অনুভূতির খাঁচা পর্ব-১৫+১৬

0
29

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-১৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

অভ্র কথাগুলো বলেও চিন্তায় পড়ে। মায়ার মন তো আর কোনো স্বাভাবিক মেয়ের মতো নরম নয়। ওকে যতটা দেখেছে, বুঝেছে তাতে এই ভালোলাগা, ভালোবাসাতে মায়ার অন্তত কিছু আসে যায় না। আর মায়ার ইচ্ছা ছাড়া সে এই বিয়ে ভাঙতেও পারবে না। সে নিজের বিয়েটা ভাঙতে গেলে সে নিজের লক্ষ্যে কখনো পৌঁছাতে পারবে না।
“ঠিকাছে।” মায়া বলে, নির্দ্বিধায়।
“ঠিকাছে?” বিস্মিত ছোঁয়া অভ্রর কন্ঠে।
“হ্যাঁ। তুমি ওই মেয়েকে আসলে পছন্দ করলে আমি এই ড্রামার মাঝখানে থাকতে পারব না। তোমরা যা করার করো, আমার কিছু আসে যায় না। কেবল এই বিজনেস ডিলটা যেন হয় এবং আমার শর্তগুলো যেন পূরণ হয়।”
“তুমি এত সহজে রাজি হয়ে গেলে?”
“ও হ্যালো, তোমার প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি না যে কান্নাকাটি করব। আরও এসব বিয়ের ড্রামা থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু আমার কথাগুলোর যেন নড়চড় না হয়।”
“হবে না, ওয়াদা রইল।”
“ওয়াদা বিশ্বাস করতে হবে? তাও তোমার মতো নেতার?
কন্টেক্ট পাঠিয়ে দিব সাইন করে দিও। পরে যদি সাইন না করো তাহলে… ”
“করে দিব, নাহয় আমি জানি আমার রক্ষা নেই।”
“গুড।”
মায়া পিছনে ফিরে যেতে নিলে দেখে জোহান দাঁড়ানো। চোখ বড় বড় করে দেখছে তাদের। তার হাতে একটি সিগারেট। মায়াকে দেখে সে সিগারেটটি ফেলে দেয়। তারপর অনিচ্ছুক হাসি দেয়। তার কোম্পানির সাথে লেখা ছিলো সিগারেট, মদ এসব গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। তাই হাসিটি ভয়েরই বুঝা যায়। কিন্তু মায়া তাকে তোয়াক্কা না করে বাড়ির ভেতরে যাবার জন্য রওনা দেয়। জোহানও তার পিছনে যায়, তাকে বুঝানোর জন্য।

ইনারা মিতার সাথে গল্প করার মাঝেই কেমন অস্থিরতা অনুভব হয়। হঠাৎ তার মাথা ঘুরানি দেয়। মিতা তাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে পানি আনতে যায় তার জন্য। ইতিমধ্যে সভ্য এসে তার পাশের চেয়ারে বসে। তার কাঁধে হাত রেখে মশকরা করে বলে, “কী ব্যাপার আজ আমার মহারাণী এত শান্ত হয়ে বসে আছে। সূর্য আজ পশ্চিম দিক থেকে উদয় হয় নি তো?”
তবে ইনারা শান্ত গলায় উওর দেয়, “আমার শরীর ভালো লাগছে না।”
“ভালো লাগছে না?” সভ্য চিন্তিত হয়ে ইনারার মাথায় হাত রাখে এবং বলে, “জ্বর নেই। তাও শরীর খারাপ আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।”
“না। ঘরে সবাই অনেক খুশি। অনুষ্ঠানের মহল তাই আমি কোনো ঝামেলা করতে চাই না। আর এত বড় কিছু হয় নি যে আমার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”
“তাহলে তুমি আমার সাথে রুমে যাচ্ছো।”
“একদম না। সবাই টেনশন করবে যা আমি চাই না। এত খুশির মহলে টেনশন ভালো লাগে?”
“তোমার কথা আমি মেনেছি এখন আমার কথা তোমার মানতে হবে।”
বলেই তাকে কোলে তুলে নেয়।
ইনারা তো হতবাক, “পার্টিতে সকলের সামনে এসব কী করছেন? সবাই কি ভাববে?”
“ভাববে যে সাফওয়াত ইসমাত সভ্য তার স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসে।”
“দেখেন মি:অসভ্য আমি লজ্জা পাচ্ছি। জ্বালাবেন না, আমাকে নামান তো।”
“উফফ আমার বউকে লজ্জা পেলে কত কিউট লাগে।”
ইনারা তার বুকে ঘুষি মেরে গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকায়। সভ্য যখন তাকে সিঁড়ি করে উপরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন বিড়বিড় করে বলে, “আই লাভ ইউ।”
সভ্য মিষ্টি হেসে তার মাথায় চুমু দেয়।

মায়া বাড়ির ভেতরে যায়। তার বাবাকে খুঁজে। সে দেখে তার বাবা অভ্রর দাদার সাথে কথা বলছে। সে যেয়ে তার বাবাকে ডাকে, “তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
“ভালো হয়েছে তুমি এসেছ। আমরা বিজনেস নিয়েই কথা বলছিলাম। আমাদের সাথে জয়েন করো।”
“তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে।”
“পরে কথা বলব।”
“জরুরী কথা।”
মায়ার বাবার তখন ভীষণ রাগ উঠে। কিন্তু সকলের সামনে তা প্রকাশ করতে পারে না। সে অভ্রর দাদা থেকে একটু সময় নিয়ে আসে। মায়ার সাথে আলাদা একটি জায়গায় যেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে? তুই কেমন ব্যবহার করছিলি? মি: ইসমাত কী ভাববেন? এনগেজমেন্ট শেষেই আমরা বিজনেস ডিলে সাইন করতাম সে কথাই বলছিলাম। আর তুই….”
“আমি এনগেজমেন্ট করবো না।”
মায়ার বাবা চুপ হয়ে যান। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এনগেজমেন্ট করবি না মানে? কেন করবি না?”
“কিছু কারণ আছে। বলা যাবে না।”
কথাটা শুনতেই মায়ার বাবা তার গালে সজোরে থাপ্পড় মারেন। ক্ষেপে উঠেন তিনি, “তোর বিবেক আছে? তোর জন্য একবার আমরা অপমানিত হয়েছি। এরপর আবার এখানে আমাদের অপমান করতে এনেছিস? তোর জন্য কত ছোট হতে হয়েছিল আমার এই ধ্যান আছে তোর? আর আবার তুই আমাকে অপমান করতে চাইছিস? তোর মতো মেয়ে হওয়া থেকে না হওয়া ভালো। অবশ্য তুই হওয়া না হওয়াতে কারো কিছু আসে যায় না। আমার তো আফসোস হয় সে দিনের জন্য যেদিন তুই জন্ম নিয়েছিলি? সেদিন তোকে গলা টিপে মেরে ফেললে ভালো হতো।”
মায়া কোনো উওর দেয় না। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তার বাবা আবারও বলে, “এখনো তোর লজ্জা নেই তাই না? আমি কিন্তু তার জানি না এই এনগেজমেন্টর উপর আমার বিজনেস টিকে আছে। আর এনগেজমেন্টটা আজ হবেই। তুই কি তোর বাপও এই এনগেজমেন্ট করবে।”
“তো তুমিই এনগেজমেন্টটা করে নেও।”
বলে সে স্বাভাবিকভাবেই সেখান থেকে হেঁটে যায়। তার বাবা পিছন থেকে তাকে বলে, “তোর মতো বেয়াদব মেয়ে আমি আগে দেখিনি। তুই আমার মেয়ে হতেই পারিস না।”
মায়া সেখান থেকে বের সময় দেখে জোহান দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। অর্থাৎ সে সবকিছু শুনেছে। তবুও সে জোহানকে কিছু বলে না। পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

এনগেজমেন্টের ঠিক আগ মুহূর্তে মায়াকে এভাবে চলে যেতে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। দাদাজান মায়ার বাবাকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
“এনগেজমেন্টের সময় হয়ে গেছে। ওর কিছু লাগলে আমাকে বললে আমি ব্যবস্থা করিয়ে দিতাম।”
“আসলে জনাব ইসমাত…. কীভাবে যে বলি…”
ফুপি বলে, “মুখ দিয়ে বলেন। অন্য কোথাও দিয়ে যে বলা যায় আমি তো জানতাম না।”
দাদাজান রাগি দৃষ্টিতে তাকায় ফুপির দিকে। সে চুপ করে যায় সাথে সাথে। তারপর মায়ার বাবাকে বলে, “আপনি নির্দ্বিধায় বলুন। আমরা এখন সম্বন্ধী, দ্বিধা করার কিছু নেই।”
“আসলে মায়া বিয়ে করবে না জানিয়েছে।”
ফুপি আবারো মুখ খুলে। এবার উচ্চস্বরে বলে, “আমার তো মেয়ে প্রথম থেকেই অসুবিধার মনে হচ্ছিলো। বাবা দেখেন নি কি পটরপটর করছিল এসেই। মানা করলে আগেই করতো বাগদানের দিন এসে এসব করার মানে কী? ফাজলামো করছেন আপনারা? আমাদের সম্মানের কথাও ভাবেন নি।”
সবার ধ্যান এখন তাদের উপর। সকলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় তাদের দিকে।
মায়ার বাবা সকলকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জিতবোধ করে। অনুরোধের সুরে বলে, “মাফ করবেন। আমিও জানতাম না ওই মেয়ে শেষ মুহূর্তে এমন কিছু করবে। আমি হাত জোর ক্ষমা চাচ্ছি আপনাদের কাছে।”
“মাফ করবেন, আমি এমন মানুষদের সাথে ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক সম্বন্ধ করি না যারা নিজের কথার মান না রাখে।”
“এমন করবেন না। আপনি চাইলে আমি আমার ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি আছি। তাও এই বিজনেস ডিল ক্যান্সেল করবেন না।”
জোহানের রাগ উঠে মায়ার বাবার উপর। সে ভাবতো কেবল তার বাবাই নিজের সাফল্যর জন্য নিজের পরিবারকেও শেষ করে দিতে পারতো। কিন্তু আজ তার মতো আরেকটি মানুষ দেখে তার রাগ উঠে গেল। সে ভাবলো মায়া এবং অভ্রর সম্পূর্ণ কথোপকথন সকলকে বলা উচিত।

“মনে হয় আপনার কাছে ব্যবসা নিজের সন্তানদের থেকে বেশি প্রিয়।” অভ্র প্রবেশ করল সে স্থানে।
মায়ার বাবা ইতস্ততবোধ করল, “এমন কিছু নয়। আমি কেবল আমার মেঝো মেয়ের জন্য দুই পরিবারের সম্মান নষ্ট করতে চাচ্ছি না। ও শেষ মুহূর্তে কীভাবে বিয়ের জন্য মানা করতে পারে?”
“ও বিয়ের জন্য মানা করে নি, আমি করেছি।”
“কী! তুমি এত দু:সাহস…” দাদাজান অভ্রকে বকতে নিলে সে তাকে থামিয়ে বলে, “দাদাজান একমিনিট ব্রেক নিন। আমি উনার সাথে কথা শেষ করে নেই তারপর আপনার সাথে কথা এগোব।”
অভ্র আবারও বলল মায়ার বাবাকে, “আপনি চিন্তা করবেন না আমাদের কোম্পানির সাথে আপনার ডিল ক্যান্সেল হবে না। আর এরপর থেকে মেয়েদের বিনিময়ে বিজনেস ডিল করা থেকে বিরত থাকবেন। মায়াকেও যে আপনি কেবল এই বিজনেস ডিলের জন্য বিয়েটা করাতে চাচ্ছিলেন তা আমি ভালো করে জানি।”
সে তারপর দাদাজানের দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদাজান আপনাদের সাথে আমি কথা বলতে পারি? কেবল আমাদের পরিবারের সাথে?”

একটি রুমের ভেতর পরিবারের সদস্যরা রয়েছে। সভ্য ও ইনারা ছাড়া, তারা পার্টিতেই উপস্থিত ছিলো না। অভ্র দরজা লাগায়। দাদাজান ক্রোধিত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ফাজলামো পেয়েছ? প্রথমে নিজেই বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললে আর এখন শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে গেলে ফাজলামো পেয়েছ?”
অভ্র শান্ত গলায় উওর দিলো, “আমার কেবল আমার উদ্দেশ্যের জন্য অর্থ লাগবে। তাই আমি একটি ডিল করেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য আপনি জানেন। আর আমি সঠিক করছি তাও আপনি জানেন। তবুও আপনি আমাকে নিজের ইশারায় নাচাতে চাচ্ছেন। মায়ার প্রতি কখনো আমার কোনো অনুভূতি ছিলো না। যখন আমি যে মেয়েকে পছন্দ করি তাকে পেয়েও আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি তাহলে কেন নয়?”
“মানে কী?”
“আমি সুরভিকে পছন্দ করি।”
“এখন আবার নতুন কাহিনী বানাচ্ছে ছেলেটা।”
“আমি ওকে এখন থেকে না, অনেক আগের থেকেই পছন্দ করি। আর এটা কোনো কাহিনী না। আপনি বলেছিলেন দাদীজান সহ সকলে ওকে এই ঘরের বউ হিসেবে দেখতে চাইতো তাহলে কেন নয়?”
“এভাবে শেষ মুহূর্তে এত তামাশার পর নয়।”
“কেন নয়?” দাদীজান অভ্রর পক্ষ নিয়ে কথা বলে, “আমি অভ্রর সাথে আছি। আমার অভ্রর পছন্দটা পছন্দ। সাথে অভ্রর মা’ও এটাই চাইতো। তাই না?”
অভ্রর মা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, “ওকে তো প্রথম দেখাতেও আমার অনেক ভালো লেগেছে। সরলতা ওর মুখে ভাসে। ওর চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় ওর মন কতটা পরিষ্কার।”
ফুপি আবারো কথার মাঝখানে কথা বলে, “কিন্তু আমি এই বিয়েতে রাজি না। ইনারা তাও ঠিক ছিলো। বড় পরিবারের মেয়ে। ও তো মিডেলক্লাস।”
অভ্র তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে, “ফুপি আপনি কী চান আমি কিছু বলি?”
ফুপি ভয়ে মাথা নাড়ায়। সে জানে অভ্রর রাগ কেমন ভয়ানক। সে শান্ত গলায় তার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিবে।

দাদাজান বলেন, “আমিও রাজি না। এখন তুমি আমাকে কি বলবে?”
দাদীজান খিটখিটে মেজাজে বলে, “ওর সাথে কথা না বলে আমার সাথে বলো।”
দাদাজান তো আর নিজের স্ত্রীর সাথে রাগী সুরে কথা বলতে পারে না। সে নম্র কন্ঠে বলো, “ও আগে বললে এত ঝামেলাই তো হতো না।”
“দেরি করলেও শেষ মুহূর্তে তো ওর বুঝ এসেছে। তোমার তো সাহস কম না তুমি আমার নাতির বিয়ে ব্যবসার জন্য করাচ্ছিলে? তোমার থেকে তো তোমার নাতিদের বুঝ বেশি দেখছি। যা কথা বলার আমার সাথে বলো আমার নাতির সাথে নয়।”
দাদাজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আচ্ছা আমি রাজি। কিন্তু সুরভি আর ওর পরিবারেরও তো রাজি হতে হবে। কাওকে পাঠাও সুরভিকে ডাকার জন্য।”

দরজায় নক পড়ে। সুরভি দরজার ওপাড় থেকেই জিজ্ঞেস করে, “দাদাজান ডেকেছিলেন আমায়?”
অভ্র দরজা খুলে তাকে ভেতরে আসতে বলে। সে ভেতরে ঢুকতেই দাদাজান সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “সুরভি অভ্র তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি জানি এটা হঠাৎ করে কিন্তু তুমি রাজি থাকলে আমি তোমার পরিবারের সাথে কথা বলতে পারি। কোনো জোরজবরদস্তি না, তোমার ইচ্ছা হলেই তুমি রাজি হবে।”
অভ্র বলে, “দাদাজান আমাদের আগেই কথা হয়েছে এ ব্যাপারে ।”
“তাই? কখন?” সুরভি না বোঝার মতো অভিনয় শুরু করে। অভ্র কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, “আমি তোমার সাথে তখন কী কথা বললাম? তুমিও রাজি ছিলে।”
“আপনি আমার সাথে কখন… ওহ হ্যাঁ এনগেজমেন্টের আগে তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তখন তো আমি ভাবছিলাম আপনি আপনার ও মায়ার কথা বলছেন। আমাদের মাঝখানে তো কখনো তেমন…. ”
অভ্র তার কথা কেটে দাদাজানকে বলে, “আমি কী সুরভির সাথে একা কিছু কথা বলতে পারি? আই থিংক তখন ও আমার কথা ভালোমতো বুঝে নি।”
“আমারও মনে হয় ওদের কথা বলার জন্য সময় দেওয়া উচিত।” দাদীজান বলেন।
দাদাজান সুরভিকে বলেন, “তুমি নিজ ইচ্ছা হলে হ্যাঁ বলবে। তোমার মত না থাকলে এনগেজমেন্ট কিছুতেই হবে না। আমি কথা দিচ্ছি।”
সকলে তাদের সময় দিয়ে বের হবার পর অভ্র গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করে সুরভিকে, “তুমি কি আজেবাজে বলছিলে?”
“হুম, ভাবতে দিন। আপনি আমাকে সেদিন হাঁটু গেড়ে বসিয়ে মাফ চাওয়ালেন। তো আমার আত্নসম্মানে চরম আঘাত লেগেছে। এখন আপনার আমাকে প্রয়োজন, অন্য রাস্তা তো নেই আপনার কাছে।”
“আচ্ছা তো আমার কি করতে হবে?”
সুরভি যেয়ে বিছানায় বসে, পা’য়ের উপর পা তুলে আদেশের সুরে বলে, “আমার সামনে হাঁটু গেড়ে অনুরোধ করুন।”
অভ্র বাঁকা হাসে। সে বলে, “ইম্প্রেসিভ, আমি তো জানতাম তুমি সহজ সরল কিন্তু এই রূপ তো দেখি নি।” সে সুরভির কাছে তার দিকে ঝুঁকে বলে, “ভেবে নিও এই রূপের প্রেমে পড়ে গেলে তোমারও ঝামেলা হবে।”
সুরভি ভয়ে পিছনে যায়। অভ্র তার এতটা কাছে এসে পড়বে সে ভাবতেও পারে নি। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে যায়। সে অভ্রর বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়। বলে, “আপনি… আপনি অনেক খারাপ। আমি আপনার সাথে অভিনয়ও করতে পারব না।”
সুরভি উঠে যেতে নিলে অভ্র তার হাত ধরে নেয়। থামায় তাকে। তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তারপর এক হাঁটু গেড়ে বসে।

সুরভি হতবাক। সে কল্পনাও করেনি যে অভ্র সত্যিই তার সামনে ঝুঁকবে। অভ্র তাকায় সুরভির দিকে। শান্ত গলায় বলে,
“তোমার সাথে আমি অনেক ভুল করেছি, যা আমার ঠিক হয় নি। কিন্তু সত্যি বলছি শেষবার যখন তোমাকে আমি অজ্ঞান হতে দেখেছি মনে হচ্ছিল আমার দম বের হয়ে যাবে। আমার নিজের উপর এত রাগ রাগছিল, মনে হচ্ছিল আমি কীভাবে আমার সীমা পেড়িয়ে গেলাম। আজ যখন আমি দাদাজানের কাছে শুনলাম তারা তোমাকে আমার জন্য বাছাই করেছিল তখন আমি নিজেকে চেয়েও আটকাতে পারি নি। কেন যেন ছুটে গেলাম তোমার কাছে। আমি জানি না কেন আমি তোমাকে সারাজীবন আমার সাথে চাই। এর জন্য তোমার সামনে হাজারবার ঝুঁকতে হলেও আমি রাজি।”
সুরভি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অভ্রর বাক্যের বিপরীতে সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। অভ্রর এই রূপ তো কখনো আশাও করে নি।

অভ্র উঠে দাঁড়ায়। সুরভির কাছে আসতেই সে চোখ নামিয়ে নেয়। অভ্র বলে বলে,
“আমি জানি তুমি কখনো কল্পনাও করো নি যে আমি এসব বলব। কারণ কল্পনা করাটাও তোমার বোকামির প্রমাণ হতো।”
সুরভি অবাক হয়ে তাকায় অভ্রর দিকে। অভ্র আবার হেসে বলে,
“তুমি এসব সত্যি ভেবেছিলে? হাউ সুইট, মাই সুইটহার্ট! স্বপ্নেও এমন কল্পনা করার পূর্বে একশোবার ভাববে। আসছে আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে।”
“একটা মানুষ এত খারাপ কীভাবে হয়?”
“কেন তোমার খারাপ লেগেছে? এসব মিথ্যা বলে কষ্ট লাগছে? এক মিনিট তোমার আমার জন্য অনুভূতি হচ্ছে না’কি?”
“আপনার প্রতি আমার অনুভূতি আসবে? পৃথিবীর শেষ পুরুষ বলেও আমার অনুভূতির খাঁচা আপনার জন্য খুলবে না। দাদাজানকে নিজের মতো বুঝিয়ে নিয়েন কারণ আপনার সাথে আমার এনগেজমেন্ট তো হচ্ছে না।”
সুরভি বিড়বিড় করে অভ্রকে বকতে বকতে বেরিয়ে যায়। অভ্রও বাঁকা হাসে, “এনগেজমেন্ট তো তোমার সাথেই আমার হবে। তোমার আর কিছু করার থাকবে না।”

সুরভি বাহিরে এসে দেখে তার বাবা মা খুশিমনে কথা বলছে দাদাজানের সাথে। সে অবাক হয়। তার মা তাকে দেখে এসে জড়িয়ে ধরে,
“জনাব ইসমাত আমাদের তোর এবং অভ্রর সম্পর্কে বলেছে। একবার আমরা ভুল মানুষের সাথে তোকে যুক্ত করে তোর জীবন খারাপ করেছি আর এবারও তুই আমাদের কথা ভেবে নিজের জীবন খারাপ করতে চাইছিলি? এত ভালো পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হওয়া তো আমাদের ভাগ্য, আমরা কেন মানা করব বল তো? তুই অভ্রকে পছন্দ করলে একবার বলতি আমাদের।”
“কী বলছো মা?”
“এখন আর নাটক করিস না। আমরা ছবি দেখেছি তোদের।”
“কীসের ছবি?”
দাদাজানও এগিয়ে আসেন, “তোমার মা ঠিক বলেছেন, ফজলু মিয়া আমাদের ছবি না দেখে তো আমরা জানতামও না যে তুমি নিজের পরিবারের জন্য বিয়ের দিকে এগোতে চাচ্ছো না। তাই আমি নিজেই তোমার মা বাবার সাথে কথা বললাম। আমি কেবল চাই তোমরা সবাই খুশি থাকো ঠিক আছে?”
সুরভি কিছু বলতে নিবে তখনই অভ্র বলে, সুরভি দেখো না আমরা রুমে কথা বলছিলাম তখন ফজলু মিয়া কতগুলো ছবি তুললো। কত কিউট হয়েছে দেখো।”
সে সুরভির হাতে ফোনটা দিয়ে তার মা’কে দেখে সালাম দেয়। তারপর মিষ্টি করে কথা বলতে শুরু করে তার সাথে। তারপর তার বাবার সাথেও। আর সুরভি তো অবাক হয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকে। রুমের ভেতর যতবার অভ্র তার কাছে এসেছে ততবারই ছবি তোলা হয়েছে। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় অভ্রর দিকে। অভ্র তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে তাকাতেই চোখ টিপ মারে সে।
সুরভি নাক ফুলিয়ে বলে, “আমিও তো বলি এই শয়তানটার মুখে লঙ্কার পরবর্তে আজ রসোগোল্লা কীভাবে টপকাচ্ছে!”
.
.
জোহান জলদিই পার্টি ছেড়ে এসে পড়ে। সে ভাবে মায়ার সাথে তার একবার দেখা করা উচিত। কিন্তু তার সাহস হয় না। কী বলবে সে? তাই একবার মায়ার বিল্ডিং এর সামনের পার্কিং এ এসেও আবার নিজের বিল্ডিংএই গাড়ি পার্ক করে সে। বিল্ডিং এর ভেতরে ঢোকার পূর্বে তার দৃষ্টিতে আপনা-আপনি যেয়ে আটকায় মায়ার বিল্ডিং এর দিকে। সাথে সাথে তার ভ্রুঁ কপালে উঠে যায়। সে উচ্চ স্বরে বলে, “এই…এই মায়া তুমি কী করছ?”
সে দেখে মায়া ছাদের বর্ডারে বসে আছে। তার হাতে একটি বোতল। মনে হচ্ছে এখনই সে ছাদ থেকেই লাফ দিবে। জোহান আতঙ্কিত হয়ে উঠে। সে দৌড়ে যায় মায়ার বিল্ডিং এর সামনে। আবার বলে, “তুমি উল্টাপাল্টা কিছু করবে না। আমি আসছি…এখনই আসছি তোমার কাছে।
ভুলেও ভুল কিছু করবে না। আমি আসছি।”
বলেই সে দৌড়ে ঢুকে বিল্ডিং এর ভেতর।

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-১৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহান লিফটের অপেক্ষা না করে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে থাকে। সে ছাদে উঠে জলদি করে দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। দেখে এখনো মায়া ছাদের বর্ডারেই বসে আছে। চাঁদের জ্যোৎস্নার আলোয় তার মুখটাও ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। সে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “তোমাকে না বলেছি এখান থেকে নামতে। এত ছোট ছোট ব্যাপারে এত বড় সিদ্ধান্ত ভুল। প্লিজ তুমি সুই*সাইডের ব্যাপারটা মাথা থেকে মুছে ফেলো।”
“সুই*সাইড? কে করছে সুই*সাইড?” মায়া অবাক হয় তার কথায়। জোহান সামনে এসে আরেকটু পরিষ্কারভাবে দেখে মায়াকে। সে এখনো এনগেজমেন্টের লেহেঙ্গা পরা। তার চুড়ি, গয়না পাশেই রাখা। সে তো আনন্দে পা নাড়াতে নাড়াতে কোকাকোলা খাচ্ছে।

জোহান ক্লান্তিতে নিচেই বসে পড়ে। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “তুমি কোক খাচ্ছো? আর আমি ভেবেছি তুমি এনগেজমেন্ট ভাঙার শোকে নেশা করে কি আকাম করতে বসেছিলে।”
মায়া হাসে তার কথায়, “তো তোমার মনে হয়েছ আমি এমন মানুষের সাথে এনগেজমেন্ট ভাঙার জন্য সুসাইড করবো যাকে আমি ভালো করে চিনিই না? কত বড় জিনিয়াস তুমি।” ব্যঙ্গপূর্ণ ভাবে বলে আবারও হাসে সে। পরক্ষণেই সে হাসিটা অবশ্য আফসোসের নিশ্বাসে পরিণত হয়, “ম*রতে হলে তো তখনই ম*রে যেতাম যখন আমার সম্পূর্ণ পৃথিবী এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গিয়েছিল, যাদের আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম তারাই আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল, এত বড় পৃথিবীতে একা হয়ে গিয়েছিলাম, যেদিন সত্যিই ম*রতে গিয়েছিলাম।” মায়া এক ঢোক গিলে পিছনে ফিরে তাকায় জোহানের দিকে, “এখন আমি নিজেকে শেষ করার কথা ভাবি না, অন্যদের পৃথিবী উজার করার ক্ষমতা রাখি।”
সে দেখে জোহান তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ঘুরে বসে। ছাদের বর্ডারের উপরই পা রাখলে চুড়িগুলো নিচে পড়ে যায়। নীরবতার মাঝে কাঁচ ভাঙার শব্দ শোনা না।
মায়া জিজ্ঞেস করে, “কী দেখছ শুনি।”
“দেখছি যে তুমি কত সহজে নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখো। তোমার বাবার কথায় তোমার মন খারাপ।”
মায়া হাসে। তার কোকের বোতলটা জোহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “নেও, খেয়ে নেও। ক্লান্তি কমে যাবে।”
জোহান যখন নেয় না তখন সে বোতলটা পাশে রেখে দেয়। সে হেসে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কী আমার জন্য খারাপ লাগছে? খারাপ লাগার দরকার নেই। এখন এসব কথা আমাকে আঘাত করতে পারে না। এসব কথা আমি আগেও শুনেছি। তখনও এমন আনন্দের এক দিন ছিলো। আমার এনগেজমেন্ট ছিলো। তবে সেদিন আমি অনেক খুশি ছিলাম। সেদিনও আমার দোষ ছিলো না। যাদের দোষ ছিলো তারা সেদিন নিজেদের ভালোবাসা পেয়ে গেছে আর আমি সব হারিয়েছি। সেদিন আমালে যত কথা শুনতে হয়েছে তার সামনে তো আজ মি: চৌধুরী কিছুই বলে নি। সেদিন যাদের সাপোর্ট করার দরকার ছিলো তারা আমাকে কষ্টে একা ছেড়ে আনন্দ করছিল।” মায়া আবারও হাসে। কিন্তু এবার হাসতেই তার চোখ দিয়ে জল বয়ে পড়ে। যা সে মুছে তার হাঁটুতে মাথা রেখে তাকায় জোহানের দিকে, “জানো আমি নিজের চোখের সামনে দেখেছি ওয়াহিদকে দিয়ার প্রেমে পড়তে। কিন্তু আমি এতটাই বোকা ছিলাম যে দেখেও বুঝিনি। আমার সামনে সব শেষ হয়ে যাচ্ছিল আর আমি…. হয়তো আমারই দোষ ছিলো। আমিই ওকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম, আমি বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম, আমিই খুব দ্রুত প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কোনো মানুষকে যখন খুব সহজে মানুষ নিজের করে পায় তার কোনো মূল্য থাকে। যাকে পেতে মানুষের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়, তার ততই গুরুত্ব থাকে। আমি সবার কাছে মূল্যহীনই রয়ে গেলাম। নিজের জন্মদাতার কাছেও। এজন্যই আজ জন্ম হতে আমাকে না মেরে ফেলার আফসোস করছিল সে।”
মায়াকে হঠাৎ কাঁদতে দেখে জোহান থতমত খেয়ে যায়। মায়াকে তার সামনে কখনো কাঁদবে সে ভাবতেও পারে নি। সে উঠে যেয়ে দাঁড়ায় মায়ার সামনে। কিন্তু কি বলবে বুঝতে পারে না। সে কেবল গাল ছুঁয়ে তার চোখের পানি মুছে দেয়। সাথে সাথে মায়া মুখ ফিরিয়ে নেয়।

জোহান বলে, “রাগের মাথায় হয়তো বলে ফেলেছে।”
মায়া কথাটির উওর দেয় না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েই রাখে। জোহান আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “জানো তোমার আর আমার গল্পে কিন্তু অনেকটা মিল আছে। আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য সব করেছি, সব হারিয়েছি, নিজেকে তবুও তার যোগ্যপুত্র হতে পারি নি। যাদের ভালোবেসেছি তাদের পায় নি। সত্যি বলতে ওদের যোগ্য ছিলাম না। এই চকমকের পৃথিবীতে এসে নিজের ভেতরটা শূন্য করে ফেলেছিলাম। বুঝতে দেরি হলো, তাও সঠিক পথে এসে পড়েছি। আর তুমি তো এতকিছুর পরও ভুল পথে যাও নি। নিজেকে সফল করেছ, শক্ত করেছ। নিজের প্রতি গর্ব হওয়া উচিত তোমার।”
“ভুল করিনি, কিন্তু ভবিষ্যতে করব না এর গ্যারান্টি কী? জোহান শুনো….”
“শুনছি।”
“তুমি নিজের ক্যারিয়ারে আবার সাফল্য পাবার পর এই কোম্পানি ছেড়ে দিও।”
“সাফল্য পাবার পর ছেড়ে দিব? কেন?”
মায়া তার দিকে তাকায়, “সব কেন এর উওর সময়ের আগে পাওয়া যায় না। আমার মনে হয় আমার বাসায় যাওয়া উচিত।”
মায়া পা বর্ডার থেকে নামিয়ে নিচে রাখতেই ব্যাথায় শব্দ করে উঠে।
“কী হয়েছে?”
“বিশেষ কিছু না, চলো।”
জোহান দেখে মায়া খালি পা’য়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কাঁচের চুড়ির উপর। যা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সে ঘাবড়ে যায়, “তো…তোমার পা’য়ে কাঁচ ঢুকে গেছে আর তুমি বলিছো কিছু না।”
“এসবে কিছু হয় না। আমি বাসায় যাচ্ছি।”
মায়া এগোলে জোহান তাকে জোর করে ধরে আবার বসায় ছাদের বর্ডারে। সে হাঁটু গেড়ে বসে দেখে তা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে না’কি। দেখে এক পা দিয়ে আসলেই অনেক রক্ত বের হচ্ছে। সে মায়াকে বকা দিয়ে বলে, “তোমার পা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আর তুমি বলছো কিছু হয় নি?”
“বলেছি তো কিছু হয় নি। ঠিক হয়ে যাবে।”
“চুপ। একদম চুপ।”
“এই তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না। আমি তোমার বস হই।”
“বস টস অফিসে এখানে না, বুঝেছ।”
মায়া বিড়বিড় করে বলে, “সাহস কত দেখেছ আমার সাথে এভাবে কথা বলে। আমাকে কি এখন আর দেখে মানুষের ভয় লাগে না?”
জোহান তবুও তার কথাগুলো শুনে নেয়। এতটা নিরবতার মধ্যে তার কন্ঠে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সে কথাটা শুনে হাসে। সে পা’য়ে ঢুকে থাকা কাঁচটা বের করার পূর্বে বলে, “বেশি ব্যাথা লাগলে বলো।”
“আমার সহ্যের ক্ষমতা অনেক। আমি এত ছোট জিনিসে ব্যাথা পাই না।”
জোহান এক টানে কাঁচটা বের করতেই মায়া ব্যাথা তার কাঁধে হাত রেখে খামচে ধরে।
জোহান বলে, “তা তো দেখতেই পারছি।”
মায়া লজ্জায় হাত সরিয়ে নেয়।
জোহান পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে মায়ার পা’য়ে বেঁধে দেয়। বলে, “তোমার বাসায় যেয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।”
“প্রয়োজন নেই।”
জোহান উঠে দাঁড়ায়, “কীভাবে প্রয়োজন নেই? ছোট কাঁচের গুড়ো ঢুকে থাকতে পারে। এছাড়া ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।”
“আমি একদম ঠিকাছি। আমার কিছু হব না।”
জোহান তার এত কাছ থেকে চাঁদের আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পারছে। সে হাত বাড়িয়ে তার চোখের নিচে লটকে যাওয়া কাজল মুছে বলে, “সকলে বলে নারীদের কাজলে মায়াবতী লাগে, কিন্তু সে কাজল যখন চোখের জলে লেপ্টে যায় তখন কত আশা সে জলের সাথে ভেসে যায় তা কেউ জানে না।”
চারদিকে নিরবতা। আঁধারের ভুবনে চন্দ্রের একটুখানি আলোয় মায়া তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। তার মুখে এমন গভীর শব্দ সে প্রথমবার শুনল। সে জোহানের হাতটা তার গাল থেকে আলতো করে সরিয়ে অন্যদিকে ফিরে ওড়না দিয়ে নিজের লেপ্টে যাওয়া কাজল মুখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করার জন্য বাঁকা হেসে বলে, “মনে হচ্ছে জলদি তোমাকে একটা গানের এলবাম দিতে হবে। গান নেই বলে এত গভীর কথনে ডুব দিচ্ছো।”
“তুমি আমার সাথে গাইবে?”
মায়া অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমি?”
“হ্যাঁ, আমি শুনেছি তুমি কলেজে থাকতে অনেক সুন্দর গাইতে।”
মায়া খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে, “আমি গান অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এখন সামলানোর জন্য আমার কাছে অনেককিছু আছে।”
“কিন্তু তাতে তুমি খুশি?”
“হ্যাঁ, এই প্রফেশন আমাকে কনফিডেন্ট করে, স্ট্রং করে, নিজেকে কন্ট্রোল করতে শেখায়।”
জোহান তার কাছে আসে আচমকায়। মায়া চমকে পিছিয়ে যায় কিন্তু তা জোহানের নজরে পড়ে না সে জিজ্ঞেস করে, “মানে তোমার গানের তালে নিজের হৃদয়ের গল্প উজার করতে মন চায় না? গানের সাথে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করতে ইচ্ছা হয় না? গানের সুরের সাথে নিজের অনুভূতির খাঁচা খুলে দিতে চাও না?”
মায়া তার দিকে তাকিয়ে থাকে। জোহান বলে, “উওর দেও।”
“তুমি আমার অনেক কাছে এসে পড়েছ।”
জোহানের মুখে দেখে বুঝা যায় তার উওর শুনে সে বিরক্ত হয়েছে। সে বিরক্তির সুরে বলে, “উওর ঘুরানোতা ভালো করেই জানে।”
জোহানের কাছে কিছু না হলেও মায়া সত্যিই অস্থিরতাবোধ করছিল। জানে না কেন, এই রাতের নিরবতায় তার নিশ্বাস আটকে আসছিলো। সে জোহানের সাথে চোখ মেলাতে পারছিল না বেশি সময়ের জন্য। সে জোহানের পাশ কাটিয়ে যাবার পূর্বে বলে, “আমি বাসায় যাচ্ছি।”
সে এগোতেই জোহান তার হাত ধরে নেয়। সে পিছনে মুখ ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকে তাকায়। জোহান তাকে কিছু বলে না, সোজা কোলে তুলে নেয়।
মায়া হতবাক, “কী করছ? নামাও আমাকে।”
“ম্যাডাম চুপ করে বসে থাকুন, নাহয় আপনার পা’য়ে যে আঘাত লেগেছে সেখানে আরও ব্যাথা করবে। আর ইনফেকশন হয়ে গেলে তো আর কথাই নেই। জেদ না করে আমাকে ধরুন।”
“আমি বলেছি না যে….”
জোহান তার দিকে তাকায়। কঠিন সুরে বলে, “চুপ করে থাকো। আমি বলেছি না তোমাকে এত সহজে ছাড়ছি না আমি। তোমার বাসায় যেয়ে ব্যাণ্ডেজ় না করা পর্যন্ত ছাড়ছি না।”
মায়া নিজেও জানে না সে কীভাবে জোহানের কথা মেনে নিলো। সে জোহানের গলায় তার হাত আবদ্ধ করে নেয়। কিন্তু সে তার দিকে তাকায় না।
জোহান বলে, “কিন্তু তুমি বিয়েটা না করে ভালোই করলে। তোমাদের ফার্স্ট মিটিং পুরো বিজনেস ডিলের মতো শুনাচ্ছিল।”
“মানে তুমি সত্যিই লুকিয়ে কথা শুনছিলে?”
“কি করব আমার বন্ধু বলেছিল।”
“ওহ নো…” মায়ার হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় তার চোখ বড় হয়ে যায়। জোহান জিজ্ঞেস করে, “কী হলো?”
“আমি তন্নি, আশরাফ, মেহেদীকে এনগেজমেন্ট ভাঙার কথা বলিনি। ওদের কতকিছু বুঝিয়ে মানিয়েছিলাম এই বিয়ের জন্য। ওরা টের পেলে আমাকে খু/ন করবে নিশ্চিত।”
“ওরা তোমার অনেক কাছের বুঝা যাচ্ছে।”
“তো হবে না। যখন কেউ আমার সাথে ছিলো না, ওরা ছিলো। শুধু ওরা, আমার ছোট বোন এবং আমার এক চাচ্চু ছিলো।”

লিফট বন্ধ থাকায় জোহানের তাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়েই নিচে নামতে হয়। তার এপার্টমেন্টের সামনে এসে দেখা যায় তন্নি ও আশরাফকে। তন্নি তাদের দেখে তার আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “ইন্টারেস্টিং… ভেরি ইন্টারেস্টিং। এদিকে আমরা তোকে নিয়ে চিন্তা করছি আর তুই একজনের সাথে রোমেন্স করছিস। বাহ!”
“এ…এমন কিছু না। এখন তো নামাও।”
জোহান তার দিকে তাকায়ও না। সে এগিয়ে যেয়ে তন্নির পাশে তাকে নামিয়ে দেয়। তন্নির দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলে, “আপনার বান্ধবী পা’য়ে কাঁচ ঢুকিয়ে বসে আছে, নাহলে ওর সাথে রোমেন্স তো দূরের কথা মুখ যেমন রাক্ষুসিদের মতো করে রাখে আশেপাশে যেতেও ভয় লাগে।”
“এই কী বললে তুমি? ” মায়া রাগান্বিত স্বরে বলে।
“আহা রাগ করছ কেন? ওয়েট তুমি চাও আমি তোমার সাথে রোমেন্স করি।”
“আমার দুশমনের জন্যও এত খারাপ চাইব না।”

তন্নি দুইজনকে চুপ করায়, “তোমরা কী চুপ করবে? ঠিক কী হয়েছে কেউ বলবে?”
“ম্যাডামের পা’য়ে কাঁচের চুড়ির কতগুলো টুকরো ঢুকে রক্ত বের হচ্ছিল। তাই এভাবে নিয়ে এলাম।”
এমন সময় ওয়াহিদ উঠে সিঁড়ি দিয়ে। জোহানকে এখানে দেখে ওয়াহিদের মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি এখানে কী করছ?”
“উফফ বারবার ব্যাখা দিতে হবে না’কি?” বিরক্তির সুরে বলে সে। আবার পালটা প্রশ্ন করে, “আমার থেকে আপনার এখানে থাকাটা বেশি বেমানান নয়?”
“তোমার সাহস কত বড় আমার কোম্পানির আন্ডারে কাজ করে আমার সাথে তর্ক করছ? তোমার ইতিহাস আমার জানা আছে। মায়ার সাথে তেমন কিছু করার চিন্তাও করবে না। ওর আশেপাশেও ঘুরবে না তুমি।”
“তো আপনি তো ধোঁয়া তুলসি পাতা না। আমার যতটুকু মনে আছে আপনার জন্যই ও সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে।”
“সাট আপ।”
“নো, ইউ সাট আপ।”

দুইজনের এমন ঝগড়া দেখে মায়া বিরক্ত হয়ে বলে, “দুইজনে সাট আপ। আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।”
সে লকে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে দরজা খুলে নিজের সাথে তন্নিকেও ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। আশরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুই আসবি না’কি আমন্ত্রণপত্র দিতে হবে।”
তারা সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে আসতে যায়। মায়া জোহান ও ওয়াহিদের দিকে রাগী দৃষ্টি তাকিয়ে তাদের মুখের উপর শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়।

জোহান থতমত খেয়ে বলে, “কি যুগ আসলো সাহায্য করার পরিবর্তে অপমান পেলাম। আহারে!”
তবে ওয়াহিদ জোহানের কলার ধরে গম্ভীরমুখে বলে, “আমি এই প্রথম ও শেষ ওয়ার্নিং দিচ্ছি মায়া থেকে দূরে থাকবে।”
জোহান তার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে বলে, “আপনি নিজের গার্লফ্রেন্ডের চিন্তা করুন। মায়ার চিন্তা ও নিজেই করতে পারবে। এছাড়া ওর উপর আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই তাই নিজের ওয়ার্নিং নিজের কাছেই রাখলে আপনার জন্য ভালো হবে।”
তারপর সেখান থেকে চলে যায়।
.
.
“মানে তুমি বলছ অভ্র ভাইয়া সুরভিকে ভালোবাসে। আর ছবিগুলোর উপর আমার বিশ্বাস করতে হবে?” সভ্য তার মা’কে বলে ফোনে ছবি দেখতে দেখতে। সে তার মা’কে একটি ছবি দেখিয়ে বলে, “মা তুমি নিজে দেখো ভাইয়া হাঁটু গেড়ে বসে আছে। অন্য কেউ হলে আমি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিতাম। কিন্তু অভ্র ভাইয়া কারো সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না। সে তার ভালোবাসার মানুষ হোক না কেন! আর ভাইয়া ভালোবাসে কাউকে এটা তো অসম্ভব।”
“এভাবে বলছিস কেন? ভালোবাসা সবাইকে পালটে দেয়। এই দেখ ইনারা তোকে কীভাবে পাল্টে দিয়েছে। এখন তুই কত্তো হাসিখুশি থাকিস। সবার সাথে কত সুন্দর করে কথা বলিস।”
“কিন্তু মা আমি আর অভ্র ভাইয়া আলাদা। আর আমি এক দুইবার কাওকে দেখে ভালোবাসিনি। ইনারাকে আমি ভালো করে চেনার পর ওকে ভালোবেসেছি।”
“এনগেজমেন্টটা হোক, ওরাও চিনে যাবে। দেখ ওদের কত খুশি দেখাচ্ছে একসাথে।”
সভ্য তার মা’য়ের সাথে দোতলায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের রুমের সামনে। তার মা তাকে নিচতলার অভ্র ও সুরভির দিকে ইশারা করে। সভ্য তাদের দিকে তাকায়। সে সুরভির হাত ধরে ছিলো। তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। সে কবে তার ভাইকে এভাবে হাসতে দেখেছিল তার মনে পড়ে না। সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ায়। অভ্রর গ্রাজুয়েশনের দিনে। তাকে হাসতে দেখে সভ্যর ঠোঁটের কোণেও হাসি আঁকে। সে তাদের দিকে তাকিয়েই বলে,
“সুরভি কী রাজি?”
“তুই ছবি দেখে বুঝতে পারছিস না? ও রাজি। ওর পরিবার তো অনেক বেশি খুশি।”
“তাহলে ঠিকাছে।”
মা খুশি হয়ে বলে, “তুই আর ইনারা জলদি নিচে আয় তাহলে।”
“ইনারার শরীর ভালো না মা। ও ঘুমাচ্ছে। আমিও ওর কাছে থাকব। এছাড়া ও যদি থাকে আজ আর এনগেজমেন্ট হবে না। ও সুরভির জন্য অনেক প্রটেক্টিভ।যাচাই করা ছাড়া কাওকে ওর সাথে থাকতে দিবে না। তা হোক আমার বড় ভাই।”
“আচ্ছা তাহলে ওর খেয়াল রাখিস তুই। আর কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে ডাক দিবি।”

মা নিচে যেয়ে অভ্র ও সুরভিকে বলে, “এনগেজমেন্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই হবে। সুরভি তুমি একটু তৈরি হয়ে নিবে?”
“না আন্টি, আমি ঠিক আছি।”
“আন্টি না, এখন থেকে ইনারার মতো তুমিও আমাকে মা বলে ডেকো ঠিক আছে?”
সুরভি জোর করে হাসে। মাথা নাড়ায়।
মা খুশি হয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলে, “আমি ভাবতাম যে ঘরে দুই বউ এলে এই ঘরকে সবসময় বেঁধে রাখবে না’কি? কিন্তু আজ নিশ্চিন্ত হলাম। আমি জানি তুমি ও ইনারা একে অপরকে অনেক ভালোবাসো তাই কখনো কোনো সমস্যা হবে না। তোমরা কথা বলো আমি একটু কাজ সেরে আসছি।”
মা যাবার পর সুরভি অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “এতগুলো মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করতে আপনার লজ্জা লাগে না?”
“না।”
সুরভি তার হাত মোচড়াতে থাকে, “হাত ছাড়ুন। আপনার ছোঁয়াতেও আমার বিরক্তি লাগছে।”
“লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকো। কেউ দেখলে সমস্যা হবে। দেখো তোমার পরিবার কতটা খুশি।”
সুরভী শান্ত হয়। সে আড়চোখে তাকায় অভ্রর দিকে। বলে,”আপনি জানেন তো, আপনি কতটা জঘন্য মানুষ। আপনি কীভাবে এমন ট্রিক করতে পারেন আমার সাথে?”
“তুমিও তো প্রথমে রাজি হয়ে শেষ মুহূর্তে নাটক করছিলে। আর এত সমস্যা হলে যাও সবাইকে যেয়ে সত্যিটা বলো।”
“সবার সামনে আপনার ও আমার পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে বলেই রাজি হয়েছি।”
“আচ্ছা তাহলে যখন তোমার নাটক সাজিয়েছিলে তখন আমার পরিবারের সম্মানের কথা মাথায় ছিলো না?”
“তখন একটা মেয়ের সম্পূর্ণ জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এখন নিজে ফেঁসে গেলাম।”
অভ্র বাঁকা হাসে, “তো এখন সারাজীবন নিজের কর্মের ফল ভোগ করো।”
“সারাজীবন মানে? আপনি বলেছিলেন বিয়ের আগেই সম্পর্কটা ভেঙে যাবে।”
“তো আমি তো জানতাম না তুমি নাটক করছ। আচ্ছা যাও, তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তুমি এই কয়মাস আমি যা বলব তা করবে আর আমি তোমাকে এই সম্পর্কের খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিব।”
সুরভি নিজের রাগকে সামলে সরাসরি তার দিকে তাকায়। কিছু বলার পূর্বেই তাদের ডাক পড়ে। আংটিবদলের সময় এসেছে। তারা সকলের সামনে যায়। দুই পরিবারের সামনে মাঝে তাদের আংটি পরানো সম্পূর্ণ হয়। সুরভির না চাইতেও আংটি পরানো লাগে। তার মধ্যে এতটা সাহস ছিলো না যে এতগুলো মানুষের মধ্যে সে কিছু বলবে। আংটি পরানো শেষে সবাই যখন তাদের সাথে ছবি তুলছিল এর মাঝে অভ্র তার আংটি সুরভিকে দেখিয়ে বিজয়ের হাসি দেয়। যেন এই খেলাটি জিতে গেছে।
আর সুরভি তাকে দেখে মুখ বানাতে থাকে। তার খুব বিরক্তি লাগছে। আবার চিন্তাও হচ্ছে। ইনারা যদি জানে এনগেজমেন্টের কথা তার কি অবস্থা করবে!

পার্টি শেষে সবাই যাবার পর সুরভির পরিবারের সাথে কথা বলতে বসেন সবাই। এর আগে আলাদাভাবে কথা হয় নি তাদের। দাদাজান বলেন, “ধন্যবাদ আপনাদের। আপনারা তখন রাজি না হলে আমাদের সম্মান নষ্ট হতো।”
ফুপি তখন ভেংচি কেটে বলে, “এমন পরিবারে সম্পর্ক হয়েছে এটাই তো তাদের সাত কপালের ভাগ্য। তারা কি স্বপ্নতেও এত বড়….” অভ্রর দিকে তাকিয়ে আবার সে চুপ হয়ে যায়। তার চোখ ঘুরানো দেখে সে ভয়ে কথাই বদলে দেয়, “মানে এত ভালো ছেলে, এত ভালো পরিবার কি সহজে পাওয়া যায়? ইনারা কত খুশি আছে এখানে এটা তো দেখেছেই তারা।”

সুরভির বাবা বলেন, “একদম ঠিক বলেছে আপা। ইনারা সবসময়ই আপনাদের প্রশংসা করেন। এর উপর অভ্রর যে জনগণের এত সেবা করে তা তো সবাই জানে। আমারও রেস্টুরেন্টের কিছু সমস্যা হয়েছিল যা উনার লোকই এসে ঠিক করে দিয়েছিল। ও অচেনা লোকেদের এত খেয়াল রাখলে আমার মেয়েকে কত সামলে রাখবে।”
সুরভি বিড়বিড় করে বলে, “ভালো না ছাই। সব লোক দেখানো কান্ড। এই মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝে না। আর রইল দোকানের কথা সে নিজেই সমস্যা তৈরি করে সমাধান করেছে, কেবল নিজের ইগো সেটেসফাই করার জন্য।”

এমন সময় দোতলা থেকে শব্দ আসে। সকলে ধ্যান যায় সেদিকে। মুহূর্ত না গড়াতেই সভ্য বেরিয়ে আসে দরজা খুলে। সে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে সুরভীর উদ্দেশ্যে বলে, “তোমার ডাক পড়েছে।”
শুনেই সুরভীর জান যেন শুকিয়ে যায়। সে এক ঢোক গিলে উঠে যায় সভ্যর কাছে। ভীতস্বরে বলে, “দুলাভাই আপনি আসবেন না?”
“আমার তো জানের ভয় আছে।”
“আমার আলুর ভর্তা করে ফেলবে।”
“আমি বকুনির কোর্স কমপ্লিট করে এলাম। এবার তোমার পালা। অল দ্যা বেস্ট।” বলেই সভ্য পাশ দিয়ে কেটে পড়ে।

সুরভি ভয়ে ভয়ে উপরে যায়। দরজা খুলে দেখে বিছানার বালিশ মেঝেতে পড়ে আছে। নিশ্চিত এগুলো দিয়ে তার বেচারা দুলাভাইয়ের উপর আঘাত হয়েছে। সে রুমে ঢুকেই বলে, “দোস্ত তুই রাগ করার আগে আমার কথাটা শুন।”
তার কথা শুনে ইনারা তার দিক তাকায়, “তোর কথা শুনব না? দাঁড়া তুই কেবল।” সে উঠে সুরভিকে মারার জন্য। সুরভি তো এক দৌড়। সে রুমের মধ্যে ইনারা থেকে বাঁচার জন্য পালাতে থাকে। ইনারাও তার পিছনে। হঠাৎ তার শরীর খারাপ লাগায় সে বিছানায় বসে পড়ে। সুরভি হঠাৎ তাকে মাথা ধরে বসতে দেখে চিন্তিত হয়ে তার কাছে আসে। তাকে ধরে বলে, “কী হলো তোর? ঠিক আছিস তুই?”
ইনারা তার হাত নিজের থেকে সরিয়ে বলে, “আমার কাছে আসবি না তুই? তুই কিভাবে আমাকে না বলে এনগেজমেন্ট করতে পারিস?”
সুরভি তার পাশে বসে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আমার হাতে কিছু ছিলো না দোস্ত।”
“তুই আমাকে ডাকলে আমি সব দেখতাম।”
“তখন আমার মাথায় কিছু আসছিল না। এছাড়া তোর শরীর খারাপ ছিল।”
“কচু! আর এক কথা বল ওইসব ছবিতে তুই অভ্র ভাইয়ার এত কাছে কেন ছিলি? আর এনগেজমেন্টের জন্য হ্যাঁ বললি কীভাবে? তুই কী তাকে ভালোবাসিস?”
সুরভী কি বলে বুঝ করতে পারে না। সত্যি কথা বললে বিরাট বড় ঝামেলায় সে ফাঁসবে এতটুকু তো ভালো করেই জানে। আর মিথ্যা বললে সে ধরা পড়বে। কেননা অচেনা এক মানুষের প্রেমে পড়া কীভাবে সম্ভব? তাই সে বলে,
“অবশ্যই ভালোবাসি না, কিন্তু উনার পরিবার এত ভালো, তুই আছিস এখানে, আর উনিও… ভালোই।”
“ভালো? কীসের ভালো? তুই জানিস উনি কত সহজে আমার সৎ বাবার বাসায় ড্রা|গসের ব্যাগ রেখেছিল। যদিও আমার সাহায্যের জন্য। কিন্তু তবুও চিন্তা কর, কতটা সহজে। আর পলিটিক্স কত খারাপ জিনিস তুই কী জানিস না? আবার ভাবতে গেলে সব পেশাতেই ভালো খারাপ আছে। এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও কত খারাপ। কিন্তু এখানেও তো ভালো মানুষ আছেন। উফফ আমি নিজেই কনফিউজড।” ইনারা উঠে দাঁড়ায়। চিন্তিত হয়ে কক্ষে পায়চারি করে। আবার বলে, “কিন্তু আমি তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে ঝুঁকি নিতে পারব না। এই এনগেজমেন্ট ততদিন আমি মানবো না যতদিন আমি সিউর না হচ্ছি যে অভ্র ভাইয়া তোর যোগ্য। কারণ দ্বিতীয়বার তোর মন ভাঙাটা আমি সহ্য করতে পারব না। দেখ যতই হোক, সে তো আমার ভাসুর। ভাসুরের নাক ফাটালে তো খারাপ দেখা যায়। এটা আমি কীভাবে করতে পারি? আবার ভাবতে গেলে, আমি পারব। তোর মন ভাঙলে তাকেই ভাংতে পারব।”
সুরভি উঠে তার পিছনে এসে দাঁড়ায়,
“কী করবি তুই?”
“পরীক্ষা নিব। তিনটি পরীক্ষা। পাশ করলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে তোর ও অভ্র ভাইয়ার সম্পর্ক আছে মেনে নিব।”

চলবে…