই সাঈদও টেবিলে বসে নাস্তা করছিল। সে মা’য়ের কথার তাল মিলিয়ে চলে, “আহা মা ওর তুলনা কুম্ভকর্ণের সাথে করে, কুম্ভকর্ণের অপমান করো না তো।”
“মা তোমার ছেলেকে বুঝাও, নাহয় ভালো হবে না কিন্তু।”
এতক্ষণে তার ভাবি রিধু আসে গরম গরম পরোটা নিয়ে। তার প্লেটে পরিবেশন করে সাঈদের প্লেটেও আরেকটা দেয়। তখন সুরভি বলে, “ভাবি বেশি পরোটা দিও না, ক’দিন বাদেই বেলুনের মতো বাস্ট হয়ে যাবে।”
একথায় সাঈদ মারে তাকে। সুরভি আবারও বিচার দেয়, “মা দেখো ভাইয়া মারছে।”
মা তাদের কান্ডে বিরুক্ত হয়ে বললেন, “বুড়ো দামড়া হয়েছিস দুটো তাও বাচ্চামি যায় নি। তোদের বয়সে ঘর, সংসার, তোদের দুইজনকে সামলিয়েছি আর তোরা মারামারি করছিস।”
“শুরু হয়ে গেছে মা’য়ের রেডিও।” সাঈদ বিড়বিড় করে বলে। সুরভি মিটিমিটি হাসে কথাটা শুনে। মা আনমনে কথা বলতে বলতে রান্নাঘরে যেতেই সুযোগ বুঝে সুরভি হাতে পরোটা নিয়েই দৌড় দেয়। ড্রইংরুমে বাবা টিভি দেখছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করে, “অফিস যাও নি বাবা?”
“তোর মা’কে আধাঘন্টা আগে চায়ের কথা বলেছি। জোর করে ছেলে মেয়েকে খাওয়াবে। আমার তো পাত্তাই নেই। যাক আমার কি আমিও খবর দেখার বাহানা পেলাম।”
তখন টিভিতে খবর আসছিল, “আট বছর পর নেতা আরিফুর ইসমাত অভ্র কেন ছাড়ছে এস.এল দল? শোনা যাচ্ছে বিরোধী দল যোগ দেবার পরিকল্পনা করছেন তিনি।”
সুরভির বাবা বললেন, “ব্যাপারটা খারাপ হয় না। এখনের সরকারে কোনো যুবক যুক্ত হলে সম্ভবত পরিবর্তন হবে। সে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়ে দেশের উন্নতি ঘটাবে।”
“অথবা দেশকে আরও বিপদে ঠেলে দিবে। এই লোকটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না।”
“এমন কেন বলছিস?”
“বাবা আমি তো টিভি চ্যানেলে কাজ করি। এমন অনেক খবর পাই যা তোমরা জানো না। রাজনীতির সাথে জড়িত অনেক খবর পাই। যা দাবিয়ে দেওয়া হয়, সামনে আসে না। আচ্ছা আমি গেলাম দেরি হয়ে যাচ্ছে। একবার মা’য়ের হাতে ধরা পড়লে না খাওয়ানো পর্যন্ত ছাড়বে না।” বলেই সে দৌড় দিলো।
বাবা বললেন, “এটাও ঠিক, মেয়ে খাওয়ার চক্করে পালায় আর আমি চেয়েও খাবার পাই না।” গভীর নিশ্বাস ফেলে আবার টিভির দিকে মনোযোগ দেয়।
রিক্সা থেকে নেমে সুরভি দ্রুত অফিসে পৌঁছায়। দেরি হয়ে গিয়েছে তার। নিশ্চিত বকা খাবে। দ্রুত অফিসের ভেতর ঢুকে, লুকিয়ে নিজের ডেস্কে যেয়ে বসে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। তার পাশের ডেস্কে বসে করছিলো তার বান্ধবী তাইফা। তাকে জিজ্ঞেস করে, “তাফু, তুষার স্যার কী রাউন্ড দিয়ে গেছে? দিলে আজ আমি শেষ।”
তাইফা কাজ করছিল তার কম্পিউটারে। অবিরত কাজ করতে করতেই উওর দেয় সে, “রাউন্ড দিলেও কী? আমাদের আহনাফ স্যার থাকা সত্ত্বেও তোমাকে সে খারুশ কী বকা দিতে পারবে?” সে তাকায় সুরভীর দিকে। দুষ্টুমি করে বলে, “এর পূর্বে আহনাফ স্যার তার ব্যান্ড না বাজিয়ে দেয়।”
“তুই আহনাফের নাম নিয়ে আমার সাথে মজা নেওয়া বন্ধ করবি?”
“আমাদের অফিসের ক্রাশকে তুমি উড়ায় নিয়ে যাবা আর আমরা মজাও নিব না? এটা তো ভারী অন্যায়। আচ্ছা তোদের প্রেম কাহিনি বল প্লিজ। তোদের একসাথে কত কিউট লাগছে।”
“প্রেমকাহিনী? জানেমান স্বপ্ন থেকে বের হও, এখানে কোনো প্রেম কাহিনি নেই। এটা যাস্ট এরেঞ্জ ম্যারেজ। প্রথমে ভেবেছিলাম দুইজনের কেউ বিয়ে করব না কিন্তু পরে একে অপরকে ভালো লাগতে শুরু করল। তাই বিয়ের জন্য রাজি হলাম।”
“বলিস কি? আমি আরও ভেবেছি তোদের লাভ ম্যারেজ। তাই তুই এই চ্যানেলে জয়েন করেছিস। আমি আসলেই অবাক যে লাভ ম্যারেজ না। তোরা একে অপরের দিকে যেভাবে তাকিয়ে থাকিস মনে হয় যে অপরজনকে অনেক ভালোবাসিস।”
“আই মিন আমাদের কথা হচ্ছে দুইবছরের বেশি হবে। কিছু অনুভূতি তো আছেই একে অপরের প্রতি। ভালোবাসা আছে কি-না, তা জানি না।”
এমন সময় ডাক পড়ে তার। একজন পিওন এসে জানায়, “ম্যাডাম আহনাফ স্যার আপনাকে ডাকছে।”
“বাহ অফিসে আসতে না আসতেই তোমার ডাক পড়ে গেল? যাও যাও তোমারই দিন।” তাইফা দুষ্টু করে বলে।
“আসতে পারি?” দরজায় টোকা দেয় সুরভী। অনুমতি আসে ভেতর থেকে। ভেতরে ঢুকতেই আহনাফ বলে, “তোমাকে বলেছি আমার কেবিনে নক দেওয়ার প্রয়োজন তোমার নেই।”
“আমিও অফিসেই কাজ করি। এভাবে ভেদাভেদ করলে তো হাজারো প্রশ্ন উঠবে।”
“তোমার ইচ্ছা। আচ্ছা শুনো, রাজনৈতিক দলের নেতা অভ্রর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো। আজকাল সে-ই হট নিউজ সব জায়গায়। প্রতিটা নিউজ চ্যানেলে তার কথা হচ্ছে। এর মধ্যে একবার যদি আমাদের চ্যানেল পার্সোনালি উনার ইন্টারভিউ নিতে পারি তাহলে টিয়ারপি অনেক বাড়বে।”
“আমি কীভাবে তার সাথে যোগাযোগ করব?”
“কাম অন সুরভী, অভিনেত্রী ইনারা তোমার বান্ধবী। তার ভাসুর হয় অভ্র। এখন তো সবাই জানে অভ্র এই যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যান্ড পঞ্চসুরের সদস্য সভ্যের ভাই। ইসমাত বংশের ছেলে। তাকে একটিবার আমাদের চ্যানেলে আনতে পাড়লে চ্যানেল টপে পৌঁছে যাবে। তোমার পক্ষে তাকে আনাটা তেমন একটা কঠিন কাজ হবে না।”
“বন্ধুত্বকে নিজের লাভের জন্য ব্যবহার করাটা আমি শিখি নি। আমি ইনারাকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পাড়ব না।”
আহনাফ উঠে এসে দাঁড়ায় তার সামনে, “প্লিজ সুরভি। আমাদের চ্যানেলের জন্য এটা খুব ভালো হবে। আর তোমাকে ফার্স্ট ইন্টারভিউ নিজে রিপোর্ট করতে দেওয়া হবে। আমি চাই তোমার স্বপ্নটা পূরণ হোক। কেবল ডেস্কজব না করে তুমি নিজের রিপোর্টার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করো।”
“ওই লোকটা এক নাম্বারের অভদ্র, বাজে এবং স্বার্থপর মানুষ।”
“তুমি তো তার সাথে সারাজীবন কাটেবে না। কেবল একটা ইন্টারভিউ।” আহনাফ হাত ধরে আবদারের সুরে বলে, “প্লিজ, আমার জন্য।”
তার করুণ গলা শুনে মন গলতে শুরু করে সুরভির। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ইনারার সাথে কথা বলে দেখব। একবারই বলব।”
“এইত্তো লক্ষ্মী মেয়ে।” বলে আলতো করে চুমু খায় তার হাতে।
সুরভীর গালে হাল্কা লাল আভা ছড়ায়। সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। মিনমিনে গলায় বলে, “আমি তাহলে কাজে ফিরে যাই। রাতে দেখা হচ্ছে।”
“ওহ সুরভী, ” আহনাফ থামায় তাকে। কেমন আমতা-আমতা করে বলে, “আজ রাতের ডিনার ক্যান্সেল করতে হবে। আমার একটু কাজ আছে।”
উদাসীনতা স্পষ্ট ভেসে উঠে সুরভীর মুখে। রাতের জন্য গত একসাপ্তাহ ধরে সে পরিকল্পনা করছিল। কী পোশাক পরবে, কি কথা বলবে, ডিনারের পর কি কি করবে ইত্যাদি। তার জন্য একটা ঘড়িও উপহার কিনেছে। আজ তাদের প্রথম দেখার দুই বছর পূরণ হলো। সে ভেবেছিল এই খুশিতেই আহনাফ আজকে ডিনারের প্রস্তাব রেখেছে। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে আহনাফের দিনটার কথাই মনে নেই। আর যদি মনে না থাকে, সে মনে করাতেও চায় না। সে মলিন হেসে উওর দেয়, “ঠিকাছে।”
কেবিন থেকে বের হতে সুরভি ফোন বের করে ইনারাকে কল দেবার জন্য। ইনারা, তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। আর তার প্রিয় একজন মানুষ। স্কুলের দিন থেকে তারা একসাথে। একসাথে কত মজা করেছে। যদিও এখন সে দিনগুলো হারিয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে জীবনের দায়িত্বগুলো সম্পর্কের আগে এসে পড়ে। কিন্তু সম্পর্ক বদলায় না। ইনারার সাথেও তার সম্পর্ক এমন। সে দ্বিধায় থাকে। একসাপ্তাহ পূর্বেই ইনারার বিয়ে হয়েছে। তাদের হানিমুনে যাবার কথা। এই সময় তাকে কল দিবে? দ্বিধা নিয়েই কল মেলায় তাকে। কিন্তু ইনারার কল ধরতে এক মুহূর্তও লাগে না। আর কল ধরতেই তার উচ্চস্বরের কথা শোনা যায়, “ভালো সময় কল দিয়েছিস। আমার মাথায় আগুন বুদবুদ করে ফুটছে।”
“তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে তুই খুব রাগে আছিস কী হয়েছে।”
“কী হবে আবার? ওই অসভ্য লোকটা থাকতে আমার মেজাজ খারাপ হবার কোনো ভিন্ন কারণ লাগে। আমি মাসুম বাচ্চা, এত চুপচাপ থাকি সে এসে উঠেপড়ে আমার সাথে ঝগড়া করতে। আর বলে আমি না’কি জংলী। আমি না’কি শুধু ঝগড়া করি। তুই বল তো, আমি এত নম্র, ভদ্র প্রকৃতির মেয়ে। আমি ঝগড়া করতে পারি?”
“জানেমান তুমিই ঝগড়াঝাটিতে চ্যাম্পিয়ন। দুলাভাই তো কেবল তোমার ঝগড়ার জালে ফেঁসে যায়।”
“এই দুলাভাইয়ের শালী, তুমি আমার দলে না ওই অসভ্যের।”
“যা সত্যি তাইতো বলছি। এসব বাদ দে, তোরা হানিমুনে কবে যাচ্ছিস?”
“যাবার কথা তো ছিলো আগামীকাল। সব গুছানো শেষ। এখন ভাবছি যাব না। ওখানে যেয়েও আমার সাথে ঝগড়া করবে।”
“দেখ তোদের একমিনিটে ঝগড়া বাঁধে অন্যমিনিটে প্রেম বিঁধে তোদের মনে। তাই হানিমুনে ক্যান্সেলের কথা তো ভাববিও না। নাহলে তোর খবর আছে।” ধমকের সুরে বলে সুরভি।
“ঠিকাছে মা, এভাবে ধমক দিচ্ছিস কেন?” বাচ্চামো ভাব নিয়ে বলে ইনারা। আবার জিজ্ঞেস করে, “তুই অফিসের সময় কল দিয়েছিস। কোনো কাজ ছিলো?”
“ওই হয়েছে কি…কিভাবে বলি…” তার আমতা-আমতা করে কথা বলার ধরণে ইনারা বলে, “মুখ দিয়ে বল। তোর বেস্টফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিস, অচেনা কারও সাথে না। এত ঢঙ করলে আছাড় মারব। বল কি হইছে?”
“আহনাফ বলছিল তোর কাছে একটা ফেভার চাইতে। অভ্রর ইন্টারভিউ নিতে চাইছে আমাদের চ্যানেলে। তুই একটু কথা বলতে পাড়বি উনার সাথে। অথবা সভ্য ভাইয়াকে বলিস কথা বলতে।”
“ভাইয়া বাড়িতেই আছে। মা গতকাল আসতে বলল। আজ দুপুরে যাবার কথা। মা’কে পটিয়ে আজ রাতে থাকতে বলব। তুই অফিস শেষে আয়। নিজেই বুঝিয়ে কথা বলে নিস। এই চক্করে তোর সাথে দেখাও হয়ে যাবে।”
“তোদের ওদিকের রাস্তা তো অনেক দূর। বেশি রাত হয়ে যাবে।”
“গাড়ি পাঠিয়ে দিব। এমনিতেও দাদাজানের বাছাই করা গাড়ি ছাড়া ঢুকতে দেয় না দোয়ার দিয়ে। আজ রাতে আমার সাথে থাকবি। কাল আমাদের এয়ারপোর্টে সি অফ করে অফিসে চলে গেলি। প্লিজ মানা করিস না, কতবছর হয়ে গেল আমরা রাত জেগে গল্প করি না। কলেজের দিনে কত গল্প করতাম। আয় না প্লিজ। তুই না আসলে আমি কিন্তু ভাইয়ার সাথে কথা বলব না।”
“এখন ব্লাকমেইল করছিস? কী খারাপ তুই! আচ্ছা শুন রাত আটটায় গাড়ি পাঠিয়ে দিস। এড্রেস সেন্ড করে দিচ্ছি। আর ড্রাইভারের নাম্বার পাঠিয়ে দিস।”
.
.
সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায় সুরভি ও তাইফা। অফিসের কাছেই বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স। সেখানে যায় ইনারার জন্য কিছু নিতে। তার বিয়েতে মন মতো তাকে আলাদা কিছু উপহার দিতে পারে নি। তাই আজ কিনতে এসেছে। তবে শপিং করতে বেশি সময় লাগে না তার। প্রথম নজরেই একটা আকাশী রঙের গাউন তার পছন্দ হয় এবং নিয়ে নেয় ইনারার জন্য। তারপর যায় ফুডকোর্ট কিছু খেতে। সুরভি তাইফাকে বলে, “এখানে একটা স্টলে ডোসা অনেক মজার পাওয়া যায়। অনেক ইয়ামি। ডোসা খাবি?”
“চল। আমি আগে ট্রাই করি নি। প্রশংসা শুনে মুখে পানি এসে পড়েছে।”
দুইজন হাঁটতে থাকে। ভেতরের দিকের স্টলের দিকে এগোয়। হঠাৎ থেমে যায় তাইফা।
সুরভি তখনও হাঁটছিল ও কথা বলছিল। তাইফাকে পাশে না পেয়ে সে ফিরে তাকায়। তার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “এখানে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?”
তাইফা একই দৃষ্টিতে তাকানো। আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে, “ওটা আহনাফ স্যার না?”
“আহনাফ? উনি এখানে কী করবে? উনি তো মিটিং….” সে ডানপাশে তাকাতেই দেখতে পায় আহনাফকে। একটি নীল রঙের জামা পরা মেয়ের সাথে বসে আছে। তাদের সামনের টেবিলে দুই গ্লাস কফি। টেবিলের উপর মেয়েটির হাতের উপর আহনাফের হাত। তাদের এভাবে দেখে চোখমুখে রাগান্বিত ভাব ছড়ায় সুরভির।
তাইফা তখন বলে, “তুই…তুই ঠিক আছিস তো? আরে তুই চিন্তা করিস না, হতে পারে মেয়েটা ভাইয়ার ফ্রেন্ড। তাই না?”
“ফ্রেন্ড না, এক্স-গার্লফ্রেন্ড।” কঠিন গলায় বলে সুরভী। নিজের ফোন বের করে আহনাফের নাম্বারে কল দেয়।
আহনাফ কথা বলছিল বিধির সাথে। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠে। সুরভির ফোন। হঠাৎ করেই তার চোখেমুখে ছড়ায় ভয়। তার ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে বিধি জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”
“হুম, সব ঠিক।” সে কল কেটে দেয়। কিন্তু আবারও কল আসে সুরভির। আবারও কাটার পর কল দেওয়ায় এবার সে কলটা রিসিভ করে। বিরক্তির সুরে বলে, “দেখছ তো কল কাটছি। বারবার কল দিচ্ছ কেন?” মৃদুস্বরে বলল আহনাফ।
“কোথায় তুমি?”
“এটা কেমন প্রশ্ন? তোমাকে তো বললামই আমি মিটিং এ আছি।”
“কফি ডেইটে হাতে হাত রেখে খুব ভালোই মিটিং চলছে তোমার।” কথাটা শুনে চমকে উঠে আহনাফ। তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায়। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পায় সুরভিকে। সে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একে অপরের উপর চোখ পড়তেই সে কানের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে নিলো। আর দ্রুত গতিতে হাঁটতে শুরু করল। আহনাফ উঠে দৌড় দিলো তার পিছনে। তাকে কৈফিয়ত দিতে শুরু করল, “সুরভি আই ক্যান এক্সপ্লেইন। তুমি যা ভাবছ এমন কিছু না। আমি যাস্ট ওর সাথে….”
সুরভি তার মুখ থেকে বাক্য কেড়ে বলে, “আমি এখন কোনো কথা শুনতে চাই না। অনেক মানুষ আছে। আমার তামাশা তৈরি করার ইচ্ছা নেই। আপনি যান ব্যক্তিগত মিটিং করতে।” খোঁচা মেরে কথাটা বলে সে লিফটে উঠে পড়ে। রাগেই বের হয় লিফট থেকে। একবার ভাবে ইনারাদের বাড়িতে যাবে না। যাবার মনটাই নষ্ট হয়ে গেছে তার। কিন্তু পরক্ষণে কিছু কথা ভেবে যাবার সিদ্ধান্ত অটল থাকল। বলার পর না গেলে ইনারার মন খারাপ হবে এবং এর কারণে আগামীকাল ট্রিপেও মন মরা হয়ে থাকবে। এছাড়া সে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কারণে কাজের প্রতি অবহেলা করতে পারে না। তাই কিছুদূর এগিয়ে যেয়ে উঠলো সে ইনারার পাঠানো গাড়িতে।
কৃষ্ণরঙা আকাশের বুকে ঝিলমিলে তারাগুলো জ্বলছে।। জ্বলছে জ্যোৎস্না ছড়ানো চন্দ্রিমাও। সুরভির চক্ষুর কোণেও চিকচিক করছে একবিন্দু জল। কিছুক্ষণ পূর্বের দৃশ্য তার চোখে ভাসছে। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক যন্ত্রণা কাবু করেছে।
.
.
ইনারা সিঁড়িতে দেখে মা ও দাদীজান কিছু কথা বলছে সোফায় বসে। তাদের দেখে সে দ্রুত নামে। সোফায় যেয়ে বাচ্চাদের মতো গুটিসুটি মেরে বসে পড়ে মা’য়ের পাশে। মা’য়ের হাতে একটি মেয়ের ছবি। ফর্সা দেহের রঙ, তীক্ষ্ণ ধারালো মুখের গঠন, আর হরিণীর মতো টানা দু’টি চোখ। সাদা শার্টের উপর কালো রঙের ব্লেজার পরা। আর চুলগুলো হাই পোনিটেল করে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ জোর করে ছবিটা তুলেছে তার। চোখে রাগ রাগ ভাব, ঠোঁটে হাসির ছোঁয়াও নেই।
ইনারা কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মেয়েটা কে মা?”
“অভ্রর জন্য বাবা বাছাই করেছেন। ওদেরও মিউজিক কোম্পানি আছে। আগে এত নাম ছিলো না কোম্পানির কিন্তু মেয়েটা কোম্পানি জয়েনের পর সফলতা অনেক বেড়েছে। ইসমাত কোম্পানির প্রতিযোগী হতে পারে বলে ধারণা করছেন। তাই বাবা ওর সাথে অভ্রর বিয়ের কথা বলছে। অবাক করার ব্যাপার হলো অভ্রও রাজি হয়েছে।”
দাদীজানও কথায় তাল মিলালেন, “আসলে, অভ্র তো বিয়ের থেকে দশহাত দূরে থাকতো। আল্লাহ জানে তোমার দাদাজান এমন কি কথা বলল যে একদিনে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল। বিষয়টা অবাক করার মতো।”
“নাম কী মেয়েটার?”
“মায়া…মায়া চৌধুরী।”
“অভ্র ভাইয়া মেয়ের ছবি দেখেছে?”
“হ্যাঁ মাত্র দেখেছে। এখন চলে যাচ্ছে।”
ইনারা ঘাবড়ে যায়, “চলে যাচ্ছে? কোথায় চলে যাচ্ছে?”
“ওর কি যেন কাজ আছে তাই রওনা দিলো যাবার জন্য।”
“আয়হায় সুরভির অভ্র ভাইয়ার সাথে কাজ ছিলো। তাই আসছে এত দূর থেকে। আমি যেয়ে ভাইয়াকে থামাই।” বলে দৌড় দেয় সে।
“এই ইনারা এভাবে দৌড় দিও না পড়ে যাবে তো।”
কে শুনে কার কথা? ইনারা দৌড়ে যায় সেদিকে।
দাদীজান বলে, “ওর বান্ধবী যার নাম বলল না? সুরভী? ওকে অভ্রর জন্য পছন্দ হয়েছিল আমার। মেয়েটা ইনারার মতো চঞ্চল ও বাচ্চামো স্বভাবের না। কিন্তু ওর গুণ দেখে মনে হলো বাড়ির বড় বউ হলে ভালো হতো। শান্ত, নমনীয় ও ধৈর্যশীল। হাসিখুশি থাকে সবসময়। অভ্রকে ওই-ই ঠিক করতে পাড়তো।”
সুরভীর গাড়ি এসে পৌঁছায় গেইটের সামনে। প্রবেশদ্বার আগের থেকেই খোলা ছিলো। তাই সরাসরি গাড়ি ভেতরে ঢুকায়। তখনই শব্দ হয়। গাড়ি হঠাৎ করে থেমে যায়। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে উচ্চস্বরে বলে, “চোখ কোথায় রেখে গাড়ি চালাস তুই? দেখতাসোস না সামনে দিয়া গাড়ি আসে?”
সেসময় গাড়ি থেকে উঁচু লম্বা একটি পুরুষ বের হয়। সাদা পাঞ্জবির উপর নীল রঙের কটি পরা। পাঞ্জাবির হাতাটা কনুই পর্যন্ত বটে রাখা। তাকে দেখেই ড্রাইভার চুপ হয়ে গেল। তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সে এক ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বলে, “সা…সাহেব আপনি? মাফ করে দেন। আমি ভাবছি কোনো ড্রাইভার গাড়ি চালায়। মাফ করে দেন স্যার।”
অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ড্রাইভারের দিকে। তারপর হেসে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আরে চাচা এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? এখন আমি ভুল করেছি বলেই তো চিল্লাচিল্লি করছিলেন। এক কাজ করুন এখন চেঁচামেচি করে মনের সব কথা বের করে দিন।”
“না না সাহেব। কি বলেন? আমার দোষ ছিলো। এভাবে আমার না গাড়ি ঢুকানো উচিত হয় নি।”
অভ্রর দৃষ্টি সরু হয়ে আসে, “আপনার দোষ থাকলে চেঁচামেচি করছিলন কেন? আমার জায়গায় আপনার জুনিয়র কোনো ড্রাইভার থাকলে তো হাতও উঠাতেন মনে হয়।”
“মাফ করে দেন স্যার। ভয় পেয়ে গেছিলাম। এত দামী গাড়ি আমার হাতে নষ্ট হইসে। এর ক্ষতিপূরণ কীভাবে দিতাম? তাই আমি…”
“তাই সামনের জনের উপর দোষ চাপিয়ে নিজে বাঁচতে চেয়েছেন। সামনেরজনও গরীব তা ভেবে। ইন্টারেস্টিং।”
ড্রাইভার হাঁটু বসে পড়ে তার সামনে। হাত জোর করে আকুতি করতে শুরু করে, “ক্ষমা করে দেন স্যার। আর হইব না। এইবারের মতো মাফ করে দেন। এই কথা বড় সাহেবরে জানায়েন না। আমার ঘরে বউ বাচ্চা আছে। চাকরি গেলে ওদের খাওয়ামু কী?”
সুরভি বসেছিলো গাড়ির ভেতর। গাড়ির ভিতরে কোনো শব্দ সঠিকভাবে শুনতে পাচ্ছিল না সে। কিন্তু জানালা দিয়ে দেখতে পাড়ছিল অভ্র এবং ড্রাইভারকে। ড্রাইভারকে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে তার মাথায় রাগ চড়ে। এক দুই না ভেবে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় অভ্রের সামনে। উচ্চস্বরে তাকে বলে, “কী সমস্যা আপনার? একতো গাড়ির এক্সিডেন্ট করলেন এর উপর নিজের বাবার বয়সী লোককে দিয়ে এমনভাবে আকুতি করাচ্ছেন? লজ্জা লাগে না আপনার।” সে ড্রাইভারের হাত ধরে দাঁড় করায়, “আপনার উনার সামনে এত অনুরোধ করার প্রয়োজন নেই।”
অভ্র হেলান দিলো গাড়িতে। মেয়েটাকে প্রথম নজরে দেখেই তার চেনা চেনা লাগছিলো। কিন্তু চেহেরা সঠিক মনে পড়ছ না। সে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, “কে আপনি? এইখানে কী করছন?”
“আমি কে সেটা পড়ে জানলেও হবে। প্রথমে আপনি উনাকে সরি বলুন।”
“সরি আর আমি? আপনি জানেন আমি কে?”
“কোনো এক দেশের রাজা হলেও সরি বলতে হবে।”
“কানের সামনে কাকের মতো ক্যাঁ ক্যাঁ করা বন্ধ করুন। বিরক্তিকর আপনার কথা।”
“আমি কাকের মতো ক্যাঁক্যাঁ করি? আপনি কে জানেন? আপনি আস্তো এক অভদ্র, বেয়াদব, ফাজিল৷ যার অন্যদের থেকে কোনো মতলব নেই আর বড় বড় কথা বলে জনগণের সেবা করার। প্রথমে নিজের ব্যবহার ঠিক করেন পরে দেশের অবস্থা ঠিক করবার কথা বলেন। আপনি…আপনু একটা ছাগল যে সারাটাক্ষণ ছাগলের মতো ম্যাহ ম্যাহ করেন। ছাগল একটা।”
“ওহ রিয়ালি!” অভ্র তাচ্ছিল্য হেসে তার দিকে এগোয়, “মুখ খুব বেশি চলে না আপনার? আপনি এখন শিখাবেন আমি কীভাবে কথা বলব? আপনি জানেন আমার মাথা নষ্ট হলে আমি কি করতে পারি?” সুরভীর একেবারে কাছে এসে পড়ে সে। এতটা কাছে যে সুরভি নিজে ঘাবড়ে পিছিয়ে যেতে নেয়। আর পাথরের সাথে পা লেগে পড়ে যেতে নেয়। শেষ সময়ে অভ্র তার হাত ধরে নেয়।
পড়ে যাবার সময় এক মুহূর্তের জন্য সুরভির হৃদয় স্পন্দিত হতে ভুলে যায়। চোখ বন্ধ করে নেয় সে। শব্দ করে উঠে। তার মনে হলো কেউ তার হাত ধরে নিয়েছে। সে চোখ খুলে। অভ্র তার হাত ধরে এবং শান্তির নিশ্বাস নিতে পারে সে। পরক্ষণেই অভ্র তার হাত ছেড়ে দেয়। সে পড়ে যায় রাস্তায়। ব্যাথায় শব্দ করে উঠে। চোখে একরাশ ক্রোধ নিয়ে তাকায় অভ্রর, “আপনি ইচ্ছা করে আমাকে নিচে ফালালেন। তাই না? মানুষ এতটা অভদ্র কীভাবে হয়? বিরক্তিকর!” সে নিজের হাত থেকে বালি ঝারছিল।
অভ্র তার সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে। সুরভি চোখ তুলে তাকাতেই বন্ধনে আবদ্ধ হয় দুইজোড়া নয়ন। এক দমকা হাওয়া ছুটে। এলোমেলো করে দিয়ে যায় সুরভির কৃষ্ণাঙ্গ কেশ। এরপর অদ্ভুত এক কান্ড ঘটে। আচমকায় অভ্র তার কপালে সামনে আসা চুলগুলো আঙুল দিয়ে আলতো করে সরিয়ে দিয়ে মৃদু হাসি নিয়ে বলে, “সুন্দর মেয়েদের রাগ করতে নেই, জানো না? নিজের লিমেটে থাকা শিখো,” সে তাকায় সুরভির দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কঠিন সুরে তার বাক্যটা সম্পূর্ণ করে, “নাহয় আমি শিখাতে গেলে তোমার জন্য ভালো হবে না।”
সুরভির কানে সম্পূর্ণ কথাও পৌঁছাল না। অভ্রও এতটা কাছে গেছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়ও লাগছে। আজ পর্যন্ত এতটা কাছে সে আহনাফকেও আসতে দেয় নি। আর এই লোক কোনো সম্বন্ধ ছাড়াই এতটা কাছে এসে পড়লো। কী নিলজ্জ!
চলবে….
অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সুরভির কানে সম্পূর্ণ কথাও পৌঁছাল না। অভ্রর এতটা কাছে এসেছে যে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়ও লাগছে। আজ পর্যন্ত এতটা কাছে সে আহনাফকেও আসতে দেয় নি। আর এই লোক কোনো সম্বন্ধ ছাড়াই এতটা কাছে এসে পড়লো। কী নিলজ্জ!
সুরভি চোখ সরিয়ে নেয়। পিছিয়ে যায়। তার বুকের ভেতর ক্রোধের ঝটিকা বইছে। কোনো মানুষ এতটা নিলজ্জ কী করে হয়ে? ঝট করে কোনো মেয়ের এতটা কাছে আসে কোন জ্ঞানে? সে তার হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। কিছু কটু কথা শোনাতে যাবে আর দেখে ইনারা দৌড়ে আসছে প্রবেশপথ থেকে। তার মুখে অনেকটা বিস্ময় দেখা গেল। তবুও সে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বে সুরভির কাছে এলো। চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কী হলো তোর?”
প্রশ্নের উপর পালটা প্রশ্ন করে অভ্র, “তুমি এই মেয়েকে চিনো?”
“জ্বি ভাইয়া আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বিয়েতে এসেছিল। আপনার মনে নেই?”
অভ্রর এইবার অচেনা মুখটি চেনা হলো। মনে পড়ল ঘটনাটি। গত সাপ্তাহে সভ্য ও ইনারার বিয়েতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছিল সে। তখন মেয়েটা না দেখে বিড়বিড় করতে করতে আসছিল তার দিকে। আশেপাশে মানুষ ভর্তি। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছিল। এর মাঝে তার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ায় বিরক্তির স্বরে বলে, “এই কোন ছাগল না দেখে হাঁটছে রে?”
মেয়েটা তার হাত ঝেরে মুখ তুলে তাকায়। একবার সরিও বলে না। তার পাশে দাঁড়ানো ফজলু। তার বিশেষ লোক। তার সহকারী। তার সকল কাজ ফজলুই সামলায়।সবসময়ই মুখভর্তি পান থাকে। সে পান চিবোতে চিবোতে বললেন, “আমার নাম ফজলু মিয়া, আপনে আমার অভ্র ভাইরে অভদ্র কইসেন আপনার সাহস তো কম না?” সে রাগ হয়। কারণ অভ্রর ব্যাপারে কোনো কটু কথা সে সহ্যই করতে পারে না।
বলতে না বলতেই মেয়েটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। সে বলে, “এইমাত্র যে গাড়ি এসেছে তা আপনার?”
“ফজলু মিয়া কয় কথা হাছা, গাড়িটা না একদম খাসা।”
“খাসারে মাসা বানিয়ে উড়িয়ে দিব। ফাজলামো করেন? একটি বৃদ্ধ মহিলা সিএনজি থেকে নামছিল। আপনারা সিএনজির একদম সামনে গাড়ি থামালেন। সেখানে এত লোক ছিলো তাদের কিছু হয়ে গেলে কী হতো? টাকা এবং ক্ষমতা আছে বলে নিজের মন মর্জি মতো সব করবেন?”
ফজলু মিয়া এবার ক্ষেপে যায়, “আপা মুখ সামলে কথা কন, আপনি জানেন সে কে?”
মেয়েটা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে, “জানি। একজন অনৈতিক নেতা। আপনার যদি মনে হয় আমি আপনাদের থেকে ভয় পেয়ে অন্যকিছু বলব আর তার আগেপিছে ঘুরবো তাহলে এমনটা একদম হচ্ছে না। আমিও এক টিভি চ্যানেলে কাজ করছি। এর মধ্যে অনেক গুপ্ত খবর পাই আপনাদের যা আপনারা টাকা দিয়ে দাবানোর চেষ্টা করেন। ইনফ্যাক্ট ইনারাকে সাহায্যর নামে যে আপনি নিজের কাজ সেরেছন তাও আমি জানি। তাই মোটেও সম্মানের আশা করবেন না। কারণ আপনারা সম্মানের যোগ্য না।”,
” ভাই আপনি চুপ কেন এই মাইয়ার র কথা শুনছেন কেন? কিছু তো…” অভ্র ফজলু মিয়াকে হাতের ইশারায় থামতে বলে। আর সুরভিকে নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তোমার নাম কী? আর কোন চ্যানেলে কাজ করো?”
“কেন? আমাকে চাকরি থেকে বের করবেন? করুন। কিন্তু নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য নিজেই খুঁজে বের করুন।”
মেয়েটা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে না। ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
অভ্রর গতসাপ্তাহের কথা মনে পড়ার পর মেয়েটার দিকে তাকায়। হ্যাঁ, এই মেয়েটাই তো তার সাথে রুষ্ট ব্যবহার করেছিল। তার দাদাজান ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ তার সাথে এভাবে উঁচু স্বরে কথা বলার সাহস পায় নি। এমনকি এমন দুঃসাহস তার দলের মুখ্য নেতাও করেন নি। আর কেউ করলে রেহাই পায় নি। সকলে জানে তার মেজাজ একটিবার খারাপ হলে তাদের কাওকে সহজে ছাড়বে না। এছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে তার সাথে এমন রুষ্ট ব্যবহার করেনি। কিন্তু এই মেয়ের এমন ব্যবহারে তার রাগ উঠছে না। উল্টো ব্যাপারটা তার কাছে হাস্যকর লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চা বিনাকারণে একরাশ ক্রোধ তার নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরছে। অবশ্য মেয়েটাকে দেখতেও বাচ্চাদের মতো দেখায়। শ্যামবর্ণা মেয়েটির বাচ্চাসুলভ মুখখানি। পুতুলের ন্যায় বড় বড় দুটো চোখ। গোলাপি ফোলা ঠোঁট। ইনারার বয়সী হলে বয়সের তুলনায় মেয়েটির মুখ থেকে বাচ্চামো ভাবটি যায় নি। তাই হয়তো চেয়েও মেয়েটার উপর এত রাগ উঠছে না অভ্রর। উল্টো এমন অহেতুক ঝগড়া ভালোই লাগছে তার। তবুও কারও সামনে নিজেকে নরম দেখানোটা তার নীতিতে পড়ে না। তাই সে কাঠকাঠ গলায় বলে,”আমি কেবল গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের মনে রাখি।” সে উঠে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে দেয় সুরভির দিকে। হাত ধরে উঠার জন্য।
সুরভির বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে। মানুষটার দিকে তাকাতেও তার গা জ্বলছে। তার হাত বাড়ানো দেখেও এড়িয়ে যায়। নিজেই উঠে দাঁড়ায় কোনোমতে। দাঁড়াতেই অনুভব করতে পাড়ল পা’য়ের ব্যাথা। হয়তো পা মুড়ে গিয়েছে।
ইনারা আতঙ্কিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “তুই ঠিক আছিস?”
সুরভি মাথা নাড়ায়, “ঠিক আছি।”
ইনারা অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “ভাইয়া আপনি প্লিজ আজ যাবেন না। সুরভি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
“নাউ, দ্যাট’স ইন্টারেস্টিং,” অভ্র ভ্রু নাচিয়ে তাকায় সুরভির দিকে, “বাট আই শিউর ডোন্ট কেয়ার।”
অভ্র তার গাড়ির দিকে ফিরে যেতে নিলেই ইনারা ডাক দেয় তাকে, “ভাইয়া প্লিজ, ওর একটু কাজ আছে।”
“কাজ থাকলে সেরকম ব্যবহারও করতে হয়। তোমার বান্ধবী এতসময় ধরে আমার সাথে বেয়াদবি করেছে কেবল।”
“এক্সকিউজ মি,” সুরভী তাদের কথোপকথনে হস্তক্ষেপ করে, “আপনি ড্রাইভার আংকেলের সাথে বেয়াদবি করছিলেন।”
ড্রাইভার এগিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত সুরে বলে, “ম্যাডাম সাহেব আমার সাথে কিছু করে নাই। আমিই ভুল করে গেইট খোলা পেয়ে ভেতর গাড়ি ঢুকিয়ে দিসি। ভাবিও নাই দরজা যেহেতু খোলা কোনো গাড়ি আইব। আমার দোষে গাড়িটা লাগছে। আর আমি অন্য ড্রাইভার ভেতরে ভেবে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার লাইগা বকা শুরু করছি। সাহেব আমার লগে বেয়াদবি করে না। আমিই অনুরোধ করতাছিলাম যেন স্যারে বড় সাহেবরে কিছু না বলে।”
সুরভির চোখ বড় হয়ে আসে। লজ্জায় থতমত খেয়ে যায় সে। অভ্রর দিকে একপলক তাকায়। অভ্র তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো, সে তাকাতেই ভ্রু নাচাল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। আবার ইনারার দিকে তাকায়। সে ইশারায় বলে ক্ষমা চাইতে। সুরভিও ইশারা মানা করে। সে কিছুতেই ক্ষমা চাইবে না। অভ্র তাদের এমন অদ্ভুত ব্যবহার দেখে বলে, “তোমরা আমার সময় নষ্ট করছ।”
ইনারা সুরভির হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বলে, “তোর কাজ আছে, তুই ভুল করছোস, সরি বলে দে।”
“এই অভদ্র লোককে আমি সরি বলব? সে কি বলেছে জানিস? আমার কন্ঠ না-কি কাকের মতো। এত বড় অপমান!”
“আরে কাজ হলে গাঁধাকেও বাপ বানাতে হয়। বলে দে না। একটা সরিতে তোর কী আসে যায়?”
“মানে তোর ভাসুর গাঁধা?”
“আরে ধ্যুর, বলতো। চলে গেলে তোর কাজের জন্য আমিও তাকে আর খুঁজে পাব না। সে বছরে একবার আসে না এই বাড়িতে। আর কারও কল ধরলেও ভাগ্য।”
“সরি।” সাথে সাথে সুরভি বলে দেয় অভ্রকে। যা সে শুনেও না শোনার ভান করে, “কী বললে? শুনতে পাড়লাম না ঠিক।”
সুরভি তার বিরক্তির নিশ্বাসটা গোপন করে উচ্চস্বরে বলল, “সরি… সরি বলছি সরি।”
“ঠিকাছে ঠিকাছে ক্যাঁ ক্যাঁক্যাঁ করা বন্ধ করো এইবার।”
সুরভি রাগেক্রোধে জ্বলে উঠে। মৃদুস্বরে ইনারাকে আবার বলে, “তোর ভাসুরের মাথা ফাটায় ফেলব আমি।”
“আয়হায় এই কাজ তো আমার। তোর হঠাৎ কী হলো? তুই তো এভাবে রাগিস না কখনো।”
“আজ আমার মেজাজ প্রচুর খারাপ। এর উপর তোর ভাসুর আমার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। মাথার দু’তিনটা তার তো ছিঁড়েই গেছে।”
“আচ্ছা কুল ডাউন হ। ভেতরে আয়।” ইনারা আবারও তাকাল অভ্রর দিকে, “ভাইয়া আপনিও আসুন। ওর একটু সাহায্য করুন।”
অভ্র জিজ্ঞেস করে, “এতে আমার কী লাভ? তুমি জানো আমি লাভ ছাড়া কোথাও সময় নষ্ট করি না।”
“কথা না শুনলে কীভাবে বুঝবেন আপনার লাভ আছে কি-না?”
অভ্র বাঁকা হাসে, “কথায় পয়েন্ট আছে।” সে ড্রাইভারের হাতে চাবি দিয়ে বলে, “গাড়িটা গ্যারেজে পার্ক করে দিবেন।” তারপর ভেতরে রওনা দেয়।
সুরভিও বিড়বিড় করে তাকে বকতে থেকে গেল তার পিছনে। পা’য়ের ব্যাথায় তার হাঁটতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তা ইনারাকে বুঝতে দিলো না। অযথা মেয়েটা চিন্তায় পড়ে যাবে।
বাসার ভেতরে আসার পর তাকে দেখে মা, দাদীজান ভীষণ খুশি হয়। ইনারা ও সভ্যর বিয়ের সময় সে যখন এখানে ছিলো তখন তারা খুব আদর করেছিল সুরভিকে। বিশেষ করে সভ্যর মা। তার মতো মিষ্টিভাষী মহিলা খুব কমই দেখেছে জীবনে। সকলকে ভীষণ আদর করে। তার মুখেও মায়া মায়া ভাব। মুখ দেখলেই স্পষ্ট হয় তার মনের ভেতর কতটা মায়া। মা তাকে দেখেই রান্নাঘরে ঢুকলেন। মজার কিছু রান্না করে আনতে। আর দাদীজান গেলেন তার এশার নামাজ আদায় করতে। সুরভি সোফায় বসে ইনারাকে জিজ্ঞেস করে, “সভ্য ভাইয়া কোথায়?”
“সে অসভ্যের কথা তো বলিসই না। কাল হানিমুনে যাব আর আজ গেছে অফিসে। একারণেই তো ঝগড়াটা হয়েছে। আমি ভালোবেসে জিজ্ঞেস করলাম কোন শাড়িগুলো নিব আর সে তৈরি হয়ে ফুরফুর করে বের হয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। ভাইয়া আপনিই বলেন আপনার ভাই আমার সাথে এটা ঠিক করল?” সে অভ্রর দিকে তাকিয়ে অজান্তেই প্রশ্নটা করে। তারপর জিহ্বায় কামড় দেয়। অভ্রর সামনে কথাটা বলা ঠিক হয়েছে না’কি এই দ্বিধায় আছে সে। অভ্রর সাথে একাধিকবার দেখা হয়েও তাকে এখনো চিনতে পারে নি। অভ্র এক মুহূর্তে গম্ভীরমুখী, তো অন্যমুহূর্তে তার ঠোঁটের কোণে হাসি। হাসিটা রহস্যময় থাকে বেশিরভাগ সময়। যেন তার মাথায় কিছু চলছে। আর যখন কথাটা মনে হয় তখনই আসলেই এমন কিছু ঘটে যা কল্পনার বাহিরে থাকে।
তবে আজ ইনারাকে অবাক করে অভ্র সরল হাসল। বলল, “সভ্যর দোষ তো আছে এখানে। দাদাজানকে ভয় পেয়ে সব কথা শুনে ও। কিন্তু যতই চেষ্টা করুক কোনো সময় দাদাজানের প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য অর্জন করতে পাড়বে না। তাও বোকার মতো তার কথায় জীবন চালায়।”
“কারণ সভ্য ভাইয়া তার বড়দের সম্মান করতে জানে।” সুরভি বলে ঠেসমারা গলায়। তার মুখোমুখি বসে ছিলো অভ্র। সে পা’য়ের উপর পা তুলে তাচ্ছিল্য হাসে, “তোমার কথার অর্থ হচ্ছে আমি কারও কথায় উঠতে বস্তে জানি না একারণে আমি কারও সম্মান করতে জানি না? তো আমাকে এটা বলো আজ পর্যন্ত তুমি তোমার মা বাবার সব ইচ্ছা মেনেছ। বিনা কোনো প্রতিবাদে?”
উওর দেয় না সুরভি। সত্যি বলতে কলেজের পর যতগুলো কথা সে মেনেছে তা হাতে গুনতে পাড়বে সে। আর সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ করেছে নিজের ক্যারিয়ার এর জন্য। মা বাবা পাড়লে কলেজের পরই তাকে বিয়ে দিয়ে দিতো। তাদের কাছে মেয়েদের এমন চাকরি অর্থই সময় নষ্ট করা। বিয়েই তাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়ার দরকার। কিন্তু সুরভির জন্য তার গন্তব্য একদম পরিষ্কার। সে কি চায় জানে। তাইতো হাজারো বিরোধিতা করেও তার স্বপ্নের পথটাই বেছে নিয়েছে সে। কিন্তু এখন অভ্রর প্রশ্নের সঠিক উওর দিলে তো তার সামনে অপমানিত হতে হবে। আর এই মানুষটাকে তার এতটা অপছন্দ যে তার সামনে ছোট হতে রাজি নয় সে। পূর্বে কোটি কোটি মেয়ের মতো তার কাছেও অভ্র ভীষণ পছন্দের ব্যক্তিত্ব ছিলো। অপছন্দটা আসে তার চাকরির পরই। অভ্রকে নিয়ে নানান ধরনের খবর আসে। যা মোটেও ভালো নয়। কিন্তু তা দাবিয়ে দেওয়া হয় টাকা দিয়ে। অন্য যাই হোক সে অন্যায়, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারে না। আর এতবছরে সে এটা তো জেনেছে অভ্রর মাঝে এই সব গুণ আছে।
সুরভি ইচ্ছা করে কথাটা ঘুরায়, যেন তার উওরটা না দিতে হয়, “আমি সরাসরি কাজের কথায় আসি। আমি এন.আই চ্যানেলে কাজ করি। চ্যানেলে আপনার ইন্টারভিউ নিতে চাইছি। এতে সাধারণ জনগণ আপনাকে আরও চিনবে।”
“অলরেডি প্রতিটি নিউজ চ্যানেলে আমার কথাই হচ্ছে। তাহলে আমি কষ্ট করে ইন্টারভিউ দিতে যাব কেন?”
“কারণ এতে জনগণের সাথে আপনি আরও বেশি কানেক্ট হতে পাড়বেন। তারা আপনাকে না জানলে সাপোর্ট কেন করবে?”
“গুড এন্সার। ওকে আমি ভেবে দেখব। আর যদি যেতে রাজিও হই তবুও আমার একটা শর্ত আছে। কুয়েশ্চনগুলো আমি বাছাই করব।”
চোখমুখ কুঁচকে নেয় সুরভি, “এটা কোন ধরনের শর্ত? এটাতো জনগণকে আঁধারে রাখা হবে।”
“হোক। আপনি এমন ভাব করছেন কেন যেন এসব নতুন শুনছেন। সব জায়গায় এমনই হয়। নাহলে হঠাৎ করে আপনারা এমন প্রশ্ন করে বসেন যাতে আমাদের বিশাল বড় সমস্যায় পড়তে হয়। ওয়েট তুমি রিপোর্টারই তো?'”
সুরভি আমতা-আমতা করে বলে, “আপাতত ইন্টার্ন। ডেস্কজব করছি। আপনার ইন্টারভিউতেই প্রথম রিপোর্টারের কাজ করতে পারি।”
অভ্র ভ্রুঁ নাচায়, “মানে আমার ইন্টারভিউ তোমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারেস্টিং। তাহলে তো আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। এখন আমাকে পছন্দ করে এমন কোটি কোটি মানুষ আছে। অনেক ভক্তও আছে। নতুন কাওকে দিয়ে ইন্টারভিউর ঝুঁকি নেওয়ার পূর্বে তো ভাবতে হবে।”
ইনারা সাথে সাথে বলে, “ভাইয়া সুরভি ওর সকল কাজ পার্ফেক্টলি করে। ওর প্রথম ইন্টারভিউ আরও বুঝেশুনে করবে। আর ভক্তদের সেন্টিমেন্টেরও খেয়াল রাখবে। সুরভিরও কলেজের টাইমে আপনার উপর হাই লেভেলের ক্রাশ ছিলো। তাই ও ভালো করে বুঝবে।”
তার কথা শুনে সুরভি চোখ বড় বড় করে তাকায় তার দিকে। মুহূর্তে তার গাল লাল হয়ে যায়। সে কণুই মারে ইনারার হাতে। কিন্তু ইনারা তাকে তোয়াক্কা না করে অনুরোধ করে অভ্রকে, “ভাইয়া একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন।”
অভ্র হাসে সুরভির দিকে তাকিয়ে, “ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং। ওকে আমি নিজের সিডিউল দেখে জানাব।” সে ঘড়ি দেখে বলে, “আমার কাজের সময়ও পেরিয়ে গেছে। আজ যেয়ে লাভ নেই। ইনারা মা’কে বলো আমার জন্য ব্লাককফি এক মগ পাঠাতে।”
ইনারা মাথা নাড়ায়। অভ্র যেতেই ইনারা সুরভির হাত ধরে বলে, “দেখলি কাজ করিয়ে দিলাম।”
“কচু করেছিস। ওই লোককে বলতে গেলি কেন কলেজের সময় তার উপর আমার ক্রাশ ছিলো?”
“ক্রাশ তো ছিলো। তুই তো তার ছবিগুলোও খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন থেকেই কেটে রাখতি।”
“কিন্তু এখন তাকে দুইচোখে সহ্য হয় না আমার। তুই জানিস লোকটা কত দুর্নীতি করে?”
“আরে তোর কাজ হইসে না? খুশি থাক। এত পটরপটর করিস না। এসব বাদ দিয়ে আমার রুমে চল। গশিপ করব আজ সারারাত ভরে।”
.
.
জোহান, একসময় দেশের বড় এক তারকা ছিলো। দেশ বিদেশের মানুষদের নিজেদের গানের সুরে মাতিয়ে রাখা পঞ্চসুরে অংশ ছিলো। নিজের এক সোলো ক্যারিয়ারেও ভালো সাফল্য অর্জন করেছে। অভিনেতা হিসেবেও নাম ছিলো তার। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল তার বাবার কোম্পানিতেই গায়ক ছিলো সে। ব্যাঙ্করাপ্ট হবার পর তার সব শেষ হয়ে গেল। তার বাবাকে জেলে ভরা হলো তার কিছু অপরাধের কারণে। এর খবরে একসময়ের জনপ্রিয় তারকা হওয়া সত্ত্বেও এখন অনেকের অপছন্দের ব্যক্তি সে। এর উপর কিছু দিন পূর্বের এক্সিডেন্ট এর পরিণামে বেডরেস্টে থাকতে হচ্ছে। আজ রাতে তাকে দেখতে এসেছে সাঈদ। তার এসিস্ট্যান্ট ছিলো একসময়। সে এসে বসে জোহানের পাশে, “কী খবর?”
“কি আর খবর? চলছে আরকি। তুমি এতরাতে কীভাবে আসলে?”
“কিছু কোম্পানির অফারের কপি পাঠিয়েছিলাম। দেখেছ?”
“দেখেছি। প্রায় সবই সভ্যর আন্ডারে যেসব কোম্পানি সেগুলো থেকে এসেছে। আর আমি ওর সাহায্য নিতে চাইছি না।”
“ও তো তোমার বন্ধু তাহলে…”
“একারণেই চাইছি না। সকলে ভাববে আমি কেবল অন্যের সাহায্যেই নিজের নাম টিকিয়ে রেখেছি। প্রথমে আমার বাবা এবং এখন আমার বন্ধু সভ্যর জন্যই সহজেই নিজের সুযোগটা পেয়ে গেছি। আর এটা সত্যও হবে। তাই এবার আমি যা করব নিজের যোগ্যতায় করব। আমি মেইলে আরেকটি কোম্পানির অফার দেখেছিলাম। চৌধুরী এন্টারটেইনমেন্ট। সভ্যর কোম্পানিগুলো বাদে কেবল ঐ প্রতিষ্ঠানই ভালো মনে হয়েছে।”
“কোম্পানিটা অনেক ভালো। ক’বছর আগেও তেমন নাম ছিলো না। নতুন সি.ই.ও আসার পর প্রফিট মার্জিন অনেক উপরে উঠেছে। মার্কেটিং স্টেটিজিও ভালো।”
“তাহলে এই কোম্পানির সাথেই কথা বলো। আমার এটাই ভালো লাগছে।”
“তাও আরেকবার ভেবে নেও। সভ্যর কোম্পানিগুলোতে তুমি অনেক সুবিধা পাবে কিন্তু এই কোম্পানিতে একটুও না। ইনফ্যাক্ট আমি শুনেছি এই কোম্পানির নতুন সি.ই.ও ভীষণ রুড ও কঠিন স্বভাবের। তুমি সহ্য করতে পাড়বে?”
জোহান দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, “পাড়তেই হবে। জীবনে কিছু সহজে পাওয়া যায় না। কিছু পেতে হলে কষ্ট করতেই হয়। তুমি কথা বলো। আচ্ছা , এই সি.ই.ও এর নামটা কী শুনি?”
“মায়া চৌধুরী।”
.
.
ডিনার শেষে ইনারা লাগেজে তার জামাকাপড় গোছাচ্ছিল। আগামীকাল সকাল সকালই তাদের রওনা দেবার কথা। হঠাৎ কেউ এসে তাকে পিছনে থেকে জড়িয়ে ধরে। ইনারা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বিরক্তির সুরে বলে, “ছাড়ুন তো। একেবারে কাছে আসবেন না আমার।”
সভ্য আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। তার কাঁধ ও গলার মাঝে মুখ ডুবায়। মৃদুস্বরে বলে , “আমার মহারাণী বেশি রাগ করেছে?”
ইনারা তার পেটে কণুই মেরে তাকে পিছনে সরিয়ে দেয়, “খবরদার আমাকে ছুঁবেনও না।”
“এতজোরে কেউ মারে? তোমার জংলীপণা কবে কমবে?”
“কথা বলবেন না আমার সাথে। যেয়ে অফিসে বসে থাকুন।”
“আমি অফিসে বসে থাকলে আগামীকাল হানিমুনে কার সাথে যাবে?”
“একাই যাবো। লাগবে না আপনাকে। হানিমুনে যেয়ে আপনার ব্যাঙের মতো মুখ আমি দেখতে পাড়ব না।”
“আমাকে না দেখলে হানিমুন কীভাবে কমপ্লিট হবে তোমার।” সে ইনারাকে জড়িয়ে ধরতে নিতেই আবারও মেয়েটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
সভ্য বলে, “আহা রাগ করো না। দাদাজান ডেকেছিল, নাহলে তোমাকে ছেড়ে আমি যাই বলো?”
“মুখে যত রসোগোল্লার মতো মিষ্টি কথা, একটু শাড়ি পছন্দ করে দিতে বললাম কোনগুলো ট্রিপে নিব তা দিলেন না। আপনার পছন্দের পরতে চেয়েছিলাম বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম।”
সভ্য কিছু না বলে বাহিরে চলে গেল। আবার ফিরেও এলো কিছু মুহূর্তের মাঝে। হাতে কিছু শাড়ির ব্যাগ। ব্যাগের থেকে একটি শাড়ি বের করে সে। লাল জরজেট শাড়িতে রুপোলী পাড়ের কাজ। শাড়িটা ইনারার মাথায় ঘোমটা করে দিয়ে বলে, “অফিসের কাজ তো সন্ধ্যাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তোমার জন্য শাড়ি আনতে গেলাম। সবগুলো শাড়িতে আপনাকে হুরপরী লাগবে মহারাণী। বিশেষ করে তোমাকে এই শাড়িতে দেখলে হুরপরীরাও লজ্জা পেয়ে যাবে। লাল টুকটুকে পুতুল বউ লাগছে তোমায়। ইচ্ছা করছে আবারও বিয়ে করে নেই।”
ইনারা লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে যায়। তার গালও লাল হয়ে যায় লজ্জায়। হৃদস্পন্দন হয় বাঁধন হারা। সে চোখ নামিয়ে নেয়। সভ্য সে লজ্জামাখা মুখে মাতোয়ারা হয়। হাজারোবার প্রাণ হারায়। সে ইনারার থুতনিতে হাত রেখে মুখ তুলে। বুড়ো আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় তার ওষ্ঠদ্বয়। শিউরে উঠে ইনারা। সে নড়ে-চড়ে বলে, “কি করছেন। সুরভি এসেছে। ও..”
সভ্য ইনারার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলে, “কোনো কথা না। এত সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করো না।”
সে এগোয় ইনারার দিকে। তার গোলাপি ঠোঁটজোড়ার উপর তার দৃষ্টি। তার ঠোঁটজোড়া স্পর্শ করবে আর দরজা খোলার শব্দ পায় সে। পরক্ষণেই ইনারা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। মেঝেতে পড়ে যায় সে। বাথরুম থেকে সুরভিকে বের হতে দেখে থতমত খেয়ে যায়। এখন শালীসাহেবার সামনে সম্মান বাঁচাতে তো হবে। তাই আশেপাশে কিছু খোঁজার বাহানা করে। সুরভি জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছেন দুলাভাই?”
“আমি… আমি তো মেঝেতে এনগেজমেন্ট রিং খুঁজছি।” অস্বস্তিতে যা তা বলে দেয় সে।
“আচ্ছা আমি একটু বাহির থেকে আসি। একটা কল করার ছিলো।” সে ব্যাগ থেকে মোবাইল নিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। তবে দরজায় দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকায় তাদের দিকে, “দুলাভাই শুনেন।”
“বলো।”
“রিংটা আপনার আঙুলেই আছে। আর প্লিজ কন্টিনিউ। আমি দরজা লাগিয়ে গেলাম।”
লজ্জায় সভ্য মেঝেতে বসেই মাথায় হাত রাখল। ইনারাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বলো নি কেন সুরভি বাথরুমে ছিলো।”
“আপনিই তো মুখে আঙুল রেখে চুপ করিয়ে দিলেন। এছাড়া ও তো গোসলে গিয়েছিল আমি কি জানতাম এত দ্রুত বের হয়ে যাবে।”
“আমার শালীকার সামনে দিলে তো আমার ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে।”
“অসভ্য লোক, নিজের দোষ আমার উপর দেন খালি। রোমেন্সের ভূত কী আপনাকে ধরেছিল না আমাকে।”
“আচ্ছা যা হবার তো হয়েই গেছে। এবার একটু কাছে আসো।” সে ইনারার হাত ধরে টান দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইনারা তার হাতে খামচি দিয়ে বলে, “কোনো দরকার নেই। ধরতে আসবেন না আমায়। বহুত কাজ আছে। এখন আমার শাড়িগুলো বের করে এগুলো আবার প্যাক করতে হবে। যত্তসব জ্বালা!”
“হ্যাঁ, কিছু করলেও দোষ, না করলেও দোষ। সব দোষ আমার।”
.
.
সুরভি হাঁটতে হাঁটতে দোতলার বড় এক ব্যালকনির সন্ধ্যান পেল। গোসল করে এসে ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে ফোনটা দেখল। আহনাফের কতগুলো কল, মেসেজ। সন্ধ্যা থেকে সে ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল ইচ্ছা করেই। এত কল মেসেজ দেখে ইনারা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতো। তার এই মুহূর্তে আহনাফের সাথে কথা বলার মোটেও ইচ্ছা নেই। হোয়াটসঅ্যাপে অডিও মেসেজ পাঠিয়েছিল সে। সে অডিও মেসেজটাই শুনল সুরভি, “কী ব্যাপার সুরভি এতগুলো কল দিচ্ছি তুমি ধরছ না কেন? মানুষ একবার সামনের মানুষটা কথা তো শুনে। আমি মানছি তোমাকে মিটিং এর মিথ্যে কথা বলাটা উচিত হয় নি। মানছি। কিন্তু তোমারও তো আমার কথা না শুনে এভাবে রাগ দেখানো উচিত হয় নি। আমার বিধির সাথে দেখা করাটা তোমার পছন্দ হবে না বলেই মিথ্যে বলেছি। বিধির ফিয়ন্সে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করছিল তাই একটু মেন্টাল সাপোর্ট দেবার জন্য দেখা করেছিলাম। কেবল বন্ধু হিসেবে। আশা করি তুমি ব্যাপারটা বুঝবে। আসলে আমার ভরসা আছে তুমি ব্যাপারটা বুঝবে, তুমিই তো আমাকে বলেছিলে মানুষের খারাপ সময়ে তাকে সাহায্য করা উচিত। আমি তাই করেছি। তুমি সময় পেলে আমাকে কল দিও।”
সুরভি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। সে কি সত্যিই বেশি রাগ করে ফেলেছিল? একবার শোনা উচিত ছিলো আহনাফের কথা? সে তো ভুল বলছে না, কারও খারাপ সময়ে সাহায্য করাটা ভুল নয়। আবার তার চোখের সামনে ভাসছে আহনাফ ও বিধির হাত ধরে থাকাটা। তার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কী করবে সে বুঝতে পাড়ছে না। সে হেঁটে যায় ব্যালকনির ভেতরে। ব্যালকনির বর্ডারে মাথা রেখে বলে, “উফফ কি পরিস্থিতিতে পড়লাম। আহনাফের কথা সত্য না মিথ্যা কিছুই বুঝতে পাড়ছি না।”
তখনই পিছন থেকে ভারী গলার স্বর শোনা গেল, “আই ডোন্ট থিংক লোকটা মিথ্যা বলছে কিন্তু তোমাকে ম্যানুপুলেট করে নিজের দোষ তোমার উপর ঠিকই চাপিয়ে দিচ্ছে।।”
সুরভি চমকে তাকায় ডান পাশে। আঁধারের স্থান থেকে শব্দ শোনা যাচ্ছে। ছায়ার নড়াচড়া অনুভূতি পাচ্ছে সে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। সে ছায়ামূর্তিটাকে দেখে তার গলার শব্দটা জোট বেঁধে আটকে যায় গলার ভেতরই। সে আতঙ্কিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কে…কে ওখানে?”
ছায়ামূর্তিটা উওর দেয় না। তবে তার নড়াচড়ার আভাস ঠিকই পায় সে। সে এগিয়ে আসে, তার দিকে।
চলবে….
[দয়া করে ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্প নিয়ে মন্তব্য জানাবেন। ভালো অথবা খারাপ।]