অনুভূতির খাঁচা পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
5

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তার চোখের সামনে ছেলেটা মায়াকে জড়িয়ে ধরেছে। তাও এত শক্ত করে!
মুহূর্তে তার বুকের ভেতর কেমন ব্যাথা করল। রাগে তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে তার হাতটা মুঠোবন্দী করে নিলো।

মায়া তাকে ফিরে জড়িয়ে ধরে না। শান্ত গলায় প্রশ্ন করে “কেমন আছো আতিফ?”
আতিফ!
এই নাম জোহান আগেও শুনেছে। মনে পড়ল তার, আশরাফের কাজিন। এটাই কি সে ছেলে যার সাথে মায়া বিয়ের ওয়াদা করে এসেছে? কপালে ভাঁজ পড়ে তার। সে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে অন্যদিকে চোখ ফেরায়।

আতিফ মায়াকে ছেড়ে নিজের চুলগুলো ঠিক করে বলে, “তোমাকে ছাড়া কীভাবে ভালো থাকতে পারি? তুমি আমাকে ক’দিন ঠিক মতো কলও দেও নি। আমি তো ভাবলাম ভুলটুলে গেলে না’কি?”
মায়া এবার হেসে বলে, “তোমাকে কীভাবে ভুলতে পারি?”
কথাটা শুনে জোহান আবার তাকায় তাদের দিকে। এই প্রথম মায়ার হাসিটা তার কাছে ভীষণ বিরক্তির লাগে। মায়া তো কেবল তার প্রিয় মানুষদের সামনে হাসে। তাহলে এই আতিফ নামক আপদটাও কি তার প্রিয় মানুষের মধ্যে একজন? ভাবতেই তার কেমন ভয় হতে লাগলো বুকে।

তন্নি তার ব্রাইডাল গাউন ঠিক করার পর সে জোর করে মায়াকে। তারও একটা লেহেঙ্গা কিনতে হবে। মায়া তো কিছুতেই রাজি না। সে পরবেই না।
“তুই এমন করছিস কেন? আমার বিয়ে না’কি যে আমার লেহেঙ্গা পরতে হবে?”
” তোর বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে বলে কথা। আমার থেকে তোকে বেশি সুন্দর থাকতে হবে। কে জানে আমার হবু দুলাভাই তোকে দেখে প্রাপোজ করে বসে।” সে জোহানের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে।
আতিফ কথার মাঝখানে হাত ঢুকায়, “প্রাপোজ তো আগেই করেছি তন্নিরাণী। তোমার বান্ধবী এক্সপেক্ট করতে আর দুই বছর মাত্র কয়েক বছর বাকি। বেশি সময় নেই।”
কথাটাশুনে মায়ার বুকের ভেতর প্রবল অস্বস্তি বেয়ে যায়। সে আড়চোখে তাকায় জোহানের দিকে। তার চোখেমুখে ক্ষোভ দেখতে পায়। সোফায় বসে আঙুলগুলো একত্রে করে রেখেছে। অথচ মুখে একটি কথাও বলছে না। এত রাগ! এত হিংসা! অথচ বলে ভালোবাসে না।
তার ইচ্ছা হলো এই মুহূর্তে জোহানকে কতগুলো থাপ্পড় দিতে। অথচ ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে নিজেকে সংযত রাখল।

আচমকা তন্নি তার সামনে হাজির হয় একটি নীল লেহেঙ্গা নিয়ে। যেটি জোহান একটু আগে দেখছিল। বলে, “এটা পরে দেখ। খুব সুন্দর লাগবে তোকে।”
সে নাচক করতে চায়। তবে এর পূর্বেই আতিফ বলে, “একদম না। মায়াকে সবচেয়ে বেশি মানায় লাল রঙে। ওর এটাটিউডে লাল রঙ মানায়।” বলেই সে উঠে সেল্ফ থেকে একটি লাল রঙের লেহেঙ্গা নিয়ে এসে হাজির হয়, “মায়াবিনী এইটা পরে দেখো। তোমায় স্পর্শে এই ড্রেসটির সৌন্দর্য বেড়ে যাবে।”
মায়া আবারও তাকাল জোহানের দিকে। সে-ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। কিন্তু মায়ার বাছাইয়ে সময় লাগলো না। সে আতিফের পছন্দ করা পোশাক নিয়ে বলল, “আমারও এটা পছন্দ হয়েছে।” বলে চলে গেল ট্রায়াল রুমে।
.
.
মায়া যাবার পরপরই অভ্র কল দেয় সুরভীকে। সাথে সাথে কল না ধরলেও কিছুক্ষণ পরই কলব্যাক করে।
“আসসালামু আলাইকুম। তখন মিটিং এ ছিলাম তাই ফোন সাইলেন্ট ছিলো। বলেন।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?”
“ক্লান্ত লাগছে। অনেক কাজ ছিলো আজ।”
“তুমি জানো তো তোমার অফিসে একমাত্র কল দিলে তোমার সব কষ্ট…. ”
সুরভি তার কথা কেটে বলে, “আপনিও জানেন তো আমার নিজের কাজের জন্য পরিশ্রম করতে ভালো লাগে। আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
“কিন্তু আমার তো তোমাকে প্রয়োজন। আজ তোমাকে দেখা করতে বলতাম তোমার ক্লান্ত কন্ঠ শুনে আর বলতে মন চাইছে না।”
“এতটাও ক্লান্ত নই আমি। দেখা করবেন কোনো কাজে?”
“দেখা করব আমার চোখের শান্তির জন্য। কাজের কথা তো ফোনেও বলা যায় তাই না?”
সুরভি মুচকি হাসলো। গালদুটো লালচে হয়ে আসে। সে মৃদুস্বরে বলে, “ফোনে কথা বলাটা সুবিধার হবে না। আপনি পাড়লে আজ সন্ধ্যায় দেখা করতে পারি।”
“শিউর? কষ্ট হবে না তো?”
“শিউর।”
“ওকে সুইটহার্ট। তোমায় নিতে আসব। অপেক্ষায় থেকো।”
“আপনি আসবেন? আমি চলে আসবো। বাসায় আসবো না অফিসে?”
“আজ অন্যকোথাও।”
“এড্রেস পাঠিয়ে দিন আমি নিজেই চলে আসবো।”
“তাহলে তো তোমাকে বিশ মিনিট কম দেখতে পাড়ব। এটা আমার দ্বারা হবে না। আমি আসব। কল দিলে একটু সামনে এগিও।”
“ওঁকে।”
কল কেটে লজ্জামাখা হাসে সুরভি। ফোনটি বুকে চেপে ধরে বলে, “অপেক্ষায় থাকব।”
.
.
মায়া ট্রায়াল রুমে তার লেহেঙ্গা পরে দেখছিল। হঠাৎ নক পড়ে, “কে?”
উওর আসে না। মায়া জিজ্ঞেস করে, “তন্নি তুই?”
এবারও উওর আসে না।
“স্টাফ?”
উওর না আসার মায়া দরজা খুলে দেখতে নেয়। এর পূর্বেই দরজা ধাক্কা মেরে কেউ রুমে ঢুকে পড়ে। জোহানকে দেখে মায়া রীতিমতো বিরক্ত হয়ে, “তুমি এখানে কী করছ? আমি এখানে চেঞ্জ করতে এসেছি।”
জোহান যখন দেখে মায়া আতিফের দেওয়া লেহেঙ্গাটা পরে নিয়েছে তখন তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে তার আনা নীল লেহেঙ্গাটা চেয়ারে রেখে বলে, “এটা পরবে তুমি। আমি তোমাকে কিনে দিব।”
“এক্সকিউজ মি, বোধহয় তুমি ভুলে গেছো আমি তোমার বস হই। আমি নিজের টাকা নিজের পছন্দের লেহেঙ্গা কিনতে পারি। আর আমি এটাই কিনবো।” বলে সে ওড়না নিয়ে ট্রায়াল রুম থেকে বেরোতে নিলে জোহান দরজা লক করে দেয়।
মায়া ঝাঁজালো গলায় বলে, “আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট? কী করছ?” সে লক খুলতে যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে আয়নার কাছে চেপে ধরে। এক হাত আয়নার সাথে চেপে ধরে তার দিকে তাকায় কঠিন দৃষ্টিতে, “তুমি হয়তো ভুলে গেছো মায়া আমি জোহান। কেবল তোমার আন্ডারে কাজ করি না। ওয়াল্ড ওয়াইড স্টার একজন। সবাই আমাকে চিনে তাহলে তোমারও চেনা উচিত তাই না?”
জোহানের দৃষ্টি সরু, স্থির। তার চোখে এই মুহূর্তে নমনীয়তা দেখতে পায় না মায়া। এই প্রথম। তাই অবাক হয় সে।
“এসব কথা বলছ কেন?” প্রশ্ন করে মায়া।
তাদের মাঝে জায়গা ছিলো সীমিত। জোহান তার কোমরে হাত রেখে এক টানে সে দূরত্বও মিটিয়ে দেয়। নাকে নাক ঘষা খায়। চোখে রাখে চোখ। কেমন মৃদুস্বরে বলে, “জোহানের জেদ জানো? সে যা চায় তা পেয়েই ছাড়ে। এই জেদে আমি সর্বহারা হয়েছি। নিজেকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। করেছিলামও। সব রাগ, জেদ,তেজ মাটিচাপা দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি মায়া… আমাকে আবারো পাগল করে দিচ্ছো। দিন রাত আমি কেবল মায়ায় মগ্ন থাকি। কী জাদু করেছ তুমি আমার উপর?”

জোহানের উষ্ণ নিশ্বাসের ছোঁয়ায় মায়ার দেহ অবশ হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পূর্বেও একজনকে আধমরা করে আসা নারী এখন তার প্রিয়পুরুষের সামনে ভীষণ দুর্বল। সে চোখ নামিয়ে নেয়। তার নিশ্বাসের ন্যায় হৃদস্পন্দনও গতিহারা।

“আমার দিকে তাকাও মায়া চৌধুরী।” জোহান মৃদুস্বরে বলে। তার কন্ঠ সে নেশা নেশা ধরায়। যা মায়ার বুকে কম্পন সৃষ্টি করল। সে চোখ বন্ধ করে নিলো। খামচে ধরল জোহানের সাদা রঙের শার্টটি।
“তোমার চোখদুটো না ডুবতে দেওয়ার শাস্তি দিচ্ছো? ওই আতিফের চোখে তো চোখ রেখে কথা বলছিলে খানিকক্ষণ আগেও।”
“ওর সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলি, নাহয় ওর সাথে প্রেম করি। তোমার কী?”
“কী বললে?” জোহান তার হাত ছেড়ে তার গাল চেপে ধরে তার দিকে ফেরায়। জোহানের চোখদুটো লালচে হয়ে গেছে। তার চোয়াল শক্ত। রাগে তার ফর্সা মুখ, কান সব লালচে হয়ে গেছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “ওর সাথে তুমি প্রেম করবে?”
“অবশ্যই করব। কেন করব না? ও আমাকে ভালোবাসে। তো করলে মন্দ হয় না।”
“তুমি তো বাসো না।”
তাচ্ছিল্য হাসে মায়া, “আমার ভালোবাসাতে কার কী আসে যায়? আমার ভালোবাসা পাওয়ার কপাল নেই। তাই যে আমাকে ভালোবাসে তার সাথেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেউ তো নিজের ভালোবাসা পাক।”
জোহানের চোখদুটো সিক্ত হয়ে উঠে। তার হাত কাঁপছিল রীতিমতো। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় মায়ার দিকে। তার গাল ছেড়ে দেয়। কোমরের বাঁধন খুলে। সে দূরে সরতে নিলেই মায়া তার কলার ধরে নিজের দিকে টান দেয়, “এমন করছো কেন এখন? কষ্ট হচ্ছে? তাহলে ভাবো যদি আমি অন্যকারো হয়ে যাই তখন তোমার কত কষ্ট হবে! মিস্টার জোহান হক শুনে রাখো মায়া চৌধুরী তোমাকে বর্তমানে ভালোবেসেছে তোমার অতীত, ভুল, খারাপ সত্তা সব কিছু আমি মেনে নিতে পাড়ব কিন্তু তুমি যেভাবে আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছ এটা আমি মেনে নিতে পাড়ব না।” কথাগুলো বলতে বলতে মায়ার চোখ ভিজে যায়। সে জাহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

বাহিরে যাবার পর সকলে তার খুব প্রশংসা করে কিন্তু সে আর দেখতে পায় না জোহানকে। তন্নি জানায় তার কাজে চলে গেছে। এতকিছুর পরও তার মনটা কেমন ছটফট করছিল। সে যাবার পূর্বে জোহানের পছন্দ করা নীল লেহেঙ্গাটা নিতে এসেছিল কিন্তু সেটা আর পায় না সে। সেলসওম্যান জানায় সেটা বিক্রি হয়ে গেছে।
.
.
সুরভি অফিসের একটু সামনে আসে। আশেপাশে তাকায় তারপর একটি গাড়িতে উঠে বসে। তাকায় তার পাশে বসা পুরুষটির দিকে। মুহূর্ত তার ভ্রু কপালে উঠে যায়। অভ্র আজ মেরুন রঙের একটি পাঞ্জাবি পরেছে। এই প্রথম তাকে কোনো এই রঙে দেখল সুরভি। দেখে মুগ্ধ হলো। এতটাই মুগ্ধ হলো যে দৃষ্টি সংযত করতে ভুলে গেল।

তার পাশে বসা পুরুষটি দুষ্টু হাসল। পিছনে সিটে একহাত রেখে ঝুঁকে এলো তার দিকে।
“অবশেষে প্রেমে পড়লে না’কি?” অভ্র বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে।
চোখ সরিয়ে নেয় সুরভি। লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে গেল সে। গাল দুটো ভারী হয়ে এলো, “আপনার প্রেমে? অসম্ভব।”
“খুব বাজে মিথ্যা বলতে পারো সুরভিনী। তোমার ঠোঁটের কোণের সে সুক্ষ্ম হাসি, লজ্জামাখা গাল, ঝুঁকে থাকা চোখদুটো অন্যকথা বলে।”
সুরভি তার কাঁধে হাত রেখে দূরে সরায়, “বিরক্ত করেন না তো। এমনিতেই আমি ক্লান্ত। মেজাজও ভালো না।”
হাত সরাতে নিলেই অভ্র তার হাত ধরে নেয়। আঙ্গুলে আঙুল ডুবিয়ে হাত ধরে রাখে শক্ত করে। সুরভিকে প্রশ্ন করে, “কেন?”
“আরে বলেন না! আমার সিনিয়র ম্যানেজারের ভাগ্নি হয়। এই সুবাদে সব কাজের ক্রেডিট দেওয়া হয় তাকে। ইনফ্যাক্ট নারীদিবসে যে ইন্টারভিউর আমি তুলেছিলাম মিটিং রুমে। আমার সামনে হুট করে তাকে ক্রেডিট দিয়ে দিলো। বলল সে যেহেতু আইডিয়া দিয়েছে সে-ই ইন্টারভিউ নিবে। যদিও আমার এই ইন্টারভিউ নেওয়ার ইচ্ছা ছিলো না কিন্তু এমন মুখের উপর মিথ্যা কথা কীভাবে বলে? মুখের উপর দুর্নীতি। আমার এসব একটুও পছন্দ না।”
“আমি ব্যবস্থা করছি ওই বাস্টার্ডের।”
সুরভি বিরক্তি নিয়ে তাকায় অভ্রের দিকে, “আপনাকে বলেছি ব্যবস্থা করতে? আপনি আমার অফিসের কাজে হাত ঢুকাবেন না খবরদার। আমি নিজের যোগ্যতায় নিজেকে প্রমাণ করব। দেখে নিয়েন।”

কথাটা শুনে ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে লুকিং গ্লাসে একবার তাদের দেখে। তার ভ্রু উঠে যায় কপালে। যে লোকের সাথে তারা কথা বলতেও ভয় পায় তাকে এই পিচ্চি মেয়েটা বকছে?

গাড়ি এসে থামে এক রেস্টুরেন্টের সামনে। রেস্টুরেন্টটায় সুরভি আগেও এসেছিল আহনাফের সাথে। সেদিন দেখাও হয়েছিল অভ্রর সাথে। সে নিচে নেমে জিজ্ঞেস করে, “এখানে এলাম যে?”
“আজ রেস্টুরেন্টটা সারাদিনের জন্য বুক করেছিলাম। প্রথমে মায়ার সাথে কথা বললাম আর এখন…. ”
অভ্রর কথা শেষ হবার পূর্বেই কপাল কুঁচকায় সুরভি, “মায়ার সাথে?”
অভ্র আড়চোখে তাকায় সুরভির দিকে, বাঁকা হাসে, “ডোন্ট ওয়ারি সুইটহার্ট ডেইটে তোমাকেই এনেছি কেবল। মায়ার সাথে কাজের কথা ছিলো।”
সুরভির গলার সুর অভিমানী, “আমি কি জিজ্ঞেস করেছি ডেইটে এসেছেন না’কি কাজে?” বলে ভেংচি কাটে।
অভ্র তার কানের কাছে এসে বলে, “কোথাও থেকে পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি। হিংসায় জ্বলছো না’কি সুরভিনী।”
“বাজে বকবেন না। আপনার জন্য কোন দুঃখে হিংসা করব আমি?”
হাঁটতে হাঁটতে তারা ভেতরে যায়। কাউকে না দেখে সুরভি প্রশ্ন করে, “আপনি সত্যি এই সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট বুক করেছেন?”
অভ্র ইশারায় সেখানের স্টাফদের যেতে বলল। তারা প্রবেশদ্বার লাগিয়ে গেল সেখান থেকে।
“প্লান অনুযায়ী কোনো সাহসী ও বুদ্ধিমান নারীর খোঁজ লাগতো তাই না? আমার মাথায় মায়া ছাড়া কারো নাম আর আসলো না। আমি ভেবেছিলাম ও কেবল বুদ্ধিমতী বাট ও আজ রাজুকে যে মেরেছে…”
সুরভী সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়, “কী? রাজু মানে আপিনার ছয় ফিট চার ইঞ্চির দানবের মতো বডিগার্ডটা? মজা করেন?”
“আমিও অবাক হয়েছি। বাট ওর স্কিল আছে মানতে হবে। বুদ্ধির সাথে কৌশল থাকলে যেকাউকে হারানো যায়।”
“ও আসলেই ইনারার বোন। এখন তো আমারই ওর সাথে দেখা করার আগ্রহ বাড়ছে।”
“ইন্টারভিউ দিতে আসবে। দেখা তো হবেই।”
“কী রাজিও হয়ে গেছে?” সুরভি উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে।
অভ্র মাথা নাড়ায়। উওর হ্যাঁ।
সুরভি একগাল হাসে, “আলহামদুলিল্লাহ। আজ দুইরাকাত নফল নামাজ পড়বো। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবো। যদি আমাদের এই কাজটা হয়ে যায় তাহলে মেঘলা আপুকে ওই নরক থেকে বের করার জন্য একধাপ এগিয়ে যাব।” সে তাকায় অভ্র দিকে, “আর গগন ভাইয়াকে দেওয়া আপনার ওয়াদা পূরণেও।”
অভ্র একপলক তার দিকে তাকায়। কিছু বলে না। কেবল হাতটা ধরে। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে নিয়ে যায় তাকে রেস্টুরেন্টের ব্যাক ইয়ার্ডে।

সুরভি এখানে আগে আসলেও এবার তার জায়গাটা আরও সুন্দর লাগে, জায়গাটায় শান্তি লাগে। সে দেখতে পায় ছোট পুকুর পাড়ের গাছগুলোরতে সারি সারি গোলাপি ফুল ফুটেছে। ঝর্ণার মতো পড়ছে ঝরে যেন। পুকুরের আশেপাশে রং-বেরঙের ফুল। সুরভি মুগ্ধ হলো সেদিকে তাকিয়ে। এক প্রকার দৌড়ে যেয়ে সেতুর উপরে দাঁড়াল। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো গাছগুলোর দিকে। বাতাসে দুলছে ফুলগুলো। কিছু কিছু ফুল ধরে পরছে পুকুরে৷ সে পুকুরের দিকেও তাকাল। আকাশী মারবেল পাথর দিয়ে কৃত্রিম পুকরের রং-বেরঙের মাছেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন মনে।

সে আভাস পেল অভ্র তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে জিজ্ঞেস করে, “এগুলো কি ক্যাসিয়া জাভানিকা গাছ?”
“ইয়েস।”
“অপূর্ব সুন্দর। এই দৃশ্যটাই অপূর্ব সুন্দর। আমার চোখই সরছে না।”
“আমারও।”
উওরটায় সুরভি তাকায় অভ্রর দিকে। অভ্র তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ব্রিজের বর্ডারে পিঠ ঠেকিয়ে বক্ষের উপরে আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে রইছে তার দিকে।
সুরভি তার চাহনি দেখে বিচলিত হয়ে গেল। সাথে সাথে সরিয়ে নিলো তার নয়ন জোড়া।

অভ্র বাঁকা হাসে, “তোমার কী মনে আছে সুরভিনী এই জায়গাটার কথা? সে সন্ধ্যায় বৃষ্টি ঝরতে চাইছিল আকাশের বুক চিরে। সে কৃষ্ণকলি আকাশের তলে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলো শুভ্রতা সেজে। আমার বাহুডোরে। মনে আছে?”
সুরভির মনে পড়ে। অভ্রকে হঠাৎ দেখার পর আঁতকে উঠে পিছলে পড়ে যেতে নেয় আর অভ্র তাকে ধরে নিয়েছিল। কীভাবে ভুলতে পারে? সে রাতেই তো এই লোকটার জন্য প্রথম হৃদয় কেঁপেছিল তার। যা সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। অথচ আজ সে জড়িয়ে আছে এই মানুষটার জীবনের সাথে। সে চায় এই মানুষটার সকল কষ্ট নিমিশে শেষ করে দিতে। সকল চিন্তা নিজের করে নিতে।

সুরভির ভাবনা কাটে অভ্রর কন্ঠে, “সেদিন যখন বৃষ্টি এসে তোমায় ছুঁয়ে তোমার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলছিল তখন আমার এতটা হিংসা হচ্ছিল জানো? সে বৃষ্টি বিনা অনুমতিতে তোমাকে কীভাবে বেহায়ার মতো ছুঁয়ে দিচ্ছিল অথচ আমি….”
সুরভি কপাল কুঁচকে তাকায় অভ্রর দিকে, “আপনি কী?”
অভ্র এক পা এগোয় তার দিকে। তর্জনী আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় তার কপালে আসা কেশ, “আমি আমি তোমায় ছুঁলেই তুমি বেঁকে বসো।”
“ছোঁয়ার অধিকার আছে আপনি?”
“এখন নেই। খুব শীঘ্রই হবে। যেদিন তুমি একান্ত আমার হবে। আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার বউ হবে।”
সুরভি চিন্তিত হবার ভান করে, “আপনার বউ? এটা কীভাবে সম্ভব বলুন আমরা তো নাটক করছি কেবল। আপনি তো বলেছেন কিছুমাস আপনার কথামতো কাজ করলে আমি মুক্ত।”
অভ্র কথাগুলো কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তারপর হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “কী বললে তুমি?”
অভ্র খানিকটা ঝুঁকে সুরভির দুইপাশে হাত ঠেকায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সুরভির দিকে। ক্ষোভ স্পষ্ট তার মুখমণ্ডলে, “সব জেনেও বলছো নাটক? তোমার কি আমার ভালোবাসা নাটক মনে হয় সুইটহার্ট? তোমায় একবার দেখার পর আমি কতটা অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম তোমার জন্য?”
সুরভি ভেংচি কাটে, অভিমানী সুরে বলে, “হ্যাঁ, একারণেই তো আমাদের দেখা করার দিন নিজের বন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন নক্ষত্র সাজিয়ে।”
“কারণ আমি নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম যদি তোমার আমাকে ভালো না লাগে? আমি যোগ্য হয়ে তোমাদের বাসায় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চেয়েছিলাম। এর আগেই….” অভ্র দীর্ঘ নিশ্বাস আবার তাকায় সুরভির দিকে, “আমি এই জীবনে একমাত্র তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি সুরভিনী। তখনও তোমাকে চেয়েছি, এখনো তোমাকে চাই।” এবার তার সুর নরম হয়।
সুরভি তবুও গলে না, “একারণেই তো অন্যকারো সাথে এনগেজমেন্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন।”
“ওটা তো আমার প্রতিশোধের জন্য। আমার বন্ধুর জন্য আমি তোমার সামনে জীবিত আছি তাহলে ওকে দেওয়া ওয়াদা কীভাবে না পূর্ণ করি বলো? কিন্তু যে মুহূর্তে আমি তোমাকে পাবার আশা দেখেছি সে মুহূর্তে তোমাকেই বেছে নিয়েছি।”
“অপশন ছিলাম বলেই তো বেছে নিয়েছেন, নাহলে তো এখন অন্যকারো সাথে সুখে সংসার করতেন। অপশন ছিলাম বলেই তো এত বছর হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। এত ভালোবাসলে খোঁজ নিতেন না একবার? আমি কেবল আপনার অপশন মাত্র।”
অভ্র নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, “তুমি কী ইচ্ছে করে ঝগড়া করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ? তোমাকে আমি বলেছিলাম সে মুহূর্তে আমার কেবল একটি লক্ষ্য ছিলো তৌফিকের ধ্বং’সকাব্য লেখা। আর তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তুমি আমার সাথে থাকলে আমি দুর্বল হয়ে যেতাম। এ পর্যন্ত এগোতেই পাড়তাম না। তোমাতে ডুবে থাকলে আমার ওয়াদার কী হতো সুরভি? তোমাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সভ্যর বিয়েতে তোমায় আবার দেখলাম। এরপর নিয়তির জোরে দেখা হতেই থাকল। নিয়তি চাইতো তোমার আমার মিলন হোক।”
এবার সত্যি সত্যি রেগে যায় সুরভি, “খুব আফসোস হচ্ছে দেখা হয়েছে বলে? নিয়তির জোরে নাহয় দেখা হয়েছে বারবার কিন্তু আমার জীবনে তো আপনি জোর করেই ঢুকেছেন। এত আফসোস হলে কেন এসেছেন তাহলে আমার জীবনে? আফসোস করতে হবে না আর আপনার থাকব না আর আমি আপনার জীবনে। চলে যাব। বিয়ে করব না। অন্যকোনো পুরুষের সাথে বিয়ে করে সংসার করব।”
রাগে অভ্রর হাতের রগ কেঁপে উঠে। সে সুরভির গাল চেপে ধরে এক হাত দিয়ে। তার চোখ দুটো লাল হয়ে যায়, “তোমার এত বড় কলিজা আমার মুখের বলছো উপর অন্য পুরুষকে বিয়ে করবে? জান নিয়ে নিব। তুমি শুধু আমার। আর তোর আমাকেই বিয়ে করতে হবে। একান্ত আমার।”
রাগের মাঝে অভ্রর সুরভির এইভাবে করে রাখা মুখটা অনেক কিউট লাগলো। ইচ্ছে হলো চুস করে তার ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে নিতে।
সুরভির এবার ভয়ে কেঁপে উঠে। অস্পষ্ট সুরে বলে, “ভাই ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি।”
অভ্র তাকে ছেড়ে একরাশ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “ঠাডা পরুক তোমার মুখে। আমি তোমার কোন জন্মের ভাই লাগি? আমি তোমার একমাত্র হবু জামাই।”
সুরভি নিজের গালে হাত ঘষে বলল, “গাল ব্যাথা করে দিয়েছেন অভদ্র লোক। আমি তো মজা করছিলাম আপনি তো রেগেমেগে আগুন হয়ে গিয়েছেন।”
“শুকরিয়া আদায় করো কেবল গাল ব্যাথা করছে আরেকটু হলে জান নিয়ে নিতাম।”
“আমার জান তো ক্ষেতের মূলা বললেই হলো জান নিয়ে নিতাম।”
অভ্র তার হাত ধরে টান দিয়ে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে। বলে, “সম্পূর্ণ তুমিই আমার আমানত সুরভিনী। তোমার সবকিছুর উপর ভবিষ্যতে কেবল আমার অধিকার আছে। কেবল আরিফুর ইসমাত অভ্রর।”

চলবে….

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

অভ্র তার হাত ধরে টান দিয়ে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে। বলে, “সম্পূর্ণ তুমিই আমার আমানত সুরভিনী। তোমার সবকিছুর উপর ভবিষ্যতে কেবল আমার অধিকার আছে। কেবল আরিফুর ইসমাত অভ্রর।”

সে অভ্রকে ঠেলে সরাতে নিলে অভ্র উলটো তাকে আরও কাছে টেনে আনে, “ছুটে যেতে চাচ্ছো? আমার বাহুডোর থেকে ছুটে গেলেও আমার অনুভূতি থেকে কীভাবে ছুটবে সুরভিনী?”
তার সাথে চক্ষুবদ্ধ হতেই সুরভির কোমল হৃদয় সাংঘাতিকভাবে কেঁপে উঠে। অভ্রের সূরমা রঙের চোখের মণিতে তার প্রতিচ্ছবিটা অতিরিক্ত সুন্দর দেখাচ্ছে। নিজেকে এত সুন্দর আর কখনো অনুভব হয় নি তার। সে অভ্রর পরনের পাঞ্জাবিটা আঁকড়ে ধরে। তাকিয়ে থাকে অভ্রের নয়নের দিকে। তীব্র বাতাস বইলো। বাতাসের সাথে একগুচ্ছ ফুলের পাঁপড়ি থৈথৈ করে বইতে লাগল প্রেমিক জুটিকে ঘিরে।

একটি ফুল এসে খুঁজে নিলো তার ঠিকানা সুরভির কৃষ্ণকেশে। অভ্র হেসে আলতো করে তা হাতে নিয়ে বলল, “আমি কী চাই জানো সুরভিনী?”
“কী?” মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে সুরভি।
“যেদিন আমি কবুল বলে সম্পূর্ণ তোমাকে পাব সেদিন যেন এই আকাশের বুক থেকে নেমে আসুক তীব্র বৃষ্টির ধারা।”
“কেন?”
“সেদিন বৃষ্টি তোমায় ছুঁলে আমার হিংসা হবে না। সেদিন আমার থেকে বেশি তোমায় ছুঁতে পারবে না কিন্তু তোমার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলবে শতগুণে।”
মুহূর্তে সুরভির কান গরম হয়ে আসে। লালচে হয়ে আসে তার শ্যামলী মুখখানা। সে ধাক্কা দিয়ে অভ্রকে সরিয়ে বলে, “ছিঃ কী অভদ্র আপনি!”
অভ্র ঠোঁট টিপে হাসে, “অভদ্র না হলে বাচ্চাকাচ্চার মুখ দেখব কীভাবে? সভ্য ইনারার বেবির কয়টা খেলার সাথী লাগবে না?”
“কয়টা মানে?” চোখ বড় করে তাকায় সুরভি।”
“এই বারো চৌদ্দটা।”
“তখন তো মজা করছিলাম এখন নিশ্চিত আপনাকে বিয়ে করব না।”
সুরভি মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করে। অভ্র আসে তার পিছনে, “আমাকে বিয়ে না করলে তোমায় কুমারী মরতে হবে সুরভিনী। অন্য কোনো পুরুষকে তোমার পাশে সহ্য হয় না। হয়তো নিজে মরবো, নয়তো তাকে মারবো।”
সুরভি তার কথা শুনে থেমে যায় তার দিকে তাকায় একপলক, “এত ভালোবাসেন?”
“তোমার জন্য নির্দ্বিধায় কারো জীবন নিতেও পারি, নিজের জীবন দিতেও পারি। সেবার তোমাকে দূর থেকে ভালোবেসে দূরে থাকাটা সহ্য করেছি কিন্তু এইবার তুমি দূরে গেলে আমি সহ্য করতে পাড়ব না সুরভিনী। তখন হয়তো সম্পূর্ণ হৃদয় তোমাকে উজার করে দেবার সুযোগ পাই নি, এবার আমিই তো সম্পূর্ণ তোমার হয়ে গেছি। এভাবে ফিরিয়ে দিও না সুরভিনী। আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না? কেবল একটুখানি।”
সুরভি চাপা হাসে, “যায় তবে…”
“তবে?”
“তবে কিছু শর্ত আছে।”
“ভালোবাসা শর্ত দিয়ে হয়?” অভ্র ভ্রু কুঁচকায়।
“আপনার জেদে জোর করে এনগেজমেন্ট হলে আমার শর্ত দিয়ে বিয়ে কেন নয়?”
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “বলো শুনি।”
“এক নাম্বার, আমার স্বপ্নপূরণের পূর্বে বিয়ের কথা বলবেন না। অর্থাৎ আমার রিপোর্টার হওয়ার পূর্বে।”
“হোয়াট?” অভ্র সুরভিকে ছেড়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ” এই শর্ত আমি মানতে পাড়ব না। কিছুতেই না। তুমি এত নির্দয় নারী সুরভী? ছিঃ!”
“ঢং বন্ধ করুন। দ্বিতীয় শর্ত, আমার এই খালি ঘর মোটেও পছন্দ না। আমরা….”
“ডোন্ট ওয়ারি একবার বিয়ে হতে দেও। ঘর ভরিয়ে দিব।”
মানেটা বুঝতে পেরে সুরভির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে কথাটা শুনে নি এমন ভান করে বলে, “আমরা প্রতি উইকেন্ডে আপনাদের বাসায় যাব। মানে আমার শশুড়বাড়ি।”
“এই শর্তও মানতে আমি নারাজ। আমি ছুটির দিনে কেবল তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব অথবা আমরা ঘুরতে যাব। কেবল আমরা দুইজন।”
“আপনাকে ভালোবাসা লাগবে না আমার। আপনি একটা বিরক্তিকর মানুষ। ” বলে হাঁটা শুরু করলে অভ্র তার হাত ধরে বলে, “আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে। দুইটাতেই রাজি। তৃতীয় শর্ত কী?”
সুরভি তার দিকে তাকায়, “এর আগে একটা প্রশ্ন। আপনি ভবিষ্যতে কী পরিকল্পনা করেছেন? আই মিন তৌফিকের শেষ পরিণতি হবার পর কী আপনি রাজনীতি করবেন না ছেড়ে দিবেন?”
“ছেড়ে দিব। রাজনীতি কখনো আমার পরিকল্পনার আনাচে-কানাচেতেও ছিলো না। কেবল ক্ষমতার জন্য এই লাইনে আসা। ক্ষমতা না থাকলে আমার উদ্দেশ্য পূরণ হবে কী করে? উদ্দেশ্য পূরণের পর এই ক্ষমতা দিয়ে আমি কী করব? আর তোমারও তো রাজনীতি পছন্দ না।”
সুরভি গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করে, “আর তারপর কী করতে চান আপনি?”
“তুমি জানো আমার লেখালেখির শখ আছে। শখ পূরণের চেষ্টা করব। তারপর আমাদের ফ্যামিলি বিজনেস জয়েন করব। সভ্যর উপর এতবছরে অনেক চাপ পড়েছে। আমি চাই ও আমার ওর স্বপ্ন বাঁচুক। গানের জগতে ফিরে যাক।”
সুরভিকে চুপ থাকতে দেখে সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এত কী ভাবছো সুরভিনী?”
সুরভি তখনই উওর দেয় না। তার উওর না পেয়ে অভ্র বলে, “তোমার খিদে লেগেছে? খাবার হয়তো সার্ভ হয়েছে।”
সুরভি চুপচাপ ভেতরে যায়। তাকে এখনো চিন্তিত দেখাচ্ছিল। সে যেয়ে একটি টেবিলে বসে। টেবিলে আগের থেকেই খাবার সাজিয়ে দেওয়া আছে। অভ্র তারপরও সুরভিকে চুপ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক আছে? তুমি তোমার পছন্দের বিরিয়ানি দেখেও এত চুপ। ব্যাপারটা কী?”
কথাটায় হুঁশ আসে সুরভির। সে নড়ে-চড়ে বসে। সে বিরিয়ানির দিকে তাকিয়ে অবাক সুরে বলে, “আপনি এই রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি পেলেন কই। গতবার মেন্যুতে তো দেখলাম না।”
“মিসেস অভ্র আপনি সামান্য বিরিয়ানিতে অবাক হচ্ছেন? আপনার যা পছন্দ তার সবকিছু আপনার পা’য়ের কাছে এনে দিতে পারি।”

সুরভি ফিক করে হেসে দেয়। টেবিলে কণুই রেগে গালে হাত রেখে তাকায় তার দিকে, “এত পছন্দ কেন আমাকে? আপনি আমার থেকে কতবেশি সুন্দর, যোগ্য ও ধনী মেয়ে বিয়ে করতে পাড়তেন নিমিষে। তবে আমাকে কেন বেছে নিলেন? আপনি কী সুদর্শন দেখতে! কলেজে সকল মেয়েরা আপনার এক দেখার পাগল ছিলাম। অথচ আপনি আমার মতো শ্যামবর্ণা মেয়েকে কেন পছন্দ করলেন? আমি তো সুন্দরও নই।”

“সুন্দর না? তুমি?” অভ্র ভ্রু কপালে তুলে প্রশ্নটা করে যেন এমন আশ্চর্যের বিষয় সে শুনে নি আগে, “তুমি জানো আমি স্যারপ্রাইজ দেবার জন্য তোমার ভার্সিটির সামনে এসেছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখে আমি নিজেই স্যারপ্রাইজ হয়ে গিয়েছিলাম। শুভ্ররঙ্গা শাড়িতে কৃষ্ণকলি তুমি। উফফ! সে দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে। আমার হৃদয়ের অবস্থা এতটা ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল যে আমি তোমার সামনে আসতেও নার্ভাস ফিল করছিলাম। না পেড়ে গগণকে পাঠিয়েছি তোমার সাথে দেখা করতে। তোমার চোখ গুলো কি সুন্দর জানো? আমার ডুবে যেতে ইচ্ছা করে। তোমার হাসিটা কী মায়াবী জানো? ইচ্ছে হয় তাকিয়ে থাকি। তোমার কেশগুলো আমাকে কতটা আকর্ষণ করে জানো? আমার ইচ্ছে হয় মুখ ডুবিয়ে থাকতে। সম্পূর্ণ তুমিটা আমাকে কতটা আসক্ত করে জানো?”
সুরভি চোখ নামিয়ে হাসে। তার নিজের প্রশংসা শোনার অভ্যাস নেই। সে জানে এই সমাজের দৃষ্টিতে সে এতটা সুন্দর না। কিন্তু মানুষটা তাকে যেভাবে বর্ণনা করল তার মনে হচ্ছে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী। সে আবার চোখ তুলে তাকাতে দেখে অভ্র এই মুহূর্তেও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অপলক। সে তাকাতেই চোখ টিপ দিলো। সুরভি চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু তার বক্ষপিঞ্জরের থেকে তার হৃদপাখিটা সে কবেই উড়াল দিয়েছে এই মানুষটার খোঁজে।

“তৃতীয় শর্তটা বললে না?” অভ্রর কথায় সুরভির আবারও ঘোর কাটে। এই মানুষটার মাঝে সে আজকাল বেশিই হারিয়ে যাচ্ছে না? সে নিজের উড়ু উড়ু মনটাকে শান্ত করে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় অভ্রর দিকে, “আমি চাই না আপনি রাজনীতি ছাড়ুন।”
“হোয়াট? ইউ হেইট পলিটিক্স।”
“আমি দুর্নীতি অপছন্দ করি। আর আমি চাই আপনি এখানে থেকে দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করেন।”
অভ্র হাসে, “রসিকতা করছো? এদেশে মানুষের রক্তে দুর্নীতি মিশানো। আমি একটা মানুষ কী করবো?”
“একটি গল্প শুরু করবার জন্য সূচনা তো করতে হয়। তাই না? আপনি শুরু করুন। আপনার জন্য কারো উপকার হলে সেটাও তো অনেক। আপনার কাছে এখন যে ক্ষমতা আছে তা যেকারো পেতে একজীবন সাধনা করতে হয়। অপব্যবহার না করে সেটা ব্যবহার করুন কারো উপকারের জন্য। আর রইলো সভ্য ভাইয়ার সাহায্য করার কথা আপনার বুদ্ধি যে শেয়ালের মতো। আপনি নিশ্চিত দুইটাই সামলাতে পাড়বেন।”
অভ্র ভ্রু নাঁচায়, “এটা কি অপমান ছিলো না প্রশংসা?”
এর উওর দেয় না সুরভি। বলে, “আর আপনার লেখালেখির শখ পূরণে আমি আপনার সাহায্য করার জন্য আছি তো।”
“ভেবে দেখো, সারাজীবন থাকতে হবে।”
সুরভি তার প্লেটে খাবার সার্ভ করে বলে, “এখন অন্যকাওকে বিয়ের কথা বললে তো আপনি না’কি তার অবস্থাই করুণ করে দিবেন। দরকার কী? তাই নাহয় করলাম আপনাকেই বিয়ে করলাম।” তার গাল ভারী হয়ে আসে লজ্জায়। বেহায়া ঠোঁট দুটো হাসিটা লুকাতেই ব্যর্থ।
.
.
তৌফিক কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে মামুনের দিকে। তার পি.এ। মামুন ভয়ে কাঁপছে। এই কাজ করতে করতেই নিশ্চয়ই সে হার্ট অ্যাটাকে মর’বে একদিন। এটা নিশ্চিত।

তৌফিক হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “তুই কয় বছর এইখানে চাকরি করিস?”
তার হুঙ্কার শুনে মামুনের হাতের থেকে ফাইল পড়ে যায়। ভয়ে সে কাঁপতে শুরু করে।
“কী জিজ্ঞেস করছি?” তৌফিক আবারও জিজ্ঞেস করে।
“স্যার…স্যার আমি মানা করতে চেয়েছিলাম। রাহিদ ভা…ভাই বলল তাও আপনাকে জিজ্ঞেস করতে।”
তৌফিক কপাল কুঁচকে তাকায় রাহিদের দিকে। সুমনের পর রাহিদই তার সবচেয়ে কাছের বিশ্বাসী লোক। সুমন যেমন বল দিয়ে তার ক্ষমতা বাড়ায় রাহিদ তেমন বুদ্ধি দিয়ে তার অর্থ বাড়ায়।
সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রাহিদের দিকে, “তুমি এত বড় বোকামি কীভাবে করলে রাহিদ। তোমার বুদ্ধিমত্তার উপর এখন কী আমার সন্দেহ করা লাগবে? মেঘলাকে আমি বাহিরে যেতে দেই না আর তাকে আমি ইন্টারভিউ দিতে পাঠাব?”
সুমন তার সাথে তাল মেলায়, “রাহিদের বুদ্ধির উপর তো আমার আগেই সন্দেহ ছিলো কেবল ভাগ্যের জোরে ওর সব উপদেশ সঠিক পড়তো। এখন বুঝছেন তো স্যার?”
“চুপ করো সুমন। আমি কথা বলছি দেখছ না? রাহিদের পিছে না লাগলে তোমার খাবার হজম হয় না?”

রাহিদ শান্ত ভঙ্গিতে একটি কাগজ দিলো তৌফিকের কাছে।
“এটা কী?” তৌফিকের প্রশ্ন।
“এই ইন্টারভিউতে নারী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে চারজন নারীরা আসবে। অভিনেত্রী তনু, দেশের প্রথম নারী এভারেস্ট অভিযানকারী রিধি, বিজনেসওম্যান মায়া, আর আমাদের ম্যাডামকে আমন্ত্রণ করেছেন। চ্যানেলের রেটিং আপাতত হাই। এই ইন্টারভিউ এলে সবাই নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে দেখবে।”
“তো?”
“স্যার আজকাল মিডিয়ার পাওয়ার অনেক বেশি। জনগণের সাথে যোগাযোগের সরাসরি পদ্ধতি। যদি ম্যাডাম টিভিতে আপনাকে নিয়ে প্রশংসা করে তাহলে আপনি সবার কাছে একজন আদর্শ স্বামী হবেন। তারপর আপনার পি আর করতে পাড়ব আমরা। আর আমি ভাবছিলাম আগামী বছর বড় স্যার ইলেকশনে না দাঁড়িয়ে আপনি দাঁড়ালে কেমন হয়? এমনেই তো স্যারের বয়স হয়েছে।”
তৌফিক হাসে, “তুই তো অনেক হারামি রিয়াদ। আমার থেকেও আগে ভেবে রেখেছিস। আমার বাপকেই সরানোর পরিকল্পনা করছিস?”
“না স্যার মানে….”
তৌফিক তার গলা থেকে স্বর্ণের চেইন খুলে তাকে দিয়ে বলল, “ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে। তোর উপহার।”
রিয়াদ তা নিয়ে বলল, “ধন্যবাদ স্যার। আরেকটা কথা।”
“বল।”
“আমি খোঁজ নিয়েছি। ওখানে অভ্রর হবু বউও কাজ করে। তাই হাই সিকিউরিটি রাখতে হবে।”
সুমন তখন বলে, “তাহলে ম্যাডাম ওখানে কীভাবে যাবে? যদি এটা অভ্রর কোনো পরিকল্পনা হয়?”
রিয়াদ উওর দেয়, “এজন্যই তো সিকিউরিটি রাখার কথা বলছি। নিজের প্রিয় বউকে পরিকল্পনার অংশ করে ক্ষতির মুখে তো ফেলবে না অভ্র। তৌফিক স্যারের ক্ষমতা সে জানে। যদি পরিকল্পনা করেও থাকে তাহলে তো আরও আগে পাঠানো উচিত। তাদের বোঝা উচিত স্যারের কাছে ওই অভ্র সামান্য পোকা মাত্র।”
তৌফিক তার কথায় খুশি হলেন, “তোমার বুদ্ধিতে আমার ভরসা আছে রিয়াদ। হাই সিকিউরিটি পাঠাও। বাকিটা আমি দেখব।”
“ম্যামকে কি কি কথা বলতে হবে তা দয়া করে বুঝিয়ে দিয়েন স্যার।”
তৌফিক উঠে দাঁড়ায়। রিয়াদের কাঁধে হাত রেখে বলে, “তোমার কাজে আমি ভীষণ খুশি রিয়াদ।”
রিয়াদ হাসে তার কথায়। তাকায় সুমনের দিকে। তার চোখমুখ কুঁচকে আছে।
.
.
জোহান তন্নি ও আশরাফের বাগদানে এসেছে আধা ঘন্টা হলো। প্রথম সকলে তাকে ঘিরে ধরলো। এতেই কত সময় কাটলো। তারপর সকলে শান্ত হলে সে আশরাফ ও মেহেদীর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হলো। অথচ তার দৃষ্টি খোঁজ করছিল চারদিক। তবে তার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টির তৃষ্ণা মিটলো না। সে যখন দেখল তন্নিকে আসতে তখন সে অতি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো। হয়তো তার সাথেই আসবে মায়া। অথচ তারপরও দেখা পেল না। মেয়েটা গেল কই? আজ সারাদিন বাসাতেও ছিলো না। মেহেদী থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সে তন্নির সাথেই ছিলো। অথচ এখনও তার দেখা পেল না।

তন্নি তার সাদা রঙের গাউন দু’হাতে খানিকটা তুলে আসছিল আশরাফের কাছে। দু’জনের মধুর মুহূর্ত আজ। তন্নি যখন আশরাফের সামনে দিয়ে আসছিল আশরাফ যেন চোখ সরাতেই পাড়ছিলো না। তন্নি তার সামনে দাঁড়িয়ে জীবনে এই প্রথম লজ্জামাখা স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?”

তবে আর তর সয় না জোহানের। সে অস্থিরতার বশে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “তোমার বান্ধবী কোথায় তন্নি?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে তন্নি ও আশরাফ কিছুটা বিস্মিত হলেও একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। তন্নি মজা করে জিজ্ঞেস করে, “আমার বান্ধবীকে দিয়ে আপনার কী কাজ জনাব জোহান?”
জোহান দ্বিধায় পড়ে। হঠাৎ না বুঝেশুনে প্রশ্ন করে নিলো। এখন কী উওর দিবে। সে মাথা চুলকে আমতা-আমতা করে বলে, “এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম এই দুইদিন অফিসেও আসে নি তো।”
“না দেখায় মিস করছিলেন না’কি?”
জোহান দৃষ্টি লুকায়, “এমন কিছু না।”
মিথ্যে, গত দুইদিন ধরে মায়াকে দেখার জন্য তার মনটা আকুম-বাকুম করছে। গতরাতে সে ঘুমায়ও নি। সারারাত বারান্দায় বসে অপেক্ষা করেছে একটিবার মায়ার দেখা মেলার। তবুও তার হাদিস মিলল না।
তন্নি তার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে। বলে, “এনগেজমেন্ট রিং-ই ভুলে রেখে এসেছিলাম। তাই আতিফের সাথে নিতে গিয়েছে।”
আফিফের নাম শুনতেই জোহান কপাল কুঁচকে তাকায় তন্নির দিকে, “আতিফ? ও কেন গিয়েছে?”
“ও মায়ার সাথে যেতে চেয়েছে তাই…”
“কতক্ষণ হলো গিয়েছে?”
“হয়েছে অনেকক্ষণই। এসে পড়বে।”
“ওঁকে।” বলে সে সেখান থেকে চলে যায়। তার মন মেজাজ এতটাও ভালো দেখাচ্ছিল না। আশরাফ জিজ্ঞেস করে, “ওর আবার কী হলো? এমন বিহেভ করছে কেন?”
“প্রেমে পড়লে হয়তো মানুষ এবনরমাল হয়ে যায়। মায়াও আজকাল কেমন যেন ব্যবহার করছে। তুইও তো করিস।”
“হবু স্বামীকে তুই তুকারি করতে লজ্জা লাগে না? সম্মান দে।”
“তোকে সম্মান দিব? এত খারাপ দিনও আসে নাই।”

জোহান দরজার সামনে দাঁড়ানো। বারবার ঘড়ি দেখছে। সে মায়াকে কলও দেয় কিন্তু তাকে পায় না। মায়া তাকে ব্লক করে দিয়েছে। সে এবার বিরক্ত হয়। সে বুঝতে পাড়ছে না মায়া এমনটা করছে কেন? সে তো এইবার স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভাবছে না। ভাবলে সে কবেই মায়াকে নিজের করে নিতো। সে ভাবছে মায়ার কথা, তার সাথে থাকলে মায়া নিশ্চয়ই খুশি থাকবে না। মায়া ব্যাপারটা বুঝতে পাড়ছে না কেন?

জোহান দেখতে পায় একটি ধূসর রঙা গাড়ি এসে থামে পার্কিং স্পটে। দরজা খুললে সে দেখতে পায় আকাশী রঙের আনারকলি পরে আছে মায়া। দেয়ালে হেলান দিয়ে ছিলো জোহান তাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে। আকাশী রঙা আনারকলিতে রূপালি রঙা করুকাজ। কানে ছোট্ট দুই সাদা স্টোনের কানেরদুল। কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলোর মাঝে গোলাপ আকৃতির সাদা রঙের ক্লিপ একপাশে বাঁধা। হাতে একটি রূপালি রঙের বড় প্লেট যার উপর সাদা রঙের গোলাপির পাঁপড়ি আর দুইটি ছোট নীল বাক্স। তার বড় থালাটা নিয়ে নামতে অসুবিধা হচ্ছিল। তা দেখে জোহান এগিয়ে যায় গাড়িটার কাছে। কয়েকটি সিঁড়ি নামতেই তার চোখে পড়ে আতিফ মায়ার কাছে এসেছে। থালাটা এক হাতে নিয়ে হাত ধরে মায়াকে বের করছে গাড়ি থেকে। এই সামান্য দৃশ্যতেই বক্ষপিঞ্জরে ব্যাথা অনুভব করল জোহান। রাগও উঠলো। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করল। সে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে রইলো।

মায়া আতিফসহ সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল। আতিফ জোহানকে দেখে দ্রুত তার কাছে যায়, “ব্রো তুমি এখানে একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে চলো।”
জোহান তাকায় মায়ার দিকে। কিন্তু এইবার সে তাকিয়ে থাকতে পাড়ল না। অন্যপুরুষের পাশে তাকে মোটেও মানায় না। তার সহ্য হয় না।
“কী হলো জোহান? কিছু বলছ না যে?”
জোহান তাকায় তার দিকে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, “অপেক্ষা করছি।”
আতিফ দুষ্টুমি ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, “গার্লফ্রেন্ডের না’কি?”
জোহান মৃদু হেসে তাকায় মায়ার দিকে, “গায়িকা রিসাকে তো চিনো। ও আসবে অনুষ্ঠানে ডুয়েটের জন্য। ওর জন্য অপেক্ষা করছি।”
“ওয়াও তুমি পারফর্ম করবে? আমি আজ পর্যন্ত তোমাকে লাইভ পারফর্ম করতে দেখিনি।
মায়া চোখ নামিয়ে ছিলো। জোহানের উওরটা শুনে সে শঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় জোহানের দিকে। তার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। সে উপরের দিকে উঠতে উঠতে বলে, ” আতিফ আসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“কিন্তু জোহান….”
“কেন তুমিও কী তার সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করতে দাঁড়িয়ে থাকবে না’কি?”
আতিফ অবাক স্বরে বলল, “ওর আবার কী হলো?” তারপর জোহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডামের বোধহয় মাথা গরম হয়ে গেছে। সকাল থেকে কাজ করছে। ওর কাছে যাই। আজ যে সুন্দর লাগছে ক্রোধ ভাবটা এই সৌন্দর্যের সাথে যাবে না।”

আতিফ যাবার পর জোহান কতক্ষণ গভীর নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করতে। ক্রোধে তার শিরায় শিরায় আগুন বইছে যেন। সে নিজে নিজেই বলে, “আতিফ এত ভালো, তবুও ওকে কিছুতেই সহ্য করতে পারি না আমি। সব তোমার দোষ মায়া। তুমি কেন ওর সঙ্গে বিয়ের চুক্তিটা করতে গেলে? তোমাকে অন্যকারোর সাথে ভাবতেই আমার অন্তর ছিঁড়ে যায়। সেখানে তোমাকে ওর সাথে আমি কীভাবে সহ্য করব?”

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সবাই আনন্দে জোরে হাতে তালি দিচ্ছে। দু’জন প্রেমিকের এক হবার আনন্দে তালির গুঞ্জন সারা রুমে ছড়িয়ে আছে। সবে আংটি বদল হয়েছে আশরাফ ও তন্নির। এই আনন্দ থেকে বের হবার পূর্বেই জোহানের পারফরম্যান্স শুরু হলো। তার গানের তালে সারা কক্ষের লোকেরা যেন মাতোয়ারা হয়ে গেল। সবাই তার সাথে গাইতে লাগলো। নাচতে লাগলো, লাফালাফি করতে লাগলো। তবে মায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। তার মুখে ছিলো স্বস্তির ছাপ। জোহানের সবচেয়ে বড় স্বপ্নই তার গানের মাঝে অনুভূতি ছড়িয়ে দেওয়া। এত মানুষ জোহানের সাথে তার গানের অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছে। নিশ্চয়ই জোহান খুব খুশি। আর সে এই খুশিটা খুঁজতে লাগল জোহানের মুখে। প্রথমে কিছু নাচা-নাচির গান করল জোহান, তারপর দুঃখের আর অবশেষে প্রেমের। প্রেমের গান গাইবার সময় রিসাও তার সাথে যোগ দিলো। এতে যেন আনন্দের দ্বিগুণ জোয়ার বইল কক্ষের মধ্যে। অথচ মায়ার মনে নেমে এলো বিষাদ। তবুও সে হাসল। যে মানুষ তাকে একটি সম্পর্কই দিতে পাড়বে না তার জন্য কীসের মন পোড়ানো? সে ঠোঁটে হাসি আঁকলো।

মায়া সকলের সাথে তাল মেলায় আনন্দে। জোহানের দিকে তাকালে দেখে জোহান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টিতে। মায়া একবার চোখ সরিয়ে তাকাল আবারও। এখনো জোহান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এত মানুষের ভিড়ে তার দৃষ্টি কেবল মায়ার উপরই আটকানো।

আতিফ মায়ার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সে আনন্দে মেতে ছিলো সকলের সাথে। তালি বাজাচ্ছিল জোহানের গানের সঙ্গ দিতে। সে খেয়াল করল জোহান কেবল তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে।এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ফেরাচ্ছে না। হঠাৎ তার হাসিটা মিলিয়ে যেতে শুরু করল। তালি বাজানো বন্ধ হয়ে গেল। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। সে তার পাশে দাঁড়ানো মায়াকে প্রশ্ন করল, “জোহান প্রেমের গান গাইছে তার সাথের গায়িকার সাথে। অথচ তোমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন মায়া?”
মায়া খেয়াল করে আরও কয়েকজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এইবার মায়ার জোহানের উপর ভিষণ রাগ উঠে। জোহান তাদের সম্পর্কের নাম দিতে চায় না, অথচ সারা পৃথিবীকে তার অনুভূতির জানান দিচ্ছে। চায় কী এই ছেলেটা?

মায়া আর সামলাতে পারে না নিজের ক্রোধ। সে আতিফের উওর দেয়, “আমি ওর বস। ওর এলবাম রিলিজের আগে অনেক ক্রিটিসাইজ করেছিলাম ওর গানের টেক্নিক নিয়ে। হয়তো এজন্য আমাকে প্রমাণ করতে চাইছে। আচ্ছা আমার তৃষ্ণা পেয়েছে আমি পানি খেয়ে আসি।”
“একা যেও না মায়া। আমি আসছি।”
আতিফও মায়ার পিছু চলে যায়।

জোহান গানের মাঝখানেই থেমে যায়। তার প্রণয়ে ভরা দৃষ্টি বিরক্তির রূপ নেয় যখন সে মায়ার সাথে আতিফকে ভিড় ঠেলে যেতে দেখে।

হঠাৎ মেহেদীর কন্ঠে ঘোর ভাঙে জোহানে, “ব্রো এই মুহূর্তে কেউ থামে? গানের নেশা শেষ করে দিলে।”
জোহান মিথ্যে হাসে, “তাহলে আবার শুরু করছি।” সে তাকায় রিসার দিকে, “সরি ধ্যান সরে গিয়েছিল হঠাৎ।”
রিসাও তাকাল মায়ার যাবার দিকে। সে তাচ্ছিল্য হাসে, “তা তো দেখতেই পাড়ছি কিন্তু… ”
“কিন্তু?”
“কিন্তু তুমি যে আগুনে ঝাপ দিতে যাচ্ছো সে আগুন সামলাতে পাড়বে তো?” রিসা তার মাইক সরিয়ে বলে।
“মানে?”
“মানে যার মন দিচ্ছো সে তো পুরোই আগুন। তোমার সাথে টিকবে না।”
“হোয়াট ডু মিন রিসা?”
“কিছু না। গান শুরু করো।”
জোহান এই মুহূর্তে কথা বাড়ায় না। আবারও গান গাইতে শুরু করে।

অনুষ্ঠান শেষ হবার কথা নাচ দিয়ে। তবে কাপল ডান্স। সকলে কাপল ডান্স শুরু করবে এবং একে একে সঙ্গী পাল্টাবে। অবশেষে নিজের জুটির সাথেই নাচ শেষ করবে। যুবকরা গোল হয়ে দাঁড়ায়। গান শুরু হয়। জোহান মায়াকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল এর পূর্বেই আতিফ তার হাত ধরে নেয়, “উইড ইউ লাইক টু ডান্স?”
মায়া একপলক জোহানের দিকে তাকায়। তার সরু দৃষ্টিতে ক্রোধ স্পষ্ট দেখতে পায়। তাই সেও আতিফের হেসে মাথা নাড়ায়। এই মুহূর্তে তার সব’চে বেশি স্বস্তি লাগছে জোহানের মন পুড়িয়ে, যেমন জোহান তার হৃদয়টাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে তিলে তিলে।

জোহানের দৃষ্টি আটকে থাকে মায়ার দিকে। বিশেষ করে আতিফের হাতে রাখা তার হাতের দিকে। তার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। হাতের রগগুলো ফরফর করছে রাগে। হঠাৎ সে-ও নিজের হাতে এক ছোঁয়া অনুভব করল। সামনে তাকিয়ে দেখল রিসাকে। রিসা বলল, “তোমার দৃষ্টি যার দিকে ছিলো সে তো অন্যকারো সাথে চলে গেল। আমি বাকি রইলাম। চলো একসাথে নাচ করি।”
জোহান বিরক্ত হয়ে তার হাত ধরল। ঠিক মায়ার পাশে যেয়ে দাঁড়াল। মায়াও কপাল কুঁচকে তাকায় তাদের দিকে। জোহানের দৃষ্টি তো তার দিকেই আটকে ছিলো। গান শুরু হলো। স্লো মেলোডি। সুরে সকলে কাপল ডান্স করতে শুরু করে। রিসা জোহানকে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে বলে,
“ওর থেকে দূরে থাকো জোহান, নাহয় পুড়ে যাবে।”

জোহান কপাল কুঁচকে তাকায় রিসার দিকে, “এক্সকিউজ মি?”
“এই ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে থাকতে একটা জিনিস তো শিখেছি। মানুষকে চিনতে। আর কয়দিন ওর সাথে থেকে ওর সম্পর্কে এতটুকু ধারণা তো হয়েছে যে ও ঠিক আগুনের মতো। যা’কে পোড়ালে সে তোমাকে ওই আগুনে ছাই করে দিবে। ও অন্যান্য মেয়েদের মতো নয়, যার সাথে তুমি সম্পর্কে জড়াবে, ছেড়ে দিবে আর সে ভুলে যাবে। তোমাকে নিঃস্ব করে দিবে।”

জোহান তাচ্ছিল্য হাসে, “তোমার আবার অন্যদের চিন্তা কবের থেকে হলো?”
“তোমার চিন্তা তো আমার সবসময়ই হয়। তুমি বুঝতে চাও না কেবল। একচুয়ালি আই এডমায়ার হার। যে তুমি মানুষের সৌন্দর্য দেখে তাকে যাচাই করতে সে তুমি অভিযোগ করছিলে মেকাপ ছাড়া ওকে বেশি সুন্দর দেখায়, তাহলে কেন মেকাপ করে! ওর বুদ্ধি, ওর সাহসীকতার গুণগান শেষ হচ্ছিল না। সে মুহূর্তে আমি বুঝেছি তুমি ওর প্রেমে পড়েছ। বাট ইউ নো হোয়াট জোহান তোমরা শেষমেশ একে অপরের সাথে থাকতে পাড়বে না। তুমি এমন মেয়ের সাথে সুখী থাকবে যে শান্ত, চুপচাপ, যার রাগ নেই আর বুদ্ধি কম। জানো তো মানুষ বদলাতে চায়। বদলায় কিছু সময়ের জন্য কিন্তু তার চরিত্র ও অভ্যাস বদলায় না। আর রইলো মায়ার কথা, ওর সাথে যে আছে তার সাথে ওর যাবে। দেখেই বুঝা যায় সে শান্ত, সৃজনশীল আর গুছানো জীবন তার। তোমার মতো এলোমেলো নয়।”
কথাগুলো জোহানের হৃদয়ে তীব্র আঘাত করলো ।

পার্টনার পরিবর্তন হলো। রিসা চলে গেল পাশে আতিফের কাছে। অন্য পাশের তন্নি জোহানের কাছে এলো। জোহান আনমনে নাচ করছিল। তার নজর ছিলো কেবল মায়ার দিকে। তন্নি বলল, “ওকে পছন্দ করো তাই না?”
“হুঁ?”
“মায়াকে…ওকে পছন্দ করো?”
জোহান উওর দিলো না।
তন্নি বলল, “ও কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে। ওর চোখ পড়তে পাড়ি আমি। আর আমি জানি তুমিও ওকে ভালোবাসো। এর আগে ভয়ানকভাবে ভেঙে গিয়েছিল মায়া। এইবার ওকে কষ্ট পেতে দিও না। এইবার ওর ভালোবাসা থেকে বিশ্বাসই উঠে যাবে।”
জোহান চুপ রইল অনেক সময় তারপর জিজ্ঞেস করল, “আতিফের সাথে ওর কী চলছে?”
“আতিফ ওকে পছন্দ করে। ও আতিফকে না।”
“আর বিয়ের কথাযে বলল?”
“সে তো অন্যকারো সাথে বিয়ে না হলে। বিষয়টা আমি জানতাম না। আশরাফ ক’দিন আগে বলল। মেয়েটা একটা পাগল। মন রাখার জন্য বলে দিয়েছে। অবশ্য কাওকে না পেলে অবশ্যই করতো। মায়া আবার নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করে না। তুমি এর চিন্তা করো না। আমি নিশ্চিত মায়া তোমাকে ভালোবাসে।”
জাহান কথা বাড়াল না। তার মাথা এই মুহূর্তে কাজ করছে না। সে কি করবে তা বুঝতে পাড়ছে না। না সে মায়াকে নিজের করতে পাড়ছে, না তাকে অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পাড়ছে। মন না মস্তিষ্কের লড়াইয়ে সে ভীষণ বিরক্ত।

নাচের শেষ পর্যায়ে মায়া আশরাফের কাছে এলো। তারা কি কথা বলছে যেন! মায়া হাসল মন খুলে। কথা শেষ হতে না হতেই আবারও সময় এলো পার্টনার এক্সচেঞ্জের। আশরাফ মায়াকে গোল ঘুরিয়ে হাত ছেড়ে দিতেই জোহান তার হাত ধরে নিলো। মায়া তাকাল তার দিকে। চোখে চোখ পড়ল। মায়ার হাসিটা মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল। হঠাৎ জোহান এক টান দিলো নিজের দিকে। মায়ার হাত গেল জোহানের কাঁধে। সে চোখ নামিয়ে নেয়।

জোহানের মেজাজ চড়ে গেল। তার দৃষ্টি এতক্ষণ ভরে ছিলো মায়ার দিকেই। সকলের সাথে সে চোখে চোখ রেখে নাচ করেছে। আতিফ ও আশরাফের সাথে হেসেছে পর্যন্ত। অথচ তার দিকে তাকাতেও নারাজ!

বিরক্তি নিয়ে মায়ার কোমড়টা চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো সে। মায়া ভড়কে যায়। সে আশেপাশের লোকদের দিকে তাকায় অস্থির ভঙ্গিতে। তারপর তাকায় জোহানের দিকে, “কী অসভ্যতামি করছ? ভুলে গেছ তুমি কে? না’কি নতুন স্কেন্ডাল করার শখ জেগেছে তোমার।”
“তোমার যেমন শখ জেগেছে আতিফের সাথে ঘোরার। ওর আসার পর তো ওকে ছাড়া তোমাকে দেখাই যায় না।”
“ও আমার সাথে তখন ছিলো যখন আমার সবচেয়ে বেশি কাওকে প্রয়োজন ছিলো। আমার অনেক ভালো বন্ধু। আমার একটাই আফসোস। ওর প্রেমে না পড়ে তোমার প্রেমে পড়েছি।”
কথাটায় যেন গা’য়ে কাঁটা বেঁধে উঠে জোহানের, “ওর প্রেমে না পড়ার আর আমার প্রেমে পড়ার আফসোস হচ্ছে তোমার!”
“এটা তো তুমিও চাও তাই না? তোমার সাথে তো আমার ভবিষ্যত নেই। হতে পারে ও আমার ফিউচার হাসবেন্ড….”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বে জোহান বলে উঠে কঠিন গলায়, “খু’ন করে ফেলব। খবরদার এই কথা মুখেও আনবে না।”
“এত বড় সাহস তোমার? মায়া চৌধুরীকে হুমকি দিচ্ছো? তন্নি আর আশরাফের বিয়ে বলে, নাহলে তোমার অবস্থা খারাপ করে দিতাম। তোমার হয়তো সারাজীবন একা থাকার শখ আছে, আমার নেই। এই একাকিত্বতা আমার সবচেয়ে অপছন্দের। এই একাকিত্বতা দূর করতে বিয়ে তো আমি করবোই। হয়তো ভালোবেসে, নয়তো ভালোবাসাহীনে।”
মায়া নিজেই জোহানকে ছেড়ে ঘুরল। আতিফ একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। মায়া তার হাত ধরবার পূর্বেই জোহান আবারও তাকে একটানে দিলো। তার পিঠ যেয়ে ঠেকল জোহানের বুকে। জোহান পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। তার বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে সাথে সাথে কেঁপে উঠে মায়া। সে বাকরুদ্ধ হয়ে। তার হৃদয়ের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে হঠাৎ করে। জোহান ঝুঁকে তার কাঁধে মাথা রেখে গলায় মুখ গুঁজল। নিশ্বাস আটকে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিলো, এতটুকুই। তবুও জোহান থামল না। সে মৃদুস্বরে বলে, “আর যদি বলি তোমাকে অন্যকারো সাথে আমার সহ্য হয় না তাহলে? অন্যকেউ তোমার চোখে ডুববে, তোমার ঘ্রাণে মাতোয়ারা হবে, তোমার ঠোঁটের স্বাদ নিবে ভাবতেই ঈর্ষায় আমি জ্বলে যাই যে মায়া।”

মায়ার বহু কষ্টে নিশ্বাস ফেলছে। সে যেন পাড়ছে না। তার উচিত এই মুহূর্তে জোহানকে কষিয়ে এক চড় মারা
সকলের সামনে সে এই তামাশা কেন করছে? কিন্তু সে কিছুতেই বিরোধিতা করতে পাড়লো না। তার গলায় এসে লাগা জোহানের উষ্ণ নিশ্বাস তাকে অবশ করে দিচ্ছে। সে সাথে সাথে জোহানের দিকে ফিরে আদুরে চোখে তাকায় জোহানের দিকে, “তাহলে নিজের সাথে সাথে আমাকেও এত কষ্ট দিচ্ছো কেন তুমি?”

জোহান একপলক তাকাল আতিফের দিকে। ঠিক তার চোখে। সে যেন জানান দিলো। মায়া তার। কেবল তারই।

জোহান এক ঢোক গিলল। মায়ার নীলাভ কাজলে মাখা দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে মাতালো স্বরে জানাল, “তোমাকে আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। আজ দৃষ্টি নামিও না। তোমার চোখদুটোয় ডুব দিতে ইচ্ছে করছে।” বলে বাহুতে হাত রাখতে গেলে মায়া তার হাত ধরে নেয়। এইবার সে চোখ সরায় না। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলে, “তাহলে সারাজীবন এই চোখে ডুবতে চাও না কেন?”
“জীবন তো অনেক লম্বা মায়া। জীবনে কখন, কোথায় মন ফিরে যায় তা আমরা কীভাবে জানব?”
কথাটা শুনে তাচ্ছিল্য হাসে মায়া, “অন্য কাওকে মন অর্পণ করলে মন ফেরানোর প্রশ্নই আসে না। কই আমার তো একটিবারও এই ভাবনাগুলো আসলো না।”
“অন্য জায়গায় প্রাইভেটে যেয়ে কথা বলি আসো।”
জোহান এইবার মায়ার হাত ধরে তাকে একপাশে নিয়ে যেতে লাগল। মায়া বিড়বিড় করে বলে, “ঢঙে বাঁচি না। এতক্ষণ সবার সামনে জড়াজড়ি করে এখন তার প্রাইভেট প্লেস লাগবে।” তারপর রুমের এককোণে যেয়ে তাকে থামিয়ে বলল,”এখানেই বলো।”
“বিয়েই কি সব মায়া?”
“বিয়ে না করতে চাইলে করবে না। না করলে এত কাছে আসো কোন অধিকারে? এই অধিকার কেবল আমার হবু স্বামীর।”
জোহান তার দুইবাহু ধরে অস্থির ভঙ্গিতে বলল, “বিয়ে ছাড়াও তো জীবন কাটানো যায় তাই না? বিয়েই তো সব না। আমার বাবা মা’য়ের বিয়ের পর সম্পর্ক আমি দেখেছি। খুব খারাপ সম্পর্ক দেখেছি। সারাজীবন একসাথে থাকতে থাকতে মন বিষিয়ে যায়।”
“এটা তোমার মনে হয়। তাহলে কোটি কোটি মানুষ বিয়ে করে নিজের মন বিষিয়ে দেবার জন্য? তোমার পরিচিত সভ্য ইনারা ওদের সম্পর্কই দেখো। কত সুন্দর! ওদের মা বাবা, দাদা দাদী তাদের সম্পর্ক কত সুন্দর। তন্নির মা বাবাকে দেখেছ? তাদের লাভ ম্যারেজ ছিলো। আজও যেন একইভাবে ভালোবাসে। বিয়ের সম্পর্ক বেঠিক হয় না, কেবল মানুষটাই বেঠিক হতে পারে।”
“আমিও তো সঠিক মানুষ না মায়া। দিনশেষে আমার বাবার রক্তই আমার মাঝে আছে।”

মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যে মানুষ বুঝতে চায় তাকে বুঝানো যায়। যে বুঝতে চায় না তাকে কীভাবে বুঝাবে?
“তোমার ভালো মন্দ সব জানার পরই তোমাকে পছন্দ করেছি আমি জোহান। তুমি ঠিক কি চাও আমি বুঝতে পাড়ছি না। নিজে কমিটমেন্ট দিতে নারাজ, আর অন্যকারো সাথে দেখলে পাগলামো করো। আমি আগেই ক্লিয়ার করেছি কোনো নামহীন সম্পর্কে থাকতে পাড়ব না।”
থেমে আবারও মায়া বলল,
“মায়া চৌধুরী কাওকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। কিন্তু তোমার কাছে আমার মনটা একটু বেশিই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে একসাপ্তাহ দিলাম, হয়তো আমাকে একেবারে অধিকারসহ আপন করবে, নয়তো আমার আশেপাশেও ঠেকবে না।” সে কথাটা বলে জাহানের কাছে যায় এককদম। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বলে, “এক সাপ্তাহ কিন্তু কম নয় জোহান। এক সেকেন্ডও ছাড়বে না। এখন থেকে ভাবতে শুরু করো সারাজীবন আমার সাথে থাকতে চাও কি-না। যদি আমার ভাবাতে হয় তাহলে তোমার অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।” বলে তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। অন্যদিকে ফিরতেই চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে। তার বুক কাঁপছে এখনো। এই ছেলেটার চোখে কিছু একটা আছে, তার চোখে তাকাতেই তার শরীরে ঝিম ধরে যায়।

তার যাবার পর আতিফ এলো মায়ার কাছে। তাকে দেখে মনে হলো সে কিছু প্রশ্ন করতে চায়। কিন্তু করল না। মায়া খেয়াল করল অনেক লোকেই তার দিকে বারবার দৃষ্টি দিচ্ছে। নিশ্চয়ই জোহানের কান্ডকারখানায়। কিন্তু এই জোহান গেল কই? তার দেখা আর পেল না।
.
.
৮ ই মার্চ, নারীদিবস উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে ইন্টারভিউ এর। চার নারীকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। অভিনেত্রী তনু, দেশের প্রথম নারী এভারেস্ট অভিযানকারী রিধি, বিজনেসওম্যান মায়া, আর প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বউ মেঘলা।

সুরভী ভীষণ ঘাবড়ে আছে। সে ব্যাক স্টেজে কাজ করছে ঠিকই কিন্তু তার আজ সেদিকে খেয়াল নেই। এ বুদ্ধিটা তার ছিল। তাই সে চায় না তার বুদ্ধির কারণে মায়া বা মেঘলার কোনো সমস্যা হোক। সে অভ্রকে মেসেজ করল, “সবাই এসেছে। মায়াই বা’কি।”
“রাস্তায় আছে। আসছে।”
মেসেজটা আসার পর সাথে সাথে আরেকটা মেসেজ আসে, “আমার জান সোনাপাখিটা এত ঘাবড়িও না। সব ঠিক হবে। আমি ওখানে নেই। কিন্তু সকলের চোখের আড়ালে আমার প্রটেকশন ঠিকই আছে। তুমি স্বাভাবিক থাকো। একবার সন্দেহ হলে সব পরিকল্পনা যাবে।”
সুরভি হাসল এবার। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তারপর ফটাফট মেসেজ ডিলিট করল। অভ্র তাকে অন্য নাম্বার দিয়েছে যেটা তার নামে রেজিষ্ট্রেশন করা না। তারা তৌফিকের ব্যাপারের সব কথা এই নাম্বারেই বলে।

মেঘলা আসার পর থেকে সকলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কয়েকজন তো হা করেই তাকিয়ে আছে। তার অস্বস্তি লাগছিল ভীষণ। একসময় এটা তার জন্য ভীষণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন আর সে আগের মতো স্বাধীন পাখি নেই, খাঁচা বন্দী পোষা পাখি। বছরে এক /দুই বার কেবল আর মানুষের মধ্যে যাওয়া হয়। নাহয় তাকে সারাটা দিন সে চার দেয়ালের মাঝেই কাটাতে হয়। তনু, রিধি, সাথে ইন্টারভিউয়ার আরও কয়েকজন তার সাথে কথা বলতে চাইল কিছু সে আওড়াল। তার অস্বস্তি লাগছে ভীষণ। অনেকে ভাবছে তার ভাব বেশি। প্রধানমন্ত্রীর ঘরের বউ বলে কথা। কিন্তু তারা তো জানে না, সে প্রতিটা মুহূর্ত কী নরকে কাটায়। প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ে, আতঙ্কে কাটে তার। তার কেবল এই দেহটারই অস্তিত্ব আছে। আত্নাটা তো সে কবে ম’রে গেছে।

তিনজনে চেয়ারে বসে ছিলো। ইন্টারভিউর সময় হয়ে গেছে। সবাই মায়ার অপেক্ষায়। ইন্টারভিউ শুরু হবার ঠিক এক মিনিট পূর্বে সে এসে পৌঁছাল। লাল রঙের স্যুট, সাদা রঙের শার্ট, হাতে ও কানে সিলভার জুয়েলারি, লাল রঙের হাই হিল। সে ঢুকতেই সকলের দৃষ্টি তার দিকে আটকাল। আত্নবিশ্বাসের সাথে সে হেঁটে এসে বসল খালি চেয়ারটাতে। মেঘলার পাশে। ইন্টারভিউ নেওয়া মেয়েটার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “ঠিক সময়ে এসেছি তো?”
তার এমন দৃঢ় এক প্রশ্নের ধরণেই মেয়েটি বুঝল এর সাথে লাগা যাবে না। কোনো উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করা তো দূরের কথা।

তনু ও রিধিও এক দুইটা বাক্য বলল পরিচয়ের জন্য । মায়া দারুণভাবে তাদের সাথে কথা বলল। মেঘলা তার সাথে কথা বলল না। কিন্তু তার আত্নবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হলো। সে-ও একসময় এমন হতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর চোখ সরিয়ে নিলো। শুরু হলো ইন্টারভিউ।
.
.
তৌফিক সোফায় বসে পা’য়ে পা তুলল। সুমন দ্রুত তার হাতে একটি ম’দের গ্লাস তুলে দিয়ে ইশারা পেয়ে টিভি ছাড়ল। জিজ্ঞেস করল ভারী গলায়,
“রিয়াদের সাথে কথা বলেছিস?”
“বলেছি ভাই। ও বলল ম্যাডাম না’কি তেমন কথা বলছে না। চুপচাপই আছে। টেনশন নেই।”
তৌফিক ভ্রু কুঁচকে চাইল সুমনের দিকে। পাশের রিমোট তার দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল, “গাঁধার বাচ্চা তুই গাঁধাই থেকে যাবি। ওকে তো সেখানে পাঠিয়েছি কথা বলে আমার গুণগান গাওয়ার জন্য। কথা না বললে ওখানে পাঠিয়ে লাভ হবে কী আমার? ওই চ্যানেল লাগা শালা।” তারপর এক বিচ্ছিরি গালি দিলো।

সুমন কিছুই বলল না। চুপচাপ আদেশ মানল।

তৌফিক টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলো। ইন্টারভিউয়ার একটি প্রশ্ন করায় সকলে উওর দিচ্ছিল। মেঘলা তেমন উওর দিলো না। ছোট করে কিছু বলল। তৌফিকের রাগে মাথা টনটন করে উঠে। সে বিরক্তি ভঙ্গিতে ম’দের গ্লাসটা মুখের কাছে নিতে যাবে আর টিভির স্ক্রিনে একটি মেয়েকে দেখতে পায়। ফর্সা শরীরের রঙ, বড় বড় চোখ, লাল লিপ্সটিক পড়া ফোলা ঠোঁটের। সাদা শার্ট ও লাল স্যুট পরা মেয়েটি। চুল কাঁধ পর্যন্ত এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তৌফিক তাকে দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। ঢোক গেলল একটা। হাতের মদের গ্লাস হাওয়ায় ধরল। ছেড়ে দিলো। মেঝেতে পড়ার আগেই সুমন দৌড়ে এসে তা ধরে নিলো।

স্ক্রিনে নাম আসলে তৌফিক বিড়বিড়াল, “মায়া… পার্ফেক্ট নাম।”
সে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তার সৌন্দর্য দেখে যত না মুগ্ধ হলো তার কথা-বার্তার সৃজনশীলতা, তার এটাটিউড আর বুদ্ধিমত্তা দেখে এরচেয়ে বেশি আকর্ষিত হলো। সে আদেশের সুরে সুমনকে বলল, “গাড়ি বের করতে বল। স্টুডিওতে যাব। বউকে না দেখে থাকা যাচ্ছে না। ওর মনে হয় আমার সাপোর্ট দরকার।”
সুমন আগেই তৈরি ছিলো। ম’দের নেশা তৌফিক ছেড়েছে মানে তাকে নারীর নেশায় ধরেছে।
.
.
ইন্টারভিউ এর মাঝে ব্রেক নেওয়া হলো। সুরভি আসে মেঘলার সাথে কথা বলতে। আসার পর কাজের চাপে তার কথা বলা হয় নি।
“কেমন আছেন আপু?”
মেঘলা মেয়েলী কন্ঠ শুনে সামনে তাকায়। মুহূর্তে তার মলিন মুখটা জ্বলজ্বল করতে শুরু করে খুশিতে সুরভিকে দেখতে পেয়ে। সে উঠে উওর দেবার জন্য। কিন্তু এর পূর্বেই রিয়াদ এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। তাকে দেখে মেঘলা আর কিছু বলতে পাড়ে না। আবারও চুপচাপ বসে পড়ে নিজের চেয়ারে।

রিয়াদ প্রশ্ন করে সুরভিকে, “কিছু প্রয়োজন?”
“না আসলে ম্যামকে অসুস্থ লাগছিল তাই কোল্ড কফি নিয়ে আসলাম।” বলে কফিটা এগিয়ে দিতে নিলে রিয়াদ বাঁধা দেয় আর সম্পূর্ণ কফির গ্লাস উল্টে পড়ে মেঘলার উপর। সাথে সাথে মেঘলা দাঁড়িয়ে পড়ে। শাড়ি থেকে কফি ঝারার চেষ্টা করে। যতটুকু পারে। মুহূর্তে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। রিয়াদ উচ্চবাক্যে প্রশ্ন করে, “চোখ নেই? এটা কী করলেন?”
সুরভিও কপাল কুঁচকে একইভঙ্গিতে বলে, “আমি তো দিচ্ছিলাম উনাকে আপনি হাত আনলেন কেন মাঝে?”
সুরভি এমনিতেই কফিটা মেঘলার উপর ফালাতো। কিন্তু রিয়াদ মাঝে তার দোষটা ভাগাভাগি হয়ে গেল। তবে তার ম্যানেজারসহ সব সিনিয়রদের কাছে তারই বকা সহ্য করতে হবে। যত চাই হোক প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বউ বলে কথা। তাকে এতে ছাড় দেওয়া হবে না।

তাই হলো। মুহূর্তের মাঝে লোকজন জড়ো হলো তাকে বকার জন্য। কিন্তু মেঘলার তা সহ্য হলো না। তার প্রিয় বন্ধুর প্রাণ এই মেয়ের মধ্যে আটকা পড়া। এছাড়া তার মেয়েটার প্রতি মায়া হয়। আগে যখন অভ্র নক্ষত্র সেজে সুরভির সাথে ফোনে আলাপ করতো তখন সে কতই না মজা নিতো। মেয়েটার সরল সহজ ভাব তার মনে ধরেছিল। বোকাও ছিলো। অভ্রর প্রেমের আভাসটাও পেল না। কিন্তু মেয়েটাকেই তার অভ্রর জন্য ভালো লাগলো ভীষণ পরিমাণে। অভ্র ও গগণ সবসময়ই তার রক্ষা করেছে। গগণ প্রেমিকের মতো আর অভ্র ভাইয়ের মতো। তার আপন ছোট ভাই থাকা থেকে না থাকাটাই ভালো। সে কেবল অভ্রকেই তার ভাই মানে। আপন ভাই। রক্তের সম্পর্ক নেই তো কি হয়েছে? তার সেই প্রিয় ভাইয়ের জান যে মেয়ের মাঝে তাকে কষ্ট পেতে সে কীভাবে দেখে? তাই সে এই প্রথম জোরগলায় বলল,
“হয়েছে। এখানে এত বড় কিছু হয় নি যে ওকে এত বকতে হবে। শাড়িটা গাঢ় কালার তাই কিছু বুঝা যাবে না।”

সুরভি সুযোগের সৎ ব্যবহার করল, “আসেন ম্যাম আপনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাই।”
মেঘলা এগোল কিন্তু রিয়াদ সুরভিকে সাথে এতে দিলো না। অন্য ছেলে নিয়ে লেডিস ওয়াশরুম দেখে এলো। পিছনে গেল গার্ডরাও। মেঘলা ভেতরে ঢুকলো। রিয়াদরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো পাহারা দিতে।

পিছনে এলো মায়া। সে ওয়াশরুমে ঢুকতে নিবে আর রিয়াদ বাঁধা দিলো, “ম্যাম ভেতরে আছে।”
“তো?”
মায়া চোখ গরম করে তাকাল। আবার বলল, “আপনার ম্যাম শাড়ি পরিষ্কার করছে। আপনাদের কান্ডে আমারও স্যুটে কফি পড়েছে। আমারও পরিষ্কার করা প্রয়োজন। রাস্তা ছাড়ুন।”
এমন কন্ঠিন কন্ঠে সে দমে যেয়ে সরে দাঁড়াল। কিন্তু দরজা খোলার পর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তা দেখে মায়া বলল,”আপনি লেডিস? লেডিস ওয়াশরুমে যাবেন?”
রিয়াদ সাথে সাথে থতমত খেয়ে সরে দাঁড়াল।

মায়া ভেতরে ঢুকে দেখে মেঘলা শাড়ি পানি দিয়ে পরিষ্কার করছে। সে-ও মেঘলার পাশে দাঁড়িয়ে বেসিন ছাড়ল। যেন তাদের কথা শব্দ বাহিরে না যায়। মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি মায়া। তোমার সাথে কথা আছে।”
মেঘলা তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। উওর দিলো না।
“তৌফিককে নিয়ে।” মায়ার কথা সে শুনল কিন্তু ঘাবড়ে গেল তৌফিকের নামে। মুহূর্তে কাঁচুমাচু হয়ে গেল। সে বলল, “আমার শরীর ভালো লাগছে না। পরে কথা বলব।” বলে সে যেতে নিলে মায়া তার কণুই ধরে সাথে সাথেই বলে দেয়, “অভ্র আমাকে পাঠিয়েছে।”
মেঘলা অভ্রর নাম শুনে শান্ত হয়। মায়া যে হাতের কণুইয়ে তাকে ধরেছিল সেখানে তৌফিক সিগারেট দিয়ে গতকাল রাতেই জ্বা’লিয়েছে। ফুল স্লিফ পরায় কিছুই বুঝা যায় না। কিন্তু অভ্রর নাম শুনে সে ব্যাথাটুকু ভুলে গেল। ঠোঁটে হাসি আঁকল চোখে পানি নিয়ে। তাকাল মায়ার দিকে, “অভ্র? কেমন আছে ও? সুরভিকে জিজ্ঞেস করার সময় পেলাম না।”
মায়া খুব গভীর গলায় বলে, “বেশি সময় হাতে নেই। তাই সরাসরি বলি, অভ্র আমাকে পাঠিয়েছে কথা জিজ্ঞেস করার জন্য। তৌফিক কি প্রতি বুধবার নাসরিন নিবাসে যায়?”
কথাটি শুনে মেঘলার উপর যেন বজ্রপাত পড়ল এমন ভাব করল। সে চোখ বড় বড় করে কাঁপতে শুরু করে। চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। মায়ার তার জন্য খারাপ লাগলো ভীষণ। মেয়েটা তার বয়সী হবে বা একটু বড়। এই বয়সেই তার কী অবস্থা! এইটুকু প্রশ্ন শুনে কাঁপা শুরু করে দিয়েছে। তাহলে নিশ্চয়ই কোনো বড়সড় ট্রমায় আছে মেয়েটি। কেমন অত্যাচা’র হলে সে এতটা ভীত হতে পারে?

মায়া এবার তার স্বভাব নম্র করল। যে কাজটা সে কখনো করে না তা করল। অচেনা এক মানুষকে জড়িয়ে ধরা। সে মেঘলাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আদুরে স্বরে বলল, “অভ্র বলেছে তোমার অতীত। আমি জানি অনেক কাছের একজন মানুষ হারিয়ে গেছে তোমার কাছ থেকে কিন্তু অভ্র নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করছে তোমাকে মুক্তি দেবার। চিন্তা করো না তুমি জলদিই ছাড়া পাবে। ফিরে যাবে তোমার বন্ধু, তোমার পরিবারের কাছে।”
মেঘলা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,”সে পরিবারই আমাকে
বিক্রি করেছে। ফেরার জায়গা নেই।”
মায়া চমকাল। দেবার মতো উওর পেল না বেশ খানিক্ষণ। এই কষ্টটা সে কিছুটা হলেও বুঝে। তার পরিবারের কাছেও তো সে মূল্যহীন।

সে মেঘলাকে ছেড়ে তার দিকে তাকাল। বলল, “নিজের জায়গা নিজে করে নিতে হয় এই পৃথিবীতে।”
মেঘলা চোখ নামিয়ে রাখল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “সে সময় চলে গেছে অনেক আগেই সাথে আমার ইচ্ছাটাও। এখন এই নরকে মানিয়ে নেওয়া শিখে গেছি।” গভীর নিশ্বাস ফেলে মেঘলা। থেমে আবার তাকায় মায়ার দিকে, “কিন্তু আমি চাই না অন্যকোনো মেয়ে এই নরকে থাকুক। তাদের পরিবার অন্তত তাদের অপেক্ষায় আছে।”
মায়া কথাটা ধরতে পাড়ল না, “মানে?”
মেঘলা কেঁপে উঠে আবারও। যেয়ে বেসিনের কাছে দাঁড়ায় বর্ডার ধরে। তার শরীর এখনো কাঁপছে। সে হঠাৎ তীব্রভাবে কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নিলো। বলল, “নাসরিন নিবাস তৌফিকের মৃ’ত মা’য়ের ছিলো। সেখানে সে মেয়ে এনে রাখে। বুধ থেকে শুক্র সবাইকে ছুটি নেয়। তখন সেখানে যেয়ে মেয়েগুলোকে ভোগ করে। তাদের উপর অত্যাচার করে। লোকটা পশুর থেকে অধম। যন্ত্রণায় মেয়েদের চিৎকার শুনতে না’কি তার ভালো লাগে। দেখো…” মেঘলা তার একটা হাতার স্লিভ কণুই পর্যন্ত মুড়িয়ে দেখাল। দেখেই আত্না কেঁপে উঠে মায়ার। এতটুকু স্থানে এতগুলো আঘাত দেখে তার শক্ত মনটাও কেঁপে উঠে। কোথাও কালো হয়ে আছে আবার পাশে চামড়া এমনকি মাং’সও উঠানো, আবার পো’ড়ার দাগ। মায়া আতঙ্কে চোখ সরিয়ে নিলো।

কাওকে নিজের আঘাত দেখাতে পেরে কেমন কান্না আসছে মেঘলার। তার মনের কথা এত বছরে সে কাওকে বলছে তাও এক অচেনা মেয়েকে! এতে তার হৃদয়ের ব্যাথা কি একাংশ কমলো? তবে তার চোখ দিয়ে পানি এইবার বয়েই পড়ল, “নিজের স্ত্রীর এই অবস্থা করলে সে মেয়েগুলোর কথা ভাবো। প্রতিবার সেখান থেকে এসে আমাকে বলে কাকে কীভাবে ছুঁয়েছিল, ব্যাথা দিয়েছিল, মেরেছিল! কী জঘন্য! এমনকি কয়েকজন তো সহ্য করতে না পেরে ম’রেই যায়। যারা বেঁচে থাকে তাদের নিজের চাহিদা শেষে বিক্রি করে দেয় অন্য দেখে।”
“নারী পাচারের ব্যবসা করে?” মায়ার প্রশ্ন।
“নাহলে এত টাকা আসে কোথা থেকে? ওর বাবা দুর্নীতি করে না এত। কম করে। যে এত টাকা থাকবে। ওই এসব করে নারী পাচার ব্যবসা, মা’দক ব্যবসা, ই’ললিগার ওয়ে’পান বাহির থেকে দেশে ঢুকানো আরও কত কি!”
মায়ার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজেকে সংযত করল। শান্ত বলা হয় মেঘলাকে বলল, “অনেক সময় হয়ে গেছে আমরা এখানে আছি। মুখ ধুঁয়ে জলদি বাইরে যাও। কান্না করবে না। যেন কেউ সন্দেহ না করে। তুমি বের হও আমি পিছনে আসছি।”

মেঘলার বের হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। কিন্তু না হয় বের হয়েও উপায় নেই। তৌফিকের লোকেরা বাহিরে দাঁড়ানো আছে। তাই সে মুখ ধুঁয়ে নিজেকে শান্ত করে বের হতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু দরজা খুলে বের হতেই তৌফিককে দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। চোখেমুখে আতঙ্ক ভেসে উঠে। তার কোমল হৃদয়খানা এতটা কেঁপে উঠে যেন এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। যদি মায়ার সাথে কথাগুলো তৌফিক শুনে তাহলে আজ তাকে মৃ’ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিয়েই ছাড়বে।

চলবে….