অনুভূতির খাঁচা পর্ব-২৯+৩০

0
30

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

অভ্র রাতে না খেয়েই তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। গত দুইরাত কাজের জন্য ভালো করে ঘুমাতে পারে নি তাই আজ বাড়িতে এসে শুতেই তার ঘুম এসে পড়েছিল। হঠাৎ এমন দু:স্বপ্ন দেখে উঠে গোসল করায় তার খিদে আরও বেড়েছে। ঘড়ি দেখে, রাত বারোটার বেশি বাজে। সে নিচে যাবার জন্য রুম থেকে বের হয়। নিচের দিকেই যাচ্ছিল সে তখনই দেখতে পায় দোতলার খোলা বারান্দার চেয়ারে কেউ বসে আছে। সে যেয়ে দেখে সুরভি সেখানের সাইড সোফায় বসে আছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে আর খাচ্ছে। তাকে দেখে অভ্রর অস্থির মনটা একটু শান্ত হয়। সে যেয়ে বসে সুরভির পাশে। তবুও সুরভির খেয়াল হয় না। সে দেখে সুরভি সুজির হালুয়া খাচ্ছে। সে সুরভির হাত ধরে তার চামচ দিয়ে নিজে খেয়ে নেয়।

ভয়ে আঁতকে সুরভি পিছনে তাকায়। অভ্রকে দেখে শান্তির নিশ্বাস ফেলে। কানের হেডফোন খুলে বলে,
“আমার জান বের হয়ে গিয়েছিল। আমি বলি এত রাতে কে আমার হাত ধরেছে।”
অভ্র হাসে, “তুমি এখানে কি করছো?”
“আমি আগেই যেতে চেয়েছিলাম। কেউ যেতে দেয় নি। আর ইনারাও জেদ করছিল তাই…”
“এখানে থাকার কথা বলছি না। এত রাতে একা বারান্দায় কী করছ?”
“ওহ, আজকের রাত, আকাশ, মেঘ, চাঁদ সব সুন্দর দেখাচ্ছিল। তাই ভাবলাম এই জায়গায় এসে বসি। গান শুনছিলাম আর আন্টি সুজির হালুয়া দিয়েছিল রাতের খাবার শেষে, খাই নি বলে রুমে রেখে গিয়েছিল। তাই নিয়ে এলাম। আপনি খাবেন?”
“খিদে লেগেছে, দেও…” অভ্র হা করে এই ভেবে সুরভি তাকে খাইয়ে দিবে কিন্তু সুরভি তার হাতে বাটিটা দিয়ে আবার অন্যদিকে তাকায়। বেচারা অভ্র মুখ ছোট করে নিজেই খাওয়া শুরু করে।

সে সুরভিকে বলে, “আগামীকাল তোমার অফিস আছে? তাহলে আমি তোমাকে ড্রপ করে দিতে পাড়ব সকালে।”
“আমি ওই অফিস ছেড়ে দিয়েছি।”
“কেন? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে, আমি দেখতাম। আহনাফ কিছু করেছে আবার?”
সুরভি অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “না, উনাকে অন্য স্টেটে ট্রান্সফার করা হয়েছে।”
“তাহলে কী সমস্যা?”
“আপনি সেদিন সবার সামনে আমাকে আপনার… ওই বলেছিলেন না যে আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে তারপর থেকে সবাই আমাকে এলিয়েনের মতো ট্রিট করেছে। কাজ করতে দেয় না, ভুল করলে বকা দিবে না, এককথায় রাণীর মতো ট্রিট করছে। এখন আমি এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি, এই রিপোর্টার হওয়া আমার স্বপ্ন ছিলো যেন সাধারণ জনগণের সামছে সত্যি আনতে পারি কিন্তু যদি আমাকে এভাবে স্পেশাল ট্রিট করতে থাকে তাহলে এককথায় ফ্রী-তে বেতন নিবো। তা অন্যদের সাথে অন্যায় হবে না? তাই ছেড়ে দিচ্ছি। অন্য কয়েক জায়গায় সিভি পাঠিয়েছি। অফিস ওটার থেকে ছোট কিন্তু পজিসন বড় পাচ্ছি। আমি আগে জানতাম না কাজ সুইচ করা এত ভালো ডিসিশন হবে।”
“এখন কি তুমি তাহলে এত ভালো পজিশন পাওয়ার জন্য আমাকে থ্যাংক ইউ বলবে, না’কি তোমার চাকরি আমার জন্য ছাড়তে হয়েছে বলে আমার সরি বলা লাগবে?”
সুরভি তার দিকে তাকিয়ে হাসে, “আপনি সরি বলবেন? আপনারে ইগো মাঝখানে আসবে না?”
“তাও ঠিক।”
সুরভি তার হাসি চাপা দিয়ে তার দিকে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আপনি আজ সত্যি আমার জন্যই এত পেনিক করছিলেন?”
“কেন?”
“না মানে আমি তো আপনার কেউ হই না তাই আর-কি।”
অভ্র তার দিকে তাকায়, মৃদু হাসেও কিন্তু কোনো উওর না দিয়ে আবারও খাবারে ধ্যান দেয়।
“কী হলো? হাসছেন কেন?”
“তুমি এ-কারণে আজ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছ? আমিও তো বলি তুমি তো আমাকে সহ্য করতে পারো না, হঠাৎ তোমার কি হলো।”

সুরভী তার হাতে চুড়িটা খুলে অভ্রর সামনে দিয়ে বলল, “এটা আপনার কাছে রাখুন।”
“দাদীজানতো ঐটা তোমাকে দিয়েছে। উপহার হিসাবে।”
“আমাকে নয়, আপনার হবু স্ত্রীকে। আজকে যখন দাদীজান এত আবেগী হয়ে চুড়িটা আমায় দিল, তখন আমার খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি সবাইকে ঠকাচ্ছি। আমার এইসব মোটেও ভালো লাগছে না। আপনার কাজ কবে শেষ হবে? আমরা কবে সবাইকে সত্যি বলব?”
অভ্রর খাবার শেষে সে বাটিটা পাশে রেখে তাকায় সুরভীর দিকে৷ তারপর উওর দেয়।

সে উঠে বারান্দার অপর কোণে যায়।
“জানো মা’য়ের ফুলের গাছের শখ ছিলো। বিশেষ করে বেলিফুলের। তাই বাবা এই বারান্দাটা ফুলের টব দিয়ে ভরে রেখেছে। ছোটবেলায় আমার এই জায়গায় বসে পড়াশোনা করাটা খুব পছন্দের ছিল। কারণ এখান থেকে বেলীফুলের মোহনীয় সুবাস আসতো।” অভ্র সেখান থেকে নিচে পড়ে থাকা কতগুলো বেলি ফুল তুলল। এসে সুরভীর সামনে বসে তার বেণীর ফাঁকে ফাঁকে সে শুভ্র বেলিফুল গাঁথতে গাঁথতে বলল, “আমারও বেলিফুলের সুরভি ভীষণ পছন্দ।”
সে উপরে তাকায়। সুরভির চোখে খানিকটা বিস্ময় অথবা প্রশ্নের ঝলক দেখতে পায়। তার নিঃশ্বাসটা গভীর। ঠোঁট নড়ছিল কিছু বলার জন্য, কিন্তু কোন শব্দ আসে না।

অভ্র হেসে হাত বাম ধরে আনামিকা আঙুলে আংটির ভেতর সুন্দর দেখে একটি শুভ্র বেলি ফুল গুঁজে দেয়। তারপর তার হাত নিয়ে বেলিফুলে আলতো চুমু খায়। তার ঠোঁটের ছোঁয়াও লাগে নি সুরভির আঙুলে অথচ তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো। সে হাত সরিয়ে অস্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, “আমার একটু… একটু না অনেক ঘুম ধরেছে। আমি যাই।”
সুরভি তড়িঘড়ি করে চলে যাবার পূর্বে আবার পিছনে তাকায়। আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা মেঘলার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
“মেঘলা? মেঘলা আমার…”
অভ্র বলতে চাচ্ছিল কিন্তু এর পূর্বে সুরভি নিজেই বলে, “থাক। আমার মনে হয় আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার প্রশ্ন করা উচিত হবে না।” বলে সে আবারো তড়িঘড়ি করে যেতে নিলে পায়ে ব্যাথা পায়। তবুও সেখান থেকে দৌড়ে পালায়। সে যাবার পরে অভ্র দেখে সেখানে বেলি ফুল পড়ে আছে। সে ফুলটা তুলে তার পকেটে রেখে দেয়।
.
.
মায়ার বাসায় আসতে আসতে অনেক রাত হয়। সে গাড়ি তাদের সোসাইটি তে ঢুকানোর সময় দেখে জোহান জগিং করছে। এত রাতে তাকে জগিং করতে দেখে মায়া অবাকই হয়। সে নিজের গাড়ি গ্যারেজে পার্ক করে এসে তার সাথে দেখা করতে আসে।

“তুমি এখানে? মাত্র এলে না’কি?” জোহান অবাক হয়।
“আমার কথা বাদ দাও, তুমি এত রাতে এখানে জগিং করছো কোন দুঃখে?”
“কয়দিন পর এলবাম রিলিজ হবে, এর আগে ফিট হতে হবে তো। তাই ডায়েট, এক্সারসাইজ সব করছি। টাইম ছিল তাই ভাবলাম করে নেই।”
“টেলেন্ট প্রয়োজন তোমার এলবামের জন্য, ফিট না। হেলদি জীবন তোমার নিজের জন্য হতে হবে, কাওকে দেখানোর জন্য না।”
“ওকে ম্যাম আপনি যেমন বলেন।”
জোহান তার পকেট থেকে চকোলেট বের করে বলে, “তোমার জন্য।”
মায়া হেসে চকোলেটটা নিয়ে বলে, “চকোলেট পকেটে নিয়ে ফিট হবার কথা বলছ?”
“তোমার কোনো কাজ আছে?”
“কেন?”
“এমনি, ছাদে যেতাম।”
“আমার ঘুম আসছিলো। আর আগামীকাল ঘরের কাজে এক জায়গায় যেতে হতো তাই আজ জলদি শুয়ে পড়বো।”
“কোথায় যাবে?”
“আমার এক চাচা আছেন। আজমল চাচা। উনাদের বাড়িতে। আমাকে বিদেশে পাঠানো থেকে শুরু করে সেখানে পড়াশোনার সব খরচ উনি উঠিয়েছিলেন। বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকলেও আমাদের অনেক আদর করেন। গত সাপ্তাহে যাবার কথা ছিলো কিন্তু মালার বিয়ের জন্য যেতে পাড়িনি। আর আজও যাবার কথা ছিলো কিন্তু ডিনারের জন্য যাই নি।”
“কখন যাবে আগামীকাল?”
“বিকেলে।”
“একা?”
“হুম।”
“আমি সাথে যেতে পারি? এই সাপ্তাহ থেকে তো মিউজিক ক্রিয়েটিং, রেকর্ডিং, শুটিং, ফটোশুট সব শুরু। এরপর কোথাও যেতে পাড়ব না।”
“আসো। আমারও একলা এতটা পথ পাড় করতে হবে না। আর তোমাকে দেখে চাচা আর দাদীও অনেক খুশি হবেন।”
“তাহলে ফোন দিও।”
“ওকে তাহলে বাই।”
“টাটা…”
বিদায় দিয়েও মায়া কিছু মুহূর্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। জোহানকে যেতে দেখে নিজে ভেতরে ঢুকে। তার হাতের চকোলেটটা দেখে হাসে। গত এক সাপ্তাহে একদিনও জোহান তার অফিসের টেবিলে তার জন্য চকোলেট রাখতে ভুলে নি। আজ অফিস ছিলো না তাদের, তবুও জোহানের কাছ থেকে সে চকোলেট পেয়ে গেল।

পরদিন বিকেলে জোহান বাহিরে দাঁড়িয়ে তার গাড়ির সাথে অপেক্ষা করছিল মায়ার জন্য। মায়া কলে বলেছিল তার আসতে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট লাগবে। তেমন হয়-ও, সে পাঁচ মিনিটে এসে হাজির হয়। জোহান তাকে দেখে ভ্রু কপালে তুলে বলে, “কী ব্যাপার? আজ সেজেগুজে যাওয়া হচ্ছে?”
“কোথায় সেজেগুজে যাচ্ছি?”
“লাল সেলোয়ার-কামিজ পরেছ, সাথে কাজল ও টিপও দিয়েছ! দ্যাটস নিউ।”
“সেলোয়ার-কামিজ না পরলে সেখানে যেয়ে দাদী দুইঘন্টার জন্য জ্ঞান দিয়ে মাথা খারাপ করে দিতো। যদিও দাদী মানুষকে মনে রাখতে পাড়ে না কিন্তু তবুও এই রিক্স আমি নিতে পাড়ব না।”
জোহান হাসে তার কথায়, “সুন্দর লাগছে। লাল রঙ তোমার উপর মানায়।”
প্রশংসাটা শুনে মায়ার গালটাও খানিক লাল হয়ে আসে।
জোহান বলে, “বসো তাহলে, আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিও।”
“চাবিটা দেও।”
“তুমি গাড়ি চালাবে? তুমি প্যাসেঞ্জার প্রিন্সেস হয়ে আসো আমি গাড়ি চালাচ্ছি।”
“ওহ হ্যালো মিস্টার, প্রথম দিনের কথা ভুলে গেছো? দ্রুত বাইক চালিয়ে তোমাকে সহিসালামত কোম্পানিতে সামনে পৌঁছিয়েছি। তোমার থেকে ভালোই গাড়ি চালাতে পাড়ব আমি। চাবিটা দেও, তুমি প্যাসেঞ্জার প্রিন্স হয়ে বসো আমি তোমাকে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর কাজ করছি।”
“ওকে ম্যাম, যা হুকুম আপনার।” জোহান মায়ার হাতে চাবিটা দিলো।

তারা গাড়িতে উঠে বসে। মায়া গাড়ি চালানো শুরু করে।
জোহান জিজ্ঞেস করে, “তাহলে তোমার কেমন চাচা হয় আজমল সাহেব?”
“তুমি চিনো উনাকে?”
“ম্যাডাম আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি আগে অভিনয়ও করেছি। আজমল সাহেবের সাথে এক দুইবার কাজ হয়েছে। এছাড়াও উনি তো ইনারার চাচা। সে হিসেবেও দেখা হয়েছে।”
“ওহ…”
“তো বললে না তোমার কেমন চাচা হয়?”
“বাবার চাচাতো ভাই।”
“মানে ইনারা তোমার চাচাতো বোন হবে?”
“কাইন্ড অফ।”
“ইনারার বাবাকে অর্থাৎ জনাব ইমতিয়াজ চৌধুরীকে দেখেছ কখনো?”
“আমি কীভাবে দেখব? উনি বহু বছর পূর্বে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।”
“আচ্ছা তোমার বড় বোন এবং ছোট বোন কি সেইম তোমার মতো?”
“মিতু কিছুটা। এখন এর মতো না, কিশোরী বয়সে যেমন ছিলাম তেমন।”
“মানে মারামারিতে ও নেই তো?”
“কী বলছ এসব?”
“না তোমার আর ইনারার মধ্যে একটা মিল আছে তো তাই জিজ্ঞেস করছি। জানার জন্য যে কেবল তোমাদের দুইজনের মধ্যেই এমন মিল আছে না তোমাদের সবার রক্তেই এমন আছে।”
“এমন কী আছে তা তো বলবে?”
“গুন্ডিপণা…দুইজনের রাগ, হুমকি, মাইর দেবার স্টাইল সেইম। কেবল ইনারা হাসিখুশি মেজাজের আর তুমি একটু বেশি ভয়ানক।”
মায়া চোখ ছোট করে তার দিকে তাকায়, “তোমার কি নিজের মুখের নকশা পরিবর্তন করার ইচ্ছা আছে?”
জোহান জোরপূর্বক হাসে, “সরি…”
“গুড।”

গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগে। গাড়ি থেকে নামার আগে মায়া তার মাথায় ওড়না দিচ্ছিল।
“কি করছো?” জোহান জিজ্ঞেস করে।
“দাদি দেখলে… ” জোহান তার কথা কেটে নিজেই বলে, “জ্ঞান দিয়ে মাথা খারাপ করে দিবে?”
মায়া মাথা নাড়ায়। উওর হ্যাঁ।
জোহান তার অসহায়তা দেখে না হেসে পারে না। তারা নেমে দেখে আজমল সাহেব বাগানের প্যাটিওর নিচে বসে আছে। সেখানে বসে গল্প করছেন কারো সাথে। দরজা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই আজমল সাহেবের নজর পড়ে তাদের উপর। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আরে আজকে তো শুভ দিন দেখছি। ঘরের দুইটা মেয়ে একসাথে এলো।”
তখন ইনারাও পেছনে তাকায়। তাদের দুজনকে দেখে একগাল হেসে হাত নাড়ায়। হাই দেয় তাদের।

জোহান তাকে দেখে বলে, “তোমাকে আজকে এখানে এক্সপেক্ট করিনি।”
“তোমাকে এখানে দেখাটা বেশি অবাক করার মতো। তাও…” সে মায়ার দিকে তাকিয়ে বাকিটা বলে, “তাও বিশেষ কারও সাথে।”
“এই সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু, মায়া গতকাল বলল এখানে আসবে তাই ভাবলাম আমিও ঘুরে আসি।” সে আজমল সাহেবকে দেখে সালাম দেয়। সালাম নিয়ে তাকে বসতে বলে আজমল সাহেব। তারপর মায়ার কাছে যেয়ে বলে, “তুই এত শুকিয়ে গেলি কেন? খাবার খাচ্ছিস না ঠিক মতো?”
“এমনি দৌড়াদৌড়ি বেশি হচ্ছে। দাদী কোথায়?”
“তোর দাদী তো রান্নাঘরে।”
“দাদী আর রান্নাঘরে?” বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করে মায়া, “কিন্তু কেন?”
“মিষ্টি কিছু বানাতে গেছে।”
“আর তুমি দিয়েও দিলে? তাও একা? যদি কোনো অঘটন ঘটে?”
“সভ্য আছে তার সাথে। ও বলেছে মা’কে কাজ করতে দিবে না। নিজেই করবে। আর খেয়াল রাখবে। তারপর আমাদের বের করে দিলো।”

“সভ্য এসেছে?” জোহান জিজ্ঞেস করে।
“ওই বাড়ি থেকেই ঘুরে আসলাম।”
“সভ্য রান্না করছে?”
“তুমিও শিখে নেও, নাহলে এই যুগে বউ পাবে না।”
“থাক সিঙ্গেলই ভালো আছি।”
ইনারা মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার কী খবর?”
“ভালো।” তারপর সে আজমল সাহেবকে বলে, “আমি দাদীকে দেখে আসছি।” তারপর সেখান থেকে চলে যায়। আজমল সাহেবও যায় তার সাথে।

ইনারা জোহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ও কী সারাক্ষণ এমনি থাকে? মুখ ওপ করে।” সে মুখ ফুলিয়েও দেখায়।
জোহান হেসে বলে, “নতুন কারো সাথে দেখা হলে একদম এভাবেই থাকে।”
“তাহলে তোমার সাথে ফ্রী হলো কীভাবে?”
“আমার চার্ম থেকে কে বাঁচতে পারে?”
কথাটা শুনে ইনারা মুখ বানালে জোহান সত্যিটা বলে, “ওর লাইফে সবচেয়ে ক্লোজ ওর বন্ধুরা। আর বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব করার পর সময় কাটাতে কাটাতে ফ্রী হয়ে গেছি। নরমালি রাক্ষসীর মতো বিহেভ করলেও মন নরম আছে।”
“তাহলে আমি কিভাবে ফ্রী হবো? ওর বন্ধুদের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট নিতে হবে?”
“আই থিঙ্ক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল কাজ করবে।”
“ওহ…. ওকে। গট ইট।”

কিছুক্ষণের মধ্যে একজন এসে তাদের ভেতরে ডাকে। দেখে সভ্য টেবিলে সবার জন্য কড়াই থেকে বাটিতে গাজরের হালুয়া বাড়ছে। জোহান বলে, “কী ব্যাপার শশুড়বাড়ি এসেও তোর বউয়ের জন্য রান্না করছিস?”
সভ্য জোহানকে দেখে বলে, ” দাদীই করেছে সব। আমি শুধু খেয়াল রেখেছি। আর আমার বউকে চাচার সাথে গল্প করতে পাঠিয়েছি। তোর কী খবর ? আর তোর এলবাম না’কি বের হচ্ছে? প্রিপারেশন ভালোভাবে নিচ্ছিস তো? নিউজটা দেখে অনেক খুশি হয়েছি।” সভ্য যেয়ে জোহানের সাথে গলা মিলে।
“থ্যাংকস ব্রো। তুই সময় বের করিস আবার আগের দিনের মতো পঞ্চসুরের একটি এলবামও বের করব।”

আজমল সাহেব আর হেল্পার রান্নাঘর থেকে আসে রসোগোল্লা, লাড্ডু, পিঠা, চমচম আরও মিষ্টি নিয়ে। সে-ও রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে বলে,”ও কি আর তেমন সময় পাবে? এখন তো আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে যাবে।”
“মানে?” জোহান জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যর দিকে।
এমন সময় সেখানে আসে মায়াও, “দাদীকে আরাম করার জন্য শুইয়ে এসেছি।”
“কী হয়েছে দাদীর? সব ঠিক আছে তো?” ইনারা প্রশ্ন করে।
“দাদী বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না তাই শরীর একটু খারাপ লাগছিল।”
“আমি বলেছিলাম কিছু করতে না। তবুও কথা শুনলো না। আমি যেয়ে দেখে আসছি।”
“উনি ঠিক আছে। যাস্ট আরাম করছে। এত চিন্তার কিছু নেই।” মায়া বসে আবার টেবিলে দেখে মুখ বানিয়ে বলে, “চাচ্চু এত মিষ্টি কেন? আমাকে ডায়বেটিস দেওয়ার প্ল্যান আছে না’কি?”
“মিষ্টি বেশিরভাগ এনেছে সভ্য ও ইনারা খুশির খবর দিতে। আর খুশির খবর শুনে তোর দাদি নিজের হাতে মিষ্টি বানানোর জেদ ধরলো।

জোহান বলে, “এক মিনিট, কী এমন খুশির খবর?”
সভ্য এবং ইনারা একে অপরের দিকে তাকায় তার মুচকি হাসে। জোহান তাদের এভাবে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে তোদের?”
সভ্য বলে, “আমরা তোদের সবাইকে একসাথে আগামী সপ্তাহে বলতাম বাট এখন যেহেতু আছিস তাহলে বলছি।” সে গলা পরিষ্কার করে বলে, “আমরা মা বাবা হতে যাচ্ছি।”
“হোয়াট!” জোহান দ্রুত এসে সভ্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, “তুই বাবা হতে যাচ্ছিস? সিরিয়াসলি? আই কান্ট বিলিভ ইট।” সে আবার সভ্যকে ছেড়ে তার দুই গালে হাত রেখে ভালো করে মুখ দেখে গম্ভীরমুখে বলে, “তুই এত বড় হয়ে গেছিস? কয়দিন আগে না তোকে প্রথমবার আমার ক্লাসে দেখলাম? আমরা একসাথে স্কুল, কলেজ সব কমপ্লিট করে ব্যান্ড তৈরি করলাম। আর তুই এখন বাবাও হয়ে যাচ্ছিস? হোয়াটএভার…তুই বাবা হতে যাচ্ছিস দোস্ত ওয়াও।” বলে আবার জড়িয়ে ধরে তাকে।
সভ্যও তাকে এত খুশি দেখে বলে, “তুইও তো মামা হতে যাচ্ছিস দোস্ত, কনগ্রেটস।”
কথাটা শুনে জোহান তাকে সরিয়ে কাঁধে হাত রেখে গম্ভীরমুখে বলে, “ভাই তুই কী চাস এত খুশিখবর শুনে তোকে একটা জোরে ঘুষি মারি। না, তাইতো? এমন মজা আর করবি না। আংকেল তাও ঠিক আছে এই মামা টামা বলে মাথার স্ক্রু ঢিলা করার দরকার নেই।”

মায়ার তাদের কাণ্ড দেখে হাসি আসছিল। সে হাসি চাপা দেওয়ার জন্য একটি মিষ্টি নেয় খাবার জন্য। তখন ইনারা মুখের সামনে এসে একগাল হাসি নিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। মায়া বুঝতে পারে না প্রথমে, “কী চাই?” জিজ্ঞেস করে সে।
ইনারা তবুও তার দিকে সে হাসিমুখে তাকি থাকে।
মায়া কী করবে বুঝতে পারে না। সে আমি তো আমি তো করে বলে, “অভিনন্দন।” তারপর মিষ্টিটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। ইনারা মিষ্টিতে কামড় দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে, “থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। আমার খুব আফসোস ছিলো আমার কোনো বোন নেই। বোনের মতো বান্ধবী আছে কিন্তু তবুও অর্ধেক জীবন আমার পরিবারের জন্য আফসোস করেছি। আজ তোমাদের সবাইকে আমার এই খুশির দিনে সাথে পেয়ে ভালো লাগছে।”
মায়া এভাবে জড়িয়ে ধরাটা পছন্দ না। তন্নি ও মিতুকে ছাড়া সে কাওকেই জড়িয়ে ধরতে দেয় না। তাই তার একটু অস্বস্তি লাগলেও ইনারার কথা শুনে সে সরিয়ে দেয় না। সে ইনারার জীবনের গল্পটা শুনেছে আজমল চাচার কাছ থেকে। তা ভেবেও সে আবেগী হয়ে যায়। তার সাথে কিছুটা নিজেরও অল্প কিছুটা মিল খুঁজে পায় সে।

ইনারার কোনো পরিবার ছিলো না, আর তার পরিবার থেকেও না থাকার মতোই। তাই সে দ্বিধাবোধ করলেও ইনারার কাঁধে হাত রেখে এবার মন থেকে বলে, “মা হবার অভিনন্দন রইল।”

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারার কোনো পরিবার ছিলো না, আর তার পরিবার থেকেও না থাকার মতোই। তাই সে দ্বিধাবোধ করলেও ইনারার কাঁধে হাত রেখে এবার মন থেকে বলে, “মা হবার অভিনন্দন রইল।”

মায়ার কথা শুনে ইনারা খুশি হয়। সে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জোহানকে ইশারা দেয়। কাজ হয়ে গেছে। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে থ্যাঙ্কিউ জানায়। জোহান তার জবাবে মাথা নাড়ায়। সভ্য এসব দেখে কিছুই বুঝতে পাড়ছিল না। সে জোহানকে জিজ্ঞেস করে, “কী হচ্ছে এসব?”
“তেমন কিছু না। যাস্ট ইনারা জিজ্ঞেস করছিল মায়ার সাথে কীভাবে বন্ডিং তৈরি করবে তো আমি বললাম ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে। ইজি পিজি।”
“তোরা একেকটা আইটাম আমার কপালে পড়ছিস।”
“বাট দোস্ত আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তুই বাবা হতে যাচ্ছিস। এতটুকু একটা পুচকু বা পুচকি আসবে আর ওকে নিয়ে গিয়ে আমাদের ছোটবেলার মতো সারাদিন ফুটবল খেলব, ক্রিকেট খেলব, গান শিখাব, আর তুই মজার মজা রান্না করবি আমরা খাব।”
মায়া জিজ্ঞেস করে, “আর পড়া?”
“ওসব বোরিং জিনিস না করলেও সমস্যা নেই।”
“তোমার সাথে তো ছাড়াই যাবে না, নাহলে একদম নিজের মতো করে ফেলবে।”
“আমার মতোই তো হওয়া দরকার,” সে নিজের জ্যাকেট ঠিক করে বলে, “আমার মতো হলে আশেপাশের সবাই-ই ক্রাশ খেতে থাকবে। তোমারও তো ক্রাশ ছিলাম তাই না?”
কথাটা শুনে মায়ার গাল লাল হয়ে গেল। সে আমতা-আমতা করে বলে, “ত…তোমাকে না বলেছি সেটা ছোটবেলার কথা? তখন আমার চয়েজ খারাপ ছিল। এছাড়া কিছুই না।”
জোহান এসে তার পাশে বসে বলে, “তোমার চয়েজ তখন খারাপ ছিল না, এখন খারাপ হয়ে গেছে।” সে সভ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, “জানিস ওর গানের গলা এত সুন্দর অথচ গান গাইতেই রাজি না।”
“তাই?” সভ্য মায়াকে প্রশ্ন করে।
উওরটা দেয় জোহান, “তো আর কি বলছি? রাঙামাটিতে ওর গান দুইবার শুনেছি আর ব্রো টাস্ট মি ওইটা বেস্ট সময় ছিলো রাঙামাটির ট্রিপের। আর রাঙামাটির ট্রিপটা বিগত কয়বছরের বেস্ট সময় ছিলো আমার জন্য। আর জানিস ওখানে কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
“যে ছেলের বিয়ে ছিলো তাকে যে ধোলাই দিয়েছে মায়া।”
“কেন?” ইনারা মায়াকে জিজ্ঞেস করে।
মায়া এবার নিজেই উওর দেয়, “নিজের বিয়েতে আমার উপরে লাইন মারছিল। এর উপর টাকার জন্য বিয়ে করছিল মালাকে। মালা আমার ফ্রেন্ডের বোন। যে উওর মধ্যম দিয়েছি এরপর আর কারো দিকে খারাপ নজরে তাকাবেও না।”
সভ্য সবার হাতে গাজরের হালুয়ার বাটি দিয়ে নিজেও একটা নেয়। মায়ার কথা শুনে বলে, “তোমরা আসলেই বোন। দুই তিনমাস আগে এই ম্যাডাম একজনের অফিসে ঢুকে তার নাক ফাটিয়ে দিয়েছে।”
“তো মারবো না? আমার বান্ধবীকে চিট করেছে।”
“গ্রেট জব।” মায়া তাকে বাহবা দেয়।
জোহান বলে, “আমিও আসার সময় তাই বলছিলাম দুইজনে গুন্ডিপণায় সেইম।”
মায়া তার দিকে ফিরে তাকায় সরু চোখে, “আমি তাও যতটুকু মেরেছি। তারপর যে এক ঘুষি মেরেছ তাতে ওর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল।”
“ও ডিসার্ভ করতো। তোমাকে খারাপভাবে ধরার সাহস কোথায় পেল ও। আমি তো আরও মারতাম কিন্তু তুমি আটকালে আর তুমি আমাকেই উল্টো বকা দিলে।
“আবার এক কথা, আমি তো তোমার কথাই চিন্তা করছিলাম। ভাগ্য যে ওই ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়ে গেছে। কথাটা পাব্লিক জানলে তোমার কত সমস্যা হতো।”

তাদের এমন কথাবার্তা শুনে সভ্য এবং ইনারা একে অপরের দিকে তাকায়। ইশারায় কিছু কথা আদান প্রদান করে। খুব কষ্টে নিজের হাসি চাপা দেয়।

তাদের কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপর রওনা দেয় তারা নিজ বাসার উদ্দেশ্যে।
.
.
একমাস পর,
সূর্যের মিষ্টি রোদ্দুর জানালার ফাঁক দিয়ে রুমে প্রবেশ করার পর ঘুম ভাঙে সুরভির। সকালে উঠে নামাজ পড়ে কিছু চা বানিয়ে এসে বসে টিভির সামনে। সকালের নিউজে দেখে সে ধর্ষণের কেইসের ছেলেদের মধ্যে আরেকজনও হাস্পাতালে ভর্তি। তার উপর এসিড দিয়ে এট্যাক হয়েছে। তার ছবি দেখে রুহ কেঁপে উঠে সুরভির। তার মাথা, মুখ থেকে গলার নিচ পর্যন্ত শরীরের সব গলে গেছে। সে সাথে সাথে টিভি বন্ধ করে দেয়। ভেবে পায় না হঠাৎ করে একের পর এক ছেলের সাথে কীভাবে এমনটা হচ্ছে? আর ছেলেটার সাথে এমন কিছু করার সাহস কার হলো? রিফাদ ছেলেটা একজন নামকরা উকিলের ছেলে। তার নামে এর পূর্বেই কেইস দাখিল করা হয়েছে কিন্তু কখনো তার কিছু হয় নি। আর এর কোনো প্রমাণ নেই তাও কীভাবে সম্ভব? তাইফার সাথে সুরভিও রিফাদের অতীত সম্পর্কে ঘেটেছে। তার প্রথম কেইস ছিলো যখন সে একটি মেয়ের মুখে এসিড নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু খুব সহজেই সে মুক্তি পেয়ে যায়। অবশ্যই তার বাবা তাকে দুইদিনের বেশি জেলে থাকতে দেন নি। সে বেশিক্ষণ টিভি অন না রেখে অফিসের জন্য তৈরি হতে শুরু করে।

সে অবশেষে নতুন অফিসে জয়েন করেছে দুইসাপ্তাহ হলো। সে সকালে তৈরি হচ্ছিল অফিসে যাবার জন্য। তার মা খাবারের জন্য ডাকছিল বারেবারে। ঘড়ি নেওয়ার জন্য ড্রয়ের খুললে সেখানে শুকনো বেলিফুলের দেখা পায়। তার মনে পড়ে সেই রাতের কথা যখন অভ্র তার বেণি এবং হাতের রিং-এ ফুল গুঁজে দিয়েছিল। কথাটা মনে পড়ে তার মেজাজও খারাপ হয় তার। মাঝখানে প্রায় প্রতিদিন ফোন দিয়ে তাকে বিরক্ত করলেও বিগত চারদিন ধরে অভ্রর কোনো খোঁজই নেই। একটিবারও ফোন দেয় নি এই কয়দিনের মধ্যে। সে অভ্রর কথা মাথা থেকে ঝরিয়ে বাসার থেকে বের হয়ে গেল নাস্তা খাওয়া ছাড়াই। নাস্তা খেতে গেলে তার আবার দেরি হয়ে যাবে।

সে বের হয়ে রিকশায় উঠতেই কল আসে অভ্রর। প্রথমে সে কল কেটে দেয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার অভ্র কল দেওয়ায় কলটা ধরে সে। কিন্তু কিছুই বলে না।
অভ্র জিজ্ঞেস করে, “দ্বিতীয়বার কল ধরতে হলে প্রথমবার কাটলে কেন?”
“আমার ফোন, আমার ইচ্ছা। আমি যা ইচ্ছা তাই করব।”
“কিন্তু তুমি তো আমার বাগদত্তা।”
“দেখুন মিস্টার অভদ্র এসব কথা আমাকে বলতে আসবেন না। আমি আপনার কেউ হই না। এসবই তো নাটক।”
“তাহলে আমি কল না দেবার কারণে তোমার মেজাজ খারাপ কেন? অভিমান করেছ বুঝি?”
“আ…আমি আপনার উপর অভিমান ক…করব কোন দু:খে?”
“তুমি মিথ্যেটাও ভালোভাবে বলতে পারো না তাহলে বলো কোন দু:খে শুনি?”
সুরভি কিছু বলে না। অভ্র নিজ থেকেই বলে, “সকালে কিছু খেয়েছ?”
“অফিসে যেয়ে কিছু খেয়ে নিব।”
“আমার বাসা তো তোমার অফিসের রাস্তায় পড়ে চলে এসো, আমি বানিয়ে খাওয়াচ্ছি।”
“বহু সময় আছে দেখছি আপনার কাছে। কাজটাজ বাদ দিয়েছেন না’কি?”
“তোমার জন্য সময় আছে।”
সুরভি ভেংচি কেটে বলে, “একারণেই তো গত চারদিনে একবার কলও দেন নি।” কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে সে। তারপর নিজের কপালে হাত রাখে।
অভ্র হেসে বলে, তাহলে মিস সুরভি আসলেই অভিমান করেছিল।”
“আমার অফিস এসে পড়েছে। রাখছি।”
“ট্রেনের শব্দ আসছে মানে অর্ধেক রাস্তাও যাও নি। এখনো তোমার বাসার কাছে।”
“আপনার এতদিকে ধ্যান থাকে?”
“কিছু মানুষের সবদিকে ধ্যান রাখতে হয়। তাকে নিখুঁতভাবে দেখতে হয়, তার হাসির কারণ হতে হয়, তার দু:খের কারণ জানতে হয়, দূর থেকে হলেও তা…তার খেয়াল রাখতে হয়।”
“বাহ আপনি দেখি কাব্যও শিখে যাচ্ছেন! দুইদিন পর কবি হয়ে যাবেন।”
অভ্র হাসে। সুরভি বলে, “আচ্ছা শুনেন আমার এখন আসলেই ফোন কাটতে হবে। রাস্তায় একটু কাজ আছে।কিছু কাগজ ফটোকপি করতে হবে।”
“আচ্ছা তাহলে রাতে আবার কল দিব। বেশি অপেক্ষা করাব না।”
“এভাবে বলছেন যেন আপনার সাথে কথা না হলে আমার জান বেরিয়ে যায়। রাখছি।”
সে কল কেটে রিকশা থেকে নামে তার কাজের জন্য।

অফিসে যাবার পরই তাকে ডাক পড়ে। সিনিয়রের কেবিনে যাবার পর সে জানতে পারে জনাব তৌফিক আসছে দুইদিন পর তাদের অফিসে ইন্টারভিউ এর জন্য। সে অবাক হয় কথাটা শুনে। কারণ জনাব তৌফিক সহজে টিভিতে আসেন না। তবুও সে কথা না বাড়িয়ে নিজের ডেস্কে এসে বসে। কাজের মাঝখানে তার অভ্রর কথা মনে পড়ে। তার আজকের কথাটা মনে ধরেছে সুরভির। সে একাই হাসে। হঠাৎ তার আরেকটা জিনিস মনে পড়ে। এমন কথা সে আগেও শুনেছে বা পড়েছে। সে ফেসবুকের এক পেইজে ঢুকে, sky town-নক্ষত্র। এটা নক্ষত্রের বাংলা পেইজ ছিলো এককালে। এই পেইজেই সর্বপ্রথম কথা হয় তার নক্ষত্রের সাথে। এর পূর্বে সে ওয়েবসাইটে কেবল ইংরেজিতে লেখা দিতো। সে তখন সবসময়ই তা পড়তো। কিন্তু এই পেইজের দ্বারাই সে জানতে পারে sky town বাঙালি। তারপর সে এমনিতেই মেসেজ দিয়েছিল পেইজে। তিনমাস পর রিপ্লাই আসে। তারপর থেকে তাদের প্রতিনিয়ত কথা হতো। একসময় ভালো অনলাইন বন্ধুত্ব হয়ে উঠে তার নক্ষত্রের সাথে। আর আজ তিন বছর ধরে এই পেইজটি ফাঁকা। সে পেইজে খোঁজার কিছুক্ষণের মধ্যেই কথাটা পায়,
“প্রিয় মানুষের সবদিকে ধ্যান রাখতে হয়। তাকে নিখুঁতভাবে দেখতে হয়, তার হাসির কারণ হতে হয়, তার দু:খের কারণ জানতে হয়, দূর থেকে হলেও তাকে ভালোবাসতে হয়। আমি ভালোবাসা কাকে বলে জানি না, কিন্তু আমি আমার প্রিয় মানুষটার স্থানে অন্যকাওকে রাখতে পারি না।”
লেখাটা দেখে সুরভির মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভেবেছিল অভ্র কথাটা নিজের মন থেকে বলেছে। কিন্তু সে তো তার বন্ধুর কথাটাই নকল করে বলে দিলো।

সুরভি হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে তার আগের পোস্টটা পড়ে,
“আজ একটি শুভ্রকন্যার দেখা পেলাম। শুভ্ররঙে তার ঝলক থেকে চোখ সরাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল এই মনটার। তার আশেপাশে যেন বেলীফুলের সুগন্ধি ম ম করছিল। ওকে প্রথম দেখি আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছিল। মনে হচ্ছে তার প্রেমে পড়ে গেছি। কিন্তু বুঝতে পাড়ছিলাম না, এটা কি প্রথম দেখার প্রেম না’কি এতগুলো বছর রাত জেগে কথা বলার প্রেম।”

সুরভি পুরনো কথাগুলো পড়ে হাসে। তারপর তার ইনবক্সে যায়। তাকে ছয়মাসেই হাজারটা মেসেজ করেছিল সে। একটারও উওর পায় নি। তারপর আড়াই বছর ধরে কোনো মেসেজই দেয় নি সে। আজ দিলো, তবে সোজা কোনো কিছু লেখে নি। লিখেছে,
” আমি জানি অভদ্র আপনার খুব কাছের বন্ধু। আপনার সাথে যখন দেখা হয়েছে তখন কী আপনি উনার এত প্রশংসা করেছিলেন? উনি তো এত প্রশংসার যোগ্য না।”
.
.
জোহানের এলবামের কাজ চলছে। তার রেকর্ডিং চলছে কয়দিন ধরে। আজও রেকর্ডিং হবার সময় মায়া আসে। তাকে দেখে জোহান গান বন্ধ করে দেয়। কম্পোজার উঠে দাঁড়ায়।
“ম্যাম আপনার কাজ আছে বললে আমিই এসে পড়তাম। আপনি কষ্ট করে এলেন কেন?”
“আপনারা কি কাজ করছেন তা দেখতে হবে না?”
“আপনি তো রেকর্ডিং হবার পর সব দেখেন ম্যাম। রেকর্ডিং শেষ করে আপনাকে দুইদিন পরই শুনাতাম।”
“এই এলবামটা তো আমাদের কোম্পানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি নিজে এসেছি।” সে কাঁচের গ্লাসের ওপাড়ে তাকিয়ে জোহানকে ইশারায় গান শুরু করতে বলে। মায়া হেডফোন কানে দিয়ে প্রথমটুকু শুনে তারপর জোহানকে থামিয়ে তার কাছে ভেতরে যায়। বলে, “আমার মনে হচ্ছে তোমার ভারী কন্ঠ এই গানে ভালো লাগবে। আর কোরাসে হাইনোট দিলে মানাবে। সো চেঞ্জ করো। আজ এটা রেকর্ড না হলেও চেঞ্জ করো।”
“ওহ…ওকে ম্যাম। যা আপনার হুকুম। ফুল অন বস মোডে আছেন দেখছি।”
“এটা আমার কাজ। আমি আমার কাজের সাথে কম্প্রোমাইজ করি না। আচ্ছা তোমার মেইন গানের জন্য একজন ফিমেইল সিঙ্গার লাগবে তো। তুমি বলেছিলে তোমাকে একজন পরিচিত আছে তুমি তাকে নিতে চাও। সে কোথায়? গতকালই তোমার প্রধান গানটা রেকর্ড হবার কথা ছিলো। আমার রুটিনের বাহিরে কাজ একটুও পছন্দ না।”
“রিলেক্স মায়া। এত হাইপার হবার কিছু নেই। সময়ে সব শেষ হবে।”
মায়া মাথা নাড়ায় তারপর বলে, “দুপুর হয়েছ। লাঞ্চব্রেক নিয়ে নেও।”
তারা কাঁচের দেয়ালের বাহিরে বের হবার পর মায়া সবাইকে জানায়, “আমি সবার জন্য বাহির থেকে লাঞ্চ এবং কফি আনিয়েছি। এখন এসে পড়বে। খেয়ে তারপর কাজ করো।”
তারপর সে যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে নেয়। মায়া পিছনে তাকায়, “কী হয়েছে?”
“তুমিও আমাদের সাথে লাঞ্চ করো।”
“আমি? আমার জন্য আনাই নি।”
“কিন্তু আমি তো এনেছি। মা দিয়েছিল। আই থিংক তোমার ওটা বেশি ভালো লাগবে।”
মায়া মৃদু হাসে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবার জন্য খাবার আসলে সেও বসে সবার সাথে। জোহান মায়াকে তার মা’য়ের হাতের খাবার দেয়। সে জানে মায়ার ঘরের খাবারই বেশি ভালো লাগবে। সে বেশিরভাগই বাহিরের খাবার খায়, তাই ঘরের খাবারের মূল্য তার কাছেই সবচেয়ে বেশি হবে। এছাড়া তার মা’য়ের হাতের খাবার তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। বিশেষ করে মিষ্টি খাবারগুলো। তাই সে তার টিফিনবক্স খুলে মায়ার সামনে দেয়। কেবল সি-ফুড বাদে। তার সি-ফুড থেকে এলার্জি। তারপর সব কর্মীদের সাথে কথা বলতে শুরু করে। মায়া খেয়াল করে এখানে সবারই কথা বলার মতো কেউ আছে। সবাই খাওয়ার সাথে গল্প করছে। কিন্তু এখানে তার পরিচিত কেবল জোহান। কিন্তু সে-ও অন্যদের সাথে কথা বলছে। তার দিকে ধ্যানই নেই। যদি অন্যদের সাথেই কথা বলতে হয় তাহলে তাকে থামাল কেন এখানে? সে বিরক্তি নিয়ে খাওয়া শুরু করে। দেখতে পায় জোহান তার খাবার থেকে মরিচগুলো সরিয়ে রাখে। মায়ার ঝাল তেমন একটা পছন্দ না। কথার মাঝেই তার বাহির থেকে আসা খাবার থেকে চিকেন কারি মায়ার খাবারের সাথে রেখে দেয়। তার চিকেন কারি পছন্দ। সে তাকায় জোহানের দিকে। মুচকি হাসে। জোহানের দৃষ্টিও তার দিকে নেই অথচ সে এতকিছুর খেয়াল রাখছে? মায়ার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটালে তার গাল দুটোয় গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ে।

খাওয়ার সময় একটি মেয়ে ঢুকে তাদের রুমে। জোহান তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। আর মেয়েটি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। জোহানও হাত রাখে তার পিঠে। দৃশ্যটা দেখে মায়ার বিশেষ ভালো লাগে না।
মেয়েটি গায়িকা রিসা। কিছু বছর আগেও তার জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়ার পর্যায়ে ছিলো। তখন কেবল জোহান ও রিসার সম্পর্কের কথা ছড়িয়ে ছিলো সব স্থানে।
রিসা জোহানকে ছেড়ে বলল, “এত মাস পর দেখা হলো। কী খবর তোমার?”
“এইত্তো এলবামের টেনশনে ভুগছিলাম। এখন তুমি এসে পড়েছ তাহলে টেনশন ফ্রী হতে পাড়ব। তোমার এডভাইস বেস্ট হয়। ওরা আমাদের সাথে গানে কাজ করছে। মিস মায়ার সাথে দেখা করো৷ আমাদের বস।”
রিসা মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাই।”
“হ্যালো।” মায়াও উওর দেয়।
একজন স্টাফ বলে, “রিসা আপনার একটা অটোগ্রাফ পাওয়া যাবে? আমরা আপনার ফ্যান।”
“আমি তো এখন তোমাদের সাথেই আছি। অটোগ্রাফ ফটোগ্রাফ সব নেওয়ার সময় পাবে।” সে জোহানের পাশেই বসে পড়ে।
জোহান জিজ্ঞেস করে, “লাঞ্চ করেছ? তোমার জন্য অর্ডার দেই?”
“আমি খেয়ে এসেছি। আর খেলেও তোমার প্লেট দেখে এক দুই বাইট দেখে পারি।”
মায়া তাদের এভাবে দেখে মুখ বানায়। তাদের দিকে মাথা না ঘামানোর চেষ্টা করলেও তাদেরকে এতটা কাছে দেখে তার খাওয়ার মন মরে যায়।

রেকর্ডিং সময় আসলে জোহানের গানের সময় সে রিসাকে নিয়ে ভেতরে যায় যেন তার গান শুনে কোথায় ইম্প্রুভ করলে ভালো হবে বলতে পারে। তারা যাবার পর
সেখানের এক স্টাফ বলে উঠে, “গায়িকা রিসার সাথে জোহানের প্রায় একবছর সম্পর্কে ছিলো না?”
আরেকজন তখন উওর দেয়, “আমি তো এটা শুনেছিলাম যে ওরা বিয়ের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিল কিন্তু তারপর আর কিছুই হয় নি। সবাই ভেবেছিল এটাও গুজব। জোহান যখন নিজে বলছে রিসা ওর এক্স-গার্ল্ফ্রেন্ড তখন কিছু একটা তো ছিল দুজনের মধ্যে।”
কথাগুলো শুনে মায়ার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে উঠে যেতে নিলে কম্পোজার বলে, “ম্যাম গান…”
” কাজ শেষ হলে রুমে পাঠিয়ে দিও। আমার আরও কাজ আছে।”
সে বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

রুমে চেয়ে দেখে তার ফোনে ইনারার কতগুলো কল এসেছিল। তার মেজাজ ভালো ছিলো না বলে সে ফিরে কল দেয় না কিন্তু ইনারার কল আবারও আসে। এবার সে কল ধরে। ফোনের ওপাড় থেকে ইনারা বলে, “কতবার কল দিলাম। কল ধরছিলে না যে? আমি তো ভেবেছি তুমি আমার নাম্বারই সেইভ করো নি।”
“তুমি সেদিন নিজে আমার ফোন নিয়ে নাম্বার সেইভ করে দিয়েছিলে।”
“ওহ হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা শুনো আজ রাতে ফ্রী আছো?”
“না।”
“কি কারণে বলছি তা তো শুনো। হয়েছে কি সভ্যর আজ সন্ধ্যায় যেতে হবে জাপানে। মিটিং আছে। আমি বাবুসহ একা থাকব কী করে?”
“তোমার কাছের বান্ধবী আছে না একজন?”
“ওর কাজ আছে।”
“তোমার শশুড়বাড়ির…” তার কথা পূর্ণ হবার আগেই ইনারা বলে, “সবাই ঢাকার বাহিরে আসতে সময় লাগবে।”
মায়া তার কাজ থামিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে, “সভ্য কখন যাবে?”
“ফ্লাইট রাত দশটায়। আগে দিয়ে বের হবে।”
“আমি কাজ শেষে দ্রুত এসে পড়বো।”
“ইয়েএএ… আমরা দুইবোন মিলে অনেক মজা করব। আচ্ছা তাহলে রাখি, তুমি এসো কিন্তু। আর জোহানকে আমার পক্ষ থেকে হ্যালো বলো।”
জোহানের নাম শুনে মায়ার আরো খারাপ হয়, “সে তার পুরাতন বান্ধবীর সাথে অতিরিক্ত ব্যস্ত।” বলে সে কল কেটে দেয়।

ইনারা কল রেখে তার পাশে বসা সভ্যর দিকে তাকায়, “মিশন সাকসেসফুল।”
“কি ড্রামাবাজ তুমি! আমি তো মা’কে বলেই রেখেছিলাম। আজ মিটিং আছে যেতে হবে। কিন্তু তুমি নিজেই মানা করলে। মায়া কী ভাববে আমি কত খারাপ হাসবেন্ড। বেবিসহ তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি। আগে থেকে কাওকে বলিও নি। কতটা দায়িত্বহীন আমি।”
ইনারা তার দিকে তাকায়। তার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে দুইগালে হাত রেখে বলে, “কারো ভালো করার জন্য ভিলেন হতে হলেও ব্যাপারটা মন্দ না।”
সভ্য ছোট চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ করে তার ঠোঁটে ছোট একটা চুমু দিলো।
“যাহ দুষ্টু!” ইনারা বলে তার বুকে মথা রেখে বলে, “আমি খুব মিস করব তোমায়।”
“চিন্তা করো না, মিটিং শেষ হতেই আমি ফ্লাইট নিয়ে এসে পড়বো।”
“আরে না রেস্ট করে এসো। এমনিতেই দেরিতে ফ্লাইট বুক করেছ যেন আমার সাথে থাকতে পারো। তোমার এখনই জাপানে থাকার কথা ছিলো। বেশি দৌড়াদৌড়ি করলে অসুস্থ হয়ে যাবে।”
“কিছু হবে না। আচ্ছা আমি রান্না করে রেখেছি। বাহির থেকে উল্টাপাল্টা কিছু অর্ডার করে খাবে না ওকে? আর টাইমে মেডিসিন নিবে। আমি ডাইনিং টেবিলে মেডিসিন রেখেছি খাবারের পাশেই। আর…”
“আরে আমি নিজের খেয়াল রাখতে পাড়ব। হুদাই প্যারা নিও না তো। যেয়ে নিজের প্যাকিং শেষ করো।”
“তাই করি, দেরি হয়ে যাবে নাহলে।”
সভ্য যেতে নিলে ইনারা তার শার্টের কলার ধরে নেয়। সভ্য তার দিকে তাকায় জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে।
“আই লাভ ইউ।” ইনারা বাচ্চামো মুখ করে বলে।
সভ্য হাসে। তার কপালে চুমু খেয়ে বলে, “আই লাভ ইউ মোর।”
.
.
মায়া আজ আগে দিয়ে অফিস থেকে বের হয়। যেহেতু ইনারার বাসায় যেতে হবে তাই সে ভাবছে বাচ্চার জন্য কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে যাবে। সে অফিস থেকে বের হলে দেখে জোহান ও রিসাকে। জোহান জিজ্ঞেস করে, “আজ এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাচ্ছো?”
মায়ার নজর প্রথমেই পড়ে তার হাতের উপর। রিসা তার কণুইয়ে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। নিজের অজান্তে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে জোহানের দিকে তাকিয়েই নজর সরিয়ে নেয়, “ইনারার বাসায় যাচ্ছি।”
“ইনারার বাসায়?”
“ওই তোমার বন্ধু দেশের বাহিরে যাচ্ছে। ও একা তাই…”
“বাহ তোমরা এত ক্লোজ হয়ে গেছ জানতাম না। ভালোই। তো তুমি তো একা যেতে পাড়বে না। আমি নিয়ে যাই।”
“প্রয়োজন নেই। তুমি নিশ্চয়ই ব্যস্ত।”
সে যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে নেয়, “বাকি কাজ আগামীকাল করে নিব। সমস্যা নেই।”
তখন রিসা বলে, “পড়ে দেরি হয়ে যাবে জোহান। আমাদের ডিনার করতে আবার রেকর্ডিং করতে হবে।”
মায়া বলে, “আমি ম্যাপ দেখে চলে যাব। ইনারা আমাকে লোকেশন পাঠিয়েছে।”
জোহান ভেবে আবারও মায়াকে বলে, “তাহলে ডিনার করে আসি চলো। তারপর তুমি সেখান থেকে চলে যেও।”
মায়া ভেবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
জোহান হাসিমুখে বলে, “গ্রেট তাহলে আজকের ডিনার আমার পক্ষ থেকে।”

তারা পাশের এক রেস্টুরেন্টেই যায় খাবারের জন্য। ওয়েটার আসলে জোহান তার সাথে মায়া ও রিসা দুইজনের জন্যই অর্ডার দেয়।
রিসা তার গালে হাত রেখে বলে, “এত বছর পরও আমার ফেভারিট ডিস মনে রেখেছ? ইম্প্রেসিভ।”
তারা দুইজন যখন কথা বলছিল তখন মায়া চোখ ঘুরিয়ে বিরক্তি নিয়ে মোবাইলে কিছু খোঁজ করে। সে ধ্যান সহকারে পড়ছিলো।
হঠাৎ করে জোহান তার পাশে এসে বসে, “এত ধ্যান সহকারে কি দেখছ দেখি।”
তারপর তার ফোনে উঁকি মারে। মায়া হঠাৎ তাকে এত কাছে দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়। তার বুকের স্পন্দন আবারও বাড়ে। তার দিকে তাকিয়ে থাকে বেহায়ার মতো কিছু মুহূর্ত ধরে। কিন্তু যখনই জোহান তার দিকে তাকায় সে চোখ সরিয়ে নেয়।
“তুমি বাচ্চাদের নিয়ে এতকিছু দেখছ কেন?” জোহান প্রশ্ন করে।
“হঁ?”
“বাচ্চাদের নিয়ে এত রিসার্চ কেন?”
“ওহ,” সে একটু সরে যায় অন্যপাশে, “ইনারার বাসায় যাব তো। ভাবছি বাবুর জন্য কিছু জামাকাপড় নিয়ে যাই।”
“ইনারা সবে দুই তিনমাসের প্রেগন্যান্ট। তুমি এখনই বেবিক্লোথ নিয়ে কি করবে?”
“যত যাই হোক আমি ফার্স্ট টাইম আন্টি হবো তাহলে ওর জন্য ফার্স্ট গিফট তো আমিই কিনবো।”
“সে হিসেবে তো তাহলে তুমি মা হলে পুরো বেবিস্টোর কিনে ফেলবে।”
মায়া তখন কিছু বলে না। তার গাল দুটো কেবল গোলাপি হয়ে যায়।

রিসা জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের মধ্যে কি কিছু চলছে?”
“পাগল না’কি? একদম না। আমরা তো কেবল ফ্রেন্ড।” জোহান মায়ার কাঁধে হাত রেখে বলে। মায়া তখন একবার তাকায় জোহানের দিকে আবার তার কাঁধের দিকে।
রিসা তখন বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, “যাক তোমাদের দেখতে পুরো কাপল লাগছিল। ভাগ্যিস কিছু নেই। মানে আমার এখনো চান্স আছে।”
জোহান হেসে মায়ার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে টেবিলের উপর হাত রেখে রিসার কথার উওর দেয়, “আমি এখন ভালো হয়ে গেছি। আগের মতো টাইমপাসে নেই।”
“তাহলে তো আরও ভালো। এত হ্যান্ডসাম ছেলেকে ফুল লাইফের জন্য নিজের নামে করতে পাড়ব।”
জোহান তার কথা হাসিতে উড়িয়ে দেয়।

এতক্ষণে খাবার এসে পড়েছে। সবাই খাচ্ছিল। খাওয়ার সময় মায়ার ঠোঁটের কোণে খাবার লেগে যাওয়ায় জোহান তার বুড়ো আঙুল দিয়ে তা পরিষ্কার করে দেয়। তার আঙুলের ছোঁয়া ঠোঁটে লাগতেই কেঁপে উঠে মায়া। তার বুকের ভেতর আবারও ধুকপুক হতে শুরু করে।
রিসা বলে, “জোহান আমার জন্য একটু কোল্ড ড্রিংক নিয়ে আসবে?”
জোহান মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কিছু লাগবে?”
মাথা নাড়িয়ে না করে। জোহান উঠে যায় কাউন্টারে। রিসা মায়াকে বলে, “আচ্ছা মায়া আমার কন্টেন্ট শেষ হবে এই বছরেই। আমি কি তোমাদের কোম্পানিতে যুক্ত হতে পারব না’কি জানিও তো। আসলেই একটু আমার ভাগ্য আবার ট্রাই করতে চাই।” সে জোহানকে দেখে কথাটা বলে। মায়ার কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলে বলে, “ঠিকাছে জানাব।”

“এই’যে আপনার কোল্ড ড্রিংক ম্যাম।” জোহান রিসাকে গ্লাস দিয়ে বলে। রিসা তার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বলল, “এটা খেয়ে দেখো অনেক টেস্টি।”
সে জোহানকে নিজের চামচ দিয়েই খাইয়ে দেয়। মায়ার তখন ভীষণ রাগ উঠে। রাঙামাটির দিকে যাবার সময় তো জোহান তার হাতে খাবার খাওয়ার জন্য এত বাহানা করেছে আর এখন চুপচাপ খেয়ে নিলো। সে উঠে দাঁড়ায়, “আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। থ্যাঙ্কিউ ট্রিটের জন্য। আমি আসি ইনারা হয়তো বাসায় একা।”
জোহানও উঠতে দেয়, “আমি এগিয়ে দিয়ে আসছি।”
“প্রয়োজন নেই আমি যেতে পাড়ব।” সে নিজের ব্যাগ নিয়ে রওনা দেবার পূর্বে জোহানকে বলে, “ইনারা তোমাকে হ্যালো বলতে বলেছিল।”
বলে সে চলে যায়। পিছনেও তাকায় না আর।

হনহনিয়ে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে এসে বসার পর গাড়ির স্টিয়ারিং এ কতগুলো মারে নিজের রাগ কমানোর জন্য।
তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে। তার জোহানের উপর ভীষণ রাগ উঠছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিল না তার এমন কেন লাগছে। সে নিজেই নিজেকে বলে, “জোহান অন্যকারো সাথে হেসে কথা বলুন, তার হাতে খাবার খাক বা প্রেম করুক, আমার কী? আমার মেজাজ কেন খারাপ হচ্ছে? রাগ কেন উঠছে? কী হলো আমার? আমার কী মাথার কোনো সমস্যা হয়েছে না মনের? আমি তো কিছুই বুঝতে পাড়ছি না।”

চলবে…