অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
অভ্র সুরভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার যাওয়াই লাগবে?”
“অফিস থেকে ছুটি নেবার পরও ডেকেছে তাহলে না গেলে কীভাবে হয় শুনি? অবশ্যই কোনো জরুরী কাজ আছে।” সুরভি তার ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত।
“সময় আছে তো।”
“আগে দিয়ে গেলে কাজ তাড়াতাড়ি সেরে যায়।”
“আমার কাছে একটু থেকে গেলে হয় না?” অভ্রর মুখে কথাটা শুনে সুরভি তাকায় তার দিকে। তার তাকিয়ে থাকা দেখে লাজুক হাসি দিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
অভ্র বলে, “তোমার জিদের কারণে, নাহলে আমার এক কলে তোমাকে নিজে এসে ছুটি দিতো তোমার অফিসের বস।”
“আমার নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য পরিশ্রম করতে ভালো লাগে বুঝলেন? দেখেন একদিন আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করবোই। টিভিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় রিপোর্টা….” হঠাৎ থেমে যায় সে। তার মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। সে অভ্রর দিকে তাকায়, উৎসুক দৃষ্টিতে। তার মুখ দেখেই অভ্র বলে দিতে পারে, “তোমার মাথায় নতুন কি বুদ্ধি এলো?”
“মেঘলা আপুকে যদি আমরা আমাদের চ্যানেলে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকি? সেখানে কথা বলতেও কষ্ট হবে না?”
“মেঘলাকে একা ছাড়বে তৌফিক? এটা কীভাবে মনে হয় তোমার? একতো তৌফিক মেঘলাকে ছাড়ে না। এর উপর ও শপিং এ গেলেও সেদিন শপিং মল বন্ধ করিয়ে রাখে। সাথে আশেপাশে দশটা বডিগার্ড থাকে। আর তুমি কেবল ওকে ডাকলে তৌফিকের টার্গেটে তুমি আসবে না?”
“তাহলে আরও কিছু ফিল্ডের নারীদের ডাকলাম। সামনে নারীদিবস আসছে। সেখানে কোনো একভাবে তাকে আলাদা করে নিব। লেডিস রুমে নিশ্চয়ই বডিগার্ড আসবে না।”
অভ্র বিষয়টা নিয়ে ভাবছিল। তখনই সুরভি বলে, “মেঘলা আপুকে আমার নিজেই ডাকতে হবে এমনটা নয়। আমি আমার সিনিয়রের কানে এই প্রাপোজাল দিলে উনি নিজেই তা নিজস্ব নামে করে নিবে।”
” কিন্তু কথা হলো তৌফিক কী কারণে মেঘলাকে আসতে দেবার জন্য রাজি হবে?” অভ্র প্রশ্ন তুলে নিজেই বলে, “সে আইডিয়া আমি খুঁজে নিব। কিন্তু এসব তুমি একা করতে পারবে না। আর আমরা কেউ থাকলে সন্দেহ বাড়বেই তৌফিকের। এমন কাওকে লাগবে যে ট্রাস্টেড। ইনারাকে বলে দেখব?”
“ও প্রেগন্যান্ট। ওকে আপাতত এসবে জড়াতে চাই না। ওকে কোনো ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না আমি। আমি কাওকে খুঁজে নিব। আপনি চিন্তা করেন না।”
“কাওকে খুঁজলেই তো হবে না। বিশ্বাস করার মতো কাওকে লাগবে। সাথে সাহসী এবং বুদ্ধিমানও।”
“এই তিনটা শব্দ শুনে ইনারার কথাই মাথায় এসেছে কিন্তু ওকে আমি এসবে জড়াতে চাই না। আপাতত আমার জন্য ও এবং ওর বাচ্চা সবচেয়ে বেশি জরুরী।”
“ওর সুরক্ষা আমার জন্যও ফার্স্ট প্রায়োরিটি। ওর গর্ভে আমার ভাইয়ের অংশ আছে।”
সুরভি ককথাটায় মুচকি হাসে। ডাইনিং টেবিলে কণুই রেখে গালে হাত রেখে দুষ্টুমির সুরে বলে, “আপনি সভ্য ভাইয়ার প্রতি এতটা যত্নশীল তাহলে দেখান না কেন? আপনার ইগোতে আঘাত পড়বে একারণে?”
অভ্রও বাঁকা হেসে তার কণুই টেবিলে রেখে একই আন্দাজে উত্তর দেয়,, “ইগো এতই গুরুত্বপূর্ণ হলে তোমাকে বলতাম না যে তোমাকে ভালোবাসি। ওয়েট বলেই বা কি হয়েছে আমার উওরটাই পেলাম না।”
সুরভি ঘাবড়ে যায়। সে এদিক-ওদিক তাকায়, উঠে দাঁড়ায় এবং নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আমতা-আমতা করে বলে, “আমার যাওয়া উচিত না?”
“যেতে দেওয়া তো উচিত না। কিন্তু এখন তোমাকে আটকালে মনে মনে আমাকে মন্দগাল করবে।”
“তাহলে আমি আসি।” সুরভি পিছনে ঘুরে যেতে যেতেও অভ্রকে মনে মনে বকেই, “একবার মানা-ও করে নি যেতে। উল্টো কি ফালতু বাহানা! আমি না’কি তাকে মন্দগাল করব। আমি কখনো কাওকে বকুনি দেই না’কি আজব! নিজেও নিশ্চিত চাইতো আমি চলে যাই।”
হঠাৎ তার কানের কাছে ভেসে উঠে অভ্রর কন্ঠ, “মনে মনে এত কি ভাবছো তুমি? আমাকে বকছো না’কি শুনি।”
সুরভি ঘাবড়ে গিয়ে পিছনে তাকিয়েই অভ্রকে দেখতে পায়। তার রুহ কেঁপে উঠে। বক্ষপিঞ্জরে তার নরম।হৃদয়টা লাফিয়ে উঠে হঠাৎ করেই। খুব কাছ থেকে অভ্রকে ভীষণ আকর্ষণীয় দেখায়।
অভ্র তার চাওনি দেখে আরেকটু নিচু ঝুঁকে আসে। দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, “এভাবে দেখো না, প্রেমে ডুবে যাবে।”
সুরভি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। পরের মুহূর্তে আবার তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনার প্রেমে পড়ব আমি? স্বপ্নে দেখেন।”
“প্রতিদিন দেখতে ইচ্ছা করে। যেদিন স্বপ্নে তুমি আসো সেদিন ভালো ঘুম হয়।”
“যত্তসব আজাইরা কথাবার্তা।” সুরভি কথাটা বললেও সামনের দিকে মুখ ফিরাতেই সে লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
অভ্র তার থেকে এগিয়ে যেয়ে সুরভির জন্য দরজা খুলে দেয়। সুরভি বের হবার পর অভ্রও বের হয় তার পিছে।
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“তোমাকে অফিসে দিতে।”
“আমি নিজেই যেতে পাড়ব। এছাড়া আপনার ড্রাইভার বডিগার্ড কেউ নেই। কেউ আপনাকে দেখলে ঝামেলা হবে।”
“আমার কাছে ব্লাক উইন্ডোর গাড়ি আছে। সো ডোন্ট ওয়ারি, কোনো সমস্যা হবে না। আমি এসবের বিশেষ খেয়াল রাখি।”
“আপনার তো আজকে রেস্ট ডে, অকারণে আমার জন্য কষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”
“তোমার সাথে সময় কাটালে এমনিতেই আমার সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।” বলে সে দরজা লক করে চলে যায়। তার পিছনে সুরভিও আসে। সে হাত দিয়ে নিজের দুই গাল ধরে দেখে। তার গাল দুটো উষ্ণ হয়ে ছিলো। সে বিড়বিড় করে বলে, “লোকটা এতটা খারাপও নয়। একটু একটু তো কিউট আছে।”
তারা গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে অন্য এক রাস্তা দিয়ে বের হয়। সুরভি খেয়াল করে অভ্রর এই গাড়িটা আলাদা। এই গাড়িটা আগে সে দেখে নি। এছাড়া তারা অন্য রাস্তা দিয়ে কেন যাচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। তাই সে কৌতুহলবসত জিজ্ঞেস করেই বসে, “আচ্ছা আমরা অন্য রাস্তা দিয়ে কেন যাচ্ছি? আর আপনার এই গাড়িটাও আগে দেখিনি।”
“কিডন্যাপ করছি তোমাকে।” অভ্র বলে দুষ্টুমি এক হাসি নিয়ে। যা সুরভির ভালো লাগে। সাধারণত সে অভ্রকে এভাবে দেখে না। সে বেশিরভাগই গম্ভীরমুখে থাকে। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরা থাকে বেশিরভাগই। অথচ আজ সে কালো রঙের শার্ট পরেছে। তাকে ভীষণ সুদর্শন লাগছে বলতে হবে। বিশেষ করে তার হাসিরটা মারাত্মক।
“কী ভয় লাগে?” সুরভি যখন তার দিকে তাকিয়ে ছিলো এক নাগারে তখন প্রশ্নটা করে বসে অভ্র। সুরভি তার থেকে চোখটা সরিয়ে নেয়।
সে উওর দেয়, “আপনার উপর এতটুকু তো ভরসা আছেই।”
অভ্র তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে আবার সামনে তাকায়। বলে, “এই গাড়িটা আমার নিজের ফার্স্ট ইনকাম দিয়ে কিনেছিলাম দেশে এসে। আমার যখন ঘরে একা একা দম বন্ধ হয়ে আসে তখন গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াই। মাঝেমধ্যে খুব দূরে চলে যাই একা একা। ব্লাক গ্লাসের কারণে কেউ আমাকে দেখতে পারে না, কিন্তু আমি সব দেখতে পাই। মাঝেমধ্যে নীরব কোনো স্থান পেলে সেখানে নেমে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেই। আমার আবার বন্ধ ঘর পছন্দ ছিলো না কখনো। কিন্তু কিছু কাজ আছে যে কাজের পরিবর্তে আপনার ব্যক্তিগত জীবন বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু এই গাড়িটার সাথে আমি আমার সে ব্যক্তিগত সসময়টুকু কাটাই। তাই এই গাড়িটি আমার ভীষণ প্রিয়। যদিও এই গাড়িটি কখনো আমার সাথে অন্যকোনো সঙ্গী পায়নি। তবে আজ পেলো। আমার প্রিয় গাড়িতে আমার প্রিয়জন প্রথম আমার পাশে বসেছে।”
সুরভির গাল উষ্ণ হয়ে যায়। সে অভ্রর দিকে মুচকি হেসে আবার নিচের দিকে তাকায়। নিজের আঙুল দিয়ে কিছু চুল কানের পিছে গুঁজে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “আজকাল আপনি অন্যরকম কথা বলছেন না?”
“দোষ তো তোমার। আমি তো লুকিয়েই রেখেছিলাম নিজেকে। তোমারই আমাকে চেনার আগ্রহটা বেশি ছিলো। এমনি এই অন্যরকম ভাবটা তোমার ভালো লেগেছে না খারাপ?”
“ভাবতে হবে।”
“সাথে এটাও ভেবো, আমার প্রিয় গাড়িতে প্রিয়জন কোনো একদিন আমার সাথে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে না’কি?”
“একপাশে রেখে দিন। আমার অফিস এসে পড়েছে।”
অভ্র অপেক্ষায় থাকলেও সে উওর পায় না। সুরভি তার ব্যাগে সব গুছিয়ে দরজা খুলে নামতেই নেয়। হতাশ হয় অভ্র। তখন সুরভি বলে, “কখনো গেলে আপনি এই কালো শার্টটাই পরে এসেন। আপনাকে মানায়। আসি…ড্রাইভের জন্য থ্যাঙ্কিউ।”
বলে সুরভি একরাশ হাসি নিয়ে নেমে যায়।
আর অভ্র গাড়ির তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ সে যখন বিল্ডিং এর ভেতর প্রবেশ করে তখন সে সামনের লুকিং মিররের দিকে তাকায়। তাকে কি এই শার্টে আসলেই এত মানিয়েছে?
.
.
মায়া পিপ-হোল দিয়ে দরজার ওপাশে জোহানকে দেখে অবাক হয়। সাথে বিরক্তও হয়। গতকাল নিজেই বলল আমাদের দূরে থাকা উচিত আর এখন নিজেই তার বাসায় এসে হাজির। সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে রূক্ষ স্বরে বলে, “তুমি এখানে কী করছ?”
জোহান তার ফোনটা উঁচু করে একটি মেসেজ দেখায় মায়াকে। আশরাফের মেসেজ, “ব্রো আমরা তিনজনই মায়ার বাসায়। আমাদের বিয়ের প্লানিং করতে এসেছি। তুমিও এসে পড় জলদি করে।”
মেসেজটা দেখে মায়া বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে যায়। দরজা খোলা রেখেই।
জোহান বাসার ভেতরে ঢোকে মেসেজটির দিকে তাকায়। আশরাফ তাকে মেসেজ দিয়েছিল প্রায় আধাঘন্টা হবে। সে প্রথমে আসতে চায় নি। মায়ার মুখোমুখি হবার ইচ্ছাটা তার ছিলো না। তাই সে অন্যকিছুতে ধ্যান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে কোনো কিছু তে মনোযোগ দিতে পাড়ছিল না। এমনকি গানেও না। তার বারবার মায়ার কথা মনে পড়ছিল, তাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাই সে না পেরে চলে আসে এখানে।
ড্রইংরুমে এসে দেখে সবাই গোল করে নিচে বসে আছে। তাদের সামনে কতগুলো কার্ড। সে রুমের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করে, “কি করছ তোমরা?”
মেহেদী তাকে দেখে উঠেই জড়িয়ে ধরে, “জোহান ভাই অবশেষে তুমি এলে। আমি তো ভেবেছিলাম আসবেই না।”
“একটু কাজ ছিলো তাই দেরি হয়ে গেল।”
মেহেদী মায়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “কি’রে তুই মিথ্যা বললি কেন? জোহানই তো এসেছে। আর আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কে এলো? তুই বললি, জানি না।”
মায়া তাকে পাত্তা না দিয়ে কার্ড দেখতে শুরু করে।
জোহান মেহেদীর পাশে বসে। মায়ার দিকে তাকায় কিন্তু মায়ার নজর কেবল তার হাতের কার্ডের দিকে।
সে আবারও জিজ্ঞেস করে বসে, “এগুলো কীসের কার্ড?”
আশরাফ জানায়, “ব্রো আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হওয়া অনুষ্ঠানের কার্ড। তুমি তো জানো আমাদের ইচ্ছা ছিলো দুই-চারবছর পর ফ্যামিলি আর কাছের ফ্রেন্ডদের নিয়ে বিয়ে করার। কিন্তু ফ্যামিলি প্রেশারে এখন করতে রাজি হলাম। এর উপর ধুমধাম করে বিয়ে করতে হবে। আমাদের বিয়েতে খেয়েদেয়ে ঘুরেফিরে যেন মানুষ আমাদের সমোচলনা করতে পারে তার ব্যবস্থা করছি। আগামী মাসেই এনগেজমেন্ট। আর একমাস পর বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। তুমি কিন্তু পারফর্ম করবে প্রমিজ করেছিলে। মনে আছে তো?”
“অফকোর্স করবো।”
মেহেদী উৎসুক সুরে বলে, “অস্থির একটা আইডিয়া আছে। জোহানের বেশিরভাগ গানেই ফিমেল সিঙ্গার আছে। তো আমাদের মায়া যদি জোহানের সাথে গান গায় তাহলে কেমন হয়?”
তন্নিও সহমত হয় তার সাথে, “তোর মাথায় এত ভালো আইডিয়া আসবে আশা করার মতো ছিলো না। সে নৌকাতে ওদের গান শুনেছিলাম না? মুগ্ধ হবার মতো মুহূর্ত ছিলো।”
“একদম ফালতু আইডিয়া।” মায়া বলে উঠে। সাথে আরও যোগ করে, “আমি কারো সাথে কোনো গানটান গাইব না।”
“তোর আবার কী হলো?” তন্নি প্রশ্ন করে।
“কিছু হয় নি। যে কারণে এসেছিস তার দিকে ধ্যান দে, নাহয় বাসায় যেয়ে আন্টির বকুনি খাবি। কার্ড সিলেক্ট কর।”
মেহেদী আরও উৎসুক স্বরে বলে, “আমাদের গ্রুপের প্রথম বিয়ে। মায়া সবকিছু ভালো করে দেখে নে, এরপর তোরই পালা।”
“কেন তোর বিয়েতে আবার কী এলার্জি হলো?”
“আরে আমার কাছে তো মেয়ে নেই। কিন্তু তোর জন্য তো আতিফ এক পা’য়ে খাড়া।”
“আতিফ?” জোহান প্রশ্ন করে, “এই আতিফ কে?”
“আশরাফের কাজিন। ইটালিতে অনেক ভালো ডাক্তার। মায়ার উপর পুরাই লাড্ডু। কিন্তু মায়া তার প্রেমের উওরই দেয় নি। তাই দুইজনে ঠিক করেছে মায়া ত্রিশ বছর পর্যন্ত কাওকে বিয়ে না করলে মায়া আতিফকে বিয়ে করবে। আচ্ছা মায়া বলতো, যদি এর পূর্বে তুই অন্য কাওকে ভালোবাসিস তাহলে কী হবে?”
মায়া তার কথা শুনে কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে তাকায় জোহানের দিকে। জোহান তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তার উওরের অপেক্ষায় ছিলো না’কি? সে চোখ সরায় না, পলক নামায় না, জোহানের দিকে তাকিয়েই অনুভূতিহীন স্বরে বলে, “ভালোবাসা সবার জন্য হয় না। কেউ সারাজীবনে ভালোবাসা পায় না, আর কেউ ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না। আর যারা ভালোবাসার মূল্যায়ন করতে জানে না তারা ভালোবাসার যোগ্যই না।”
জোহান চোখ নামিয়ে নেয় তার কথা শুনে। মায়াও আবার তার সামনের কার্ডগুলো দেখতে থাকে।
তন্নি চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে মায়াকে, “তোর কি কিছু হয়েছে?”
কিন্তু মাদবুরি করে উওর দেয় মেহেদি, “আরে ওর সঙ্গদোষ হয়েছে। সারাদিন জোহানের সাথে থেকে আবেগের কথাও বলতে শিখে গেছে। অফিসেও জোহান, পাশের বাসায়ও জোহান, আর ফ্রী টাইমেও এখন জোহানের সাথে সময় কাটায়। আচ্ছা জোহান ব্রো শুনো, একটা ভালো প্রস্তাব দেই। আতিফ যদিও আমার অনেক পছন্দ কিন্তু তুমি তো আমার ফেভারিট তাই তোমার কখনো যদি ওরে পছন্দ হয় নিশ্চিন্তে আমার কাছে এসে পড়বা। তোমাকে আমার দুলাভাই বানানোর দায়িত্ব আমার।”
মায়া রেগেমেগে মেহেদীর উপর কতগুলো কার্ড ছুঁড়ে মেরে বল, “মেহেদীর বাচ্চা তুই এখন তোর মুখের তালা বন্ধ না করলে তোকে ফুটবল বানিয়ে লাথি মেরে মেরে
বাসা থেকে বের করে দিব।”
মেহেদী তারপরও বলে, “মায়ার নাকে রাগ সারাক্ষণ টুস করে বসে থাকলেও মেয়েটা আমাদের এত ভালোবাসে তাহলে চিন্তা করো নিজের জামাইকে কত ভালোবাসবে।”
“তোকে শিক্ষা না দিলে তুই ভালো হবি না-তো। দাঁড়া তুই…” মায়া তাকে মারার জন্য উঠতে নিলে তন্নি তার হাত ধরে নেয়। তাকে বুঝিয়ে বলে, “ও তো এমনিতেই মজা করছে। তুই শান্ত হ। চল আমরা টুকটাক নাস্তা নিয়ে আসি।”
মায়া আবার মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বলে, “বেঁচে গেলি, নাহলে তোর আজ খবর ছিলো।”
মায়া তন্নির সাথে যাবার পর কফি বানায় এবং কিছু ফ্রোজেন ফুড বের করে ভাজার জন্য। তন্নি সাহায্য করছিল তার৷ তন্নি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, “সব ঠিক আছে রে?”
মায়া থমকে যায় এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করে, “মানে?”
“মানে তোর আর জোহানের মধ্যে কিছু হয়েছে? তোদের মধ্যে কিছু একটা চলছে।”
“তেমন কিছু না।”
তন্নি মায়ার কাঁধ ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, “তুই আজ পর্যন্ত আমার থেকে কিছু লুকাস নি। আমার বিশ্বাস কখনোই লুকাবি না। আমি জানি তুই ওকে পছন্দ করিস। তুই শুধু বল, ও যদি তোকে কষ্ট দিয়ে থাকে তাহলে ওর সাথে সকলের সম্পর্ক নিমিষে ভঙ্গ করে দিব। আর কেউ কখনো ওর সাথে যোগাযোগ করব না।”
মায়া তার কথা শুনে কিছু মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে অন্যদিকে ফিরে আবারও আগের কাজ শুরু করে এবং উওর দেয়, “আসলে আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি যা আমি চাই না একারণে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি।”
“যা তুই একদমই ঠিক করছিস না। একটা ইন্সিডেন্টের কারণে তুই নিজের জীবন এমন থামিয়ে রাখিস না। আমি জানি আতিফ অনেক ভালো ছেলে, আর তোকে অনেক সুখেও রাখবে কিন্তু এত বছরে এক মুহূর্তের জন্যও আমি তোর দিক থেকে ওর প্রতি কোনো অনুভূতি দেখি নি কিন্তু জোহানের জন্য আমি তা তোর চোখেমুখে স্পষ্ট দেখতে পারছি। তুই ওকে ভালোবেসে ফেলেছিস। জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না রে। তুই নিজের অনুভূতিটাকে সারাজীবন খাঁচায় বন্দী করে রাখতে পারিস না। এক না একদিন তোকে…. ”
মায়া তাকে থামিয়ে বলে, “আমার সময় দরকার। আমি এখন হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছি না। আর তুই এখন আমার চিন্তা না করে নিজের বিয়ের দিকে ধ্যান দে। আর বল শপিং এ কবে যাবি? আমার বহুত শপিং বাকি। আই তো কোন ফাংশনে কি পরব সব ডিসাইড করে ফেলেছি।”
“তুই ডিসাইড করে ফেলেছিস? আমি তো ভাবিও নি।
“ভাই আমার বেস্টফ্রেন্ডদের বিয়ে বলে কথা, আমাকে তো বোম্ব ডট কম লাগতে হবে। তোর বিয়েতে আর তোকে কে দেখবে বল? তুই তো বিবাহিত হয়েই যাচ্ছিস। সবাই নজর তো জামাইয়ের শালীর দিকেই থাকবে।”
“সবার তো জানি না কিন্তু সারাক্ষণ জোহানের নজর কিন্তু তোর দিকেই থাকে। আজও কীভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাচ্ছিল দেখেছিস?”
মায়ার হাসিমুখটা আবারও মলিন হয়ে যায়। সে তন্নির হাতে কফির মগ দিয়ে বলে, “তুই আগে ওদের কফি দিয়ে আয় তো, আর আমি এই খাবারগুলো ভাজি। নাহলে ক্ষুধার্ত বান্দরদের মতো লাফাতে শুরু করবে একটু পর।”
সে তন্নিকে পাঠানোর পর হাফ ছাড়ে। রান্নাঘরের আড়ালে থেকে এক পলক তাকায় জোহানের দিকে। গভীর নিশ্বাস ফেলে, বলে, “আমি তোর সাথে মিথ্যা বলতে চাইনি কিন্তু তোর এই বিশেষ সময়ে তোর আনন্দটা আমি নষ্ট করতে চাই না। তোকে যা বলার আমি তোর বিয়ের পর বলব।”
সন্ধ্যার পর তন্নি, আশরাফ, মেহেদী চলে যাচ্ছিল। তাদের বিদায় দিতে নিচে আসে মায়া ও জোহান। মেহেদী বলে, “আমার তো যাওয়ার ইচ্ছা নেই তোরা আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিস কেন বলতো?”
তন্নি তার হাত খামচে ধরে বলে, “তোকে আমাদের দরকার একারণে নিয়ে যাচ্ছি। বুঝ একটু।”
“তাহলে মায়াও তো আমাদের সাথে যেতে পারে। ওকে কেন নয়? কাল তো ওরও বন্ধ।”
আশরাফ তখন বলে, “কারণ আমার বাবা স্পেশালি তোর কথা বলেছে। যেহেতু জায়গা সেলেক্ট করতে হবে। বাবা বলেছে তুই-ই কাজটা বেস্ট করতে পারবি।”
“আংকেল বলেছে? দেখলি আমার কত ডিমান্ড সব জায়গায়। আচ্ছা আমি গাড়িতে বসছি তোরাও আয়।” বলে সে ভাব নিয়ে যেয়ে বসে গাড়িতে।
আশরাফ ও তন্নি তাদের যেমন তেমন করে বিদায় জানিয়ে দ্রুত এসে গাড়িতে বসে। তন্নি আশরাফকে বলে, “এই ফালতুটাকে ওর বাসার সামনে ফিক্কা মারবি। আমার সব প্লানিং এর বারোটা বাজায় দিচ্ছিল এখনই।”
মেহেদী পিছনের সিটে বসে ছিলো। তন্নি কথা শুনে সে লাফ দিয়ে সামনের দুই সিটের মধ্যে মুখ বের করে অবাক হয়ে তাকায় তাদের দিকে, “আমি কী করলাম?”
“মায়া ও জোহান যেন একসাথে সময় কাটাতে পারে তাইতো আমরা জলদি এসে পড়েছি।”
“ওহ….কিন্তু কেন? তাহলে কি আংকেল আমাকে ভেন্যু ডিসাইডের দায়িত্ব দেয় নি?”
“তোর ব্রেন একটু তাড়াতাড়ি কাজ করে ফেলল না? আশরাফ গাড়ি স্টার্ট কর তো।”
তাদের যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে মায়া। তারা যাওয়ার পর সে তার পাশে তাকায়, দেখে জোহান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ পড়ে। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বিরক্তির সুরে জোহানকে বলে, “যদিও তোমার চেহেরা দেখার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট আমার নেই কিন্তু তবুও যদি পারো তন্নি, আশরাফের বিয়ের আগ পর্যন্ত ওদের সামনে আমরা আগের মতো নরমাল বিহেভ করব। আর যদি তোমার সমস্যা হয় তাহলে প্রয়োজন নেই। কেবল দয়া করে তুমি ওদের আমাদের মধ্যে যা হয়েছে….মানে এই কয়দিনের ব্যাপারে কিছু বলো না।”
বলে সে যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে নেয়। মায়া পিছনে ফিরে তাকায়, ” কিছু বলার আছে?”
জোহান মাথা নাড়ায়। তার কিছু বলার নেই।
মায়া কিছু মুহূর্ত অপেক্ষা করে জোহানের হাত ছাড়ার। জোহান তার দিকে তাকিয়ে থাকে, হাত ছাড়ে না। মায়া বিরক্তির সুরে বলে, “কিছু বলার না থাকলে হাত ধরে আছো কোন দু:খে? হাত ছাড়ো।”
জোহান তার কথা শুনে লজ্জায় পড়ে যায়। সে না চাওয়া সত্ত্বেও মায়ার হাত ছেড়ে দেয়। মৃদুস্বরে বলে, “আমরা কি আবার আগের মতোই থাকতে পারি না?”
মায়া তার কথায় তাচ্ছিল্য হাসে, “তুমিই গতকাল বলেছিলে আমাদের একে অপরকে ইগনোর করা উচিত।তাই না?”
“কিন্তু এখন কেন যেন আমার ভীষণ অস্থির লাগছে। কিছুক্ষণ পর পর হৃদয়ে চিন করে ব্যাথা উঠে। হঠাৎ করে মনে হয় আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।”
“আমাকে কি ডক্টর মনে হয় যে আমি তোমার ট্রিটমেন্ট করব?”
“আমি তা বলিনি।”
“তো কি বলছো আমি বুঝতে পারছি না।”
“আমি কেবল চাচ্ছি আমরা আগের মতো হয়ে যাই। আগের মতো একসাথে সময় কাটাই।”
“ওহ প্লিজ… তুমি আমাকে তোমার আগের গার্লফ্রেন্ডদের মতো ভেবো না যাকে যখন ইচ্ছা তুমি পুতুলের মতো নাচাবে। যখন ইচ্ছা কাছে টানবে আর যখন ইচ্ছে দূরে ঠেলে দিবে। আমি তোমার প্রেমে কোনো হাবুডুবু খাচ্ছি না। তুমি নিজের ভুলটাও বুঝো নি। তুমি কেবল ভাবো তুমি যখন যা বলবে তাই হবে। তোমার সাথে সময় কাটানো তো দূরের কথা তোমাকে তো আমার বিষের মতো লাগছে। আগে ভেবে দেখো তুমি কি ভুল করেছ। সে ভুলের অনুতাপ করার পর একথা বলতে এসো আমায়।”
কথাগুলো বলে হুড়োহুড়ি করে চলে গেল মায়া। লিফটে উঠার পরও তাকে বেশ বিরক্ত ও রাগান্বিত মনে হচ্ছিল।
সে বাসায় ঢুকে সবার পূর্বে বেসিনের সামনে যেয়ে জোহানের ধরা হাতটা বারবার ধোঁয়। তার বেশ রাগ উঠছিল জোহানের উপর। সে কি আদৌও বুঝেছে মায়া কতটা কষ্ট পেয়েছে তার এমন কান্ডে। ভালোবাসা হয়তো এত কঠিন কিছু নয়, বিশ্বাসটাও সহজে যেতে পারে…. হয়তো। কিন্তু একদফা যে মনটা ভেঙেছিল তা তো বেশ সাধনার দ্বারা সংযত করেছিল মায়া। আপনজনদের থেকে বিশ্বাসঘাতকতা পাবার পরও তাকে দিয়েছিল এই জোড়া লাগানো মনটা খুব যত্নে। আর সে কী করল? এত সহজে ভালোবাসার প্রদীপ দেখিয়ে তার মনটা আঁধারে ঢেকে দিয়ে গেল?
মায়া রাগে-দুঃখে কাঁপছিল। সে কল ছেড়ে মুখে পানি দিতে থাকে। বারবার। সে আয়নায় তাকায় নিজের দিকে। নিজেকে দেখে তার আরও রাগ উঠে। এত বড় ভুল তার দ্বারা আবারও কীভাবে হলো? রাগের বশে সে একটি ছোট ফুলদানি আয়নায় মেরে দেয়। সাথে সাথে আয়নাটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
জোহান ছাদে উঠে কিনারায় বসে। পা ঝুলাতে ঝুলাতে সামনের বিল্ডিংগুলো দেখে। তার মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা যেদিন মায়াকে এই ছাদেই পেয়েছিল সে। সেদিন প্রথম কত কথা হয়েছিল তাদের। নতুন এক মায়ার সাথে পরিচিত হয়েছিলসে। সে তার পাশে তাকায়। হঠাৎ সেখানে মায়াকে কল্পনা করে। সে হাসছিল। তার হাসি দেখে জোহানের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে ওঠে আবার মুহূর্তে মলিনও হয়ে যায় যখন সে বুঝতে পারে সে কেমন মায়াকে কল্পনাই করছিল। দীর্ঘ এক নিশ্বাস মিশে যায় বাতাসের সাথে। সে মাথা তুলে তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। আজকে চাঁদের জ্যোৎস্না একটু বেশিই তীব্র। তার চাঁদ দেখাটা প্রিয় ছিলো। জ্যোৎস্নাময়ী চন্দ্ররাতের সৌন্দর্যই আলাদা। সে কখনো ভাবেনি এই সৌন্দর্য তার বুকে ব্যাথা বিঁধবে।
অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“বাবুটার তো খিদে লেগেছে আর কতক্ষণ?” ড্রইংরুমে সোফার উপর বসে অধৈর্য্য হয়ে বলে ইনারা।
“পাঁচ মিনিট।” রান্নাঘর থেকে শান্ত কন্ঠে উওর এলো সভ্যর।
“সে আধাঘন্টা ধরে পাঁচ মিনিটই লাগবে। এদিকে আমার পেটে গুড়ুম গুড়ুম করছে।”
এমন সময় কলিংবেল বাজায় ইনারা আবারও উঁচুস্বরে বলে, “কলিংবেল বাজছে।”
সভ্য দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে জোহানকে দেখে বেশ খুশি হয় সে, “আরে তুই এখানে? কী খবর তোর?”
তবে জোহান তার কথার উওর দেয় না। সে অবাক হয়ে দেখে সভ্যকে। হাতে বড় চামচ, এপ্রোণ ও মুখে আটা ভরা। সে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, “এ’কি অবস্থা তোর? কি হয়েছে?”
“আরে আমি একটু কিচেনে আছি তো রান্না করছিলাম ইনারার জন্য। তুই আগে ভেতরে তো আয়।”
” তুই আগে বল তোর এই কি অবস্থা!
স্টাফরা সব একসাথে ছুটি নিয়েছে যে তুই একা এসব করছিস?”
“আজ আমার অফিসের ছুটি তাই ইনারার খুব ইচ্ছে করছিল একসাথে সময় কাটানোর।”
“তাহলে আমি কি পরে আসব?”
তারা কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে। ইনারা জোহানের কথা শুনে বলে, “আরে নো প্যারা স্যারা। চিল করো আর চিপ্স খাও।”
“হ্যাঁ তুই ইনারার সাথে বসে গল্প কর আমি আসছি।”
সভ্য রান্নাঘরের দিকে যাবার পর জোহান এসে বসে ইনারার পাশের সোফায়।
“ক’মাস পর তোমার বাচ্চা হবে। তুমিই কার্টুন দেখলে বাচ্চাকে সামলাবে কি করে?”
“কোন ডিকশিনারিতে লেখা আছে যে কার্টুন দেখলে বাচ্চা সামলানো যায় না?”
ইনারার কথার ধরনে রাগান্বিত ভাব থাকায় জোহান একটু ভয়ই পায়। তাই সে আবারও বলে, “রাগ হচ্ছো কেন? আমি তো এমনিতেই বলছিলাম।”
“আমি বাচ্চা থাকতে পুরো ছয়মাস ধরে তোমাদের পাঁচজনকে সামলিয়েছি। এ হিসেবে আমি সবই সামলাতে পাড়বো। বুঝলা?”
“বুঝলাম।”
ইনারা মুহূর্তের মধ্যে একগাল হেসে তার সোফার শেষ প্রান্তে এসে বসে। অর্থাৎ জোহানের কাছে এসে বসে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তারপর আমার বোনের সাথে কেমন চলছে?”
জোহান অবাক হয়, “তোমার বোন?”
“মায়া….মায়া আমার কাজিন। তো বোনই তো। কী বলদ একটা ভাই তুমি!”
“ল্যাংগুয়েজ।”
“ভাই বলা মানা না’কি?”
“বলদ বলা মানা।”
“আগে বলো মায়াকে প্রাপোজ করেছ?”
প্রশ্নটা শুনতে অপ্রস্তুত হয়ে যায় জোহান। তার মায়ার কথা মনে পড়তেই মনটা কেমন উদাসীন হয়ে আসে।
সে চোখ নিচে নামিয়ে মিনমিনিয়ে উওর দেয়, “আমাদের মধ্যে এমন কিছুই চলছে না।”
উওরটা শুনে ইনারা নিরাশ হয়। সে মুখ গোমড়া করে বলে, “বলদ একটা।”
“কে বলদ?” সভ্য রান্নাঘর থেকে এপ্রোন খুলতে খুলতে আসে। এসে বসে ইনারার পাশে। ইনারা তখনও গোমড়া মুখে তাকে উওর দেয়, “তোমার বন্ধু।”
“দেখো ইনারা, অন্য যাই বলো বলদ বলবা না।” জোহান বলে।
“ঠিকাছে, বলব না।” ইনারা উওর দেয়। পরক্ষণেই বলে, “গর্দভ, স্টুপিড, বেক্কল।”
“দোস্ত তুই ওকে কিছু বলবি?”
ইনারা চোখ ঘুরিয়ে তাকায় সভ্যার দিকে। সভ্য হাসিমুখে মাথা নাড়ায়, “তোর মনে হয় আমার এত সাহস আছে? আচ্ছা পিজ্জা ওভেনে দিয়েছি। হতে সময় লাগবে। ততক্ষণ গার্ডেনে ঘুরে আসি?”
জোহানও রাজি হয়। তারা বাগানে আসার পর জোহান বলে, “বাগানটা তো খুব সুন্দর। আগে খেয়াল করিনি।”
“আমার মহারাণীর কাজ। তার তো ফুল ভীষণ পছন্দ তাই ভরে দিয়েছে।”
“সুন্দর হয়েছে। দেখে শান্তি লাগছে।”
“তাহলে এতক্ষণ তোর মনে কী নিয়ে অশান্তি ছিলো বল তো।”
“অশান্তি? না-তো।”
“ভাই আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব। তোর মুখ দেখে মনের অবস্থা বলে দিতে পাড়ি। বল কি হয়েছে?”
“ঠিক জানি না কি হয়েছ। কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তি লাগে আজকাল। বুকের ভেতরটা ভার হয়ে থাকে। আচ্ছা দোস্ত আমি কেন এমন? কখন কি করি নিজেও বুঝে উঠতে পারি না। কেউ আমার কাছে আসলে তাকেও দূরে সরে যেতে আমিই বাধ্য করি। সবাইকে হারিয়ে ফেলি৷ কেন?”
সভ্য তার কথা শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। সে হাত আড়া আড়ি ভাঁজ করে বলে, “কারণ তুই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিস না। তোর ভয় হয়, তুই আবার না আরেক ভুল করিস।”
জোহান বাগানের প্যাটিওতে যায়। সেখানের এক চেয়ারে
বসে গভীর নিশ্বাস ফেলে, “সো ট্রু। একারণেই তো আমাদের গ্রুপের মধ্যে কেবলমাত্র আমিই এখনো সেটেল্ড হতে পারি নি। না প্রফেশনাল লাইফে আর না পার্সোনাল লাইফে। তোরা সবাই কত এগিয়ে গেলি। আর আমি আজও সেখানেই রয়ে গেলাম।”
সভ্য তার সামনের চেয়ারে বসে, “হয়তো তোর ভাগ্যে আরও ভালো কিছু আছে।”
“আমার আর ভালো ভাগ্য। হোয়াট আ জোক! ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমার লাইফ একটা কমেডি হয়ে আছে।”
“লাইফ তোর, ডিসিশন তোর। যদি ভুল সিদ্ধান্ত নিস, জীবন তো তোর সাথে ন্যায় করবে না।”
জোহান গভীর নিশ্বাস ফেলে।
সভ্য আবারও বলে, “জীবন তো হারানোর ভয়েই কাটালি এবার নাহয় পাওয়ার আকাঙ্খা করে দেখ। অন্যদের খুশি করার চিন্তা না করে তোর মন যা বলে সেটা কর।”
জোহানের হঠাৎ প্রচন্ড মাথা ধরে। সে মাথা উপুর করে গভীর নিশ্বাস ফেলে, “আমি যা চাই তার কিছুই হয় না। আমি কখনো ওকে কষ্ট দিতে চাইনি। একারণে ওর থেকে দূরে চলে গেছি কিন্তু দূরে যেয়েও শেষমেশ ওকেই কষ্ট দিচ্ছি।”
“কার কথা বলছিস?”
জোহান মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। সে সভ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, “ইউ নো রাইট আই স্লেপ্ট ইউথ লট অফ গার্লস। আমি তা এখন রিগরেট করি। কিন্তু সত্যি বলছি আমি কখনো ওকে নিয়ে এসব কল্পনাও করিনি। ওকে আমার অনেক ভালো ফ্রেন্ড ভেবেছি। যাস্ট ফ্রেন্ড। আই ডোন্ট নো ওরাতে আমার কি হয়েছিল। আমি নিজেকে আটকানো সত্ত্বেও ওকে কিস করে বসি। পরে আমি চেয়েছিলাম ওকে দূরে রাখতে। কিন্তু আমিই এখন ওর থেকে দূরে থাকতে পাড়ছি না। ওর সাথে কথা না বলে থাকতে পাড়ছি না, ও যখন আমাকে এড়িয়ে যায় তখন বুকের ভেতর কেমন ব্যাথা করে, ওর হাসিটা আরেকবার দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে আছে। হয়েছেটা কী আমার?”
“তোর তো ভয়ংকর রোগ হয়েছে।”
সভ্যর কথায় জোহান কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, “মাথা ঠিক আছে তোর? কী বলছিস?”
“ঠিকই বলছিস। তোর প্রেমের রোগ হয়েছে। তুই মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস।”
“অসম্ভব। ও যাস্ট আমার ফ্রেন্ড।”
“ইয়া রাইট, যাস্ট ফ্রেন্ড।”
“সত্যি।”
“সময় দে আপনা-আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন ভেতরে চল দেখি ম্যাডাম কি করছে। সে সময় মতো পিজ্জা না পেলে তোর চুল ছিঁড়ে ফেলবে।”
“কি কস প্রেগন্যান্ট মেয়েরা এত ডেঞ্জারাস হয় না’কি?”
“সবার কথা জানি না। কিন্তু ও তো ইনারা।”
জোহান এই কথায় হাসে, “একদম ঠিক।”
তারা ভেতরে যাবার পর দেখে আরেক দৃশ্য ইনারা কার্টুন দেখে কান্না করছে। সভ্য যেয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়। তাকে বুকে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বুঝাতে থাকে।
জোহান পাশের সোফায় বসে তাদের দেখতে থাকে। তার ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি। তাদের একসাথে এভাবে দেখে তার ভালো লাগছে। সে ভাবে ইনারা একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সভ্যকে বাছাই করে। দুইজন এত কষ্টের পর একসাথে সুখ পেয়েছে। কথাটা ভাবতেই তার মায়ার কথা মনে পড়ে।
.
.
মায়া বসে আছে একটি রেস্টুরেন্টে। তার সামনে এক কাপ কফি। অপরপাশে বসা অভ্র। সে কফিতে এক চুমুক দিয়ে অভ্রকে বলে, “কি দরকারে ডেকেছেন তা বলবেন? আমি এতটাও ফ্রী মানুষ না যে আপনার সাথে এতক্ষণ ধরে বসে কফি খাব।”
“তুমি আমার এত বড় সাহায্য করেছ আমি দরকার ছাড়া তোমার সাথে দেখা করতে পারি না?”
মায়া হেসে পা’য়ের উপর পা তুলে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, “আপনার এতমাস পর আমার সাহায্যের কথা মনে পড়েছে? তাও যাস্ট কফির জন্য আপনি সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট বুক করেছেন? আমাকে এতটাই বোকা মনে হয়। কাজের কথায় আসুন।”
অভ্রও প্রথমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর হাসে, “রাইট। তুমি মোটেও বোকা না একারণেই এই কাজে তোমার হেল্প আবার চাইছি।”
“বলুন।”
“একটা ইন্টারভিউ হবে। তোমার যাস্ট সে ইন্টারভিউ জয়েন করতে হবে৷ তোমার সাথে ইন্টারভিউ করবে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তৌফিকের স্ত্রী মেঘলা।”
মায়ার চোখেমুখে এইবার বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট, “আপনার হবু স্ত্রী না নিউজ চ্যানেলে কাজ করে?”
“রাইট।”
“তো আপনি তাকে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য আমাকে ডেকেছেন? নিজের কাছে পাওয়ার আছে বলে যা ইচ্ছা করবেন?”
অভ্র সুরভির কথা ভেবে হাসে, “সুরভি আগে একটা নিউজ চ্যানেলে কাজ করতো। আমার সাথে বিয়ের কথা সবাই জানার পর ও নিজের স্বপ্নের কাজটাই ছেড়ে দিলো। ওর আমার কোনো হেল্প নেওয়া পছন্দ না। ”
“ওকে, আই লাইক হার। বাট আপনার তাহলে কেন আমাকে প্রয়োজন?”
অভ্র চুপ থেকে বলে, “আমি অনেক ভেবেছি। কথাটা গোপনীয়, কিন্তু কেন যেন আমার তোমার উপর বিশ্বাস আছে। হয়তো তোমার আর আমার মাঝে কিছুটা মিল আছে এজন্য। কথাটা প্রধানমন্ত্রী সাহেবের ছেলে তৌফিককে নিয়ে। আসলে…. উনি এত সুবিধার মানুষ না।”
“তার বা আপনার সুবিধা অসুবিধা দিয়ে আমার কিছু আসে যায়?”
অভ্র তার কফির কাপটি শক্ত করে ধরে, “এই কথা সুরভি ছাড়া কেউ জানে না। আজ তোমাকে বলছি। এই বিশ্বাস রেখে যে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। আমার রাজনীতিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমি আজ এইখানে বসে আছি কেবল প্রতিশোধ নেবার জন্য। তৌফিক কেবলমাত্র নিজের জেদের জন্য আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু,আমার ভাইকে আমার চোখের সামনে খু*ন করেছে।” অভ্র সে সময় মনে হয় তার চোখজোড়া সিক্ত হয়ে আসছে। বুকে ব্যাথা উঠল প্রচন্ড রকমের। সে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়। সে নিজের চোখের জল যেকাউকেই দেখাতে পারে না। সে কাঁপানো গলায় বলতে থাকে, “কেবলমাত্র মেঘলাকে পাওয়ার জন্য। আর মেঘলার আত্নাকেও ও প্রতিটাদিন খু*ন করে। ওর উপর অত্যাচার করে। ওরা একে অপরকে ভালোবেসেছিল। এটাই ওদের শাস্তির কারণ। আমি আজও শান্তি মতো ঘুমাতে পারি না। আজও আমার চোখ বন্ধ করলে আমার বন্ধুর র*ক্তাক্ত শরীর আমার…. ”
চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই তার হাতের কাপটি ভেঙে যায়। মায়া চমকে উঠে। তার দৃষ্টি এবার করুণ হয়।
অভ্র এবার চোখ তুলে তাকায়, “তুমি জানো মায়া, গগন সম্পর্কের আগে থেকে একটা ছোট আঘাতও লাগতে দেয় নি মেঘলার শরীরে। ওর একটু আঘাত লাগলে অস্থির হয়ে যেত। আর ওই জানোয়ার….” অভ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রাগে তার শরীর কাঁপতে শুরু করে, “ওই জানোয়ার ওর উপর প্রতিদিন অত্যাচার করে। ওর শরীরে কেবল আঘাতের চিহ্ন।” অভ্র একটু থেমে আবারও বলে মায়াকে, “তুমি আমাকে তখন সাহায্য করেছিলে কেবল আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। এখন কেবল ভালোবাসা না, ওদের জীবনের প্রশ্ন। মেঘলাকে ওই নরক থেকে বের না করলে না আমার বন্ধুর আত্না শান্তি পাবে আর না আমি শান্তি পাব। তোমাকে জোর করছি না। কাজটা রিক্সের। তুমি মানা করতে পারো। আর যদি করো, তাহলে তুমি যা চাও আমি তোমাকে তাই দিব।”
“আমার কোনো কিছুর অভাব নেই।” মায়ার কথায় নিরাশ হয়ে যায় অভ্র। তার মাথায় কেবল মায়ার কথাই এসেছিল। এখন তার আবার নতুন কিছু ভাবতে হবে।
মায়া আবার বলে, “কিন্তু যদি সত্যি একটি মেয়ের জীবনের প্রশ্ন হয় তাহলে আমি চুপও থাকতে পারি না। কি করতে হবে তা বলুন।”
কথাটা শুনে তার নিশ্বাস ফিরে। মায়া তার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে, “আপনার চোখে প্রতিশোধের আগুন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার জন্য হাত র*ক্তাক্ত করতে হবে না। কি করতে হবে তা বলুন।”
“ইন্টারভিউ দিতে হবে আর মেঘলা থেকে কিছু তথ্য নিতে হবে। আসলে তৌফিক লুকিয়ে প্রতি বুধবার থেকে শুক্রবার একটি জায়গায় থাকে। এটা সন্দেহের বিষয় না হলেও ও নিজের রূপে সেখানে যায় না। লুকিয়ে ওর ম্যানেজারের রূপে যায়।”
“নিশ্চয়ই অ*বৈধভাবে কিছু করে।” মায়া বলে।
“আমার ভাবনাও তাই। কিন্তু এর জন্য আমার কিছু ক্লু লাগবে। যা মেঘলা থেকে পাওয়া যাবে। সুরভিকে তৌফিক চিনে এবং সন্দেহ করে তাই তোমার ওর থেকে তথ্য নেওয়া লাগবে।”
“হয়ে যাবে।”
“গ্রেট। আমি তাহলে সুরভিকে বলি।”
মায়া উঠে দাঁড়ায়, “মেসেজে সব জানিয়ে দিয়েন। আমার যেতে হবে। মিটিং আছে।”
“একটু দাঁড়াও।” অভ্রও তার সামনে দাঁড়ায়, “অভ্র কারও ঋণ রাখে না। আর তুমি তো দুই দুইটা সাহায্য করছ আমায়। বলো তোমার কি লাগবে।”
“আমার যা প্রয়োজন হয় তা আমি অর্জন করতে জানি।”
“তুমি না একটা সাহায্য চাইতে? বিয়ের ভাঙার সময় শর্ত দিয়েছিলে।”
মায়ার মনে পড়ে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ভেবেছিলাম কিছু একটা। মনে একটা আগুন ছিলো। প্রতিশোধের আগুন। ভেবেছিলাম সে আগুনে সব পুড়িয়ে ছাই করে দিব। এখন ইচ্ছা করছে না। বুঝেছি তাদের কষ্ট দিয়েও আমার মন শান্ত হবে না। যত যাই হোক তারা আমার পরিবার। তাদের জন্য আমি কেউ না হলেও তারা আমার সবকিছু।”
“তো বলো তোমার মন কীভাবে শান্ত হবে? তুমি আমার এতটা সাহায্য করছ। আমি তো এতটুকু করতেই পারি?”
মায়া তাচ্ছিল্য হাসে। তার মনে পড়ে জোহানের কথা। যে মানুষটার জন্য সে নিজের বুকের সব আগুনে জল ঢেলে দিয়েছিল সে মানুষটায় তাকে আগুনে ছাই হতে ছেড়ে গেল।
“যে মানুষ ভালোবাসা চিনে না তাকে ভালোবাসা শিখাতে পাড়বেন?”
“কী!” মায়ার কথায় গোলকধাঁধায় পড়ে গেল অভ্র। সে কি বলল, কিছুই বুঝল না।
মায়া হাসল, “কিছু না।”
“আর অবশ্যই সিকিউরিটি থাকবে ওখানে। তাই চিন্তা করো না।”
তাচ্ছিল্য হাসে মায়া, চিন্তা করলে সেখানে যাওয়ার জন্যে প্রস্তত হতাম না। আর সেখানে তৌফিক যদি জানতে পারে আপনি সিকিউরিটি পাঠিয়েছেন তাহলে সম্পূর্ণ প্লান ভেস্তে যাবে। আপনার বান্ধবী মেঘলার উপর তার দৃষ্টি থাকবে আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পাড়ব না।”
“কিন্তু তাই বলে তোমাকে আর সুরভিকে আমি ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।”
“ডোন্ট ওয়ারি আমি সামলে নিব।”
অভ্র তবুও আশ্বস্ত হয় না। মায়া যাবার সময় দরজায় দু’টো সিকিউরিটি গার্ড দেখে। তার চেয়ে ওজনে দ্বিগুণ হবে তারা। সে মাথা ঘুরিয়ে অভ্রর দিকে তাকায়, “আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার উপর আক্রমণ হলে সামলাতে পাড়ব তাই না? বলুন আক্রমণ করতে।”
“হোয়াট! পাগল তুমি?”
“আপনি ঋণ পরিশোধের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন তাই না? আমি যা বলছি তা করুন।”
মায়ার জোর গলায় বলায় অভ্র খানিকটা বিরক্ত হয়। এমন অদ্ভুত মেয়ে সে জীবনে দেখে নি। অভ্র ইশারা করল একজন সিকিউরিটি গার্ডকে। সে হাত থেকে নিজের ব*ন্দুক রেখে মায়ার দিকে এগোতেই সে গার্ডের হঠাৎ করে ঝুঁকে পা’য়ে জোরে কিক মারে। যদিও প্রথমে এতে বিন্দুমাত্র ব্যাথা হয় না গার্ডের। সে উল্টো হেসে উড়ায়। কিন্তু পরের মুহূর্তেই যখন সে সুক্ষ্ম থেকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করে তখন সে রেগে যায়। সে হাঁটু গেড়ে বসতে নিলেও উঠে দাঁড়ায়। ভেবেছিল ছোট একটি মেয়ে সহজভাবে ছেড়ে দিবে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা তার ইগোতে এসে লেগেছে। সে উঠে মেয়েটার উপর ভয়ানকভাবে আক্রমণ করে। মায়া খুবই চতুরতার সাথে আক্রমণ পরিহার করে উল্টো তার চোয়ালে একটা ঘুষি মারে।
অভ্রর অবাক হয়ে হেসে দেয়। সে ভেবেছিল মেয়েটা কেবল বুদ্ধিমতি। কিন্তু তার কৌশল ও শক্তি দেখে সে প্রভাবিত হয়। সে চেয়ার টেনে বসে তাদের দৃশ্যটা উপভোগ করতে। আয়েশে কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখে মায়ার ফাইটিং। এমন সময় ফজলু মিয়া আসে তার পাশে, “ভাই এই মাইয়ারে দেইখা ভয়ে কাঁপতাছে আমার বুক, আমার বউয়েরতে বেশি চেঞ্জ এর এই লুক।”
অভ্র হাসে। সে চা’য়ে চুমুক দিয়ে দেখে মায়ার দিকে। সে শেষ পাঞ্চে গার্ডকে মাটিতে কিভাবে শুইয়ে দিলো তা দেখে সে এবার আশ্বস্ত হয়।
মায়া ফ্লোর থেকে তার ব্যাগ নিয়ে তাকায় অভ্রর দিকে। অভ্র রসিকতার ভঙ্গিতে বলে, “আমার জানকে তোমার দায়িত্বে রাখলাম সেদিনের জন্য। আমার জানের কিছু হলে আমার প্রাণ চলে যাবে। ওর খেয়াল রেখো।”
কথাটা শুনে মায়া মুখ বানায়, “এত বড় নেতার মুখে এসব ক্রিঞ্জি কথা শুনতে কটু লাগছে। ছিঃ!”
“আমার হবু বউ আমার প্রাণই।” এবার সে গম্ভীর মনোভাব প্রকাশ করে।
“তো আপনার প্রাণ আমার অধীনে থাকল।” বলে সে নিজের ব্লেজার ঠিক করে চলে যায়।
.
.
মায়া সেখান থেকে যায় সোজা যায় তন্নির সাথে ব্রাইডাল শপিং এর জন্য। এই সাপ্তাহেই এনগেজমেন্ট। অথচ তন্নির এখনো ড্রেস কেনা হয় নি। আর সে মায়াকে ছাড়া কোনোমতে যাবে না। তাই মায়া আজ ছুটি নিয়ে এলো তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। তন্নিকে নিয়ে বাইক দাঁড় করাল ব্রাইডাল শপের সামনে৷ আশরাফ ও মেহদীর এখানে আসার কথা। তবে ভেতরে যেয়ে তারা আশরাফকে পেল না। মেহদী ছিলো কেবল।
“কি’রে তোর বন্ধু কই?” তন্নি জিজ্ঞেস করে।
“আমার বন্ধু? তোর জামাই লাগে না?”
“ওই শালার কথা কইস না। কালকে থেকে সে মহান ব্যক্তি খুব ব্যস্ত। কল করার টাইম নাই। এখনো আসে নাই। বউয়ের ড্রেস থেকে এই মুহূর্তে তার কী বেশি দরকার।”
“রাস্তায় আছে। আসতেছে।”
” এখন আমরা তিনজন ড্রেস বাছাই করব না’কি?”
“তিনজন না। চারজন।” সে পিছনে আঙুলের ইশারায় জোহানকে দেখায়।
তাকে দেখে বিরক্ত হয় মায়া। তাকে সব জায়গায় আসতে হবে না’কি?”
তন্নি তাকে দেখে খুশিতে গদগদ করে বলে, “আরে জোহান আমি ভেবেছি তুমি আসবেই না। তুমি এসেছ আমি অনেক খুশি।”
“ছুটি নিয়েছিলাম আজ। সভ্য ও ইনারার সাথে দেখা করতে গেলাম। মেহদী কল দিলো তাই এলাম।” বলে সে তাকাল মায়ার দিকে। তাকে ভালো করে দেখার জন্যই তার আসা। এই কিছু সময় অন্তত সে মায়াকে দেখতে পাড়বে, মায়া তার দিকে তাকাবে, তার সাথে আগের মতো কথা বলবে। হোক তা নাটকীয়!
তন্নি জিজ্ঞেস করে, “তুমি দেখি আমাদের আগে ড্রেস দেখা শুরু করে দিলে।”
“না, এমনিই। এই নীল লেহেঙ্গাটা চোখ কাড়ল তাই।”
তন্নি আড়চোখে তাকায় মায়ার দিকে। কণুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলে, “কাওকে কল্পনা করেছিলে না’কি?”
মায়া তন্নির দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসে।
আবার জোহানের নির্বিকার উওরে ফিরে তাকায় সাথে সাথেই, “হ্যাঁ।”
মায়ার ঢোকে তার রাগ ও কষ্ট গিলে। তন্নির দিকে তাকিয়ে বলে, “চল তোর জন্য গাউন দেখি।”
তন্নির ইচ্ছা সে সাদা গাউন পরবে। তাই সেদিকে যায় তারা। এক এসিস্ট্যান্ট নিয়ে যায় তন্নিকে। তিনজন একটি সোফায় বসা। মায়া ও জোহানের মাঝে বসা মেহেদী। তন্নি একটু পর পর এসে তাদের গাউন দেখাচ্ছে। তারা নিজের অভিমত দিচ্ছে। আর মেহেদী ছবি তুলে রাখছে। হঠাৎ তার ফোন আসায় যে উঠে যায়। তন্নিও যায় আরেকটি পোশাক পরে আসতে। রুমে আসেপাশে কাওকে না দেখে জোহান মায়ার সাথে কথা বলার সুযোগ পায়, “মায়া তোমার সাথে কথা ছিলো।”
মায়া উওর দেয় না।
“প্লিজ আমার সাথে কথা বলো। আমার ভুল হয়ে গেছে।”
মায়া তবুও কথা বলে না। জোহান এবার অতিষ্ঠ হয়ে তার সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে। সে মায়ার গালে হাত রেখে তার দিকে মুখ ফেরায়। সে রাগান্বিত স্বরে বলে, “সমস্যা কি তোমার? আমি ডাকছি শুনছ না?”
“তোমার সাহস অতিরিক্ত বেড়েছে না? তোমার সাহস কি করে হয় আমার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলার। ভুলে যেও না আমি কি করতে পারি!”
“কী তোমার কোম্পানি থেকে বের করে দিবে? দেও। যা করার করো আই ডোন্ট কেয়ার কিন্তু আমার সাথে কথা বলো।”
মায়া আবারও তার মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সে এবার মায়ার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলে, “প্লিজ মায়া আমার সাথে কথা বলো। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি সেরাতের পর…. আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে দিব। সেরাতে আমি নিজের হুঁশে ছিলাম না মায়া। হুঁশ ফিরতেই বেশ দেরি হয়ে গেল। জানি না তোমার চোখে তাকাতেই আমার কি হয়ে যায়। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমার কেবল ইচ্ছে করে তোমার চোখ দুটোয় ডুবে যেতে। আফসোস তোমার চোখদুটো সত্যিকারের সমুদ্র না, নাহয় আমি ম*রতে একবিন্দু দ্বিধাবোধ করতাম না।”
মায়া এক পলক তার দিকে তাকায়। তার শব্দচয়নে সে রাগ করবে না আফসোস তাই বুঝে কুলায় না।
জোহান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, “তুমি তো জানো, আমি ভালোবাসার যোগ্য না। অতীতে আমার ভুলগুলো মুছে দেবার পর যদি আমি ফিরতে পাড়তাম তাহলে তোমার কাছেই ফিরতাম। তোমার ভালোবাসা আমার প্রতি গভীর হবে কিন্তু যদি আমি তোমার সে চোখের সমুদ্রে সারাজীবনের জন্য ডুবতে না পারি তখন কী করবে বলো? আমি তো ভালো মানুষ না মায়া। আমার মতো খারাপ মানুষকে ভালোবাসাটা তোমার ভুল হয়ে গেল না?”
মায়া তার ছলছলে চোখে চোখ রেখে বলে, “কীসব কেন বলছ তুমি?”
জোহান চোখ সরায় না। কত প্রতিক্ষার পর এই দৃষ্টির দর্শন হলো!
সে মায়ার হাত ধরে তার বুকের বাঁ পাশে রাখে, “তোমার অভাবে আমি এখানে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।”
মায়ার ইচ্ছা করছিল ছেলেটাকে মেরেধেরে হাড্ডি ভেঙে দিতে। সে কি এতটাই অবুঝ? নিজের শব্দের মানে বুঝে না? সে ভালোবাসে মায়াকে। ভালোবাসে। তাহলে কেন নিজেকে ও মায়াকে কষ্ট দিচ্ছে।
তার চোখে পানি আসার পূর্বেই সে চোখ সরিয়ে নিলো।
“দোস্ত এই গাউনটা…” তন্নি দরজা দিয়ে রুমে ঢুকতেই তাদের এই দৃশ্য দেখে থমকে যায়। সে প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। তারপর দুই গালে রেখে চেঁচিয়ে উঠে নিজের ভুল ধারটা প্রকাশ করে, “ওহ মাই গড, জোহান কি তোকে প্রাপোজ করছে?”
মায়া উঠে সাথে সাথে, “একদম না।”
জোহানও উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু মায়ার হাত ছাড়ে না।
আচমকায় বিপরীত দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আশরাফ ও মেহেদী। তন্নি আশরাফকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে, “বেয়াদব একটা এই সময় তোর বউয়ের ড্রেস সিলেক্ট করার জন্য।”
“এভাবে বলিস না। সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এসেছি শুধু তোর জন্য।”
“এয়ারপোর্ট থেকে? কেন?”
সে দেখে দরজা দিয়ে আতিফ ঢুকছে। তন্নি খুশিতে লাফিয়ে উঠে। সে দৌড়ে যেয়ে আতিফের কাছে। তাকে সামনে থেকে দেখে খুশিতে ছন্নছাড়া হয়ে যায়, “আরে তুমি সত্যি এসেছ?” বলেই তার হাত ধরে নেয়, “এই প্রথম ভিডিওকল ছাড়া সামনা-সামনি দেখা হচ্ছে। আমি অনেক হ্যাপি।”
“আপনার বিয়ে উপলক্ষে দেড়মাসের ছুটিতে এসেছি ভাবিজি। ইচ্ছামতো দেখে নিয়েন। কিন্তু এখন অন্যকাওকে দেখার জন্য আমার মন ছুটছে। আসি।”
সে তন্নির হাত ছেড়ে একপ্রকার দৌড়ে আসে মায়ার দিকে। তার সামনে আসতে সে প্রথমে কয়েক সেকেন্ড তাকে দেখে নেয়। তারপর একগাল হেসে বলে, “তোমাকে কতটা মিস করেছি তুমি কল্পনাও করতে পাড়বে না এঞ্জেল।” মুহূর্ত না গড়াতেই সে মায়ার হাত ধরে তাকে টান ধরে। সাথে সাথে মায়ার হাত জোহানের হাত থেকে ছুটে যায়। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার সামনে। সে অবাক হয় তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার সাহসীকতা দেখে। তার চোখের সামনে ছেলেটা মায়াকে জড়িয়ে ধরেছে। তাও এত শক্ত করে!
মুহূর্তে তার বক্ষপিঞ্জরে ভেতর কেমন ব্যাথা করল। রাগে তার শরীরের শিরায় শিরায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। সে তার হাতটা মুঠোবন্দী করে নিলো।
চলবে।