অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
আজ জন্মদিন জোহানের। সাথে তার এলবামও রিলিজ হয়েছে। আর রিলিজের প্রথমদিনই ভাবনার বেশি ভালো করেছে। সকাল থেকে ইন্টারভিউ এবং ফ্যানসাইনিং এ তার দিন কেটে গেল। অফিসে তাকে মায়া ছাড়া সবাই উইশ করেছে। সাথে ফ্যানদের অনেক উইশ এবং উপহার পেয়েছে সে। কিন্তু তার কোনো বন্ধু একবারও তাকে উইশ করল না। এমনকি তার মা’ও দুপুরে কল করে তাকে জানাল যে সে যাচ্ছে ঐশির বাসায়। তার একটু কাজ আছে। রান্না করে সে খাবার ফ্রিজে রেখে যাচ্ছে। আসলে খেয়ে নিতে।
তার খারাপ লাগছিল। তার জীবনের কাছের মানুষগুলোই তার জন্মদিনের কথা মনে রাখে নি ভেবে। সে ইন্টারভিউ শেষে দুপুরে মায়ার কেবিনেও যায়। সেখানেও সে ছিলো না। সে কাজে গিয়েছে না’কি!
সে বিরক্ত হয়ে আবারও কাজে ফিরে যায়। কাজ শেষে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে। দরজা খুলতে যেয়ে দেখে তালা লাগানো। তার মনে পড়ে আজ বাসায় কেউ নেই। সে তার চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। অন্ধকার দেখে উদাসী মনে সুইচ অন করে। বাতি জ্বলতেই সে পিছনে ফিরে দেখতে পায় তার সকল বন্ধু বান্ধব ও তার মা’কে। সে সবাইকে দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অবাক স্বরে বলে, “তোমরা সবাই এখানে?”
আর সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠে, “স্যারপ্রাইজ…”
সামি আর সভ্য দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। সভ্য বলে, “হ্যাপি বার্থডে ভাই…”
“কনগ্রেটস ভাই, তোর কামব্যাক তো সারাদেশে উৎসব লাগিয়ে দিলো। সবদিকে তোরই কথা হচ্ছে। প্রাউড অফ ইউ।”
সভ্যও তাল মেলিয়ে প্রশংসা করে তার, “আমি তো গানগুলো রিপিটে শুনছি। থামতেই পারছি না।”
“হয়েছে, এত প্রশংসা শুনলে ডায়বেটিস হয়ে যাবে।”
“তোর প্রশংসা করছি না। এত বছর আমাদের সাথে থেকে তোর গুণ বেড়েছ। এতে তো কৃতিত্ব আমাদের। তাই না সামি?”
“আবার জিগায়! এই পোলার ট্যালেন্ট তো আমাদের সাথে চিপকায় থাকার কারণেই বের হইল।”
সভ্য তার কথা শুনে আফসোসের নিশ্বাস ফেলে তাকায় ইনারার দিকে, “বেচারাকে বলেছিলাম তোমার সাথে বেশিক্ষণ থাকতে না। কিন্তু আমার কথাই শুনল না।”
ইনারা দাঁত বের করে হাসছিল। সভ্যর কথা শুনে সে বুঝে উঠতে পারে না কি হলো?
“আমি কী করলাম?” সে অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে।
“তোমার এলিয়েন ভাষার ইফেক্ট ওকেও ধরেছে।”
“তুমি কী চাও সবার সামনে তোমার ধোলাই হোক। অবশ্যই না। চুপ করে থাকো।”
“দুইজন থামবে?” জোহান থামায় তাদের। বলে, “কয়দিন পর দুইজন মা বাবা হবে আর এখনো লড়াই করছ।” সে আবার তার মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললে, “তুমি না ঐশির বাসায় যেতে?”
“তোর এত বিশেষ দিনে আমি কোথাও কীভাবে যেতাম? আর ঐশি আর ইরফান তো নিজেই কাজে লন্ডনে গেছে। তাইতো আজ আসতে পারে নি। আমাকে তো মায়া বলে রেখেছিল যে তোমার জন্মদিনে এসব করবে তাই যেন তোমাকে কিছু না বলি।”
“মায়া বলেছে?”
ইনারা এই কথার উওর দেয়, “আমি আর মায়া তো সেদিন সারারাত ভরে প্লানিং করছিলাম। তারপর সবাইকে দলে নিয়েছি।”
“আইডিয়া আমার ছিলো।” সভ্য বলে।
“কেবল আইডিয়া দিয়েছ বাকিসব তো আমরাই করেছি।” ইনারা পালটে জবাব দেয়।
“তো সবার আগে তো আইডিয়া আমারই ছিলো। আমি আইডিয়া না দিলে তোমরা প্লানিং করতে কি?”
জোহান আবার থামায় দুইজনকে, “হয়েছে দুইজন এবার থামবি?” সে চোখ বুলিয়ে সারা কক্ষে দেখে। যার খোঁজ তার নয়ন করছিল তার দেখা পায় না সে। তাই জিজ্ঞেস করেই বসে, “মায়া এসব প্লানিং করলে ও নিজে কোথায়?”
ইনারা কথাটা শুনে দুষ্টুমি হাসি দেয়, “কেন? ওর কথা খুব মনে পড়ছে না’কি?”
“এমন…না এমন কিছু না। আমি কেবল জিজ্ঞেস করলাম। অনেক সুন্দর ডেকোরেশন করেছ।”
জোহান এত কথার পর এখন খেয়াল করে সবাই সোনালি ও কালো বেলুন দিয়ে সম্পূর্ণ রুম সাজিয়েছে। সাথে রয়েছে সাদা ফুল ও মোমবাতি। চমৎকার দেখাচ্ছে সবকিছু। কিন্তু তবুও কেন যেন তার ভেতরের এক শান্তি অনুভব হচ্ছে না। এমন সময় কলিংবেল বাজে। আর সে এক দুই না ভেবে জলদি যেয়ে দরজা খুলে। কিন্তু দরজাটা খুলেও হতাশাই পেল সে। দরজার ওপাড়ে মায়া নেই, তন্নি ও আশরাফ দাঁড়িয়ে আছে।
আশরাফ তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “হ্যাপি বার্থডে ব্রো।”
তন্নি তো পিছনে সভ্যকে দেখে জোহানকে এড়িয়ে যেয়ে সভ্যর সামনে যায়, “ওয়াও আমার আপনার সাথে দেখা হচ্ছে বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান। মায়া যখন বলল আজ আপনি এখানে আসবেন আমি মিটিং ছেড়ে এসে পড়েছি। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আপনি আমার সামনে। আপনাকে দেখে চিৎকার করতাম বাট জোহানের প্রতিবেশীরা এখানে এসে যেন জড়িত না হয় এজন্য কম লাফাচ্ছি। আমি কি আপনার অটোগ্রাফ পেতে পারি? আর হ্যান্ডশেক করতে পারি? প্লিজ।” মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করে তন্নি।
সভ্য নিজেই হাত বাড়িয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে একগাল হেসে বলে, “সো সুইট। থ্যাঙ্কিউ। এতবছর পরও আমাকে মনে রেখেছ।”
“মনে রাখব না? আমার ফার্স্ট ক্রাশ ছিলেন আপনি। আমার চাইল্ডহুড ক্রাশ।”
কথা শুনতেই সভ্যর একগাল হাসি উধাও হয়ে যায়।
সামি আর জোহান শব্দ করে হেসে দেয়। সামি এসে সভ্যর কাঁধে হাত রেখে বলে, “ভাই চাইল্ডহুড ক্রাশ ছিলি ওর। মানে আংকেলের ক্যাটাগরিতে এসে পড়েছিস তুই।”
সভ্য তার পেটে কণুই দিয়ে আঘাত করে।
তন্নি তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনারা সবাই আমার চাইল্ডহুড ফেভারিট ব্যান্ড।”
কথাটা শুনে সামি সভ্যর কানে কানে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আমরা কী আসলে বুড়ো হয়ে গেছি না’কি? তুই তো তারপর বিয়ে করে কাম সেরে ফেললি। আমার কী হবে? আমি তো সাতাশ বছর ধরে সিঙ্গেল আছি। আমি কী সিঙ্গেলই মারা যাবো? বুড়ো বয়সে কেউ বিয়ে করবে আমায়? আমি ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে তাকায় সামির দিকে, “তুই আর ইনারার আশেপাশে থাকিস না’রে। আমি দুই ড্রামাকুইনকে সামলাতে পাড়ব না।”
জোহান তাকে পিছন থেকে বলে, “আমরা তোমাদের তিন অথবা চার বছরেরই বড়। আমরা আঠারো বছর বয়সি পঞ্চসুর শুরু করেছিলাম।”
“তো তখন তো আমি চৌদ্দ বছরের ছিলাম। তাই চাইল্ডহুড ফেভারিট ব্যান্ডই তো হলো।”
“এসব বাদ দিয়ে বলো তোমার ফ্রেন্ড কোথায়?”
এই প্রশ্নে সামি ছাড়া সব বন্ধুরা তাকায় জোহানের দিকে। মায়াকে নিয়ে প্রশ্নটা বুঝতে পেরেও তন্নি বলে, “মেহেদীর একটা কাজ ছিলো তাই আসতে পাড়ে নি। তবে তোমাকে বার্থডে উইশ করতে বলছে।”
“ওহ্… আর তোমার আরেকটা ফ্রেন্ডও তো আছে।”
“কার কথা বলছ?”
জোহান যখন বুঝতে পারে তন্নি ইচ্ছা করে তার সাথে মজা নিচ্ছে তখন সে প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়, “কিছু না।”
বলে সবার দিকে তাকিয়ে থেকেই দরজা বন্ধ করতে নিলে পিছন থেকে শব্দ আসে, “কী করছ তুমি? কেক নষ্ট হয়ে যাবে তো।”
কন্ঠ শুনে জোহান পিছনে তাকায়। মায়াকে দেখতে পায়। তার হাতে একটি চকোলেট কেক।
তাকে দেখে ইনারা বলে, “আমি তো ভেবেছি আমাদের লক করে তুমি উধাও হয়ে গেছো।”
মায়া ভেতরে ঢুকে কেক টেবিলে রেখে বলে, “কেক সাজাতে সময় লেগে গেল।”
“ইয়ামি লাগছে। জোহান জলদি এসে কাটো। সবাই একপিস করে নিবে তারপর পুরোটা আমার।”
“একদম না। দুপুর থেকে অলরেডি তুমি অনেক জাঙ্কফুড খেয়েছ। তোমার জন্য স্যুপ এনেছি বানিয়ে ওটা খাবে।” মায়া তাকে আদেশের সুরে বলে। কিন্তু ইনারার প্রতিক্রিয়া এমন হয় যেন তার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে, “মানে আমার সামনে সবাই এত মজাদার খাবার খাবে আর আমি এই সবজির পানি খাব? মন দিল আছে তোমার মাঝে। এত কিউট একটা বাচ্চার উপর এমন অত্যাচার করতে লজ্জা লাগে না?”
“বাচ্চার মা হতে যাচ্ছো এখন। বেছে খেতে হবে বুঝেছ।” সে আবার সভ্যর দিকে তাকিয়ে বকুনি দেয় তাকে, “আর আপনার দোষ তো সবার বেশি। ওকে যা তা খেতে দেন কেন? খেয়াল রাখার দায়িত্ব আপনার না?”
সভ্য তার বকুনি শুনে আমতা-আমতা করে বলে, “আমার কথা তো শুনে না। ও যে কত জেদি তা জানো না। আর এখন তো ওর মুড যেভাবে পরিবর্তন হয় আমার তো ভয় লাগে ওর থেকে।”
“তো হাত-পা বেঁধে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিবেন। বাসার সব জাঙ্কফুড বের করে শুধু হেলদি খাবার…”
মায়া সামনে কিছু বলার পূর্বে ইনারা তার মুখে হাত চেপে ধরে, “অনেক হয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু বলার দরকার নেই। আমার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করার ধান্দায় আছো তুমি।”
সৌমিতা আন্টিও মায়ার পক্ষ নিয়ে কথা বলে, “মায়া কিন্তু ঠিক বলছে। তোর এখন নিজের বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে। এখন তোর মাঝে আরেকটি জান আছে।”
ইনারা নকল কান্নার অভিনয় করে বলে, “এটা ঠিক না আন্টি আপনি আগে আমার পক্ষ নিতেন এখন মায়াকে পেয়ে আমার ভালোবাসা কমিয়ে দিলেন? আপনার সাথে
আমার কাট্টি।”
সভ্য গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “ড্রামাবাজ।”
ইনারা আড়চোখে তাকায় সভ্যার দিকে। সভ্যর কথা তার কানে গিয়েছে। সে বলে, “তুমি তো আমার সাথে বাসায় চলো, জেদ আর মুড দুটোই দেখাচ্ছি তোমায়।”
সৌমিতা আন্টি ইনারার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার হাত ইনারার মাথায় বুলিয়ে বলে, “তোমার প্রতি আমার আদর কমতেই পারে না। তোমার দিকে তাকালে আমার কেবল সাইয়ারার কথা মনে পড়ে।”
কথাটা শুনে ইনারারও মনে পড়ে যায় তার মা’য়ের কিছু স্মৃতি। মন উদাসীন হয়ে পড়ে। আজ তার মা বাবাও হয়তো তার পাশে থাকতো। তখন কী হতো? একটা সুখী পরিবার হতো তার। তার মা বাবা থাকলে হয়তো তার জীবন এতটা মুশকিল হতো না। হয়তো প্রিয় আজও জীবিত হতো। সে কখনো কষ্টর মুখই দেখতো না। হাসিখুশি কাটাতো নিজের জীবন। ভাগ্য হয়তো তেমনটা না করলেও পাড়তো।
আচ্ছা তখন কী তার দেখা হতো সভ্যর সাথে? দেখা পেতো সে সভ্যর পরিবারের? কখনো পরিচয় হতো সুরভি আর প্রিয়র সাথে? নিজের মধ্যের এই সাহসটা অনুভব করতে পাড়তো সে? নিজেকে এতটা শক্ত করতে পাড়তো না’কি যে এত কঠিন মুহূর্তগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে পাড়তো সে? হয়তো না।
সে চোখ বুলিয়ে রুমের সবার দিকে তাকায়। যদি তার ভাগ্যে এমনটা না হতো তাহলে হয়তো সবার ভাগ্যও অন্যরকম হতো। পঞ্চসুর হয়তো এখনো আগের মতো থাকতো, জোহান এখনো তার বাবার প্রেশার সহ্য করতো, সভ্য এবং জোহানের বন্ধুত্বটা আজও তেঁতো থাকতো, ইরফান ও ঐশির জুটি হতো না, মায়ার সাথে জোহানের কখনো দেখাই হতো না, সুরভি অভ্রকে পেতো না, আজ তার জীবনে এতগুলো নি:স্বার্থ সম্পর্কের অস্তিত্ব থাকতো না।
সে তাকায় সভ্যর দিকে, আর তার জীবনে তার ভালোবাসার মানুষ থাকতো না। হয়তো আমাদের জীবনের সবকিছু কোনো বিশেষ কারণে হয়। আমাদের ভাগ্যের একটি লেখা কেবল আমাদের নয়, আমাদের আশেপাশের সকলের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা নিয়েও একগাল হেসে সৌমিতা আন্টির দিকে তাকায়। বলে, “আমাকে এক বাটি বিরিয়ানি দিলে আমার রাগ ছুঁ মন্তর হয়ে যাবে।”
হাসে সৌমিতা আন্টি, “এখনই আনছি।”
সৌমিতা আন্টি যাবার পর সে হেসে তাকায় মায়ার দিকে। মায়া আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলে, “তুমি ভালো হবে না।”
“আয়হায় কী বলো? আমি তো অনেক ভালো। সবাই এটা বলে।”
সভ্য তাদের মাঝে এসে বলে, “ওটা তো তুমি জোর করে বলাও। না বললে তো তাদের মাথার প্রত্যেকটা স্ক্রু খুলে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে ভূতের মতো লেগে থাকবে।”
ইনারা তার কথায় ভেংচি কাটে কিন্তু মানাও করতে পারে না যেহেতু কথাটা সত্য।
মায়া তাদের কথায় না পেরে হেসে দেয়। এর মাঝেই জোহান তার সামনের সোফায় এসে বসে, “থ্যাঙ্কিউ কেকের জন্য। ইনারা বলল এসব তোমাদের প্লান ছিলো তার জন্যও থ্যাঙ্কিউ। আমি ভেবেছিলাম তুমি ভুলে গেছো। সারাদিন তোমার দেখাও পাইনি, উইশও করো নি।”
“সারাদিন তো এখানেই ছিলাম।”
“সুন্দর হয়েছে সবকিছু।”
“তুমি এত ফর্মালিটি কেন করছ?” মায়া তার দিকে এগিয়ে ভালো করে দেখে তাকে, “তোমাকে এত নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?”
জোহানের কিছু বলার পূর্বেই সৌমিতা আন্টি ডাক দেয় তাকে। আর সে উঠে চলে যায়।
সে যাবার পর সকলে কথোপকথন শুরু করে দল বেঁধে। সভ্য অবাক হয় জেনে যে সামি আগের থেকেই চিনতো মায়ার বন্ধুদের। আর তার এক বন্ধু তাদের জুনিয়র ছিলো। ব্যাপারটা তার অজানা ছিলো। সকলের মাঝে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ভালো হাসিঠাট্টা শুরু হয়। কিন্তু জোহানের এখানে মন বসছিল না। তাইতো সে উঠে চলে যায় কিচেনের দিকে। সে দেখে তার মা ও মায়া কাজ করছে। তার মা জোহানকে দেখে বলে, “আরে তুই এখানে কিছু লাগবে?”
“কি করছ দেখতে আসলাম।”
“সবার জন্য বিরিয়ানি করা হচ্ছে। শেষ দিকেই আছে। আর মায়াই দুপুর থেকে সব করেছে। তাই মসলা কোথায় রেখেছে ও জানে। ওকে তা বলার জন্য ডেকেছি আর ও আবার কাজ শুরু করেছে। বলতো এটা ঠিক?”
জোহান কাউন্টারে হেলান দিয়ে হেসে তাকায় মায়ার দিকে। সে ক্লিপ দিয়ে তার চুলগুলো খোপা করে কাবাব বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাকে একদম গৃহিণীর মতো লাগছে। সে হেসে বলে, “তুমি ভালোই গুণী দেখে যাচ্ছে।”
“তোমার থেকে অন্তত হাজারগুণ বেশি।” মায়াও তার উওর দেয়।
সৌমিতা আন্টি বলে, “আমিও তো তাই বলি। ক্যারিয়ারের দিকে যতটা সাফল্য, রান্নাতেও ততটা গুণী। আর ওর মায়াবী মুখটায় কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারে? আমি ওকে বলছিলাম সীমান্তর কথা। সামির চাচাতো ভাই আছে না? ও মা ওদিন বলছিল ওর জন্য ভালো একটা মেয়ে থাকলে বলতে। তাই আমি মায়াকে ওর কথা বললাম…”
জোহান তার কথা শুনে বিস্মিত সুরে বলে, “মা তোমার এসব বিয়ের ঘটকালি করার কী দরকার?”
“এসব তো পূর্ণের কাজ। আর মায়াকে তো আমার অনেক পছন্দ। তুই তো বিয়ে করবি না বলে ঘোষণা করে দিলি, নাহলে নিশ্চিত আমি ওকে নিজের বউ করে আনার জন্য ওর পিছু ঘুরতাম। এখন কারো তো ভালো করি।”
“কারো ভালো করা লাগবে না। বিয়েই সবকিছু না। সারাজীবনের কামিটমেন্ট কেউ রাখতে পারে না। কেবল মানুষ অসুখী হয়। আর কিছু না।”
মায়া একবার তাকায় জোহানের দিকে। আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়।
জোহান তা দেখে নিজের মা’কে বলে, “অনেক খিদে পেয়েছে মা। বিরিয়ানি হতে হতে তুমি প্লেটিং করে ফেলো যেন রান্না হলেই খেতে বসতে পারি।”
“ভালো কথা বলেছিস তো। আমি প্লেট বের করে আসি।”
মা যাবার পর জোহান এসে দাঁড়ায় মায়ার পাশে, তুমি মা’কে কিছু বলো নি কেন?”
“কিছু বলার ছিলো?”
“মা তোমার জন্য কারও প্রস্তাব এনেছে।”
“তো?”
“তো মানে? তুমি মানা করবেন না?”
“আমি মানা করব কেন? আমি তো কখনো বলিনি যে আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।”
“আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অনেক বুদ্ধিমান। তাহলে লাইফটাইম কমিটমেন্টে তুমি কীভাবে বিশ্বাস করতে পারো? ভালোবাসা সহজ, কিন্তু সে ভালোবাসা কেউ টিকিয়ে রাখতে পারে না। আর সারাজীবনের দায়িত্ব কেউ ধরে রাখতে পারে না। আমি ভালোবাসাকে বিশ্বাস করি কিন্তু সারাজীবনের জন্য সে ভালোবাসা প্রতিশ্রুতি কয়জন দিতে পারে? তুমি তো তা বুঝো। একবার এমন প্রতিশ্রুতি পাবার পরই তো তোমার মন ভাঙলো। তাহলে কেন তুমি অকারণে এমন মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে জড়াতে চাও?”
“যখন দিনশেষে প্রতিটি মুহূর্ত আপনার একা থাকতে হয় তখন একাকিত্বটাকে বিরক্ত লাগে প্রচুর। যতটা সময় কাটে সকলে ততটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে জীবনে। আর আমারও কাওকে দরকার যার সামনে আমি নিজের মতো থাকতে পারি। সারাদিনের সব কথা, বিচার, ভালোলাগা বলার জন্যও কাওকে প্রয়োজন।”
“আমি আছি তো।”
কথাটা শুনে মায়া তাকায় জোহানের দিকে। জোহান সাথে সাথেই বলে ফেলে, “আই মিন আমরা প্রতিবেশী। তুমি যখন ইচ্ছা আমাকে তোমার মনের কথা বলতে পারো, আমার সামনে নিজের মতো থাকতে পারো। এসবের জন্য অল্প কিছু সময় লাগে, সারাজীবনের প্রতিশ্রুতি নয়।”
“যে ভালোবেসেও প্রতিশ্রুতি দিতে ভয় পায় সে সারাজীবন সাথে থাকার যোগ্যতাও রাখে না।” মায়া তার হাত ধুঁয়ে বলে, “আমি আসছি। আন্টিকে জিজ্ঞেস করে আসি এগুলো কখন ভাঁজবে।”
মায়া যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে নেয়, “ওসব কথা বাদ দেও। তুমি কিছু ভুলে যাচ্ছো না?
মায়া তাকায় পিছনে, ” কী ভুলে যাচ্ছি?”
“আজকে কেবল তুমিই….”
হঠাৎ তার মা’য়ের কন্ঠ শোনা যায়। আর জোহান মায়ার হাত ছেড়ে দেয়। মা জোহানকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায়। বলে, “জোহান তোকে সামি ডাকছে।”
“আসছি ।”
মায়া তাকায় জোহানের হাতের দিকে। তারপর নিজের হাতের দিকে। সে নিজেকেই মনে মনে বলে, জীবনের অঙ্গিকারনামায় কারও কাছ থেকে সম্পর্ক লুকানোর জন্য এভাবে হাত ছাড়তে হয় না।
রাতের খাবার শেষে কেক কাটার আয়োজন করা হয়। সব শেষে সকলের যাবার সময় আসে। সকলে নামে বিল্ডিং এর নিচে। জোহান সবাইকে ধন্যবাদ জানায় তার দিনটা এত বিশেষ করার জন্য। তখন সভ্য তাকে একটি বক্স বের করে দেয়।
“কী এখানে?” জোহান প্রশ্ন করে।
“খুলে দেখলেই বুঝবি।”
জোহান বক্সটি খুলে দেখে সেখানে একটি ব্রেসলেট আছে। ব্রেসলেটে পঞ্চসুরের এবং তার লগো গাঁথা আছে। দু’টো সংগীতের সংকেত। যা একসাথে যুক্ত করা হয়েছে।
“ওয়াও, এটা অনেক সুন্দর। থ্যাঙ্কিউ ভাই।” জোহান উৎসুক হয়ে সভ্যকে জড়িয়ে ধরে। বার বলে, “আমি জানতাম তুই ক্রিয়েটিভ বাট এতটা ক্রিয়েটিভিটি আমার গিফটে লাগাবি তা ভাবিনি।”
সামিও বলে, “ব্রো আমার জন্মদিনে তো এত জোস জোস আইডিয়া তোর খোপড়িতে ঢুকে না।”
“ভাই তোরা দুইজন আর ভুলেও দেখা না করিস নাহলে….” ইনারা সবার কথা কেটে জিজ্ঞেস করে, “নাহলে? নাহলে কী করবে তুমি?”
ইনারার সামনে তো আর সে হুমকি দিতে পারে না। তাই অনুরোধের সুরে বলে, “প্লিজ দয়া করো। তুমি কী চাও তোমার এত কিউট বর এত জলদি মেন্টাল হাস্পাতালে যায়। দয়া করে ওকে এসব আজব শব্দ শিখিও না। তুমিই আমার জন্য যথেষ্ট মেন্টাল হাস্পাতালে যাবার জন্য। ”
সে আবার সামিকে উওর দেয়, “আর এই আইডিয়া আমার না মায়ার ছিলো। ওই দুইটা একসাথে ডিজাইন করে আমাকে দিয়েছে। আমি কেবল জুয়েলার্সের কাছে বানাতে দিয়েছি।”
“আমিও বলেছিলাম আমার জন্য একটা ডিজাইন করতে। কিন্তু আমি কি এত স্পেশাল না’কি?” ইনারা অভিমানের সাথে তার সাথে একটু মজা নেবারও চেষ্টা করে। তার কথা শুনে সবাই মিটিমিটি হাসলেও সামি কিছুই বুঝে না। সে সরাসরি এবার জিজ্ঞেস করেই ফেলে, “আচ্ছা সবাই কী আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ? আমার কেন যেন ফিল আসছে এখানে সবাই কিছু জানে শুধু আমি ছাড়া।”
মায়া তার কথা একদম এড়িয়ে যেয়ে ইনারাকে বলে, “তোমার জন্য না কিন্তু আমার ভাগ্নির জন্য আমি অলরেডি একটা পেনডেন্ট ডিজাইন করে রেখেছি।”
“আমরা নিজেরাই জানি না ও ছেলে না মেয়ে।”
“আমার অনুভূতি হচ্ছে মেয়েই হবে। আর আমার প্রথম ভাগ্নি সো সবচেয়ে কুল আন্টি আমিই হবো।”
“সাথে খারুশও।” জোহান পাশের থেকে বলে।
মায়া সরু চোখে তাকায় তার দিকে, “খারুশ তো জানি না কিন্তু ফাইটিং এক্সপার্ট বানাতে পাড়ব। যেন সবাই ভয় পায়। তোমার উপরই প্রাক্টিস করব ডোন্ট ওয়ারি।”
ইনারা মজা নিয়ে বলে, “মায়া আপি জানো আমাদের বিয়ের আগেও আমরা এভাবেই ঝগড়া করতাম। তোমাদের দুইজনকে দেখে আমাদের কথা মনে পড়ে গেল।”
কথাটা শুনে জোহান ও মায়া একে অপরের দিকে তাকায়। আবার সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। বেখাপ্পা এক মুহূর্ত কাটল। ভাগ্যিস তখন তন্নি হঠাৎ করে বলেছিল, “আচ্ছা একটু সবাই এদিকে ধ্যান দেও। একটা এনাউন্সমেন্ট আছে। সরি জোহান আমি জানি আজ তোমার বিশেষ দিন তাও আজ যেহেতু সকলে এখানে তাই কথাটা না বললে হয় না।”
“এমন কী কথা?”
“আমার আর আশরাফের আগামী মাসে বিয়ে।”
“হোয়াট? কনগ্রেটস।” জোহান আশরাফকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। বাকি সবাইও তাকে অভিনন্দন জানায়। জোহান মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এত শান্ত আছো যে? তুমি জানতে?”
“ওদের আগে আমি জানতাম। ওরা তো এখন বিয়েই করবে না। তাই আংকেল আন্টি আমাকে আর মেহেদীকে কল করে মিটিং বসিয়েছে।”
“এরপর এরা দুইজন মহান ব্যক্তি আমাদের ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে মানিয়েছে।” তন্নি জানায়। সে আবার বলে,
“আর আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের বিয়েতে পঞ্চসুর একটা গান গাইবে। আমার ড্রিম ছিলো একসময়। আমি জানি আপনারা সবাই অনেক ব্যস্ত মানুষ। বাট প্লিজ একটু সময় বের করলে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে।”
সভ্য জানায়, “অফকোর্স, তোমরা জোহানের ফ্রেন্ড। মানে আমাদেরও ফ্রেন্ড।”
তন্নি খুশিতে চিৎকার করে উঠে। মায়া তার মুখ চেপে ধরে বিরক্তি নিয়ে বলে, “ও নরমালি অনেক বুদ্ধিমান কিন্তু আপনি ওর ক্রাশ ছিলেন তো তাই আপনাকে দেখে একটু পাগলপণার এট্যাক এসে পড়ে।”
জোহান বলে, “আমিও তো তোমার চাইল্ডহুড ক্রাশ ছিলাম। আমাকে দেখলে তো তোমার এমন এট্যাক আসে।”
“বয়স কম ছিলো তো তাই তখন বুদ্ধিহীন ছিলাম তো এখন একটু বুদ্ধি এসেছে।”
“তোমার সাথে কথাই বলা যায় না।”
“তো কে বলতে বলেছে?”
ইনারা তাদের মাঝে আবার বলে, ” বিয়ের আগে না আমি এবং সভ্য এভাবেই…”
মায়া তার কাছে দ্রুত যেয়ে তার কাঁধ ধরে বলে, “তোমাদের যাওয়া উচিত। দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই না? তোমার ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে।”
“আহা লজ্জায় কারও গাল দুটো লাল হয়ে গেছে।”
মায়া চোখ রাঙিয়ে বলে, “গেট আউট।”
“আল্লাহ আমি তো অনেক ভয় পেয়ে গেছি।” সে একগাল হেসে বল। আবার মায়ার গাল টেনে বলে, “হাউ কিউট।”
মায়া এবার আসলে বিরক্ত হয়। সে বিড়বিড় করে বলে, “তোমরা এখান থেকে যাওয়ার কী ঘুষ নিবে?”
“কেন জোহানের সাথে রোমেন্স করবে না’কি?”
“তোমাদের উল্টাপাল্টা কথা থেকে বাঁচবো। তোমরা কতটা অকোয়ার্ড সিচুয়েশন তৈরি করছ জানো?”
“বুঝেছি, রোমেন্সে সমস্যা হচ্ছে। আমরা চলে যাচ্ছি। আমাকে কেবল ব্লুবেরি চিজ কেক খাওয়ালেই আমি খুশি। কত কিউট আমি তাই না?”
মায়া মুখ বানায় তার কথা শুনে। কিন্তু ইনারা তাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায়। তারপর সবাইকে সেই টেনেটুনে পাঠিয়ে দেয়। সাথে নিজেরাও চলে।
তাদের বিদায় দেবার পর জোহান জিজ্ঞেস করে, “তুমি এমন ফিসফিস করে কি বললে যে ইনারা এভাবে পালালো।”
“আমাদের বোনের কথা। তুমি জেনে কী করবে?”
“ভালোই তো আমার এত পরে দেখা হলো কিন্তু আমার থেকেও বেশি স্পেশাল হয়ে গেল তোমার জন্য?”
“আমি কখন বললাম তোমার থেকে বেশি স্পেশাল হয়ে গেছে?” বলে মায়া নিজের বিল্ডিং এর দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু জোহান হঠাৎ করে তার সামনে এসে হাত ধরে নেয়, “তার মানে আমি তোমার জন্য স্পেশাল?”
মায়া উওর দেয় না, সে বলে, “তোমার কোনো ফ্যান আমার হাত ধরে রাখতে দেখলে কালকের হেডলাইনে তোমার আর আমার ছবিই থাকবে, সাথে থাকবে কতগুলো গুজব।”
“তাহলে এমন কোথাও যাই যেখান তুমি আমি ছাড়া কেউ থাকবে না।”
“কোথায়?”
জোহান হাত ধরেই মায়ার বিল্ডিং এর দিকে দৌড় দেয়। মায়াকে নিয়েই। মায়া বলে, “আস্তে গেলেও আমরা পৌঁছাবোই।”
মায়া ভাবে তারা তার ফ্লাটে যাচ্ছে। কিন্তু জোহান যখন উপরে উঠতেই থাকে তখন সে বুঝে তারা ছাদে যাচ্ছে। দু’জনেই উপরে উঠে হাপাচ্ছিল। জোহান বলে, “কাজের দিনেই তোমার বিল্ডিং এর লিফট বন্ধ থাকে কেন?”
“কী কাজ আছে তোমার?”
“তোমার সাথে আমার জন্মদিন কাটানো।”
“জন্মদিন তো প্রায় শেষই। আর কত পালন করবে?”
“ভালো করে দেখেও আরও আঠারো মিনিট আছে। এখনো শেষ হয় নি। প্রতিটি মুহূর্তকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”
মায়া কিছু বলে না। সে ফট করে উঠে বসে ছাদের বর্ডারের উপর।
জোহান আতঙ্কিত সুরে বলে, “পাগল না’কি তুমি? পড়ে যাবে, নিচে নামো।”
“আমার এখানে বসতে অনেক ভালো লাগে। আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা।”
“পাগল তুমি। এখান থেকে একবার পড়লে কি হবে জানো?”
“এত ভয় পেলে হয়? একদিন তো সবাই-ই মরে যাব। মন মতো জীবন কাটিয়ে যাওয়া উচিত।”
“মৃত্যুর কথা বলা অনেক সহজ। কিন্তু তাকে কাছ থেকে অনুভব করলে এই সাহস আর থাকে না।”
“তুমি করেছ?”
“করেছিলাম একসময়। নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য।” জোহান মনে করে যে সময় যখন তার বাবা সভ্যক্ব শেষ করার ব্যবস্থা করেছিল এবং সভ্যর পরিবর্তে সে গিয়েছিল সে জায়গায়। সে বাঁচতে পারবে বলেও মনহয়নি। তখন তার মনে হয়েছিল, ঈর্ষার কবজে সে যা ভুল করেছে তার পরিণাম তার জীবনই। সে কখনো ভালো ছেলে, বন্ধু, প্রেমিক এমনকি ভালো মানুষও হতে পারে নি। তার জন্য কে কাঁদবে?
অথচ সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে বেরিয়ে আসার পর সে নতুন জীবন পেল। সময় লাগল, কিন্তু সে সব ফিরে পেল।
সে তাকায় মায়ার দিকে। নিজ অজান্তেই বলে, “সেদিন আমার মনে হয়েছিল আমি মারা গেলেই ভালো হতো। ভাগ্যিস মারা যাইনি, নাহলে তোমার সাথে আজ এই ছাদে থাকতাম না।”
মায়া তাকিয়ে ছিলো জোহানের দিকেই। সে চোখ সরিয়ে নেয়। আবার লুকিয়ে তাকাতে চায় জোহানের দিকে। কিন্তু জোহান তখনও তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সে পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করতে চেয়ে বলে, “আচ্ছা তোমার এলবাম রিলিজ করলে, আমি এত সাহায্য করলাম। কিন্তু আমাকে তো একটাও গান শুনালে না এখনো।”
“আগে তুমি শুনাও, তাহলে আমিও গাইব।”
“আমি তো গায়িকা না। কিন্তু তুমি গায়ক।”
“বলেছিলাম তোমাকে আমার সাথে এলবামে গানটা গাও। কিন্তু আমার কথার মূল্য তো শূন্য তোমার কাছে। আমার অনেক ইচ্ছা ছিলো তোমার কন্ঠের মধুতে আমার গানটা আরও মিষ্টি হয়ে যাক।”
মায়া তার দিকে একপলক তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। তারপর আবার তাকায় আকাশের দিকে। আকাশে মেঘ জমে আছে। ঝুম বৃষ্টির সাক্ষাৎ হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। এই পরিস্থিতি তার একটি গান আসে মস্তিষ্কে হাওয়ায় পা দুলাতে দুলাতে জোহানের এলবামের একটি গান ধরে,
“ঝুম ঝুম বৃষ্টি কিছু তো কয়,
হাওয়ার ছোঁয়ায় মোহে লয়,
তোমার দুয়ারে বসে এখনো
অপেক্ষায় চাহিয়া রয়।”
জোহান তার দিকে তাকিয়ে হেসে সামনে গায়,
“সে বৃষ্টির আড়ালে, মেঘের ওপাড়ে,
তোমার দেখাতে মোহে ডুবিয়া যায়,
মায়ার সাগরে ভাসিয়া যায়,
মোহে ডুবিয়া, মায়ায় জুড়িয়া
নিজেকে যে কোথায় হারাই?
ঝুম ঝুম বৃষ্টি কিছু তো কয়।”
জোহান গাইতে গাইতে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। একমুহূর্তের জন্যও সে চোখ সরায় নি মায়ার থেকে। আচমকায় সে মায়ার কণুই ধরে টান দেয়। পরে যাবার পূর্বেই তাকে জড়িয়ে ধরে নেয় জোহান। এক মুহূর্তের জন্য মায়া নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিল। সে তাকায় জোহানের দিকে।
সে বলে, “এভাবে কেউ টেন দেয়? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“আমি তোমাকে কিছু হতে দিতাম না। এতটুকু তো ভরসা রাখো।”
“ভরসা আছে।” মায়া তার এমন গভীর চাহনি দেখে ঢোক গিলে। চোখ সরাতেই খেয়াল করে সে জোহানের বাহুডোরে। সে জলদি করে সরতে নিলে জোহান তাকে আটকায়। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে, “আমরা বেশি কাছে এসে পড়েছি।”
“মিস মায়া, উইড ইউ লাইক টু ডান্স?”
মায়া তার দিকে তাকিয়ে থাকে, উওর দেয় না। চোখ সরিয়ে নিতেই জোহান তার হাত ধরে ঘুরিয়ে দূরে সরায়। বলে, “তোমার এই অভ্যাসট আমার ভীষণ বাজে লাগে।”
“কোন অভ্যাস?” মায়া প্রশ্ন করে।
জোহান ঘুরিয়ে তাকে আবারও কাছে টেনে নেয়, “এই’যে বারবার চোখ সরিয়ে নেও যে।”
“তোমার দিকে তাকিয়ে থাকাটা আমার জন্য কষ্টকর।”
জোহান হেসে ফেলে কথাটায়, “আমি কি এতটা ভয়াবহ দেখতে?”
“না-তো।”
“তাহলে একটু চেয়ে থাকো না আমার চোখে।”
“কেন?”
“আমার ভালো লাগে।
“কেন ভালো লাগে?”
“জানি না।”
“তুমি জানো।”
জোহান আলতো আঙুল দিয়ে মায়ার সামনে আসা চুলগুলো আলতো করে কানের পিছে গুঁজে দেয়। তার হাত নিজের কাঁধে রেখে তার কোমরে হাত রেখে তাকে আরও কাছে টেনে নেয়। মায়া চমকে তাকায় তার দিকে। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
জোহান বলে, “তোমার চোখদুটো যেন মায়ার সাগরের মতো। আমার সে দৃষ্টির মাঝে ডুবতে ভালো লাগে।”
“আর তোমার দৃষ্টিতে আমার ডুবতে ভয় লাগে।”
উওরটা শুনে জোহান চমকিত হয়ে তাকিয়ে রয় কিছু মুহূর্ত।
গর্জন শুনে সে তাকায় আকাশের দিকে। বিদুৎ চমকাচ্ছে। ধীরে ধীরে আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি ঝরে। জোহান মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ সকলে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। আমার প্রিয় বৃষ্টি ঝরিয়ে এই আসমানও। কেবল তুমি বাদে।”
মায়া হাসে তার কথায়।
জোহান তার কোনো উওর না পেয়ে গুনগুন করে সামনের দিকে গাইতে থাকে,
“সে রঙের বর্ষণে তোমার আমার গল্পের আরম্ভে,
সে নিঝুম রাত্রিটা তুমি আমি কাটাই হাসিতে,
সে ঝুমঝুমে বৃষ্টি, তোমার এই দৃষ্টি
ডুবে যাই চলো মায়ানগরীর রাজ্যে,
ঝুম ঝুম বৃষ্টি কিছু তো কয়, হাওয়ার ছোঁয়ায় মোহে লয়,
তোমার দুয়ারে বসে এখনো অপেক্ষায় চাহিয়া রয়।”
জোহান মায়াকে বাহুডোরে নিয়ে নাচতে ব্যস্ত। তাদের সাথে নৃত্য করে বৃষ্টির ফোঁটা জল।
মায়া তার দিকে তাকিয়ে রয়। তার এখন গানটা আবার শোনার পর মাথায় এলো গানটা তাকে নিয়ে। তাকে ও জোহানকে নিয়ে। এটা তাদের গল্প। রঙ খেলাতে তাদের কাছে আসা, নিঝুম রাত্রিতে গল্প করা, সে বৃষ্টির দিনে হাল্কা ভেজা। এসব তো তাদেরই মুহূর্ত, তাদেরই গল্প। ভাবতেই তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি এসে পড়ে। সে ভেবেছিল জোহান তাদের সম্পর্ক নিয়ে গম্ভীর নয়। কিন্তু সে ভুল ছিলো। জোহানেরও তাকে নিয়ে অনুভূতি একই রকম যেমনটা তার। দু’জনে একই অনুভূতির খাঁচায় বাঁধা।
সে থেমে যায়। জোহান অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।
“কি হলো?” সে প্রশ্ন করে।
মায়া তার বুকে হাত রেখে পা উঁচু করে তার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলে, “হ্যাপি বার্থডে মিস্টার। আপনার সাথে আপনার জন্মদিন কাটিয়ে ভালো লাগলো।” সে সরে দাঁড়িয়ে জোহানকে জানায়, ” এখন তুমি ততক্ষণ আমার চোখে তাকিয়ে থাকতে পারেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার হৃদয়ের অবস্থা বেহাল না হয়ে যায়।”
জোহান তার দিকে ঝুঁকে সে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। মুগ্ধ গলায় বলে, “ভেবে নিও কিন্তু। পরে আফসোস করো না।”
মায়ার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। তবুও সে স্বাভাবিক গলায় বলে, “মায়া আফসোস করার মতো কিছু করে না।”
জোহান তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যেন সে দৃষ্টি দিয়ে হৃদয়টাকে নিজের বশে করে নিবে।
মায়া প্রথম পরাজিত হয় তার হৃদপিণ্ডের কাছে। আর সইতে পারে না সে। দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এক’পা পিছাতেই জোহান তার কণুই ধরে নিজের দিকে টান দেয়।সে মোহনীয় কন্ঠে আবারও বলে, “নিজের কথার বিরুদ্ধে যাবার অনুমতি তোমার নেই।”
“এভাবে তাকিও না। বুকের ভেতর কেমন তুফান উঠে যায়।”
“আমার হৃদয় তো আরও বেশি জেদি। কত বারণ করি তবুও তোমার দিকে ছুটে যায়।”
জোহান বৃষ্টিতে ভেজা তার মুখে আসা চুল সরিয়ে দেয়। তার ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠে মায়া। চোখ বন্ধ করে নেয়।
জোহান তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মুগ্ধ নয়নে। তার হাত সরায় না মায়ার গাল থেকে। হঠাৎ করে সে নিজের কাবুতে আর রয় না। হঠাৎ আলতো করে চুমু খেয়ে বসে মায়ার ওষ্ঠে।
মায়া চকিতে চোখ খুলে। হঠাৎ জোহান এমন কিছু করে বসবে সে আশা করে নি। কিন্তু সে সরায় না জোহানকে। সরাতে পারে না। এভাবে নিজের উপর থেকে বশ সে আগে কখনো হারায় নি। এই বৃষ্টির জাদু, না জোহানের? সে জানে না। তবুও সে এই মোহ থেকে বের হতে চায় না। সে হাত উঁচু করে জোহানের হাতের উপর রাখে। আর নয়নজোড়া আবারও বন্ধ করে নেয়।
চলবে…
অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সভ্য গাড়ি চালাচ্ছিল। সে তার পাশে তাকালে দেখতে পায় ইনারার অন্যমনস্ক হয়ে জানালার ওপারে তাকিয়ে আছে।
“কী ভাবছো?” সভ্য প্রশ্ন করে।
“হুঁ? আমি? কিছু না তো।”
“তোমার মাথায় কিছু তো চলছে। অনেকক্ষণ ধরে তোমার মন খারাপ।”
“আমার মন খারাপ? আমি সে কখন থেকে লাফাচ্ছি।”
“তুমি কখন আসলে হাসিখুশি থাকো আর কখন মিথ্যে অভিনয় করো, তার খেয়াল আমার আছে। সৌমিতা আন্টি যখন থেকে সাইয়ারা মা এর নাম নিয়েছে তখন থেকে তোমার মন খারাপ।”
ইনারা তার দিকে তাকায়। তারপর ফিক করে হেসে দেয়, “তুমি এতকিছুর খেয়াল রাখো? আমি এমন কি করেছি যে তুমি আমার জীবনে এলে?”
“আমাকে ভালোবাসা শিখিয়েছ।” সভ্য তার হাত বাড়িয়ে ইনারার হাত ধরে। আরও প্রশ্ন করল, “কী ভাবছিলে?”
“ভাবছিলাম, কতকিছু হলো আমাদের জীবনে, সবকিছু হওয়ার তো কোনো কারণ থাকে তাই না?”
“পৃথিবীতে তো সবকিছুই কোনো কারণেই হয়।”
“কোনো কিছু পাওয়ার পরিবর্তে কিছু হারাতেও হয়। আর কাওকে হারালে তার পরিবর্তে উপরওয়ালা অন্য কাওকে পাঠিয়ে দেয় খেয়াল রাখার জন্য।” বলে সে তাকায় সভ্যর দিকে। কিন্তু সভ্যর তো সকল কথাই মাথার উপর দিয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে “কী বলছ তুমি?”
ইনারা হাসে কেবল, “কিছু না বাদ দেও। আচ্ছা তোমার মেয়ে চাই না ছেলে?”
“আল্লাহ খুশি হয়ে যা দেয়। কিন্তু মেয়ে হলে আমার লাভ আছে।”
“কীভাবে?
“আমাকে বেশি ভালোবাসবে। আর তুমি আমাকে বকলে তোমাকে উল্টো বকবে।”
কথাটা শুনে আড়চোখে ইনারা তাকায় সভ্যর দিকে, “তোমাকে আমার বকা থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না বুঝলে?”
.
.
মায়া চকিতে চোখ খুলে। হঠাৎ জোহান এমন কিছু করে বসবে সে আশা করে নি। কিন্তু সে সরায় না জোহানকে। সরাতে পারে না। এভাবে নিজের উপর থেকে বশ সে আগে কখনো হারায় নি। এটা বৃষ্টির জাদু, না জোহানের? সে জানে না। তবুও সে এই মোহ থেকে বের হতে চায় না। সে হাত উঁচু করে জোহানের হাতের উপর রাখে। আর নয়নজোড়া আবারও বন্ধ করে নেয়।
হঠাৎ করে জোহান সরে যায়। সে চিন্তিত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মায়াকে “সরি” বলে। আর সেখান থেকে দ্রুত চলে যায়। যাবার সময় সে একটিবারের জন্যও পিছে ফিরে তাকায় না। দেখে না একটি মেয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। মেয়েটি একাকী বৃষ্টিতে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। স্তব্ধ হয়ে। সে বুঝতে পাড়ছিল পরিস্থিতিটা বিদঘুটে হয়ে গেছে কিন্তু এভাবে তাকে একা ছেড়ে যাওয়াটা কি উচিত ছিলো জোহানের? আর সরি? সরি কেন? তার সাথের মুহূর্তটা কি ভুল ছিলো জোহানের জন্য? সে কী আফসোস করছে?
জোহান একেরপর এক কলিংবেল বাজিয়েই যাচ্ছে। তার মা দরজা খুলে বলে, ” কলিংবেল বাজালেই তো আর হবে না আসতেও তো সময় লাগে। আর তুই ভেজা কেন?”
জোহান তার কথা শুনেও এড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। মা তার পিছনে যায়, “কী হয়েছে তোর? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? সব ঠিক আছে তো?”
“মা প্লিজ এখন কোনো কথা বলো না। আমার মন মেজাজ ঠিক নেই।”
“কী হয়েছে আমাকে বল। কারো সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
“মা প্লিজ…” উচ্চস্বরে বলে জোহান। আরও যোগ করে, “আমার এখন কথা বলার ইচ্ছা নেই।”
বলে সে যেতে নিলেই থেমে যায়। অপরাধীবোধ তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পিছনে ফিরে শান্ত গলায় বলে, “সরি মা। আমি বেয়াদবি করতে চাই নি। আমার ভালো লাগছে না। আমার মাথা কাজ করছে না।”
“কী হয়েছে বাবা?” সে জোহানের গালে হাত রাখে, “মায়ার সাথে কিছু হয়েছে?”
জোহান অবাক হয়ে তাকায় তার মা’য়ের দিকে। তার মা নিজে থেকেই বলে, “ওর সাথেই কিছু হয়েছে বুঝেছি।”
“তুমি কীভাবে…. ”
“আমি আমার ছেলের মনের কথা জানব না? আমি তো জানি তুই ওকে ভালোবাসিস তাইতো ওর বিয়ের কথা তোর সামনে বলছিলাম। আমি জানতাম এতেই তুই ওকে নিজের মনের কথা বলবি। তাই হয়েছে না? তুই ওকে নিজের মনের কথা বলেছিস? ও কি তোকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে? তুই চিন্তা করিস না, আমি জানি ও তোকে ভালোবাসে। হয়তো নার্ভাস হয়ে মানা করে দিয়েছে। আমি ওর সাথে কথা বলব। তুই মন খারাপ করিস না।”
জোহান আচমকায় তার মা’কে জড়িয়ে ধরে, “এটাই তো সমস্যা। আমি ওকে ভালোবাসতে চাই না। আমি কাওকে ভালোবাসতে চাই না। আমি যাকে ভালোবাসি তাকে কষ্ট ছাড়া কিছু দিতে পারি না। আমার মতো মানুষ ভালোবাসা ডিসার্ভই করে না।”
মা তার কথায় চমকিত হয়। সে জোহানকে সরিয়ে দেখে তার চোখে পানি। তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে, সে কাঁপানো কন্ঠে বলে, “এমন কিছু না বাবা। তুই এভাবে বলিস না।”
“কীভাবে না বলি মা? বাবার জন্য তোমার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছি আমি, ঐশির ভাই আমি হলেও ওর ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছে সামি ও সভ্য, ফেমের নেশায় আমি আমার ভাইয়ের মতো বন্ধু সভ্যকে কত কষ্ট দিলাম, বাবার এক কথায় আমার ভালোবাসার পঞ্চসুরকে শেষ করার জন্য একমুহূর্তও ভাবি নি, আমি প্রথম যাকে ভালোবেসেছি তার ক্যারিয়ার আমার দোষে শেষ হয়ে গেল, ইনারাকে আমি কত বিপদে ফেললাম, অবশেষে বাবাও আমার কারণে আজ জেলে। আমি কার ভালো করেছি মা? আমি কেবল নিজের জীবন না, আমার সাথের সবার জীবন শেষ করে দিয়েছি। মা…মায়া যদি আমার সাথে থাকে ওর জীবনও শেষ হয়ে যাবে দেখো। আর আমি ওকে কীভাবে কামিটমেন্ট দেই মা? যেখানে আজ পর্যন্ত আমি কোনো একজনের সাথে থাকতে পারলাম না? মা ওর অতীত এমনিতেই অনেক কষ্টের, যদি আমিও ওকে কষ্ট দেই? ওকে ভালোবাসতে না পারি তাহলে? তাহলে কী হবে মা? না, আমি ওকে ভালোবাসতে পাড়ব না। আমারই দোষ… ওর জন্য অনুভূতি তৈরি করাটা আমারই দোষ। আমি কী করব মা? আমি কী করব?”
হঠাৎ জোহানের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তার হাত পা কাঁপতে শুরু করে। তার মাথা হাল্কা হয়ে আসে। সে নিজের কাঁপা হাত দেখে দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার মা দরজার কাছে এসে বলে, “বাবা তুই দরজা খুল। আমার কথা শুন।”
“মা আমাকে একটু একা থাকতে দেও। একটু….একটু…” সে দ্রুত যেয়ে আলমারি খুলে একটা বক্সের থেকে মেডিসিন নিয়ে টেবিলের উপর রাখা গ্লাস নিতে যেয়ে তা ভেঙেই ফেলে। তাই ঔষধ মুখে দিয়ে জগের থেকে পানি খেয়ে নেয়। আর মেঝেতে বসে পড়ে। কিছু মুহূর্তের জন্য সে কিছু অনুভব করতে পারে না। সামনের সব ঘোলাটে দেখে। দরজার বাহির থেকে শব্দও শুনতে পারে না। কিছু মুহূর্ত শেষে তার প্রথম অনুভূতি হয়। তার বুকের বাঁ পাশে প্রচন্ড রকমের ব্যাথা হয়।
.
.
পরদিন সকালে অভ্রর ঘুম ভাঙে কলিংবেলের শব্দে। সে বিরক্ত হয়। সে গতকাল ভোর চারটায় কাজ করে ঘুমিয়েছে। ঘুমানোর পূর্বে সে ফজলু মিয়াকে মেসেজ করে জানিয়েছিল যে আজ বিকেলের আগে আসতে না। কারণ বহুদিন সে ঘুমায় না। মেসেজ দেওয়া সত্ত্বেও আজ সকাল এগারোটায় তার আসতে হলো। এর উপর কয়েকবার কলিংবেলও বাজাল। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। সে ধীরে সুস্থে উঠে যায় দরজা খুলতে। যেয়ে খুলতে খুলতে বলে, “ফজলু তোমাকে বলেছিলাম আজ সকালে ভুলেও আসবে না….”
দরজা খুলে সুরভিকে দেখে সে স্থির হয়ে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য।
“আমি কী ভুল সময়ে এসে পড়লাম?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
অভ্র দ্রুত মাথা নাড়ায়, “আরে এমন কিছু না। ফজলুই কেবল বাসায় আসে তো তাই…বাদ দেও। আসো, ভেতরে আসো।”
সুরভি সামনে এগিয়ে যায় ও বলতে থাকে, “আরে হয়েছে কি আমি আজ ছুটি নিয়েছিলাম। তাই দুপুরেই আসতাম কিন্তু মাঝখানে অফিস থেকে কল এলো দুপুরে যেতে হবে। আর আমি আপনাকে প্রমিজ করেছিলাম যে আপনাকে আমার হাতের বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াব। এখন আমি কি নিজের প্রমিজ ফেলতে পারি? তাই সকাল সকালেই চলে এলাম বিরিয়ানি নিয়ে।” সে ভেতরে ঢুকে কথা বলতে বলতে। পিছনে ফিরে অভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখে সে নিজের হাত দিয়ে চুল ঠিক করছে। তা দেখে ফিক করে হেসে উঠে সুরভি। বলে,”এত তৈরি হবার প্রয়োজন নেই। এলোমেলো চুলেই আপনাকে বেশি ভালো দেখায়।”
অভ্র তাকে দেখে ভ্রু কপালে তুলে বলে, “মানে আমাকে তোমার ভালো লাগে?”
“এটাও বলিনি আমি।”
“তাহলে কী বলেছ যা আমি ভালো করে শুনতে পারিনি।”
তারা কথা বলতে বলতে রান্নাঘরে পৌঁছায়। সুরভি রান্নাঘরে যেয়ে টেবিলের উপর টিফিন রাখে। তারপর অভ্রর দিকে ফিরে বলে, “আপনি একটা কথাকে ধরে এত পেঁচান কেন?”
“ভালো কথা, তুমি আজ ছুটি নিলে কেন? তুমি তো ছুটি নেবার মতো মানুষ না।”
“আমি কিছু তথ্য বের করেছি। আপনার কাজে লাগবে।”
“কীসের তথ্য?”
“তৌফিকে।”
“হোয়াট?” অভ্র এবার খানিকটা রাগান্বিত স্বরে বলে, “সুরভি তোমাকে আমি বলেছিলাম এসব ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে। তৌফিক ডেঞ্জারাস মানুষ। পরে তোমার কোনো ক্ষতি করলে?”
“আরে আমি তো তার সাথে যেয়ে ঝগড়া করছি না। আমি তার তথ্য আপনাকে এনে দিচ্ছি। আমার আরেকটা প্লানও আছে।”
“এজন্য তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই নি।”
“আপনি আগে দয়া করে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি আপনার জন্য আলুর পরোটাও বানিয়ে এনেছি। খেতে খেতে আমরা সব প্লানিং করব ওকে? যান, জলদি যান।”
“আমার কথা শেষ হয় নি।”
“যা শুনার পরে শুনব।” সে কানের উপর হাত রেখে বলে।
অভ্র সকাল সকাল আর তর্ক না করে নিজের রুমের দিকে যায়। গোসল করে রেডি হয়ে এসে দেখে সুরভি ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট লাগিয়েছে। আলুর পরোটার সাথে চাটনি দিয়েছে। সাথে ফ্রুট সালাদও ও ওটসও রেখেছে।
“হেলদি খাওয়াচ্ছো না আনহেলদি তাই তো বুঝতে পারছি না। এটা কী কম্বিনেশন হলো?”
“পরোটা তো আমি এনেছি। বাটারের জন্য ফ্রিজ খুলে দেখি ওভারনাইট ওটস আর ফ্রুট রাখা আছে। ভাবলাম আপনি বোধহয় সকাল সকাল এগুলো খান। পরোটা ভালো না লাগলে এগুলো অপশনে রাখলাম।”
“তুমি নাস্তা করেছ?”
“না। আমার জন্যও ইয়ামি ইয়ামি পরোটা এনেছি।”
অভ্র তার হাত থেকে প্লেট নিয়ে তার সামনে ওটস রেখে বলে, “তাহলে আজ আমরা খাবার এক্সচেঞ্জ করি। আজ তুমি একটু হেলদি খেয়ে নেও।”
“আমি পরোটা ছাড়া সকালে কিছু খেতে পারি না। আর হেলদি খাবার খেলে তো আমার মাথা ঘুরঘুর করে। আমার ও ইনারার এই দিক থেকে একদম মিলে, জীবন তো এতটুকু, এই এতটুকু জীবনে মজাদার খাবার না খেলে বেঁচে লাভ কী? আপনি জানেন ইনারা ও প্রিয়’র সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ স্ট্রং হয়েছিল ফুচকার চক্করে। আচ্ছা এসব কথা সাইডে রেখে যার জন্য এসেছিলাম তা বলি।” সে উঠে নিজের ব্যাগ থেকে কতগুলো কাগজ বের করে তা অভ্রর সামনে রাখে, “দেখেন এখানে তৌফিকের সকল তথ্য আছে। কোন স্কুল, কলেজে পড়েছে। সে গ্রাজুয়েশন করার জন্য লন্ডনে গিয়েছিল, সেখানে তার তিন তিনটা গার্লফ্রেন্ডও ছিলো। তো আমার প্লান হচ্ছে সে মেয়েদের সাথে কথা বলে সে যা অপরাধ করেছে তা বের করা। তারপর এখানে মেঘলা আপুর বাবারও সকল অপরাধ আছে। তারা অনেক জায়গায় স্কেম করেছে। তার কোম্পানি যেসব প্রডাক্ট বানায় তা পাব্লিকের জন্য অনেক হার্মফুল। এই লিস্টে সব ক্যামিকেলের নাম দেওয়া যার কারণে ক্ষতি হয়।”
সে মুখ তুলে তাকায় অভ্রর দিকে। দেখে সে আরামসে খাবার খাচ্ছে। বলে, “আসলে পরোটা অনেক মজার বানিয়েছ।”
“আমি এখানে গত কতদিন ধরে রাত জেগে রিসার্চ করছি আর আপনি আমার কথায় ধ্যান দিচ্ছেন না।”
“কারণ আমি এসব আগের থেকেই জানি। ইনফ্যাক্ট এই তথ্য আমি একরাতেই বের করেছি। আর এসবে ওদের বড় কোনো ক্ষতি হবে না। তৌফিক অনেক বুদ্ধিমান। ও নিজের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ রাখে না।”
হতাশ হয়ে সুরভি চেয়ারে বসে পড়ে। সে কাগজগুলো দেখে বলে, “আর আমি এত কষ্ট করে এসব খবর বের করলাম। তাইফাকে দিয়ে তৌফিক আর ওর ম্যানেজারের প্রতিদিনের রুটিন বের করালাম। ও কোন লোক লাগিয়েছিল তৌফিকের রাইট হ্যান্ড সুমনের পিছু করার জন্য। প্রতি বুধবার তো একশো ফিটের দিকে যেয়ে সে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল।”
“সুমন একশোফিটের দিকে যেত? প্রতি বুধবার? কেন?”
“জানি না। একটা বাড়ির ভেতরে যেতো। অনেক সিকিউরিটি থাকার কারণে কখনো আশেপাশেও যেতে পারে নি। এখন উনার তো নিজের জানেরও ভয় আছে।” সুরভি কথা বলার শেষে অভ্রর দিকে তাকালে দেখতে পায় তার মুখের ভাবটা চিন্তিত। তাই সে প্রশ্ন করে, “কী নিয়ে চিন্তা করছেন?”
“সুমন নিজের বাসা থেকে যায়?”
“অফকোর্স। নিজের বাসা থেকেই ত যাবে।”
“গত সাপ্তাহেও গিয়েছিল।”
“আমি তিন সাপ্তাহ যাবত নজর রাখছে। প্রতি বুধবারই সে জায়গায় যাচ্ছে।”
“আমার একজন বিশেষ লোক আছে তৌফিকের বাড়িতে। যার কাছ থেকে আমি ওর বাসার খবর পাই। প্রতি সাপ্তাহ বুধবার থেকে শুক্রবার ওদের ছুটি থাকে। বাহিরের সিকিউরিটি বাদে। আর গত বুধবার ওরা সকলে ট্রিপে ঢাকার বাহিরে গিয়েছিল। সুমন ওর সাথেই ছিল। আমি বেশি ভাবছি। হয়তো ওরা রাতে গিয়েছিল।”
“না। সুমন বুধবার যেয়ে পরদিন রাত পর্যন্ত যেখানেই থাকে। যদিও আমি কনফার্ম না। কিন্তু তাইফা আমাকে এই খবরই দিয়েছিল।”
“আর তৌফিককেও এই দুইদিন বাহিরে বের হতে দেখা যায় না। আমি ভেবেছি এটা নরমাল… এই কথাটা আমার মাথায় আগে ক্লিক করে নি কেন?”
সে দ্রুত ফজলুকে কল করে তাকে দুপুরেই তার অফিসে আসতে বলে।
কল রাখার পর সুরভি তাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার মাথায় কী ক্লিক করেছে ওটা তো বলবেন?”
“একটা সন্দেহ আছে। একমাস আগে ওদের সবার পিছনে লোক লাগাই তারপর কনফার্ম হয়ে বলব। এতদিন তো আমি কেবল তৌফিকের সাথে লোক লাগিয়ে রেখেছিলাম।”
“আগে বলুন তারপর কনফার্ম হবেন।”
“আচ্ছা তাইফা যাকে দিয়ে সুমনের পিছু করিয়েছে তার নাম্বারটা দিও।”
“আপনি বলবেন কেন?”
“আমার সন্দেহ আছে প্রতি বুধবার সুমন না, তৌফিক সে বাড়িতে যায়। কিন্তু আমার কনফার্ম হতে হবে প্রথমে।”
“ওটা তো আমি একদিনেই বের করতে পারবো।”
“কীভাবে?”
“মেঘলা আপুর সাথে দেখা করে। মেঘলা আপুকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়ে যাবে।”
“তোমাকে আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি তুমি এসবে জড়াবে না। আমি তোমার জীবন ঝুঁকিতে ফালাতে পাড়ব না। আমার কথা না শুনলে তোমার জন্য ভালো হবে না।”
“দেখুন, এভাবে বকবেন না আমাকে। আপনার হুমকিতে এখন আর আমি ভয় পায় না।”
“কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি একথা জেনে?”
প্রশ্নটা শুনে সুরভি থতমত খেয়ে যায়। কথাটা তো সত্যি। কিন্তু উওরটা দিলে যদি অভ্র মনে করে সে তার ভালোবাসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে তাহলে?
“এমন কিছু না। আচ্ছা এসব কথা বাদ দিয়ে এখন খাওয়ায় ধ্যান দিন। আমিও খেয়ে নেই। খিদু লেগেছে।” সুরভি বলে।
অভ্র তার চেয়ার টেনে নিজের দিকে নিয়ে আসে।
হঠাৎ এমন করায় সুরভিও বিস্মিত চোখে তাকায় অভ্রর দিকে। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই ছিলো তার দিকে তখনই অভ্র বলে, “এভাবে তাকিও না, সময়ের আগেই প্রেমে পড়ে যাবে।”
সুরভির গাল লাল হয়ে যায়। আর সে সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে জিজ্ঞেস করে, “দে…দেখুন এমন বেয়াদবি করবেন না। ভাববেন না ওদিন… ওদিন জড়িয়ে ধরতে দিয়েছি বলে আপনার প্রেমে পড়ে গেছি আমি।”
অভ্র টেবিলে বামহাতের কণুই রেখে গালে হাত দিয়ে তাকায় সুরভির দিকে, “সেটা মানলাম। কিন্তু আজ যে সকালে এত কষ্ট করে উঠে আমার জন্য এতকিছু বানালে তার কারণ কী?”
“আপনি আমাকে বিরিয়ানি রান্না করে খাইয়েছেন। তাই আমিও খাওয়ালাম। হিসাব বরাবর।”
অভ্র বাঁকা হাসে। সে তার প্লেট থেকে পরোটা একটুকরো ছিঁড়ে সুরভির মুখের সামনে নেয়। বলে, “সেরাতে তুমি আমাকে নিজ হাতে খাওয়ানোর পরই বাসায় গিয়েছিলে। তাহলে এখানও হিসাব বরাবর করো।”
সুরভির গাল আরও ভার হয়ে যায়। সে জলদি করে খেয়ে নেয়। তারপর আবার বলে, “আমি সব হিসাব বরাবর রাখি। তাই খেয়েছি। বুঝেছেন? এখন আমি চা বানিয়ে আনছি।”
সে তাড়াহুড়া করে উঠে যেতে নিলে অভ্র তার হাত ধরে নেয়, “আমি তো তোমাকে ভালোও বেসেছি। সে হিসাব বরাবর করবে না?”
সুরভি কিছু বলতেও পারে না। সে লজ্জা পেয়ে বলে, “আমি চা বানিয়ে আনছি।” তারপর হাত ছাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যায় দ্রুত।
.
.
মায়া অফিস যাবার পূর্বে কল করে জোহানকে কিন্তু সে তার কলও কেটে দেয়। অফিসে যাবার পর সে জোহানের সাথে দেখা করতে চায় কিন্তু জোহান তাকে পরিপূর্ণভাবে এড়িয়ে যায়। সে যেয়ে কথা বলতে চাইলে সে অন্যকারো সাথে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অথবা কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে বিরক্ত হয়ে পড়ে জোহানের উপর। সে অন্তত কিছু তো বলবে।
চিন্তায় সে সকাল থেকে কাজে মন লাগাতে পাড়ছিল না। ধৈর্য্য হারিয়ে সে অবশেষে পিওন দিয়ে ডাকে জোহানকে। জোহান অনুমতি না নিয়েই তার কেবিনে ঢুকে পড়ে। ঢুকে দেখে মায়া রুমে চিন্তিত চেহেরায় পায়চারি করছে। সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “ডেকেছিলে?”
তার কন্ঠ শুনে মায়ার নিশ্বাস আসে। সে জোহানকে দেখে দ্রুত তার কাছে আসে। সে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে তোমার? তুমি আমার কল ধরছ না, আমার সাথে কথা বলছ না, ইগনোর করছ আমায়। কেন? কারণটা কী বলোতো।”
জোহান তার সাথে চোখ মেলায় না। কেবল মৃদু কন্ঠে বলে, “আই থিংক আমাদের বেশি দেখা করা উচিত না। গতকাল রাতে যা ভুল হয়েছিল, তা আমি চাই না আর কখনো হোক। আমাদের আর বেশি সময় কাটানো উচিত হবে না। তুমি জানো আমার তোমার প্রতি অনুভূতি আছে। আমিও জানি তোমার মনে আমার জন্য অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে। কিন্তু আমার একে অপরের জন্য তৈরি হই নি। আমাদের কারও অতীতই সুখময় ছিলো না যে অপরজনের হৃদয়ের কষ্টকে দূর করতে পাড়ব।”
মায়া তার দিকে নি:স্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের ভেতর প্রচন্ড রকমের ব্যাথা হচ্ছে। ক
জোহান আবার বলে, “মায়া বুঝতে চেষ্টা করো আমি জীবনে যাকেই ভালোবাসি সেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আর আমি তোমাকে হারাতে চাই না। আমরা অনুভূতিগুলোকে আমাদের হৃদয়ে দাবিয়ে রেখে কেবল বন্ধু হয়েই তো সারাজীবন কাটাতে পারি। আমার এখন আর ভালোবাসার উপর বিশ্বাস নেই। আমার নিজের উপরই ভরসা নেই। আমি কাওকে সারাজীবন ভালোবাসতে পারবো কি-না তাও জানি না। আমি ওয়াহিদের মতো তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। তোমাকে ওয়াদা করলে সে ওয়াদা আমি রাখতে পারব কি-না জানি না। তোমার প্রতি এখন আমার অনুভূতি আছে, কিন্তু এটা কেবল কিছুদিনের অনুভূতি হলে তখন?”
মায়া স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সে কিছু বলতে পারে না। হঠাৎ সে অনুভব করে তার গাল ভিজে গেছে। সে নিজের গালে আঙুল ছোঁয়ায়। তারপর বিস্ময় নিয়ে তার আঙুলের ডগায় নোনাপানি দেখে। এই কয়েক বছরে এই পর্যায়ে আসার জন্য সে কতকিছু সহ্য করেছে তবুও সহজে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে নি। কিন্তু আজ তার চোখ দিয়ে জল পড়লো।
তার চোখ দিয়ে আবারও জল গড়িয়ে পড়ে তার গালে। জোহান তার হাত উঠিয়ে মায়ার গালে হাত রাখে তার কান্না মোছার জন্য, “প্লিজ তুমি কান্না করো না। আমি তোমাকে কষ্ট না দেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো….”
মায়া তার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। নিজের গাল মুছে বলে, ” মনে আছে তোমাকে আমি একবার বলেছিলাম যে আমি নিজেকে ভালোবাসা শিখে গেছি। তোমার সাথে সময় কাটানোর পর হয়তো নিজের প্রতি ভালোবাসাটা কমে গিয়েছিল কিন্তু আমারই ভুল ছিলো।”
জোহান তার দুই হাত ধরে বলে, “আমি কেবল নিজের স্বার্থের জন্য এমনটা বলছি না। আমি আমাদের দুইজনের ভালোর জন্য বলছি। তুমিও জানো, ভালোবাসা কষ্ট ছাড়া কিছু দেয় না।”
“তুমি যখন তা জানো তাহলে আগেই কেন দূরে সরে যাও নি?”
জোহান তার প্রশ্ন শুনে চোখ সরিয়ে নেয়, বলে, “সরি… তখন আমি বুঝি নি।”
মায়া তাচ্ছিল্য হাসে, “সরি? আবার সে সরি? একটা শব্দ থেকে এর পূর্বে কখনো আমার এত ঘৃণা হয় নি। তোমার যদি কমিটমেন্ট ইস্যু থাকে তাহলে তোমার প্রয়োজনই ছিলো না আমার কাছে আসার, আমার এত যত্ন করার, আমার মনে আসার প্রদীপ জ্বালানোর যে আমি আবারও কখনো ভালোবাসা পাবো। তুমি বলছো তুমি ওয়াহিদের মতো আমার মন ভাঙতে চাও না? তুমি তো আরও জঘন্য ভাবে আমার মন ভেঙেছ। অন্তত ও আমাকে কখনো ভালোবাসার কথা তো বলে নি। তুমি তো আমার চোখে ডুবে থাকতে চাইতে তাই না? আমার চোখ তো তোমার জন্য মায়ার সাগর ছিলো। সে চোখেই জল এনে দিলে?”
“মায়া বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। আমার কারণে তোমার চোখে পানি আসবে এটা আমি কল্পনাতেও আনি নি। প্লিজ মায়া আমরা যাস্ট ফ্রেন্ড থাকি। আই প্রমিজ আমি এরপর আর কখনো তোমার চোখে পানি আসতে দিব না।”
“তুমি আমার চোখে পানি আসতে দিবে না? তুমি কে?তুমি ভাবছ তোমার জন্য আমি দ্বিতীয়বার কাঁদবো? আমার অনুভূতিকে তোমার নিয়ন্ত্রণে দিয়ে আমি ভুল করেছিলাম। এই ভুল আমি দ্বিতীয়বার করব না। আজ থেকে তোমার ও আমার পথ আলাদা। মায়া চৌধুরী নিজের অনুভূতির দাসী না। তোমার ভালোবাসা পেলেও আমি বাঁচতাম, তোমাকে ছাড়াও আমি বাঁচবো।” সে জোহানের শার্টের কলার ধরে তার চোখে চোখ রেখে বলে, “তুমি জানতে চাইতে আমি কেন তোমার চোখে তাকিয়ে থাকি না? কারণ আমার বেখেয়ালি মন তোমার ভালোবাসার খাঁচায় বন্দী ছিলো। তোমার চোখে তাকিয়ে থাকলে আমার হৃদয় কেঁপে উঠতো। আমি তাকিয়ে থাকতে পাড়তাম না। আর জানো আজ কেন তোমার চোখে এভাবে তাকিয়ে থাকতে পাড়ছি। কারণ এই মুহূর্ত থেকে। আমার মন উড়াল দিয়েছে তোমার ভালোবাসার খাঁচা থেকে। মরে গেছে আমার ভালোবাসা, শেষ হয়ে গেছে। যেমনটা তুমি চাইতে।” সে জোহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আর বলে, “আজ থেকে তুমি আমার কোম্পানির আর্টিস্ট ছাড়া কেউ না।”
সে নিজের চেয়ারে যেয়ে বসে, কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে, “গেট লস্ট।”
“মায়া আমার কথা তো বুঝা….”
মায়া উচ্চস্বরে বলে, “গেট লস্ট।”
জোহান তার দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে চলে যায়। আর মায়া আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করে। সে ফাইলের একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। আর চেষ্টা করে নিজের কষ্ট ভুলাতে। কিন্তু পেরে উঠে না সে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তেই থাকে। সে বহু চেষ্টা করে চোখের জলকে থামানোর। বেহায়া মনকে বুঝানোর। কিন্তু পাড়ছে না সে। তার বুকের ভেতর হাহাকার তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার কান্না করার জন্য কিন্তু সে পারে না। সে টেবিলের নিচে যেয়ে বসে দাঁত দিয়ে হাত কামড়ে ধরে কান্না করতে থাকে। যেন কেউ না দেখতে পায় তার কষ্ট, তার অসহায়তা। সে এই পৃথিবীর সামনে যতই শক্ত হোক তারও তো অনুভূতি আছে। তারও কষ্ট হয়। এটা কেও কেন বুঝে না?
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ]